| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

পাতার মানবী

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
আছে গৃহ এবং তার বৃত্তের ক্রমবর্ধমান পরিধিতে আছে বৃহৎ সংসার, পৃথিবী, প্রকৃতি। 
বাঁশফুল ও এই সব নির্জনতা নামে প্রকাশিত একটিমাত্র কবিতার বই থেকে বেছে ও তার সঙ্গে অপ্রকাশিত অন্যান্যসহ মণীন্দ্র গুপ্ত বের করেন তাঁর মৃত্যুর পরে ‘পাতার মানবী’ । পাঠক বললেন, তবু ভরিল না চিত্ত। অতঃপর তাঁর পরিবারের একজন কবি, সম্পাদক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক মণীন্দ্র গুপ্তের বিশ্লেষণ জরুরি ছিল কবিতার পাঠকের জন্য। কিন্তু যিনি বহু অখ্যাত পুরুষ কবিকে আলো দিয়েছিলেন, তিনি শ্যালিকার পারিবারিক ছোঁওয়া বাঁচিয়ে বিশুদ্ধ সমালোচনার তাত্ত্বিক নৈতিকতাকে কিছুটা যেন স্বেচ্ছায় সরিয়ে রাখলেন, পাশ ফিরে থাকার মতো করে তিনি ২০১০ এ প্রকাশিত ‘দ্রাক্ষাপুঞ্জ,শুঁড়ি ও মাতাল’ বইটিতে তাঁর ছেলেমানুষের মতো বাড়িয়ে দেওয়া রঙ্গরসিক হাতটি এগিয়ে দিলেন। সে হাতে উঠলো মধুমেহাক্রান্ত প্রৌঢ়যাপন, যা স্নেহমদিরায় লগ্ন, তবু সংসারের ঘোমটা ছিঁড়ে কবির লুকানো অমা দেখানো হল না। কবিতার সমালোচনা হয়ে গেল জন্মকাঙাল মেয়েটির পরিত্যক্ত গহনার মতো, বঙ্কিম কপালকুণ্ডলার মধ্যে দিয়ে যাকে এনেছিলেন বাংলা উপন্যাসে। অপরিচিত ভিক্ষুকের হাতে তার পরা গহনা খুলে দিয়ে তবে তার শান্তি । কিন্তু প্রায় অপঠিত, অনাবিষ্কৃত এই কবির লেখা বামনের ফুসফুসের মতো আমাদের গতানুগতিক পুরুষের পার্সপেক্টিভ থেকে উদ্ধার করে, বুঝিয়ে দেয় “সৃষ্টির অ “কাকে বলে। কাকে বলে “অভ্র- আগুন-মেঝের তলায় “তৈরি হওয়া “মহাজাগতিক ঘাস”। সেই কসমিক আত্ম-প্রক্ষেপের কোল আঁচল বাঁধা আছে পৃথিবীর ক্ষীয়মান স্মৃতি বিস্মৃতিতে, আর ঐ প্রান্তর অনিরূপিত জন্মগত অরণ্যের ব্যাসার্ধ। যেমন এখানে, আমাকে অর্ধেক এঁকে আমার মা হঠাৎ চলে গেলেন গভীর বনে।
সবুজ গাছে ডুবে ডুবে
তিনি খুব স্নান করলেন…।
 
তারপর তিনি ফিরে এলেন ইজেলের কাছে
আমার বাকি অর্ধেক শেষ করে দিলেন দ্রুত টানে।
সাদা ক্যানভাসের পর্দা দুলিয়ে
ঢুকে এল কালোসবুজ অরণ্যমানবী।
কবিতাটির মধ্যবর্তী প্রাণের গুম্ফায় তবে কি সেই স্বাধীনতার কথা লেখা আছে- যা পড়েছি দেবেশ রায় সম্পাদিত ‘রক্তমণির হারে’ সংকলনের রবি সেনের আখ্যানে? উদভ্রান্তের অপরাজেয় একটি সত্তা এখানেও কবির কথনে মিশে আছে, ঠিক যেমন রবি সেন লিখেছেনঃ
“গোলার্ধের সবচেয়ে বড় খাঁচা বানাবে… খাঁচায় প্যারীকমিউনের সব ডানাভাঙা পাখিদের পুরবে…”
কবি বললেন, না। “আমি হব না মোম/ আমায় জ্বালিয়ে ঘরে তুমি লিখবে না।” কবিতা সিংহের প্রতিবাদী স্বর নয়, এখানে তাঁর কলম মেয়েলি জগতের বাইরে চতুর্থ কোনো গোলোকের। এ কবির ভাষ্য
শুরু থেকেই ভিন্ন। এ এক অপ্রাকৃত নারীত্বের আবিষ্কার, তাই ক্রিয়াবাচক অভিপ্রায় আলাদা, যেমন

ভূপৃষ্ঠ খুলতে খুলতে- বলামাত্র চামড়া, তারপর পোশাক, তারপর অন্যের ত্বক ক্রমশ আমারই অভ্যন্তরস্থ দশ দিক ১৪ দুয়ার এ সিঁধ দেয়। আমি আমার ই চোখ ঠোঁট গ্রীবার স্ক্রু খুলতে থাকি। এরকম ভাবে আমার অগোচর আমার অহং আমারই ছুরিতে কেটেকুটে বেরিয়ে আসে ধ্বংসের অমোঘ ধ্বংস। কেবল “স্বপ্নকুহেলিকাময়” বললেই তার পরিধির বহু স্তর বিশিষ্ট অনুপুঙ্খ বিচার হয় না মনে হয়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


 
পাতার মানবী বইটির প্রকাশক কবি ও প্রাবন্ধিক দেবারতি মিত্র লিখলেন এক অনবদ্য ভূমিকা। এ কেবল অগ্রজের স্বস্তয়ন নয়, বরং বাংলা কবিতার আবহমান কালের হাতে তিনি সহোদরার গূঢ় কাহিনি তৈরি করলেন নতুন পরিচয়ে। “মৃত্যুকে তার কখনো মনে হয়েছে মামার বাড়ির খেলনার আলমারিতে সাজ পোশাক পরা পরসেলিনের পুরনো পরী যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে এক-একটি উজ্জ্বল তারার মাথায় ।তার
জন্মের আগে গভীর বনের মধ্যে সবুজ গাছে ডুবে ডুবে স্নান করেছিলেন মা। সে একেবারে সৃষ্টির ‘অ’ এ চলে যেতে চেয়েছিল।” কবিতাটির আগাগোড়াই তুলে দেওয়া হল:
 
গোল গোল আসত কাঁচের বয়ামে
তুলি ডুবিয়ে একজনের সে
আমাকে আঁকতে লাগল।
 
সূক্ষ্ম রুপোলি সীমোফেন মণির মতো
ধক করে উঠল প্রথমেই আমার চোখ।
আমি তিনলোক কাঁপিয়ে চিৎকার করলামঃ
চোখের জায়গায় তুলি ঘষে
কালো রঙের অন্ধকার নামাও।
 
আমি সৃষ্টির ‘অ ‘ এ চলে যেতে চাই ।
 
এখানে মায়া বা মতিভ্রম কোনটাই নেই। এখানে মানে? চিমটি কেটে দেখুন তো বেঁচে আছেন কিনা।
কবিতাটির কোনো স্থানকালপাত্র নেই। নেই সময় সংকেত বা কবির নিজের সম্পর্কে গঠিত গল্প। বার্গম্যানের ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ সিনেমায় যখন রাস্তায় কফিনবন্দি সে দেখছে নিজেরই মুখ, এ তারও
আগের পৃষ্ঠার। এ পিঠে অমাবস্যা। গোল কাঁচের বয়াম একটি তিরোহিত কালের সংকেত, গোল গোল অর্থাৎ মৃত্যুবৃত্ত।ফুরোনো ও না -ফুরানোর মালা, তারই পাশে আতশ শব্দটি মাতৃজঠর, আবার আত্মজন্ম, জাতকের বৃত্ত, এক ও বহু। ত্রিকালজ্ঞের এ অঙ্ক তাই ৩ ছত্রের। “আমাকে আঁকতে লাগল”
কে? এর উত্তর আছে। দ্বিতীয় লাইনে বললেন, সে। তিন স্তবক। প্রথম ৩ লাইনে গর্ভ আঁকা হল ।দ্বিতীয় স্তবক ৫ ছত্রের। তিনলোকের বিস্তার স্পষ্ট হল। তার মানে জন্ম আয়ু মৃত্যু। চোখের মণি জ্বলে

উঠল চিৎকারে। আর তখন ই জন্ম নিল অন্ধকার। আদিনাদ থেকে এল আলো, এল চেতনা- যা অজানার, অন্ধকারের। তা বহু কোটি যুগান্তর পেরিয়ে আসা প্রথম অ, যার আর কোনো দ্বিতীয় আরম্ভ নেই। অ,অর্থাৎ যা বিনা, যা নাস্তি, যা রহিত। আমি যে নেই, এই ই আমার প্রজ্ঞা, এই আমার অস্তিত্ব।না এর কাফন সরিয়ে আমি মুখ দেখলাম, কোন সে মাছের পেটের নাড়ীর ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা এক বীজের কথা দিয়ে এই শুরু।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


১৯৫৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। মৃত্যু ১৯৯৬। নিজের কিশোরীবেলার উপকথা থেকে জুড়ে দিয়ে তৈরি করেছেন নতুন কাব্য-ভাষা, যা সুররিয়াল কে নামিয়ে এনেছে কাঠঠোকরার শিল্পে। নাগরিক চিহ্ন ধরে তাঁর রথের চাকা এগিয়েছে রং আর প্রাকৃতিক শব্দযৌগ নিয়ে,ত্রিলোক অবধি।অরণ্যমেয়ের যমজ তাঁর কলমের দোসর। এই তিন জন্মের উন্মীলন কবির প্রারব্ধ। এদিক থেকে এই নিসর্গ ভূগোলের নজরটান দিয়ে তাঁকে পাঠ করা দরকার। দেবারতি মিত্র বা মণীন্দ্র গুপ্ত র লেখার সঙ্গে কোনো মিল নেই।সময় বলতে তিনি কি বোঝেন? বলা বাহুল্য প্রথাগত প্রশ্ন দিয়ে এঁকে বোঝা কঠিন। পরাবাস্তবকে নিয়ে, আকাশ, নভোমণ্ডল ও প্রাণীলোক নিয়ে তিনি পিকারেস্ক ন্যারেটিভ রচনা করলেন। শুরু নেই, শেষ ও নেই তার। তাই তিন সংখ্যার প্রাধান্য।এর সঙ্গে আশাকরি কেউ সম্প্রদায়ভুক্ত অনুশাসন গুলিয়ে ফেলবেন না। গ্রীক ট্র্যাজেডির মৌল ধারণায় এই তিনলোকের নানা বিবরণ পাই আমরা, আমাদের বাংলা ভাষার উপকথা, রূপকথা, সর্বত্র তার স্বভাব বিচরণ।শস্যের যে বাড়িতে তাঁর আঁতুড়, সে তো গাছেদের “গভীর ভেতরে”, সাদা ঝাউ কুঁড়িদের ঘরে। সেই ঘরের জন্য তিনি ঘুরে যান এক থেকে আর নিটশে, চমস্কি, বাক্তে, লাকঁ জানা বাঙালি সে কবিতাকে সত্যি কি করে গ্রহণ করবে এর মীমাংসা নির্ণয় করা মুস্কিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত