| 20 এপ্রিল 2024
Categories
সঙ্গীত

লোকসংগীত ভাওয়াইয়ায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ । সুশান্ত কুমার রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

সংগীতই জ্ঞান। চৌষট্টি প্রকার কলাবিদ্যার মধ্যে সংগীতের স্থান সবার শীর্ষে। লোকসংগীতের অমীয় সাগরে প্রাণবন্ত ও প্র্রবহমান একটি ধারা ভাওয়াইয়া, যা আজও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল তথা রংপুর-দিনাজপুর-লালমনিরহাট-কুড়িগ্রাম এবং ভারতের কোচবিহার, আসাম, জলপাইগুড়ি জেলার বৃহৎ এক জনগোষ্ঠীর অন্তরের গান। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যমলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ রূপ ঐশ্বর্য আর এ অঞ্চলের মানুষের সহজ সরল জীবন যাত্রার নানা অনুষঙ্গ বাঙালি জাতিকে করে তুলেছে সংগীত প্রবণ। সংগীত গবেষকদের মতে ভারতবর্ষে বৈদিক যুগে সংগীত চর্চার ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্ন থেকেই বাংলা সংগীত চর্চার ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশন চর্যাপদ। চর্যাপদ মূলতঃ বাংলা সংগীতেরও আদি নিদর্শন। গবেষকরা মনে করেন চর্যাপদে সংকলিত পদগুলো রচনাকালের বহু পূর্ব থেকেই বাঙালির সংগীত ও সাহিত্য চর্চার সূচনা। একথা বলা যায় যে মূলতঃ সংগীতের মধ্য দিয়েই বাঙালির প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। আর বাঙালির গান গাওয়ার শুরু থেকেই ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ভাওয়াইয়ার যাত্রা। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত ভাওয়াইয়া গান মূলত নারী, নদী ও প্রকৃতি নির্ভর। সাধারণ পেশাজীবী মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-অনুভূতি, নারী মনে প্রেমের আকুতি, প্রেম-ভালবাসা, বিরহ-বেদনা প্রভৃতি ভাওয়াইয়া গানের বিষয়বস্তু। ভাওয়াইয়া গানের সঙ্গে বিশেষ ছন্দে বাজানো হয় দোতরা, তবলা, সারিন্দা, ঢোল, মন্দিরা ও বাঁশি। এ বাদ্যযন্ত্রগুলোকে সংগত করে সংগীতের এক মধুময় মুর্ছণা ও আবেগ সৃষ্টি করা হয়। শিল্পীর উদাস করা সুরের মুর্ছণার মাঝে ভাংতি এ গানের সুরের বৈশিষ্ট্য। আর দোতারা হচ্ছে ভাওয়াইয়ার প্রধান বাদ্য অনুষঙ্গ। আসামের গোয়ালপাড়া হলো ভাওয়াইয়া গানের আদিভূমি আর রংপুর হলো ভাওয়াইয়ার উর্বরভূমি বা চর্চাভূমি । ধরলা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অঞ্চলে ভাওয়াইয়া গানের ব্যাপক প্রচার ও প্র্রসার ঘটেছে । ইতিহাস থেকে জানা যায় আজকের আসামের গোয়ালপাড়া এক সময় রংপুর জেলার অন্তর্র্ভূক্ত ছিল । ইতিহাসবিদ ও লোকসংগীত গবেষক এবং ভারতের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. আনন্দগোপাল ঘোষ এর মতে, “ রংপুরের আয়তনের কথা ভেবেই ইংরেজ কোম্পানী রংপুরকে বিভাজন করে উত্তরপূর্ব রংপুর জেলার সৃষ্টি করেছিলেন ১৮২২ সালে। এই উত্তরপূর্ব রংপুরই পরে গোয়ালপাড়া নামে পরিচিতি পেয়েছিল । লোকসংগীত গবেষকদের মতে ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই অঞ্চল। ভাওয়াইয়া উৎপত্তিগত দিক থেকে তিনটি দেশের তিনটি অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছে”। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বা রংপুর-দিনাজপুর, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল বা কোচবিহার-জলপাইগুড়ি ও আসাম এবং নেপালের সমতটের তরাই অঞ্চলের আপা ও মোরং উপঅঞ্চল। ভাওয়াইয়ার ভাষা ও সুরের কাঠামোয় উত্তরাঞ্চলের আঞ্চলিকতার প্রাধান্য বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। রংপুর-দিনাজপুর কোচবিহারের উপ-ভাষার শব্দ ভান্ডার, শব্দতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, ধ্বনিতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব, উচ্চারণরীতি ইত্যাদির সঙ্গে এর কথার ও সুরের নিবিড় সম্পর্ক আছে। তাই অন্য অঞ্চলের ভাষারীতি ও উচ্চারণ ভঙ্গি দ্বারা ভাওয়াইয়া গান বাঁধা ও সুর তোলা যায় না।

বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। কালের আবহে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাঙালি সংস্কৃতি নবধারায় নব আনন্দে বিকশিত হয়ে আজ নবরূপ ধারণ করেছে। লোকসংস্কৃতিই লোকসংগীতের পরিচয় বা সাক্ষ্য বহন করে। ভাওয়াইয়ার কথা ও সুরে আমরা খুঁজে পাই অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য। যে ইতিহাস আর ঐতিহ্য কালের আবহে তথ্য প্রযুক্তির ডামাডোলে আজ বিস্মৃত প্রায়। ইতিহাস আর ঐতিহ্যে গাঁথা বাংলাদেশের উত্তর জনপদের একটি সুপ্রাচীন জেলা রঙ্গপুর। বর্তমানে রংপুর রঙ্গ-রূপ ও রসে ভরপুর এক প্রাচীন জনপদ। এক সময় বৃহত্তর রংপুর জেলা নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও রংপুর নিয়ে গঠিত ছিল। চিরায়ত বাংলার ঐতিহাসিক কালের গোড়ার দিকে এ অঞ্চলটি কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারপর কালের আবহে নানা ধরনের পট পরিবর্তন আর ঘটনাবহুল ইতিহাস বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, বিদ্রোহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং নানা ধর্মীয় ও সামাজিক ঘটনাবলীর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এই বৃহত্তর রংপুর। শুধু তাই নয় ভাষা আন্দোলনের আর মুক্তিকামী স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ এ অঞ্চলের মানুষের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আর লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মাধ্যমে আমাদের যে অর্জিত স্বাধীনতা তা একদিনে করায়ত্ত হয়নি। ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিকামী স্বাধীনতার চেতনায় একটি ধারাবাহিক ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যে লাল টুকটুকে সূর্য আর বাংলাদেশ নামের সবুজ শ্যামল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটে তা আমাদের বাঙালি জাতির গৌরব আর অহংকারের ইতিহাস। পাকিস্তানী দুঃশাসন আর প্রতারণায় বিপর্যস্ত এদেশের মানুষ নিজেদের মুখোমুখি দাড়িয়ে হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করতে পেরেছিল নিজেদের সংকটাপন্ন অস্তিত্বকে। তখনি আত্মপরিচয় উদ্ধারের অন্তর্গত তাড়নায় ক্রমে ক্রমে সাগরের উত্তাল তরঙ্গমালার ন্যায় ফুসে ওঠে। বিক্ষুদ্ধ হয়ে গর্জে ওঠে পাকিস্তানী দুঃশাসনকে প্রতিহত করতে- জাতিসত্তার বিকাশে মুক্তি কামনায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যাঁরা জাগরণ বা চেতনার গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় মনোবল, শক্তি, সাহস সঞ্চার করেছিলেন তাঁরা শব্দ সৈনিক হিসেবে পরিচিত। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের পাশাপাশি, বিভিন্ন ক্যাম্প, শরনার্থী শিবির, যুদ্ধে অংশগ্রহনের নিমিত্তে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে দেশ মাতৃকার ডাকে চেতনার গান গেয়ে উৎসাহ ও সাহস যোগাতেন। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে রংপুর,লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের অনেক ভাওয়াইয়া শিল্পী গান গেয়ে অর্থাৎ শব্দ সৈনিক হিসেবে অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। সংগীত পরিচালক সমর দাশের তত্ত্বাবধানে এবং এম.পি. শাহ আব্দুর রাজ্জাক এর পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের কোচবিহারে “সাংস্কৃতিক মুক্তি পরিষদ” গঠিত হয়। সেই সময়ে কৃষ্ণ চন্দ্র সরখেল, বুলবুল বকসী, অরুণ কুমার মুখার্জী, নমর উদ্দিন (দোতরা বাদক), শাহানা চৌধুরী, চায়না নিয়োগী, বলাই পাল, জিন্নাহ, নাসরিন আহমেদ, নিকুঞ্জ বিহারী, বিনয় কুমার বণিক, কবিতা দাস, এসরাউল হক, ইতি বিশ্বাস, রামকৃষ্ণ সোমানী, মেসবাউল আযম, শহিদুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ছাড়াও আরো অনেকে সাংস্কৃতিক মুক্তিপরিষদে যোগদান করে দেশ ভাওয়াইয়ার পাশাপাশি চেতনার গান বা জাগরণী সংগীত পরিবেশন করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধার কিছু অংশ ও বুড়িমারী-পাটগ্রাম মুক্ত ছিল এবং এসব মুক্তাঞ্চলে শব্দ সৈনিকেরা তৎকালীন আবিদ আলী এম. পি. এর সহযোগিতায় উইং কমান্ডার এম. কে. বাশার এর উৎসাহে গঠিত হয় “বিপ্লবী সাংস্কৃতিক পরিষদ” এবং মুক্তিযুদ্ধ ফ্রন্ট দল নিয়ে শব্দ সৈনিকেরা সংগীত পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল জাগ্রত করে তুলতেন। হাজার বছরের  শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার প্রবাদ পুরুষ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারী। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান ও নেতৃত্বে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন সাহিত্য ও সংগীত প্রেমিক। ভাওয়াইয়া যুবরাজ কছিম উদ্দীন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে বেশ কিছু গান রচনা করেন। লোকসংগীত শিল্পী ভাওয়াইয়া যুবরাজ কছিম উদ্দিনকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭৩ সালের ২৩ ফ্রেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কুড়িগ্রামে আসেন। কুড়িগ্রাম কলেজ মাঠে জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ শেষে শুরু হয় এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সেই অনুষ্ঠানে কছিম উদ্দিন তাঁর দরদী কন্ঠে-“জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ভাই / তোমার আগমনে হামার খুশির সীমা নাই”…গানটি পরিবেশন করেন। গান শুনে শুধু কছিম উদ্দিনের ভূয়শী প্রশংসাই করেননি, তাঁকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন-‘তুই আমাকে কি দেখালিরে, তুই একি শোনালিরে কছিম উদ্দিন’। ওই বছরই বঙ্গভবনে এক ফোক ফেস্টিভেলের আয়োজন করা হয় এবং জনপ্রিয় এই ভাওয়াইয়া শিল্পী কছিম উদ্দিন সংগীত পরিবেশনের আমন্ত্রণ পান। 

ভাওয়াইয়া গানকে প্রথম সাংগীতিক মর্যাদায় অভিসিক্ত করে একে আঞ্চলিকতার গন্ডীর বাইরে এদেশের সর্বাঞ্চলে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন বাংলার সংগীত ভূবনের অনন্য পুরুষ ভাওয়াইয়া সম্র্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমদ্ ।  ভাওয়াইয়ার প্রসঙ্গ আসলে সবার আগে আসে ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের নাম। বাংলার পল্লীর বাংলার হিন্দু-মুসলমানের বাংলার সহজ-সরল সাধনার দুঃখ বেদনা আশা-নিরাশা প্রাণ ফিরে পেয়েছে এই মহান শিল্পীর মধ্যে। আর তাইতো খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কন্ঠে গীত এ ভাওয়াইয়া গান বাঙালি জনজীবন ছাড়িয়ে বিস্তৃত আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। সেই সাথে আব্বাস উদ্দিন পরবর্তী মহেশ চন্দ্র রায়, হরলাল রায়, ভাওয়াইয়া যুবরাজ মো. কছিম উদ্দিন, কে. এস. এম. আশরাফুজ্জামান সাজু,  মকবুল আলী, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ফেরদৌসী রহমান, সিরাজ উদ্দিন, নুরুল ইসলাম জাহিদ, নমর উদ্দিন, শমসের আলী প্রধান, নাদিরা বেগম, রথীন্দ্রনাথ রায়, সুরাইয়া বেলী, রবীন্দ্রনাথ মিশ্র, নীলকমল মিশ্র, সুভাষ চন্দ্র রায়, এ.কে.এম. মোস্তাফিজুর রহমান, অনন্ত কুমার দেব, তরুণী কান্ত রায়, নির্মল কুমার দে, জগৎপতি বর্মা, ভূপতি ভূষণ বর্মা, ভবতরণ, শফিকুল ইসলাম শফি, পঞ্চানন রায়, রণজিৎ কুমার রায়, সচ্ছিদানন্দ রায়, অরুণ কুমার অধিকারী, মনোরঞ্জন রায়, সুনীল রায়, বিশ্বনাথ মোহান্ত, নীতি রাণী রায় ,শ্যামলী সরকার, রানু মন্ডল, দুলালী রায়, বাদশা আলম সহ উচ্চারিত হয় উত্তরাঞ্চলের আরো অনেক প্রথিতযশা ও প্রতিষ্ঠিত গুণী শিল্পীর নাম  এবং ওপার বাংলার কেশব বর্মন, সুভাষ দাস, হরিশ্চন্দ্রপাল, সুরেন বসুনিয়া, কেদার চক্রবর্তী, গোপাল চন্দ্র দে, যতীন্দ্রনাথ সিংহ সরকার, ধীরেন্দ্রনাথ বসু, সুখবিলাস বর্মা, সুনীল দাস, সুধাংশুশেখর মুস্তাফী, দেশবন্ধু চক্রবর্তী, মাধবচন্দ্র পাল, উপেন্দ্রনাথ সরকার, ছত্রমোহন সরকার, ঝাপুরা বর্মন, নায়েব আলী টেপু, অরুণ কুমার ভট্টাচার্য, ত্রিফুল্ল কুমার রায়, প্রসেনজিৎ বর্মন, রথীন্দ্রনাথ গোস্বামী, প্যারীমোহন দাস, গঙ্গাধর দাস, ধনেশ্বর রায়, বিরাজ সেন মাঝু, নীলিমা বন্দোপাধ্যায়, শেফালী সরকার বসু, অসমের প্রতিমা বড়ুয়া পান্ডে, আয়েশা সরকার, সুনীতি রায়, দুর্গা রায়, সুমিত্রা রায়, কেরামত আলী, রহিমা বেগম কলিতা, নগেন শীল বর্মা, কামেশ্বর রায়, নজরুল ইসলাম, হিমাদ্রী দেউড়ি, টুম্পা রায়, রাম কুমার বর্মন ছাড়াও আরো অনেক ভাওয়াইয়া শিল্পী সংগঠক, গীতিকার ও সুরকার।

লোকসংগীত ভাওয়াইয়া নিয়ে বেশ পত্র-পত্রিকা ও বই প্রকাশিত হয়েছে। হরিশ্চন্দ্র পাল উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতির একজন পুরোধা। লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে স্মরনীয় নাম হরিশ্চন্দ্র পাল। শিল্পী, সংগ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক, নাট্যাভিনেতা, নাট্যকার ও পরিচালক হরিশ্চন্দ্র পাল। উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া ও চটকা গানের সর্বপ্রথম সংগ্রাহক। উত্তরবঙ্গের ‘পল্লীগীতি ভাওয়াইয়া খন্ড’ ও উত্তরবঙ্গের ‘পল্লীগীতি চটকাখন্ড’ তাঁর অমরকীর্তি। প্রতি বছর ভারতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যবস্থাপনায় রাজ্য ভাওয়াইয়া সংগীত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সেই রাজ্য ভাওয়াইয়া প্রতিযোগিতায় ভাওয়াইয়া বিষয়ক স্মরণিকা প্রকাশিত হয়ে থাকে। যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক গবেষক-লেখকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতিকেন্দ্র থেকে গীতিকবি শ্যামাপদ বর্মণের ‘ভাওয়াইয়া গীতিসংগ্রহ ও স্মরলিপি’ ২০০০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে। সিধুভাই কল্যাণ ট্রাস্ট, রংপুর থেকে ২০০৩ সালে ‘ভাওয়াইয়া’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথিতযশা দশ জন শিল্পীর গান স্মরলিপি সহযোগে শচীমোহন বর্মন এর সম্পাদনায় ‘লোকসংগীত স্মরলিপি’ নামে ২০১৫ সালে মুক্তচিন্তাকেন্দ্র ও ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন, কোচবিহার থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ‘লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ও শিল্পীজীবনী’ নামে শব্দ প্রকাশনা থেকে একুশের বইমেলা ২০১৫ তে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘রংপুরের ভাওয়াইয়া’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া একাডেমি উলিপুর, কুড়িগ্রাম থেকে গীতিকবি রবীন্দ্রনাথ মিশ্রের ১৪৩টি ভাওয়াইয়া গানের কথামালা নিয়ে। এছাড়াও গীতিকবি নীলকমল মিশ্রের ১১১টি গান নিয়ে কবি ও গল্পকার ফেরদৌসী বেগম বিউটি কর্তৃক স্বর্নামতি প্রকাশনা থেকে ‘জীবন পোড়ে তুষের আগুন’ নামে গুরুত্বপূর্ণ  বইটি আগস্ট-২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া একাডেমি উলিপুর কুড়িগ্রাম থেকে ত্রৈমাসিক ‘ভাওয়াইয়ালোক’ নামে পত্রিকার কয়েকটি  গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দুই বাংলার লেখকদের লেখায় পত্রিকাটি  সমৃদ্ধ। দেশের একমাত্র সংগীত বিষয়ক পত্রিকা মাসিক সরগমে ভাওয়াইয়ার উপর অনেক লেখা বিভিন্ন সময়ে ভাওয়াইয়া গবেষকদের লেখনিতে প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। এছাড়াও আরও অনেক প্রকাশনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। ভাওয়াইয়া গানের আদিকথা ও সুর বিকৃতিরোধে স্বরলিপিসহ ভাওয়াইয়া গান ভাওয়াইয়া বিষয়ক গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা সরকারিভাবে করতে হবে। ভাওয়াইয়ার আদিতে যে স্বরলিপি ও সুর ব্যবহৃত হয়েছে এবং ওপার বাংলায় গ্রামোফোন রেকর্ডে যে সমস্ত এপার বাংলা ও ওপার বাংলার স্বণামধন্য শিল্পীর গান গীত হয়েছে সেগুলো উদ্ধার ও সংগ্রহ যৌথভাবে ভারত-বাংলাদেশ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করা যেতে পারে। ভাওয়াইয়ার আদি কথা ও সুর বিকৃত রোধে স্বরলিপি সহযোগে ভাওয়াইয়া গান প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কন্ঠে ধারণ করে প্রকাশ ও সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহন করা যেতে পারে । যে সমস্ত বাদ্য অনুষঙ্গ ভাওয়াইয়াকে জনপ্রিয় করে তুলেছে সেগুলোর শরীরী অস্তিত্ব সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে । ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা, রজনী, ভাওয়াইয়া বিষয়ক অনুষ্ঠান ও সেমিনারের আয়োজন এবং সেই সাথে নতুন প্রজন্মকে ভাওয়াইয়া প্রশিক্ষণ চর্চায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহন করতে পারলে তবেই আদি, করুণ, হাস্য, বীর ও শান্ত রসে সিক্ত পঞ্চসুরের পঞ্চরসে ভরা ভাওয়াইয়া অখন্ড সুরের মূর্ছণায় অগণিত মানুষের অন্তরে দোলা দেবে অপার মহিমায়।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত