| 20 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

যেটুকু বৃশ্চিক রাশি

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

আজ ৩০ সেপ্টেম্বর কবি, কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক ও চিকিৎসক আশরাফ জুয়েলের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


সম্পর্কের আয়ুতে কে ঝুলিয়েছে দাঁড়। ব্যাহত স্রোতের নিয়ম ভেঙে সংকলিত অসুখ বানাও। সুদীর্ঘ অসুখ, ভীষণ খরস্রোতা অসুখ, প্রথম যৌবনের কবিতার-অসুখ; তেমন করে, ঠিক তেমন করেই  তির্যক উল্লাসে জেগে আছে রাত, রাতের কাঁধে ভর দেওয়া অন্ধকার কাঁপুনি দিয়ে ছেড়ে যাওয়া জ্বরের ভঙিমায় জেগে উঠেছিল, এই নির্ঘুমের ভেতর ভাসছে মেঘ- অনাবশ্যক, স্পর্শ এড়িয়ে যাবার মতো, বৃষ্টি-বহির্ভূত, মৃদু কপোলে থোকা থোকা অতীত আদরের সংঘবদ্ধ পায়চারি, অনিবার্য নেশা যেন।  শহুরে রাত, যেন সতর্ক প্রহরী- জেগে থাকার জন্যই জন্ম যার, ঘুমাতে চাইলেও ঘুমাবার ইচ্ছা হলেও, ঘুম এলেও; ঘুমানো নাজায়েজ। গলিত মদের আহ্বান, মিথ্যে শীৎকারের খুনসুটি আর অবাধ্য নিয়নের অত্যাচার কখনই ঘুমোতে দেয় না শহুরে রাতকে।

একটা বিচ্ছিন্ন আওয়াজ একাকী বালিশের বাম পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে পড়ল, অজানা গন্তব্যে গিয়ে নিজেকে সঁপে দেবে হয়ত, খাঁচা থেকে সদ্যমুক্ত গর্জন ঝাঁপিয়ে পড়বে মুহূর্তেই- কোথাও ভেজা হাওয়া বইছে, কোথাও পোক্ত সন্দেহ।

‘তোমার দেহ-ঘ্রাণ থেকে ধার দেবে একটু লোবান?’

ছুরি চালিয়ে কে যেন আঁধার কেটে আনল, দরদর শব্দে তালু ভরা কান্নার দলা খসে পড়ল আগুনের আয়নায়। প্রতিচ্ছবি কাঁপছে, কাঁপছে বাতাসের ঘের। শ্বাসের খাঁচায় বন্দি অগোছালো মেঘ।

‘নদী!’

‘হয়ত ঢেউ।’

‘নদী?’

‘হয়ত অন্য কেউ!’

‘কে? কে?’

‘নদী নদী নয় তো সে।’

বিদ্রুপের পালতোলা নৌকায় স¤পূরক বিচ্ছেদের সমাহার, কবিতার মতোÑ অন্তহীন, বাঁধভাঙা, স্তব্ধ, একাকী। ইচ্ছের আদিম সাগরে ভাসছে স্রোত- সীমাহীন অশ্রুতে সাজানো ব্যথার লবণ। 

‘নিদ্রাচ্ছন্ন, ভান ধরে আছে রাত- সমুদয় নেশার ছায়ায় হারিয়েছি ঘ্রাণ। তোমার দেহ থেকে ধার দেবে একটু লোবান?’ 

এভাবেই একটা স্বপ্ন-দৃশ্যের মৃত্যু ঘটবে, যেভাবে প্রতিনিয়ত ঘটে, ঘটে চলেছে; ঘোরতর, এ হচ্ছে প্রবল অনাপত্তির বিরুদ্ধে জারি করা আপত্তি। সন্দেহের ভেতর মস্ত এক মাশরুম- শুধু নিজেকে ছাড়িয়ে যায়, সঙ্গোপনে, একাকী।

ঘুম জেগে ওঠে, সহসা, দিগ্ভ্রান্ত, নিজেকে ভুলে যাওয়া বাতাস, অস্থির। এখন তো সিজোফ্রেনিয়া রোগীর অভ্যাসের মতো পাশে কেউ বসে নেই, তাহলে? কীভাবে আলোর স্রোতে ভাসবে ভোর? কীভাবে উপসর্গ পেরিয়ে আসবে সোনালি ইঙ্গিতময় সুখ, কিশোরীর বাড়ন্ত নখের ইশারা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে শয্যাপাশে। 

আকাশটা যেন ডাস্টার, গুঁড়ো গুঁড়ো ভেজা চক খসে পড়ছে আপন খেয়ালে, এক বিষণ্ণ নীরবতা খেলা করছে আশপাশজুড়ে। সন্দিহান দুটো পায়ে ভর দিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে যায় মেঘ, তারই সহোদরা, বিষণ্ণ, একাকী, উড়ে বেড়াচ্ছে, অবিন্যস্ত; মুখোশ ভিজিয়ে ফেলার অভ্যাসে। জানালার পরিমাপ ভেদ করে হাত বাড়ায় মেঘ, বৃষ্টিক্লান্ত শূন্যের দিকে- আদতেও শূন্য বলে কিছু আছে? সহোদরার গর্তে তার অভিমানগুলো বিলীন করে দিতে চায়, শর্ত ছাড়াই নিজেকে সমর্পণ করে, কোনো বিশৃঙ্খলায় জড়াতে চায় না মেঘ। এই বাড়ন্ত রাত ভেসে আসছে, কোনো অন্ধ ডাহুকের সুরে ভর করে, একাকী, মনের গোপন পোশাকে ঢের আগুনের উপস্থিতি টের পাচ্ছে মেঘ। পুড়তে পুড়তে সবকিছু শেষ হয়ে গেলেও আরও পুড়তে চায়, পুড়তে পুড়তে ছাই হতেও কোনো আপত্তি নেই, থাকে না; কবিতার মতো, আসতে আসতেও আসে না, না বোঝার পূর্বেই হতাশার হাহাকারে ভস্ম হয়ে যায়। মোবাইলের মৃত স্ক্রিন হেসে ওঠে সহসা, নীলাভ একটা সংকেত ছুটে আসতে চায় মেঘের দিকে। আকাশের বুকে বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা পুনরায় নিজের ভেতর ফিরিয়ে আনে মেঘ, জানালার গ্লাস টেনে দিয়ে সাময়িক বিচ্ছেদ আঁকে- সহোদরা, আসছি, এখুনি, দূরে যেও না, হারিয়ে যেও না, ঝরে পড়ো না। জারিকৃত সংকেতের দিকে এগোতে এগোতে ঘাড় ঘুরিয়ে মেঘ একবার তাকিয়ে নেয় সময়ের কাঁটার দিকে- তিনটা একুশ? ভাবনার ভেতর একটা আশঙ্কা মোচড় দিয়ে ওঠে। এ কী করে সম্ভব, সম্ভব না, কীভাবে সম্ভব! কিছুতেই সম্ভব নয়। এমন সময়েই সুনসান নীরবতা ভেঙে ঝরে পড়ল জানালায় আশ্রয় নেওয়া সহোদরা- এভাবেই সবাই মেঘকে ছেড়ে চলে যায়। রাতের পর রাত সন্দেহবাতিক ঘুমের সাথে মেঘের এই দুঃসম্পর্-ঘোরতর হত্যাকাণ্ডের চেয়েও সুপরিকল্পিত।  

দুই

এ নিয়ে পরপর তিন দিন নিরাশ হতে হলো। একা একা বসে থাকা- ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তিন কাপ কফির সাথে হৃদ্যতা এবং বিচ্ছেদ। এই সময়টাতে মেঘের পাশে বসে থাকে অক্ষম ইজেল, নির্বাক তুলি আর বন্ধ্যা রঙ। প্রস্তুতির মাঝেও সীমাহীন অপ্রস্তুতি, মেঘ বিরক্ত হয় না- বিরক্ত না হবার মাঝেও আছে বিস্তর আনন্দ।

এই কফি শপেই প্রথম দেখা, এমনই এক নিরীহ বিকেলে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এক তরুণ বসে ছিল মেয়েটির পাশে, তরুণের শুকনো কণ্ঠনালি পেরিয়ে একটি নাম পৃথিবীর বায়ুতে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়েছিল।

মেঘ নিজের মনোযোগকে সংকুচিত করে নিয়ে এসেছিল, ছুড়ে মেরেছিল আগ্রহ হারিয়ে ফেলা তরুণের কণ্ঠস্বরের দিকে, যাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছিল লক্ষ্য ছুঁতে না পারা তার একজোড়া সচল দৃষ্টি।

নারীর ছায়ায় বেড়ে ওঠা শিশুদের আকাক্সক্ষা, পুরুষের নয়- এই মেয়েটির গোল চশমায় ঢেকে রাখা সঙ্ঘবদ্ধ দৃষ্টিসীমানা থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে আত্মবিশ্বাস, যার মাথা দোলানোর ভঙিমায় শাসনের সমূহ ইঙ্গিত, যে দুই ধাপ পেছনে হটে যাওয়াকেই ধরে নিই সম্ভাব্য বিজয়ের নিশ্চিত সংকেত হিসেবে। ‘নদী, নামটি কিন্তু বেশ! নাম সুন্দর হবার চাইতে নামটি যাকে ইঙ্গিত করে, সেই মানুষটি সুন্দর হওয়া জরুরি। পরপর তিন দিন মেঘ নিজেকে তার অভ্যাস-বহির্ভূত অভ্যাসে ব্যস্ত রেখেছে। নিজেকে নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত, কিছুটা উ™£ান্তও। এই অবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টায় কিছুটা সফল হয়েছে, নিজেকে ধন্যবাদ দিতে ভুল করে না সে। কিছুটা ধিক্কারও কি প্রাপ্য নয়? ভালো কাজের জন্য ধন্যবাদ আর খারাপ কাজের জন্য ধিক্কার দেওয়ার ব্যাপারটা নিজের মধ্যে খুব সযত্নেই সচল রেখেছে মেঘ।  

চতুর্থে নয়, পঞ্চমেও নয়’- কাক্সিক্ষত সাফল্য কথা হয়ে ফুটল ষষ্ঠ দিনে। পাশের সেই অনাশ্রয়ী তরুণ লাপাত্তা। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, মেঘ যে টেবিলে বসে আছে- সেই টেবিলের ফাঁকা চেয়ারটায় এসে বসল মেয়েটি, ‘নদী’। ফাঁকা চেয়ার; ঠিক সামনের চেয়ারটাতে, দৃষ্টাদৃষ্ট ভঙ্গিমায়। মেঘ নিজেকে প্রস্তুত রেখেছিল, এমন একটা পরিস্থিতির প্লটই তো সে গত ছয় দিন থেকে এঁকেছে। 

‘খুব প্রতিশোধপরায়ণ আমি।’

‘জানি।’

‘মানে?’

‘এই যে আপনি খুব প্রতিশোধপরায়ণ।’ উঠে দাঁড়ায় মেঘ, ‘একটু বসুন, প্লিজ।’ বলেই কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল, এক কাপ কফি হাতে ফিরে এসে বসল।

‘গত কয়েকদিন ধরে আপনি যা করছেন তা এক কথায় বেয়াদবি।’

‘ঐ যে ওইদিকে একটু তাকান তো।’

‘কেন? কী ওখানে?’

‘কিছু দেখছেন?’

‘হ্যাঁ’

‘কী দেখলেন?’

‘আপনার সাথে গল্প করার জন্য এখানে এসে বসিনি আমি।’

‘জানি, প্রতিশোধ নেবার জন্য এসেছেন তো?’

‘কি দেখাচ্ছিলেন যেন?’ রাগের থালায় অদ্ভুত সুন্দরের পসরা। ‘ঐখানে একটা ফুল ফুটে আছে, ওই যে ওইখানে’- মেঘ ইশারা করে, নদী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করে, তার ঠোঁটের আশ্রয়ে কফি কাপটা যথেষ্ট স্বস্তি বোধ করছে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ‘হ্যাঁ, রডোডেনড্রন, ডার্ক পার্পল কালারের…’

‘খুব সুন্দর, তাই না?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি প্রসঙ্গ পালটাচ্ছেন কেন?’

‘বারবার দেখতে ইচ্ছা করে, বারবার, তাই না?’

‘সুন্দর জিনিস দেখতে ইচ্ছে তো করবেই।’

‘বারবার, বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে।’

‘দেখুন, কে আপনাকে নিষেধ করেছে দেখতে।’

‘আমরা এই যে বারবার ফুলটাকে দেখছি, সুন্দর বলছি, ফুলটা কি মন খারাপ করছে?’

‘আরে কী আশ্চর্য, মন খারাপ করবে কেন?’

গুলশান একশ’ একুশ নাম্বার রোডের ক্যাফে ওয়ান ও এইট-এ মাঝে মাঝেই বসে মেঘ এবং অবধারিতভাবেই একা। কফি শপটা দারুণ, শপ তো নয় আসলে এটা একটা পুরনো বাড়ি। সামান্য কিছু রেনোভেশন করে একে কফি শপ বানানো হয়েছে। গেট পেরিয়ে ঢুকলেই একটা ফাঁকা জায়গা, ছোট্ট একটা ফুলের বাগান, দারুণ সত্যি দারুণ!

‘যদি ওই ফুলের চেয়েও সুন্দর কিছু আপনাকে মুগ্ধ করে?’

‘দ্যাখেন, কে আপনাকে নিষেধ করেছে।’

‘তাহলে প্রতিশোধ কেন?’

‘মানে? আর ইউ কিডিং মি? রডোডেনড্রোন আর আমি এক?’

‘নো, অ্যাবসলিউটলি নট। ইউ আর মোর দ্যান দ্যাট।’

‘ইউ জাস্ট ক্রসিং ইয়োর লিমিট।’

‘গত কয়েকদিন ধরে ওই ডার্ক পার্পল কালারের রডোডেনড্রনের চেয়েও অনেক সুন্দর কিছুর দিকে তাকিয়েছি, এটা আমার অপরাধ? ইফ ইট ইজ, দেন পানিশ মি। প্লিজ।’

‘ইউ আর আ টোটাল রাবিশ।’ থরথর কাঁপছে সৌন্দর্য- রাগের আয়নায় উতলে উঠছে নিজস্ব ভঙ্গিমায়। 

‘যদি ছোঁয়া যেত…!’ ভাবে মেঘ। চূড়ান্ত নীরবতায় উপভোগ করতে হয় এমন অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য। ঠিক এই কাজটাই করছে সে।

তিন

ঝগড়াঝাঁটি দিয়ে মেঘ-নদীর সম্পর্কটা প্রাণ পেয়েছিল, ঠিক প্রেম নয়, তবে খুব অল্প দিনেই সম্পর্কটা একটা রঙ পেতে যাচ্ছিল। এক আশ্চর্য নীরবতা আর বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সবকিছুই।

‘ক্যাফেতে স্বভাববিরুদ্ধ স্বরে নদী মেঘকে ক্যাফে ওয়ান ও এইটে ডেকেছিল, নদীর স্বরে প্রাণের অনুপস্থিতিই বলে দিচ্ছিল সুতোয় টান পড়ার আকস্মিক সম্ভাবনার কথা।

‘কী ব্যাপার?’ আজ পৃথিবীর মুখে কেউ অন্ধকার ছিটিয়ে দিয়েছে? মেঘের মনে সীমাহীন শঙ্কা, আর ভয়।

‘বসে রামধনু হারিয়ে যাবার পূর্বমুহূর্তে আকাশ যেমন নিঃশব্দের মাঝে নিজেকে সমর্পণ করে ঠিক তেমনি অবস্থা নদীর।’

‘ইউ লুকস গ্রেট- কী হয়েছে জানো?’ মেঘ নিজেকে বৃষ্টি হিসেবে ঝরাতে চাইছে, যদি পরিবেশটা একটু হালকা হয়।

‘বসো, প্লিজ মুখ তুলে তাকায়, মেঘকে ইশারায় সামনের সিটে বসতে বলে নদী।’

‘কফি?’

‘না।’

‘কী হল?’

‘বসো।’

‘হু।’

নদীর এমন চেহারা এর আগে কখনই দেখেনি মেঘ, কেমন অস্বাভাবিক, আড়ষ্ট। এই তো, হ্যাঁ, গত সপ্তাহেই তো ওদের বাসায় গিয়েছিল মেঘ, নদীই যেতে বলেছিল। ওর বাবা-মায়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছে সেদিন। সে নিজেও মেঘকে তাদের বাসায় নিয়ে যাবে একদিন, খুব শীঘ্রই। ‘তোমাকে কিছু কথা বলব, শুধু শুনবে, উত্তর দিতে পারো, কিন্তু প্রশ্ন করতে পারবে না।’ ‘বলো, কী বলবে?’ মেঘ নদীর মুখের দিকে তাকায়, সে বুঝতে পারে ভেতরে স্রোত নেই, ভেতরে ভেতরে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে নারাজ নদী। কিন্তু কী বলবে নদী? ভাবনার ডানায় বাতাস লাগায় মেঘ, কিন্তু তার ভাবনারা উড়তে পারে না, মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। ‘তোমার আমার মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল; এবং, নির্দ্বিধায় বলা যায় এই স¤পর্ক একটা নতুন অর্থপ্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু; আজ, এই মুহূর্ত থেকে এই সম্পর্কটা অতীত। কেন কী কারণে এমন প্রশ্ন করবে না, এর কোনো উত্তর নেই।

‘মা-নে?’ মেঘের মুখ থেকে আর কোন শব্দ বেরোয় না, কী বলবে বুঝে উঠতে পারে নাÑ সে ভালো করেই জানে নদী একবার যে কথা বলেছে সেখান থেকে একচুলও সরে আসবে না। ‘এ নিয়ে কোনো আলোচনা নয়।’

‘কি-ন্তু।’

‘মেঘ, আমরা দাবি করি পৃথিবীটা আমাদের, এটা মিথ্যে; ভেবে নাও এই মিথ্যের কুয়াশা আমাদের একে অন্যের থেকে আড়াল করে দিয়েছে।’

‘প্রথম দিনেই তুমি বলেছিলে, খুব প্রতিশোধপরায়ণ তুমি, প্রতিশোধ নিলে? এইভাবে? আমার সমস্ত পৃথিবীকে কেড়ে নিয়ে, আমাকে নিঃস্ব করে? মেঘ, বলতে পারো- আমি আর কতবার নিঃস্ব হব?’ জন্মের পরেই কাঁদার অভ্যাস ভুলে গিয়েছিল মেঘ, তবু; কান্না আসছে আজ, কিন্তু না কাঁদবে না মেঘ। ‘মেঘ আমাদের চেয়েও সময় সবচেয়ে বড় প্রতিশোধপরায়ণ, আমরা শুধু ক্রীড়নক।’ এই নদীকে মেঘ চেনে না। ‘আরেকটা কথা, আমি নেক্সট উইকে ইউ এস এ চলে- যাচ্ছি, হয়ত আর কোনোদিনও ফিরব না। ওখানে যাবার কয়েকদিনের মধ্যেই আমার আর সঙ্গীতের বিয়ে।’ কী অবলীলায় কথাগুলো বলে যাচ্ছে নদী।

মেঘ কী বলবে, এমন সিচুয়েশনে কী বলা উচিত ভেবে পায় না। তার ভেতরের সেই পুরনো ঘৃণাবোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যদিও সে বিশ্বাস করত সবাই এক রকম নয়, হতে পারে না; হতে পারে না বলেই নদীকে তার ভালো লেগেছিল।

সেদিন ঠিক কতক্ষণ কথা হয়েছিল মনে নেই। তবে দু’জনের মধ্যে খুব সাধারণ কথাবার্তা হয়েছিল এটুকু মনে আছে, মানে অন্যান্য দিন যেমন হয়। কথা বলতে বলতে তিন বার কফি নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবারই কফি কাপ দুটো চুমুকবঞ্চিত ছিল।  

‘দেখেছো? রডোডেনড্রনগুলোও কাঁদছে… মেঘ চোখ ফেরায়, বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘যা-চ্ছি ভালো থেকো’- যাবার পূর্বে মেঘের হাত দুটোকে শেষবারের মতো নিজের হাতের ভেতর নিয়ে কিছুক্ষণ রেখেছিল নদী। 

মেঘ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছিল, এ স্পর্শ তো একদমই ভিন্ন, এটা কি মেঘের স্পর্শ নয়? নাকি মেয়েরা সম্পর্ক পাল্টানোর সাথে সাথে সবকিছুই পাল্টে ফেলে, তাদের স্পর্শ, চাহনি, তাদের কথা বলার ধরন? সব, সবকিছুই। 

এরপর থেকেই একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছিল মেঘ, নিজের সম্মতিতেই। কেউ ছিল না, কেউ ছিল না আগলে রাখার, ছিল না বলেই ডুবে যাচ্ছিল- কেউ তাকে এই সম্ভাব্য ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারবে না। কারণ কেউ ইচ্ছাকৃত ডুবে যেতে চাইলে অন্য কারও সাধ্য নেই তাকে বাঁচিয়ে তোলার। এক অন্যায্য ঢেউয়ে তলিয়ে যাচ্ছিল মেঘ। কোনো কিছুই সহ্য হচ্ছিল না, এমনকি নিজেকেও না। সেই সময়টায় নিজের সাথে চূড়ান্ত অন্যায় করে গেছে, যেন সমস্ত দোষ তার নিজেরই। অতএব নিজেকে শাস্তি দেওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছে। নেশাসক্ত হয়ে উঠছিল মেঘ, ভেবেছিল, একসময় সবকিছুই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি, যায় না, যায় না বলেই বেঁচে আছে মেঘ। শুকিয়ে যাওয়া নদী উধাও হয়ে গেছে হৃদয়ের মানচিত্র থেকে। সেদিনের পর মেঘ নদীর সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টাই করেনি। কোনোদিন করবেও না। 

চার

‘জানি তুমিও অন্যদের মতোই আমাকে ধোঁকা দেবে…’

‘না, আবার দিতেও পারি, তবে হয়ত দেবো না…’

‘আমিও দেখতে চাই কতজন আমাকে কতভাবে কষ্ট দিতে পারে, দেখিই না…’ মেঘের গলা ধরে আসে, কিন্তু সে এটাকে লুকিয়ে ফেলে। ‘মেঘ, তুমি কাঁদবে? একবার কাঁদো… দেখবে হালকা লাগছে…’

‘না, জন্মের সময় মেঘ কেঁদেছিল কিনা জানে না, তবে এরপর আর কাঁদেনি।

‘কাঁদো মেঘ, কাঁদো, তোমার সারা জীবনের জমানো কান্না; সব ধুয়েমুছে যাক, কাঁদতে কাঁদতে তোমার সব কষ্ট, সব দুঃখ একেবারে সাফ হয়ে যাক, কাঁদো … এই বলে নিজেই কাঁদতে আরম্ভ করে রুমু, জড়িয়ে ধরল মেঘকে। ‘কী অদ্ভুত! আরে, তুমি কাঁদছ কেন? তুমি তো আমাকে কাঁদতে বললে, বলে আবার নিজেই কাঁদছ? গল্প শুনবে? তোমাকে একটা গল্প শোনাই? কান্না থামে না রুমুর, থামবে বলে মনেও হয় না। আচ্ছা, কাঁদুক। যতক্ষণ ইচ্ছে কাঁদুক।

নদী চলে যাবার পর যাচ্ছেতাই জীবনের ভেতর নিজেকে ছুড়ে মেরেছিল মেঘ। অনিয়মই তাঁর কাছে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সব কিছু থেকে নিজের সমস্ত আগ্রহকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সে। বারবার ঘুরেফিরে তার মনে একটাই প্রশ্ন, নদী কেন এমন করল? নিজের প্রতি সমস্ত ভালোবাসা একসময় ঘৃণায় পরিণত হলো, সেই পুরনো ঘৃণা, যা কিনা এতদিন মৃত আগ্নেয়গিরির মতো ঘুমিয়ে ছিল, সেটা পুনরায় নতুনভাবে সামনে এলো। আসলেই সব নারীই একই রকম, নিজেদের স্বার্থ ব্যতীত এরা কোনোকিছুই বোঝে না, কোনোদিন বুঝবেও না। এ কথাই-বা বলবে কেমন করে, রুমু, এমনই সময়ে, যখন নিজের প্রতি সমস্ত আস্থা হারিয়ে ফেলে মেঘ নিজেকে নিঃশেষ করার সমস্ত আয়োজন প্রায় স¤পন্ন করে ফেলেছে, ঠিক তখনই এই আশ্চর্য মানবী রুমু আসে তার জীবনে। আসে মানে কি একপ্রকার জোর করেই আসে। অতীত স্মৃতি মেঘের মনে এক অস্বস্তিকর আলোড়ন তোলে, মেঘ নিজেকে সরিয়ে রাখতে চায়, কিন্তু পারে না, রুমুই পারতে দেয় না। নারীরা যখন ভালোবাসে তখন সমস্ত কিছু উজাড় করে ভালোবাসে; যেমন রুমু, আর যখন নিজেকে উইথড্র করে, তখন খুব নৃশংস হয়ে ওঠে তারা, নদীর কথা ইদানীং মনে করতে চায় না মেঘ। নদীকে মুছে ফেলার জন্য যা যা করা লাগে তাই করতে প্রস্তুত মেঘ; রুমু সেই প্রস্তুতির সর্বশেষ পাঠ্য।

পুরনো ভাবনার অতল গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছিল মেঘ, কতক্ষণ সেই জগতে ছিল মনে নেই, যখন ফিরে এলো, দেখল তখনও কাঁদছে রুমু। নিজেকে দোষারোপ করতে পিছপা হলো না মেঘ। খুব অন্যায় করছে সে, রুমু, রুমুর বাসর রাত আজ। এমন দিনে এই মেয়েটির আবেগ নিয়ে খেলা করতে চায় না মেঘ। এই মেয়েই তো সেই মেয়ে যে হারিয়ে যেতে বসা মেঘকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। রুমুর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই মেঘের। রুমুর সাথে খুব অল্পদিনের সম্পর্ক। রুমুর জেদ আর মেঘের বাবার জোরাজুরিতে হুট করেই এই বিয়ে।

রুমু, রুমু মেঘের বিবাহিত স্ত্রী, নদী, না নদী কেউ নয়। নদী মেঘের জীবনের এক কালো অধ্যায়। নদী জঘন্য একটা মেয়ে, যে নিজের স্বার্থে এককথায় মেঘের সাথে সব স¤পর্ক ছিন্ন করে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছে।

‘নদীর কথা ভাবছ?’

শব্দ তিনটি বজ্রাঘাতের মতো আঘাত হানল মেঘের মাথায়। নিজেকে সামলে নেওয়ার সময় পেতেই বেগ

পেতে হলো মেঘকে। কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিতেই রুমু মেঘকে থামিয়ে মেঘের মাথাটা খুব যত্ন সহকারে নিজের কোলে নিয়ে বসে রুমু। চমকে ওঠে সে। ‘বলেছিলে না গল্প শোনাবে? তুমি না, আমিই তোমাকে গল্প শোনাই…’

অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ঘরটা। ঘরজুড়ে সাদা বেলি ফুল ছড়ানো, সাদা চাদরের ওপর ছিটানো বেলি ফুল। বাসরে আলাদা ড্রেস; রুমুর জন্য সাদা গাউন, মেঘের জন্য সাদা পাজামা- পাঞ্জাবি। এই প্ল্যান রুমুর।

‘নদীর কথা ভাবছ…?’ শক্ত হয়ে যায় মেঘ, তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোয় না। 

রুমু নিজের কোলে রাখা মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেঘকে বলে, ‘প্রায় তেইশ বছর আগেকার ঘটনা, এক সদ্যোজাত শিশুসন্তানকে কে বা কারা ফেলে রেখে এসেছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন রেললাইনের ওপর। ঊনত্রিশ বছর বয়সী এক যুবক, মাত্রই ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন, খুব ভালোও করছিলেন… তিনিই সেই শিশুসন্তানটিকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন, সেই সময়ে এই ঘটনাটা নিয়ে খুব শোরগোল হয়েছিল। পেপার পত্রিকা এমনকি একাধিক টিভিতেও এ নিয়ে রিপোর্ট হয়েছিল… ধারণা করা হয়েছিল কোনো এক কুমারী মা তার সদ্যোজাত সন্তানকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন, এই ঘটনার পর সেই ব্যাবসায়ী যুবক রীতিমতো নায়ক বনে যান। কিন্তু যা হয়, কয়েকদিনেই সব উন্মাদনা শেষ। সেই যুবক পরে আর বিয়ে থা করেননি, কুড়িয়ে পাওয়া সন্তানকেই নিজের সন্তান হিসেবে মানুষ করতে থাকেন, এর আগে আইনি জটিলতা এড়াতে সমস্ত পেপার তৈরি করে নেন তিনি… এবার রুমুকে আঁকড়ে ধরে মেঘ, ওর কোলে মুখ গোঁজে, আর্তনাদ করে করে ওঠে প্রায়, গোঙানির শব্দটা বের হতে দেয় না। ‘রুমু…’ এর বেশি কোনো শব্দ বের হয় না মেঘের কণ্ঠ থেকে। ‘এসব কথা কে আমাকে বলেছে জানো? না জানারই কথা…’

মনে হচ্ছে পৃথিবীটা সংকুচিত হয়ে আসছে মেঘের জন্য, নিশ্বাস ফেলতে না পেরে মৃত্যুর দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে মেঘ। পরম আদরে মেঘের মুখটাকে দুই হাতের তালুতে তুলে নেয় রুমু, বলে, ‘নদী, নদী এসব কথা বলেছে। সি ইজ মাই ক্লোজ ফ্রেন্ড…’

কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না মেঘ, তার ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, নতুন-পুরোনো ব্যথা তাকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে আজ। মেঘ সেই আক্রমণের সামনে মেলে ধরে নিজেকে, তার কিছুই বলার নেই আজ। ‘কিন্তু রুমু?’ 

কিছু বলতে পারে না মেঘ। তাকিয়ে থাকে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রুমুর মুখের দিকে। ‘শেষবার আমেরিকা যাবার পর আর ফেরেনি ওরা, ওদের ডুয়েল সিটিজেনশিপ। মাঝে মাঝে এখানে থাকত, মাঝে মাঝে ওখানে। তবে ওর মা, নীরু আন্টি বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশে থাকতেন, তোমার মনে আছে নিশ্চয়; একদিন তুমি ওদের বাসায় গিয়েছিলে? নদীর বাবা তোমার সাথে নদীর বিয়ে দেবার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। তোমার ব্যাপারে খোঁজখবরও নিয়েছিলেন… কিন্তু…    

‘হ্যাঁ, মনে আছে। তবে আমার পরিচয় জেনেই সেই স¤পর্ক থেকে নদী নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল?’

‘ভুল, কোনো নারী কখনওই কোনো ধরনের স¤পর্ক থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে না, করতে বাধ্য হয়।

পুরুষই তাদের বাধ্য করে, পুরুষই তাদের বাধ্য করে স¤পর্ক গড়তে, পুরুষই বাধ্য করে স¤পর্ক ভাঙতে…

এসব কথাবার্তার কিছুই বুঝতে পারে না মেঘ। ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই থাকে। ‘এবার এখান থেকে যাবার সময় ওনাকে খুব অসুস্থ দেখেছিলাম। যাবার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই নীরু আন্টি মারা গেছেন… মেঘ, আজ থেকে তেইশ বছর পূর্বে নীরু আন্টি তার সন্তানকে বাঁচাতে রেললাইনের পাশে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। 

কিছু বলতে পারে না মেঘ, চুপ করেই থাকে, তার দুই চোখের কোনা বেয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়ছে শীতল অশ্রু, সেই অশ্রুতে সিক্ত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সকল বৃশ্চিক রাশি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত