Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Bangla anubad sahitya

প্রবন্ধ: অনুবাদ সাহিত্য । সৈয়দ মুজতবা আলী

Reading Time: 3 minutes

বাংলা সাহিত্যের মত অদ্ভুত এবং বেতালা সাহিত্য পৃথিবীতে কমই আছে। রবীন্দ্রনাথ গান আর কবিতা দিয়ে যে বাঙলা গীতিসাহিত্য রচে গিয়েছেন তার কাছে এসে দাঁড়াতে পারে, এমন গীতিসাহিত্য পৃথিবীতে আর নেই বললেও চলে। মেঘদূতের মতো গীতিকাব্য পৃথিবীতে নেই- রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান অনেক স্থলে কালিদাসের মেঘদূতকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তার গীতিকাব্য দিয়ে বাঙলা সাহিত্যকে যেন একসঙ্গে তেইশটা ডবল প্রমোশন পাইয়ে দিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পও বিশ্বসাহিত্যের যে-কোনো কথাসাহিত্যের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারে। আরো বিস্তর অতুলনীয় সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের কলম দিয়ে বেরিয়েছে, তার উল্লেখ এখানে অবাস্তর।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সৃষ্টিকার। তাঁর পক্ষে অন্য লেখকের রচনা অনুবাদ করবার কোন প্রয়োজন ছিল না। এমন কি একথা বললে ভুল বলা হবে না, যেটুকু অনুবাদ তিনি করেছেন তাতে সময় নষ্ট হয়েছে মাত্র। কদম-ফুলের কেশর ছাড়িয়ে লাট্টু বানিয়ে ছেলেরা জিনিসটাকে কাজে লাগায় বটে, তবু নিষ্কর্মা কদম-ফুলেরই দাম বেশি।

অনুবাদ-চর্চা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বেশি সময় নষ্ট করেননি বলেই বোধ করি বাংলা সাহিত্য অনুবাদের দিক দিয়ে এত হীন। তাই বলছিলুম, বাংলা সাহিত্য বেতালা সাহিত্য, গীতিকাব্যে যেন সে পঙ্খিরাজের পিঠে চড়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডময় উড়ে বেড়ায় আর অনুবাদ সাহিত্যের বেলা সে যেন এঁদো কুয়োর ভেতরে খাবি খায়।

অথচ উনবিংশ শতকের শেষের দিকে বাংলা ভাষায় যে অনুবাদ সাহিত্যের রচনা দানা বাঁধতে আরম্ভ করে, তার তুলনায় আজকের দিনে তাকিয়ে দেখি সে দানা দিয়ে মিঠাই মণ্ডা তো হলই না, তলানির চিনিটুকু দিয়ে আজ যেন সাহিত্য-সভায় পানসে শরবত বিলানো হচ্ছে। গীতকাব্যে যে সাহিত্য তেইশটে ডবল প্রমোশন পেয়েছিল, অনুবাদে সেই সাহিত্যকেই বাহান্নটা ডিগ্রেডেশন দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অনুবাদ করতে হলে বিদেশি ভাষা জানার প্রয়োজন। আজকের দিনে কলকাতা শহরে শুধু ফরাসি বই বিক্রয়ের জন্যে দোকান হয়েছে- সত্তর বৎসর আগে, ছিল নাÑ তবু আমাদের অনুবাদ-সাহিত্যে যেটুকু শরবত আজ বিলানো হচ্ছে তার আগাগোড়া ইংরেজি থেকে।

অথচ উনবিংশ শতকের শেষের দিকেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ফরাসি সাহিত্যের উত্তম রস-সৃষ্টি বাংলায় অনুবাদ করতে আরম্ভ করেন। বিংশ শতকেও তিনি এই কর্মে লিপ্ত এবং মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ কাজে ক্ষান্ত দেননি। ঠিক স্মরণ নেই, তবে খুব সম্ভব লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলকের বিরাট মারাঠি গীতার অনুবাদই তার শেষ দান।

আশ্চর্য বোধ হয় যে, বাঙালি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভুলে গিয়েছে। সংস্কৃত থেকে তিনি যেসব নাটক অনুবাদ করেছিলেন সেগুলোর কথা আজ থাক। উপস্থিত পিয়ের লোতির একখানা বইয়ের কথা স্মরণ করছি।

পিয়ের লোতির মত লেখক পৃথিবীতে কমই জন্মেছেন। শুদ্ধমাত্র শব্দের জোরে, সম্পূর্ণ অজানা, অদেখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা গড়ে তোলা যে কি কঠিন কর্ম, তা শুধু তাঁরাই বুঝতে পারবেন, যাঁরা কখনো এ-চেষ্টায় দণ্ডমাত্র কালক্ষেপ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করার মতো দুর্মতি কোনো বাঙালির হওয়ার কথা নয়, তাই বলতে আপত্তি নেই যে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বাঙালির অদেখা জিনিস নিয়ে কাব্য সৃষ্টি করাটা পছন্দ করতেন না। সাধারণ বাঙালির সঙ্গে পাহাড় এবং সমুদ্রের পরিচয় অতি কম- তাই বোধ করি রবীন্দ্রনাথ এ দুটো জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন যতদূর সম্ভব কম। শীতপ্রধান দেশের পাতা-ঝরা হেমন্ত ঋতু, শুভ্র মল্লিকা বর্ষণের মত বরফপাত যে কী দর্শনীয় বস্তু, সিনেমা থেকেও তার খানিকটে আন্দাজ করা যায়– রবীন্দ্রনাথ এসব দেখেছেন, উপভোগ করেছেন বহুবার; কিন্তু কোথাও তার বর্ণনা করেছেন বলে তো মনে পড়ে না।

পিয়ের লোতির বৈশিষ্ট্য এইখানেই। তিনি জাপান, তুর্কি, আইসল্যান্ড এবং আরো নানাদেশের যেসব ছবি ফরাসি ভাষায় এঁকে দিয়ে গিয়েছেন, সেসব পড়ে মনে হয় ভাষার সংগীত, বর্ণ, গন্ধ একসঙ্গে মিলে গিয়ে কী করে এইরূপ রসবস্তু নির্মাণ হতে পারে! মনে হয়, একসঙ্গে যেন পঞ্চেন্দ্রিয় রস গ্রহণ করছে, মনে হয় কারো কলম যদি নিতান্ত অরসিক জনকে দেশ-কাল-পাত্র ভোলাতে সক্ষম হয় তবে সে কলম পিয়ের লোতির।

ভারতবর্ষ সম্বন্ধে লোতি যে বইখানা লিখেছেন তার নাম ল্যাঁদ, সাঁজাংলে। অর্থাৎ ‘ভারতবর্ষ, কিন্তু ইংরেজকে বাদ দিয়ে’। অর্থাৎ তিনি ভারতবর্ষের ছবি আঁকতে বসেছেন। কিন্তু মনস্থির করে ফেলেছেন যে, এদেশের ইংরেজদের সম্বন্ধে তিনি কিছু বলবেন না।

স্বীকার করি, ‘ইংরেজ-বর্জিত-ভারত’ (‘বসুমতী’ কর্তৃক প্রকাশিত জ্যোতিরিন্দ্র গ্রন্থাবলী দ্রষ্টব্য) ল্যাঁদ, সাঁজাংলের ঠিক অনুবাদ নয়, কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুবাদশশাঙ্কে ওই একটি মাত্র কলঙ্ক। বাদবাকি পুস্তকখানা অনুবাদ-সাহিত্যে যে কী আশ্চর্য কুতুব-মিনার, তার বর্ণনা দিতে হলে লোতির কলমের প্রয়োজন।

ত্রিবাঙ্কুরে লোতি ভারতীয় সঙ্গীত শুনে বিস্ময়ের উচ্ছ্বাসে সে-সংগীতের বর্ণনাতে কত না স্বর কত না ধ্বনি মিশিয়ে দিয়েছেন; জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাংলা সে-স্বর সে-ধ্বনি অবিকল বাজিয়ে চলেছে। মাদ্রাজে লোতি ভরত-নাট্যম দেখে ভাবাবেগে অভিভূত হয়ে মানবহৃদয়ের যত প্রকারের আশা- নৈরাশ্য, ঘূণা-ক্রোধ, আকুলি-বিকুলি সম্ভব হতে পারে, সব-কটি প্রকাশ করেছেন কখনো গভীর মেঘমন্দ্রে, কখনো মধুর বীণাঝঙ্কারে, কখনো শব্দ সমন্বয়ের চটুল নৃত্যে- জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাংলা- বীণা যেন প্রতি মন্দ্র, প্রতি ঝঙ্কার, প্রতি ব্যঞ্জনা ঠিক সেই সুরে রস সৃষ্টি করেছে। ইলোরার স্থাপত্য-ভাস্কর্য লোতিকে বিহ্বল ভয়াতুর করে ফেলেছে, অনির্বচনীয় চিরন্তন সত্তার রসস্বরূপে স্বপ্রকাশ দেখিয়ে- জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখনী লোতির বিহ্বল ভয়ার্ত হৃদয়ের প্রতি কম্পন প্রতি স্পন্দন ধরে নিয়ে যেন বীণাযন্ত্রের চিকণ কাজের সঙ্গে মৃদঙ্গর নিপুণ বোল মিশিয়ে দিয়েছে।

এরূপ অদ্ভুত সংগীত দিয়ে বাংলা সাহিত্যের মজলিসে যে অনুবাদ-সাহিত্য আরম্ভ হয়েছিল, আজ তার সমাপ্তি দেখতে পাচ্ছি সস্তা, রগরগে ইংরেজি উপন্যাসের অনুবাদে। খেমটা আর ‘ফিলমি গানের’ সঙ্গে তার মিতালি।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>