| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতীর অণুগল্প: ওম । ব্রততী সেন দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

 

সারা রাত বৃষ্টির অঝোর বর্ষণ, টিনের চালের ওপরে বৃষ্টির ফোঁটার তান্ডবে ভারি এক গুমগুম শব্দের কোলাহল। চারদিকে এক কানচাপা ভাব, দমচাপা অস্থিরতা। বাইরে মোতি কুই কুই শব্দে জানান দিচ্ছে তার শীত কাতরতা। বারান্দার পা মোছার চটের বস্তাটার ওপর গুটিয়ে শুয়ে থাকে রাতে কুকুরটা। গোটানো উলের দলা হয়ে, পাঁজরাটা ধুকধুক করে। নীলিমা আরও একটা বস্তা চাপা দিয়ে দেয় ওর গায়ে,আহা!কেষ্টর জীব! জলের ছাঁট থেকে তো বাঁচুক। রাতটা যেন ঝঞ্জঝা বিক্ষুদ্ধ অতল সমুদ্রে দিশাহীন এক পালছেঁড়া জাহাজ। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে জাহাজের গায়ে,টাল সামলে ভেসে যাচ্ছে কোন এক অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে। নীলিমা কাঁথাখানা গায়ে জড়িয়ে বসল।লাইট নেই, ঘরের কোণায় হ্যারিকেনটা টিম টিম করে জ্বলছে। দরজার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে হাওয়ার ঝাপটা হ্যারিকেনের শিখাটাকে কাঁপাচ্ছে, দেওয়ালে আবছা কদাকার ছায়ার দোলন। রাত গভীর হয়েছে,জানালা খুলে রাতের তল পাওয়া মুশকিল। মশারির মধ্যে একটা পোড়া কাঠের মত শুয়ে রয়েছে ননীবালা।বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে প্রাণটুকু আর সাঁ সাঁ আওয়াজে বোঝা যায় শ্বাস প্রশ্বাসের আনাগোনা শব্দ।
বৃষ্টিটা কি আরও বাড়ল? দমকা হাওয়ায় কি নড়ে উঠল রান্নাঘরের জানালাটা? মোতি অঘোর ঘুমে…বাইরে একটা খস খস আওয়াজ টের পাওয়া যাচ্ছে, একটা গুনগুন সুর শোনা যাচ্ছে। নীলিমা শ্বাসরোধ করে কান পেতে রইল। হু, মোতি মৃদু স্বরে কেঁউ কেঁউ করে কিছু আপত্তি জানাল। এই টানা বারান্দাটায় ওর মৌরসিপাট্টা, জন্ম থেকে এই বারান্দাটায় ওর অবাধ গতিবিধি। ওর মা টুনি এই বারান্দার কোণে তিনবার বাচ্চা বিইয়েছে। তারপর একদিন টুনি কোথায় হারিয়ে গেল, রয়ে গেল মোতি। কিন্তু মোতির রাজত্বে এখন একজনের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।রাত্রি বেলায় জায়গার দখলদারি নিয়ে দুটি প্রাণীর মধ্যে রেষারেষি আছে টের পায় নীলিমা।কোন এক দুর্নিরীক্ষ্য রাতে বারান্দার আশ্রয় নেয় এক আগন্তুক-অচিন্ত পাগলা।ওকে কেউ চেনে না তাই লোকে ডাকে অচিন্ত বলে, স্টেশনের টিকিটঘরের ছাউনিতে ওকে দেখতে পাওয়া যায়। মাথা জুড়ে উকুন-ভরা অবিন্যস্ত চুল।ময়লা চিরকুট্টি মারা গায়ের চামড়া,বড় দাড়ি আর ঘোলাটে লাল চোখ।কিন্তু ভারি মোলায়েম মনোহর হাসিখানি, ছেলেমানুষীতে ভরা। নীলিমা যেদিন অ্যালুমিনিয়াম থালা ভরে পান্তা আর কাঁচালঙ্কা দেয় অচিন্ত দু-চোখ তুলে এক চমৎকার হাসি হাসে। ঘোলাটে চোখ দুখানা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ভাত খাওয়ার পুলকে।নীলিমা তখন কেমন লজ্জা পায়। একটা গা শিউরে ওঠার অনুভূতি জাগে। রাতের বেলায় যেদিন যেদিন অবিনাশ বাড়ি ফেরে না, শাশুড়ি ননীবালার হাঁপের কষ্ট বাড়ে। মনে হয় রাতটুকু আর পার হবে না তখন বাইরে অচিন্তর গুনগুন গান আর পায়ের খস খস আওয়াজখানি ভর করে রাতটা কাবার করে নীলিমা। একজন মানুষের অনস্তিত্বের দহন কিছু শব্দ কেমন ভুলিয়ে রাখে!
চিতলদিঘির পশ্চিমপাড়ে একটেরে বাড়ি,দু পাশে বুনো ঝোপ আর জঙ্গল। বর্ষাকালে সাপ ব্যাঙ ঘর দিয়ে যাতায়াত করে। অচিন্ত মাঝে মাঝে স্টেশনের আশ্রয় ছেড়ে এ বাড়ির বারান্দায় মাথা গুঁজে। তিন দিন হয়েছে অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে অবিনাশ হুমড়ি খেয়ে অচিন্তের গায়ে পড়েছে।তীব্র ঘৃণায় সজোরে লাথি কষিয়েছে অচিন্তের গায়ে। চিৎকার করে বারান্দা থেকে হটিয়েছে। কিন্তু তাও পাগলটা বারে বারে ফিরে আসে, অবিনাশ ঠোঁটের কোণে হেসে বলে, তোমার রসের টানে আসে। নীলিমার বিবমিষা জাগে। আবার অনেকদিন ও ফেরার থাকে। নীলিমা ভাবে কোথায় যায়, কেন যায়? শেষ দুপুরে পুকুরে দুটো ডুব দিয়ে এসে খেতে বসে। ঠান্ডা কনকনে দুটো ভাতের পাতে ডাল আর পুঁইশাকের ঘন্ট দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে জাহাজঘাটার কথা মনে পড়ে নীলিমার। দু পাশে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি পার করে গঞ্জের বাজার, কলোনীর টালির চাল দেওয়া, পলেস্তারাবিহীন ইটের বাড়িগুলো নীলিমা চোখ বন্ধ করে দেখতে পায়। দেখতে পায় হাইস্কুলের ইতিহাসের টিচার নীলকান্ত স্যানালের ছোট ছেলে সুকুমার স্যানালকে,যে বলেছিল, নীলু, আমার দিকে তাকা। আমার চোখের তারায় তোর সব প্রশ্নের উত্তর লেখা আছে। অথচ কিছু প্রশ্নের জবাব আজও পায় না নীলিমা। যেমন কোন এক বসন্ত পূর্ণিমার রাতে, হোলির দিন বিহারী মাল্লাদের ভাঙা জাহাজের অন্ধকারে নীলিমার শরীর আর মন কেড়ে নিয়ে শহরে গিয়ে আর কেন ফিরল না সুকুদা? রেখে গেল এক সমুদ্র প্রতীক্ষা আর অবসাদ। আজও বেড়ার গায়ে ভেজা শাড়ি মেলতে গিয়ে দূরে কোথাও জাহাজে ভোঁ শুনতে পায় নীলিমা। অচিন্ত পাগলার থুতনির ভাঁজে আর হাসিতে কি সুকুমার স্যানালের আদল খুঁজে পায় ও?
সে রাতটা কখনো নীলিমা ভুলতে পারবে না যেদিন নীলিমা জানতে পারল অবিনাশ সোদপুরের বিস্কুট কারখানার পাশে বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে আর একটা সংসার পেতেছে,ওর ছেলেও হয়েছে। সে ছিল এক রি রি কাঁপানো করাল শীতের রাত।ভিষণ কনকনে ঠান্ডা, ঘন কুয়াশা চাদর পেতে বসেছিল চিতলদিঘির ওপর, সর্ষে ক্ষেত জুড়ে। অসহায়ত্বের অপমানে সে রাতে নীলিমা সারা রাত ঠক ঠক করে কেঁপেছিল।বাইরের শীত যেন ছুঁচের মত তীক্ষ্ম দাঁত ফুটিয়ে দিচ্ছিল ওর হাড়ে। কম্পিত হচ্ছিল শীত আর এক অবরুদ্ধ শোকে। মনে হচ্ছিল রাতটা আর শেষ হবে না আর ও পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে, আর এক চুল এগোলে নিশ্ছিদ্র অনন্ত গহ্বর। মশারির নীচে ননীবালার উসখুসানি আর হাঁপের টান যখন নিশ্চুপ হয়ে গেল তখন নীলিমাকে এক প্রচন্ড ভয় জড়িয়ে ধরল। চারদিকের দেওয়ালগুলো গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে, জাপ্টে ধরতে চাইছে ওকে। অসম্ভব আতঙ্কে নীলিমার দু চোখ জল থৈ থৈ। সে মুহূর্তে ওর শ্রবণ উতকর্ণ হয়ে রইল বাইরের কোন পায়ের শব্দের জন্য। ঐ টুকু জৈবিক শব্দের উৎসটা স্বীকার করে ও গভীর গহীন রাতটা পার করতে পারবে এইটুকু ভরসা ওর আছে। এই শীতার্ত রাতে মানুষের অস্তিত্বের ওম যে বড় প্রয়োজন। প্রায় সারা রাত শ্রান্তির শেষে একটা শব্দ কানে এলো।পরিচিত আওয়াজ।মোতির ডেকে ওঠা, ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে আহ্লাদী আবেশ মিশ্রিত সুর আর একটা খস খস শব্দ। মানুষটা এসেছে, অচিন্ত পাগলা এসেছে এই নির্ভরতায় শ্রান্ত মাথাটা বালিশে রেখে চোখ দুটো বুজল নীলিমা, শেষ রাতে!
ভোরে উঠে দেখে অচিন্ত নয়,মোতি চটের বস্তাটা ভাগ করে নিয়েছে আর এক আগন্তুকের সাথে,তার সঙ্গিনী আর এক নেড়ির সঙ্গে। এই দুটোকে ইদানীং ছেঁচতলায় ঘুরঘুর করতে দেখা যাচ্ছিল। নীলিমা মায়াভরা চোখে দেখল দুটিকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত