দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান। হীরক রাজার দেশে ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় সংলাপ। রূপকের আশ্রয় নিয়ে চলচ্চিত্রটিতে কিছু ধ্রুব সত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি গুপী গাইন বাঘা বাইন সিরিজের একটি চলচ্চিত্র। এর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে মূল শিল্পীদের সকল সংলাপ ছড়ার আকারে করা হয়েছে। তবে কেবল একটি চরিত্র ছড়ার ভাষায় কথা বলেননি। তিনি হলেন শিক্ষক। এ দ্বারা বোঝানো হয়েছে একমাত্র শিক্ষক মুক্ত চিন্তার অধিকারী, বাদবাকি সবার চিন্তাই নির্দিষ্ট পরিসরে আবদ্ধ। হীরক রাজার দেশে সিনেমার রূপকের আড়ালের সন্ধান করেছেন শৌনক দত্ত।
সত্যজিৎ রায় কে আমি প্রথম চিনি চৌত্রিশ বছর আগে। ছোটবেলা থেকেই আমি ইঁচড়ে পাকা। বড়দের সবকিছুতেই নিজেকে ঢুকিয়ে নেবার প্রবল এক প্রবণতা আমার খুব করে ছিলো। নিজ বয়সী কিছুই আমার ঠিক ভালো লাগতো না। দূরদর্শনের পর্দায় গ্রীষ্মের বা পূজার ছুটিগুলো আমার বয়সী যাদের রঙিন হতো ছুটি ছুটি দেখে তারা হয়ত মনে করতে পারবেন কিংবা সার্ক উপলক্ষে বিশেষ সেই অনুষ্ঠান যেখানে সার্ক দেশগুলোর সিনেমা দেখানো হতো। তেমন কোন ছুটিছুটি বা সার্ক অনুষ্ঠানে আমার সাথে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম দেখা। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে বাড়ির প্রায় সবাই কি যেন এক জাদুর টানে সংসারের সব কাজ সময়ের আগে শেষ করে ফেলেছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই খুব পরিপাটি হয়ে বসে অপেক্ষা করছে। সত্যজিৎ রায় আসছেন। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ২১ ইঞ্চি সাদা কালো টিভিতে অন্যরকম এক সঙ্গীত আবহে এলেন তিনি,সিনেমার নাম হীরক রাজার দেশে। মা কিংবা দাদু কেউ একজন বলেছিলো খুব ভালো বই বাচ্চাদের জন্য। এখনো দেখতে পাই। সেই সময় বাচ্চাদের জন্য বই শুনে যে বড় বড় ভাব করে নাক সিঁটকে ছিলাম তা সিনেমা শুরু হবার পর থেকে সেই যে গেলো আর কখনো ফিরে আসেনি। সেই প্রথম সত্যজিৎ কে দেখে আমার যে মুগ্ধতা সেই মুগ্ধতা আমার আজো যায়নি।
সেই বয়সে হীরক রাজার দেশে সিনেমাটি কেবলই বিনোদনের জন্য মুগ্ধ করলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুঝেছি হীরক রাজার দেশে সিনেমাটিতে ১৯৮০ সালেই বিশ্বায়নের এক পৃথিবী ভাবনা সেলুয়ডে বন্ধী করেছেন সত্যজিৎ এ ছবিতে মূলত আমরা তিনটি পক্ষ দেখি। একটি হলো হীরক রাজা ও তার লোকজন, দ্বিতীয় পক্ষ হলো উদয়ন পণ্ডিত, ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষক। আর তৃতীয় পক্ষটি হলো বিদেশি শক্তি অর্থাৎ গুপী ও বাঘা। দ্বিতীয় পক্ষ তৃতীয় পক্ষের সহযোগিতায় প্রথম পক্ষের বিপক্ষে জয়লাভ করার গল্প এটি। রাজনৈতিক ভাষ্যে বললে শোষিতদের সঙ্গে শাসকের সংঘাতের গল্পই বলেছেন সত্যজিৎ। সত্যিজিৎ রায় যখন হীরক রাজার দেশে কাহিনীটি রচনা করেছিলেন, তখন সম্ভবত তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকের সময়কে বেছে নিয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে বিশেষ করে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংয়ের দ্বিতীয় মেয়াদের শাসনামলে ভারতবর্ষে শত সহস্র জমিদার ও সামন্তরাজার উদ্ভব হয় যারা মূলত তৎকালীন সরকারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নীতির কারণে সৃষ্ট হয়েছিলেন। এই শ্রেণীটিই লর্ড ডালহৌসির আমলে অসম্ভব শক্তিশালী, অত্যাচারী, নির্মম এবং নৃশংস হয়ে উঠেছিলেন। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশে এরা সাঙ্ঘাতিক রকমের বিশ্রী সব তাণ্ডব করে বেড়াত। রায় বাবু সম্ভবত বঙ্গের কোনো সামন্তরাজাকে মন মস্তিষ্কে ধারণ করে কাহিনী ও চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন।
চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এটির সংলাপ। তেমনি একটি সংলাপ হীরক রাজার মুখে শুনি জনগণকে নিয়ে যেখানে তিনি বলছেন- “এরা যত পড়ে, তত বেশি জানে আর তত কম মানে”। খুব গভীর ভাবে ভাবলে দেখবেন শাসকশ্রেণীর একদম মনের কথা যেন বলে দিয়েছেন হীরক রাজা!
পৃথিবীর প্রায় সব শাসকশ্রেনীই চেয়েছে বা চায় জনগন যেন সচেতন না হয়,সচেতন ও শিক্ষিত জনগণ চিরদিন শোষকদের জন্য হুমকি, তাতে তাদের সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এইজন্যই শাসক শ্রেনী সবসময় জনগনের চিন্তার জগতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। আর এই কাজে সহায়তা করে বুদ্ধিজীবি শ্রেনীর একটি অংশ। এই সিনেমাতে আমরা দেখি সত্যজিৎ শাসকশ্রেণী ও বুদ্ধিজীবি শ্রেণীকে এক হতে আর তারই ফল যন্তর মন্তর ঘর নামে একটা ঘর। যেখানে নিয়ে সবার মগজ ধোলাই করা হয়। সেখানে নিয়ে যার মাথায় যা ঢুকানো হয় তাই সে তোতাপাখির মতো আউড়ে যায়। আর এই যন্তর মন্তর ঘরের মন্ত্র লিখে দেয়ে রাজকবি। রাজ কবি লিখে:
“ভরপেট নাও খাই, রাজকর দেওয়া চাই”
“বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না”
“যায় যদি যাক প্রাণ, হিরকের রাজা ভগবান”
“যে করে খনিতে শ্রম যেনো তারে ডরে যম”
“অনাহারে নাহি খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ”
“লেখাপড়া করে যেই, অনাহারে মরে সেই”
“জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই”
“বিদ্যা লাভে লোকসান, নাই অর্থ, নাই মান”
বাস্তব জীবনে যদি চোখ রাখি দেখবো আমাদের সমাজেও এই ধরনের পরিস্থিতি দেখা যায়। বাস্তবিক পৃথিবীতে রাজ কবির ভূমিকা পালন করে বুদ্ধিজীবি মহল শোষকশ্রেনীর অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয়ে শাসকশ্রেণীকে সব কাজে সঙ্গ দেয় আর যন্তর মন্তর ঘরের ভূমিকা পালন করে পুরো পূঁজিবাদী সংস্কৃতিটাই। রাষ্ট্রের পত্রপত্রিকা, রেডিও, টেলিভিষণ, সিনেমা, গান, নাটক, উপন্যাস, গল্প, কবিতা সবই শোষক শ্রেণীর আদর্শ প্রচার করে। আর জনগনের চিন্তা চেতনাও সেই অনুযায়ী পরিচালিত হয়। তবে এতকিছুর পরও সমাজে বিপ্লবী চরিত্রের অস্তিত্ব থাকে। ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমায় এই বিপ্লবী চরিত্র হচ্ছে উদয়ন পন্ডিত। উদয়ন পন্ডিতই হচ্ছে রাজার সবচেয়ে বড় শত্রু।
এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি চরিত্রই প্রতীকী। বাস্তবতার নিরিখে সাজানো। প্রতিটি রাজযন্ত্রের শাসককে যেভাবে তোষামোদ করা হয় হীরক রাজার দেশেও দেখি তেমনি রাজসভার সবাই রাজার কথার সাথে সুর মেলায়। রাজার প্রতিটি কথার শেষেই ওরা বলে ঠিক ঠিক ঠিক। জনগন যখন অনাহারে মরে তখন রাজা তার সভার লোকদের হীরের হার বিতরন করে। তারমধ্যে আছে শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী প্রমুখ। রাজা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দেয় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের আগে রাজ্য থেকে দারিদ্রের সব চিহ্ন যেনো নির্মুল করে দেয়। কোন ভিখারীকে যেনো পথে দেখা না যায়। এ যেনো আমাদের এই বৈষম্যমূলক সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। জনগন যখন অনাহারে অর্ধাহারে মৃতপ্রায় তখন রাষ্ট্রের সুবিধাভোগীরা বিলাশবহুল জীবন যাপন করে। নগরের সৌন্দর্য বর্ধনের নামে উচ্ছেদ করা হয় ছিন্নমূল মানুষদের। অথচ মানুষকে অনাহারী রেখে যে কোন নগরের সৌন্দর্য বর্ধন যে সম্ভব না সেটা আমাদের শাসক শ্রেণী বুঝতে চায় না।
আরো পড়ুন: বিভূতিভূষণ আমাকে খুবই প্রভাবিত করেছেন: সত্যজিৎ রায়
সত্যজিতের ছবিতে জোরালো বিদ্রোহ বা বিপ্লবের চিৎকার কোথাও নেই, অথচ রয়েছে প্রতিবাদের তীব্র চাবুকের শব্দ।সিনেমাকে রাজনীতির pamphlet করেছনে অনেকেই সত্যজিৎ কখনোই তেমন করেননি। তিনি শিল্পের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ ছিলেন, রাজনীতির চেয়ে। না, সেজন্য তাঁকে কখোনোই অরাজনৈতিক মনোভাবের শিল্পী বা মানুষ বলা যাবে না। তিনিই প্রমাণ করে গেছেন শিল্পসৃজন ও সমাজ সচেতনতা হাত ধরাধরি করে চলতেই পারে।
তারই সুন্দর নিদর্শন দেশ–কাল ছাড়িয়ে ‘হীরক রাজার দেশে’–এর গল্প যা আমরা এখন সারা পৃথিবীতে দেখতে পাই। সারা পৃথিবীর দিকে তাকালেই দেখি উপমহাদেশের দেশগুলোর কর্তৃত্ববাদী শাসন, সাম্প্রদায়িক সংকট। এশিয়া থেকে ইউরোপ এমন কি যুক্তরাষ্ট্র, ল্যাটিন আমেরিকায়ও হীরক রাজারা শাসন করছেন এখনো। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখলাম ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ক্যাপিটাল হিলে হামলা করছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহরা সবাই ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখতে নীতিহীন, নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন। বর্ণবাদকে ইউরোপ–যুক্তরাষ্ট্রে পুষ্ট করা হচ্ছে। আর আমাদের উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে। বৈষম্য সৃষ্টির জন্য শাসকেরা সীমাহীন ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন।
সিনেমার শেষ দিকে দেখা যায় হীরকরাজার বিশাল মূর্তি উন্মোচন হবে। সেই উৎসব উদয়ন পন্ডিত গোপি ও বাঘার সহযোগীতায় পন্ড করে দেয়। দেশের জনগন উদয়নের নেতৃত্বে হীরক রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে বিশাল এক মূর্তি। কোমরে দড়ি পরানো। উদয়ন পন্ডিত খনি শ্রমিক কৃষক মজুর সবাই মিলে দড়ি ধরে টান মারবে। খানখান হয়ে ভূলুণ্ঠিত হবে শয়তানি ফ্যাসিবাদের প্রতীক হীরক রাজার মূর্তি। পতন ঘটবে ফ্যাসিবাদের। উত্থান হবে গণআন্দোলনের। বিজয়ী হবে জনগণ। টেনে নামিয়ে ফেলে হীরক রাজার মূর্তি সমবেত জনতা স্লোগান দেয় ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’।
এই ভাষা বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের সার্বিক মুক্তি ও প্রতিবাদের ভাষা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু মানবমুক্তি ঘটেনি। দেশে দেশে প্রাপ্ত স্বাধীনতাও ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হচ্ছে। আধিপত্যের কাছে আজ নানা ভাবে পরাজিত স্বাধীনতা। মানবমুক্তির মাধ্যমেই আজ প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ সম্ভব। পুরো বিশ্বে তাই মানুষের সার্বিক মুক্তি ও স্বাধীনতা এখন সময়ের দাবি। এ কাজ করতে পারেন উজ্জীবিত, সচেতন মানুষদের নিয়ে উদয়ন পণ্ডিতের মতো নেতারাই। হীরক রাজার রূপকে সত্যজিৎ রায় পেরেছেন প্রতিবাদের রণদামামা না বাজিয়েও নান্দনিকতার নরম হাতে ফ্যাসিবাদের গালে, অত্যাচারী শাসকের গালে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় বসাতে। সিনেমা মুক্তির সময়কালে ফিরে গেলে দেখি এই ছবি যখন তৈরি হয় তখন দেশে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। দেশে চলছে ইমার্জেন্সি পরবর্তী থমথমে পরিস্থিতি। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই ছবি হয়ে উঠে ছিলো প্রতিবাদের স্বরূপ। শুধু এটুকুই না, হীরক রাজার দেশের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে সমকালীন সমাজে কৃষক শ্রমিক মানুষের যন্ত্রনার কথা। মানুষ হয়ত হারিয়ে যাবে কালের স্রোতে কিন্তু চিরকাল রয়ে যাবে এই সৃজনশীল প্রতিবাদের ভাষা। সাক্ষ্য দেবে সেলুলয়েডের পর্দা। আর প্রশান্তির হাসি মুখে সত্যজিৎ…
কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ৭ আগস্ট, উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখির সূত্রপাত। সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা এবং ওয়েবজিন। বর্তমানে ইরাবতী ডেইলি ওয়েবজিনের সাথে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : জল ভাঙে জলের ভেতর [২০১১], ঠোঁটে দাও জ্যোৎস্নার বিষ [২০১২], ডুব সাঁতার [২০১৭], নিরুদ্দেশ গাছে সন্ন্যাসীর মুখ [২০১৭]। গল্পগ্রন্থ : কারুময় খামে অচেনা প্রেম [২০১২]। উপন্যাস: ইতি খন্ডিত জীবন [২০২২]। প্রবন্ধ সংকলন: মাটির গন্ধ [২০২২]। সম্পাদনা গ্রন্থ: দুই বাংলার সাম্প্রতিক গল্প [২০২২] ।
শখ বইপড়া, লেখালেখি, ছবিতোলা, গান শোনা ও ভ্রমণ। বেশ কিছু গানও লিখেছেন তিনি।
চমৎকার সুন্দর লেখা