| 16 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

ইরাবতীর গদ্য: স্থানিকের দিনলিপি । জ্যোতি পোদ্দার

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

চৈত্রের গরমে গাছের পাতাও নড়ছে না।বিদ্যুত ছিল না বলে একটু রাত করেই ঘুমাতে গেছি। এপাশ ওপাশ করতেই রাত সাবাড়।তখনই তীব্র এক পঁচা গন্ধ হামলে পড়ল ঘরময়। এখনো ভোরের  আলো ফোটেনি।জানালা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শেষ রাতের হালকা ঘুম ঘুম বাতাসে সারা পাড়া ছড়িয়ে পড়ল পঁচা উৎকট গন্ধ। পেট উগড়ে বমি যেমন আসছিল তেমনি কাঁশি।এক্কেবারে ব্রহ্মতালু কাঁপানো কাঁশি আর বমি।

কীসের গন্ধ কীসের গন্ধ করতে করতেই ভোরের পাড়া সরব হয়ে উঠল। গন্ধ আর হল্লা মাথায় নিয়ে বের হতে জানা গেল ঘটনা।বাঁশঝোঁপের আড়ায় যেখানে কয়েক দিন আগে যে কুকুরকে গোর দেয়া হয়েছিল সেই গোর থেকে মৃত কুকুরকে টেনে বের করে ফেলেছে শিয়াল। 

কয়েকদিন আগেই এই কালো খয়েরি কুকুরটি মরেছে।মরেছে না বলে বরং বলি কেউ হয়তো বিষ খাইয়ে মেরেছে। অপরিচিত নয় শুধু –একটু খুট করে শব্দ হলেই ঘেউ ঘেউ করে পাড়া মাথায় তুলতো কুকুরটি। সাথে আরো গোটা পাঁচেক ছিল। রাস্তার মোড় থেকে মন্দিরের চাতাল পর্যন্তই এই কুকুর বাহিনীর টেরিটরি। এর বাইরে তারা যান না।

গত বছর যে সকল পৌরকর্মীরা ইয়া বড়  চিমটা গোপনে হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খপ করে মাজা ভেতর চিমটা দিয়ে আটকে ফেলে ধরে ইনজেকশন পুশ করে করে মারত তাদের হাত থেকে এই কুকুরটি যেন কিভাবে বেঁচে গেছিল। বাকি গুলো বেঘোরে মরেছে ভাদ্রের আগেই। মানুষের বার মাস কুকুরের শ্রাবণ-ভাদ্র। লাজ শরমের বালাই নাই।কুকুরী দেখলেই দুই পা উঠিয়ে সঙ্গমে মেতে উঠে প্রকাশ্যে। পাতলা লাল জিব দিয়ে টুপটাপ লালা ঝরিয়ে দুই মুখ দুই দিকে নিয়ে অপার আনন্দে মেতে উঠল কী হবে? ছেলে বুড়ো ছ্যা ছ্যা করে উঠে।


আরো পড়ুন: আচিক মান্দির সঙরাম


এই সময়েই সঙ্গম উৎসব ও হিংস্রতা বেড়ে যায়। বেড়ে যায় কুকুরের কামড়ে রক্তাক্ত পায়ের সংখ্যা। তখনই ডাক পড়ে ঘাতক পৌরকর্মীর। সে এক আরেক হিংস্রতা। কুকুর হামলে পড়ছে পৌরকর্মীও। চিমটা দিয়ে ধর আর ইনজেকশনে ঘেউহীন কুকুর করে দাও।

ত্রিপল দিয়ে ঢাকা পৌর ময়লা ট্রাকে তখন বাড়ে লাশের স্তুপ। মফস্বলের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা বেওয়ারিশ কুত্তার লাশ।শহরের কেউ টুঁ শব্দ করল না। শুধু দেখল মোড়ের রাস্তা ফাঁকা। ঘেউ ঘেউ নেই।এবার নির্বিঘ্নে পথ চলা যাবে। মানুষের মৃত্যুই মানুষকে টানে না—আর কুত্তা বিলাইয়ের প্রাণ।ইতরের প্রাণ নিয়ে কে আর ভাবে?

সেই বেঁচে যাওয়া মহাপ্রাণ কালো খয়েরি কুকুরটি কয়েকদিন আগে মরেছে।মানে বিষ খাইয়ে মেরেছে। ওর এক সাঙ্গাত সপ্তাহ খানেক আগে কয়েকজন কে কামড়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। দু’জন শিশুও আছে। বয়স্ক লোকের হাতের কব্জির দিকের মাংস এক কামড়ে খুবলে নিয়েছি।

রক্ত ভেজা হাত দেখেছি আমি। সাদা হাড়ও বের হয়ে গেছে। সেদিন থেকেই মন্দির চাতালে ছেলেদের খেলা বন্ধ। সেই সাঙ্গাত ট্রাকের তলায় মরেছে।আর উনি মরলেন বিষে।এই কুকুরটির ক্ষিপ্রতা ছিল;ছিল সাধারণ কুকুরের চেয়ে একটু উঁচু। দলের ভেতর আলাদা করে চোখে পড়ার মতো। তাই বলে ভয় পেতাম না তা ঠিক নয়।

তাকে দেখলেই অন্যদিকে তাকিয়ে দমবন্ধ করে দ্রুত পাড় হয়ে যাবার চেষ্টা ছিল নিয়মিত।চকিত দৃষ্টি আর ক্ষিপ্রতার কারণে এই কুত্তার প্রতি ছিল আমার  পক্ষপাত ।

একবার এক বন্ধুকে,” তোর বাসায় কুত্তা আছে” যাবো না বলতে প্রচন্ড রেগে উঠেছিল। ‘যাবো না ‘ এটার জন্য নয় বরং ওদের জার্মান শের্ফাডকে কুত্তা বলেছিলাম বলে। রাস্তার আর বাড়ির কুকুরের শ্রেণি মর্যাদা তখন টের পেয়েছিলাম বন্ধুর আত্মশ্লাঘা বোধের তাপে। বন্ধুত্ব টেকেনি।ব্র্যাক আপ। কাজে কাজেই কুকুর আর কুত্তার ডিলেমা আমার তখন থেকেই।কুত্তার লাল ভেজা জিব আর বাঁকানো তীক্ষ্ণ দাঁত দেখলে অন্তর আত্মায় পানি থাকে না। ভয়ে কুকড়ে উঠি।এই বুঝি হামলে পড়ল!

কে বিষ খাইয়ে মেরেছে এটি বের করার আগেই এই আড়ায় তাকে গোর দেয়া হয়েছিল। কোমর সমান মাটি খুড়ে গোর দিতে বলা হলেও অল্প গর্তে করে গোর দেবার কারনেই এই বিপত্তি– শিয়াল পঁচা গন্ধের সন্ধান করতে করতে রাতে বেলা পায়ের নখের আঁচড়ে মৃত কুকুরকে বাইরে এনে ফেলেছ।তাতেই চৈত্রের গরম বাতাসে তীব্র কটু গন্ধ সারা পাড়া।

শিয়ালের আর দোষ কী? চারদিকে তার খাদ্যাভাব। নেই পুরো বাড়ি।পরিত্যক্ত শ্মাশান বা গোরস্থান। নেই কোন জলাশয়ের পাড়ে কোন উঁইয়ের ঢিবি অথবা বাঁশের আড়া।  লেজ ফুলিয়ে চকিত দৌড় দেবে এমন কোন প্রান্তরও নেই আজকাল। সব কিছু মানুষের দখলে। সারি সারি বাড়ি আর অফিস পাড়া।কোথাও কোন প্রাণীর আশ্রয় নেই।

মানুষ শুধু মানুষের কথা ভেবেছে। যে পশু পশুপাখি প্রাণীকুল নিয়ে তার বসত সেই প্র্যান্ড ডিজাইনের কথা ভাবেনি। সব এখন ব্যক্তি মালিকানাধীন। কোন কৌম চরাচর নেই। সমূহের খাল নেই। সমূহের তৃণভূমি নেই। 

যেটুকু খাল ইজারাদারের খাল।পার্টিনেতার নিজস্ব মাছের খামের।পোল্টি ফার্ম।খাস জমিতে হাইব্রীড চাষের খামার।প্রান্তর নেই আর— কাজে কাজেই নিরুপায় শিয়াল পণ্ডিত। শিশু সাহিত্যে পাতার পর পাতায় চালাক ধূর্ত পন্ডিত শিয়ালের গল্পগাছা আমাদের আমোদিত করলেও বাঘ মামার ভাগ্নের প্রশস্ত বাসস্থান এখন শুন্যের কোটায়। যত নগরায়ন হচ্ছে ততই হুমকির মুখে পড়ছে শিয়াল পণ্ডিত।

ইঁদুর পোকামাকড় মৃত প্রানী বা  পচাগলা খেয়েই পরিবেশকে মানুষের বসবাসের অনুকুলতা সৃষ্টি করে  প্রতিবেশের ভারসাম্য জৈববৈচিত্রতা রক্ষা করে কিন্তু এই শিয়াল মশাই।এই প্রাকৃতিক পৌর কর্মির কথা আমরা মনে রাখিনি–যতটুকু রেখেছি পৌর সভার ময়লা বহনের ভ্যানের কথা।

কিন্ত শিয়ালের ভাগ্য প্রসন্ন নয়। ছিল না কোন কালে। শিয়ালের নানা ধূর্তামির কারণে মনে রাখিনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার এই প্রাণীর কথা।  দলবেঁধে আড়াই হাতের বাঁশের লাঠি নিয়ে চারদিকে পাকড়াও করে শিয়াল মারার ভঙ্ককর বিভৎসতা দেখেছি জীবনে অনেক বার। নিজেও যে অংশ নেই নি তাও নয়। এক উন্মত্ততা পেয়ে বসে জনতাকে। ধর ধর…..ঐ যে ঐ যে…সমস্বরে চিৎকারের ভেতর শিয়াল দাবড়ানো ও  পেটানোর  ভেতর ক্ষোভ আর জোশের ভেতর জনতার প্রশান্তি দেখবার মতো।যেন তারা চরম শত্রুকে নিকেশ কর দিল চিরতরে।

এই শেরপুর অঞ্চলে শিয়াল মারার জন্য একটা পেশাবৃত্তিই গড়ে উঠেছিল একদা।এই তল্লাটে ছিল শিয়ালের অবাধ বিচরণ।সংখ্যাও কম ছিল না। নইলে কী আর শিয়াল মারার জন্য এক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে? তাদের বলা হতো ‘ মুগম’—শিয়াল মারার জন্য তাদের ডাকা হতো।অর্থের বিনিময়ে শিয়াল মেরে জীবিকাও নির্বাহ করত। এখন সেই ঝোঁপঝাঁপ বাঁশের আড়াও নেই;নেই শিয়ালের বাস উপযোগী ঢিবি। কাজে কাজেই সময়ের দাপটে সেই পেশার বিলয় ঘটে গেছে বহুদিন হলো।

এখন প্রতিটি মানুষই মুগম।শিয়াল হত্যাকারী। যে কয়টি শিয়াল এখনও রয়ে গেছে এখানে সেখানে– শুধু শিয়াল দেখলে নয়–শিয়ালের ছায়া দেখলেই আড়াই হাতের বাঁশের লাঠি উঁচিয়ে উঠে দৌড়ে আসে মানুষের দল  ।    আর ঐ যে ঐ যে…..চিৎকার… গেরিলা আক্রমণের চিৎকার।

পুনরায় মৃত কুকুরকে গোর দেবার পর বাতাসে আর ছিল না  কোন দুর্গন্ধ। একদিন বিকেলে আমার বাড়ি ছাড়িয়ে কিছুদূর এগুলে যে মৃগী নদী সেখানেই  হাঁটতে গিয়ে দেখলাম  একটি শিয়াল পড়ে আছে নদীর কিনারে।চারদিকে মানুষের ভিড়। জলে আর বালিতে ভিজে একাকার।লম্বাটে মুখের একপাশ দিয়ে রক্ত ঝরতে ঝরতে খয়েরি হয়ে গেছে।একপাটি দাঁতের ফাঁকে আটকে আছে উল্টানো জিব।কালচে হয়ে আছে।

এই শিয়ালই কী সেদিন মৃত কুকুরকে গোর থেকে বের এনে শিয়ালেরা মিলে সেরেছিল রাতের ভোজ? আমি জানি না। ভোজ শেষ কতে পারেনি। মানুষের আঁচ পেয়ে উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পালিয়েছিল হয়তো তারা।সেটিই কি ছিল শিয়ালদের লাস্ট সাপার?

নদীর কিনারে যে শিয়াল পড়ে আছে হয়তো সে তাদেরই একজন ছিল।সঙ্গীদের নিয়ে বসে ছিল রাতের নিমণ্ত্রণে।  মানুষের যৌথ বিভৎসতার শিকার শিয়াল পণ্ডিত এখন নিস্তেজ–লেজ ছড়িয়ে পড়ে আছে;কাঁদা আর রক্তে মাখামাখি ফোলানো লেজ পেঁচানো দড়ি হয়ে পড়ে আছে মাটিতে।

শিয়ালের লেজ দারুণ দেখতে। ঝুঁটি বাঁধা চুল যেমন ফুলে ফেঁপে থাকে কিশোরীর পিঠে তেমন ছড়ানো শোয়ালের লেজ– যেন চিরুণিতে আঁচড়ানো।ফোলানো। চকিত গতিতে যখন শিয়াল দৌড়ে লোকালয় পাড় হয় তখন  এই ফোলানো লেজ আমি বহুবার দেখেছি।আবার কুকুরের আক্রমণে মুখে পড়ে যখন  কুকড়ে উঠে তখন পেছনের দুইয়ের ফাঁকের ভেতর ফোলানো লেজ বিনুনির মতো দড়িগাছার মতো চিকন হয়ে পড়ে।

তেমনি চিকন দড়িগাছার  মতো বাঘের ভাগ্নের লেজ পড়ে আছে নদীর কিনারে।এই ফোলানো লেজের বহর দেখেই হয়তো উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা ঝুলন্ত মঞ্জুরি নাম রেখেছে ফক্সটেইল অর্কিড মানে শিয়াল লেজি অর্কিড। পরাশ্রয়ী এই অর্কিডের বিন্যাসও ছড়ানো–ফাঁপানো– সাদা বেগুনি রঙের ছড়ানো লেজ। ঝুঁটি বাঁধার মতো করে ঝুলে থাকে গাছের কাণ্ড কাণ্ডে।ভারি সুন্দর দেখতে। শিয়ালের যে পন্ডিতিই থাক  না কেন এই লেজের কারনেই তাকে আমার ভালো লাগে।  ভালো লাগে বর্ণিল  শিয়াল লেজি অর্কিড। 

ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আমার চোখ আটকে আছে  মৃত কুকড়ানো লেজের গোছার দিকে।যৌথ আক্রমনের শিকার পন্ডিত শিয়ালের নিস্তেজ লেজেরর দিকে।দাড়ির মতো নিস্তেজ লেজ– সাদা বেগুনি নয়–রক্তে ভেজা; পড়ে আছে জল বালি কাঁদার চাতালে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত