| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

জটিল অঙ্ক

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
অঙ্কটা এমন কিছুই কঠিন নয়। সিম্পল ত্রৈরাশিক। মজুরসংখ্যা, দিন সংখ্যা আর দিন-প্রতি কাজের ঘন্টার হিসেব। ছ’টা তথ্যর মধ্যে পাঁচটা রয়েছে, একটা কেবলমাত্র দেওয়া নেই। কিছুতেই ছকটা সাজাতে পারছি না। কার পাশে কোনটা বসবে, কোনটা ওপরে কোনটা নিচে…সব ঘেঁটে যাচ্ছে। অথচ ছকটা সাজাতে পারলেই কষে ফেলতে পারি অঙ্কটা। কান-মাথা দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে যেন! ঘন্টা পড়ে গেল। গার্ডে থাকা শেফালিদি এগিয়ে এলেন গটগট করে। আমার খাতাটা ধরেই টান মারছেন। বুকে আঁকড়ে রয়েছি খাতাটা। পাতার পর পাতা কাটাকুটি শুধু। অঙ্কটা সাজাতেই পারিনি। রাগে ভয়ে চেঁচাতে আরম্ভ করলাম। গোঁ গোঁ করে গোঙানি ছাড়া আর কিচ্ছু বেরোচ্ছে না। খাতা ছেড়ে দিয়ে এবারে আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছেন শেফালিদি। বলছেন, “অ্যাই কেয়া, কেয়া! কী হল! আরে হলটা কী?
চোখ খুলে উঠে বসে পড়েছি কখন! রাস্তার আলোটুকুতেই ঘরের সবকিছু আবছা দেখা যাচ্ছে। পর্দাগুলো উড়ছে। মনোজিৎ আমার কাঁধ ধরে নাড়াচ্ছে।
“আবার নিশ্চয় সেই বোকা বোকা স্বপ্নটা?”
“হুম…তুমি কী করে জানলে!” আমার গলাটা ঈষৎ জড়ানো, ভয় মেশানো। এখনও ঠিকমতো ধাতস্থ হইনি।
“তাছাড়া আর কীই-বা হতে পারে? রোজই এক কিস্সা! ওফ্, শোও তো চুপচাপ।”
মনোজিত গজগজ করতে করতে উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। আমিও শুলাম শান্ত হয়ে। জল খেতে পারলে ভাল হত।
পঁচিশটা বছর হয়ে গেল স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোনোর। তবুও কেন যে স্বপ্নটা দেখি মাঝেমধ্যেই! একটা অঙ্ক কিছুতেই সাজাতে পারছি না। এদিকে গোটা প্রশ্নপত্রের বাকি অঙ্কগুলো আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে। সারা শরীর ঘেমে উঠেছে। হাঁফ ধরছে। অসম্ভব অসহায়তা। ঘন্টা পড়ল, খাতা কেড়ে নিচ্ছেন শোফালিদি। ছন্দা, মধুপর্ণা, কেতকীরা নির্বিকারে আমার দুর্দশা দেখছে। সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না কেউই।
ঋষিকে তো আজ সন্ধ্যায় ত্রৈরাশিক করাইনি! ওটা ওর সিলেবাসের নয়। ত্রিকোণমিতির উচ্চতা ও দূরত্বের একটা প্রাথমিক পরিচয় দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। ঋষির ম্যাথস আর ফিজিক্সটা আমিই দেখি। বায়োলজি আর ইংলিশের জন্য কোচিংয়ে যায়। বাজার বুঝে চলতে হয়। টিউশনের পেছনে একগাদা অনর্থক খরচ আমার পোষায় না। হিসেব করে চলি বলে ঠোনা দেয় মনোজিত। বলে, “আমার বিনি পয়সার অ্যাকাউন্ট্যান্ট।”
দুধওয়ালার বাড়তি-বন্ধ, ডিমওয়ালার মাসকাবারি, পেপারের সাথে কখনোসখনো মন হলে  নেওয়া টুকটাক ম্যাগাজিন, গ্যাস সিলিন্ডারের আয়ু, ডেলিভারি বয়ের বখশিশ…সব হিসেব আমার মগজে রেডি থাকে। কোথাও এতটুকু সিকি-আধুলির গরমিলও হয় না। অথচ ওই ত্রৈরাশিকের হিসেবটা আমাকে নাজেহাল করে ছাড়ে অকারণে। মাধ্যমিকে লেটার ছিল অঙ্কে। অনার্সেও অঙ্ক। কিছুদিন মোহনপুরে একটা বেসরকারি স্কুলে অঙ্কের টিচার হিসেবে চাকরি করার পর ছাড়লাম। ঋষি মারাত্মক অসুস্থ হয়েছিল সেসময়ে। হেপাটাইটিসে পুরো একটা অ্যাকাডেমিক ইয়ার ওর নষ্ট হল।
টুনির মায়ের মাইনেটা তিনমাস হয়ে গেল বাড়িয়েছি। আগে শুধুই একবেলার ঠিকে ছিল। আটশো টাকা শুকনো বেতন। এভাবে বছর পাঁচেক চলেছে।
সকালের তাড়াহুড়োয় কাটা-বাটা-রান্না বেশ কিছুটা ঝক্কি বলে মনে হচ্ছিল কিছুদিন ধরে। বয়সটাও চল্লিশের দাঁড়ি ছুঁয়েছে বছর দুই আগে। শরীরে এটা-সেটা উপসর্গ। কোমরে-পায়ে যন্ত্রণা হয় থেকে থেকেই। কাজের গতি কমে আসছে। দৌড়ঝাঁপ যেন আর পোষায় না। সন্ধেবেলায় ঋষিকে নিয়ে বসি। সামনেই টেস্ট। তাই তখন যে বেটে-কেটে কাজ এগিয়ে রাখব সে আর হয়ে ওঠে না।
মনোজিতের সাথে আলোচনা করার পর টুনির মায়ের কাছে কথাটা পাড়লাম। ও ঘাড় কাত করে রাজিও হল। অভাবী মানুষ। কাজ বাড়ালে দামও বাড়াব, সেটা নিশ্চয়ই বুঝেছিল। এক কথায় খাড়া হয়ে গেল।
সন্ধে লাগার ঠিক মুখটায় এসে ফ্রিজ খুলে সব্জিপাতি বের করে কেটে, মশলা বেটে কৌটোয় পুরে ফ্রিজে রেখে বিদায় নেয়। মাইনে একলাফে আরও আাড়াইশো বেড়ে এক হাজার পঞ্চাশ টাকায় গিয়ে ঠেকল।
কিছুদিন খুব চুল উঠছিল। ঋষির স্কুলের বন্ধু সাগ্নিকের মা একটা তেলের কথা বলল। ও নিজে যাচাই করে ফল পেয়েছে। তবে, তেলটা একটু মালিশ খায়। ঘষে ঘষে খুলির চামড়ায় ভরে না দিলে কাজ দেয় না। টুনির মা’কে জপালাম। এবারেও “না” বলল না। টুনির মায়ের মাইনেতে সপ্তাহে দুদিন কুড়ি টাকা করে ধরে সপ্তাহে চল্লিশ টাকা হলে মাসে চার সপ্তাহ আন্দাজে চার চল্লিশং একশো ষাট টাকা আরও যোগ হল।
তেল মালিশের বাঁধা দিনগুলোতে বিকেলের আলো থাকতে থাকতেই আসে টুনির মা। আমি বড় টিভিটা ওর মুখের সামনে চালিয়ে দিই। বাংলা সিরিয়াল চলে গাঁকগাঁকিয়ে। টুনির মায়ের হাঁ-মুখে মাছি সেঁধোলেও টের পায় না। আঙ্গুল চলে এলোমেলো পথে চুলের ফাঁকে ফাঁকে। গোড়াগুলোয় ব্লাড সার্কুলেশন বাড়ে। আরামে আমার চোখ বুজে আসে। যা দাম দিই তার কয়েকগুণ বেশি পরিষেবা তুলে নেওয়ার জন্যই টিভির বন্দোবস্ত। শাশুড়ি-বৌমার ক্যাঁচালে ঢুকে পড়ে টুনির মায়ের আর সময়ের হুঁশ থাকে না।
টুনির মায়ের আসল নাম ফুল্লরা। মুর্শিদাবাদের ডোমকলের দিকে আদি বাড়ি-ঘর ছিল। ভালো কাজের তাগিদে পুঁটলিতে সংসার বেঁধে এখানে এসে ভাড়ায় উঠেছিল। টুনিকেও এনেছিল, পেটে ধরে। টুনির মায়ের কথায় মুর্শিদাবাদের ছাপ স্পষ্ট।
“তখুনকে অই টুনির মা গানটা খুব গাইথ জি লুখ্যা! অইলিগ্যাই থ বিটির টুনি নাম। ইখানে ফুল্লরা বুললে পরে কেউ চিনে না খুও। অই টুনির মা বুলোগা যাও, সুবাই চিনবে।”
টুনির বাপটা চায়ের দোকান চালায়। ঘর-লাগোয়া টিনের ঝাঁপে বাঁশের ঠেকনা দিয়ে। আমি কোনওদিন দেখিনি। টুনির মা-ই বলে।
“নেশাভাঙ করে না খুও বুইদি। জমি-ঘরের দালালি করথুও। ইস্টোক হবার বাদ  আর অই কাজবাজে যেতে পারে না খুও। পারলে কি আর বাসুন ধুবার কাজ করথাম? লাঁচারে পড়িই…।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুনির মা। কথায় কথায় উঠে আসে উপায়ান্তর না পেয়ে টুনির মায়ের ঠিকে কাজ খোঁজার ইতিহাস। টুনির বাপকে ঘরে বসে ঠেকনাটুকু দেওয়ার  মতো চায়ের দোকানদানি ধরানোর কাহিনি।
টুনির বিয়ে হয়েছে মছলন্দপুরের দিকে। জামাই টোটো চালায়। ভাড়ার টোটো।
“আর ক’বচ্ছর ভাড়ার টোটো টাইনলে পরে লতুন টোটো কিনথে পারবে গুও বুইদি জামাইটা।” টুনির মায়ের চোখ দু’টো চকচকে দেখায়। সংসারটাকে অনেকটাই গুছিয়ে তুলতে পেরেছে টুনির মা। কতই বা বয়স হবে। আমার চাইতে অবশ্যই ছোট। এরই মধ্যে কত লড়াইয়ের পথ হেঁটে ফেলেছে। জমি-বাড়ির দালালির উপায়ের জমানো পয়সায় নিজেদের এককুঠুরি খাড়া করেছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। টুনির একটা মেয়ে আছে বছর পাঁচেকের। আবার হবে সামনের অঘ্রানে। নাতনির পরে এবারে একটা নাতির মুখ দেখতে চায় টুনির মা।
টুনির বাপটা অকেজো না হয়ে গেলে আজ আরেকটু সুখের মুখ দেখতে পেত টুনির মা।  কপালে সব সুখ সয় না কারো কারো।
হঠাৎ ডুব দিল টুনির মা। না বলেকয়ে কামাই করলে ফ্যাসাদে পড়ি। পইপই করে বলেছি একটা সেকেণ্ড হ্যান্ড হলেও মোবাইল নিতে। শোনেনি। খবরটুকু পেলে তো সামলে নেওয়া যায়। কিন্তু, এরকম বিনা নোটিশে কামাই করার কোনও যুক্তি পাই না। কে জানে, হয়তো মিউনিসিপ্যালিটির কলে জল নিতে গিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়েছে। এই আরেক ঝামেলা। জলের ঝগড়ায় টুনির মা এতটাই মজে যায় যে আর কাজের খেয়াল থাকে না। তার বাড়ি সেই স্টেশনবাজারটা পেরিয়ে নতুন সাঁকোর দিকে। রাস্তাও চিনি না। টুনির মা সাইকেল চালিয়ে আসে। মনে মনে ক্ষুব্ধ হই। দাঁত কামড়ে বাসন ঘষি, ঘর মুছি, কাপড় পেটাই।
সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেল এভাবে। রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া দু’-চারজন কাজের মহিলা দেখলে মুখ শুলোয়। আবার ভাবি, টুনির মা ফিরলে বিপদ। নতুন রাখা লোকের সাথে চুলোচুলি করবে এসে। টুনির মায়ের এলাকা থেকে এ তল্লাটে কেউ কাজে আসে না। জিজ্ঞাসা করে খবরাখবর নেব যে সে উপায় নেই। পরিচিত একজন বলল ওদের নাকি এটা ইদানীং বাড়তি ইনকামের ফিকির। মুখে না বলে ধাঁ করে কামাই দিয়ে অন্য বাড়িতে পার্ট টাইম সার্ভিস দিচ্ছে। বাঁধা ঘরগুলোয় তো আর মাইনে কাটবে না। যা জুটবে তাই উপরি।
মাথায় আগুন জ্বলে। সবমিলিয়ে নাজেহাল দশা। মনোজিত বলে আমি নাকি খিটিমিটি করছি সর্বদাই। ঋষিরও এক ‘রা’।  ওরা কষ্ট বোঝে না। খিঁচড়ানো মেজাজটাই দেখতে পায় আমার।
বেল বাজতেই উৎকর্ণ হয়ে ছুটে গেলাম। টুনির মা। রুগ্ন ঝড়লাগা ক্ষীণ গাছের মতো নুয়ে পড়া চেহারা। ভিতরে এল। পনেরো দিনে বয়স বেড়েছে পনেরো বছর। চোখ নামিয়ে রান্নাঘরের সিঙ্কেের দিকে এগিয়ে গেল। আমি পিছনে।
কামাই করার কারণ সরাসরি জিজ্ঞেস করা রুচিতে বাধে। আজকাল জবাবদিহির দায় এদের থাকেও না। চুপ করেই রয়েছি। বাসন মাজার স্টিলউলটা গুছিয়ে বাটি থেকে সাবান তুলে আমার মুখপানে চাইল।
“বুইদি, একটা কথা বুলবুঅ?”
“বলো।”
“ইবার থেখ্যে আর বিকেলকে আসা হবে না বুইদি। টুনি আগুনে পুড়ে মরি জ্যালো গো বুইদি।”
আমার বুকটা কেঁপে উঠল, “সে কী! এই না বললে, জামাই ভালো। নতুন টোটো কিনবে?”
“অই টোটোই কাল হল বুইদি। পয়সার লেগ্যা টুনিকে মারধর করছেল। আমাকে দিতে বুল্যাছেল। তা আমি প্যাট পেলে পেলে খেঁইয়ে বাঁচি বু’দি। টোটোর কিনার পয়সা কুতি পাবু তা? অই লেগ্যা ক্রাসিন ত্যাল ঢেল্যাঁ…।”
ফোঁপাচ্ছে টুনির মা। শীর্ণ শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
“অথেই কি আর শ্যাষ হল গুঅ? বিটি মরার খপরে টুনির বাপের আবার ইস্টোক হল। আর উঠল না গো বুইদি। বিছনাতেই পঢ়্যাঁ। টুনির বিটিকে আমার কাছকে লি’থুইছি। উ দাদুকে আগলিন বোস্ থাকিয়ে আখুন। ঘরে একজুনা রুগি, আরেকজুনা কচি। অইলেগ্যা বিকেলকে কাজে আাসার আর জো নাই খুও।”
ঋষির গালে ঠাস ঠাস করে চড় কষিয়েছি আজ। পাটিগণিতের চারটে চ্যাপ্টার থেকে প্রশ্ন দিয়ে মডেল সেট তৈরি করে দিয়েছিলাম। পাঁচখানা অঙ্ক ভুল। টেস্ট পেরিয়ে হাতে আর মোটে দু’টো মাস। অতবড় ছেলের গায়ে হাত তোলাটা ঠিক হল না। পরে নিজেকে দুষলাম। মেজাজ হারাচ্ছি একটুতেই আজকাল। সন্ধেবেলায় একগাদা সব্জি কুটনো নিয়ে বসি। বাটনাও আছে সাথে। মিক্সিতে বাটা পোস্ত দাঁতে ঠেকে। চুলের তেলটা বাথরুমের ছোট ওয়াল-মাউন্টিং তাকে ঝুল খাচ্ছে। নিজের হাতে ওসব আর খাটুনিতে পোষায় না।
টুনির মায়ের বেতন থেকে কাটা-বাটা আর তেল মালিশ বাবদ আড়াই শো প্লাস একশো ষাট মিলিয়ে চারশো দশ কমিয়ে আগের মাইনে আটশোর সাথে নাতনিটার নাম করে পঞ্চাশটা টাকা ধরে সাড়ে আটশো টাকা দিই মাসপয়লায়।
টুনির বাপটা উঠে দাঁড়ায় নি । কাজ সেরেই হুটোপাটি করে দৌড় লাগায় টুনির মা। বলে, “টুনির বিটি ছটফট্যা হইচে যি খুবই। লুক করি একডণ্ড বসথাখিয়ে না খুও বুইদি।”
আমিও বিভিন্নরকমের চিন্তা করছি। নতুন লোক রাখব কি না। বিকেলের কাজ, সাথে চুলে তেল মালিশের কথাটথা একসাথেই হিসেব করে নেব তার সাথে। তাকে তো আর টুনির মায়ের মাইনে দিলে চলবে না। নতুন লোক মানে নতুন বেতন কাঠামো। ঋষিকে টেস্টের পরে একটা স্পেশাল কোচিংয়ে দেওয়া হয়েছে। কেবলমাত্র চারটে বিষয়ের মক টেস্ট নিচ্ছে সেখানে। খরচে এটা বাড়তি যোগ হয়েছে। তাছাড়া নতুন আনকোরা লোক মানেই তাকে আবার সবটা নতুন করে বোঝাও রে। কোথায় ঘর মোছার ন্যাতা রাখবে, কোথায় ঝ্যাঁটা নামাবে না, কোন সাবানটা কোন পারপাসে, জানলার ধারিগুলো সপ্তাহে ক’দিন মুছবে, বালতির জল কোন নালিতে ফেলবে…এইসব মিলিয়ে লম্বা ফর্দ। তাই দু’পা এগিয়েও চার পা পিছোচ্ছি  বারবার। তবু সিদ্ধান্ত তো একটা নিতেই হবে।
আজ টুনির মা ঢুকেই আমার হাতে একটা স্টিলের টিফিনকৌটো ধরাল। প্রশ্নবোধক চোখে তাকালাম। টুনির মা একটু একটু করে বিষাদ ঝেড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। চা বিক্রি করবে বলে টিনের ঝাঁপটা তুলছে বিকেলের দিকে। শুধু চা-বিস্কুট নয়, ডিমটোস্ট বানানোরও প্ল্যান আছে। টুনির বাপের কাছে কতলোক ধারে চা-বিস্কুট খেয়েছিল। তারা আর দোকানমুখো হয়নি। টুনির মা একদিন কথায় কথায় বলেছে, “আর কেউরিখ্যেও ধারে খ’ব না গো বুইদি। লগদ দাও, খাও।”
ঠিকই ভেবেছে টুনির মা। ধারবাকি বড় ঘিনঘিনে ব্যাপার। হিসেবনিকেশ পরিস্কার রাখাই তো ভাল।
আমার হাতে কৌটোটা দিয়ে বলল, “ভাই আলছেল বাবার ঘর থেখ্যে। খাজুরের গুড় আছিয়ে খানিক এথ্যে। আমাদের গাঁয়ের গুড়। খেয়্যাঁ পরে বুলোঅ। বাচিন লি’আলছি। তুমি ভালো গুড় পাও না পাও না কর। ছোটবাবুও খাজুরের গুড়ের পায়েস  ভালবাসে তো। ঘরে থাকল্যে পরে টুনির বিটি একাই সাবড়ে দিথ সবটুঁই।”
কৌটো খুলে নাকে ধরেছি। এ গন্ধই আলাদা। আমার চিরচেনা। এ গন্ধটা বুক ভরে নেব বলেই মাথায় ঝাঁকা নিয়ে আসা গুড়ওয়ালাদের কাছে যেচেপড়ে বহুবার ঠকেছি। সাবানের গন্ধ আর চিনির ডেলা ছাড়া কিছু জোটেনি কপালে। এ গন্ধে আমার শৈশব, মুর্শিদাবাদ লাগোয়া বীরভূমের একফালি জমিতে আমার বাবার বাড়ির ছায়া। ছায়ার মাদুরখানা গুটিয়ে  নিয়ে বাবা-মা তো সরে গিয়েছে সেই কবেই। দাদা-বউদির আতিথেয়তায় কি আর সেই ছায়ামেদুরতা থাকে?
কো-অপ স্টোরে আমদানি করা খেজুরের গুড়ের পাটালি রাখে। তবে র্যাকে সাজাতে না সাজাতেই সেগুলো  উধাও হয়ে যায় খদ্দেরের চাহিদার চোটে।
ঢাকনা বন্ধ করে ফ্রিজে ভরে রাখলাম গুড়টা। ঋষি গুড়ের পায়েস ভালো খায়। মনোজিতের দুধপুলি পছন্দ। খানিকটা পায়েস করব আজ দুপুরের দিকে। মনোজিতের জন্য দুধপুলি না-হয় আরেকদিন বানানো যাবে। গুড় তো রইলই।
টুনির মা সিঙ্কের কাছে চলে গিয়েছে। বক্স জানালায় রোদ খেতে ফেলে রাখা ব্ল্যাঙ্কেটটা উল্টেপাল্টে দিতে গেলাম। বহুদিন খেজুরের গুড় নিজে আর কিনি না। পাড়ার মুদিখানাটা থেকে মনোজিত এনেছিল খুব সামান্য পরিমাণে, তাও বেশ অনেকদিন হল। কেজি প্রতি কত দরে কিনেছিল মনোজিত? ঝোলা আর পাটালির দাম এক নয়। টিফিনকৌটোটায় কতটা গুড় ধরেছে? পাঁচশ? না কি তারও বেশি? কমও হতে পারে। টুনির মা কি মেপে দিয়েছে গুড়টা? ও আজকাল আর ধারবাকিতে কারবার করে না। আমিও ধারে খাব না। কত দাম হতে পারে কৌটোবন্দি গুড়টার?
ঐকিক নিয়মে সাজাব। চারটে তথ্যের মধ্যে একটা অমিল থাকার কথা। অথচ, আমার যে চারটে ঘরই ফাঁকা। মাথা ঝিমঝিম করছে। হাতের তালু ঘামছে। ব্ল্যাঙ্কেট শুষে নিচ্ছে ঘাম। বুকে চাপ। বেশ চাপ। ঘন্টা পড়ল নাকি? শেফালিদি এগিয়ে আসছেন। খাতাটা প্রাণপণে বুকে চেপে ধরেছি। বাসনপত্রের  সাথে টুনির মায়ের খাঁজে খাঁজে  ময়লা জমে কালচে হয়ে যাওয়া প্লাস্টিকের শাঁখা আর ঘষা দাগ ধরা রঙচটা সরু পলাগুলোর নির্বিকার ঠোকাঠুকির আওয়াজটুকু আসছে শুধু কানে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত