| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতীর গল্প: স্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি । মোহিত কামাল

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার কমপ্লেক্সের পাঠাগারের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল জিদনি। বাইর থেকে শোরগোল শোনা যাচ্ছে ভেতরে।

এ আওয়াজ ছড়াচ্ছে কারা ?

কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিল ও। কানখাড়া করে চোখের ভুরু কপালে উঠিয়ে শোনার চেষ্টা করল সহস্র কোটি মানুষের দলবদ্ধ উচ্ছ্বসিত কলরোল। কারা তুলছে এ উচ্ছ্বাস ? এখানে এখনো তো অন্যকোনো দর্শনার্থী এসে পৌঁছায়নি। ওদেরকে নিয়ে আসা বাসটাই প্রথম এসেছে। সবাই গেছে মাজার কমপ্লেক্সের সমাধিসৌধের দিকে। ও সেদিকে না-গিয়ে একা এগিয়ে এসেছে পাঠাগারের কাছে। পাঠাগারের ভেতরের শোরগোলের টানে কৌতূহলী হয়ে এক পা এক পা করে এগোতে লাগল।

আশ্চর্য! করিডর একদম ফাঁকা। ডানে উঁকি দিয়ে দেখল একটা খোলা গ্যালারি। সেটাও ফাঁকা। কোনো জনসমাগম নেই। অথচ ভেতর থেকে জনরোল ছড়িয়ে যাচ্ছে। বাইরেও এসে হানা দিচ্ছে শব্দরাজির তরঙ্গস্রোত।

এ আওয়াজের  উৎস কী ? একই ধরনের প্রশ্ন মাথায় এল পর পর তিন বার।

জিদনির বুকের ভেতরে থেকে ছুটে আসা প্রশ্ন প্রবল শক্তি জাগিয়ে তুলল পায়ে। ও এগোতে লাগল। নাহ্, কেউ নেই আশেপাশে। কোনো গাইড নেই, পাহারাদারও নেই। বাইরের দরজা খোলা। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নানা ধরনের ঐতিহাসিক ছবি। অধিকাংশই সাদাকালো। এমন জনবিরল পরিবেশে ভয় লাগার কথা। ভয় জাগার কথা। অথচ ভয় নেই। ডর নেই। বুকের ভেতরের অদম্য সাহস খলবল করে সামনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জিদনিকে।

মূল ভবনের ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আকস্মিক থেমে গেল সহস্র কোটি শব্দের উল্লাস, কলরোল, শোরগোল।

 চমকে উঠল জিদনি! হঠাৎ এ পরিবর্তন ঘটে গেল কেন ? কারা শোরগোল তুলেছিল ? চুপই হয়ে গেল কেন ওরা ? এসব প্রশ্ন মাথায় চেপে বসার সঙ্গে সঙ্গে এবার ভেসে এল একক এক কণ্ঠস্বর। ভরাট কন্ঠ জিজ্ঞেস করল, ‘ভয় পাচ্ছো ?’

 এক ঝটকায় অন হয়ে গেল ব্রেনের কোষে কোষে আসনগেড়ে বসে থাকা অডিও-আর্কাইভ। স্মৃতির ঘর থেকে উড়ে এল পরিচিত এক কণ্ঠের আওয়াজ! চেনা কণ্ঠের তরঙ্গধ্বনি শুনে দুর্মর সাহস আবার জেগে ওঠায় জিদনি বলে বসল, ‘আবার প্রশ্নটা করুন, প্লিজ, প্লিজ! আবার! থেমে আছেন কেন ? আবার জিজ্ঞেস করুন। আবার কথা বলুন! এ কণ্ঠ আমার চেনা। এ কণ্ঠ আমার মেমোরি-সত্তায় অমলিন হয়ে আছে। আবার কথা বলুন। আবার জিজ্ঞেস করুন।’

 উত্তর নেই। কথা নেই। পাঠাগারের পুরো অন্তঃপুর নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ওর উত্তেজিত কথার তাগিদ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে চারপাশ। চারপাশের গাছগাছালির বাসায় থাকা পাখিদের স্বরেও স্তব্ধতা চেপে বসেছে। উড়াল দিতে ভুলে গেছে ওরা। পাঠাগারে এখন জেগে উঠেছে পিনপতন নিস্তব্ধতা। সুনশান নীরবতা।

 হঠাৎ জিদনির মাথার ভেতর থেকে ভেসে উঠল জীবন্ত এক স্বর :

‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে

লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি

আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।

বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।…’

‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ,

জীবনানন্দের রূপসী বাংলা

রূপের যে তার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ।…’

নিজের ব্রেনের কোডের সংরক্ষিত স্বর শুনে বেপরোয়া হয়ে জিদনি চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘তুমি নিশ্চয় টুঙ্গিপাড়ার খোকা, মিয়াভাই। নিশ্চয় তুমি বঙ্গবন্ধু। নিশ্চয় তুমি শতবর্ষের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। নিশ্চয় তুমি জাতির পিতা! নিশ্চয় তুমি শেখ মুজিবুর রহমান! কথা বলো, বন্ধু। কথা বলো।’ জিদনির কথার দাপটে পাঠাগার আবার গমগম করত শুরু করেছে। আবার শোরগোল উঠতে লাগল।

 এতে তৃপ্ত হলো না জিদনি। আরও বেপরোয়া আর অবাধ্য প্রশ্নের দাপটে চুরমার হয়ে ভাঙতে ভাঙতে বলতে লাগল, ‘তোমার কোটি কোটি স্বরের ধ্বনি কেবল এ লাইব্রেরিতে বন্দি নেই। তারা ঢুকে বসে আছে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মননে। পরবর্তী প্রজন্মও ধারণ করছে তোমার স্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি। তুমি আমার আড়ালে থাকতে পারবে না, বন্ধু। আবার শুনতে চাই তোমার কণ্ঠস্বর। দেখতেও চাই তোমাকে।’

 হঠাৎ বিউগলের করুণ সুর বেজে উঠল। বেদানবিধুর সুর জিদনির উত্তেজনা কমিয়ে দিল। চুপ হয়ে সে করুণ আওয়াজ শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলল। তারপর নিজেকে সামলে প্রশ্ন করল, ‘শোকগাথা শুনতে চাই না। শুনতে চাই না তুমি নেই। বুঝতে চাই তুমি আছো। জীবন্ত। শুনতে চাই তোমার সেই বজ্রকণ্ঠ। কথা বলো। কথা না-বললে এ পাঠাগার ছেড়ে যাব না আমি।’ বলতে বলতে মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়ল জিদনি। অবাধ্য আর বেপরোয়া জিদনির এ অবস্থা দেখে এবার বেরোল সেই স্বর, ‘মনে মনে আমাকে শুনতে পাবে, দেখতে তো পাবে না, বন্ধু। আমি যে না-দেখার জগতে চলে এসেছি।’

 ‘তাই সই। তুমি কথা বলো। তোমার কথা মাথায় পুরে নিয়ে যেতে চাই ঢাকায়। লক্ষ লক্ষ শিশুর মনে-প্রাণে-মগজে ছড়িয়ে দিতে চাই তোমার স্বর। স্বরের জাদুতে ভরিয়ে তুলতে চাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মনোজগৎ।’

 হঠাৎ জিদনি শুনল ভরাট কণ্ঠের আওয়াজ, ‘জয় বাংলা।’

 শূন্য সেকেন্ডের ব্যবধানে জিদনিও সাড়া দিল, ‘জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবি হোক।’

 স্বরধ্বনির তরঙ্গ আরও জোরাল ঢেউ তুলতে লাগল। বেপরোয়া তরঙ্গ-ঢেউ ছড়িয়ে যেতে লাগল চারপাশে- বিশ্বকবির সোনার বাংলায় সেই ঢেউ আঘাত হানতে লাগল, নজরুলের বাংলাদেশের মাটিতে কাঁপন তুলল। জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার রূপ-অপরূপ প্রকৃতি ফুঁড়ে বেরোতে লাগল অন্য আলো। সে আলোয় জিদনি দেখার সুযোগ পেল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর সোনার দেশ, বাংলাদেশ।

 পাঠাগারের দেড়-দুই হাজার বইয়ের বাক্যের শৃঙ্খলে ঢুকে থাকা বাংলা বর্ণমালারা আচমকা জোয়ারের ঢেউয়ের মতো ফুঁসে ফুঁসে উঠতে লাগল। গর্জন তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছো ? মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম ?’

 ‘কী বলো তোমরা ? আমি সত্তরের নির্বাচন দেখেছি। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মসজিদ কলোনির প্রাথমিক শাখায় তখন  ফাইভে পড়ি। ওই ছোটো বয়সেও  নির্বাচনী প্রচারে নেমেছিলাম আমরা। কাগজের নৌকা বানিয়ে, নৌকার নীচের খোলটা মাথায় টুপির মতো পরে মিছিল করেছিলাম আমাদের ক্লাবের পক্ষ হয়ে―ক্লাবের নাম ছিল “আগ্রাবাদ দুর্জয়  সংঘ”। জয়ের অর্থ তখন বুঝতাম না। তবে জয়ের প্রতিজ্ঞা নিয়ে তোমার মনোনীত ইসহাক মিয়াকে এমপি বানাতে গিয়ে মিছিলে স্লোগান তুলেছিলাম কচিকণ্ঠে। আজও মাথা গেড়ে বসে আছে সেই স্লোগান। কলোনির রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে ঘুরে আওয়াজ তুলেছিলাম, ‘আমার নেতা, তোমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।’

 ‘বাহ! কচি বয়সে মুজিবকে চিনে ফেলেছিলে ?’

 ‘কেবল চিনেছি বললে ভুল হবে, আমাদের মগজের ফাউন্ডেশনে মুজিব। চোখে মুজিব। বুকে মুজিব। মুজিব নিয়েই তো বড়ো হয়েছি। আর একাত্তরের “জয় বাংলা”, “জয় বঙ্গবন্ধু”তো মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য স্বর। সে-স্বর কী ভুলে যেতে পারি ? এ পাঠাগারে কেন ঢুকলাম জানি না। তবে মুজিবের স্বর শুনে লক্ষ মুজিব জেগে উঠেছে আমার মাথায়। তারাও কথা বলতে চায় মুজিবের সঙ্গে।’

 শব্দশৃঙ্খল থেকে জেগে ওঠা শোরগোল থেমে গেল হঠাৎ। আর সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল আবার সে-অমর, অক্ষয় স্বরধ্বনি, ‘একাত্তরে আমি তো ছিলাম কারাগারে বন্দী। কীভাবে মনে রেখেছিলে বন্দি মুজিবকে ?’

 ‘যুদ্ধ তো পরিচালিত হয়েছে তোমার নামে, প্রিয় মুজিব। তুমি তো তখন ঢুকে বসেছিলে বাঙালির মননে। মগজে। অল্পসংখ্যক বাঙালি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর। তারা বাদে সবার চোখের মনি ছিলে তুমি। ছিলে যুদ্ধের মাঠে, গেরিলা আক্রমণের মূল প্রেরণা। কে বলল তুমি বন্দি ছিলে পাকিস্তানে। তোমাকে বুকে পুরে অসীম সাহস আর তেজ নিয়ে যুদ্ধ করেছে মুক্তিবাহিনী। বিচ্ছু বাহিনীর চেতনার উৎস ছিলে তুমি। “জয় বাংলা” আর “জয় বঙ্গবন্ধু” ধ্বনি তো ছিল শক্তিশালী বুলেটের চেয়ে বড়ো অস্ত্র। এসব কথা না-বলে বন্দিত্বের কথা বলছো কেন, প্রিয় মুজিব ? এ তোমার বিনয়-কথন ছাড়া আর কোনোভাবেই দেখতে চাই না আমি।’

 ‘বাহ! ভালো লাগল তোমার কথা শুনে। আমার অবর্তমানেও তোমরা আমাকে মাথায় রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলে। ভালো কথা। তবু জানতে চাচ্ছি এখনকার করোনাযুদ্ধ কীভাবে মোকাবিলা করছো ?’

 হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে গেল। কিছুটা তাল হারিয়ে ফেললেও নিজেকে সামলে নিয়ে জিদনি বলল, ‘সন্তান হচ্ছে বাবা-মায়ের ক্রোমোজমের এক্সটেনশন; জেনেটিক লিংক। কানেকশনে মাতা-পিতার বৈশিষ্ট্য সন্তানের মধ্যে চলে আসে। তোমার স্বজন, তোমার আত্নজা হাসু এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। তোমার সাহস, প্রজ্ঞা আর ধৈর্য্যও তাঁর মধ্যে চলে আসবে সেটাই স্বাভাবিক। সাহসের সঙ্গে একাই লড়ে যাচ্ছেন বিপন্ন পরিবেশে। ভয় তাঁকে থামাতে পারেনি।’

 ‘যুদ্ধে কি সে জয়ী হবে, কী বলো তুমি ?’

 ‘তাঁকে মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে হচ্ছে, বিধ্বস্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হচ্ছে, দুর্নীতির শেকড়ও উৎপাটন করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক মৃত্যু মোকাবিলার জন্য নানা উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। যুদ্ধের ময়দানে সরব তিনি। বিশ্ববাসীর জয়-পরাজয় শেখ হাসিনার জয়-পরাজয়ের সঙ্গে এককভাবে সম্পর্কিত নয়। হয় বিশ্ব মানব জয়ী হবে, অথবা একটা জেনারেশন শেষ হয়ে যাবে। তবে যুদ্ধ চলছে। সর্বোচ্চ সংক্রমণের এ পিক আওয়ারে ফলাফল নিয়ে বেশি ভাবলে কি চলবে ?’

 ‘জনগণ হাসুর পক্ষে আছে তো ?’

 ‘জনগণ সব সময় জনগণ। কিছু কিছু চোরবাটপার নিয়ে সেই আমলেই তোমার কণ্ঠে হতাশা শুনেছি। এখনো তা দেখছি আমরা। একশ্রেণির মানুষ পেটের দায়ে রাস্তায়, তারা নিয়মবিধি মানছে না। আরেকশ্রেণি লুটেপাটে ব্যস্ত, মৃত্যুভয় নেই তাদের। আরেক শ্রেণি অতি সচেতন। ঘরে বসেও তারা আক্রান্ত হচ্ছে। এ নিয়ে তোমার হাসু লড়ছে। লড়াইয়ের ময়দানে তিনি লুকিয়ে নেই। চোখের সামনে সরব। তাঁর চাওয়া-পাওয়া হচ্ছে মানুষের মঙ্গল। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসৎ লোকের কারণে অমঙ্গলের কালো ছায়া বার বার উড়ে আসছে আকাশে। এ নিয়ে চলছে দেশ। তোমার ভাষায় বলি, জয় আমাদের হবে ইনশাল্লাহ, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। করোনাও না।’

 পাঠাগারের ভেতরের শোরগোল থেমে গেছে। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরও শোনা যাচ্ছে না। কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে জিদনি আবার প্রশ্ন করল, ‘আমার কথা শুনে মন খারাপ করেছো, বন্ধু ?’

 ‘শিল্পে কাব্যে কোথায় আছে হায়রে এমন সোনার দেশ’ উত্তরের বদলায় মুক্তিযুদ্ধের সময় শোনা সেই গানের লিরিক্স হঠাৎ উচ্চারিত হলো পাঠাগারের ভেতরে থেকে। কোটি কোটি স্বর একসঙ্গে গেয়ে উঠল পুরোনো দিনের সেই গান। জিদনির মনে হলো কিছু কিছু কথা হারিয়ে যায় না। কথার পিঠে মরচে জমে না। নিজের দেশের শিল্প-কাব্যের ঐশ্বর্যেও না। সবুজের বুক চেরা মেঠোপথের সৌন্দর্য এখনো গ্রামীণ জনপদে আগের মতোই আছে। মাজার কমপ্লেক্সে ঢোকার আগে সড়কের ডানপাশে তা দেখে এসেছে ও। আর এখন এ লিরিক্স আচমকা ওর ভেতর থেকে ঠেলে বের করে দিল সেই স্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’

 এ স্লোগান উচ্চারণে কোনো দ্বিধা নেই, সংশয় নেই। কৃত্রিমতা নেই। স্লোগানটি শুনে শব্দশৃঙ্খলে ঢুকে থাকা বঙ্গবন্ধুর শব্দস্বর খুলে গেল আবার। মনের নেতা গেয়ে উঠল, ‘…আমার হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো, অন্ধকারে পুবাকাশে উঠবে আবার দিনমণি।…’

দুই

বত্রিশ নম্বর বাড়ির সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল জিদনি। বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ পড়েছিল এখানে। আসলে কি নিথর করতে পেরেছিল ওরা বঙ্গবন্ধুকে ? প্রশ্নের ভেতর থেকে কবি রফিক আজাদের কলম উগড়ানো সত্য উচ্চারণের শব্দভেলায় চড়ে দাপিয়ে উঠল উত্তর :

 ‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,

 সিঁড়ি ভেঙ্গে রক্ত নেমে গেছে―

 বত্রিশ নম্বর থেকে

 সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে

 অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।

… স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে পড়ে আছে বিশাল শরীর।’

 রফিক আজাদের পঙ্ক্তিতে মগ্ন জিদনি হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল। দু’পা পিছিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গেল শক্ত হয়ে। পুরো সিঁড়ি কাঁপছে। দৃশ্যমান কম্পনের ভেতর থেকে জেগে উঠতে দেখল এক অলীক ভেলা। দৃশ্যমান ভেলায় দেখল তিনি নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন। জীবন্ত ছবি। সেই ছবি, যা দেখে এসেছে সমাধি কমপ্লেক্সের পাঠাগারের দেয়ালে সাঁটানো, রক্তাক্ত বঙ্গবন্ধুর ছবি। এটি এখন জীবন্ত। কীভাবে সম্ভব ? নিজেকে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নের উত্তর দিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই।

 ‘ভয় পেয়েছো ?’

 ‘পেয়েছিলাম। এখন তোমার কণ্ঠস্বর শুনে ভয় পালিয়ে গেছে। আমার সৌভাগ্য তোমাকে এভাবে দেখছি। তোমার দেহ নিথর নয়। সরব। সরব দেহে তোমার কণ্ঠস্বরও সেই ৭ই মার্চের ভাষণের মতো জ্যান্ত।’

 ‘চরম সত্য হচ্ছে আমার দেহ নেই এ জগতে। তবে আমার ইমেজ, আমার কথা তোমার মগজের সরব রাজ্যে টগবগ করছে। এজন্য আমাকে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে তোমার মস্তিষ্ক। তোমার চোখে ঢেলে দিচ্ছে দেখার আলো। তোমার মনের আলো সার্চলাইটের মতো ইতিহাসের পাতায় পাতায় আলো ঢেলে দিচ্ছে। এ কারণে দেখতে পাচ্ছো আমাকে।’

 ‘না। আমি মানি না তোমার কথা, বন্ধু। আমি আসলেই তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।’ জোর দিয়েই বলল জিদনি।

 কথার জোর দেখে সিঁড়ির ধাপগুলো এবার জোরে জোরে ঢেউ তুলতে লাগল। অলৌকিকভাবে খুলে গেল সিঁড়ির স্বর, কণ্ঠস্বর, ‘তুমি ঠিকই দেখছো, জিদনি। আমরা, এ সিঁড়ির ধাপগুলো সেই অভাগার দল, বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহটাকে বুকে ধরে রেখেছিলাম।’

‘রেখেছিলাম কী ? এখনও তো রেখেছো।’

‘ঠিকই বলেছো, শ্রদ্ধায় আর মমতায় আমাদের স্পর্শে এখনো এখানে অবিকল সেই রকম আছেন তিনি। তবে সবাই দেখতে পায় না। তুমি দেখতে পাচ্ছো, কেবল দেহের চোখে নয়, মনের চোখেও।’

 ‘তোমাদের এ কথাও আমি মানলাম না। আমার সত্যিকারের চোখ দিয়ে চারপাশ যেমন দেখা যায় তেমনি দেখছি বঙ্গবন্ধুকে। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, শোনোনি ?’

 সিঁড়ির ধাপের কম্পন থেমে গেল। কথা থেমে গেল। হঠাৎ ও দেখল প্রতিটি ধাপ থেকে আকাশের দিকে উঠে গেছে দুই সারিতে ১৫টি পতাকা-স্ট্যান্ড। আর সঙ্গে সঙ্গে উড়তে লাগল, অর্ধ-উত্তোলিত লাল-সবুজ পতাকা। কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে জিদনি দেখল পতাকার ওড়াউড়ি। তারপর  প্রশ্ন করল, ‘এসবের অর্থ কী, সিঁড়ি ভাই ?’

 ‘আমরা আমাদের বুকে পতাকা দিয়ে ঘিরে রেখেছি বঙ্গবন্ধুর শেষ বিদায়ক্ষণ, জীবনের শেষ মুহূর্তটা। সবাই দেখতে পায় না। তুমি পাচ্ছো। স্যালুট তোমাকে। আর পতাকার অর্ধ-উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শোকপ্রকাশ করলাম, পনের পতাকা দিয়ে স্মরণ করলাম উনিশ শ পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের ভোরটাকে।’

 ‘কী বলছো তোমরা ?’ শেষ বিদায়ক্ষণ আবার কী ? শেষ মুহূর্তই বা কী ? আচ্ছা, যা বলেছো, তোমাদের মতো করে বলেছো, অসম্মান করবো না। তোমাদের এ ক্ষুদ্র চিন্তাটাকে সম্মান জানিয়ে বলছি, শোনো, মনোযোগ দিয়ে শোনো, বঙ্গবন্ধু বিদায় হননি। তিনি মিশে আছেন স্বদেশের সর্বত্র। বিশ্বজুড়েও। দেশের পুরা মানচিত্রটাই একটা লাল-সবুজ পতাকা। আর দেশজুড়ে মিশে থাকা বঙ্গবন্ধুর দেহটাকে ঢেকে রেখেছে সেই পতাকা, বুঝেছো ?’

 ‘তোমার ভাবনাকে মেনে নিলাম। গৌরববোধ করলাম বঙ্গবন্ধুকে এভাবে ধারণ করেছো দেখে। আমাদের ক্ষুদ্রতাকে তোমার বিশালতা দিয়ে বরণ করে নাও।’

 ‘আমার বিশালতা বলে কিছু নেই। আমার যা আছে, বোধের তলে, সব তাঁর। তাঁর দেওয়া গোপন প্রেরণা। গৌরববোধ তাঁকে নিয়ে করো, যাকে তুমিও ধারণ করে রেখেছো।’

 হঠাৎ সিঁড়ির ধাপগুলো একযোগে আবৃত্তি করা শুরু করল:

‘ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।

বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে,

জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞঝা-অশনি বেয়ে।’ ‘কী ব্যাপার ? জসীমউদ্দীনের ‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতা পাঠ করছো কেন ?’

 ‘তোমার কথা শুনে পল্লীকবির কাব্যচরণ আমাদের বুকে এসে আঘাত হেনেছে। কালের স্রোতে লুকোনো শব্দরা আমাদের জবান খুলে আপন তালে গেয়ে উঠেছে। তোমার ভালো লাগেনি ?’

 ‘ভালো লাগবে না কেন। লেগেছে। আবার লাগেওনি।’

 এ কী কথা ?’ সব সিঁড়ি একযোগে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে জিদনির দিকে তাকিয়ে রইল উত্তরের আশায়।

 ‘এসব প্রত্যয়দীপ্ত শব্দগুচ্ছ জসীমউদ্দীন লিখেছিলেন একাত্তরের অগ্নিঝরা সময়ে। তাই মেনে নেওয়া যায়। এখন আর ইতিহাসের সিংহাসনে বঙ্গবন্ধুকে “মুকুটবিহীন প্রসূত রাজ” বলা যাবে না। বলা যাবে সর্বকালের বাঙালির শ্রেষ্ঠতম মুকুটধারী মহাসম্রাট তিনি। আর প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়েও তিনি তক্ত তাজ নয়। এখনো গুপ্তঘাতকের দল আছে, তাদের কথা মনে না-রাখলে, সবাইকে এক কাতারে নামিয়ে বিচার করলে আরও ট্র্যাজেডি ঘটে যেতে পারে। গুপ্তঘাতকদের চিনে রাখাও চলমান যুদ্ধ। মাথায় রাখতে হবে। সাবধান থাকতে হবে।’

 জিদনির শক্ত কথা শুনে থেমে গেল সিঁড়িকথন। আর একই সঙ্গে জিদনি শুনল এক অমর বাণী, ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালোবাসি।’

 বাণীটি শুনে জিদনি উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘জি। অতি ভালোবাসারও এক ধরনের দুর্বলতা। সরলতা আর বিশ্বাসের আড়াল থেকে তখন গুপ্তহানা আসে। এটাও ইতিহাসের শিক্ষা। সেই শিক্ষা কি নেওয়া উচিত নয় আমাদের, বন্ধু ?’

 ‘হ্যাঁ। আমার জীবনের ট্র্যাজেডি থেকে সেই শিক্ষা তোমাদের নেওয়া উচিত। হাসুরও। কিন্তু সাত কোটি এখন আঠার কোটি, এ বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারবো না। এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেটভরে খেতে পাবে, পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন, তখনই শুধু লাখো শহিদের আত্মা তৃপ্তি পাবে।’

 ‘কিছু বিপদগামী সেনা অফিসার তোমাকে মেরে ফেলল। তোমার রক্তে ভাসা সিঁড়ি না শুকাতেই কেউ কেউ ক্ষমতার মসনদে বসে তোমাকে বিলীন করে দিতে চেয়েছিল। তারপরও সব বাঙালিকে ভালোবাসার কথা বলবে ?’

‘হ্যাঁ। বলব। আমার মধ্যে হিংসা নেই। প্রতিহিংসা নেই। তারা ভুল করেছে। আর ভুল না-করুক। তাদের বোধোদয় হোক। দেশটাকে সবাই মিলে সোনারবাংলা হিসেবে গড়ে তুলুক, এখনও চাই। আমি যে আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি, জিদনি, বড্ড ভালোবাসি!’

রক্তরঞ্জিত সিঁড়ির ধাপগুলো আবার কেঁপে কেঁপে উঠল। আবার তারা জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দিল। এবার পূর্ণভাবে উড়ল পুরো পতাকা। জিদনি বিস্ময় নিয়ে দেখল পতাকা কেবল বত্রিশ নম্বর বাড়িতে নয়, একযোগে উড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের পুরো মানচিত্রজুড়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে বত্রিশ নম্বর বাড়ির কার্ণিশে বসে থাকা একঝাঁক সাদা কবুতর উড়াল দিল। ওদের স্বর খুলে গেছে। বত্রিশ নম্বর বাড়ির চারপাশে উড়তে উড়তে ওরা একযোগে গাইতে লাগল :

শোনো, একটি মুজিবরের থেকে

লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি

আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।

বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।।…

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত