হিথ্রো এয়ারপোর্টে বসে আছি। দুপুর দুইটা বাজে।
আমার পাশে বসে থাকা ভদ্রমহিলাটি আমার অপরিচিত। তিনিও বাঙালি। আমরা দুইজন একই ফ্লাইটে হিথ্রো থেকে ঢাকা যাবো। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের আলাপ করা শুরু হয়েছে। তিনিই আগ্রহ করে আলাপ শুরু করেছেন।
:তুমি কি লন্ডনে একাই থাকো? ভদ্রমহিলা আমাকে প্রশ্ন করে।
:জি আন্টি।
:তোমার কোন আত্মীয়স্বজন নাই এই দেশে?
:জি না।
:এই বয়সে বিদেশে এমন একলা থাকা কি ঠিক? অবশ্য, এই দেশে আইন কানুন ভালো আছে। অনেক বয়স পর্যন্ত মেয়েরা একলাই থাকে দেখি।
আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসি লুকাই। আপাদমস্তক কালো বোরখায় শরীর ঢাকা আন্টির আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণটি আমি বুঝতে পারছি। তিনি আসলে জানতে চাইছেন আমি বিয়ে করেছি কিনা।
:হুম। আন্টি আমিও একলাই থাকি। কোনো অসুবিধা হয় না।
:কাজ করো?
:লেখাপড়া করি। সাথে পার্ট টাইম একটা কাজও করি।
:তোমার আব্বা আম্মার তো মনে অনেক টেনশন থাকে নিশ্চয়ই তোমাকে নিয়ে। যুবতী মেয়ে, বিদেশের দেশে একলা একলা থাকা কি সহজ কথা নাকি?
:জি খালাম্মা। টেনশন তো করেই। কিন্তু ক্যারিয়ারের জন্য এইটুকু কষ্ট করতে হচ্ছে এখন। কি আর করা!
এয়ারপোর্টে একজন বাঙালি ভদ্রমহিলাকে পেয়ে গিয়ে যতটা খুশি হয়েছিলাম, এখন ততটাই বিরক্তি লাগছে। ভীষণ ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলা শুরু করেছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর হয়তো জিজ্ঞেস করবেন আমার বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি? আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলাও অসম্ভব কিছু না। আমি আবার দেখতে সুন্দর কিনা। সুন্দরী মেয়েদের জন্য যেখানে সেখানে পাত্র পাওয়া যায়। বাসে, ট্রেনে, পার্কে, শপিং কমপ্লেক্সে, এয়ারপোর্টে, খালুর ছেলের মোছলমানি কিংবা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে।
আমি ভদ্রমহিলাকে এড়ানোর জন্য কেবিন লাগেজ খুলে একটা বই বের করে পড়ার ভান করি। পরবর্তী কয়েক মিনিটে বই থেকে একবারও চোখ তুলে না তাকানোয় ভদ্রমহিলা আমার দিকে পেছন ফিরে অন্যপাশে আরেকজনের সাথে গল্পে মেতেছে। আমি মনে মনে খুশি হই। যাক, আমি আরেকটি পাত্র পক্ষের সামনে ইন্টারভিউ দেয়া থেকে বাঁচলাম।
আমি ঢাকায় যাচ্ছি দুই বছর পর। মনে হচ্ছে যেন দুই যুগ। দেশে যাবার সিদ্ধান্তটি অনেক আগে থেকে নেয়া ছিল না। বছরের শুরুতে ভেবেছিলাম, এই ছুটিটা ঘরে বসে ক্লাসের পড়া আর গল্পের বই পড়েই কাটিয়ে দেব। অনলাইনে কে এল স্যাটারের দ্যা এভিডেন্স নামের একটি ক্রাইম ফিকশনও কিনে রেখেছিলাম। এই বইয়ে একজন ছোটখাটো সাধারণ দেখতে মহিলা তার স্বামীকে খুন করেছে। থ্রিলারটি গুড রিডার্স রিভিউতে ৫ এ ৪.১ স্কোর পেয়েছে। টানটান উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনী হবার কথা। তাই আমি বইটি হাতে পেলেও এখনো পড়া শুরু করিনি। এমন সময়ে শুরু করবো যখন পুরোটা কাহিনী একটানা পড়তে পারবো।
এই সামার হলিডেতে আমার প্ল্যান–এ ছিল যে কলেজ বন্ধ হবার পর আয়েস করে প্যাটিওতে পাটি বিছিয়ে সাইকোলজিক্যাল রহস্য উপন্যাসটি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবো। মার্ডার থ্রিলার আমার বরাবরই খুব পছন্দের। প্ল্যান–বি ছিল কভেন্ট্রিতে আমার বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যাবো দুই সপ্তাহের জন্য। ওর হাসব্যান্ড আছে ওর সাথে। সেও আমার বন্ধু। তাই তিন বন্ধুতে মিলে খুব বেড়াবো আর আনন্দ করবো। কিন্তু ছয় সপ্তাহের লম্বা সামার ছুটি শুরুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে আমি ঠিক করলাম, এবার দেশে যাবো। যেভাবেই হোক, আমাকে দেশে যেতেই হবে। পরীক্ষার চাপে আর টিকিটের পয়সা জমাতে না পারায় গত দুই বছর দেশে যাইনি। কথাটা মনে হতেই দেশের সবার জন্য মনটা কেমন করে কেঁদে উঠেছিল আমার।
ইংল্যান্ড সরকারের তালিকায় বাংলাদেশ এখনো রেড লিস্টেড আছে। আমাদের ওদিকটায়, মানে বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, নেপাল, ভুটান, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এখন করোনার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট খুব ছড়িয়েছে। অবস্থা ভয়াবহ। কিন্তু আমার মনের অবস্থাও ভয়াবহ। আব্বা আর আম্মাকে দেখার জন্য মন ছুটে গেছে। করোনার ভয় ছাড়াও আরেকটা বিষয় খুব চিন্তায় ফেলেছিলো প্রথমে। সেটি হলো ছুটি শেষে আবার ইউকেতে প্রবেশ করার খরচটা কোথায় পাবো। বাংলাদেশ থেকে ইউকেতে ঢুকতে হলে সবাইকে ১০ দিন হোটেলে কোয়ারেন্টাইন করতে হচ্ছে এখন। হোটেল যাপন শেষ করে তবেই তারা জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আসামির মতো ফিরে যেতে পারবে নিজের গৃহে। হোটেলে থাকার খরচাও প্রায় দুই লক্ষ টাকা। তবুও আমি সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। টাকা যোগাবে উপরওয়ালা। আমার ছুটে যাওয়া মন নিয়ে আমি বিমানের টিকেট এজেন্সি থেকে একটা টিকেট বুক করে ছুটি শুরুর দ্বিতীয় দিনেই প্লেনে উঠে বসেছি। বিমানের ডাইরেক্ট ফ্লাইটটি আমাকে ১১ ঘন্টা পর নিজের দেশের রানওয়েতে নামিয়ে দেবে, ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠলো।
এয়ারপোর্টে লাগেজের জন্য বেল্টের কাছে অপেক্ষা করছিলাম যখন, তখন আবার আন্টির মুখোমুখি পড়ে গেলাম। লক্ষ্য করলাম, উনার সাথে দুইটি মেয়েও আছে। বড় মেয়েটিকে দেখতে অতিরিক্ত ক্লান্ত মনে হচ্ছে। লম্বা জার্নির ফল। ছোট মেয়েটি মারাত্মক চঞ্চল। হাতে একটা পুতুল নিয়ে চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছে। আর আন্টি তাকে ডেকে ডেকে বকে যাচ্ছেন
:দু`জন কি আপনার মেয়ে?
:হুম। আমার এই দুইটাই মেয়ে। ছোটটার বয়স ৮ বছর। আর বড় জন ১৪ হয়েছে গত মাসে। হাইস্কুলে পড়ে। বয়সের তুলনায় বেশি লম্বা হয়ে গেছে। সবাই ওকে আরো বড় মনে করে।
আমার মুখে চলে এসেছিলো, তাহলে তো মেয়ের জন্য পাত্র দেখতে হয় এবার। মুরুব্বি মানুষের সাথে বেয়াদবি হয়ে যায় ভেবে ও কথা বললাম না।
:তোমাকে নিতে কেউ আসবে তো এয়ারপোর্টে? নাকি তুমি ঢাকাতেও একা?
:জি না। এখানে আমি একা না। আমার আব্বা আসবেন আমাকে নিয়ে যেতে।
:তোমার আম্মা নাই?
:আম্মা বাড়িতে আছেন। আমার জন্য রান্না বান্না করছে মনে হয়। দুই বছর পর মেয়েকে কাছে পেয়েছে, কতো কিছু করতে ইচ্ছা করবে আমার মায়ের।
এয়ারপোর্টে নিজের টিকার দুই ডোজের কাগজ আর আসার আগে করা কোভিড টেস্টের নেগেটিভ রেজাল্ট এর কাগজ পত্র দেখিয়ে খুশিতে লাফাতে লাফাতে বাইরে এসে আমার আব্বার সাথে ট্যাক্সিতে করে রওনা দিলাম মালিবাগের দিকে। দুই বছরে মনে হচ্ছে সবকিছু অনেক বদলে গেছে। আরো অনেক অনেক বিল্ডিং গজিয়েছে চারপাশে। ধুলা আর ধুলা। বড় রাস্তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা গাছগুলোতে বিষন্ন মুখ ভার করে আছে কয়েকটি করে ধুলোয় চোবানো লম্বা পাতা। আব্বার সাথে গল্প করতে করতে একসময় গাড়িতে চোখ বন্ধ হয়ে এলো আমার। চোখ বন্ধ করার আগে মনে হলো, আব্বা সিরাজগঞ্জের কথা বলছেন। আমাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবার কথা বলছেন। আমি আব্বার কথার উত্তরে মাথা নাড়তে পারলেও মুখে কিছু বলার আগেই ঘুমের দেশে পৌঁছে গিয়েছিলাম।
আম্মা আমার ছোট্ট ঘরটি সেই আগের মতোই সাজিয়ে রেখেছে। চৌধুরী পাড়ার এই এলাকাতে হট্টগোল কম। আমি অনেকদিন পর আমার প্রিয় ছোট্ট বারান্দাতে দাঁড়িয়ে চারপাশের ঘর বাড়ি দেখি। রাস্তায় একটি দুটি পরিচিত মুখ খুঁজি। মিনিট বিশের মতো অপেক্ষা করেও তেমন কাউকে দেখলাম না। রাতে খাবার টেবিলে জানলাম, একদিন পর আমরা সিরাজগঞ্জ যাবো। সেখানে তিনদিন থাকার পরিকল্পনা করেছেন আব্বা। বেশ ভালো লাগছে আমার সিরাজগঞ্জে যাবার কথা শুনে। আমার বাল্যকালের কয়েকজন বান্ধবী আছে ওখানে। ওদের সাথে দেখা হলে সবসময়ই আমার খুব ভালো লাগে। তাদের ভেতর দুইজনের বিয়ে হয়েছে একই গ্রামের ছেলের সাথে। বাচ্চা কাচ্চাও আছে এখন। অথচ আমি এখনো বিয়ে করিনি। লেখাপড়াটা শেষ না করে বিয়ে করতে পারবো না, আমার আব্বার কড়া নিষেধ আছে এব্যাপারে।
দুই
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট বেড়ে যাওয়ায় কড়া লক ডাউন দিয়েছে সরকার। দূর পাল্লার যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধ। আব্বা একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করেছেন আমাদের জন্য। অন্যান্য গাড়ি কম থাকায় আমরা আড়াই ঘন্টার ভেতর যমুনা সেতু পার হয়ে সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করলাম। মাইক্রোবাসের জানালা খুলে দিয়ে গ্রামের বিশুদ্ধ হওয়া অবাধে খেলে যেতে দেই আমার শ্যাম্পু করা সিল্কি চুলে। সেই ছোটবেলা থেকে আমরা বছরে অন্তত একবার সিরাজগঞ্জে আমার দাদা বাড়িতে বেড়াতে আসতাম। আমার বয়স এখন চব্বিশ হয়ে যাবার পরেও, যতবার আমি এইখানে আসি, ঠিক একই রকম একটা গন্ধ পাই নাকে। সন্ধ্যায় ক্ষেতের নাড়ায় আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহানোর গন্ধের সাথে আমার শৈশব সুর করে ছড়া কেটে যায় আমার মনে। নিজেকে আমার আজকেও মনে হচ্ছে আমি এখনো যেন সেই ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটি আছি।
আমার দাদা বাড়িতে পাকা একতলা বিল্ডিং। অনেকগুলো ঘর আছে বাড়িতে। বাবার একমাত্র বড় ভাই, অর্থ্যাৎ আমার জেঠাজি এখন থাকেন এই বাড়িতে। আমরা আসছি বলে আমাদের জন্য দুইটা রুম আগে থেকেই ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে। এক রুমে থাকবেন আমার আব্বা আর আম্মা। আরেক রুমে আমি একা। আমার কোন ভাইবোন নেই। তাই আমাকে কারো সাথে রুম শেয়ার করতে হবে না। শেয়ারিং না করেই বড় হওয়ার কারণে আমার ভেতর কিছুটা স্বার্থপরতা জন্মে গিয়েছে সেই ছোটকাল থেকেই। কখনো কখনো সেটা নির্লজ্জ ঠেকে অন্যের চোখে।
আমার জেঠি আম্মা আমাকে দেখে খুবই খুশি হয়েছেন, আমি তার চোখ দেখে বুঝতে পারি। বিকেলে পাকা উঠানে বসে জেঠি আম্মা আমার চুল আঁচড়িয়ে দিলেন। আমার কাছে বিলেতের গল্প শুনতে চান তিনি।
:স্বর্ণা, তোমাদের ওখানে কি আমাদের মতো মানুষ দেখা যায়?
:মানুষ তো সব দেখতে একই রকম জেঠি আম্মা। সব মানুষেরই দুইটা করে হাত, দুইটা পা, একটা মাথা। আলাদা আবার কী? আমি জেঠি আম্মার সাথে দুষ্টামি করে তার কথা না বোঝার ভান করি।
:না মানে বলতিছিলাম, তোমাগোর ওখানে তো সব সাদা মানুষ। ফরেনার। রাস্তা ঘাটে আমাদের মতো কালো মানুষ দেখা যায় কী দুই একখান?
:যায় জেঠি আম্মা। আমি যেমন পড়তে গিয়েছি, তেমন আরো অনেক দেশের অনেক মানুষ আছে ওই দেশে। একেক জনের গায়ের রং একেক রকম। চুল, চোখ, মুখ, মুখের ভাষা সব আলাদা আলাদা।
:সাদা মানুষেরা কালো মানুষগোর সাথে ভালো ব্যবহার করে?
