| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

কয়লায় আঁকা ছবি

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

বাইরের হট্টগোলে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মেজাজটা খিঁচিয়ে ওঠে কেয়ার। কাঁচাঘুম ভাঙার বিরক্তি নিয়ে বিছানা থেকে নামতে নামতে বাইরে কোলাহলরত রমনীকণ্ঠকে উদ্দেশ্য করে রাগঝারে আপন মনে, ‘খানকিমাগি গো জ্বালায় যুদি ইকটু শান্তি পাওয়া যায়, মাগিরা ঘরে লোক তুলা নিয়্যাও ঝগড়া লাগায়। এত খাউজ ক্যান তগো?’ তারপর বাইরে বেড়িয়ে এসে পাগলার মা বুড়ির কাছে শোনে প্রকৃত ঘটনা।

কেয়াদের বাড়ি ঢুকতেই গেটের ডানপাশ লাগোয়া বাড়ির মালিক দুলাল বৈরাগির দোকানঘর। দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসে মেয়েরা কাস্টমারের জন্য অপেক্ষা করত আগে। একবার বেঞ্চিতে বসা নিয়ে দোকানে আসা কাস্টমারের সাথে রাণী ঝগড়া লাগালে গেটের বামপাশে মেয়েদের জন্য আলাদা সিমেন্টের বেঞ্চ বানিয়ে দিয়েছে বৈরাগি। আজ সেই বেঞ্চির গায়ে রাণীর মেয়ে শাপলা কয়লা দিয়ে কি একটা ছবিএঁকেছিল যেন। তারপর কোত্থেকে সামনের বাড়ির কালীর ছেলে এসে পিসাব করে দেয় শাপলার আঁকা ছবির উপর। মূত্র জলের তোড়ে শাপলার আঁকা ছবিটি ধুয়ে গেলে কাঁদতে কাঁদতে সে ধাক্কা মারে মায়ের দরজায়। ঘরে দরজা এঁটে তখন কাস্টমার সামলাচ্ছিল রাণী। বাইরে শিশুর মা মা করে কান্না ও দরজা ধাক্কায় কোনরকমে কাজ সেরে বিদায় নেয় বিরক্ত কাস্টমার। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় রাণী জানে এ লোক আর কখনো আসবে না তাঁর কাছে। তখন তাঁর সমস্ত রাগ গিয়ে পরে কালীর ছেলের ওপর। মেয়ের হাত ধরে সিমেন্টের বেঞ্চির কাছে গিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসা কালীর ছেলেকে এক চড় মারতেই শুরু হয় কালী ও রাণীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া। ওদের কথ্য-অকথ্য বাক্যবানে সচকিত হয়ে ওঠে গোটা পাড়া। ঝগড়া, গালাগালি, চুলোচুলি, কলহ এ পাড়ার নৈমিত্তিক ঘটনা। কেয়া এখানে আসার পর থেকেই দেখে আসছে এসব। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় ঘরে লোক বসানো, খাওয়া, ঘুমানোর মত ঝগড়া করাও সিএন্ডবি ঘাটের এ পাড়ার মেয়েদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাস্টমারের জন্য দাঁড়ানো, দোকানের বেঞ্চিতে বসা, কাস্টমারের হাত ধরে টানা, অন্য জনের নাং ভাগিয়ে নেওয়া; কী নিয়ে ঝগড়া করে না তারা? কাঁচা ঘুমটা ভাঙার জন্য মন খারাপ হয় কেয়ার।

বুধবারের এ সময়টাতে ঘুমানো তাঁর বহুদিনের অভ্যাস ও ক্লান্তি নিরসনের উপায়। ঘাটের পাশেই টেপাখোলায় গরুর বড় হাট বসে মঙ্গলবার। সপ্তাহের এই একদিন মৌমাছির মত কাস্টমার ঘুর ঘুর করে এ পাড়ায়। মেয়েরাও চান্স পায় হাটে আসা এসব কাস্টমারদের কাছ থেকে মোটা টাকা কামাবার। নইলে তো অন্যসব দিনে আসে কেবল ঘাটের কুলি, সর্দার ও দূর দেশের মালটানা জাহাজের খালাসি-সারেংরা। ওরা কি আর টাকা বের করে সহজে? ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, শরীয়তপুরের গরুর পাইকাররা আসে এদিন ঘাটে। আসে তাদের নৌকা-ট্রলারের মাঝি ও গরুর রাখালিরা। বিকেল পর্যন্ত হাটে ঘুরে ঘুরে গরু কিনে দল বেঁধে ঘাটে এনে জড়ো করে পাইকারের লোকজন। কিন্তু পথে অর্থ ও জীবন সংহারকারী ডাকাতের আক্রমণ, প্রবল ঘূর্ণিপাকে গরু-নৌকা সমেত অতলে নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা,রাত-নিশীথে অন্ধকার নদীরহাতছানিতে ভুল পথে চলে রাত কাবার করা; প্রভৃতি নানা বিপদের ভয়ে সন্ধ্যায় গরুভরা নৌকা ছাড়ে না ওরা। ঘাটের পাশেই ইজারাদারদের বানানো গরুর হোটেলে ঢোকায় সব গরু সারা রাতের জন্য। গরুগুলো গুণে গুণে আথালে বেঁধে ও ক্যাশ টাকা গদিতে জমা দিয়ে স্লিপ নিয়ে নির্ভয় হয় তারা। রাখালিরা গরুকে কুঁড়া-ভূষি-ঘাস খাওয়ায়, গোসল করায়। এমনকি দুধেল গাই দুইয়ে দুধচা’দোকান ও গোয়ালাদের কাছে বিক্রি করারও ব্যবস্থা আছে এখানে। সারারাত গরু ও ব্যাপারিরা বিশ্রাম নিয়ে ইজারাদরকে পাওনা শোধ করে ভোরে নৌকা ভাসায় ওরা প্রমত্তা পদ্মায়। পাইকার মহাজন ও তাদের লোক-লস্কর মিলে এত লোকের সমাগমে মঙ্গলবারের রাত ‘চানরাত’হয়ে ওঠে সিএন্ডবি ঘাটের এ পাড়ায়।

দুপুর গড়াতে না গড়াতেই মেয়েরা স্নো-পাউডারে মুখ বানিয়ে, লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙিয়ে গেটে এসে দাঁড়ায় কাস্টমারের আশায়। কাস্টমারও নিরাশ করে না তাদের। গতকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বারো জন লোক নিয়েছে কেয়া। তারপর সন্ধ্যায় ঘরে নিয়েছে মৈনটঘাটের সামছু বেপারিকে। কেয়ার দীর্ঘদিনের পরিচিত কাস্টমার বেপারি। রাতে থাকার ভিজিট, ডিলাক্স হোটেল থেকে এনে দু’জনে খাওয়া বিরানি, দুইপ্যাকেট বেনসন সিগারেট ও এক বোতল কেরুর দাম; সবই শোধ করেছে দিলখোলা সামছু মিয়া। টাকার সাথে তাঁর আরও একটা জিনিস আছে; দম। এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সেও সে একরাতে চার চারবার পরীক্ষা নিয়েছে কেয়ার। ভোররাতে আজানের সময় আর একবার আব্দার করলে আর রাজি হয় নি কেয়া।সকালে যাওয়ার সময় হাসতে হাসতে বলেছে, “তোমার চাকে যে কি মধু আছে, খালি খাইতে মন চায়। যাইতে মন চায় না।”

হঠাৎ এ পট্টিতে ঢোকার গলিতে নজর পড়ে কেয়ার। মুহূর্তেই মন ভাল হয়ে যায় ওর। ওদের পট্টির ওই মাথা দিয়ে লালজামা গায়ে দিয়ে হেঁটে আসছে জুলু। জুলু কেয়ার মনের মানুষ; পাড়ার পরিচয় নাঙ। তিন নম্বর কয়লা ঘাটেরকুলির সর্দার। সারাদিন কয়লা ঘাটের কুলি-শ্রমিক ঠেঙানো মানুষটার মনের রঙে কেয়া রাঙিয়ে নিয়েছে নিজের ভূবন। কেয়াকে ক্ষেপাতে এ বাড়ির অন্য মেয়েরা তাঁকে ডাকে ‘কয়লা’ নামে। ওকে আসতে দেখে বৈরাগির দোকানে বসা চম্পা হাসতে হাসতে বলে, “কেয়ারে, তর কয়লা আইছে। তর তো এহন ঈদ।” জুলু এসে কোন ভনিতা না করেই জিজ্ঞেস করে, “কী অইছে? মাগি দুইট্যা এই ভরদুপুরে চিল্লায় ক্যাঁ? বেশি বিগ্যার উঠলে মানকচু নিলেই তো পারে।” “তাতে তুমার কাম নাই,”কেয়া বলে,“ তুমি ঘরে যাও, পুলাপানের মারামারি নিয়্যা উরা ঝগড়া লাগাইছে। তুমি কিছু কইলে আবার আমাগো দোষ অইবো।” ওরা ঘরের দিকে রওনা দিতেই পাগলার মা বুড়ি ডাক চদেয়, “ও ক্যায়া, কয়লা ভাইরে আমার পান খাওনের পয়সা দিতি কইস কইলাম।” কেয়া হাসতে হাসতে বলে, “মরার বুড়ি, তোমার সাহস কত আমার মানুষরে কয়লা কও, আবার ট্যাকা চাও।” “হ, নাতিন জামাইর ট্যাকা নিমু না তো কার ট্যাকা নিমু এ্যাঁ।” তারপর গলায় সুর চড়িয়ে, হাততালি দিয়ে ওদের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বলে, “কয়লার রঙ টিকে না, ম্যাঘে ধুইলে পাইবি না।”

দুই.

কেয়া এ পাড়ায় এসেছে আজ তিন বছর। এই সময়ের মধ্যে কত মানুষ এসেছে ওর ঘরে। কিন্তু ওর মনে ধরেছে জুলুকে। জুলুও দাম দিয়েছে বিপদে-আপদে ওর পাশে দাঁড়িয়ে কেয়ার ভালোবাসার। সিএন্ডবি ঘাটের সবাই ওকে এক ডাকে চেনে জুলু সর্দার নামে। সেই কবে কয়লা ঘাটে এসে প্রথমে কুলিগিরি, তারপর লেবার হাটে খিচুরি বিক্রি, শেষে কুলির সর্দারি পেশায় নাম লেখিয়েছে জুলু। বড় বড় জাহাজ ঘাটে ভিড়িয়ে কয়লাওয়ালারা জুলুকে খোঁজে। তারপর সেই জাহাজ আনলোডের কন্ট্রাক্ট নিয়ে কুলি দিয়ে জাহাজ খালাস করায় জুলু। হাতে কাঁচা টাকা থাকায় প্রায়ই পাড়ায় ঢু মারত সে। কেয়ার নাঙ হওয়ার পর পাড়া তো এখন তাঁর ডাল ভাত। ঘাটে জাহাজ আনলোড করার তাড়া না থাকলেই আসে কেয়ার কাছে আর সপ্তাহের বুধবারের রাত তো তাঁর জন্য নির্ধারণ করা। এদিন যত টাকাই বলুক না কেন অন্যকোন কাস্টমার নেয় না কেয়া।

ঘরে ঢুকেই ফ্যান চালিয়ে দেয় কেয়া। জামা খুলে বাঁশের খামে পোতা লোহায় ঝুলিয়ে জুলু সটান শুয়ে পরে নানা ফুল-পাতার ছবির ছাপা চাদরের বিছানায়। টিভি ছেড়ে কেয়া জুলুর পাশে এসে শুতেই দরজায় ঘা দেয় কেউ। কেয়া চেঁচিয়ে বলে, “কেরা?” বাহির থেকে উত্তর আসে, “আমি, ঘরে লোক নাকি?” “হ” জবাব দেয় কেয়া। তারপর জুলুর দিকে পাশ ফিরে বলে, “আব্বাস, ওই যে গরুর হোটেলে থাকে। আমার ঘরে আইছিল দুইদিন। তারপর রোজ আইস্যা যন্ত্রণা করে। আমারে বিয়্যা করবো কয়।” “খাড়া, ওরে বিয়্যা করাইতেছি” বলে জুলু উঠে দরজা খুলতে গেলে কেয়া বলে, “থাক, তুমি আবার তারে কিছু কইও না।” কোন জবাব না দিয়ে গেটের দিকে হাঁটতে থাকা আব্বাসকে ডাকে জুলু, “ওই হোন।” তারপর আব্বাস কাছে আসলে গলা চড়িয়ে বলে, “খানকির পুলা, তুই জানস না কেয়া আমার মাগি? আবার যদি ওর লগে ভাব চোদাইতে আসবি তো এক্কেবারে খাইয়া ফালামু। আইজ থিকা ওরে দেখলে মা কইয়া ডাকবি। যা ভাগ কইলাম। ভাগ।” আব্বাস বলে “আমি আপনের কি করছি।” এবার জুলু কেয়ার একপাটি জুতা হাতে উঠিয়ে বলে, “আবার কতা কস, মাগির জুইত্যার বাড়ি খাওয়ার আগে ভাগ কইলাম।” তারপর কেয়ার দিকে ফিরে বলেছে, “তোরেও কই মাগি, যদি ওরে আর ঘরে তুলছস তো বুঝবি সেদিন।” বলেই একটানে জামাটা নিয়ে কোন রকমে গায়ে চাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দুলাল বৈরাগির দোকানে বসে সিগারেট ধরায়। কেয়াও তাঁর পিছু পিছু এসে ওর হাত থেকে নিয়ে সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, “চা দেও দাদু, চা খামু।”

তিন.

ক’দিন ধরে মন খারাপ কেয়ার। তিনদিনের কথা বলে দেশের বাড়ি পাবনা গেছে জুলু। দিন গড়িয়ে দশদিন পার হলেও ওর ফেরার নাম নেই। প্রিয়জন না ফেরার হতাশায় বিষন্ন কেয়া প্রায় সময়ই নির্জীব বসে থাকে দুলাল বৈরাগির সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চিতে। চম্পা, চামেলী, রাণীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে কাস্টমার ডাকতে এখন আর উৎসাহ পায় না। কেয়ার এই নির্লিপ্ততা দেখে পাগলার মা বুড়ি খালি হাসে। কখনো বলে, “মন খারাপ কইরো না গো, হতীন। নাগর তুমার আইলো বইল্যা।” আবার কোন কোনদিন কেয়ার চারপাশ ঘিরে নাচতে নাচতে সুর করে বলে,
“ধান বান্ধিয়্যা কুইড়্যা খামু, ত্যাল দিমু তুমার চান্দিতে
আমারে ছাইড়্যারে বন্ধু যাইও না বৈদ্যাশেতে।”
তবুও মন ভাল হয় না তাঁর। দু’চার জন পরিচিত কাস্টমার যারা পূর্বোক্ত সম্পর্কের জেরে ওর ঘরে আসে তারাও যেন নতুন আবিষ্কার করে অন্য আরেক কেয়াকে। জুলুর এই অনুপস্থিতির সুযোগে আব্বাস এসেছিল কেয়ার ঘরে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় আসতেই শুরু করেছে সেই পুরানো প্যাঁচাল। “তুমি জানো না, আমি হ্যার এলাকার একজনের কাছে খোঁজ নিছি। হেরা ঝাড়বংশে চিটার। ওর বাপ জেল খাটছে জাল দলিলের কেসে। অর নামেও চুরির কেস আছে। আমি তুমারে সত্যই ভালজানি। তুমি ওরে ছাইড়্যা দেও। আমি তুমারে নিয়্যা যামু এহান থিক্যা। মাথায় তুইল্যা রাখমু তুমারে।” তখন বিরক্ত হয়ে কেয়া বলেছে, “আহারে নাগর রে! তুমার এত ভালোবাসার দরকার নাই। যে কাম করতে আইছো, হেই কাম কর। হে আইলে তো তাও পারবা না।” কাঁটায় কাঁটায় বিশদিন পার করে ফিরে আসে জুলু। ওকে দেখে মরা নদীতে জোয়ার ডাকার মত চাঙা হয়ে ওঠে কেয়া। পাবনা থেকে ওর জন্য নিয়ে আসা নতুন রাঙা শাড়ি পরে সারাক্ষণ সেজে গুজে থাকে। কাস্টমাররাও যেন আবার খুঁজে পায় সেই হারানো কেয়াকে। যেদিন জুলু ওর ঘরে রাত কাটায়, সেদিন সমস্ত গহনায় শরীর মুড়ে তাঁর বুকে মুখ গুজে নানা গল্প ও সুখ-স্বপ্নে বিভোর হয়ে রাত পার করে সে।

চার.

জুলুর কাছ থেকে প্রস্তাবটা শোনার পর কেয়া বাকরুদ্ধ হয়েছিল কত সময়ের জন্য তা নিজেই বলতে পারবে না। অনেকক্ষণ পর সে যেন নিজেকে ফিরে পেয়েছে নিজের ভেতর। তাঁর এই যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনে আল্লাহ যে এত সুখ লিখে রেখেছে তা তাঁর বিশ্বাস করতে এখনও কষ্ট হয়। ঘটনা এই, গতরাতে জুলু ছিল ওর ঘরে। অনেক গল্প-কথার পর রোজকার অভ্যাসমত কেয়ার লাল ব্লাউজের ভেতর হাত ঢুকায়। তাঁর প্রিয় খেলনা ওর বুকের তিতিজামের মত বোঁটা দুটো। তারই একটা নিয়ে খেলতে খেলতে বলে, “আমি এখান থেইক্যা চইলা যাম। সর্দারি আর করমু না। তুইও ল আমার লগে। দুইজনে ঘর করমু দেশে গিয়্যা।” প্রথমে বিষয়টা বুঝতে পারে না কেয়া। বলে, “কী কও?” “হ, যা কই ভাইবাই কইছি। দেশের কেউ তো আর তরে চিনে না। ভাব-ভালোবাসা কইরে বিয়্যা করছি কইলেই মানবো হগলে। তোরে আমি সুখে রাখমু, আমারে বিশ্বাস অয় না তর?” জুলুর এই প্রশ্নের উত্তর আর দিতে পারেনি কেয়া। তিনবছর ঘরকন্নার পর দ্বিতীয় বিয়ে করে ওর স্বামী হোসেন খাঁ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় ওকে। তখন দুনিয়ার সুকঠিন নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছে সে জীবন দিয়ে। বাপের অনুপস্থিতে ভাইয়ের সংসারে ঠাঁই হয়নি। তারপর কাজের খোঁজে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ করে নানা হাত ও পেশা বদলিয়ে তাঁর ঠাঁই হয়েছে ফরিদপুরের এ পাড়ায়। এ নিষ্ঠুর দুনিয়া, তার চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর মানুষ; কাউকেই আর বিশ্বাস হয় না তাঁর। কিন্তু জুলু এর ব্যতিক্রম। জুলু কেবল তাঁর বাঁধা বাবু নয়; মনের মানুষ। এখন তাঁর পৃথিবী একদিকে, যেদিকে জুলু। মাঝে মাঝে মনে হয় সে অনায়সে দুনিয়া ছাড়তে পারবে; জুলুকে নয়।

কোন ভাবনা না ভেবেই কেয়া সায় দিয়েছে জুলুর প্রস্তাবে। তারপর দু’জনে মিলে যুক্তি করে, কি করে পাততারি গোটানো যায় সিএন্ডবি ঘাটের এ জীবনের। সিদ্ধান্ত হয়, প্রথমে কাউকে কিছু জানাবে ওরা। ঘর ফাঁকা হওয়ায় ব্যবসা লসের কারণে কেয়ার চলে যাওয়ায় বাঁধা দিতে চেষ্টা করবে বাড়িওয়ালা। তারচেয়ে নিজেদের নেওয়ার মত যা আছে তা নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে সময় বুঝে একদিন ভাগলেই হল। এটাই এ পাড়া থেকে বিদায় নেওয়ার প্রচলিত নিয়ম। কেয়া এ পাড়ায় আসার পর থেকে এভাবেই এ পেশা ছাড়তে দেখেছে মেয়েদের। যারা ছাড়তে পারে না এ পেশা তারা এখানেই যৌবন পার করে বৃদ্ধ হয়, ধুকে ধুকে জীবন কাটায় মৃত্যুর অপেক্ষাতে; পাগলার মা বুড়ির মত।

জুলু ঘাটের কুলি সর্দার, এখানে তাঁর বিষয় সম্পত্তি বলতে ভাড়া ঘরের বিছানা চাদর, ইজারাদার-মহাজনদের সাথে খায়-খাতির, পরিচয় আর দোকানের খাতায় বিস্তর বাকি। মনে মনে ঠিক করে বিছানা চাদর, যেমন সে এখান থেকে নিয়ে যাবে না, তেমনি তাঁর নামে ঘাটের দোকানের বাকি-দেনাও শোধ করবে না। যেহেতু এ ঘাটে আর ফিরে আসা হবে না আর কোনদিন, তাঁর ধরা খাওয়ারও কোন ভয় নেই। চিন্তা কেবল কেয়ার টাকা-গহনা নিয়ে।

পাঁচ.

হৃদয়ের গোপন কুঠুরী ও শরীরের আনাচ-কানাচ চষে বেড়ানোর অভিজ্ঞতায় যে জুলু শুধু অনুমান করেছে টাকা জমানোর জন্যে কেয়ার অতিগোপন কোনা-কুঠুরী আছে; কিন্তু তার হদিস পায়নি কোনদিন। তাকে সাথে নিয়েই সে তাঁর ঘরের বাঁশের খাম ফুটো করে বানানো গোপন খোলসে জমানো চকচকে পাঁচশ টাকার নোটগুলো বের করেছে রাতে। বালিশ-তোশকের ভিতরের টাকাগুলো মিলে কেয়ার সঞ্চয় কম নয়। দু’জনে মিলে গুণে দেখে সত্তর হাজার ছাড়িয়েছে অংক। নিজের জমানো এ টাকা নির্দ্বিধায় জুলুর হাতে তুলে দিয়ে কেয়া বলে, “আমার গয়না বাদে সমিতিতে সঞ্চয় আছে আর ধর চল্লিশ হাজার। এহন ওইড্যা তুললে আর চিন্তা নাই।”

ভোর না হতেই দু’জন গিয়েছে সমিতির অফিসে। তারা বলেছে, ‘দুদিন লাগবে সব কাগজ ঠিক করতে। তারপর টাকা পাওয়া যাবে।’ সমিতির টাকা উত্তোলনের খবর পাঁচকান হওয়ার আগেই কেয়া জুলুর বুদ্ধিমত নিজেই জানিয়েছে সবাইকে। ঘাটের দোকানদার-মহাজনেরা চড়া সুদে টাকা নেয়। কেয়া এখন সুদে টাকা খাটাবে কয়লা ঘাটের মহাজনদের কাছে। ফলে সমিতির সঞ্চয় ভাঙা নিয়ে আর প্রশ্ন তোলেনি কেউ। বরঞ্চ ইর্ষা করছে অন্য মেয়েরা; নটিগিরির টাকায় তাঁর সুদের ব্যবসা করার সৌভাগ্য দেখে।

পরিকল্পনা মাফিক সব কিছু ঠিকঠাক ঘটায় মনে মনে খুশি হয় কেয়া। গত কয়েকদিনে তাকে বিষন্ন দেখেনি কেউ। পায়ে আলতা দিয়ে স্নো-পাউডার-লিপস্টিকে মুখ বানিয়েছে সুন্দর করে। অভ্যাসমত সদ্যধোয়া বাম হাতের তালুতে মুখ ঢেকে হেঁটে এসেছে গেটে। সূর্যের দিকে মুখরেখে ডানহাতে সৃষ্টিকর্তাকে তিনবার সালাম জানিয়ে দিনের যাত্রা শুরু করেছে আজ। তাঁর হাসি হাসি মুখ দেখে পাগলার মা বুড়ি টিটকারি মারে, “কিরে ক্যায়া, এত খুশি ক্যান? নাগর আইবো বুঝি?” কেয়াও মুখ ঝামটা দেয়নি আজ তাঁকে, বরঞ্চ নিজেও যোগ দিয়েছে হাসি-ঠাট্টায়, “আইলেই বুড়ি তুমার কি, তুমার ঘরে তো আর বইবো না।” “হ, হে তো আমি জানি। আমার কি আর হে দিন আছে,” তারপর সুর টেনে নেচে নেচে বলে,
“সই লো সই, কিলো সই, একখান কতা কই,
কয়লার রঙ্গে রাইঙ্গো না, জলে সে রঙ টিকবো না।
কয়লার কালি মুখে মাইখ্যা সঙ সাইজ্যা কাইন্দো না।”
তখন বুড়ির নাচের সাথে হাততালি দিয়েছে গেটে খদ্দেরের খোঁজে দাঁড়ানো রাণী, চম্পা, চামেলীরা। ওদের শরীরে আনন্দ এসে হিল্লোল তুলে; প্রমত্তা পদ্মার বাঁকানো ঢেউয়ের মত। তার দোলায় হাসির দমক, ওরা দুলতেই থাকে।

ক’দিন ধরে বেশ বৃষ্টি নামছে। আষাঢ়ের টানা বৃষ্টি। হঠাৎ দু’একবার যদি বৃষ্টি থামে তো পরক্ষণেই আবার নামে আকাশ ভেঙে। বৃষ্টিতে গলিতে ঢোকার রাস্তায় পানি জমে থিকথিকে কাদা হওয়ায় সহজে এ রাস্তা মাড়ায় না খদ্দেররা। আয়-ইনকাম বন্ধ হয়ে মেয়েদের না খেয়ে উপোষ করার দশা। এই বৃষ্টি-জল মাথায় করে জুলু আসে কেয়ার কাছে। বৃষ্টিস্নাত দুপুরে ঘরের দরজা এঁটে আদর সোহাগে ভরিয়ে তোলে ওকে। তারপর বলে, “আইজ রাইতে রেডি থাকিস, ঠিক কাটায় কাটায় তিনট্যা বাজলেই চইল্যা আসবি মেইন গেটের সামনে। তারপর আমি নিয়্যা যামু তরে।” বিস্মিত কেয়া জিজ্ঞাসা করে, “এই ম্যাগের দিনে যামু?” “হ, ম্যাগের দিনই তো ভালো। সবাই ঘুমাইয়্যা থাকবো। আমরা ভাগমু,” বলে হি হি করে হাসে জুলু। তারপর বলে, “যা যা নিবি, আমার কাছে দিয়্যা দে।” কেয়া নিজের বিছানার নিচ থেকে সমিতি থেকে তোলা চল্লিশ হাজার টাকা ও গহনার পোটলা বের করে দিয়েছে ওর হাতে। ঘড়ি ধরে ঠিক তিনটায় বের হওয়ার কথা বার বার মনে করিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছে জুলু।

উত্তেজনায় সারারাত ঘুম আসে না কেয়ার। বার বার উঠে ঘড়ি দেখে আর হিসাব করে তিনটা বাঁজতে কত দেরি। তারপর গলিতে কোন মানুষজন না থাকলেও অতি সন্তর্পনে তিনটা বাঁজার কয়েক মিনিট আগেই উপস্থিত হয় মেইন গেটের মাথায়। রিদি ফার্মেসির সামনে জ্বলা টিমটিমে আলোর হাত থেকে বাঁচতে রাস্তার পাশের কাঁঠাল গাছের ছায়ার নিচে এসে জমাট বাঁধা অন্ধকারে দাঁড়ায় সে। ডানে বামে যে দিকেই তাকায় কোন মানুষের চিহ্ন নেই। পায়ের উপর হামলে পরা মশাদের অন্য পা দিয়ে তাড়ায় আর ভাবে, ‘এখনো আসছে না কেন, জুলু।’ তিনটা পার হয়ে চারটা বেঁজেছে সেই কখন, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ছাপিয়ে শুরু হয়েছে ভারি বর্ষণ; এর মধ্যে দু’একটা কুকুর ছাড়া আর কেউই আসেনি এ রাস্তা ধরে।

ছয়.

রাতে দুলাল বৈরাগির দোকানের বারান্দায় ঘুমায় পাগলার মা বুড়ি। এমনিতে সারারাত ঘুম হয় না তাঁর। কাকভোরে জেগে ওঠে রোজ। আজ শেষরাতে বৃষ্টিতে নামা হালকা হালকা শীতভাব যেন তাঁর চোখে নিয়ে এসেছে রাজ্যের ঘুম। তবুও এ পট্টিতে সবার আগে ঘুম ভাঙল তাঁর। নোংরা-ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত কাঁথা-বালিশ বগলে নিয়ে দোকান থেকে বেড় হতেই চোখ পড়ে বামপাশের সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চিতে। সেখানে ঝুম বৃষ্টিতে ঠায় বসে কাঁদছে কেয়া। কান্নার দমকে বারবার কেঁপে উঠছে দেহ। বৃষ্টির জলধারা ওর চোখের জল-কাজলের সাথে ধুয়ে নিচ্ছে বেঞ্চির গায়ে রাণীর মেয়ের আঁকা লতা-পাতায় মোড়ানো ফুলের ছবি। স্মৃতি হাতরে মনে করে বুড়ি; কয়েক বছর আগে এরকম অন্য এক ভোরে পোয়াতি রাণীকেও কাঁদতে দেখেছিল সে।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত