Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla golpo amit chakraborty

ইরাবতীর গল্প: সাক্ষাৎকার । অমিতরূপ চক্রবর্তী

Reading Time: 11 minutes

একটা উন্মুক্ত ভগের সামনে কিলবিল করছে দলা দলা মানুষ। এরা সবাই ভেতরে ঢুকবে বলে এমন কিলবিল করছে। ফাঁক করা ভগের দু-পাশে দুটি সিভিক পুলিসের উর্দি পরা মেয়ে, তাদের একজনের মুখ পাকা গোলাপজামের মতো, অন্যটিকে দেখলে পাতিকাক ছাড়া অন্যকিছুর কথা মাথায় আসবে না। এই ফল এবং কাক দুজনে মিলে বাচ্চা সাপের মতো কিলবিল করা মানুষগুলোকে সামলাচ্ছে। চেঁচিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলছে লাইন মে আইয়ে, লাইন মে আইয়ে। সাপের বাচ্চারা কী আর শুনবে? ওদের তো কানই নেই। ওরা যেমন কিলবিল করার, তেমনই কিলবিল করে যাচ্ছে।

ভগের সঙ্গে আটকানো কোলাপসিবল গেট। ভেতর থেকে অনেক মানুষ বেরিয়েও আসছে। যেন লালা ঝোল ফুল ছাড়াই শুকনো পরিচ্ছন্ন জন্ম হচ্ছে মানুষের। এবং জন্মেই যারা বিভিন্ন অভিমুখে চলে যাচ্ছে, তারা সবাই পোশাক-পরিচ্ছদ পরা। কেউই উলঙ্গ নয়। পরিণত জেন্ডার বিভাজন। সকলেরই হাড়গোর মাংশপেশী সুগঠিত। ধূসর পরিপক্ক মস্তিষ্ক নানা প্রজাতির চুল দিয়ে ঢাকা। খুলির চাদরও বেশ মজবুত। ফল এবং কাক জন্মকামী মানুষদের কিছু বলছিল না। তারা নিজেরা একটু সরে গিয়ে ইজি একটা রাস্তা করে দিচ্ছিল শুধু। শুধু মোটা সুতির জামার নীচে ব্রা-এর মুঠোয় চাপা স্তনের তৃণশীর্ষ সেই রাস্তাকে একটু কণ্টকিত করার মতো পরিবেশ তৈরি করেছিল – এই যা।

যদি এই কিলবিল করা সাপের বাচ্ছাগুলোকে একটা গোটা সাপ ধরা যায়, তাহলে আমাদের বন্ধু চরিত্র সুজয় দাঁড়িয়েছিল লেজের দিকে। লেজটা যেখানে একটা গাজরের সমান ব্যাস নিয়ে আছে। সুজয়কেও ওই ভগ দিয়ে ঢুকতে হবে এবং আগে যেমন বলা হলো, তেমনই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জন্ম নিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে এই ঢোকা এবং বেরোনোর মধ্যে কত দীর্ঘ সময় (সময় নাকি জীবন?) কাটাতে হবে তা সুজয় জানে না। সেটা নির্ধারিত করেন অভ্যন্তরের সুবেশ দেবদেবীগণ এবং ভেতরের কিউতে থাকা আরও অনেক কিলবিল করা সাপের বাচ্ছারা। তবে ভেতরে বাইরের মতো অতো কিলবিলানি নেই। বরং যেন শঙ্খলাগার মতো স্থির। উদগ্রীব।

সুজয় একবার জামা ও প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখল অস্ত্রশস্ত্র সব ঠিকঠাক এনেছে কিনা। সে দেখল জামার বুকপকেটে ব্যাঙ্কের বই হিমশৈলের মতো চূড়া দেখিয়ে ভেসে আছে। তার মধ্যে নিশ্চয়ই ভাঁজ হয়ে ঘামছে বাড়ি থেকে লিখে আনা নিজের প্যানকার্ড। প্যান্টের বাঁ দিকের হিপপকেটে গোল করা চেকবইটা, যা তার বলতে গেলে কাজেই লাগে না (আজ অবশ্য লাগল এবং আরও লাগতে পারে)। সামনের পকেটে মোবাইল আর কলম। একবার সবটা হাতড়ে নিশ্চিত এবং নির্ভয় হলো সুজয়। সবই ঠিকঠাক এসেছে।এখন ভগের ভেতরকার ঠাণ্ডায় ঢুকে পড়তে পারলেই হল।

সাপের লেজে দাঁড়িয়ে নিতান্ত সময় কাটানোর জন্যই ফল আর কাককে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল সুজয়। প্রথমে সে ফলকে জরিপ করছিল। পাকা গোলাপজামের মতো মুখ–ঠিকই মনে হয়েছে। কপালের শেষে কোঁকড়া চুলের সীমানা। ভুরুতে অনেক বেশি পেন্সিল ঘষে রঙ করা এবং এজগুলোকে পেন্সিল দিয়েই টেনে লম্বা করে নামানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় নাকটি তেমন কিছু নয়। ঠোঁটদুটোকে ঠিক ফুলের পাপড়ি বলা যাবে না। উপমা খুঁজতে গিয়ে সুজয়ের জামবুরার কোনার দিকের কোয়াগুলির কথা মনে পড়ল। যেগুলো সবশেষে খাওয়া হতো। সাদা স্পঞ্জের ভেতর থেকে নখ দিয়ে বের করে খেতে হতো। দাঁত পড়লেই ফিনকি দিয়ে সারা মুখগহ্বরে রস বেরতো– তেমন। যদি চোখ ধরা যায়, সেখানে কিছুই বলবার মতো নেই। বলবার এইটুকুই যে, সেটা একজোড়া চোখ। সাদা জামায় কালো বোতাম লাগানো। বোতামগুলি এদিক-ওদিক ঘুরছে। এরপর গলা, সেখানে আদুরে ভাঁজ আর তারপরেই মোটা সুতির জামার কলার। রঙ আকাশ-নীল। এর আড়ালে ঢাকা বাকি সব ভূ-প্রকৃতি। স্তন বেশ ডাকাবুকো, তার ওপরে ঢাকনা দেওয়া দুটো পকেট। এই পকেটদুটো দেখলে যে কেউ বলে দিতে পারে ওগুলো কোনও কাজের নয়। শুধু কারুকাজের কথা মাথায় রেখেই তৈরি। যদি কারুকাজই হবে– তাহলে ওমন অকর্মণ্য দুটো ঢাকনা দেওয়া পকেট কেন? কোনও লতানো ফুলের নকশাও তো হতে পারত। পুলিসের উর্দি বলেই কি এখানে জেন্ডার বিভাজন রাখা হয় নি?

এবার কাক। পাতিকাক একদম অ্যাপ্রোপ্রিয়েট উপমা তবে মানবতার দিক থেকে কটু। মা কাক আর বাবা কাক যখন মিলিত হচ্ছে তখন সে কোথায়? তাকে তো কেউ চয়েজের অপশনও দেয়নি। সে তো জানেই না কখন তাকে ঘিরে ডিমের খোলা তৈরি হল এবং তার জন্য বাইরে সারাজীবনের জন্য একটা সমাজ, একটা গোত্র প্রস্তুত হয়ে গেল। ঠিক আছে, এই উপমা না হয় প্রত্যাহার করে নেওয়া যাবে– এখন দেখা যাক তার মধ্যে দর্শণীয় আর কী কী আছে।

নিজের মধ্যে এমন ইন্টারভিউ চালাতে চালাতে একসময় একটা সিগারেটের জন্য ঠোঁট চুলকে উঠল সুজয়ের। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সামনাসামনি একটা ঝুলো দোকান আছে অবশ্য। নানাবিধ গুঠকার ঝালরের আড়ালে একজন বসেও আছে। তার মুখ নেই। গেঞ্জী পরা গা আর হাত আর লুঙ্গি ওঠানো থাই দেখা যাচ্ছে। হাতগুলো কেমন যেন বেঁটে বেঁটে। থাইয়ের মাংস বুড়িয়ে যাওয়া। সুজয়ের ভেতরে যে ইন্টারভিউ চলছিল, তার সেক্রেটারিয়েট টেবিলের একপ্রান্তে বসা একটি লোক আমাদের এই সুজয়কে প্রশ্ন করল কেন? দোকানির হাঁটুর উর্দ্ধভাগকে আপনার উরুর বদলে থাই মনে হল কেন? থাই আর উরুর গঠনগত ডাইনামিক্সে কোনও পার্থক্য আছে নাকি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে একটু ভাবতে হল সুজয়কে। ঠিক যেন সত্যজিৎ রায়ের প্রতিদ্বন্দী সিনেমার ইন্টারভিউয়ের দৃশ্যটার মতো। ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি। বোর্ডের ফর্সা ব্যাঙগোছের একজন লোক ওঁকে জিজ্ঞেস করছে আপনি কি কম্যুনিস্ট?

সুজয় খানিকটা ভেবে বলল, দেখুন উরু শব্দটার সঙ্গে একটা নান্দনিক যোগ আছে। সাধরণত উরুর উপমায় কী সব অবজেক্ট ব্যবহার হয়? থাম, কদলীবৃক্ষ অথবা মিনার। ভেবে দেখুন এইসব অবজেক্টগুলোর সবকটিই নান্দনিক, প্রাণবন্ত এবং কিছুটা ফেমিনিন। আর থাই বলতে বাজারে ঝোলানো খাসি অথবা পাঠা অথবা ব্যায়ামবীরের কথা মনে হয়। এই দোকানির ক্ষেত্রে আমার ছাল ছাড়ানো বাসি একটা খাসির ছবি মনে হয়েছে। যার থাইয়ের থেকে মাংস নিয়ে প্রেসারে দুদিন ভাপালেও দড়ি দড়ি মনে হবে– তেমন। তাই থাই ভেবেছি। সুজয়ের উত্তরে প্রশ্নকর্তা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে চেয়ার থেকেই উবে গেল।

পেছনেই একটা শালকাঠের মতো এবড়োখেবড়ো লোক। সুজয় ওকে বলল আপনার আগে আমি আছি। কাউকে দাঁড়াতে দেবেন না। একটু বাথরুম করে আসি। লোকটি কাঠের, তাই একটু দুলে উঠল বোধহয়। সুজয় ঠিক ধরতে পারল না।

সুজয় সেই ঝুলো দোকানটার সামনে গিয়ে নিচু হয়ে ভেতরের দোকানিকে বলল, একটা সিগারেট দিন। দোকানি যেন যন্ত্রের মতো বলল কোনটা? সুজয় তার পছন্দের ব্র্যান্ডটার নাম বলতেই লোকটা কেমন একটা তেলতেলে, নখের নীচে নোংরা জমা হাতে সুজয়কে সিগারেট আর দেশলাই এগিয়ে দিল অথচ ওর দেহ অ্যাতোটুকু নড়ল না। সিগারেটটা নিতে নিতে সুজয়ের মনে হল, লোকটা হয়তো ইচ্ছেমতো নিজের হাত লম্বা আর ছোট করতে পারে। একটা দশটাকার নোট থেকে সিগারেটের দামটা কেটে যখন খুচরো ফেরাল– তখনও তাই। তার বডি একটুও নড়ল না। হাত এসে খুচরোটা দিয়ে গেল।

সিগারেট ধরিয়ে একবার মাথার ওপরে চাইল সুজয়। আকাশে গভীর নীল। শেভিংফোমের মতো কিছু দূরে দূরে মেঘ। অবশ্য নদীর ধারে ফুটে থাকা কাশফুলের মতোও বলা যেতে পারে। কিন্তু কাশফুলের পিঠ বেঁকে থাকে। যেন ভারবাহী পোর্টার কিন্তু মেঘগুলোর পিঠ তেমন বেঁকে নেই। বরং শুভ্র ফেনার মতোই। সুজয়ের মনে পড়ল তার নাক আর ঠোঁটের মাঝে একটা জড়ুল আছে। ফেনায় ঢেকে গেলে তার অবস্থান আয়নায় ঠিক বোঝা যেত না। সুজয় তখন তাকে ফিল করত মানে অনুভব করতো। তারপর রেজার টানত। নিজের অনুভব ব্যবহার করেও কয়েকবার ঠকে গেছে সুজয়। ব্লেডের কানা লেগে শুভ্র ফেনার স্তর ফাটিয়ে বেরিয়ে এসেছে কখনও নিজের মনে-না-করা রক্ত। বেরিয়ে আসার পরই তাকে নিজের মনে হয়। অপত্যবোধ জাগে। অনুভবে এমনই ঠকেছে সুজয়। কখনও জড়ুলের অবস্থান বুঝতে গিয়ে, কখনও অর্পিতার অবস্থান বুঝতে গিয়ে।

সেক্রেটারিয়েট টেবিলের অপর প্রান্তে বসা একটি ছাই ছাই অবয়ব হঠাৎই সুজয়কে বলল অর্পিতার কে, সেটা খোলাখুলি বলুন। কিছু গোপন করবেন না। সুজয় এখন তেমন থামল না। থামবেই বা কেন। বারো বছর হতে চলল তাদের বিয়ে। এখনও থামতে হবে নাকি? বার বছর কথাটা একবার ভাবল সুজয়। মানে একযুগ। যুগ? সুজয় অবাকই হল। সভ্যতার ইতিহাসে কতযুগ। হিমযুগ. পুরনো প্রস্তর যুগ, তাম্রযুগ কিম্বা সুবিখ্যাত নিওথিলিক যুগ– যেখানে শব্দ নেই। শুধুই স্তব্ধতা। স্তব্ধ তো অর্পিতাও। ও বোধহয় ওই নিওলিথিক যুগের। সেই যুগটা আস্তে আস্তে সুজয়কেও ঢেকে ফেলছে। এই বারো বছরে কীরকম বেপথু হয়ে গেছে অর্পিতা। নিঃসাড়ে ঘুমোয়। কখনও সুজয় কোমর জড়িয়ে ধরে উষ্ণ হয়ে শুলে মনে হয় একটি ফাঁকা মাটির কলসী জড়িয়ে ধরে সে শুয়ে আছে বা অতিকায় একটা বিলিতি কুমড়োকে। যা দিয়ে সুন্দর একটা পদ হয় দু’বেলা, এমনকি সপ্তাহের বেশ কদিন প্রাইমারি মেনু হিসেবেও চলে যায় কিন্তু নালিগ্রন্থির মধ্যে যে শূন্যতা– তা মেটে না। প্রকান্ড খালি হলঘরে যেমন নিজের চটির শব্দ বা কাশির শব্দ গমগম করে– তেমনই নলিগ্রন্থির ভেতরে শূন্যতা গমগম করে। কিন্তু সুজয় কি কামব্যাক করে নি? বহুবার বহুবার ফিরে আসতে চেয়েছে। নতুন উইলো কাঠের ব্যাটে, প্যাডে, হেলমেটে। প্রচণ্ড আর্দ্র আবহাওয়ায়। বল যেখানে ভীষণ ভীষণ সুইং করে। হয় ব্যাটের কানায় লেগে ক্যাচ ওঠে নয়তো সোজা ভেতরে এসে স্ট্যাম্প চুরমার করে দেয়। তাও ওপেন স্ট্রাইক নিতে এগিয়ে আসেনি কি সুজয়? কিন্তু অর্পিতা গলে যাওয়া চকলেটের মতো। বিছানার সঙ্গে সেঁটে আছে। টেনে তুললেও লগবগে হয়ে থাকে। ভূতে পাওয়া মেয়ের মতো বুকে মাথা নামিয়ে ঢুলতে থাকে। চুলগুলো মাথা কপাল উপছে এসে করুণাময়ী স্তনের গায়ে ঝুলতে থাকে। অ্যাটাকিং খেলার মতো সুজয়কেই যা করার করতে হয়। তারপর ঘুমজড়ানো চোখে নির্বস্ত্র অর্পিতা যখন পোশাক গলিয়ে বাথরুমে যায়, তখন নগ্ন হয়ে দেওয়ালে বা বালিশে ঠেস দিয়ে থাকতে থাকতে সুজয়ের মনে হয় এই ইনিংসটাও ব্যর্থ হলো। বা এই কামব্যাকের হয়তো কোনও প্রয়োজনই ছিল না। গ্যালারিভর্তি তার অপদেবতারা দেখল সুজয় সান্যাল আবারও ফেলিওর। তারা মুখে চুঃ চুঃ শব্দ করে উঠে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। ঘরে শুধু ক্রাশড মিনারেল ওয়াটারের বোতল পড়ে থাকে। সুজয়ের জামাকাপড়, ব্যাট জুতো হেলমেট পড়ে থাকে। একটু পরেই অর্পিতার শ্বাসপ্রশ্বাস বুঝি নভোমণ্ডল থেকেও শোনা যায়।

ছাই ছাই অবয়বটি সুজয়কে বলল কিছু কি গোপন করে যাচ্ছেন? সুজয় বেশ সপ্রতিভ ভাবেই বলল হ্যাঁ, একটা ঘটনা গোপন করে যাচ্ছি। যদি জানতে চান কেন, তাহলে বলব সেটা মনে করতে চাই না। ছাই ছাই লোকটি বলল মনে না করতে চাইলেও কি মনে পড়ে না? সুজয় টেবিলের কাঠের পালিশ কিছুক্ষণ দেখে বলল, হয়, মনে হয়। আমার মনে হয় ওই ঘটনাটর পর থেকেই নিওলিথিক যুগে চলে গেছে অর্পিতা। অন্তহীন স্তব্ধতার প্রান্তর ছাড়া ওর আর কিছু নেই। ছাই ছাই অবয়বটি বলল জমানো কথা অনেক সময় হৃৎপিণ্ডে, ফুসফুসে পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করে দেয়। যদি চান তো বলতে পারেন। সুজয় বলল উঁহু, এটাকে ঠিক বলা হয়তো যায় না। বরং কনফেশান শব্দটাই সঠিক। সুজয় অবয়বকে বলল ওই দেওয়ালে তাকান।

দেখা গেল সুজয়ের বুকের একটা গোল ঢাকনা সরে গিয়ে সেখানে পুরনো দিনের খটখট করে চলা একটা প্রোজেক্টার থেকে আলো বেরচ্ছে। চারকোনা সেই ফোকাস পড়েছে উদ্দিষ্ট দেওয়ালে। পুরনো সাদাকালো ফিল্মে যেমন দেখা যায় জাতির জনক চরকা কাটছেন অথবা নেহেরু গলায় মালা পরে বক্তৃতা করছেন– তেমন সাদকালো ছবি।সুজয় আর অর্পিতার ঘর। অর্পিতা বিছানায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর সুজয় ঘরময় পায়চারি করছে। অর্পিতার মাথায় হাত রেখে বলছে বোঝার চেষ্টা করো, এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। আমাদের বিয়ের দু বছরও হয় নি। এখন ইসু নেওয়া আমাদের সম্ভব নয়। আমার সেভিংস কোথায়? মাসখরচ আর ঘরভাড়া দিতেই তো সব শেষ। ইস্যু নিতে গেলে কম করে চল্লিশ পঞ্চাশ হাজারের ধাক্কা। প্লিজ তুমি বোঝার চেষ্টা কর। আমি এখন কোথায় পাব অ্যাতোগুলো টাকা। এখন না নিয়ে বরং কয়েকটা দিন পরেই নিই। সে একটা নিজের ঘর, একটু স্বাচ্ছন্দ্যে আসুক। প্লিজ অর্পিতা!

পরে আরেকটি দৃশ্য। হাসপাতালে বাসি রজনীগন্ধার মতো শুয়ে আছে অর্পিতা। চারপাশে সবুজ, যদিও ফিল্মে সব সবুজকেই কালো দেখাচ্ছে। কেবিনের দরজায় ৫০৩ লেখা নাম্বার প্লেটের সামনে দাঁড়িয়ে গলায় স্টেথো ঝোলানো একজন চিকিৎসক সুজয়কে কিছু বলছেন অথবা বোঝাচ্ছেন। সুজয় মেঝের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন সেটা সমুদ্রে ভাসমান কোনও কাচের মেঝে। নীচে শৈবাল, প্রবালশিরা, বিচিত্র ফুল, নিমো ফিশ– এসব দেখা যাচ্ছে। শুধু একবার একটা শোনা গেল একটি কণ্ঠ বলছে ঈশ্বরকে ডাকুন, যদি ওয়ান ফাইন মর্নিং কোনও মিরাকল ঘটে যায়। তবে এখনকার রিডিংএ দেখা যাচ্ছে ওর ব্লাডারটাই ভেরি ব্যাডলি হ্যাম্পার্ড।

প্রোজেক্টারের খটখট বন্ধ হয়ে আলো নিভে গেল। সুজয় অন্যপ্রান্তে তাকিয়ে দেখল প্রশ্নকারী ছাই ছাই অবয়বটি নেই। কেবল চেয়ারে একটা ভাসে একগুচ্ছ নকল সূর্যমুখী দুলছে।

২.

ভগের ভেতরে স্নিগ্ধ ঠান্ডা। এখানে দিনের বেলাতেও আলো জ্বলছে। সাঁই সাঁই করে ঘুরছে পাখা। জন্মকামী অনেক লোক বিভিন্ন উপদুয়ারে দাঁড়ানো। কেউ কেউ কোলে বাচ্ছা নিয়ে ভগের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ফল আর কাক তখনও বাইরে কিলবিল করা সাপের বাচ্চাগুলোকে সামলাচ্ছে। ও হ্যাঁ, কাকের কী কী দর্শণীয় রয়েছে, সেই প্রসঙ্গটা মাঝখানে হারিয়ে গিয়েছিল। এই স্নিগ্ধ ঠাণ্ডায় একটু জিরোতে জিরোতে কাকের দিকে তাকাল সুজয়। গোটা ইউনিফর্মটা ঢলঢল করছে। হয়তো শরীর আর কাপড়ের মাঝখান দিয়ে জনস্রোতের মতো হাওয়া চলাচল করছে। পাতিকাকের মুখ কিংবা ঠোঁটের রং দু-রকম হয়, এমন তো কেউই দেখেনি। সবটাই কালো দিয়ে চুনকাম করা। চুলগুলো বিসর্জনের পর মা দুর্গার কাছ থেকে চেয়ে এনে ঝোলানে হয়েছে। তাতে বটগাছে পেঁচানো মনস্কামের লাল সুতোর মতো একটা রাবার ব্যান্ড। গলাও চুনকাম করা। সুজয়ের মনে হল শুধু নখ বাদে হয়তো গোটা বাড়িখানাই চুনকাম করা হয়েছে। বাড়িখানা শব্দটি ভেবে একটু অবাক হলো সুজয়। দারুণ একটা উপমা তো! সত্যিই তো বাড়ি! বাড়ি নয়? ড্রয়িংরুম, শোবার ঘর, রান্নঘর, বাথরুম, গ্যারেজ, সিঁড়ি, ছাদ– সবই আছে। এমনকি খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে কম্পাউন্ডের বাউন্ডারি, ওড়নার মতো ঘাসের লন, বেতের চেয়ার টেবিল ছাতা সবই আছে। আম জাম পাইন এইসব গাছও পাওয়া যেতে পারে। সারভান্টস কোয়ার্টা , বুড়ো শিবের মন্দিরও পাওয়া যেতে পারে। এই বাড়িগুলোতে লোক থাকে। বাস করে। কাজে যায়। কাজ থেকে ফেরে। উৎসব-অনুষ্ঠান করে। ইনভাইটিরা আসে। খেয়ে চলে যায়। তাই নয় কি? পাখির কালো চুনকাম করা বাড়িটায় কে থাকে? হয়তো ওর স্বামী, ছেলেমেয়ে অথবা প্রেমিক। যেমন সবার থাকে। সবাই থাকে। কেউ কেউ ভাড়াটেও বসায়। সুজয় ভাবল অর্পিতার বাড়িতে কে থাকে? কেউ কি থাকে? নাকি পরিত্যক্ত বাড়িতে অর্পিতাই অশরীরী ছায়া হয়ে বিষণ্ণ গান গাইতে গাইতে হেঁটে বেড়ায়? টেবিল থেকে অনেকটা দূরে প্রায় ছায়ার মধ্যে বসা একটা লোক সুজয়কে প্রশ্ন করল কেন আপনি থাকেন না? চট করে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সুজয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। সে নিস্তব্ধ সিনেমার নায়কের মতো নিজের দুই হাতের আঙুলে একটা থুতনির সমান্তরাল ঝুলবরান্দা তৈরি করে চোখের সামনেকার দৃশ্যহীনতায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। দুই ঠোঁট কুঁচকে একবার জড়ো করল কাছাকাছি তারপর ঘাড়টা অন্যদিকে হেলিয়ে রাখল। প্রশ্ন এল কই কিছু বলুন? সুজয় আস্তে আস্তে কেটে কেটে বলল না, আমি হয়তো আর থাকি না। ঝড়-জলে ভেজা প্যাজার্সের মতো মাঝে মাঝে কার্নিসের নীচে আশ্রয় নিই। তারপর ঝড়-জল থেমে গেলে বেরিয়ে আসি। তবে থাকার চেষ্টা হয়তো করেছিলাম। বসবাসের নিয়ম ভঙ্গ করেছি বলেই বোধহয় আর পারি না।

একটা সাঁই সাঁই করে ঘোরা পাখার নীচে ছিপছিপে সুদর্শণ দেবদেবীদের একজন বসে আছে।তার মাথার ওপরে কাঁচা দুধ গড়িয়ে পড়ছে। অনেক চুপচাপ লোক সার বেধে ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুজয় যে লোকটার ইটরঙা জামার পিঠে লেখা ক্যার্লিফোর্নিয়া, তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। আশেপাশে আরও অনেক এমন লাইন, যেগুলোর মুখ সুদর্শণ সব চেহারার দিকে। সবারই চোখে নীলাভ চশমা, তাতে এই লাইনে দাঁড়ানো লোকের জন্মঠিকুজি, পাপ-পুণ্যের ছায়া। সুজয় হিপপকেট থেকে গোল করা চেকবইটা নিয়ে একটা পাতা ছিঁড়ে নির্দিষ্ট জায়গায় তার নাম এবং জমানো পুণ্যের যেটুকু খরচ করতে চায়– সেই অংকটা লিখল। সবশেষে হস্তাক্ষর। এল বর্ণটা লিখে ডানদিকে অনেকটা টানে সে– তেমন করে। বর সাজে অর্পিতার পাশে বসে একটা কাগজে এমনই হস্তাক্ষর করেছিল একদিন। এল এর টানটা চলে গিয়েছিল ডানদিকে বধূবেশে বসে থাকা অর্পিতার দিকে। অর্পিতা নাম লেখে খুদে খুদে ছাড়া ছাড়া অক্ষরে। কবেকার দিন সেসব? প্রস্তর যুগ বা হিমযুগেরও আগের? কারা থাকত তখন পৃথিবীতে?

সুজয় দেখল দুটো গ্রিল ক্রাফ্টের পেছনে একজোড়া চোখ বসে আছে। গায়ের রঙ হলুদ। কিছু না ভেবেই সেইদিকে তাকিয়ে থাকল সুজয়। চোখজোড়া ভীষণ চঞ্চল যেন পাখি। বার বার আশপাশ নিরীক্ষণ করে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কী কাজ করছে ওই চোখদুটি? প্লাক করা ভুরুর নীচে নরম মায়া। কতক্ষণ ওইদিকে সুজয় তাকিয়েছিল, সে খেয়াল ছিল না। মুখে চুরুট টানতে টানতে আইবি অফিসারের মতো একজন লোক সুজয়ের পেছন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল কী দেখছেন? একটা নিচু টেবিলে কনুই রেখে বসেছিল সুজয়। মাথার ওপরে গোল একটা আলো। বলল না, কিছু না। চুরুট টানা অফিসারটি উল্টোদিকে একটা চেয়ারে বসে বেশ কড়া ভাবে বলল মিঃ সুজয় সান্যাল, ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভারস্মার্ট। আপনি ওই ক্যাশ সেকসনের মহিলাটির চোখ দেখছেন। বলুন, দেখছেন না? সুজয় মাথাটা উপর-নীচ করল শুধু। কোনও কথা বলল না। আইবি অফিসার টেবিলে আঙুলে দুবার টোকা মেরে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল হুঁ, কোয়াইট নর্মাল– কোয়াইট নর্মাল। ইটস এ টিপিক্যাল সাইন অফ লোনলি মিডল এজ ডিপ্রেসন। বাট আপনার স্ত্রী অর্পিতার চোখও তো সুন্দর। কেন দেখেন না? নাকি ইনটেনশনালি ইগনোর করেন? এই কথাটায় বুকটা একবার কোথাও কাঁপল সুজয়ের। অর্পিতার চোখ সুন্দর? সুন্দরই তো। অর্পিতার চোখে তাকালে মনে হয় অনেকদূর অবধি যেন দেখা যাচ্ছে। বা চোখদুটো ছাড়া যেন অর্পিতার অন্য কোনও অলংকারই নেই। কতদিন সেই চোখে চোখ বসাতে পারে না সে। সুজয় চোখের পাতায় চুমু খেলে অনেকক্ষণ চোখ বুজে থাকত অর্পিতা। যেন ঠোঁটের উত্তাপ সারা শরীরের প্রত্যন্তে প্রত্যন্তে টেনে নিচ্ছে। চুরুট ঠিক সুজয়ের পেছনে এসে বলল মিঃ সান্যাল পাথুরে দুর্গম খাড়া পাহাড়ি রাস্তা দেখেছেন? দেখেছেন তো। বিয়ের পর তো আপনারা বিহারের দিকে হিলসে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ওই হিলসে টপে অনেক মানুষজন থাকে। আমার আপনারই মতো। তাঁরা ওই পাথুরে দুর্গম খাড়া রাস্তাগুলো দিয়েই চলাচল করে। কখনো নামে, আবার ওই রাস্তা দিয়েই নিজের বাড়িতে পৌঁছায়। সুজয় ভাবল এখানেও বাড়ি শব্দটা এসে পড়ল। অর্পিতার বাড়ি। খুব বড় না হলেও উষ্ণ ড্রয়িংরুম, শোবার ঘর, জানালার দিকে একচিলতে পালকের মতো ব্যালকনি। দুটো চেয়ার। অপ্রশস্ত বাথরুম কিন্তু তাতে চন্দনকাঠের মতো গন্ধ। বাড়িটা কি পাহাড়ের অনেক ওপরে? না সে-ই অনেকটা নীচে নেমে এসেছে? এইসব ভাবনার মধ্যে চুরুট বলল ঠিক আছে, আপনি আসতে পারেন। বেরিয়ে আসছিল সুজয়, ঠিক তখনই সিনেমাটিক ঢঙয়ে চুরুট বলল শুনুন, স্ত্রীর সঙ্গে একটু জোক করবেন, হাসবেন এবং হাসাবেন। ইটস এ ভেরি ইউজফুল ভিটামিন। আর যেটা করতে চাইছেন ইমিডিয়েট করে ফেলুন।

কাউন্টারে চেকটা এগিয়ে দিল সুজয়। কাচের বর্মের পেছনে থাকা দেবদেবীদের একজন হাত বাড়িয়ে চেক আর পাসবুকটা নিল। কিছুক্ষণ চেক আর দিব্যযন্ত্রে সুজয়ের ঠিকুজিপঞ্জী আর পাপ-পুণ্য দেখে বলল আপনি কি নতুন চেকবুক নেন নি? সুজয় না বলল। আরও খানিকক্ষণ বিভিন্ন রাশি, গ্রহ-নক্ষত্র মিলিয়ে দেখার পর সেই দেবদেবীদের একজন বলল এটা পুরনো চেক। এই চেকে এখন আর পেমেন্ট করা হয় না। দাঁড়ান , ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করি। একথা বলে বক্তা কিউবের দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল ওই চোখজোড়ার কাছে। সুজয়ের মাথার ওপরেই একটা ঘড়ি। সুজয় দেখল সাড়ে তিনটে পেরিয়ে গেছে। স্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়াবে সাড়ে ছ’টায়। তার মানে হাতে আর বেশি সময় নেই। খুব তাড়াতাড়ি জন্ম নিতে হবে। সেই চোখজোড়া, সেই খঞ্জনাপাখিকে মনে মনে একটা এসওএস পাঠাল সুজয়। খঞ্জনাপাখি আমার সময় খুব কম, একটু দ্যাখো। খঞ্জনাপাখি শব্দটা কোথা থেকে কেন মনে এল বুঝল না সুজয়। তবে এসওএসটি পাঠিয়ে একটু যেন শান্তি বোধ করল।

ওবেলার উন্মুক্ত ভগটি এখন অনেটাই সংকুচিত হয়ে এসেছে। বাইরে কিলবিল করা সাপের বাচ্ছার জটলা নেই আর। ফল আর কাক ভগের কাছেই দুটো চেয়ারে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। পশ্চিম থেকে একটা সরষের তেল রঙের আলো ভগের ভেতরে ঢুকে স্থির হয়ে আছে। জন্মের হার এখন কম। সরকারি বিজ্ঞাপনে যেরকম বিরতির কথা বলে– সেরকম। ইতিমধ্যে কাচের বর্মের পেছনে থাকা দেবদেবীদের একজন ফিরে এসে সুজয়কে জানিয়েছে যে, যেহেতু সেম পারসন তাই ট্রানসকশানটা হবে। আপনি একটু ওয়েট করুন। ম্যানেজারের একটা সই লাগবে। তাই সুজয় কাউন্টারের একপাশে সরে ভগের ভেতরকার অন্য সব ক্রিয়াকলাপ দেখছিল। সার্ভিস ম্যানেজারের মুকুট পরা যে দেবদেবীদের একজন, তার কাউন্টার থেকে যে মহিলাটি হেঁটে এসে সুজয়ের পাশের লাইনে দাঁড়াল, তার গাছের গুড়ির মতো উরু এবং বুলডোজারের মতো দুই স্তন। সেক্রেটারিয়েট টেবিলটার কোথাও মিনমিনে গলার কোনও লোক বসে ছিল। সে বলল এবার তো দ্বিচারিতাই করলেন। সুজয়ের টান হয়ে ওঠা দেখে লোকটি বলল ওবেলা যে নান্দনিক থিয়োরির কথা বলছিলেন, এবারে তো সেটা ফলো করলেন না? সুজয় লোকটাকে থেমে দম নেবার সুযোগ না দিয়েই বলল এখানে কি সেটা ফলো করা যায়? আপনার কী মনে হয়? এখানে নান্দনিকতার যোগ কোথাও থাকা উচিত? মিনমিনে গলার লোকটি তড়িতগতিতে জবাব দিল ডিপেন্ডস ওন ভিউয়ারস অ্যাঙ্গেল। নয়? এবার সত্যিই বলার কিছু খুঁজে পেল না সুজয়। কেবল মাথার মধ্যে উড়ে বেড়াতে লাগল কথাটা। ডিপেন্ডস ওন ভিউয়ারস অ্যাঙ্গেল। অ্যাডাপশান সেন্টারে যোগাযোগের দিন থেকেই মনে একটা ইবলিশের মাথা খয়েরের দাগ লাগা নোংরা দাঁতে হেসে হেসে বলে যাচ্ছে অন্যের মাল নিজের করে ভাবতে পারবি তো? একদিনও কি তোর মনে হবে না কোথাকার চালান ও? বৈঁচিকাঁটার বন চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল সুজয়কে। যেন দাড়িবান্দা খেলা। যেখানেই সুজয় পজিশন নেয়, বৈঁচিকাঁটার বন এসে গার্ড করে। অন্যদিকে অর্পিতার নিওলিথিক স্তব্ধতাতেও ছেয়ে যাচ্ছে সে। নাকে তুষার প্রান্তরের ফিকে গন্ধ পায় যেন। যত রাউন্ড কথা হয়েছে সেন্টারের সাথে, ফাইনাল ভিজিট, বেবি চয়েস এবং চূড়ান্ত কাগজপত্রে হস্তাক্ষর– তখনও, তখনও সুজয়ের চারপাশে বৈঁচিকাঁটার বন, ইবলিশের নোংরা দাঁতের হাসি কিন্তু সুজয় দেখল দিনান্তের ওই সরষেরঙ আলোর মতো একটা আলো অর্পিতার নিওলিথিক স্তব্ধতা আর ধূসর তুষারের ওপর এসে পড়েছে। যেন যুগবদলের সংকেত অথচ বৈঁচিকাঁটার বনে সুজয়ের কখনও কখনও হাত-পা ছড়ে যাচ্ছে। কথাটা তখনও মাথার মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে সুজয়ের। ডিপেন্ডস ওন ভিউয়ারস অ্যাঙ্গেল।

কাচের ওপার থেকে সেই দেবদেবীদের একজন রঙিন কাগজের বান্ডিলটা পাসবুক সমেত সুজয়ের হাতে তুলে দেবার পর সুজয় একবার খঞ্জনাপাখির দিকে তাকাল। কালো চোখ, গায়ের রঙ হলুদ। নিবিষ্টমনে কাজ করছে। এখন সুজয়কে জন্মগ্রহণ করতে হবে, আবার পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হতে হবে। সাপ-খোপ, বাঘ-ভালুকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। সমাজ মানতে হবে। গোত্র মানতে হবে। পেশীর জোর দিয়ে বুলডোজারকে রুখে দিতে হবে। তার পাশাপাশি সেই পাথুরে দুর্গম খাড়া পাহাড়ি রাস্তাটা দিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। যেখানে অর্পিতার শ্যাওলা-গুল্ম, বুনো অর্কিডে ঢেকে যাওয়া লাল ইটের বাড়িটি। একটি সরষে রঙ আলো যুগ বদলে দিতে সেখানে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করছে।

জন্মগ্রহণ করে ভূমিষ্ঠ হবার আগে মনে মনে একটি মেসেজ পাঠাল সুজয়। থ্যাঙ্কিউ , থ্যাঙ্কিউ খঞ্জনাপাখি।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>