বাঙালি জাতির সমাজ পরিচয় ও ধর্ম (পর্ব-২)

Reading Time: 4 minutes

 

গত পর্বের পরে…

 

গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বাংলায় অনুপ্রবেশ করলেও এর বিকাশ ও প্রসার লাভ করেছিলো তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে। বৈদিক ধর্মে তন্ত্রের কোন স্থান নেই, কিন্তু গুপ্তযুগেই তারা অজ্ঞাত সব দেব দেবীর শুভদৃষ্টি লাভ করেন, ফলে বৈদিক ধর্ম সম্পূর্ণভাবে নতুন রূপ লাভ করে। শুধু তাই নয়, এ যুগেই তারা বৈদিক আচার অনুষ্ঠানে অবৈদিক আচার অনুষ্ঠান ও পূজা পার্বনে অভ্যস্ত হয়ে পরেন। পুরান ও তন্ত্র পুঁথির রচনার শুরু হয়ে যায় এ যুগে। ড. সুর বলেন, পাল রাজাগণ বৌদ্ধ হলেও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যথেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। আর সেন রাজাগণের তো কথাই নেই, তারা ব্রহ্মণ্যধর্ম প্রসারের কাজে নিজেদের ব্যাপৃত রেখেছিলেন। বস্তুত তাঁদের সময়েই বাঙলায় ব্রহ্মণ্যধর্ম তুঙ্গে উঠেছিল। কিন্তু তা সম্ভবত ব্রহ্মণ্য ও বেীদ্ধ ধর্ম উভয়ই সমধারায় প্রবাহিত হয়ে উভয়ে উভয়কে প্রভাবান্বিত করেছিল। বস্তুত মুসলমান যুগের অনতিপূর্বে উভয় ধর্মই বাঙালার নিজস্ব তন্ত্রধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। তন্ত্র মূলত ক্রিয়ামূলক। প্রাক বৈদিকধর্মের আচরণীয় ক্রিয়া কর্মই এর মূল ভিত্তি। শুদ্ধচারী ব্রাহ্মণ বা বৌদ্ধ কেউ এই তন্ত্রধর্মের কথা ভাবতে পারেন নি। ড. সুর বলেন, তন্ত্রধর্মের উদ্ভব হয়েছিল নবোপালীয় যুগে ভূমি কর্ষণের ব্যাপার নিয়ে। তন্ত্রধর্ম বহুল দেবদেবী নির্ভর, যা ক্রমে বৌদ্ধ ও ব্রহ্মণ্য বা বৈদিক ধর্মকে আছন্ন করে ফেলে। এ প্রসঙ্গে নাীহাররঞ্জন রায় বলেন, “এইভাবে ধীরে ধীরে বেদবিরোধী, যজ্ঞবিরোধী-বুদ্ধদেব ব্রহ্মণ্য ধ্যানের স্বাঙ্গীকৃত হইয়া গেলেন। বৌদ্ধ ধর্মের তন্ত্রমার্গী সাধনা ও ব্রহ্মণ্য তন্ত্রমার্গী সাধনার সঙ্গে মিলিয়া প্রায় এক হইয়া গেল। বৌদ্ধদেবায়তন আর ব্রহ্মণ্যদেবায়তনে প্রতিমার রূপ কল্পনার পার্থক্য প্রায় আর রহিল না।”১০ এই মিশ্রণই বাঙলায় নানারকম লোকায়ত ধর্মের জন্ম দিয়েছিল। যেমন, বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছিলো নাথ ধর্ম। তেমনি ব্রহ্মণ্য তান্ত্রিক সাধকদের শাখাও বিস্তৃত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল বৈষ্ণব ধর্মের। কালক্রমে নানারকম বিষ্ণুমুর্তির মধ্যেও বুদ্ধের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পৌরনিক বিষ্ণু কালক্রমে মৌখিক (বৈদীক?) দেবায়তনে বিস্তার লাভ করে পাল ও সেন পর্বে। এছাড়া জৈন ও আজীকিব সম্প্রদায়ের মত সাধনাপন্থী ছিল অবধূতমার্গীরা। এরা ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করত, এরা বর্ণাশ্রম মানত না, শাস্ত্র মানত না। কোন কিছুতেই এদের আসক্তি ছিলনা। এরা ছিল উন্মাদ বা পাগল। বাঙলাদেশে প্রায় গোড়ার দিকে যারা বৌদ্ধ সিদ্ধচার্যদের সাধনপন্থা, বিশেষ করে বজ্রযানী-সহযানীদের তন্ত্রপদ্ধতি মেনে চলেছেন, তারা বাউল। এরা কায়া সাধনাকেই মুক্তির উপায় বলে মনে করে। এরাও অবধূতমার্গীদের মতই অনেকটা উন্মাদ। বলা হয়ে থাকে যে, বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি যাংখ্য মত থেকে। বুদ্ধদেবের গরু আড়ার কলম ও উদ্রেক দুজনই ছিলেন যাংখ্যাাবলম্বী।১১ আর যাংখ্য দর্শনেও পুরুষ-প্রকৃতির আদি-মৈথুন স্বীকৃত। যা তান্ত্রিকদের কায়া সাধনকে উস্কে দেয়।


“বাউল মতাবলম্বীরাও ‘দেহের সাধন’ কে ‘সর্বযার’ বলে মনে করেন “


যতই ব্রহ্মণ্য ধর্ম লোকায়ত ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান রপ্ত করুক না কেন, কৌলিন্য প্রথা তৎকালিন বাঙালি সমাজকে কলুষিত করে দিয়েছিলো। পাল ও গুপ্তযুগে এ প্রথা বা বর্ণাশ্রম মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারলেও সেন আমলে এসে কৌলিন্য প্রথা জন্ম দেয়-ভয়ানক সব অমানবীয় প্রথার। কৌলিন্য যেহেতু বজায় রাখতে হত মেয়ের দিক থেকে তাই ব্রাহ্মণ কুলীনের মেয়েকে বিয়ে দেয়া হত কম বয়সেই। তাছাড়া ব্রাহ্মণ ছেলে যে কোন মেয়ে বিয়ে করতে পারলেও ব্রাহ্মণ কুলীনের মেয়েকে কুল রাখতে হত ব্রাহ্মণের ছেলেকে বিয়ে করার মাধ্যমে। ফলে সমাজের চেহারাটাই ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে শুরু করল এসময়। বয়স্ক পাত্রের সাথে বিয়ের ফলে-বৈধব্য বরন করতে হত। পাত্র না পাওয়া গেলে দেবদাসী হিসেবে মন্দিরে জীবন পার করতে হত। কখনও কখনও ব্রাহ্মণ বাপ তার মেয়েকে গঙ্গায় ভাসিয়েও দিতো। এসময়ই প্রাদুর্ভাব ঘটল সহমরণ প্রথার। এভাবে মধ্যযুগের সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেণির ভেদজ্ঞান তৈরী হয়েছিল মারাত্মকভাবে। শুধু তাই নয়, এই দূরত্ব উস্কেও দেয়া হতে লাগল। নানারকম প্রাত্যহিক আচার আচরণেও তৈরী হল বিধি-বিধান, যেমন, “রজক, কর্মকার, নট, বরুড়, কৈবর্ত, মেদ, ভিল্ল, চণ্ডাল, পুককশ, কাপালিক, নর্তক, তক্ষণ, সুবর্ণকার, শৌডিক এবং পতিত ও নিষিদ্ধ বৃত্তিজীবী ব্রাহ্মণদের দ্বারা স্পৃষ্ট বা পক্ক খাদ্য ব্রাহ্মণের পক্ষে ভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল, এই নিষেধ অমান্য করিলে প্রায়শ্চিত করিতে হইত। শূদ্র পক্ক অন্ন ভক্ষণও নিষিদ্ধ ছিল, নিষেধ অমান্য করিলে পূর্ণকৃচদ্র প্রায়শ্চিত্তের বিধান ছিল।”১২ এছাড়া ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শুদ্র কেউ-ই চণ্ডাল ও অন্ত্যজদের পাত্রের জল পান করতে পারত না, করলে পুরোপুরি প্রায়শ্চিত করতে হত। এই নিকৃষ্ট প্রথাটি, অর্থাৎ ব্রহ্মণ্য আধিপাত্যবাদকে উস্কে দিয়েছিল গুপ্তযুগের রাজারাই। গুপ্তযুগের রাজা কর্তৃক ব্রাহ্মণদের ‘ভূমিপ্রথা’ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে রাষ্ট্রকে সামন্ততন্ত্রের দিকে ধাবিত করেছিল। ভূমি দানের কারনে ব্রাহ্মণ প্রভূত্ত্বের পথ সুগম হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে রাম শরণ শর্মা বলেন, “অতঃপর ভূমিদানের বহুল ব্যবহার শুধু যে ব্রাহ্মণ প্রভূত্ত্বের পথ সুগম করে দিয়েছিলো তাই নয়, ব্রাহ্মণরা শাসন কার্য পরিচালনা করতেন রাজ্য পুরুষদের ক্ষমতার বাইরে থেকে, প্রায় স্বাধীনভাবে। তাদের কোন রাজকীয় পদস্থ ব্যক্তির অধীনে থাকতে হত না।”১৩ নীহাররঞ্জন রায় বলেন-‘গুপ্ত আমলেই দেখিয়াছি, এই রাজতন্ত্র ছিল সামন্ততন্ত্র নির্ভর। এই আমলেও দেখিতেছি তাহার ব্যতিক্রম নাই, বরং সামন্ততন্ত্রের প্রসারই দেখা যাইতেছে।”১৪ এজন্য সেন আমলের রাষ্ট্র সংঘকে বলা হয়-ব্রাহ্মণতান্ত্রিক সেন রাষ্ট্র, যার সংবিধান হল স্মৃতি পুরান। বলা হয়ে থাকে, সেনযুগে রচিত স্মৃতি ও পুরানে ব্রাহ্মণ সমাজের সংরক্ষণী মনোভাবই পরিস্কার হয়ে উঠেছিল।১৫ ব্রহ্মণ্যবাদের কঠোর বিধি নিষেধের মধ্যে তুর্কি বিজয় ভারতের ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা করে। দ্বাদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এই যুগের বিস্তার, যার নাম ‘মধ্যযুগ’। এসময় পর্বে পাঠান-মোঘল ও তাদের সুবেদাররা এবং নবাবরা ছিলেন শাসক। কেন্দ্রীয় মুঘল শাসনের ফলে বাঙলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলেও ধর্মান্ধতার প্রতিক্রিয়ার ফলে তা টিকে থাকেনি। ফলে ত্রয়োদশ ও চর্তুদশ শতক ইতিহাসে ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় ছিল। তবে এর ভিতর দিয়েই বাঙালির বিবর্তন সূচিত হতে থাকে। “ তুর্কি মুসলমান আক্রমণের পর হিন্দু সমাজে তাহার পুরাতন খুঁটি ধরিয়া বসিয়া থাকে নাই। হিন্দু সমাজে বিপুল পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে; বাহিরের আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ কর্ম ব্যবস্থায় সংরক্ষণশীলতার ফলে বর্তমান হিন্দু সমাজ বিবর্তিত হইয়াছে”।১৬ বাঙালি যখন সেনদের আমলাতান্ত্রিক শক্তি ও ব্রহ্মণ্যবাদের আস্ফালনে নুব্জ তখন তুর্কি বিজয়ের ফলে এদের মধ্যে একটি মিশ্রণ প্রক্রিয়া সূচিত হল এবং এই অন্ধকার পর্ব জুড়ে এই প্রক্রিয়ায় বাঙালি একটি ঐক্যবদ্ধ চেহারা লাভ করে।১৭ তা সত্ত্বেও সমকালীন হিন্দু ও মুসলমান তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে উপাদানগত বহু সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও সমান্তরালভাবে চলছে-কোন সমন্বিত অভিপ্রায় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। ফলে ‘হিন্দু সমাজ যে একটি প্রতিরোধী সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়েছে মুসলমান সমাজের কাছে তা তাৎপর্যহীন।’১৮ আর এভাবে বাঙালি সমাজে নতুন সংকট ক্রমে হাজির হয়ে যায়, কেননা উভয়ের সামাজিক মনস্তত্ত্বের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বা ভিন্নতা রয়েছে।

 

 

 

ক্রমশ…

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>