| 24 এপ্রিল 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

তোমারে বধিবে যে

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট
 
 
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comফজলু মিয়া রেলের গুমটির কাছে এসেই একটা হল্লা শুনতে পেল।
‘ঐ ধর ধর…ধর…পলাইলো হারামজাদারা! ধর সব কয়টারে ধর!  আজ এইহানেই পুঁইতা ফেলুম বেবাক গুলানরে! হারামজাদা শুয়ারের দল! বাড়িত মা-বোন নাই কুত্তা শালাগো! যারে পায়, তাদের চুদাইতে মন চায়! আন্ধার নামলেই ভাদর মাসের কুত্তা হইয়া যায় শালারা! চুত…’
 
অকথ্য সব গালিগালাজ ভেসে আসতে লাগলো দূর থেকে। ছুটে আসা লোকদের কয়েকজনের হাতে ধরা হারিকেনের টিমটিমে আলো শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল। সেই আলোতে ফজলু মিয়া দেখতে পেলো, পাঁচ-ছ’জনের একটা যুবকের দল তাড়া খেয়ে পড়িমড়ি করে এদিক পানেই ছুটে আসছে।
 
ফজলু মিয়া ভেবেছিল, শর্টকাট নেওয়ার জন্য ক্ষেতের আল ধরে এগুবে।এদিক দিয়ে গেলে খুব তাড়াতাড়ি তার গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু ধেয়ে আসা লোকজন আর তাদের সামনে পলায়নপর যুবকদের মাঝখানে গিয়ে পড়ার তার কিছুমাত্র ইচ্ছা নেই। খামোখা কোনো বিপদের ভেতরে গিয়ে ঢুকতে চায় না সে। নিরীহ গোবেচারা জীবন তার। এসব উটকো ঝামেলা সে সবসময় এড়িয়ে চলে।
 
তবু ঝামেলা একেবারে এড়ানো গেল না!
 
যুবকের দল তখন প্রাণ বাঁচাতে এঁকেবেঁকে ছুট লাগিয়েছে। ফজলু মিয়ার পঞ্চাশ বছরের ধকল সওয়া শরীর সেই যুবকের দলের মিলিত পদভারের ধাক্কায় গোত্তা খেয়ে রাস্তার পাশে পড়ে গেল। সরু মাটির রাস্তা। সেই রাস্তার ওপরে মাঝে মাঝেই গরুর গাড়ির চাকা দেবে যাওয়ার গাঢ় চিহ্ন। বৃষ্টির অঝোর ধারায় সিক্ত হয়ে সেই গাঢ়ত্ব আরো প্রকট হয়েছে। এবড়োথেবড়ো রাস্তায় আলো না নিয়ে চললে মহাবিপদ। যখন তখন পপাত ধরণীতলে আশ্রয় নিতে হয়। পথের দু’পাশটা অনেকখানি ঢালু হয়ে নীচে জমির সাথে মিলেছে। সেই ঢালু অংশে শন আর কাশের জঙ্গলে নিরাপদ প্রকোষ্ঠ তৈরি হয়েছে। ফজলু মিয়ার সাইকেলের চাকা ক্যাঁক করে শব্দ তুলে সোজা সেই প্রকোষ্ঠের মাঝখানে গিয়ে আশ্রয় নিলো। লাভের মধ্যে যা হলো, জান বাঁচাতে মরিয়া যুবকের দল তাকে আর দেখতে পেল না। অবশ্য দেখলেও তখন তাদের কিছু করার মতো অবস্থা ছিল না। নিজেদের নিয়েই তখন তারা দিশেহারা।
ফজলু মিয়া কোমরের এক পাশে হাত দিয়ে বেঁকেচুরে উঠে দাঁড়ালো। জন্মাবধি রুগ্ন শরীর তার। ছোটবেলা থেকেই খাওয়া দাওয়ায় রুচি ছিল না। বহুকষ্টে যেটুকু খাবার পেটে যেত, তার বেশিরভাগটুকুই আবার বমি হয়ে বেরিয়ে যেত। বাবা-মা নিজেদের সাধ্যমত খাওয়াতো। অভাবের সংসারে হরেক পদের খাবারেরও তো আর জোগান ছিল না! শাকপাতা ভাজিভুজি আর মাঝে মধ্যে মলা ঢেলা কিংবা কুঁচো চিংড়ির তরকারি। তাই খেয়ে শরীরটা কোনো রকমে টিকে গেছে। আজ এই পঞ্চাশ অব্দি তো টিকেই রইলো! কিন্তু শরীর টিকলে কী হবে? মনের পুষ্টির অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। কেউ একটু উঁচু গলায় কথা বললেও তার কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। ধমক দিলে তো কথাই নেই। দ্বিতীয়বার আর ওমুখো হয় না। মন আর শরীর দুটোরই ভগ্নদশা ফজলু মিয়ার। এলাকার লোক তাকে ডাকে ‘শিনটা’ নামে। শিনটা অর্থাৎ পাটকাঠি। কী শরীরে কী মনে, পাটকাঠির চেয়ে এক কাঠিও বেশি ক্ষমতা নেই ফজলু মিয়ার।
ফজলু মিয়া ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে নিজের সাইকেলটাকে সোজা করে দাঁড় করালো। তার কোমরের কলকব্জা ভেঙ্গেচুরে গেলেও এই মুহূর্তে অসুবিধা নেই। কিন্তু সাইকেল ভাঙলে বিরাট বিপদ। এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে। তার মালিকেরা আজ আবার একটু আগেভাগে খেয়ে নিবে জানিয়েছে। কী নাকি কাজ আছে তাদের। নিজের একটা ব্যক্তিগত কাজে আজ একটু গঞ্জে যেতে হয়েছিল ফজলু মিয়াকে। পথিমধ্যে এই বিপত্তি! না জানি আজ আর কী কী দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হবে!
 
আক্রমনকারী গ্রামবাসীরা এখন এখানে চলে এসেছে। যুবকের দলকে হাতছাড়া হয়ে যেতে দেখে কেউ কেউ ক্ষেদোক্তি করে,
 
‘যাহ্ শালা! হারামজাদারা পলাইয়াই গেল! এত্তগুলান মিল্যাও ধরবার পারলাম না!’
 
‘হারামজাদাগো জানে টান লাগছে। আইবার দাও আরেকবার! এইবারে এক্কেরে টুঁটি যদি না ছিড়বার পারি, তয় বাপের পোলা না আমি!’
 
ফজলু মিয়াকে ঝোপের মধ্যে থেকে বেরুতে দেখেই উপস্থিত জনতার এতক্ষণে তার দিকে চোখ পড়লো।
 
‘আরে! এইডা ক্যাডা! এইডাও আছিলো নাকি? আরে ধর ধর শালারে! এইডা য্যান পলাইবার না পারে! ধর ধর!’
 
ভয়ে সিঁটকিয়ে যাওয়া ফজলু মিয়া কোনোমতে বলার চেষ্টা করে, ‘না না আমি না! আমি ওগো কেউ না! আমার নাম ফজলু! আমি ছিলাম না হ্যাগো লগে!’ দলের মধ্যে একজন চিনতে পারলো ফজলু মিয়াকে। সে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
 
‘আরে এইডা তো শিনটা! এ্যারে ছাইড়া দাও! এ্যার জিন্দেগীতে এই হিম্মত হইবো না! ছাড়ো মিয়ারা! ছুঁচা মাইরা হাত গন্দ বানাইও না! আসল গুলানরে ধরবার পারলা না…’
 
ফজলু মিয়ার ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো। সে লোকটার সাথে গলা মিলিয়ে বললো,
 
‘হ হ! আমি শিনটা! পূব পাড়ায় থাগি! আমি ওগো লগে ছিলাম না!’
 
একটা হাসির হল্লা উঠলো এবার। নিজেই নিজেকে শিনটা নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়ায় উপস্থিত মারমূখী জনতা বেশ বিনোদিত হলো। দলের মধ্যে সবাই ফজলু মিয়াকে চিনতো। তার কাপুরুষতার সাথে কমবেশি প্রত্যেকেরই পরিচয় আছে। সে গ্রামের মেয়েদের ইজ্জতের ওপরে হামলা করবে, এতখানি সাহস তার কস্মিনকালেও ছিল না। মনের মধ্যে এমন কুইচ্ছা জাগলেও বাস্তবে রূপ দেওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
 
একটু আগের উত্তপ্ত পরিবেশে বেশ হালকা কৌতুক মজা যুক্ত হলো। লোকজন ফজলু মিয়াকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশা জুড়ে দিল।
 
‘তা মিয়া তুমারও রঙ করার খায়েশ আছে নাকি? এই দলের মইধ্যে চুপ কইরা হান্ধাইছিলা ক্যান? বাড়িত যাও বাড়িত যাও। বাড়িত গিয়া বউয়ের আঁচলের নীচে হান্ধাইয়া থাগো! রাত বিরাইতে বেশি ঘুরাঘুরি ভালা না!’ আরেকজন সাথে সাথে বলে উঠলো,
 
‘আরে আরে! তুমি দেহি কিছুই জানো না! আমাগো ফজলু মিয়ার তো ওহনো শাদীই হয়নি! বেচারা বউয়ের আঁচল পাইবো কনে থিইকা?’
 
আবার একটা হাসির ঢেউ উঠলো। দলের একজন মুরুব্বি গোছের লোক এবারে চটুল মন্তব্যকারীদের দিকে তিরস্কার সূচক দৃষ্টি দিয়ে বললো,
 
‘ঐ চুপ থাক তরা! এট্টু আগেই কাগো পিছে ধাওয়া করছিলি মনে আছে? কুত্তাগো পিছে ধাওয়া দিছিলি! ভাদর মাসের কুত্তা! ওহন তরা নিজেরাও কুত্তামার্কা মজা করবার লাগছিস? হ্যার বউ নাই তাই দিয়া তগো কী? যা বাড়িত যা সব! নিজের নিজের বউ বাচ্চাগো হেফাজত কর মন দিয়া। আউল ফাউল ইদিক উদিকের প্যাঁচাল কম পারবি মনে থাগবো?’
 
ধমকে কাজ হলো।কেউ কেউ পেছন দিকে ঘুরে গ্রামের দিকে হাঁটা দিলো। এবারে মুরুব্বি ব্যক্তিটি ফজলু মিয়ার দিকে মন দিলো।
 
‘এই যে ফজলু! তোমার লগে দেখা হইয়া ভালাই হইলো। একবার ভাবছিলাম তোমার লগে নিরিবিলিতে দুইডা কথা কউম। তা তুমি কাগো কাম করো, সেই হুঁশ আছে?’
 
প্রশ্নটা নতুন নয় ফজলু মিয়ার কাছে। এর আগেও কেউ কেউ তাকে এই প্রশ্ন করেছে। উত্তরটা জানা আছে ফজলু মিয়ার। কাদের কাজ সে করছে, তা ভালোভাবেই জানে। এলাকার নামকরা কিছু মাস্তানের কাজ করে সে। সেইসব মাস্তানদের প্রধান কাজই হচ্ছে অসহায় নিরীহ লোকজনের কাছে গিয়ে চাঁদাবাজি করা। সেটা অর্থও হতে পারে আবার অন্যকিছুও। ইদানিং তো প্রায়ই ঘরে মেয়েমানুষ নিয়ে আসছে। খারাপ মেয়েমানুষ। সারারাত তার সাথে মৌজমাস্তি করে নেশায় চুর হয়ে থাকে একেকজন। ফজলু মিয়া সকালে গিয়ে সেইসব নেশাখোর মাতাল মেয়েবাজগুলোকে ঘুম থেকে জাগায়, তাদের জন্য নাস্তা বানায়, বাজারে গিয়ে দরদাম করে জিনিসপাতি কেনে। বিনিময়ে টাকা পায়। মাস্তানগুলো এখন পর্যন্ত বেতনটা দিতে হারামিগিরি ফলায় না। দু’একবার তুচ্ছ দোষ ধরে বেতন কেটে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তবু মাসশেষে একেবারে খালি হাতে রাখেনি কখনো। আসলে ঐ কয়টা মোটে টাকা তাদের একরাতের মৌজের রসদ। ও আর মেরেধরে তারা করবেটা কী?
 
তবু ঘরে মেয়েছেলে নিয়ে আসে, এটা নিয়ে আশেপাশের প্রতিবেশিরা সিঁটিয়ে থাকে। রাত বিরেতে অশ্লীল ভাষায় হল্লা করে, শীষ বাজায়। অশ্লীলতার শব্দে কান পাতা দায়। নতুন চেয়ারম্যান আসার পরে এদের দাপট আরো কয়েকগুণ বেড়েছে। চেয়ারম্যান এদের পোষে, মালপাত্তি দিয়ে বশে রাখে। বিনিময়ে এরাও চেয়ারম্যানকে খুশি রাখে। তার কথামতো মাস্তানি করে, একে তাকে শাসায়, জোর করে চাঁদা আদায় করে। গতমাসে পাশের গ্রামে একটা খুন হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, তাদের ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের দোসররাই নাকি কাজটা করেছে। এমনটাই দাবী নিহতের পরিবারের। সে নাকি চেয়ারম্যানের পাল্টিগ্রুপের লোক ছিল। অবশ্য প্রমাণ কিংবা সাক্ষীসাবুদ সবকিছুই চেয়ারম্যানের পক্ষে। কাজেই তার এক চুল ক্ষতিও কেউ করতে পারছে না। ফলে চেয়ারম্যানের চ্যালা চামুন্ডারাও বিশেষ নিরাপদে আছে।
 
এখন তো শোনা যাচ্ছে, চেয়ারম্যানের নাকি ঘরের বউয়ের দিকেও আর তাকাতে ভালো লাগছে না। আশেপাশে এত কচি কচি নধরকান্তি বালিকারা ঘুরঘুর করছে! চেয়ারম্যান প্রায়শই ভেট দাবী করছে তার চ্যালাদের কাছে। চ্যালাদের এতে আরো পোয়াবারো। এতদিন তারা শুধু খারাপ মেয়েছেলেদেরই চেখে দেখার সুযোগ পেত। এখন চেয়ারম্যানের উছিলায় তাদের পাতেও মাঝে মধ্যেই পোলাও বিরিয়ানি জোটে। সবটুকু তো আর চেয়ারম্যান একা খেয়ে ফুরোতে পারে না! কিছু উচ্ছিষ্ট রয়ে যায়!
 
ফজলু মিয়ার মনিবদের আশেপাশের প্রতিবেশিরা চম্পট দিতে শুরু করেছে। অনেকের বাড়িতেই সোমত্ত মেয়ে। ঘরবাড়ি গেলে আবার পাওয়া যাবে। মেয়ের ইজ্জত একবার হারালে আর ফিরে আসবে না।
 
ফজলু মিয়াকে নীরব থাকতে দেখে মুরুব্বি আবার বলে,
 
‘শুনো মিয়া। তুমি ভালা হও আর নাই হও। দুর্বল হও আর সবল হও, কেউ দ্যাখবার যাইবো না। বেবাকে এইডাই জানবো যে, তুমি তাগো জোগানদার। খাওন দাওন আর বাড়িঘর দেখভালের চৌকিদার। ওহন তুমি মিয়া বেবাক কিছু জাইনা শুইনা এই শুয়ারগুলানের লগে থাকতাছো? আমরা এই অঞ্চলের বেবাক মানুষ আইজ একাঠঠা হইছি। যত্ত শুয়ার কুত্তা আছে আমগো অঞ্চলের, বেবাকরে খেদামু। ঠিক কইরা কও, তুমিও তাগো দলে নাম লিখাইছো নাকি? যদি লিখাও, তাইলে আইজ তুমারেও ছাড়ুম না। দুই ঘা আইজ খাইয়া যাও। আর দুই ঘা দুইদিন পরে খাওনের লাইগা রেডি থাগো! আর যদি তাগো দলে ওহনতরি না ভিড়ো, তাইলে আমাগো দলে আসো। দুইদিন সময় দিলাম। ভাইবা চিইন্তা উত্তর দাও। এই দুইদিনের মইধ্যেই নিজের দল ঠিক কইরা ফ্যালবা বুইঝছো?’
ফজলু মিয়া শিউরে ওঠে। বিপদ আজ তার উভয়দিকেই। এই ক্রুদ্ধ জনতার জিজ্ঞাসা আর আক্রোশের হাত থেকে কোনক্রমে বেঁচে গেলেও বেশিদিন সেই বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব নয়। একবার তার মালিকপক্ষের লোকজনের কাছে যদি এর বিন্দু বিসর্গ খবরও পৌঁছায়, তাহলে তার আধখাওয়া চিমড়ানো শরীরের সিকিকণাও আর কেউ খুঁজে পাবে না। এই ভগ্ন শরীর আর ততোধিক ভগ্ন মনের জন্য আজ অব্দি বিয়েটাও করতে পারেনি সে। বউকে কোনোদিকেই সুখ দিতে পারবে বলে ভরসা জাগেনি মনে। বাবা-মাও চলে গেছে ঐ দুনিয়ায়। নিজের বলতে আছে এই ধুকপুকুনির জীবনটাই। মাঝে মধ্যে মনে হয়, সেটাকেও বা এত যত্নে বাঁচিয়ে রাখা কেন? মরে গেলেই তো ল্যাঠা চুকেবুকে যায়!
 
তবু কীসের এক অদৃশ্য মায়া এসে পথ আটকে দাঁড়ায়। আহা! মায়া! বেঁচে থাকার মায়া! যত বয়স হচ্ছে ততই যেন এই মায়ার গিঁট শক্ত হচ্ছে! চিন্তার সূত্র কেটে গেল সামনে দাঁড়ানো মুরুব্বীর আওয়াজে।
 
‘কী হইলো মিয়া? কথা মনে থাগবো? আমরা কইলাম জঙ্গলা সাফ করবার গ্যালে দেইখা শুইনা কোপ দিমু না! কার কোপে কে খতম হইবো কিচ্ছু বুঝবার আগেই বেবাক ফিনিশ!’
 
কাঁপতে কাঁপতে নিজের গন্তব্যে ফিরলো ফজলু মিয়া।
 
তার মনিবেরা সব ‘কাজকর্ম’ শেষ করে ডেরায় ফিরেছে। ফজলু মিয়ার ফিরতে দেরি হওয়ায় একজন খটখটে স্বরে হাঁক দিলো।
 
‘ঐ ব্যাটা হাভাইত্যার পোলা! কনে ডুব দিছিলি? তরে না কইছিলাম আইজ তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না শ্যাষ করবি? আমাগো কাম আছে! কইছিলাম না তরে? কথা কানে হান্ধায়নি? তরে সময় দিলাম আধাঘণ্টা। এর মইধ্যে খাওন দিবি ব্যাস! ক্যামনে দিবি হেইডা জানি না!’
 
ফজলু মিয়া প্রমাদ গুনলো। আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিল কে জানে! কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ সে। শুভ অশুভ মানে। সকাল বেলা ভালো মানুষের মুখ না দেখলে দিনটাও অশুভ যায়, এটা সে হাড়েহাড়ে বিশ্বাস করে। এই বাড়িরই এক কোণাতে ঘুপচি এক ঘরে সে বাস করে। সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে চুলায় আগুন দেওয়ার আগেই সে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে নেয় কিছুক্ষণ। ভালো দিনের আশাতে এই কাজ সে নিয়মিত করে। তার পাঁচজন মনিবের একজনের ঘুমও বেলা দশটার আগে ভাঙে না। তবু প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে বাড়ির চৌকাঠটা পার হয় ফজলু মিয়া। বলা যায় না, কেউ যদি টয়লেটে যাওয়ার জন্য আগেভাগে উঠে পড়ে! তাহলেই তো তার শুভদিনের মুণ্ডুপাত হয়ে গেল! এখন অব্দি এই ঘটনা কদাচিত ঘটেছে বই কী! তবে আজ ঘটেছে বলে তো মনে করতে পারছে না! তাহলে আজকে তার সাথে একের পর এক এসব কী ঘটে চলেছে?
 
ফজলু মিয়া চিঁ চিঁ করে জবাব দিল,
‘অখনই রান্না বসাইতাছি, দেরি হইবো না!’ একজন খেঁকিয়ে উঠলো,
 
‘-ইহ্‌ দেরি হইবো না! আবার মুখে মুখে কতা! তাড়াতাড়ি কর হারামজাদা!’ পাশ থেকে আরেকজন অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে বললো,
‘তগো দেখি, দেরি সইতাছে না! ধইর্য রাখ। হিহ হিহ…’
 
কথাবার্তা শুনে ফজলু মিয়ার বুঝতে বাকি রইলো না, আজ রাতে কোনো এক মেয়ের সর্বনাশ করতে চলেছে তার মনিবেরা। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয়, কাজটা ছেড়ে দিবে। অন্য কোনো একটা কাজ খুঁজে পেতে নিবে। একজনের পেট। এটা চালাতে আর কতখানি খোরাকি লাগে? তবু অনিশ্চয়তার ভয় চেপে বসতে দু’দন্ড সময় লাগে না। বললেই কি এত সহজে কাজ ছাড়া যায়? হাভাতের ছেলেই তো সে! বাপ মরে যাওয়ার সময় যদি দুই কানা জমিও রেখে যেত, সেটাতে হালচাষ করেও দিন গুজরান করা যেত। আজকাল খাবারের দোকানে কাজ নিয়েই চলছে অনেকে। কিন্তু সেখানে অনেক প্রতিযোগিতা। টিকে থাকার জন্য একজন আরেকজনের গলায় ছুরি বসাতেও কার্পণ্য করে না। কাজেই সেসব জায়গায় তার মতো হাড় লিকলিকে লোক বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না। তার এই কাজে বরং কোনো প্রতিযোগিতা নেই। ভয়ে কেউ আসতেই চায় না। তবু তার মতো হাড়-সর্বস্ব ভীতুর ডিম এতদিন ধরে এখানে টিকে গেল! হয়ত তার ব্যক্তিত্ব, সাহস কিংবা শরীরের বল…কোনোটাই নেই বলেই এরাও তার প্রতিই আস্থাশীল। ফজলু মিয়া কাজ ছাড়তে চাইলেও এখন এরাই তাকে ছাড়াবে না। কোথাও যেতে চাইলে মেরে হাত পা ভেঙে দিবে। তাদের সবরকম গোপন আঁতাতের নীরব সাক্ষী সে। এমন মুখবন্ধ পোষা কুকুরকে কি কেউ ছাড়িয়ে দেয়?
  
তার মনিবদের একজন গম্ভীর গলায় বললো,
 
‘এট্টু আগে তিনরাস্তার মোড়ে একডা ঘটনা ঘটছে, হুনছোশ? মানিক আর তার কয়েকডা বন্ধু মিইলা বাদল মিয়ার ঘরে হান্ধাইছিল। হ্যাগো পাড়ার টিপু মিয়া আর হ্যার কয়েকজন সাগরেদ নাকি ধাবাড় দিছে। মানিকের হাতে লাঠির বাড়ি মারছে হালারা। হাত নাকি ভাইঙ্গা গ্যাছে!’
 
ফজলু মিয়ার কান খাড়া হয়ে গেল সাথে সাথে। রান্না করাতে ঢিলেমি করার উপায় নেই। তবু প্রতিটি শব্দ খুব মন দিয়ে শুনতে লাগলো সে।
 
‘বাদল মিয়ার বউ মানে হেই মাইয়া না? শালী আবার নতুন সোয়ামীর ঘর করতাছে! মানিক খারাপ আছিলোনি? মানিক না হ্যারে পছন্দ করতো?’
 
‘হ! শালী রাজি আছিলো না। বাদলারে বিয়া করছে। তাই তিন বন্ধু লইয়া শোধ তুলবার গ্যাছিলো মানিক্কা। শালাগুলান এমুন খেদান দিছে! আবার জখমও করছে। গালিগালাজ করছে। কইছে আরেকবার গ্যালে জানে মাইরা ফ্যালবো!’
 
‘কী? টিপু হারামির এত্ত সাহস! ব্যাটা মুরুব্বি হইছেনি? ওর মুরুব্বিয়ানার শখ দ্যাখতাছি ঘুঁইচা দেওন লাগবো! বেশ্যা মাগীর লাইগা এত্ত দরদ! ঐ শালীরে উঠাইয়া আনুম আইজগা চ! যেই কাজে যাইবার চাইতাছি হেইডা পরে করুম!’
 
একজন মৃদু প্রতিবাদ করে বললো,
 
‘আইজ না গ্যালাম। আইজ ওরা হজ্ঞলে সজাগ হইয়া আছে। আমরা গ্যালে ধইরা ফ্যালবো!’
 
‘ধইরা ফ্যালব মানে? হালা তুই না চেয়ারম্যানের সাগরেদ! তর মুখে এই কতা? ওরা আমাগো ধরবো আর আমরা চাইয়া চাইয়া আমের আঁটি চুষুম? বেশি তেড়িবেড়ি দ্যাখলে দিবি সোজা ঘোড়া টিইপা!’
 
‘তাও থাকুক। আজ না গ্যালাম। কাইল যামু। পাক্কা!’
 
‘বুঝছি। আইজ ঐ কাম না কইরা আসা অব্দি তোগো জানে শান্তি আইতাছে না! হিহ হিহ হি…’
 
ফজলু মিয়া তড়িৎগতিতে রান্নার কাজ শেষ করে আধাঘন্টার মধ্যেই খাবার লাগিয়ে দিলো। তার জান ধুকপুক করছিল, কখন বুঝি তার নামটাও আলগোছে উচ্চারিত হয়! সেটা না হওয়াতে তার জানে নতুন প্রাণসঞ্চার হলো। যাক, এই যাত্রা বুঝি বেঁচে গেল সে!
রাতের খাওয়া শেষ করেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে আবার কাজে ছুটলো ফজলু মিয়ার পাঁচ মনিব।
 
সারারাত কড়িকাঠের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রাত পার করলো ফজলু মিয়া। দরজা খোলার জন্য তাকে রাত জেগে অপেক্ষা করতে হয় না। এটুকু দয়া মনিবেরা তার জন্য বরাদ্দ করেছে। গভীর রাতে দরজায় আওয়াজ, চেঁচামেচি আর নারীকন্ঠের কান্নার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলো, তার মনিবেরা অবশেষে ফিরেছে। আজ কোনো বাজারের মেয়েছলে নয়, হয়ত নীরিহ চাষাভূষার অল্পবয়সী কোনো মেয়ে তাদের লালসার শিকার হতে যাচ্ছে। সারারাত মেয়েটার বিভৎস বুকফাটা আর্তনাদে ঘুমের চৌদ্দগুষ্টি কাছেপিঠে ভিড়তে পারলো না ফজলু মিয়ার।
 
ভোরের আলো ফুটতেই ভয়ে ভয়ে নিজের ঘরের দরজা ফাঁক করে একবার চারপাশটা দেখে নিলো সে। তারপর চুপিসারে পা টিপে টিপে এগুতে লাগলো মনিবরা যে ঘরে থাকে, সেই ঘরের দিকে। কাছাকাছি যেতেই মনে হলো বাইরের মূল গেটের বাইরে কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। আচমকা ভোরের শান্তিকে খানখান করে দিতে কোথা থেকে যে উদয় হয়েছে কুকুরগুলো! ভাবতে ভাবতেই সেদিকে এগিয়ে গেল ফজলু মিয়া। আর গিয়েই তার পা দুটো একেবারে বরফের মতো জমে গেল। গেটের বিপরীতমুখে অবস্থিত আমগাছটার সাথে শাড়ি পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে আছে চৌদ্দ পনের বছরের একটি মেয়ে। সারা মুখ আর পেটের উন্মুক্তস্থানে ছড়ানো ছিটানো কালসিটে দাগগুলো মনে করিয়ে দেয় গত রাতের পাশবিকতা। মেয়েটির মুখজুড়ে স্নিগ্ধ মায়াময়তা। টলটলে চোখদুটো একরাশ প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে এদিকেই, ঠিক যেখানে ফজলু মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না ফজলু মিয়া। রাত্রি জাগরণের অবসাদ, গতকাল সন্ধ্যা থেকে ঘটমান নানাবিধ ঘটনা আর এই মুহূর্তের মূর্তিমান বিভৎসতা…মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠলো। তীব্র একটা চিৎকার দিয়ে সেখানেই উল্টে পড়ে গেল ফজলু মিয়া।
 
এরপরের ঘটনাপ্রবাহ শুরু হলো ফজলু মিয়ার চৈতন্য ফিরে আসার পর।
 
কে বা কারা তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়েছে, সেটা সে মনে করতে পারেনি। শুধু মনে আছে একটা আর্ত চিতকারে স্থবির হয়ে পড়ছিল তার জাগতিক সকল বোধবুদ্ধি। মেয়েটির বাবা-মা অনেকক্ষণ ধরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলছিল আর অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ্য করে বিচারের মিনতি জানাচ্ছিল। ফজলু মিয়ার কানে ঝিঁ ঝিঁ পোকার এক বিশাল ঝাঁক তখন বাসা বেঁধেছে। আশেপাশের আওয়াজ গুলো গতিপথে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তার কাছে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিলো। চারপাশে বহু মানুষ জড়ো হয়েছে। ফজলু মিয়া ব্যাকুল চোখে তার মনিবদের খুঁজছিল। কিন্তু পাঁচজনের কাউকেই সেখানে দেখা যাচ্ছিল না। ফজলু মিয়া সভয়ে ভেতরের ঘরের দিকে যেতে চাইলো। মনিবরা কেউ এখন এসে পড়লে মহা সর্বনাশ হবে। এতগুলো লোককে যে সে ডেকে আনেনি, এটা কিছুতেই তারা মানতে চাইবে না।
 
হঠাৎ কার একটা ঝটকা টানে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝাঁক সাঁই করে তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেল। কেউ সবেগে চড় বসিয়েছে ফজলু মিয়ার গালে। তাকাতেই চিনতে পারলো লোকটাকে। গতকাল সন্ধার সেই মুরুব্বি। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো লোকটা।
 
‘বল তর হুজুররা কই পলাইছে? আইজ না কইলে এইহানেই তরে পুইতা যামু। শালা কাপুরুষের বাচ্চা, আজন্মা…  ‘
 
গোঁ গোঁ করে কিছু একটা বলতে চাইলো ফজলু মিয়া। আওয়াজ বেরুলো না তার গলা চিরে। একটু পরেই পুলিশের গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। তাদের ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সাহেবকেই প্রথমে নামতে দেখা গেল গাড়ি থেকে। পুলিশ নামলো তার পেছন পেছন। পুলিশের নরম চাহনি আর মার্জিত হাবভাবে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা চুক্তির লক্ষণ পরিস্ফূট। চেয়ারম্যান সাহেব গাড়ি থেকে নেমেই সোজা এগিয়ে গেল মেয়েটির লাশের দিকে। নাকে রুমাল গুঁজে কিছু একটা দেখে নিয়েই বললো,
 
‘এই যে দেখেন দেখেন ইন্সপেক্টর সাব, আপনি নিজেই দেখেন! এই মাইয়ার গায়ের আঁচড় গুলান দেইখাই বুঝা যাইতাছে, সব সক্কাল বেলার টাটকা আঁচড়। এই এগো মইধ্যেকার কেউ এ্যারে মাইরা আমার পোলাপানগুলানের গায়ে দোষ চাপাইতাছে। এই যে, এই যে…টিপু মিয়া তুমি এত্ত জলদি খবর পাইলা ক্যামনে? কাইল রাত থাইকাই শুনলাম ব্যাপক গ্যাঞ্জাম চালাইতাছো! আমার চেয়ারম্যানগিরি নাকি ছুটাইয়া দিবার চাও? কও দেহি ওহন, এই আকামডা করলা কহন? আর এই মাইয়া কি তুমার পোষা মাইয়া মানুষ ছিল নাকি? আগেভাগেই খবর পাইয়া ছুইটা আইলা কীয়ের দরদে?’
 
পুলিশ ইন্সপেক্টরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে যা বলার চেয়ারম্যান সাহেব একাই বলে যেতে লাগলো। একসময় তার চোখ পড়লো ফজলু মিয়ার দিকে। একটু চোখমুখের ভঙ্গিমা করে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
 
‘এই যে ফজলু মিয়াও আছে এইহানে। আমার পোলারা কিছু ঘটাইলে ফজলু মিয়া তো জানবোই। কী গো মিয়া, হাছা কইরা কও। কিছু দেখছোনি তুমি?’
 
চেয়ারম্যানের কটকটে লালচক্ষু একেবারে সূচের ফলার মতো বিদ্ধ করে দিলো ফজলু মিয়াকে। নিজের অজান্তেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,
 
‘আমি কিছু দেহি নাই!’
চেয়ারম্যানের চোখমুখ আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠলো। উপস্থিত পুলিশের সদস্য, জনতা সবার দিকে তাকিয়ে বিজয়গর্বে বলে উঠলো,
 
‘এই দ্যাহেন হাতে নাতে পরমান পাইয়া গেলেন! এই ফজলু মিয়া এই বাড়ির কেয়ারটেকার। হেয় কিচ্ছু দেহেই নাই! ইন্সপেক্টর সাব, এই টিপু মিয়ারে তুইলা নিয়া যান! এর পেট টিইপা ধরলেই বেবাক সত্যি বাইর হইয়া যাইবো। এ্যার পেডেই বেবাক কিছুর জট পাকাইয়া আছে!’
 
টিপু মুরুব্বি দুইচোখ দিয়ে ফজলু মিয়াকে ভস্ম করতে করতে পুলিশের ভ্যানে গিয়ে উঠলো। মেয়েটির লাশ তার বাবা-মাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। তারা হাতে পায়ে ধরে ময়নাতদন্ত না করার প্রার্থনা জানালো। অনেক কাটাছেঁড়া করা হয়েছে তাদের আদরের মনিকে। আরো কাটাছেঁড়া করলে আর নতুন কিছু বেরিয়ে আসবে না। চেয়ারম্যান সাহেবও উদারমনে ইন্সপেক্টরকে বলে দিলো,
 
‘আহা…হাছাই তো! ছাইড়া দ্যান ইন্সপেক্টর সাব! আর কিছু করনের কাম নাই। লাশ এরা লইয়া যাক। যাও যাও…তাড়াতাড়ি দাফন কাফন সাইরা ফালাও। মাইয়া যদি আকাম কুকাম কিছু কইরা থাগে, বেলা চড়নের আগেই চাপা দিয়া দাও। যাও যাও…লইয়া যাও!’
একে একে সবাই বেরিয়ে গেল। শূন্য বাড়িঘর আগলে ধরে ফজলু মিয়া বসে রইলো। আস্তে আস্তে বেলা চড়তে থাকলো। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। প্রচণ্ড বিবমিষায় ঘুলিয়ে উঠছে পুরো দুনিয়া। তবু অদম্য মনোবল একত্র করে একসময় উঠে দাঁড়ালো ফজলু মিয়া। সে জানে, আয়োজন সব হয়ে গেছে। আর একটু পরেই বিজয়ীর বেশে ফিরে আসবে তার মনিবেরা। তাদেরকে সাদরে বরণ করতে হবে ফজলু মিয়ারই। সেটারও আয়োজন করে রাখা দরকার। পাকঘরে ঢুকে কেরোসিনের বড় জ্যারিকেনটা খুঁজে বের করলো সে। খোঁয়াড়ে একটা বড় বোতলে কিছু পেট্রোলও রাখা আছে। কখনো কাজে লাগতে পারে ভেবে, রেখে দিয়েছিল ফজলু মিয়া। আজ সত্যি সত্যিই কী সুন্দর কাজে লেগে গেল!
 
 
মনিবদের বিরাট ঘরের দরজা হাট করে খুলে রাখাই ছিল। সারারাতের জঘণ্য বর্বরতার চিহ্ন ছড়ানো ছিটানো আছে ঘরের প্রতিটি কোণে। পুলিশ একবার এসে তল্লাশী চালালেই যা পাওয়ার পেয়ে যেত। কিন্তু এত সময় কি আছে ব্যস্ত পুলিশের?
 
সময় নষ্ট করলো না ফজলু মিয়া। যেকোনো মুহূর্তে তার মনিবেরা চলে আসবে। সারা ঘরে নিখুঁত পারদর্শীতায় কেরোসিন আর পেট্রোল ছড়িয়ে দিলো সে। একটু একটু করে প্রতিটি ফাঁক ফোকড় আর কাপড়-চোপড়ে কেরোসিনের স্পর্শ বুলিয়ে দিলো প্রগাঢ় মমতায়।
 
কাজ শেষ করে অনেক যত্ন নিয়ে রান্নাবান্না করলো ফজলু মিয়া। কতদিন এত যত্ন নিয়ে রান্না করে না সে! আজ প্রতিটি খাবার খেয়েই তৃপ্তি পাবে তার মনিবেরা। সে নিজেও পেটপুরে খেলো। তারপর অবশিষ্ট খাবারে মিশিয়ে দিলো গাঢ় ঘুমের ঔষধ।
 
সন্ধ্যা নামার আগেই মনিবেরা সাড়ম্বরে ফিরে এলো। তৈরি করে রাখা খাবার দাবারের আয়োজন দেখে খুশি হয়ে উঠলো তারা। আজ বহুদিন পরে দারুণ একটা বাণিজ্য হয়েছে। তাদের সব কাজের বাগড়াদাতা টিপু মাতব্বরকে পুলিশের ঠেঙ্গানি খাওয়ানো গেছে। তাও আবার তাদের নিজেদেরই কৃতকর্মের শাস্তিস্বরূপ! শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তিও এক লাফে কয়েকগুণ উঁচু হয়ে গেছে। আর ভয় কী তাদের? স্বয়ং পুলিশ ইন্সপেক্টর রয়েছে তাদের সাথে! চেয়ারম্যান তো তাদেরকে নিজের ‘পোলা’ বলেই পরিচয় দেয় সবার কাছে! তাদের টিকি ছুঁতে পারে, এমন আর কে থাকলো এই অঞ্চলে?
রাত নামার আগেই ঘুমে চোখ ঢুলে পড়তো চাইলো তাদের একেকজনের। দীর্ঘ ক্লান্তি, উৎকন্ঠা… এসবের কারণেই হয়ত আজ বড্ড আগে ঘুম পাচ্ছে। নিজেদের শরীর একসময় নিজেদেরই বশে রইলো না। যে যেখানে পারলো, ঘুমের কোলে ঢলে পড়লো।
 
লিকপিকে মন আর দেহের দুর্বল এক মানুষ তখন গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলো নিজের ঘর থেকে।
 
হাতে রাখা আছে মস্ত এক তালা। সাত পাঁচ না ভেবে সযত্নে তার মনিবদের ঘরের দরজা টেনে দিয়ে তালাটা লাগিয়ে দিলো দরজার কপাটের সাথে। তারপর জ্বলন্ত একটা শিনটের টুকরা ছুঁড়ে দিলো খোলা জানালা ভেদ করে সোজা ঘরের মাঝখানে।
 
লকলকে আগুনের লেলিহান শিখা নিমেষেই দাউদাউ করে ঘরের তুঙ্গ স্পর্শ করলো।
সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে ক্লান্ত পায়ে এ’বাড়ির ফটক থেকে বেরিয়ে এলো… শেষবারের মতো!
 
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত