| 17 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

ইরাবতীর গদ্য: স্থানিকের দিনলিপি । জ্যোতি পোদ্দার

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

তাঁতিহাটির গায়ে তখনো হালকা কুয়াশার চাঁদর। সকালের আলো পশ্চিমের জলে চিকচিক করছে। চুপচাপ শয়ান আয়না-জলের ভেতর মস্ত আকাশ নিজেকে দেখছে খুব করে গভীর ভাবে। আমরা যখন পৌঁছালাম তখনো পাকা সড়কে কেউ নেই। গাড়ি থেকে নেমে সবে দাঁড়িয়েছি মিক্রি বিলের পশ্চিম পাড়ে। পাকা সড়ক সীমান্ত রেখা–এপাশে মিক্রি বিল ওপাশে তামাম ধানের ক্ষেতের পর ধানের ক্ষেত। চোখ ধাঁধিয়ে দেয় সবুজ আর রোদের ছটায়।

বর্ষার বিল  বিবাহযোগ্যা নারীর ভরাট শরীরের মতো নাদুসনুদুস। খলবলিয়ে খলবলিয়ে ওঠে। বাতাসে জলের শরীরে ছোট ছোট কম্পন ওঠে–রোদে জলে মেশানে কম্পন। চোখ জুড়িয়ে যায়। কেঁপে কেঁপে জলের শরীরে অনেকটা দূরে বড় কোন জলের পরিসরে মিশে যায় গুড়িগুড়ি কম্পন।

সকালে জলে কম্পন আর  দুপুরে জলে কম্পন আর শেষ বিকেলে জলের কম্পন আলাদা আলাদা। রোদের ক্রম প্রতাপ আর বাতাসের দাপটে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে যখন হাজির হয় শেষ বিকেলে  বিলের রূপময়তা আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তখন। প্লাবিত পূর্ণিমার ভেতর বিলের  জল কেমন নেচে ওঠে তা আমি দেখেনি।চাঁদের আলোর নিজস্ব মাদকতা আছে। কী জানি কেমন নেচে ওঠে বিল জল–জলের ছোট ছোট ঢেউ।

খরা মৌসুমে বিল যে কোন নারীর শরীর। তাপ নেই। চোখ আটকে থাকবে কী–চোখও সরে সরে যায় অন্য কোথাও। শুকিয়ে ঝুলে যাওয়া স্তনের মতো বিলের এখানে সেখানে ভাঙা এবড়োথেবড়ো ভিটি। আর সদ্য সরে যাওয়া জল–শ্রীহীন ঘোলাটে জল।

মিক্রি বিলের বলয় এক সময় দীগন্ত প্রসারিত ছিল। এখন চোখ আটকে যায়। দূরে পাশ ভরাট করে করে  চৌচালা ঘরের বসতি। বিলের আগের জৌলুস নেই। শুধু মিক্রি নয়–বগাডুবি, কুর্শা,রৌহা,নকশি প্রমুখ বিলের অখন্ডতা নেই।  শত বছর আগে হরচন্দ্র চৌধুরী যে সকল বিলের ব্যাপ্তি আর গভীরতার কথা লিখেছিলেন  তাঁর গ্রন্থে সেগুলো এখন কাগজে কলমে স্থানিক ম্যাপে আছে–জমিনে নেই। বসতের বিস্তার ঘটেছে মানুষের জন্য মানুষের পরিকল্পনায়– জলমহালকে দূরো ঠেলে দিয়ে কিংবা ভাগাড় অথবা পরিত্যক্ত করে।

পরিত্যক্ত কোন কিছুর প্রতি কারো মমত্ব থাকে না থাকে ঘৃণামিশ্রিত অবজ্ঞা। প্রাণবান সত্তা হিসেবে বিল ডোবা খাল  আমাদের অনুভবে নেই। বিলের যে নিজস্ব সত্তা আছে সে যে মানুষের জীবনের সাথে বহুরূপে গ্রন্থিত সে যে প্রাণের জন্ম বিকাশ ও বিস্তারের চাতাল সেই বোধ  আমাদের গড়ে উঠল কই?

বিলের বহুধা বিভক্ত আমাকে ব্যথিত করে। বিল সমূহের সম্পদ। প্রাণের সাথে প্রাণের মিলবার ও মিলাবার জীবন্ত চাতাল। প্রাণ তো জীবনের ভিত্তি। তার উপর গড়ে ওঠে জীবিকার সৌধ। বিল স্থানিক মানুষের জীবিকার আঁতুরঘরও বটে। সত্য বলতে কী  কোন বিলই আজ আর ইজমালি নেই।যেমন নেই গবাদি পশুর জন্য স্বাস্থ্যবান কোন তৃণভূমি। বিল এখন ক্ষমতাবান মানুষের দখল স্বত্ব।গ্রামে মুখে মুখে ফেরে সাতবার ডিক্রি জারি করেও নাকি দখল স্বত্ব ছাড়তে পারে না।দখলের এমনই মহিমা!


আরো পড়ুন: স্থানিকের দিনলিপি


বিলের যে নিজস্ততা তা এই দখলত্বের কারণে নেই। নেই সমূহের সম্পত্তি। গুটি কয়েক মানুষ নিজেদের ভেতর নিজেদের মতো করে খন্ড খণ্ড করে নিয়েছে। বিলের শরীরে করেছে মাছের ঘেড়। মাগুর কই পাঙাসের আবাদ। উঁচু  উঁচু পাড় বেঁধে  রাসায়নিক উপাদান নির্ভর মাছের আবাদ একদিকে বিলের উর্বরতা যেমন নষ্ট করছে তেমনি জলনির্ভর লভাগুল্মের প্রাণ হুমকির মুখে পড়ে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করছে।

খাল বিল নির্ভর যে জেলে জীবন সে জীবন বিপন্ন। পেশা হুমকির মুখে। কেউ কেউ অনেক আগেই পাল্টিয়েছে পেশা। বিপন্ন জলাশয় বিপন্ন পেশা। ক্ষমতা কাঠামোর বিন্যাসের কারণে ইজমালি ধারনাও বিপন্ন। পুঁজি কোথাও আর সমুহের সম্পদ রাখতে চায় না। হোক সে গাড়ো পাহাড় কিংবা সমতলের খেলার মাঠ অথবা কোন জলাশয় কিংবা ‘পাহাড় কেটে জলাশয় ভরাট’ কোথাও আর সমূহের পতাকা থাকছে না। উড়ছে ব্যক্তি মুনাফার ধ্বজা।

বিলের মাছের প্রতি সাধারণের পক্ষপাত মারমার কাটকাট। মাছের বাজারে চাষের  খাসা কই মাগুর মাছের চেয়ে নদী খাল বিলের মলা, ঢেলা, পুঁটি,কাচকি, বোয়াল,শোল মায় কালো কালো ইঁচার গন্ধ ও স্বাদ খাদ্য রসিকদের জিবে এক্সট্রা লোলে ভরে যায় মুখগহ্বর। বাজারে দামও বেশি–চাষের মাছ খাল বিলের মাছ বলে চালিয়ে দেবার  প্রবণতাও কমে নয়। ঠক ও  ঠকানোর ভেতর যে একটা গোপন আনন্দ-লোভ-লাভ কাজ করে তা তো বলাই বাহুল্য। জাইল্লাদের কাছে আমিও ঠকেছি  বহুবার। বিলের পুঁটি মাছের ভাজা কিংবা পাতলা ঝোলে এক মোঠো ভাত পাতে বেশিই লাগে।

ছিপ হাতে ধরে পাতা কাঠির দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকা  মাছ শিকারি আমি নই। আমি ভোক্তা। ভুরি ভোজন যে আনন্দ পাই মাছ ধরাতে তার কনাকড়িও নেই। মাছধরা ধ্যানীর কাজ। মন সর্ষে দানার মতো জড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লে মাছ ধরা আর হয় না। বসে থাকাই সার। একাধিক বার চেষ্টা করে দেখেছি কী ভীষণ অস্থীর আমার মন-কেবলই ছড়িয়ে পড়ে।

তবে যারা ছিপ হাতে নিয়ে  মাছ মারে তাদের ধৈর্যের তুলনা নেই। ময়লার মণ্ড বা কিলবিল করা কেঁচো দুই অাঙুলে টিপে বর্শির বাঁকানো শুলে গেঁথে জলে ডুবিয়ে দিয়ে পাতি কাঠির দিকে ধ্যানস্থ হওয়া চাট্টি খানি কথা নয়। খাল বিল এমন ধ্যানী রসনা বিলাসীদের তীর্থস্থান। ঘাটে ঘাটে ঢালু জমি বা বিলের জলের ভেতর বাঁশের মাঁচা করে খাড়া রোদের ভেতর দিনভর বসে থাকা কম ধ্যানের কাজ নয়। 

তবে ছোট্ট খেয়া নৌকায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাল ছুঁড়ে মাছ মারার অানন্দ আরেক ধরনের। কুর্শা বিলে যে লোকটি বাম হাতের কব্জিতে জালের গোছা রেখে ডান হাতে জালের দড়ি কড়ে আঙুলে বেঁধে ঝাঁকিজাল ছুঁড়ছিল তার ফটোগ্রাফ তুলে এনে ছিলাম কুঁর্শা বিলের কালো জলে হাঁটু অব্দি নেমে। কেমন পাট পঁচা পেট উগড়ানো গন্ধ রে বাবা! বমিতে নাড়িভুঁড়ি হয়ে বের যাবার যোগাড়।

কালো মতো লোকটি ময়লা চেক লুঙ্গি কাছা দিয়ে উদোম গায়ে ঝাঁকিজাল ছুঁড়ছিল। ছোট্ট নৌকা। নৌকার নাক বরারব জল ডুবছে আর ভাসছে। এই বুঝি জল ওঠে এলো! এরই  মাঝে নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে রোদে পুড়ে কয়লা হওয়া লোকটি জাল ছুঁড়ছিল জলে। ঝাঁকিজাল গোল বৃত্তের মতো  যখন ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দে জলে আছড়ে পড়ে  দারুণ লাগে দেখতে।  

জালের নিচের কিনারা জুড়ে চারদিকে লোহার গোল বা চেপ্টা রিং থাকে বলে জলে পড়ার সাথে সাথে ঝপাৎ শব্দের দ্যোতনা জেলেকে আরো মাকদাসক্তের মতো করে তোলে।একটু ধনুকের মতো বেঁকে কী গভীর আশায় জালের গোছার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে জাল টেনে তুলছে নৌকার পাটাতনে। গোছা ঝেঁকে ছাড়িয়ে আবার পূর্ণ বিশ্বাসে জলে ফেলছে ঝপাৎ করে জাল।

ঝিনাইগাতি–শেরপুর সড়কের এপাশ ওপাশ মিলে যে বগাডুবি বিল তার ব্যাপ্তিও কম নয়।তলদেশ ভরাট হবর কারণে  গভীরতা কমে গেছে। দখল বাড়ছে।ভরাটও হচ্ছে।এখানে আড় বাঁশ বেঁধে বেঁধে মাচা করা সারি সারি শিপজালের বিস্তার। শিপ জাল চৌকো আকৃতির। আড়াআড়ি বাঁধা বাঁশের চারটি ফালির চার আগায়  জালের চারকোনা বাঁধা থাকে শক্ত করে। আড়াআড়ি বাঁশের ঠিক মাঝখানে সরল রেখার মতো শক্ত বাঁশ দিয়ে খাড়া বাঁশের আগায় বাঁধা থাকে।সড়কের এই পাশটা সারি সারি স্থায়ী শিপজালের হস্তচালিত ফাঁদ।

হস্তচালিত এই শিপজাল বিলের পাড় ঘেষে স্থায়ী ভাবেই গড়া । বর্ষার নয়া জলে এই জাল জলে ফেলতে না ফেলতেই ঝাঁক বেঁধে উঠে আসে  মাছ অপ্রশস্ত জালে। এক খেউয়ে ভরে ওঠে খালুই। খলবল খলবল করে ওঠে খালুইয়ের ভেতর বিলের জেতামাছ।

বিল দখল বিল ভরাট যে দ্রুত গতিতে চলছে শীঘ্রই  স্থানিক প্রাণজ বিলসত্তাকে হারাবো। হারাবো বিলের অপার সৌন্দর্যকে। বিল নির্ভর মানুষের বিপন্নতা চরমে। চলছে খাস বিলের লীজের বন্দোবস্ত। 

পশ্চিমমুখী পাকা সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতেই সুজয় একজনকে খপ করে ধরে ফেলল। সড়কে তখন একটু একটু ভীড় বাড়ছে। এদিকে রাস্তা খানাখন্দে ভরা। বর্ষার নয়া ভাঙনে সড়কের অবস্থা আরো সঙ্গিন। তাই দলবলের সাথে  কিছুপথ হেঁটে কোমরকে একটু সোজা হবার ফুসরত দেয়া।আনমনেই হাঁটছিলাম–তখনই সুজয় খপ করে ধরে ফেলল লোকটিকে।

ধরতে ধরতেই সুজয় বললেন, হালা দিছো কেন?

বিশ বাইশ বছরের আব্দুল মালেক মাথা নীচু করে বললেন, খাবারের জন্য।

হালা দেয়া–একটি ফাঁদ। পাখি ধরার ফাঁদ।ভাদ্র আশ্বিন থেকে ফাল্গুন চৈত্র পর্যন্ত এই ফাঁদে বক ধরেন পাখি শিকারিরা। মিক্রি বিলের পুবে যে বিস্তৃণ ক্ষেতের পর ক্ষেত তার আলেই নানা জায়গায় এই হালা দেয়া হয়েছে। বাঁশের কঞ্চি মাটিতে গেড়ে  কলা পাতায় ঢেকে যে ঘরের মতো করা হয় তাকেই হালা বলে।

ঘরের ভেতর কেউ  একজন ঢুকে  পালা বকের পায়ে দড়ি বেঁধে হালার উপর ছেড়ে দেয়। আর নিচ থেকে দড়ি ধরে টানাটানি করলেই বক ডানা ঝাপটিয়ে উড়ন্ত বককে আহ্বান করে।সেই কলাপাতায় ঘেরা হালার উপর নবাগত বক বসলেই নিচে বসা লোকটি পা ধরে হেঁচকা টানে নয়া বক বোঝার আগেই নিচে টেনে এনে খাঁচায় বন্দি করে রাখে। 

আব্দুল মালেক যাই বলুক না কেন এতো কসরত করে বক ধরা খাওয়া বা শখের জন্য নয়– বাণিজ্যের কারণে মালেকদের এমন তৎপরতা। শহরের রাস্তার মোড়ে বা  প্রায় অন্ধকার গলির মুখে  মাথা নীচু করা বকের ঠ্যাং ঝুলিয়ে যারা উঁচিয়ে ধরে ‘ লাগবে কিনা’ জিজ্ঞেস করে  নাগরিকদের রসনা বিলাস মেটায় তাদের উৎস কারিগর আব্দুল মালেকেরা।

যদিও পাখি শিকার অপরাধ। পাখি একটি স্বাধীন সত্তা। বিলের মতই তার প্রাণবাণ সত্তা। পাখি পরিবেশ বান্ধব। হোক বক বা শকুন–সে কোন না কোন ভাবে  স্বাস্থাবান পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পাখিরা পাখির জায়গায় সুন্দর।পাখির নিজস্ব যাপনে পাখি যেন পাখির মতো করে নিজস্ব আবাসস্থলে বেঁচে বর্তে থাকতে পারে তার জন্যই সুজয়দের নানামুখী পাখিবান্ধব তৎপরতা।

খাঁচায় পাখি পালা যে কী করুণ বিভৎসতা সেই প্রাথমিক জ্ঞানকান্ড আমাদের হয়নি। বারান্দায় রেলিঙে ঝুঁলিয়ে রাখা বন্দী পাখি দেখে ও দেখিয়ে আয়েশী সুখ পাবার তাড়নাও মানুষের মাঝে প্রচন্ড ঝোঁক। কোন পাখিল্যান্ডে  পাখিদের বৈঠকঘরের আড় বাঁশে ঝুলিয়ে রেখেছে এক ছোট্টমোট্ট গায়ের চাম ফর্সা কোন মানব শিশুকে– এমন দৃশ্যপট নিশ্চয় আমরা কল্পনা করতেও পারি না। মানুষ নিজে স্বাধীন সত্তা বলে নানা দর্শন কপচায় অথচ কী অদ্ভূত কারণে  অপরাপর প্রাণকে সে বন্দী করার জন্য প্রণোদিত হয়।

 ২০১২ সালে বন্যপ্রানী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা অাইন পাশ হয়েছে। আইনে যা হয়। কাগজেই থাকে–সচেতনতা বাড়ে না। আবার কেউ কেউ দণ্ডিতও হচ্ছেন। দুটি পাখির দোকানীকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আলাদত। পত্রিকায় প্রকাশ,”….. উপজেলা সদরের একটি পাখির দোকানে দেশীয় পাখি ক্রয় বিক্রয় করে আসছিলেন। মধ্য বাজার ও মামদামারী গ্রামে দুটি পৃথক স্থানে অভিয়ান চালিয়ে  ৫টি টিয়া ৩টি তিলা ঘুঘু ৪টি বেগুনি কালেম ১টি ডাহুক ১টি পানকৌড়ি ও ৫টি বক উদ্ধার করেন।”

তিন ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমান ও পাখিগুলোকে অবমুক্ত করে দিয়ে পাখি ধরবার নানা ফাঁদ বিনষ্ট করে দেয়া হয় প্রশাসন।তবু মালেকদের তৎপরতা আছে সুজয়  তাকে একদিকে যেমন সাবধান করে দিলো তেমনি পরিবেশ প্রতিবেশের জন্য পাখি যে উপকারি বন্ধু সে কথাও বুঝিয়ে দিলো। জানি না মালেক পাল্টাবে কি না?

বিলের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল বড় বড় শিংঅলা কালো মহিষ। সবুজ কচুরি পানা চিবাতে চিবাতে চৈত্রের গরমে নেমে যেতো বিলের জলে। সবুজ কচুরি পানা  ও গোলাপি রঙের বড়নখা ফুলের ভেতর নাক উঁচিয়ে শিং বের করে ডুবে আছে মহিষ–এই দৃশ্য বিলের পরচিত মুখস্ত দৃশ্য ছিল একদা।

বিলের জলে ডুবে মহিষ জাবার কাটছে তো কাটছে–বিরাম নেই। উঁচিয়ে ওঠা মোষের পিঠের উপর ওড়ে এসে বসা পাখা ঝাপ্টানো বকের ছবি চিরকালের জন্য আমার চোখে আটকে আছে। চোখ বন্ধ করলেই চলচিত্রের মতো ভেসে ওঠে। আমার শৈশবের ছবির গ্যালারি–পর পপর নানা ছবি স্মৃতির হুকে ঝুঁলে আছে। আমাদের বাড়ির ঠিক পেছেনই তেতুল আর গাব গাছের অল্প পাড় রেখে বাকিটুকু  ছিল প্রশস্ত ডোবা–বিলের মতো। সে সব নেই এখন। বসত বাড়ি উঠেছে সারি সারি। মাঝখানে স্মৃতিটুকু থাকার মতো কুলু বাড়ির ছোট্ট পুকুরটা রয়েছে শুধু।

সেইবার কুর্শা বিলে বেড়াতে গিয়ে শৈশবের দেখার স্মৃতির যেন নতুন মঞ্চায়ন দেখলাম।বিলের জলে ডুবে মোষ জাবার কাটছে আর জাবার কাটছে।আর তেল মাখা কুচকুচে শিঙ সূর্য্যের আলোয় চিক চিক করছে। কুর্শার কালো গন্ধমাখা ভারি জল আমাকে আমোদিত করে তুললো। উল্লাসী মানুষ দেবু’ দা এক মাথা রোদ নিয়ে একটু গাছের ছায়ায় আমরা যখন গোল হয়ে একটু জুড়িয়ে নিচ্ছিলাম তখনই তিনি  গাইলেন

“”লাউ লাগাইলাম জাঙ্লা দিলাম।

খাইলাম রে তরকারি

লাউয়ের বস দিয়ে

বানাইলাম ডুগডুগি।

কচি লাউয়ের পায়েস খাইতে

                         বড় ভালো লাগে

বৌ আমার 

সেই পায়েস  দেয় না যে করে–

আমি দুখের কথা কারে বলি রে

আমি দুখের কথা কারে জানাই রে…..

প্রচলিত সুরে দেবু’দার লেখা। তিনি  শিল্পী। গীতিকারও। তুখোড় সংগঠক ছিলেন একদা।প্রাণখোলা দেবু’ দা মনে যা আসছে হোক সে শ্লীল বা অশ্লীল দুই ঠোঁট খুলেই উপুড় করে ঢেলে দেয় উদার ভাবে। রাখ ডাক নেই। দিলখোলা।  আড্ডাবাজ মানুষ।

কুর্শা বিলে  একদিকে রোদের দাপট অন্যদিকে বাতাসের ঝটকা। গরম আর শীতলতা একই সাথে মূদ্রার এই পীঠ ওপীঠের মতো আছড়ে পড়ছে গায়ে। ফিরতে পথে বারবার  কুর্শার ফিরছিলাম অথবা আমার সাথে কুর্শা চলছে। কুর্শা আর আমি বা অামি আর কুর্শা দুই জনে পাশাপাশি চলছি। সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই লিখে ফেললাম কলাপাড়া নতুন বাজার সিরিজের কবিতাগুলো–একটানে; ঘোরের ভেতর  জলের পাঁকের মতো ঘুর ঘুর করছিল কুর্শার শীতল ভারি জল।

” ইচ্ছে হলো কুর্শার বিলে নামি

ইচ্ছে হলো বৃত্ত ভাঙি

                                বৃত্ত আঁকি

কে কবে বৃত্ত না ভেঙে বৃত্ত এঁকেছে জগতে?

ইচ্ছে হলো সাদা হলুদ শাপলা কুড়িয়ে কুড়িয়ে

নরম সবুজ ডাঁটা চুষে চুষে পান করি কুর্শার শীতল জল।

বিলের জলের মাদক স্বভাব আমি জানি।

যে করেছে পান আকন্ঠ বিলের ভারি জল

সে পেয়েছে সহজিয়া জলজ জীবন।

কোন ঘাট তার ঘাট নয়– সকল ঘাটেই

                                          ভিড়ে তার নাও।

বগাডুবি বিলে আশ্বিন-কার্তিকে  জল কমে আসে। কোথাও বুক সমান থাকলেও কোথাও কোথাও হাঁটু অব্দি। আর সেখানেই ছন মাথা তুলেছে। জলের ধাক্কায় একবার কাৎ হয় তো আবার সোজা হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় –প্রতিকুলতায় টিকে থাকার লড়াই সংগ্রাম করে নিরন্তর। ভাদ্র আশ্বিন কার্তিকে  এই লড়াই শুধু ছন নয় আরো কোন না কোন লতাগুল্ম করে পায়ের পাতা ভেজা জলে শিরঁদাড়া উঁচু করে দাঁড়াবে বলে।

পাকা সড়কের দুই পাশেই বিলের বিস্তার। কোথাও লীজের বন্দোবস্ত করে কই মাগুরের চাষাবাদ। তারাই পাড় উঁচু করে লাগিয়েছে আম, কাঁঠাল, গামা,জামের নানা গাছ। ডাঙর হয়ে গেছে। ঢালু পাড়েই আমরা বসেছি। ক্যামেরার ল্যান্স তাক করে আব্দুল কাদির আমাদের ছাড়িয়ে আরেকটু ভেতর দিকে এগিয়ে গেলো।

পাড়ে বসে বসে শহীদ দেখালেন হিজলের বছর পাঁচকের গাছ। জলের ভেতর একটু নেমে ছুঁতে হয়।জলজ কাদাজলই হিজলের আঁতুর ঘর। কিশোরের ঝাঁকবাঁধা চুলের মতো সবুজ গোল বেড় হিজলের মাথায়।  এ তল্লাটে হিজল খুবই কম। হিজল ফুল আমি দেখিনি। কালচে সবুজ জলে শরতের শেষ বিকেলে ছায়া পড়েছে জলে। হিজলেরও।তমাল হিজল জারুলে  উচ্চারনে আমরা কাব্যপৃষ্ট হই। কিশোর হিজলের দিকে তাকিয়ে ভাবছি জলে নেমে একটু ছূঁয়ে দেখি…

হিজল তমাল বনে ঝুলন ঝুলায়ে

তাপিতা ধরার চোখে অঞ্জন বুলায়ে

যমুনা স্রোতে ভাসায়ে প্রেমের খেয়া

ঘন দেয়া, মোহনীয়া, শ্যাম পিয়া

           নজরুলসঙ্গীতঃ কাজী নজরুল ইসলাম

লিখিয়া রাখিল পত্র ইজল গাছের মূলে

এইখানে পড়িব কন্যা নয়ন ফিরাইলে

সাক্ষী হও ইজল গাছ নদীর কূলে বাসা

তোমার কাছে কইয়া গেলাম মনের যত আশা

                       চন্দ্রাবতী পালা: নয়ান চাঁদ ঘোষ

আবছায়া চলে যায় হিজলের দিন

অভিমান জমে জমে আমি ব্যথাহীন

আহারে জীবন আহা জীবন

জলে ভাসা পদ্ম জীবন

                              চিরকুটের গান

বাংলা সাহিত্য হিজলময়। কবিতায় গানে নাটকে পালাগানে হিজল আছে।  আহা! হিজল 

পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে

পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে:

পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে

আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে

আকাশে আকাশে।

                         সন্ধ্যা হয়ঃজীবনানন্দ দাশ

আলো কমে আসছে।পাখিরা ঘরে ফিরছে।বক,ডাহুক, বুলবুলি বিলের জল ছুঁয়ে ছুঁয়েয়ে ঘুরে ঘুরে উড়ে যাচ্ছে কোথাও। কনে দেখা আলোর ভেতরই পটাপট ক্লীক ক্লীক করে ফ্রেমবন্দি করে ফেলল উড়ন্ত পাখির খণ্ডচিত্র। বিলের ভেতর জলে পোঁতা বাঁকানো কঞ্চির উপর একটা মাছরাঙা ঘুরে ফিরেই বসছে আবার উড়ে খুব উঁচুতে উঠে গিয়ে চক্কর দিয়ে এসে জলের গভীরে ডুব দিয়ে তুলে আনছে তার রাতের খাবার। মাছরাঙা লক্ষভেদী মাছ শিকারি। উঁচুতে উড়লেও চোখ থাকে তার জলের গভীরে মাছের শরীরে। 

রৌহা কিংবা কুর্শা  বিলও পাখির চাতাল। যে-কোন বিলকে আবর্ত করেই পাখি বিস্তার ঘটে । বিল বিপন্ন হলে পাখি জীবনও বিপন্ন হয়। পাখি দেখা মানে কোন স্থীরচিত্রে ফ্রেমে দেখা নয়–পাখি দেখা উড়ন্ত পাখির প্রসারিত ডানা ঝাপ্টানোর গতিময়তা দেখা। নানা পাখির নানা স্বর শোনা। আমি সব পাখি চিনি না। স্বর শুনেও বুঝতে পারি না। তবে শহীদ সুজয়দের দক্ষতা ঈর্ষনীয়। 

পাখির ফিল গাইড দেখে দেখে দক্ষ হলেই যে পাখি ও পাখির স্বর চেনা যাবে সেটা মনে হয় না। দরকার পাখির মন বোঝা।সহমর্মী হয়ে ওঠা। পাখির আত্মীয় হয়ে ওঠা। সেটি আমি পারি নি।শহীদ সুজয়েরা সেটা হতে পেরেছে। কলাপাতা নতুন বাজার সিরিজ কবিতায় লিখেছিলাম–

ও ফোটোগ্রাফার দেখো দেখো আকাশের

রেম্পে ওড়ে ওড়ে শঙ্খচিল উড়ে গেল দৃশ্যের ওপাশে

                                                       চিহ্নের আড়ালে।

তাকে ফ্রেমে আনো 

                      দেখি তার গার্হস্থ জীবন

                      দেখি তার দাম্পত্য জীবন।

শেষ বিকেলে সোনালু রোদে চিকচিক করে উঠল বগাডুবির ঘোলাটে জল। পশ্চিমের আভায় সোনার কাকন গরা রমনীর মতো জ্বলজ্বল করছে পুব পাশের বগাডুবি। চাক চাক সোনা যেন ঝরে পড়ছে বিলের জলে।এই সোনালুর ভেতর চোখের পলকে চক্কর দিয়ে জলে নামল পানকৌড়ি। সারা গা বুক  কালো কুচকুচে। লেজের দিক দিয়ে ধুসর।স্বর্নালি আলোর ভেতর কালোর আভা উড়ন্ত পানকৌড়ি সহজেই চোখ কেড়ে নিল।

উড়ে উড়ে জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ডানা ঝাপ্টিয়ে যখন পানকৌড়ি পায়ের পাতা জোড়া দিয়ে  জল ঠেলে ঠেলে যাচ্ছিল তখনই আল মাহমুদে পানকৌড়ির রক্ত গল্পের কথা মনে পড়ে গেলো।বাংলা গল্পের ইতিহাসে এক অনন্য প্রতিকী গল্প। বিল ঝিল পানকৌড়ির পছন্দের চাতাল। তাঁর বেঁচে থাকা। তাঁর শিকার। তাঁর ডুব সাঁতার  জলকে নিয়ে জলের ভেতর জলকেলি। 

কবি আল মাহমুদ নদী আর পানকৌড়ির বয়ানে এনেছেন শান দেয়া দায়ের মতো ধার।শৈল্পিক টানাপোড়েন । আর প্রতীকায়নের সাথে শৃঙ্গার রসের মন কেমন করা এক মিলন আকাঙ্খা। প্রথম গুলি ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় গুলিতে পানকৌড়ির লাল রক্তে সয়লাব নদীর জায়মান শরীর।…” নদীটা যেখানে বাঁক নিয়েছে আমি”,মানে গল্পের নায়ক,’ সেখানে এসে পেশাদার শিকারির মতো হাঁটু গেঁড়ে বসে বন্দুক বাগিয়ে বসলাম..” পাঠক হিসেবে নিজেই বন্দুক বাগিয়ে ট্রিগারে রেখেছি আঙুল আর চোখ স্থীর করে রেখেছি শিকারের নরম বুকে।

দ্বিতীয় গুলিতেই চাক চাক রক্ত।অন্যদিকে আদিনার রজস্বলায় সয়লাব তার শরীর। একদিকে নদীতে নিহত পানকৌড়ির ফিনকি দেয়া রক্তের স্রোত অন্যদিকে নববধু আদিনার জঙ্ঘা বেয়ে পড়া রজস্বলা রক্তের ভেতর দুই প্রাণবান সত্তা। একদিকে মৃত্যু–পুরাতনের মৃত্যু। কামনা ও আদি শৃঙ্গার রসে নতুনের সম্ভবনা। নবতর প্রস্তাবনা নিয়ে পানকৌড়ির রক্তে একই মূদ্রার দুই পীঠ দুই সত্তা —আদিনা আর পানকৌড়; প্রেক্ষাপটে বিলের জায়মান শরীর। আর সন্মুখপটে জীবনের জায়মান লীলা।

হঠাৎ সুজয়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরল।ততক্ষনে সড়কের ইলেকট্রিকপুলের  বাতিগুলো থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো। অন্ধকার আর আবছায়ার ভেতর আল ধরে হেঁটে এলাম বিলের পাড়ে রাস্তার ধারে–যেখানে মাটি ভরাট করে কে যেন কফিশপ খোলার  উদ্যোগ নিচ্ছেন।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত