Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla anugolpo amita mazumder

অমিতা মজুমদারের দুটি অণুগল্প

Reading Time: 3 minutes

একজোড়া সোনার বালা ও রক্তাক্ত ফুলশয্যা

ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে তন্দ্রা, দাঁতে দাঁত চেপে থাকে,বাইরে যেন কোনো শব্দ না যায়। শ্বশুরবাড়ি আসার আগে মা, চাচি বার বার করে বলে দিয়েছে। তন্দ্রা সবে চৌদ্দ পার করেছে। আঠারো বলে তার বিয়ে দেয়া হয়েছে। সৌদি আরব প্রবাসী ইয়াকুবের সাথে। এমন সুপাত্র না-কী হাতছাড়া করা যায় না। ইয়াকুবের বয়েস বছর পয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। বেশ দশাসই শক্ত সমর্থ শরীর।এটা তার দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম স্ত্রী বিয়ের বছর পাঁচেক পরে ইয়াকুবকে ছেড়ে চলে গেছে। একটা মেয়ে আছে ইয়াকুবের বছর চারেক বয়েস হবে। আজ সেই ইয়াকুবের সাথে তন্দ্রার ফুলশয্যা হচ্ছে।

ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে যেন নিজেকে খুঁজে পায় তন্দ্রা। নীরব সমর্পণ ছাড়া আর কিছু করার নেই তার। রাতে ইয়াকুব সকলের চোখের আড়ালে সৌদি থেকে আনা এক জোড়া খাঁটি সোনার বালা দিয়েছিল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিছানা থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়ায় তন্দ্রা, নিজের মুখোমুখি হয়ে ভয়ে শিউরে ওঠে। হঠাৎ হাতের চকচকে নতুন বালা জোড়ায় চোখ আটকে যায় তন্দ্রার।

উপহার

একটি অসফল বিয়েকে টিকিয়ে রাখার চেয়ে সে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা ভালো। এমনটাই মনে করে রুপা। আর সে ভাবনা থেকেই উকিলের শরণাপন্ন হয়। কারণ দিপুকে আজকাল তার একেবারেই সহ্য হয় না। তাই প্রতিদিনের খিটিমিটি থেকে শান্তি বজায় রেখে দূরে থাকাই ভালো। সে-মতোই উকিলকে সে তার অভিযোগগুলো জানায়। উকিল সব শুনে দিপুকে ডেকে পাঠায়। দিপুরও কোনো আপত্তি নেই। সত্যি বলতে সেও হাঁপিয়ে উঠেছে এই রোজকার অশান্তিতে। দুজনার কথামতো উকিল কাগজপত্র তৈরি করে ওদের ডেকে পাঠায়। ওরা সকাল সকাল চলে আসে ওদের সাত বছরের ছেলে অভিকে নিয়ে। অভির হাতে একটা  বল। সেটা নিয়ে সে একবার এ হাত আবার ওহাত করছে। উকিলবাবু বললেন কাগজপত্র তো সব তৈরি কিন্তু অভি কার কাছে থাকবে সেটা আপনারা সিদ্ধান্ত নিন। রুপা অবলীলায় বলল অভি আমার কাছে থাকবে। আমি অভির মা, ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। শুনে দিপু বলে, আমি অভিকে কিছুতেই দেবো না। অভিকে ছাড়া আমি থাকার কথা ভাবতেই পারি না। দুজনের এই ব্যাকুলতা দেখে উকিলবাবু অভির কাছেই জানতে চাইলেন, সে কার কাছে থাকতে চায়। অভির নির্বিকার উত্তর “ বাবা মা দু’জনকেই চাই তার”।কোনো মীমাংসা না হওয়ায় শেষ অবধি ওরা কোর্টে যায়। আর কোর্টের রায়ে নাবালক অভির দায়িত্ব পায় মা রুপা। বাবা দিপু সপ্তাহে দু’দিন অভির সাথে সময় কাটাবার সুযোগ পায়। মাস ছয়েক অভি তার মায়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে ওঠে। দিপু সপ্তাহের দু’টো দিনে যেন অভিকে সারা সপ্তাহের সময়টুকু দিয়ে আগলে রাখে।

ছ’মাস পরে ছবিটা একটু অন্যরকম হয়ে যায়। রুপা অভির দিকে তেমন খেয়াল দিতে পারে না। কারণ তার সময়ের সিংহভাগই কেটে যায় মুঠোফোনে কারও সাথে আলাপচারিতায়। অভির দিকে কোনো খেয়ালই তার নেই। যে অভিকে ছাড়া বাঁচবে না মনে হয়েছিল রুপার সেই অভিকে এখন কিছুটা বোঝা মনে হয়। অপরদিকে দিপুরও কেমন যেন গা-ছাড়া ভাব আজকাল। সপ্তাহে নিয়ম করে দু’টো দিন অভিকে নিতে আসে ,নিয়ে বাইরে যায় কিন্তু অভি দেখে বাবা তার ল্যাপটপ নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করছে। সেদিন-তো পার্কে খেলতে গিয়ে পড়েই গিয়েছিল অভি ওপাশ থেকে এক আংকেল এসে ধরে ফেলে। বাবাতো ল্যাপটপ থেকে মুখও তুলে দেখেনি। সেদিন দিপু অভিকে দিতে রুপার বাসায় গেলে রুপা বলে দিপু আমার কিছু কথা আছে। দিপু বলে বেশ বলো। রুপা বলে দিপু তুমি অভিকে তোমার কাছে নিয়ে রাখতে পারো। আরও পরিস্কার করে বলে এবার আমি নতুন করে জীবন শুরু করতে চাই। আমার ছোটবেলার বন্ধুর সাথে হঠাৎ করেই যোগাযোগ হয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নতুন করে জীবন শুরু করার। তাই অভিকে আমি তোমায় দিয়ে দিতে চাই। ধরে নাও আমাদের এতদিনকার সম্পর্কের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমার তরফ থেকে তোমাকে দেয়া  উপহার ।

দিপুও কেমন মিনমিনে গলায় বলে ওঠে, রুপা আমারও তোমাকে কিছু বলার আছে। আমিও বেশকিছুদিন যাবৎ আমার বন্ধু স্বপ্নার সাথে থাকছি। তুমিতো স্বপ্নাকে চেনো। এবারে আমরাও বিয়ে করবো ভেবেছি। তাছাড়া স্বপ্নাও মা হতে চলেছে। এ অবস্থায় আমি চাই অভি তোমার সাথেই একেবারে থাকুক। তোমাদের নতুন জীবনে তোমার একসময়ের জীবনসাথীর দেয়া প্রীতিউপহার মনে করে নিয়ে নাও।

মাসখানেক পরে একদিন রুপা আর দিপু অভির চাওয়া মতো একসাথে অভিকে নিয়ে বেড়াতে গেল। সুন্দর করে অভির লাগেজ গুছিয়ে নিল ওরা। তারপর গাড়িতে চেপে ওরা রওয়ানা হলো। গাড়ি এসে থামল একটা বোর্ডিং স্কুলের সামনে। রুপা অভিকে তাড়া দিল গাড়ি থেকে নেমে আসার জন্য।

সুন্দর পরিপাটি সাজানো বোর্ডিংস্কুলের বারান্দায় বসে অভি দেখলো তার বাবা মা এক গাড়িতে করে এলেও দুটো গাড়িতে চড়ে চলে গেল। অভি স্বপ্নহীন চোখে হাতের বলটাকে এহাত ওহাত করতে করতে তৃতীয় আর একটা হাত খুঁজছিল।

(আশির দশকে রাজধানীর একটি স্কুল যেখানে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থাও ছিল।সেখানে শিক্ষকতা করার সময় দেখেছিলাম অভির মত শিশুর সংখ্যাই বেশি। স্কুলে শিক্ষকতা করার সুবাদে জানার সুযোগ হয়েছিল এমন কঠিন বাস্তবতাও লুকিয়ে আছে ফুলের মতো শিশুদের ধোপদূরস্ত জীবনে। তখন নিজের অপরিপক্ক মনে এ সামাজিক ব্যাধির অন্তর্নিহিত দহন তেমন একটা রেখাপাত করেনি। আজ জীবনের সাঁঝবেলায় এসে মনটা কেমন করে উঠল।সে ভাবনা থেকেই আমার এ লেখা যাকে গল্প বলা যাবে কি-না আমি পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম) 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>