আমার কাজের ইংলিশ কলিগ এমান্ডার কথা মনে পড়লো। ব্রেক টাইমে এশিয়ান কেউ টয়লেটে গেলে সে স্টাফ টয়লেট ব্যবহার করে না। এশিয়ান কেউ যে চেয়ারে বসেছে, সেই চেয়ারে সে কখনোই বসবে না। যদিও এমান্ডা মুখে আমাদের সাথে খুব মিষ্টি করে কথা বলে, কিন্তু যারা অনেকদিন ধরে তাকে চেনে, তারা সবাই জানে সে একটা রেসিস্ট। বর্ণবাদী মহিলা। আমার কাজের ইংলিশ ম্যানেজার লোকটিও ভীষণ পক্ষপাতমূলক আচরণ করে আমাদের মতো নন–ব্রিটিশ এমপ্লয়িদের সাথে। আমার সরল সোজা জেঠি আম্মাকে এসব কথা কিছুই বললাম না। শুধু বললাম, ভালো ব্যবহারই করে। সাদাদের মন তাদের চামড়ার মতোই সাদা।
খুব তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো আমার জেঠি আম্মার দুই চোখে। দেখে খুব ভালো লাগে আমার। আমার কথায় তিনি নিশ্চিত হলেন যে দূরের দেশে একা একা থাকলেও আমি ভালোই আছি। সবার আদরে আছি। ইচ্ছে আছে, বিলেতে আমার লেখাপড়া শেষ হলে, আমি যদি ব্যারিস্টার হতে পারি কোনদিন, জেঠি আম্মাকে একবার লন্ডন শহর দেখতে নিয়ে যাবো। লন্ডন আইয়ের আয়না ঘেরা বাক্সে বসিয়ে উনাকে উপর থেকে পুরো লন্ডন শহরটাকে দেখাবো। সাদা ফকফকা চামড়ার ইংলিশদের সাথে এক রেস্টুরেন্টে বসে খাবার সময় তার মুখটি কেমন হয়, আমার খুব দেখার ইচ্ছা।
রাতে জেঠি আম্মার রান্না করা মজার মাছের তরকারি ও নরম ভাত খেয়ে বিছানায় যাবার কিছুক্ষণের ভেতর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। স্বপ্নহীন গভীর প্রশান্তির ঘুম। কিন্তু পরদিন সকাল হতেই, সিরাজগঞ্জে আমার শান্তিপূর্ণ বেড়ানোটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলো। ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণের ভেতরেই আমাকে ছুটে যেতে হয়েছিল একটি রোমহর্ষক দুর্ঘটনাস্থলে। সেই গল্প বলছি এবার।
তিন
বড় বাজারে সকালের হাট আজ অন্ধকার থাকতেই অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি থমথমে। টাটকা শাকসবজি ও তরতাজা হাঁস মুরগির ক্রেতা–বিক্রেতা সবাই কেমন একটা আতঙ্কিত মুখে কেনাবেচা সারছে। কথা বলছে মাথা নিচু করে, যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে। উত্তরাঞ্চলের মানুষের মুখের কথা এমনিতেই মিঠা। আজ সকালে মিঠা মুখের এই মানুষেরা কেমন ভয়ে জুবুথুবু হয়ে আছেন সবখানে। ঘুম ভেঙে আমি খাটে শুয়ে শুয়ে জেঠি আম্মার কথা ভাবছিলাম। আমার মায়ের চেয়ে তিনি বয়সে বড়। আমার আর কোন ভাইবোন নেই বলে নিজের ছেলেমেয়েদের সামনে তাদের চেয়েও আমাকে বেশি স্নেহ দেখান সব সময়। বাইরে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আমি বালিশের নিচ্ থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখলাম, সকাল ১০টা বেজে গেছে। আমাকে কেউ ডাকে নাই কেন? গ্রামদেশে সকাল দশটা মানে তো বেশ সকাল। ঢাকা থেকে আত্মীয় এসেছে, এই বাড়িতে অনেক মানুষের আজ আনাগোনা হবে। দূর দূর থেকে অনেক মানুষ আসবে একবার দেখা করতে। কিন্তু আমি কারো কথার আওয়াজ পাচ্ছি না। মনে হলো, আমাকে ঘুমে রেখে সবাই হয়তো কোথাও বেড়াতে চলে গেছে।
দরজা খুলে রান্নাঘরের দিকে আগাই। অচেনা তিনজন মহিলা সহ আমার আম্মা ও জেঠি পাঁচ মাথা এক করে কথা বলছে। মনে হচ্ছে যেন তারা খুব গোপন কোন বিষয়ে কথা বলছে। সতর্ক একটা অভিব্যক্তি তাদের আচরণে। আমাকে দেখে আম্মা জিজ্ঞেস করলো, ঘুম কেমন হয়েছে?
:খুব ভালো। এক ঘুমে রাত কাবার।
:রাতে পেঁচার ডাক শোনেন নাই? গ্রামের মহিলাদের একজন বলে?
:পেঁচা? কি নাতো! হয়তো ডেকেছে। আমি বুঝতে পারি নাই।
এরপর রান্নাঘরের এক কোনে চেয়ারে বসে শুনলাম, গতকাল রাতে এখানে একটি ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেছে। গ্রামের একদিকে প্রকান্ড একটি মাঠের শেষে বড় একটি নদী আছে। এই নদীর পাশে জংলা মতো জায়গার ভেতর কে বা করা যেন মানুষ খুন করে বস্তায় ভরে ফেলে রেখে গিয়েছে। অল্প বয়সী একটি মেয়ের লাশ। সকালের আলো ফোটার পর গ্রামের কয়েকটি ছেলে পাতা কুড়োতে গিয়ে জংলার ভেতর থেকে টেনে বের করে আনে বস্তাটি। প্রথমে তারা ভেবেছিলো বস্তার ভেতর কেউ হয়তো গুপ্ত ধন লুকিয়ে রেখে গেছে এখানে। বস্তার মুখ খুলেই ছেলের দল ভয়ে দৌড়ে কাঁচা সড়কের উপর উঠে এসে চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে। তারপর সবাই মিলে জঙ্গলের শেষে চটের বস্তাটি টেনে বের করে আনে। ঘন্টা দুই তারা কেবল নিজেদের ভেতর ফিসফিস করেছে। লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছে সাধারণ সময়ের নিশ্চুপ জঙ্গলের শেষে নদীর কিনারা। গ্রামের মোটামোটি সব বাড়ির কেউ না কেউ গিয়েছে ঘটনাস্থলে একবার হলেও উঁকি দিয়ে দেখতে। এই বাড়ির কাজের মহিলা সিদ্দিকাও গিয়েছিলো সেখানে।
:আপা, আমি দূর থেকে দেখেছি। একটা বস্তা মাটিতে লম্বা করে শুইয়ে রেখেছে। বস্তার মুখ খোলা। ফর্সা মতো একটা মানুষের মুখ।
: কে খুন হয়েছে? আপনি চেনেন তাকে?
:আমি চিনতে পারি নাই। অনেক দূর থেকে দেখেছি তো। সবাই বলাবলি করছে, মেম্বার বাড়ির অতিথি খুন হয়েছে।
কোথাও অপরাধ ঘটলে আমি নিজের ভেতর কেমন একটা তৎপরতা টের পাই। আমার অস্থির লাগতে থাকে। আমার মনে হয়, আমি নিজে বিষয়টি ভালো করে তদন্ত করে দেখি। টিভিতে ক্রাইম থ্রিলার দেখার সময় ঘটনার অর্ধেকেই আমি বলে দিতে পারি, আসল অপরাধী কে। প্রায় ৯০ভাগ ক্ষেত্রেই আমার অনুমান সঠিক হয়। অবশ্য আমি লজিক দিয়ে অপরাধী কে হতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করে থাকি। আব্বার কাছে গিয়ে আবদার করলাম আমি একবার জঙ্গলের ওদিকটায় যেতে চাই। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র পনেরো মিনিটের রাস্তা। আব্বা নিজেও হয়তো যেতে চাচ্ছিলেন। তাই ঝটপট দুজনে তৈরী হয়ে পৌঁছে গেলাম বিশেষ সেই নদীর পাড়ের জঙ্গলের কাছে। কুস্থলে পৌঁছে দেখি সেখানে থানা থেকে ওসি এসেছে। সাথে বেশ কয়েকজন পোশাক পরিহিত পুলিশ। এখন কাউকে লাশের কাছাকাছি হতে দিচ্ছে না। কিন্তু গ্রামের মানুষজন খুব নাছোড়বান্দা। কয়েকজনকে দেখলাম উঁচু গাছের মগডালে উঠে বসে আছে। শুনলাম তারা সেই ভোরবেলা থেকে গাছে উঠে বসে আছে।
আমাদেরকে দেখে ওসি সাহেব কথা বলতে এগিয়ে এলেন। দেখলাম তিনি আমার আব্বাকে পরিচিত।
:শরীফ সাহেব। কবে এলেন সিরাজগঞ্জ?
:এইতো। গতকাল। আমার মেয়ে এসেছে লন্ডন থেকে। তাই ভাবলাম ওকে একটু বেরিয়ে নিয়ে যাই নিজেদের গ্রাম থেকে।
:খুব ভালো করেছেন। থাকবেন কিছুদিন?
:তিনদিন থাকার প্ল্যান করে এসেছি। এখানে তো শুনছি অবস্থা ভয়ানক।
:এ আর নতুন কি? এইসব নিয়েই আমাদের জীবন জীবিকা।
:আমার মেয়েটা লন্ডনে আইন নিয়ে পড়ছে। ওর আবার এসব ব্যাপারে একটু বেশি আগ্রহ। ওর আগ্রহেই ছুটে আসলাম এখন এখানে।
বাবা ওসি সাহেবের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, একটু কাছে গিয়ে দেখা যাবে লাশটিকে?
ওসি সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশদের দিকে তাকালেন একবার। আমাদেরকে বললেন, ঠিক আছে আপনারা আসুন আমার সাথে। জলদি করতে হবে কিন্তু। একদম শেষ সময়ে এসেছেন। এক্ষুণি আমরা লাশটি ভ্যানে তুলতে যাচ্ছিলাম। হাসপাতালে নিতে হবে ময়নাতদন্ত করতে।
নদীর পাড়ের মাটি ভেজা। তার উপর সকাল থেকে এতো মানুষের পায়ের চাপে মাটি আরো দেবে গেছে যেন। শুকনো পাতা, ময়লা কাগজ আর ধুলোর উপর পড়ে আছে বস্তাটি। বস্তার মুখ খোলা। শুধু মুখটি বের হয়ে আছে। শরীর এখনো বস্তার ভেতরে। মেয়েটি কিশোরী বয়সী। লম্বা শরীর বোঝা যাচ্ছে বস্তার উপর থেকে। মুখের ডান দিকে গালের উঁচু হারের কাছে ইঞ্চি খানেক জায়গা থেবড়ানো দেখা যাচ্ছে। কালশিটে দাগ পড়ে গিয়েছে। ভারী কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন। ঠোঁটের উপর জমে আছে কয়েকটি বুদ্বুদ, রক্তের বুদ্বুদ। আমি মেয়েটির মুখের কাছে বসে ঝুকে তাকালাম। ছড়িয়ে পড়া চুলের ভেতর থেকে মনে হচ্ছে গলার কাছে স্যাঁতসেঁতে রক্ত জমে আছে। আমি ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে মনে হচ্ছে।
তিনি বললেন, জি।
:রেইপ কেইস?
:এখন বলা যাচ্ছে না। ময়নাতদন্তের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
:খুন কি এখানে করা হয়েছে?
:মনে হয় না। এখানে কোন ধস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এমনকি বস্তা টেনে আনার দাগও নেই কোথাও মাটিতে। সম্ভবত খুন করার পর বস্তায় ভরে ভ্যানে করে বা মানুষের ঘাড়ে করে এনে এখানে ফেলে গেছে রাতের অন্ধকারে।
কেন যেন আমার মনে হচ্ছে, মৃত মেয়েটির আমার চেনা। আগে দেখেছি কোথাও। কিন্তু কিভাবে চেনা সেটা মনে করতে না পারলেও ছয় সাত বছরের আরেকটি মেয়ের মুখ ভেসে উঠলো মনের পর্দায়। ছয় কি সাত বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে? আমি আবার তাকালাম বস্তার বাইরে বেরিয়ে থাকা কিশোরী মেয়েটির লাশের দিকে। এবার বস্তার বাইরে বেরিয়ে থাকা ফ্যাকাশে মুখটি দেখে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে বরফের ঠান্ডা জল গড়িয়ে নামতে থাকে যেন। আমি চোখের সামনে দেখতে পেলাম, ছোট্ট মেয়েটি ছুটে ছুটে খেলে বেড়াচ্ছে এয়ারপোর্টের লাগেজ বেল্টের চারপাশে। ইংরেজিতে রাইম্স বলছে, মিস পলি হেড এ ডলি হু ওয়াস সিক সিক সিক….আর তার মা বারবার ডেকে যাচ্ছে, সেরিনা, ক্যান ইউ স্টপ নাউ। কাম হিয়ার প্লিজ। তারপর তাদের মা বড় মেয়েটিকে ধমকের স্বরে বলছেন, মেরিনা, ক্যান ইউ আস্ক ইউর সিস্টার টু স্টে উইথ ইউ, জাস্ট নাউ? গভীর চোখের মেয়েটি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে। যেন মায়ের কথা সে শুনতেই পায়নি।
আমি বললাম, ওর নাম মেরিনা।
ওসি অবাক হয়ে বললেন, আপনি চিনতেন?
আমি নিজের কপালে হাত রেখে মাটিতে বসে পড়ি। আমি যেন আকাশ পাতাল কীসব ভাবতে বসে গেলাম। অবশ্য বেশি ভাবার সময় পেলাম না। কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে এসেছে ডেডবডি ভ্যানে তুলতে। আমি আব্বার সাথে বাড়ি ফিরে আসলাম। আমরা যে একই প্লেনে করে লন্ডন থেকে এসেছি, সে কথা আব্বাকে জানালাম। খেতে বসে এইবেলা জেঠি আম্মার রান্না করা সপ্তব্যঞ্জন মুখে উঠলো না আর আমার। আমি কেমন যেন ভীষণ দুঃখ অনুভব করতে থাকি। ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটিকে কে বা করা এমন নির্মমভাবে খুন করতে পারে? ও তো এখানে থাকেও না। হয়তো বছরে একবার করে আসে। তবুও কার এতো জরুরি হয়ে পড়েছিল ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে? সারাদিন আমার মাথায় শুধু এই চিন্তা চলতে থাকলো।
চার
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখবো। মেম্বারের বাড়িতে খুন হয়েছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টিকে নিয়ে বাইরে বেশি আলাপ আলোচনা হওয়াটা পছন্দ করছে না। আমি গ্রামের বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে দেখেছি, তারা কেউই ঘটনার পর মেম্বার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু আমাকে যেতে হবে বাড়ির ভেতর। আমার মন বলছে, ওখানে গেলে আমি কিছু না কিছু ক্লু পেয়েই যাবো। আমার আব্বার কথা ফেলতে পারলেন না থানার ওসি সাহেব। পুলিশ স্টেশনে সবার কাছে আমাকে স্টুডেন্ট ইনভেস্টিগেটর হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ছবিসহ একটি নকল আইডি কার্ডও বানিয়ে দিলেন। সেই পরিচয়ে আমি পরদিন দুপুরে ঢুকে গেলাম মেম্বার বাড়িতে। সদর দরজা থেকে মোটা মতন একটা লোক আমার সাথে লেগে থাকলো।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে বেশ একটা ধাক্কা খেলাম। ভেতরটা অনেকটা প্রাসাদের মতন, অনেক বড় উঠান, অনেকগুলো কামরাসহ একটা দোতলা বিল্ডিং, বাড়ির ভেতর বাঁধানো ঘাট, যত্ন করে সাজানো বাগানে ফুটে আছে নানা রঙের দেশি ফুল। আমার মনে হচ্ছে, যেন কোন রাজার বাড়ির একাংশ এটা। আমার কল্পনা বলে, দোতলায় হয়তো একটা জলসা ঘরও আছে। মোটা মতন লোকটা চুপ করে থাকে। আমি প্রশ্ন করলে তবেই সে কিছু বলে। যতখানি সম্ভব ছোট করে।
:মার্ডার কি এই বাড়িতে হয়েছিল?
:জি না।
:মেয়েটাকে আপনি আগে দেখেছেন?
:জি।
:ওরা কি প্রতি বছর আসতো এখানে লন্ডন থেকে?
:জি না। পাঁচ বছর পর এসেছে এবার।
:ওদের মা কোথায়?
:বাড়িতে কোথাও আছেন।
:ওদের বাবা কোথায় থাকেন? এই বাড়িতেই? তিনি কি বাড়িতে আছেন এখন?
:তিনি বেঁচে নেই।
:তিনি কত বছর আগে মারা গিয়েছেন?
:ঠিক বলতে পারবো না।
:তার কি স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল? নাকি তিনিও খুন হয়েছিলেন?
:বলতে পারি না।
:আচ্ছা, আপনি আমাকে ওর ঘরে নিয়ে চলুন। মেরিনা যে ঘরটাতে থাকতো সেই ঘরে।
লোকটি কথা না বলে হনহন করে অন্ধকারের দিকে একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। আমি আবার প্রশ্ন করি, দুই বোন কি এক ঘরে থাকতো নাকি আলাদা ঘরে?
লোকটি আমার কথার জবাব দিলো না। দোতলায় হাফ বারান্দার সাথে কোনার একটি রুমের দরজা দেখিয়ে বললো, তারা দুই বোন এই ঘরে থাকতো।
: ওদের মা কী পাশের ঘরে থাকেন? আমি প্রশ্ন করি।
লোকটি কথার উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি আর সময় নষ্ট না করে রুমের ভেতরে ঢুকে গেলাম। রুমটি আয়তনে বেশ বড়, খোলামেলা। বাইরের দিকে দুটি বড় জানালা। লোহার শিক গাঁথা। মনে হলো, এই লোহার শিক ভেঙে কারো পক্ষে বাইরে থেকে আসা সম্ভব নয়। তাহলে, খুন যদি এই ঘরে করা হয়ে থাকে, বাড়ির ভেতর থেকেই প্রবেশ করেছে আততায়ী।
খাটের উপর বিছানাটি টানটান করে গোছানো। মনে হচ্ছে এই বিছানায় কেউ শোয়নি কয়েকরাত। চকচকে মেঝে। আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, দেয়ালের ছবি, জানালার পর্দা, চোখে কোথাও কিছুর অসঙ্গতি চোখে পড়লো না। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী মেম্বার বাড়ির সবাই সাক্ষ্য দিয়েছে হত্যার আগের দিন বিকেলে বড় মেয়ে মেরিনা পারিবারিক বিশ্বস্ত কাজের মহিলার সাথে নদীর পাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলো। সন্ধ্যা হয়ে যাবার পরেও যখন ফিরে আসছিলো না, তখন লোক পাঠিয়ে চারপাশে অনেক খুঁজেও কোথাও পাওয়া যায়নি ওদেরকে। সকালবেলা গ্রামের লোকজন এসে মেম্বার সাহেবকে এই বাড়ির এক মেয়ের লাশ উদ্ধারের খবর দিয়ে যায়। মেম্বার সাহেব নিজে গিয়ে লাশ সনাক্ত করে এসেছেন।
আমার মনে খটকা লাগে, পুরোনো বিশ্বস্ত বুয়ার কি এতো সাহস হবে মালিকের আপন ভাইঝিকে খুন করে ফেলবে? খুনের মোটিভ কী? অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা? তাহলে নিশ্চয়ই খুন করে ফেলতো না। বাঁচিয়ে রেখে বড় অংকের টাকা দাবি করতো।
আমি বড় জানালাটির পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি। গলির মাথায় একটি মোটর সাইকেল ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে কয়েকটি ছেলে। এছাড়া আর তেমন বিশেষ কিছু চোখে পড়লো না। খাটের নিচে উঁকি দিয়ে খুঁজলাম। কি খুঁজছি জানি না। একটা কিছু। একটা ক্লু। টেবিলের উপর কয়েকটি বই খাতা। নেড়ে চেড়ে দেখলাম। খাতার ভেতরে বিভিন্ন রকম ছেড়া কাটাকুটি লেখা। কয়েক পাতার ছবি তুলে নিলাম আমার মোবাইলে। বাড়িতে বসে ঠান্ডা মাথায় দেখবো। কোথাও কিছু লেখা পাওয়া যায় কি না। ভগ্নমনে ঘর থেকে বেরিয়ে মোটা লোকটিকে আমি সরাসরি বললাম, উনি কোথায়?
:কে?
:মেয়েদের মা।
:তিনি বাড়িতে নাই।
:একটু আগেই তো বললেন বাড়িতে আছে। এখনই নাই বলছেন।
: এইমাত্র বাইরে গিয়েছেন।
:কোথায় গিয়েছেন এমন সময়ে? তার মেয়ে খুন হয়েছে, আর তিনি বাইরে গেছেন? বিশ্বাসযোগ্য কথা না।
লোকটা আমার কথা উত্তর না দিয়ে দ্রুত হেঁটে বাড়ির বাইরের দরজার কাছে চলে এলো। শান্ত কিন্তু প্রায় আদেশের সুরে বললো, আপনি এবার আসুন। লাগলে আবার আরেকদিন আসবেন। এই বাড়িতে এখন কারো মাথা ঠিক নাই।
:মেম্বার সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই। তাকে কোথায় পাবো?
:তিনিও বাড়িতে নাই। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পুলিশের কাছে পাবেন। তাদেরকে সব কথা বলা আছে।
বাড়ি ফিরে আসার পর থেকে আমার চোখে শুধু মেয়েদের ঘরটি ভাসতে থাকে। আমি কল্পনায় দুই বোনকে সেই ঘরের ভেতর ছুটে বেড়াতে দেখি, খিলখিল করে হাসতে শুনি, জোকস বলতে শুনি, খাটে শুয়ে গল্পের বই পড়তে দেখি। লন্ডন থেকে নিয়ে আসা দ্যা এভিডেন্স নামের ক্রাইম ফিকশনটির কথা মনে পড়লো। যদিও বই পড়ার মতো মনের অবস্থা নেই, আমি ভাবতে থাকি, না পড়া সেই থ্রিলারটিতে সাধারণ হাউজওয়াইফ কী কী কারণে তার স্বামীকে নৃশংসভাবে খুন করতে পারে? স্বামীর লাম্পট্য, মহিলার নিজের পরকীয়ার সম্পর্ক, সন্দেহ, স্বামীটি খুব অত্যাচারী ছিল– নাকি, কী? বইটা পড়লেই জানতে পারবো আমি সেই কারণ। কিন্তু এখানে এই সিরাজগঞ্জে, অল্পবয়সী মেয়েটিকে কে বা করা, কেন মেরে ফেলল, এই কথা জানার উপায় খুঁজে পাচ্ছি না কোনভাবেই। দুপুরে মেম্বার সাহেবের বাড়ি থেকে আসার সময় রিকশায় উঠে আমি বারবার বাড়িটির দিকে তাকাচ্ছিলাম। দোতলায় মেয়েদের ঘরের জানালায় তাকিয়ে মনে হয়েছিল পর্দার ওপাশে কেউ দেখছে আমাকে। আমি নিশ্চিত, ওটা এয়ারপোর্টে পরিচয় হওয়া সেই মিশুকে আন্টি। মেরিনার মা। বুঝলাম না, উনি আমার সাথে দেখা করতে রাজি হলেন না কেন। আমি যদি তার মেয়ের খুনিকে বের করতে সাহায্য করতে পারি, তাহলে তো তার খুশিই হবার কথা। কিন্তু সব সময় যা হবার কথা তা তো আর হতে দেখা যায় না। গাছের পাতা এলোমেলো উড়াউড়ি করে যেভাবে তাদের উড়ার কথা না।
আমি আব্বার সাথে আশেপাশে অনেকগুলো দর্শনীয় জায়গা ঘুরে ফেলেছি এবারো। বিকেলবেলা আমরা যমুনা সেতুর উপরে হাঁটতে যাই। রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি দেখে এসেছি একদিন। আমার আম্মা ভীষণ ব্যস্ত আছেন। গ্রামের মহিলাদেরকে নিয়ে ছোটখাটো কী একটা রান্নার কোর্সের মতো করাচ্ছেন। আমার খুব প্রিয় খাবার তেল–কই মাছ আর মটরশুঁটির ভর্তা খেলাম একদিন। জেঠি আম্মার হাতে একেক বেলা একেকটা প্রিয় খাবার খেতে খেতে আমি একরকম স্পয়েলড হয়ে গেছি। আমরা এসেছিলাম তিন দিন থাকার প্ল্যান করে। এখন এক সপ্তাহ পার হয়ে যাচ্ছে প্রায়। কবে ঢাকায় ফিরতে পারবো জানি না। পুলিশের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে কাজের মহিলা ওকে খুন করে পালিয়েছে। খুনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, ভিকটিমের গলায় সোনার চেইন, হাতের আংটি, কানের দুল আর ঘড়ির লোভে গরিব মহিলা এই কাজ করেছে। কিন্তু আমার সিক্সথ সেন্স বা যে কারোই কমন সেন্স বলবে, এটা সত্যি কারণ হতে পারে না। একদিনের সহযাত্রী একজন মেয়ের খুনি এভাবে শাস্তি ছাড়া পার পেয়ে যাবে, মানতে পারছি না নিজের কাছে। আমি গ্রামের বিভিন্ন মানুষজনের সাথে কথা বলে মেম্বার বাড়ির সদস্যদের সম্পর্কে আরো তথ্য জানার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি। বিশেষ কারো সাথে তাদের পারিবারিক শত্রুতার কারণে মেয়েটিকে খুন করা হয়েছে কিনা, এখনো তেমন পরিষ্কার ভাবে কেউ বলতে পারেনি।
পরদিন আমি আবার গিয়েছিলাম তাদের বাড়ি। মেম্বার সাহেবের সাথে দেখা করতে। দেখতে মার্জিত, ভদ্রগোছের লোকটি আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে। যা যা প্রশ্ন করেছি সবগুলো উত্তর দিয়েছে। বললো, ভাইঝিরা তার কাছে নিজের মেয়ের মতো ছিল। মেরিনার মৃত্যুতে তিনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। মেরিনার কথা বলার সময় আমি তাকে কাঁদতেও দেখলাম। কিন্তু সেদিনও আন্টির সাথে দেখা করতে পারিনি। তার সাথে কথা বলা খুব জরুরি ছিল।
বাড়িতে এসে খাটে শুয়ে সবগুলো ঘটনা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছিলাম আমি, তখন হঠাৎ মনে পড়লো সেদিন টেবিলের উপর খাতার কিছু পাতার ছবি তুলে এনেছিলাম। সেগুলোকে দেখা হয়নি আর। মোবাইল থেকে ছবিগুলোকে ল্যাপটপে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে থাকি আমি প্রতিটি শব্দ। মেরিনার লেখা। প্রথম পাতায় বড় করে তার নাম লেখা। পাতায় পাতায় বেশির ভাগই সংক্ষিপ্ত লেখা। ছোট বাণী। স্কুলের পড়া। বন্ধুদের নাম। ম্যাকডোনাল্ডসে মিটিংয়ের টাইম লেখা। অর্থহীন হলেও টুকে রাখলাম, একটি ছবিতে বেশ কয়েকবার লেখা– বেবি, বেবি, বেবি। আরো কিছু এলোমেলো ডায়ালগ। কিছুই পেলাম না এখানেও। শুধু একটা লাইন মাথায় টোকা মারে আমার, আর ইউ এ বেবি বয় অর এ গার্ল?
আমি শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম। দ্রুত থানার নাম্বারে ফোন করলাম। জানালাম, ময়নাতদন্তের রিপোর্টটি আমি একবার পড়তে চাই। আমার আব্বা ঘুমাচ্ছিলো, তাই আমি একাই চলে গেলাম থানায়। ওসি সাহেব চোখ মুখ শক্ত করে বুঝিয়ে দিলেন আমাকে দেখে তিনি খুশি হননি। তবুও জোর করে হাসি ফুটিয়ে বললেন, আপনার না তিনদিন থাকার কথা এখানে? এখন তো মনে হচ্ছে তিনদিন অনেক লম্বা!
ওসি লোকটি আমার উপর বীতরাগ কেন হয়েছেন বুঝতে পারছি না। আমি একটু বাঁকা করে উত্তর দিলাম, কাজ হলে তিনদিনেই চলে যেতে পারতাম। আপনারা কাজ ঠিক মতো করছেন না, তাই আমার তিনদিনও আর শেষ হচ্ছে না।
:আমার মনে হয়, আপনি যদি এই কেইসটা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি না করেন তাহলেই আপনার মঙ্গল। আর আমাদের অনেক কাজ আছে। আমরা ভীষণ ব্যস্ত। আপনি আমাদের কাজে ঝামেলা করছেন ম্যাডাম।
:কিন্তু একটা অন্যায়ের সঠিক বিচার হওয়া খুব দরকার।
:বিচার তো হয়েছেই। খুনি নিরুদ্দেশ আছে। তাছাড়া মেম্বার বাড়ির সবাই বলেছে, এটি কাজের মহিলারই করা কাজ। তাই আপনার এ নিয়ে আর মাথা না ঘামানোই ভালো।
ওসি সাহেবের কথার ঝাঁঝে বুঝলাম ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আমাকে দেখতে দেবে না। এখানে বেশি ঝুলাঝুলি করে লাভ নেই বুঝে আমি নিজের মনে বাড়ির পথ ধরলাম। আমাকে অন্য উপায় বার করতে হবে।
থানা থেকে বের হয়ে ইচ্ছা করে আমি পাকা রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তা ধরে আগালাম। এখানে অনেক সবুজ। সজীবতার গন্ধ আছে বাতাসে। মানুষজন খুব সরল। পথে অনেকের সাথে দুই এক লাইন করে কথা হলো। মেম্বার বাড়ির কাজের মহিলা সুফিয়াকে পেয়ে গেলাম সৌভাগ্যক্রমে। খুব পটিয়েপাঠিয়ে মেরিনার খুনের কথা জানতে চাইলাম। সুফিয়া খুন বা খুনি সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে না পারলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য দিয়েছে আমাকে, দেশে আসার পর থেকেই মেরিনা খুব অসুস্থ ছিল। কিন্তু বাড়িতে ডাক্তার ডাকা হয়নি একবারও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি হাঁটতে শুরু করি একা। উঁচু নিচু রাস্তার পাশে ফুটে আছে হলুদ বুনো ফুল। রাস্তার পাশে ফুটে আছে কিছু হলুদ সরিষা ফুল। ঝুকে বসে আমি কয়েকটা ফুল তুলতে গিয়েছি এমন সময় খুব জোরে একটা বাইক এসে ধাক্কা মেরে আমাকে ফেলে দিলো রাস্তার পাশে ঢালু গর্তে। দুই হাতের কনুই থেকে চামড়া ছিড়েছে। ডান পা টাও হালকা মচকেছে মনে হচ্ছে। আঘাতের আকস্মিকতায় ভড়কে গেলেও আমি পেছন ফিরে মোটর সাইকেলটিকে লক্ষ্য করেছিলাম। সাইকেলে বসা তিনটি ছেলের পেছনের ছেলেটির লাল ফুলেল শার্ট আমি আগে দেখেছি।
ক`দিনের জন্য বেড়াতে এসে আমার এই যেচে পড়ে নিজের ঘাড়ে বিপদ টেনে নেয়াকে আমার আম্মা একদম মানতে পারছেন না। তিনি পারলে আজকেই আমাকে নিয়ে ঢাকা চলে যেতেন। কিন্তু আমার এখন একটু রেস্ট দরকার। তাই বলেছেন, আর শুধু দুইদিন। তারপর আম্মা আর কারো কথাই শুনবেন না ,আমাদের তিনজনকেই ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। আমাকে আহত করার উদ্দেশ্যে হোক অথবা ভয় দেখানোর জন্যই হোক, মেম্বার বাড়ির রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি মোটরসাইকেল নিয়ে আমাকে ধাক্কা মেরে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে কেউ একজন আছে যে চাইছে না আমি মেরিনার খুনের ব্যাপারটি নিয়ে তদন্ত করি। মেরিনার মা দেখা করছে না আমার সাথে। থানা, ওসি, পুলিশ সবাই থামিয়ে রাখছে আমাকে। মেম্বার লোকটি নিজেও চাইছেন না আমি তাদের এই খুনের ব্যাপারে মাথা ঘামাই। এদের কেউই আমাকে এখান থেকে চলে যাবার জন্য একটা ইশারা দিয়েছে হালকা করে। এই হালকা ইশারায় আমি চলে না গেলে যে তারা কঠিন ইশারা দেখাবে আমাকে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। যেদিন মেরিনার চাচা, এই গ্রামের মেম্বারের সাথে কথা বলেছিলাম, সেদিন তিনি খুব কাঁদছিলেন, মনে হচ্ছিলো তার কান্না সত্যি। তাহলে প্রকৃত খুনিকে ধরতে তার এতো অনীহা কেন? গ্রামের সবচেয়ে সম্মানিত ও শক্তিশালী বাড়ির একটি মেয়েকে কেউ খুন করে ফেললো, অথচ তিনি প্রচন্ড রাগে ফেটে পড়ে গ্রামের আকাশ বাতাস এক করে ফেলছেন না, তিনি কেমন চাচা? এরপর আমার মনে হতে লাগলো, তিনি কি মেয়েটি মারা যাওয়ায় একরকম খুশিই হয়েছেন? ভাইয়ের সম্পত্তির ভাগ নিজে পাবেন বলে? তেমন লোভী মানুষ বলে মনে হয় না লোকটির মুখ দেখে। অবশ্য মানুষের মুখ তার মনের কথা বলে না সব সময়। সিরিয়াল কিলাররাও দেখতে সাধারণ মানুষদের মতোই হয়।
এরপরের দুদিন আমাকে বাড়িতে বন্দি করেই রাখা হয়েছে এক রকম। সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরে আসার দিন শুনেছিলাম, মেরিনাকে নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়েছিলো যে কাজের মহিলা, তার লাশ পাওয়া গেছে নদীতে। তারমানে, সেই মহিলা মেরিনাকে খুন করেনি, কিন্তু আসল খুনের সাক্ষী ছিল সে। তাই মহিলাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে চিরদিনের মতো। আমার মায়ের মন রাখতে মেরিনার খুনের বিষয়টি মনের ভেতর চাপা দিয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম বাধ্য মেয়ের মতো। আমার আর শার্লক হোমস হওয়া হলো না এবছর। কিন্তু মেরিনার খুনের ব্যাপারটি আমার মন থেকে সরছিল না কিছুতেই। হয়তো মেয়েটির প্রাণহীন ফ্যাকাশে মুখটি কয়েক মিনিটের জন্য দেখেছিলাম বলেই। হয়তো তার ছোট্ট বোনটিকে হাসতে খেলতে দেখেছিলাম বলে। হয়তো তার বেশি কথা বলা মায়ের সাথে আমার কিছুক্ষণ কথা বলেছিলাম বলে। আমি মনের ভেতর একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম, ভবিষ্যতে আইন শিক্ষা পাশ করে ব্যারিস্টার হয়ে পেশাগত ক্ষমতার বলে মেরিনার ময়না তদন্তের রিপোর্টটি দেখতে আসবো আবার। নিষ্পাপ একটি মেয়েকে কে এভাবে অকালেই সরিয়ে দিলো পৃথিবীর আলো বাতাস আর মায়া থেকে, সেটা আমাকে জানতেই হবে।
পাঁচ
এরপর সিরাজগঞ্জের ঘটনাটি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। মেরিনার হত্যা রহস্যকে আমি সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মাত্র ছয় সপ্তাহের জন্য দেশে যাওয়ার ছুটিতে যতখানি সম্ভব আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করে সময়টুকু উপভোগ করার চেষ্টা করতে থাকি। আর এভাবে রাতের শেষে দিন আসার মতোই চৌধুরী পাড়ার বাড়িতে আমার থাকার ছুটিও শেষ হয়ে গেলো, সহসাই। আমি আবার বিমানে চড়ে বসেছি। এবার ফ্লাইট উল্টো। ঢাকা থেকে হিথ্রো। বিমানে উঠে একটি মুখ দেখে মনে হলো, মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন তার সাথে নিয়তি খেলা করে যায় যখনতখন। ঘটায় অনভিপ্রেত কিছু দৈব–সাক্ষাত। নিয়তির চরম বিদ্রুপ কিনা জানি না, প্লেনে উঠে বুঝলাম একই ফ্লাইটে ফিরছেন কালো বোরখায় ঢাকা আন্টি এবং ছোট্ট সেরিনা। আন্টি এবার আমাকে লক্ষ্য করেনি। হয়তো নিজের মনে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। সেরিনাকেও বকছেন না। চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন তিনি বিমান টেক–অফ করার সময় থেকে।
আমি হাত ব্যাগ খুলে একটি দৈনিকের প্রথম পাতার সংবাদটি বের করে আবার পড়ি। যেখানে কাজের মহিলাকে দিয়ে ভাইঝিকে খুন করার অপরাধে চাচাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণার সংবাদ ছাপা হয়েছে। ইংল্যান্ডে জন্ম ও বেড়ে উঠা একটি মেয়ে টিনেজ লাইফের শুরুতে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায় তার বয় ফ্রেন্ডের সাথে। মেয়েটির মা অনেক বুঝিয়েও মেয়েকে বাচ্চাটি এবরশন করাতে রাজি করাতে পারেনি। কিন্তু পরিবারের সম্মান ক্ষুন্ন হবে বলে, এই বাচ্চাটিকে নষ্ট করে দেয়া খুব জরুরি মনে হয়েছিল তাদের কাছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে মেয়েটির মা তাকে নিয়ে দেশে যায়। ইচ্ছে ছিল, বাবার অবর্তমানে চাচার কথায় মেয়েটি হয়তো রাজি হবে বাচ্চাটিকে ফেলে দিতে। বংশ মর্যাদা ও পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে হলেও অন্তত। কিন্তু মেয়েটিকে কিছুতেই রাজি করাতে পারছিলো না কেউ। ঘটনার দিন, ভিকটিমের(মেরিনার) সাথে তার চাচার কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে চাচা রাগের মাথায় হাতের কাছে থাকা একটা ভারী শো পিচ্ ছুড়ে মারলে সেটি মেরিনার মাথায় গিয়ে লাগে। মেরিনা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। তার মাথা থেকে প্রচুর রক্ত ক্ষরণের কারণে চাচা মনে করেছিল মেরিনাকে হাসপাতালে নিলেও বাঁচানো সম্ভব হবে না। আর যদি বেঁচে যায়, তাহলেও তিনিই বিপদে পড়বেন এই অপকর্মের জন্য। আর চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে ভাতিজির দুশ্চরিত্রের গল্প। বদনাম হয়ে যাবে পুরো বংশের। তাই বাড়ির পুরোনো বিশ্বস্ত কাজের মহিলাকে আদেশ করেন ছুরি দিয়ে মেরিনার গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করতে।
ঘটনার পরপর মেরিনার মা, কয়েক সপ্তাহ ট্রমাটাইজড হয়েছিলেন। একটিও কথা বলেননি কারো সাথে। দশদিন পর তিনি থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে সব কথা জানান। এবং কোর্টে মেয়ের খুনির বিরুদ্ধে চাক্ষুস সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হয়ে তার বিচার দাবি করেন। মেরিনার মা জানিয়েছে, মেয়েকে কেউ মেরে ফেলুক এটা তার ইচ্ছা ছিল না। মেয়েকে বুঝিয়ে তার মন বদলানোর ইচ্ছাতেই তিনি মেয়ের চাচার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন, তিনি বাঁধা দেবার আগেই চাচার ছুড়ে মারা ভারী বস্তুর আঘাতে মেরিনা মেঝেতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।
কাজের মহিলাকে কে মারলো?
পাঠকের এই প্রশ্নের উত্তরটিও সংবাদের পাতাতে পেয়েছি। মেরিনার চাচা নিজের লোক দিয়ে কাজের মহিলাকে খুন করিয়ে বালির বস্তায় বেঁধে নদীতেই ফেলে দিয়েছিলো। গ্রামের ছেলেরা পুকুরে গোসল করতে গিয়ে পেয়ে যায় লাশটিকে।
আজ প্লেনে অর্ধেকের বেশি সিট্ খালি থাকায় আমি এক ফাঁকে আন্টির পাশের সিটে গিয়ে বসলাম। যমদূত দেখার মতো করে চমকে উঠেন তিনি। আমি খুব আস্তে আস্তে আমার কথা বলে যাই উনাকে।
:স্লামুআলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?
:ভালো। তুমি?
:আমি ভালো আছি আন্টি। ছুটি শেষ। আব্বা আম্মাকে রেখে ফিরে যাচ্ছি আবার আমার একলা জীবনে।
আন্টি চুপ করে থাকেন। কথা খুঁজে পাচ্ছেন না যেন কিছু। পাশে বসা সেরিনা আমাকে দেখে হাসে। হাত নেড়ে হ্যালো বলে। আমিও হাসি। হ্যালো বলি।
:আন্টি, মেরিনার জন্য আপনার মন খারাপ লাগছে?
তিনি কথা বলেন না। সেরিনার মুখটা মুহূর্তে চিমসে গেলো। মায়ের গায়ের সাথে সেটে বসে নিজের মুখ লুকিয়ে ফেললো মায়ের পিঠের পেছনে।
এদের দুজনকে দেখে আমার খুব কষ্ট লাগতে থাকে। বুকের ভেতরটা কেউ খামচে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে নিষ্ঠুরভাবে। তবুও আমি স্বগোক্তির মতো করেই বললাম কথাগুলো। আন্টি, মেরিনার বয়স অনেক অল্প ছিল। ওকে ক্ষমা করে দেয়া যেত না? ইংল্যান্ডে কুমারী মাতার সংখ্যা কতো আপনি জানেন? ৫২ হাজারের বেশি। মেরিনা বাচ্চাটিকে এবরশন করতে না চাইলে ওকে আপনি ইংল্যান্ডে রেখেই বড় করতে পারতেন কিন্তু। তাহলে মেরিনার সন্তানের সাথে আপনার মেয়েটিও বেঁচে থাকতো আজ। মেয়েটি হয়তো বেঁচে থাকতো আপনার মৃত্যু পর্যন্ত। সন্তানের চেয়েও কি সমাজ, সম্পদ, পারিবারিক সম্মান বড় হতে পারে কোনদিন?
আমার আরো অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমার গলা ভারী হয়ে আসে। প্লেনের ভেতর ঠান্ডা হাওয়ায় ঝিমিয়ে থাকা মানুষদের কয়েকজন কান পেতে আমার কথা শুনছে। সেরিনা কেন ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে, আমি জানি না। আমার এতো ভারী কথা ৭ বছরের মেয়েটির কি বোঝার কথা? দেখলাম মেরিনার মা–ও নিজের দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুলে ফুলে ডুকরে কেঁদে যাচ্ছেন। মেয়ের জন্য বুক ভাসানো কান্না। আজ তিনি আমার সাথে একটি কথাও বলবেন না। আজ তিনি শুধুই কাঁদবেন।
আমি উঠে নিজের সিটে গিয়ে বসলাম নীরবে। আমার সিটের চারপাশে যাত্রীরা প্রায় সবাই এখন ঘুমাচ্ছে। আমিও চোখ বন্ধ করে থাকলাম। আমার বন্ধ চোখের পাতায় নিয়ন আলোর মতো জ্বলজ্বলে হয়ে ভেসে উঠেছে মেরিনার হাতে লেখা একটি লাইন, তুমি কি ছেলে বাবু নাকি তুমি মেয়ে বাবু?
মেরিনা যদি বাংলায় লিখতে জানতো তাহলে হয়তো সে এই কথাটাই লিখতো।
বিঃদ্রঃ এই গল্পের প্রতিটি ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। সিরাজগঞ্জ বা উল্লেখিত নামের কোন চরিত্রের সাথে বাস্তবের কোন মিল ঘটে গেলে সেট হবে নিতান্তই কাকতালীয়।
কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক