| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

গল্প: অহিংসা পরমো ধম্ম । নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

আনুমানিক পঠনকাল: 14 মিনিট

(লেখাটি সম্পূর্ণ কল্পনা প্রসুত। ঐতিহাসিক নয়।  )

১ 

চন্দ্রহীন সন্ধ্যাবাতাসে সূর্যের প্রবল উত্তাপের গন্ধ। অশ্বারোহীরা এতটা উত্তাপের কথা চিন্তা করেনি।দীর্ঘপথে জলের দেখা নাই।অবশেষে এই শীর্ণ নদী খাত।মাধব চারখানি অশ্ব কে জলপান  করাবার জন্যেমজে আসা নদীর ধারার ঢালুতে নেমে   গেছে  পেছনে অন্য তিন জন।সারাদিনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে এই অজানা গ্রামের পাশে বিশ্রাম নেবার সিধান্ত নিল মাধবের প্রভু জয়সেন।জয়সেন কে রাজা ডেকেছেন দক্ষিনের দ্বীপরাজ্যে গমনের সময়রাজপুত্রের সাথে যাবার জন্যে। জয়সেন রাজার অন্যতম সহায়ক তার প্রতিপত্তি যথেষ্ট তবু সে সন্তুষ্ট নয়।রাজা ভগবান বুদ্ধের শরণে এসেছেন। জয়সেন দেবী পুজক। তার পক্ষে এই অহিংসা’ মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।  তাই মাধবের প্রভুকে নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকে,

রাজাদেশ কে অশ্রদ্ধা করা অশুভকর হতে পারে অন্য যে দুজন আছে তার মধ্যে একজন সহায়ক উদ্ভবঅন্যজন দেহরক্ষী দীর্ঘবাহু।তারা জয়সেনের সাথে সে ভাবে লিপ্ত নয়। কিন্তু মাধব জানে জয়সেনের জীবনের বহু দুঃখবহু ভ্রান্তি। রাজার সাথে  মতের মিল না হলেওসে রাজাকে ত্যাগ করে না। একসময় রাজা তাঁকে বড় স্নেহ করতেন।জয়সেন তার দক্ষতা আর বীরত্ব দিয়ে সকলের সমীহ আদায় করে থাকে। মাধবকে অকারণে প্রচুর তিরস্কার করেতবু মাধব ভিন্ন আর কারো ওপরে জয়সেন নির্ভর করতে পারে না। জলপান করে নদীর জলে গা ডুবিয়ে বসে রইল সকলেই।আকাশে ছোট ছোট আলোর বিন্দুর মতো তারা উঠছে।সূর্যাস্ত হয়ে যাবার ফলে উত্তাপ ধীরে ধীরে কমে আসছে। সম্পূর্ণ নগ্ন দেহে জল থেকে উঠে দাঁড়াল জয়সেন।আজ তার এই বিরাট আকাশের নীচে বড় আনন্দ হচ্ছে। মাধব আর উদ্ধব গ্রামে খাদ্যের জন্যে যাবে স্থির করল।গ্রাম্য মদিরার খোঁজ করতে বলল জয়সেন। চমকে উঠল মাধব। সে জানে মদিরা আসল কথা নয়। আসলে আজ প্রভুর নারীর খুব প্রয়োজন এই গ্রামে নারী খুঁজলে গ্রামবাসীর হাতের প্রহার নিশ্চিত। কোন বণিক প্রধান  অঞ্চল,কিংবা যোদ্ধাদের থাকার জায়গা হলে আসেপাশে  খুব স্বাভাবিক ভাবেই পেশাদার বিনোদিনী পাওয়া যায়। সামান্য গুটি কয়েক ঘরের জনপদ। এখানে খোঁজ করবে কি করে! উদ্ধব ব্যাপারটা আন্দাজ  করে।স্যাঙ্গাত হেতুমি খোঁজ কর আমি খাবার ,মদিরা সব জোগাড় করে ,কাঁধে করে একাই নিয়ে চলে যাচ্ছি।” খ্যা খ্যা করে দাঁত বার করে হাসতে থাকে সে।খুব অদ্ভুত ভাবে খাদ্য আর মদিরা দুই অনায়াসে পাওয়া যায়।  ছোট একটি উঠান ওয়ালা ঘরের সামনে বসে থাকা একজন ধূমপায়ী কে বলে ফেলল মাধবতাদের নারীর প্রয়োজন”  লোকটি উদাসীন ভাবে এক বৃদ্ধা কে নির্দেশ করল। বৃদ্ধা ঘরে ঢুকে গেল । একটি রোগা কন্যা কে নিয়ে এল। সে ঘুম ভেঙ্গে উঠে চোখ মুছতে মুছতে পরনের কাপড় ঠিক করতে করতে মাধবদের সাথে যাত্রা শুরু করল মাথায় চুড়ো করে চুল বাঁধা। মাথায় বেশ ছোট। চেহারা দেখে মনে হল এখনো ঠিক বড় হয়নি।

 মদিরা আর খাদ্য পেটে যেতেই চনমনে হয়ে উঠেছে জয়সেন। আজ সে পুরুষ। শুকনো ঘাসের একটা শোবার জায়গা করে দিয়েছে উদ্ধব। মেয়েটিকে পাঠাল মাধব। এবার একটু দুরের ঝোপের আড়ালে সে আর উদ্ধব গড়িয়ে নেবে কাল আবার দীর্ঘ যাত্রা। উদ্ধব কেবল ফিকফিক করে হাসে। তার পৌরুষ একটুতেই টলে যায়। সে অন্ধকারে একায় হাতের মুঠোয় সম্ভোগ করে । মাধবের আজকাল অত দ্রুত ইচ্ছা হয় না। সে চোখ বোজার চেষ্টা করে। দেহরক্ষী দীর্ঘবাহু বহুক্ষন নাক ডাকছে । প্রচুর জোনাকি। মাটি থেকে ভাপ উঠলেওএতো ক্লান্তি যে ঘুমে  চোখ জুড়িয়ে আসছে। আচমকা চিৎকারে মাধব আর দীর্ঘবাহু তড়িঘড়ি উঠে পড়ে।জয়সেন চিৎকার করছে, “ তুমি এ কাকে এনেছ মাধব। একটা পুচকে মেয়ে। এ কে ফেরত দিয়ে এসো। আমার শক্ত সমর্থ কাউকে চাই এ তো কিছু জানে না।রমণী বোঝযার ক্ষমতা আছে আমাকে নেবার।”  মেয়েটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মাধব আরও একটা মশাল জ্বালায় মেয়েটিকে উঠতে বলে। জয়সেন কে মৃদু সে স্বরে বলে, “প্রভু আপনার উপযুক্ত এখানে কাউকে পাচ্ছি না,ক্ষমা করবেন।” জয়সেন নিজের আচরণে একটু লজ্জিত হয়।  “একে সাবধানে রেখে এসো” । মাধব জানে জয়সেন আসলে একাধারে বীর যোদ্ধানিষ্ঠুরঅকারণ জেদি অন্যদিকে কোথাও খুব একা একজন।হয়ত তার প্রেমের প্রয়োজন হয়!

মেয়েটিকে ফেরত দিতে গিয়ে অবাক হয়ে যায় মাধব। সেই বৃদ্ধা খুব দুঃখিত হয়ে যায়। অতিথির ঠিক মত সম্মান করা গেল না। মাধব অবাক হয় আর বুঝতে পারেসে জনপদটিকে গৃহস্থ আবাস মনে করছিল আসলে তা নয়।মশালের আলোয় রাস্তা দেখে দেখে ফিরে যাওয়ার সময় মাধব বুঝতে পারল তার পেছনে কেউ আসছে। সে সাবধান হল। তড়িৎ গতিতে ঘুরে দাঁড়ায় মাধব। পেছনে একটি নারী মূর্তি। সে খল খল করে হেসে ওঠে। মাধবের যোদ্ধা সুলভ কাঠিন্য আহত হয়। কে তুমি?” ঢোঁক গিলে  শুকনো গলায় মাধব জিজ্ঞাসা করে। “ আমাকে নিয়ে চল ,তোমার প্রভুর কাছে।আমি পারবো” নারী কন্ঠে দাপটের সুর। কণ্ঠস্বরে কি একটা চেনা ব্যাপার আছে। কিন্তু মুখাবরনের আড়ালে মুখটি দেখতে পায়না মাধব মন কেমন করা একটা ভাব এনে দিল। পায়ের তলায় অসমতল মাটির ওপর হাঁটতে হাঁটতে ফিরছে মাধব। গাছে কি এক অদ্ভুত ফুলের গন্ধ।যাওয়ার সময় পায়নি তো!

  অন্ধকারে জয়সেনের বিরাট দেহ নিয়ে পায়চারি করার আবছায়া অবয়ব দেখা গেল।নারী কণ্ঠ বলল, “তুমি গিয়ে বল অপেক্ষা করতেআমি আসছি। মশাল নিভিয়ে দাও। দূরে চলে যাও।” মাধব অন্য সময় হলে এর কথা শুনত না। সে আজ যেন ভেসে যাচ্ছে। যন্ত্রের মত জয়সেন কে এই কথা নিবেদন করে আড়ালে চলে গেল। মশাল নিভিয়ে দেওয়াতে অন্ধকার গাঢ় হল।জয়সেনের শরীরের খুব কাছে একটি নিঃশ্বাস ফেলার হাল্কা শব্দ। জয়সেন অবাক হয়।দুহাত এগিয়ে নারীদেহ স্পর্শ করে। হাতের আঙুলে আঙুল লাগতেই জয়সেনের অপূর্ব এক আনন্দ হয়। নারীদেহ খুব কাছে আসে। বহু নারী সঙ্গ করেছে জয়সেন। কিন্তু এ নারী শুধু দেহ নিয়ে আসেনি। কোথাও যেন  সেই কিশোর বেলার কদম্বগন্ধী প্রেম। নারী জয়সেনের বুকে মাথা রাখে। গ্রাম্য রমণীর মাথার চুলে এ কোন ফুলের গন্ধ! গভীর চুম্বনে এ কোন মানবী এ ওষ্ঠ কি জয়সেন আগে পাণ করেছে?সারা শরীর জুড়ে  প্রেম নামে। শুধু স্তনজঘন,যোনি নয়জয়সেন ঘোর অন্ধকারে এ অজানিত নারীদেহ থেকে হৃদয় জুড়ে কাউকে পায়। যেন কতকালের চেনা কেউ অপেক্ষায় ছিল তার জন্যে। “ তোমার মুখ দেখতে চাই আমি” চুম্বন শেষে জয়সেন বলে । জয়সেনের প্রসারিত বুকে হাত রেখে নারী  বলে , “ না দেখায় ভালোঅন্ধকারে অনেক কিছু বেশী সুন্দর হয়ে ওঠে যেমন তোমাকে আমি দেখেছি স্নান করার সময়। তখন যত ভালো লেগেছিল তার চেয়ে অনেক গুণ ভালো লাগছে।পরিহাসে এ নারী দক্ষভয় পায় না। জয়সেন দুহাত দিয়ে তার মুখ তুলে ধরে  হাতে।দেখবার চেষ্টা করে তার মুখের অবয়ব। খুব দ্রুত হাত  সরিয়ে দেয় সে,“ এবার আমি ফিরবো। তুমি ঘুমিয়ে পড়।” জয়সেন হাত চেপে ধরে, “এতো তাড়াতাড়ি তোমায় ছাড়ি কি করেভোরবেলা আমি তোমায় ঘরে দিয়ে আসব। তোমার বাড়ির লোকেদের বলব আমার তোমাকে পছন্দ হয়েছে।আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই”  “আমি তোমার সাথে যেতে চাই না।” নারী মধুস্বরে বলে ওঠে। জয়সেন দুহাতে তাকে আবার ধারণ করে,আবার উপগত হয় যেমন দিগন্তরেখা তে ভুমি আর আকাশ মিশে যায়।

    ঘুম ভাঙে জয়সেনের। সূর্য উঠে গেছে। ঘোড়া প্রস্তুত করে মাধব দাঁড়িয়ে আছে। জয়সেন বিরক্ত হয়। এতো দেরী হওয়া ঠিক হল না। সে সকালে পূজা করে। এখন পুজার সময় নেই । খুব দ্রুত তৈরি হল সে। রাতে একজন নারী যে তার কাছে এসেছিলসেটা এখন নিছক স্বপ্ন। শিশির যেমন সূর্যালোকে অস্তিত্বহীন হয় এই নারীর ও আর কোন ছাপ নেই। চারটি ঘোড়া পূর্ব দিকে রওনা দিল।            

   

প্রার্থনা শেষে ঋজু ভাবে বসলেন ভিক্ষু নিগ্রোধ কুমার।মন একটু উচাটন। ভগবান বুদ্ধের স্মরণ করতে গিয়ে অদ্ভুত ভাবে তার মায়ের কথা মনে এলো। মা তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। নিজের দীর্ণ অতীত জানেন নিগ্রোধ কুমারকিন্তু বিচলিত হন না। কারণ তিনি সঙ্ঘের শরণ নিয়েছেন। তাঁর পিতা রাজ-সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। পিতামহের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার নিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। বীভৎস ভাবে পিতার মৃত্যু হয়। নিগ্রোধ কুমার তাঁর পালিতা মাতার মুখ থেকে শুনেছেন সে কথা। তাঁর গর্ভবতী মা পিতার রক্তস্নাত দেহ দেখে মূক হয়ে গিয়েছিলেন। অজাত সন্তানের জীবনের জন্যে কোন ভাবে পালিয়ে আসেন। একটি নিগ্রোধ বৃক্ষের নীচে সন্তানের জন্ম দেন। নিগ্রোধ কুমার নাম সেই জন্যেই দেওয়া। নামকরণ হবার আগেই তিনি মারা যান।একদল বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিক্ষুণী নিগ্রোধ কুমার কে উদ্ধার করে গ্রামের এক পরিবারে দিয়ে আসেন। অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করেন না  ভিক্ষু নিগ্রোধ কুমার। তিনি কেবল সত্য খুঁজে চলেন। আত্মানুসন্ধান করেন দুঃখ নিবৃতির।  সমস্ত অসহ্য থেকে ক্ষমাশীল হবার প্রচেষ্টা করেন তবুও একমনে  শরণ করলেই মাতৃমূর্তি এসে দাঁড়ায়। কি বলতে চান মা। তাঁকে দেখবার জন্যে মন তৃষ্ণার্ত হয়। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সব হারিয়ে যায়। নিগ্রোধ কুমার চোখ খুলে তাকিয়ে দেখেন ঘরে সকালের আলো। নিগ্রোধ কুমারের  সেবক ভিক্ষু কনাদ এসে দাঁড়াল। খুব শান্ত স্বরে সে বলল, “মহারাজ এসেছেনআপনি বাইরে আসবেন! না তাঁকে ভেতরে ডাকব।” নিগ্রোধ কুমার উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বাইরে গিয়ে রাজা কে আপ্যায়ন করলেন। একটি শিলা নির্মিত উচ্চস্থানে রাজা কে বসতে বললেন। বদ্ধ হস্তে রাজা আনত হলেন। নিগ্রোধ কুমার রাজার গুরু। দুজনেই নানান বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন। রাজার শরীরে বহু অস্ত্রাঘাতের দাগ। বার বার চোখ চলে যাচ্ছে সেই দাগ গুলির ওপরে। নিগ্রোধ কুমারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভিক্ষু কনাদ কনাদের দিকে রাজা তাকালেন। কনাদের বিরাট চেহারাশান্ত চোখ দেখে রাজার ভালো লাগে। পুত্র কে দক্ষিন দ্বীপ রাজ্যে বুদ্ধের কথা প্রচার করতে পাঠাবেন। নিগ্রোধ কুমারের বয়স রাজপুত্রের চেয়ে মাত্র দুই মাসের অধিক। রাজা একাধারে তাঁর কাছে নিজের আধ্যাত্মিক জীবন সমর্পণ করেছেনঅন্যদিকে রাজপুত্রের মত তাঁকে স্নেহ করেন। ভিক্ষু কনাদ ভিক্ষু নিগ্রোধ কুমারআর মহারাজা একসাথে বুদ্ধের শরণে প্রার্থনা করলেন।রাজা শিলালেখ করতে দেবেন ভগবান বুদ্ধের বানী। সেই গুলি নিগ্রোধ কুমার কে দেখতে বললেন। স্থপতি আর লিপিকার দুজন ভিক্ষু নিগ্রোধ কুমারের পায়ের কাছে আনত হলেন। স্বস্তি বচন দিয়ে ভিক্ষু নিগ্রোধ কুমার তাদের কিছু নির্দেশ দিলেন। রাজা ধীরে ধীরে প্রত্যাগমন করতে গেলেন। আর অশ্ব সঞ্চালন করতে পারেন না। তাঁর রথ আছে। একসময় প্রবল সাহসী যোদ্ধা ছিলেন।শরীরে বয়স ছোবল বসিয়েছে।বাহু শিথিল হয়েছে।কে বলবে এই রাজা তাঁর পিতার হত্যাকারী। সেই ভয়ানক উত্তরাধিকার যুদ্ধের একমাত্র বিজয়ী।  

      নিগ্রোধ কুমারের আজ কেবল মন চঞ্চল হচ্ছে।তাঁর মা তাঁকে কি বলতে চান! সামনে বিরাট পদব্রজে যাত্রা আছে। দক্ষিনের দ্বীপরাজ্যে যেতে হবে। তিনি নিজে সেখানে আদৌ পৌছাতে  পারবেন কিনা জানেন না। কিন্তু প্রতিনিধিরা যাতে যেতে পারেন সে চেষ্টা করতেই হবে। ভিক্ষু কনাদ চুপ করে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।আমি কিছুদিন একটু একান্ত চাই কনাদ।” নিগ্রোধ কুমার তার দিকে তাকিয়ে বলেন। কনাদ মাথা নাড়লেন, “কোথায় যেতে চান বলুন। আমি একা যাবকেউ যাবে না।” নিগ্রোধ কুমার উত্তর দেন।কনাদ মাথা নেড়ে মেনে নেন।

                         সন্ধ্যা হবার আগেই নিগ্রোধ কুমার একা যাত্রা করলেন।

কনাদের ইচ্ছা ছিল না একেবারে একা নিগ্রোধ কুমার কোথাও যাত্রা করুন। কিন্তু কনাদ বুঝলেন তার মতামত দেওয়া উচিৎ হবে না। রাজধানীর বাইরে ছোট উপবনে এখন কেউ যায় না। সকলের চোখের আড়ালে  সেখানে যেতে চাইছেন তিনি।আত্ম- জিজ্ঞাসার শেষে কি আছে সেটা এখন না জানলে আর বোধহয় সময় পাওয়া যাবে না। ভগবান বুদ্ধ নিজের মনের সত্য জানতে বলেছেন। নিগ্রোধ কুমারের যাত্রা পথে অজস্র নুড়ি পাথর। তিনি নদীর শুষ্ক জলধারার পাশেই কোথাও বসবেন। মনে আশা নিশ্চয় আজ তিনি নির্দেশ পাবেন। শুকনো বুনো ফুলের অজস্র গুঁড়ো গুঁড়ো রেনু বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। পাথরের গায়ে শ্যাওলা শুকিয়ে আছে। একটি ঘাস পূর্ণ জমি পেলেন নিগ্রোধ কুমার। এখানে বহুক্ষন বসে থাকতে অসুবিধা হবে নাশান্ত হয়ে কিছুক্ষন প্রকৃতির দিকে তাকালেন। আকাশে এখনো আলো আছে। মন নিবিষ্ট করে পদ্মাসনে বসলেন।জনহীন এই শুষ্ক ঘন বনাঞ্চলে তিনি যে একান্ত চেয়েছিলেন  তাই পাওয়া যাবে মনে হয় তবে দূরে তাঁকে লক্ষ্য রেখে একজন পুরুষ অর্জুন গাছের ওপরে উঠে গেল। সে শ্যেন দৃষ্টিতে তার ওপর নজর রাখছে।ভিক্ষু জানলেন না।

আর বেশী পথ নেই মধ্য রাত্রির আগেই রাজধানী প্রবেশ করতে পারবে জয়সেন ক্লান্ত হলেও জয়সেন বিরতি চায় না। সামনে বিরাট রুক্ষ প্রান্তর। বৃষ্টি হলে এখান দিয়ে এভাবে যাতায়াত করা যায় না। কারণ বিরাট বিরাট ঘাসের জঙ্গল হয়ে যায়। সেই সময় অনেক শ্বাপদ আর দস্যুর এখানে উপদ্রব হয়। এখন সম্পূর্ণ রিক্ত ভূমি রাস্তা অনেক টা কমে গেল। আচমকা সামনে ছোটা অশ্ব টি সহ আরোহী উদ্ধব উল্টে পড়ে গেল। দীর্ঘবাহু মুহূর্তে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। জয়সেন চমকে ওঠে হঠাৎ যেন মাটি ফুঁরে উঠে দাঁড়ায়তিনটি তিরধনুক হাতে শীর্ণ শরীর। মাটিতে এভাবে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে তা আশা করেনি । একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ। জয়সেন চিনতে পারল। সেও হেসে ফেলল।দাক্ষায়নএ রসিকতার মানে কি?” জয়সেন দ্রুত মাটিতে নেমে এগিয়ে যায়। উদ্ভব উঠে দাঁড়িয়েছে।একটি তির অশ্বের পায়ে আঘাত করেছে। মাধব অত্যন্ত বিরক্ত হল। দাক্ষায়ন খুব ধুরন্ধর যোদ্ধা। এক কালে বহু যুদ্ধকেবল তার কৌশলের ওপর নির্ভর করে জিতিয়ে এনেছে জয়সেন। কিন্তু রাজার সাথে দাক্ষায়নের মত মেলে না। জয়সেনের সাথে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয় দাক্ষায়ন। আমি জানতাম তুমি এই পথে আসবে।” দাক্ষায়ন বলে। অশ্বের শুশ্রূষা করতে থাকে মাধব। দীর্ঘবাহু অস্ত্র নামায় না। কারণ দাক্ষায়ন কে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তুমি একটা দিন আমার সাথে কাটাওজয়সেন। অনেক কথা জমে আছে। বন্ধুর কি বন্ধুর প্রতি কর্তব্য নেই?” দাক্ষায়ন পরিহাস করে বলে। সারাদিনের দীর্ঘ পথযাত্রায় ক্লান্ত জয়সেনের মন টলে গেল। সে নির্দেশ দিল আজকের যাত্রা এখানে বিরতি টানার । মাধব প্রমাদ গোনে। তার আর আজ রাতে ঘুম হবে না।দীর্ঘবাহুকেও সজাগ থাকতে হবে। বেশ কিছু বন্য পাখী হত্যা করেছে দাক্ষায়নের সঙ্গীরা। কিছু বন্য ফল। রাতের এই আহার। আগুনে পাখীর মাংস ঝলসে নিচ্ছিল দাক্ষায়ন। মাধব জানিয়ে দিল সে মাংস খাবে না। দাক্ষায়ন আর তার বন্ধুরা সকলে হো হো করে হেসে উঠল।মাধব বুঝতে পারে এরা রাজার আদেশ মানতে ইচ্ছুক নন। রাজা অকারণে প্রাণীহত্যা নিষিদ্ধ করেছেন। জয়সেন আনন্দ করে মাংস খেলেন। মাধব ছাড়া অন্য সকলে খেল। উদ্ধব জয়সেনের শয়নের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারল না। দাক্ষায়ন তাই নিয়েও পরিহাস করে বললজয়সেন বড় অলস আর আরামপ্রিয় হয়ে গিয়েছেন। জয়সেনের অহংকারে লাগলো। সে রাজার পৃষ্ঠপোষকতাতে বিলাস করে কিন্তু আদ্যন্ত যোদ্ধা। সে উদ্ধব কে বিরত করল। আগুনের চারপাশে হাঁটুর ওপর হাত রেখে নানান কথা হতে লাগল। দীর্ঘবাহু পায়চারী করে শ্বাপদ সঙ্কুল এই স্থানে বিপদের কথা ভেবে।  দাক্ষায়ন জয়সেন কে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করল, “ তুমি রাজার এই অহিংসা’ সম্পূর্ণ মেনে নিচ্ছএটা ভুল হচ্ছে না। বিদেশ থেকে যদি কোন আক্রমণ হয় আমরা আমাদের রক্ষা করতে পারবো?” জয়সেন মাথা নিচু করে শুনতে শুনতে চোখ তুলে তাকায়।সামান্য হাসির রেখা দেখা দেয় তার মুখে। জোর করে কাউকে অহিংসক বানানো যায়আমি কি ভয়ানক হিংস্র তুমি জানো তো!” দাক্ষায়ন রাগত স্বরে বলে, “আমাদের পল্লিতে পল্লিতে লোক পাঠানো হচ্ছে পশু হত্যা বন্ধ করার জন্যে। ছোট বাচ্চাদের  অহিংসা শিক্ষা দিতে বলা হচ্ছে। লোকগুলোকে কি যেন নাম দেওয়া হয়েছে?” পাশ থেকে তার সঙ্গী বলে, “ধর্ম্যামাত্য। “ ঐ দ্যাখো ধর্ম্যামাত্য…আবার এতবড় নামকরণ হাস্যকর। ভেবে দ্যাখোব্যাধের সন্তান আমরা । শিকার ভুলে গেলেঅস্ত্রশাস্ত্র ভুলে গেলে থাকল কি?”খুব দ্রুত বলে চলে দাক্ষায়ন,  “ তারা পল্লীতে এলেই আমি সরে চলে আসি। অসহ্য লাগে। বড় বিপদ এলে কি ভাবে সামলাবে ভাবো।” জয়সেন এতোটা তলিয়ে ভাবেনি। তার যুক্তিযুক্ত মনে হল। সে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলে ওঠে, “এটা ভুল হচ্ছে। আমি রাজার সাথে কথা বলব। উনি আমার কথা শুনবেন।” “ না শুনবেন না। উনি কোনদিন কোন কথা শোনেননি। তাঁর যখন যুদ্ধ ভালো লেগেছে তখন অকারণে যুদ্ধ করিয়েছেন। এখন এক বৌদ্ধ ভিক্ষু কে খুব মনে ধরেছে তাই … সেই ভিক্ষু যা বলে তাই তিনি করবেন।” জয়সেন সম্মতি দিলেন।তুমি রাজদ্রোহ না করঅন্তত কোন উপায় বার কর। এই ভিক্ষুকে সরিয়ে দাও। দেখবে রাজা ধীরে ধীরে বদলে গেছে। তুমি এটা করতে পারো জয়সেন। এটা দেশের জন্যে করা দরকার।” জয়সেন চুপ করে আছে।চুপ থেকো না জয়সেন” দাক্ষায়ন দৃঢ়তার সাথে বলে, “ ভুলে যেও না তুমি দেবী পুজক। তোমার দেবীর মন্দিরে এককালে হাজার ছাগ বলি দিয়ে তুমি তাঁকে তুষ্ট করতে।” জয়সেন উঠে দাঁড়ায়। স্থান ত্যাগ করে হাঁটতে থাকে। দীর্ঘবাহু সাথে চলতে থাকে। দাক্ষায়ন অত্যন্ত রুক্ষ ভাবে চিৎকার করে, “ তুমি ভীতুঅলসআরামপ্রিয় আর অবশ্যই অধার্মিক।” দীর্ঘবাহু রুখে দাঁড়ায়। জয়সেন বিরত করে। দীর্ঘবাহু কে দাঁড়াতে বলে। “ তুমি আমার সাথে একটু একান্তে এসো দাক্ষায়ন।সব কথা সবার সামনে হয় না।” জয়সেন শান্ত ভাবে বলে।দাক্ষায়ন লাফ দিয়ে ওঠে। দীর্ঘবাহু তাঁকে আটকায়। মাধব তার হাত থেকে তির-ধনুক নিয়ে নেয়কোমরে একটি ছোট কিন্তু ধারালো ছুরি ছিল তাও নিয়ে নেয়। জয়সেনের শারীরিক শক্তি যথেষ্ট ,তাই আর ভয় পায় না মাধব। অত্যন্ত রাগত হয়ে বিড়বিড় করতে করতে দাক্ষায়নজয়সেনের দিকে যাত্রা করে।

             বেশ কিছুটা দূরে একটা বজ্রাহত তাল গাছের ভাঙা গুড়ি আছে। তার পাশে বসে জয়সেন। পাশে এসে দাঁড়ায় দাক্ষায়ন। ক্রোধে তার শ্বাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তার দেহ  থেকে পশুর শুকনো চামড়ার গন্ধ বার হচ্ছে বল ,তুমি  কি চাও দাক্ষায়ন?” জয়সেন জিজ্ঞাসা করে। রাজার বৌদ্ধ গুরুর মৃত্যু চাই আমিসে মরে গেলে রাজাকে আর ঐ সব অদ্ভুত বদবুদ্ধি দেবার কেউ থাকবে না।শুকনো ঠোঁট চেটে নেয় দাক্ষায়ন। রাজা কিন্তু সকলকে রক্ষা করার কথা বলছেন। সাধারণ প্রজা খুশি। তাছাড়া নিজের ধর্ম ত্যাগের কথা তো তিনি বলেননি। ভগবান বুদ্ধের প্রতি মানুষের প্রবল ভালোবাসা। সেটা কে কি করে বাদ দেবে?তারা অহিংসা আর বৌদ্ধ ধম্ম দুই জীবনে গ্রহণ করেছে।” জয়সেন বলে। এক সহচরকে আমি পাঠিয়েছি খোঁজ নিতে…  সুযোগ বুঝেই সে যেন আঘাত করে। তুমি কি ভাবছ বা করছ তা নিয়ে আমার বিন্দু মাত্র চিন্তা নেই। তুমি যে আমার কথা বুঝবে না আমি জানতাম! ফুঃ!” দাক্ষায়ন বলে।আমি তোমার সব কথা বুঝতে পারছিভিক্ষু নিগ্রোধ কুমার কে সরিয়ে দিলেই হবে কি?”, জয়সেন উঠে দাঁড়িয়ে যায়। হবেরাজা এমনি নড়বড় করছে।উনি কষ্টে পাগল হবেন। বউ চলে গেছে। সেই দুঃখে এই পুঁচকে গুরু ঠাকুর কে আঁকড়ে ধরেছে। তারপর উত্তরাধিকারী কেউ ঠিক করা নেই। আমি কথা দিচ্ছি এই এলাকার সমস্ত উপজাতিদের দল নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াব।রাজাকে তুমি কারারুদ্ধ করবে। তুমি রাজা হবে। রাজা হবার সব গুণ তোমার আছে। আমি পশ্চিম দেশের অধিকর্তার সাথে দরকার হলে কথা বলব। সে রাজি না হলেও ভয় নেই। তাঁর নীচে একজন অধিনায়ক আছেসে আগের মাসেই আমার সাথে দেখা করে গেছে ” দাক্ষায়ন ঝড়ের মত বলে চলে। জয়সেন হতবাক হয়। “নিগ্রোধ কুমার কে হত্যা করা খুব সোজা,কিন্তু সাধারণ প্রজা তার ওপর ক্ষেপে যাবে!অনেক সেনাপতি আর সেনারাও বিপক্ষে চলে যেতে পারে।  ” জয়সেন শুকনো গলায় বলে চলে।সেইজন্যে তো তোমাকে বলছিতুমি খুব সহজে এটা করতে পারবে। তোমাকে কেউ সন্দেহ করবে না।একটা সুযোগ পেলেই আড়াল থেকে …” হিস হিস করে বলে চলে দাক্ষায়ন।  জয়সেন অবাক হয়। সে এভাবে কেন ভাবতে পারে না। রাজা তাকে খুব স্নেহ করে। কিন্তু সেটা তো কাজের সম্পর্ক। সে দেশের শাসক হতে পারে!আগুনের মতো বুকের মধ্যে টা পুড়ে যাচ্ছে। কেউ তাকে শাসক হিসাবে ভাবছে! রাজার সিংহাসন তার হতে পারে। জয়সেন নিজেকে রাজ সিংহাসনে দেখতে পায় দাক্ষায়ন কে কথা দেয় সে নিগ্রোধ কুমার কে শেষ করবে। আর রাজার দুর্বলতার সুযোগে অভ্যুথান ঘটাবে। দাক্ষায়ন তৈরি থাকবে। মাধবউদ্ধবআর দীর্ঘবাহুকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে হবে। এই বিরাট রাষ্ট্রের সে অধিকারী হবে। এবার তার মস্তিষ্ক আর পারছে না। ঘুম আসছে। দাক্ষায়ন আর তাঁর সঙ্গীরাও শুয়ে পড়ল। দীর্ঘবাহু আর মাধব জেগে থাকার চেষ্টা করলেও ঘুমিয়ে পড়ল।

          

 ঘুমের মধ্যে মাধবের আচমকা দম বন্ধ হয়ে আসে তার বুকের ওপর প্রবল চাপ কোন রকমে চোখ খোলে মাধব দেখে বুকের ওপরে জয়সেন ,তার গলা টিপে ধরেছে মাধবের দীর্ঘ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা  বিশেষ কৌশলে জয়সেন কে সরিয়ে দিতে পারে অন্ধকারের মধ্যে অন্য সকলে উঠে দাঁড়িয়েছেদীর্ঘবাহু অস্ত্র হাতে নিলেও সে মাধব কে আক্রমণ করে না। সে জানে মাধব অতি মাত্রায় বিশ্বস্ত। বেশ কিছুক্ষন খক্‌ খক্‌ করে কাশে মাধব। তারপর চিত হয়ে শুয়ে থাকা জয়সেনের কাছে যায়।“ কি ,অপরাধ আমার প্রভুআমি কি করেছি?” সে ভাঙা গলায় জানায়। জয়সেন গোঙাতে গোঙাতে বলে, “তুই কাকে কাল রাতে আমার কাছে এনেছিলি মাধবকাকে?” “আমি জানি নাঐ অন্ধকারে আমি দেখিনি”, হতবাক মাধব নিচু স্বরে বলে। সে আমাকে কিছুতেই ঘুমাতে দিচ্ছে না।তাকে কি আমি আগে থেকে চিনি। সে সারাক্ষন আমাকে ডাকছে। আমি তাকে জানতে চাই। ” “আমি সত্যি তাকে চিনি না।” মাধব বড় কাতর স্বরে বলে। উঠে বসায় জয়সেন কে।যেটুকু জল তার কাছে ছিল সেটুকু পাণ করায়। সকলে নিশ্চিন্ত হল। মাধব পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। আমি কি তাকে চিনি মাধব। আমার স্থির বিশ্বাস একে আমি চিনি। কিন্তু কেতুমি ফিরে যেতে পারবে সেখানে। খুঁজে দেখবে?” মাধব কে তুই’ সম্বোধন করে না জয়সেন।খুব সন্তর্পণে এ কথা গুলি বলে জয়সেন। এখন রাজধানী তে আপনার পাশে আমার থাকা দরকার। আপনি দ্বিপরাজ্যে যাত্রা করলে আমি বরং খুঁজে দেখবো।মাধব বলে।জয়সেন যেখানে শুয়ে ছিল সেখানেই আছন্নের মতো পড়ে রইল। মধ্য বয়সে উপস্থিত জয়সেনের একাধিক স্ত্রীতাছাড়া বহু বিনোদিনী কে মাধব চেনে।অনেক জনের সাথেই অনেক রকম ঘটনা। মন টা আবার উচাটন হল মাধবের। মাধব পাশে বসে রইল। পুব আকাশে লাল রঙ। রাজাধানী আর দুই প্রহরের দূরত্ব। আবার যাত্রার জন্যে তৈরি হল সবাই।

          

  রাজপ্রসাদের একধারে মাধব একটি শিলালেখ জোরে জোরে পড়ছিল, “দেবতাদের প্রিয় রাজা সমস্ত পরস্পর বিরোধী ধর্ম সম্প্রদায়সন্ন্যাসী ও গৃহস্থদের পুরস্কার ও সম্মান দিয়ে থাকেন …মাধব মন খুব নরম হয়। রাজার এই আশ্বাস বানী তাঁর ভালো লাগে। রাজার প্রতি তার অবিচল বিশ্বস্ততা। সেদিন রাতে দাক্ষায়নের সাথে জয়সেনের কথাবার্তা ভালো লাগছিল না। জয়সেন রাজার সাথে সৌজন্যে সাক্ষাৎ করে বার হয়ে এলেন। তুমি বিশ্রামাগারে ফিরে যাও ,আমি একটু ঘুরে আসছি।” জয়সেনের অশ্ব মুহূর্তে চোখে সামনে থেকে অদৃশ্য হল। নিগ্রোধ কুমারের অস্থায়ী আবাসপশু চিকিৎসালয়ের পাশে। নতুন তৈরি পশু-চিকিৎসালয়টি দেখে অবাক হল জয়সেন। নিগ্রোধ কুমারের চেহারাটা দেখতে পাওয়া খুব দরকার। সে চেনে না। এমনি তে সব বৌদ্ধ ভিক্ষুকেই তার এক রকম লাগে। নিগ্রোধ কুমারের সাথে দেখা করা গেল না। তিনি একান্তে কোথাও গিয়েছেন। হয়ত আজ সন্ধ্যাকালে ফিরতে পারেন। নিজে রাজপুরুষ হিসাবে যা কিছু ধারণ করে থাকেন জয়সেন, সেগুলি খুলে অশ্বের পিঠের গোপন পেটিকায় রাখলো। কতগুলি ফলের গাছ লাগানো হয়েছে । তাঁর নীচে বহু মানুষ বসে আছে ।  সেখানে অপেক্ষা করবে বলে মনস্ত করল। মৃদু হাওয়া দিচ্ছে। একটা আছন্ন মত অবস্থা আসে তার। আবার নারী মূর্তি তার শরীরে হাত দেয়। নিজের শরীর উন্মুক্ত করে  মুখের বস্ত্র খন্ড এতো মোটা কেনঅথচ চুম্বন কি নিবিড়। ঘোর দ্বিপ্রহরে কাকে শরীরের গোপনে ধারণ করছে জয়সেন।  চমকে ঘোর ভাঙল। গাছে ঠেস দিয়ে বসে আছে সে। নিজের মস্তিষ্ক ধাতস্ত হল জয়সেনের। হৈমবতীহ্যাঁ সেদিন হৈমবতী এসেছিল। বুকের মধ্যে সব আলো নিভে গেল জয়সেনের। জয়সেনের দ্বিতীয় পত্নী। প্রানোচ্ছল হৈমবতী কে অপহরণ করে বিরুদ্ধ পক্ষ।কুম্ভীর প্রদেশের এক শাসক হঠাৎ খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। জয়সেন সদ্য বিবাহ করে ফিরেছিল। প্রথম পত্নী পিতার অতি স্নেহের জন্যে কখনো জয়সেনের খুব কাছে ছিল না। কিন্তু হৈমবতী তার সব কিছু অকাতরে জয়সেন কে সমর্পণ করেছিল। তাকে এক সন্ধ্যাকালে অতর্কিতে কুম্ভীর এর যোদ্ধারা ঘর থেকে অপহরণ করে। প্রবল অত্যাচার হয় তার ওপর। এক ভোরবেলা হৈমবতী তার ধস্ত শরীর নিয়ে  ফিরে এসে, জয়সেনের কাছে আশ্রয় চায়। জয়সেন দিতে পারেনি।তার পরিবার তার  সমাজ মেনে  নিত না।অশ্রুহীন চোখে জয়সেনের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে কোন কথা না বলে চলে যায় হৈমবতী।এরপর যখন পুনরায় খুঁজতে গিয়েছিল জয়সেন তখন সকলে বলেছিল সে নিজে আগুনে পুড়ে মরেছে। মন মানেনি জয়সেনের। তবে কি সে চরম পরিহাস করে গেল সেদিন।মাধব কেন চিনতে পারেনিমাধব কে পাঠাতে হবে। খুঁজে আনুক হৈমবতী কে। সে সময় তার কিশোর বয়স। সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেনি জয়সেন। এবার তাকে প্রধানা মহিষী করবে । রাজা হবে জয়সেনদেখে নেবে কোন সমাজ কি বলে।যারা হৈমবতীর বিরুদ্ধে এই কোন কথা বলবে তাকে নিজে হাতে গলা কাটবে জয়সেন।দুচোখ বেয়ে অশ্রু নামে তার। সে রাতে কেন চলে গেলে হৈমবতী।একবার যদি বলত।

     না সন্ধ্যাকালে নিগ্রোধ কুমার ফিরলেন না। একদল সুন্দরী অর্ঘ নিয়ে বুদ্ধের পূজা সেরে ফিরে গেলেন। জয়সেন বিশ্রামাগারে ফিরে এসে মাধব কে ডাকলেন। মাধব এসে উৎফুল্ল চিত্তে বললেন, “ রাজার কাছ থেকে লোক এসেছিল। তারা বলেছে আপনার সাথে আমিও দ্বীপ রাজ্যে যাব।আমাকেও ওরা নিতে চায়।” “তুমি আবার ঐ গ্রামে ফিরে যাবে মাধব” জয়সেন বিরক্ত হয়ে বলে। না না আমি আপনার সাথে যাব।।” কথা শেষ হয় না মাধবের। আমরা কোথাও যাচ্ছি না।” দাঁত চিপে জয়সেন বলে।  মাধব অবাক হয়। চুপ করে থাকে। মাধব কে গোটা পরিকল্পনা বলা যাবে না। অন্যভাবে বলতে হবে। মাধবসেদিন তোমার সাথে যার দেখা হয়েছিল তাকে তুমি চিনতে পারনি?আমার দৃঢ় ধারণা সে হৈমবতী! তাকে আমি ফিরিয়ে আনতে চাই। তুমি আর একবার সেখানে যাও। দিনের আলোতে খোঁজ কর। আমি কাজ শেষ করেই সেখানে চলে যাব।” মাধবের থুতনি নেমে যায়। সে বসে পড়ে। আপনি ঠিক বলেছেন। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম।    যেন কতদিনের চেনা। আমি যাব।” জয়সেন নিশ্চিন্ত হয়। বাইরে একজন শবর দেখা করতে এসেছে উদ্ধব এসে জানায়। শবর আর কেউ নয়। দাক্ষায়নের সহচর। সে খোঁজ দেয় উত্তরের উপবনে নিগ্রোধ কুমার ধ্যান করছেন। সব কথায় ইঙ্গিতে হয়।জয়সেন মধ্যরাত পর্যন্ত উচ্চস্বরে তার আরাধ্যা দেবীর মন্ত্র পাঠ করে। হৃদয় থেকে এই কাজে সফলতার জন্যে প্রার্থনা করে। কাজ সমাধা হলে ছাগ শিশু বলি দেবার মনের ইচ্ছা জানায়।

জয়সেন কে এমন কিছু অস্ত্র নিতে হবে যা দেখে বোঝা যায় না যে সেটি কার। তার নিজের সব অস্ত্রেই নিজস্ব একটি চিনহ্‌ আছে। পশুচিকিৎসালয়ের কাছে একটি ছোট ছেলে অনেক ধরণের পশু বেঁধে নিয়ে যাবার  দড়ি কাঁধে ঘুরছে। চমকে উঠল জয়সেন। একজন শীর্ণ, অহিংস মানুষ কে মারবার এর চাইতে ভালো অস্ত্র আর কি আছে! বাছুর বাঁধার সরু আর নরম দড়ি কিনল ছেলেটির কাছে। ছেলেটি খুব উচ্ছসিত হয়ে জানাল এতে নাকি বাছুরের একটুও লাগে না। তাকে একটু বেশী মুদ্রা দিল জয়সেন। সে আরও উচ্ছসিত হয়ে জানাল,আজ সে প্রভু বুদ্ধের জন্যে দীপ জ্বালাবে। আরও অনেক কথা সে বলতে লাগলো। নিগ্রোধ কুমার কে সে অনেক বার দেখেছে। জয়সেন আবার চুপ করে একটা গাছের নীচে বসে রইল। দাক্ষায়নের বিশেষ সহায়ক তার কাছে এল। খুব নিচু স্বরে জানাল তাদের শিকার উপবনে আছে। আর একদম একা। অতএব যাত্রা শুরু করল জয়সেন। বহুকাল পরে খুব উত্তেজিত সে।একজন ছটপট করে মরে যাবে। বহু মানুষের মৃত্যু সে পূর্বে ঘটিয়েছে।বেঁচে থাকার জন্যে শেষ মুহূর্তে মানুষের কি তীব্র ক্ষমতা তৈরি হয় সেটার অভিজ্ঞতা থেকে ভেতরে ভেতরে নিজেকে শান্ত করে জয়সেন।

      প্রায় শুষ্ক জলধারা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে জয়সেন।দড়িটি কোমরে বেঁধে নিয়েছে সে। বিরাট শ্যাওলা ধরা হলুদ রঙের পাথর এর জন্যে সামনের যাত্রা পথ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। জলধারা একটি দিকে ঘাস নুড়ির ওপর উঠে এল জয়সেন। একটু এগিয়ে যেতেই নিজেই অবাক হল। হলুদ পাথরের জন্যে দৃষ্টির বাধা সরতেই সামনে সবুজ জমিতে ভিক্ষুর দেখা পেল জয়সেন।কিশোর চেহারা শান্ত ভাবে ধ্যানে মগ্ন। উন্নত শির, যেন প্রদীপের শিখাস্থির হল জয়সেন। কোমর থেকে দড়ি খুলে দু হাতের মুঠিতে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। গলাতে পেঁচিয়ে চাপ দিলেই কাজ শেষ হবে। খুব ধীর পায়ে এগোতে থাকে জয়সেন। আচমকা পায়ে একটা টান।জয়সেন মুহূর্তের মধ্যে তাকিয়ে একটি বিরাট শরীরের মানুষ কে দেখতে পায়।পাথরের মত তার শরীর। হতচকিত জয়সেন মাথার পেছনে প্রবল ব্যাথা অনুভব করল।              

              সমস্ত প্রহরীরা ছুটে চলেছে ।উত্তরের উপবনে দাবানল লেগেছে। এই শুষ্ক আবহাওয়াতে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে আগুন। ভোর হবার আগেই কি ভয়ানক অবস্থা । পাখীরা সারা আকাশ জুড়ে বিলাপ করছে। কয়েক ঘর শবর উত্তরের উপবনের পাশে থাকে। তারা অনুদ্বিগ্ন ভাবে আগুন দেখছে। প্রহরীরা দেখলএকজন বেশ দীর্ঘকায় ভিক্ষুআর এক ভিক্ষুকে পিঠে করে  নিয়ে আসছে। কাছে চলে এলে বুঝতে পারলো নিগ্রোধ কুমার আর তার একান্ত সেবক কনাদ। সকলে নত হল। নিগ্রোধ কুমার কিঞ্চিৎ আছন্ন। 

     মাধব ঘুম থেকে উঠে জয়সেনের খোঁজ পাচ্ছে না। অশ্বটিও নেই। বিশ্রামাগারের বাইরে এসে জানতে পারলো উত্তরের উপবনে দাবানল। বেলা হতে আগুন নিভু নিভু।প্রহরীরা সকলে কৌতূহলী উপবনের ভেতরে যাওয়া শুরু করল। মাধব ও তাদের সাথে যাত্রা করল। শুকনো নদীর ধারের ওপারে কিন্তু  আগুন যায়নি। আচমকা  সেখানে একটি দেহ দেখে অবাক হল তারা। উত্তেজিত সকলে গিয়ে দেখল একজন রাজপুরুষ। ভিড় ঠেলে মাধব হতবাক হয়ে গেল। জয়সেন ভূলুণ্ঠিত হয়ে আছেনঘাড়টা একটু বাঁকা। শ্বাস পড়ছে না। গা এখনো গরম।

বুকে কান দিয়ে বুঝতে পারে মাধব সব শেষসারা রাজধানী জুড়ে খবর রটে যায়। রাজার একান্ত সহায়ক বীর জয়সেন রহস্য জনক ভাবে মৃত।প্রবল বৈভবের সাথে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হল। মাধব খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করল। দীর্ঘবাহুকে বারংবার তিরস্কার করল।

    নিগ্রোধ কুমার সত্যের খোঁজ পেয়েছেন। ক্ষমা’ ,একমাত্র ক্ষমা হল আসল সত্য। মা তাঁকে ধ্যানের মধ্যে আশীর্বাদ করে গেছেন। প্রকৃষ্ট ক্ষমা ছাড়া আর কোন কিছুই সত্য নয়। রাজা বারংবার নত হলেন বৌদ্ধভিক্ষুর প্রতি।ভ্রাতুষ্পুত্র কে তিনি সব সমর্পণ করেছেন। বড় শান্তি নিয়ে তিনি আজ ফিরে যাবেন। ভিক্ষু কনাদ কে কাছে ডাকলেন।আশেপাশে কেউ নেই।কনাদ মাথা নিচু করে দাঁড়ালেন। “ তোমার ওপর আমার পরম বিশ্বাস ,কনাদ। তুমি না থাকলে একটা অনর্থ ঘটে যেত। এভাবে তুমি সমাধা করেছ তার জন্যে ধন্যবাদ।” রাজা দীর্ঘকায় কনাদের দিকে তাকালেন। কনাদ ধীর কণ্ঠে বললেন, “ আপনি বিশ্বাস রাখুন। আমার দেহে প্রান থাকাকালীন কারো ক্ষমতা হবে না নিগ্রোধ কুমারের গায়ে হাত দেবার।ছায়ার মতো আমি তাঁর পাশে ছিলাম।” রাজা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “ তোমার কোন অস্ত্র লাগবে?” কনাদ অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলে,“আমি কাউকে নৃশংস ভাবে হত্যা করি না।খুব দ্রুত আর তীব্র আঘাতে যে কোন মানুষ মারা যাবে। অস্ত্রের কোন দরকার নেই।” মহারাজ অশোক তার পিঠে হাত রাখলেন।কিন্তু দাবানল?  সেটা কি করে ঘটালেকনাদ। কনাদ মাথা নিচু করলেন, “ওসব আমাদের প্রিয় শবর রা করেছে। আপনি তাদের কে উচ্চ বর্ণের সমান বলে শিলালেখতে জানিয়েছেন। ভগবান বুদ্ধকে ওরা নিজেদের মানুষ বলে মনে করে।”    

            মাধব ধর্ম্যামাত্য হল।রাজা প্রিয়দর্শী অশোকের শিলালেখ সে গ্রামে গ্রামে মানুষ কে পাঠ করে শোনায়। দাক্ষায়নের দল একবার তাকে ভয় দেখিয়েছিল। তাদের ধারণা জয়সেনের মৃত্যুর জন্যে সেই দায়ী। কিন্তু তার কান্না আর একজন শবরের কথায় তাকে আর কেউ বিরক্ত করে না।   

মাধব সেই নাম না জানা গ্রামে এসে হৈমবতীর খোঁজ করে। কেউ বলতে পারে না। তবে সে যখন জানায় যে তার প্রভু মারা গেছে, সকলেই দুঃখ পায়। মাধব কে উৎকৃষ্ট খাদ্য,পানীয় দান করে। ভোরবেলা অশ্ব নিয়ে নিজের দেশে ফেরার সময় নদীর ধারে একজন নারীকে সে দেখতে পায়। সদ্য বৈধব্যের পোশাকে। বড় কুৎসিত এক মহিলা। সারা দেহে পুড়ে যাওয়া ক্ষতের দাগ। হৈমবতী এত খারাপ দেখতে নয়।   

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত