ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। কথাগুলো কানে যাওয়ার সাথে সাথেই; আমিন সাহেব ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে সোফার উপর উঠে বসলেন। বুকের ভিতরে ধাম-ধাম করে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে, যেমন করে নির্মাণ শ্রমিকরা রড পেটায়; ভয় হচ্ছে এই বাড়ির বাড়াবাড়িতে না হার্ট ধুম করে বন্ধ হয়ে যায়। কাঁচা ঘুমের উপর হঠাৎ এমন আক্রমণ সামাল দেয়ার বয়স আর নাই। সকালের ‘মর্নিং ওয়াক’ সেরে নাস্তার আগে তিনি সোফায় গুটিসুটি মেরে ঘুমের রাজ্য থেকে একটু বেড়িয়ে আসেন। হেঁটে আসার কারণে ঘুমটা জমেও বেশ। আজ ঘুমটা ভাঙ্গলো মসজিদের মাইকে ভেসে আসা ‘একটি শোক সংবাদ’ ঘোষণায়। ঘোষণাটা ভালোভাবে শোনার জন্য আমিন সাহেব জামার বুক পকেট থেকে হিয়ারিং এইড বের করে কানে বসিয়ে নিলেন।
চোখ-নাক-মুখ কুঁচকে গভীর মনোযোগ দিয়ে ঘোষণা শোনেন আমিন সাহেব, চিনতে চেষ্টা করেন ‘কে ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন’। ক্যাটারেক্ট অপারেশনের পর ঝাপসা দেখার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন, কানে হিয়ারিং এইড লাগিয়ে ভালোই শোনেন। একগাদা নিয়ম-কানুন মেনে আর কম-বেশি ঔষধ খেয়ে ডায়াবেটিস আর রক্তচাপকে মোটামুটি সামলে নিচ্ছেন। সবচেয়ে কষ্ট পান স্মৃতির নিয়ন্ত্রণ হারানোয়, এখন পুরানো তো বটেই অনেক আজ-কালের কথাও মনে করতে পারেন না; মনে হয় ‘মনে আছে’, ‘মনে পড়ছে’, ‘মনে পড়বে’ কিন্তু মনে পড়ে না।
২৪ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাসার আলি সাহেব ভোর চারটার সময় ইন্তেকাল করেছেন, ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। আমিন সাহেবের বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ভেসে ভেসে ‘একটি শোক সংবাদ’ এর সাথে মিশে যায়। শোক সংবাদের যে অংশটুকু শোনার জন্য আমিন সাহেব কান পেতে ছিলেন তা ঘোষণা করা হয় না। মরহুমের জানাজার নামাজ কখন কোথায় অনুষ্ঠিত হবে তা বলেনি, হয়তো এখনো ঠিক হয়নি। বুকের ভিতরটা খচ করে উঠল, জানাজার নামাজই এখন অনেক পরিচিতজনের সাথে শেষ সাক্ষাৎ। এই সাক্ষাৎ একই সাথে স্বস্তির এবং কষ্টের।
আলি সাহেবকে চিনতে পেরে তার নিজের স্মৃতির প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করেন। বছর খানেক আগেও আলি সাহেব ছিলেন তার ভোরবেলার হাঁটার সঙ্গী। মুখ ভর্তি হালকা চাপ দাড়ি, চোখে মেরুন রঙের মোটা ফ্রেমের চশমা; একটু খুড়িয়ে হাঁটতেন, হাতে থাকতো একটা লাঠি। আমিন সাহেব একটু মাথা নাড়লেন, লাঠি শব্দটা ঠিক মানানসই হয় না -ওয়াকিং স্টিক। আগে একবার স্ট্রোকের কারণে তার হাঁটায় এই ছন্দ পতন। মনে করতে পারলেন আলি সাহেবের বাসায়ও গিয়েছেন। সেটা সকালের নাস্তার দাওয়াতে। হঠাৎ হঠাৎ হাঁটার সঙ্গীরা দল বেধে কোন এক শুক্রবারের সকালে কারো বাসায় নাস্তার দাওয়াত খাওয়ার উৎসবে মেতে উঠতেন। এই সব অনুষ্ঠানের ভাল দিক হচ্ছে অসুখের কারণে নিষিদ্ধ খাবার একটু-আধটু চেখে দেখা যায়। অনেকে আবার সু্যোগ পেয়ে চেখে দেখার সীমানা পার হয়ে যান।
আমিন সাহেব প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন, তার স্ত্রী মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরলে তিনি আলি সাহেবের বাসার উদ্দেশ্যে বের হবেন।
প্রথমবার সামলে নিলেও দ্বিতীয় স্ট্রোক সামাল দিতে পারেননি আলি সাহেব, বিছানায় পড়ে গেলেন। পুরো শরীর অবশ হয়ে গেল। মাস দুই হাসপাতালের আইসিইউতে কাটিয়ে এম্বুলেন্সে শুয়ে বাড়ি ফিরলেন। হয়তো শেষ দেখা এমন মনে করে হাঁটার সঙ্গীরা তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন, কিন্তু মন খারাপ করে ফিরতে হয়েছে। হাসপাতালের নিয়ম খুব কড়া, আইসিইউতে নিকটজন ছাড়া কারো ঢোকার অনুমতি নেই। বাসায় ফেরার পর তিনি একবার আলি সাহেবকে দেখতে গিয়াছিলেন, সেই স্মৃতি বড়ই মর্মান্তিক। জলজ্যান্ত একটা মানুষ কাঠের তক্তার মতো বিছানায় পড়ে আছে, কোন নড়াচড়া নেই। ডাকলে কোন সাড়া দেন না, কেবল চোখের মণি খানিকটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে বলে মনে হয়। আসলে হয় কিনা কে জানে! মানুষজনকে চিনতে পারেন কিনা বোঝা মুশকিল। আলি সাহেবের স্ত্রী রুমানা কানের কাছে মুখ নিয়ে গলার স্বর উচিয়ে বললেন, আমিন ভাই এসেছেন। এই শুনছো, আমিন ভাই তোমাকে দেখতে এসেছেন।
কোন সাড়া নেই, কোন নড়া-চড়া নেই। আলি সাহেবের নীরবতাকে ভাষা দেন তার স্ত্রী। বলেন, ভাই সাহেব উনি সব বুঝতে পারেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস। রিলে রেসের মতো এই দীর্ঘশ্বাস সংক্রমিত করে আমিন সাহেবকে। তার দীর্ঘশ্বাস শুধুমাত্র আলি সাহেবের জন্য নয়, নিজের জন্যও। সামনে তার কি পরিণতি হবে, একমাত্র আল্লাহই জানেন।
২৪ নম্বর রোডে ঢুকতেই আলি সাহেবের বাসা খুব সহজে চোখে পড়ল। বাসার সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। টকটকে লাল রঙে ‘লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি’ লেখাটা দূর থেকে চোখে পড়ে। বাসার সামনে এক সারি চেয়ার সাজানো আর গ্যারাজের ভিতরে শব বহনের খাট। খাটের উপরে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন আলি সাহেব, মাথার কাছে আগরবাতি জ্বলছে। কর্পূর, আতর আর আগরবাতির ধোঁয়ার গন্ধে ভারী হয়ে আছে চারপাশ। বাসার ভিতর থেকে ভেসে আসছে কোর’আন তেলওয়াতের সুরেলা আওয়াজ। আমিন সাহেবের বুকের বা দিকটায় একটু ব্যথা-ব্যথা মনে হল। তিনি আলতো করে বুকে হাত বুলালেন। বুক পকেট থেকে ওষুধ বের করে জিহ্বার নিচে স্প্রে করলেন। বুক ভর্তি করে বাতাস টেনে নিলেন; না, এখন আর ব্যাথা নেই। অনেকে এসেছেন, অনেকে আসছেন; ধীরে ধীরে ১১ নম্বর বাসার সামনে ভিড় বাড়ছে।
দ্বিতীয় স্ট্রোকের পর আলি সাহেবকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে সরাসরি নেয়া হলো আইসিইউতে। পুরো আইসিইউ এলাকা হিম শীতল বিষন্নতায় ভারী হয়ে আছে। সারি সারি চেয়ারে বিধ্বস্ত স্বজনেরা উদ্বেগ, ক্লান্তি আর অনিশ্চয়তা নিয়ে অপেক্ষায় ভেঙে পড়ার অবস্থায়। রুমানা গিয়ে তাদের সাথে বসলেন, টের পেলেন তার কপালে গলায় মৃদু ঘাম। বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই আইসিইউর ভিতরে কি হচ্ছে। রুমানার মাথায় নানা চিন্তা, নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষটা কি বেঁচে আছে? ডাক্তাররা কি করছে? আইসিইউ কি মানুষের শেষ ঠিকানা? সময় পার হচ্ছে আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রুমানার টেনশন । ঠোঁট জোড়া অনবরত নড়ছে মুখস্থ দোয়া-দরুদের নীরব পাঠে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই রুমানার ডাক পড়লো। ঘোর লাগা কাঁপা কাঁপা পায়ে রুমানা আইসিইউর ইনচার্জ ডাক্তার মনিরুজ্জামানের রুমে ঢুকলেন। প্রাণপণে খোদাকে ডাকতে ডাকতে তার গলা শুকিয়ে কাঠ। মনের ভিতর থেকে একটা কু-ডাক বারবার ফিসফিস করছে, মানুষটা বুঝি আর নাই! আইসিইউ তো মরতে বসা রোগিদের জায়গা। তবু মনের ভিতরে ক্ষীণ আশার শিখাটা দুলছে। যেমনই হোক মানুষটা বেঁচে থাকুক, পঙ্গু-অন্ধ কত মানুষ কত ভাবেই না বেঁচে আছে। শুধু বেঁচে থাকা! খোদা কি তার প্রতি একটুও করুণা করবেন না! একটু দয়া!
ডাক্তার মনিরুজ্জামান রুমানাকে বসতে বললেন। রুমানা বসলেন; তার চোখে-মুখে জিজ্ঞাসা, রোগী কেমন আছে? কিছুক্ষণ নীরবতা। নীরবতা ভেঙে ডাক্তার জানতে চাইলেন, আপনি একা? আপনার সাথে আর কেউ নেই?
নিমেষে রুমানার বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠলো। তবে কি মনের ভিতরের কু-ডাকটাই সত্য হলো। মনটাকে শক্ত করে বললেন, আমাকে বলুন। আমি তার স্ত্রী। যে প্রশ্ন তিনি করতে চান না, কিন্তু উত্তর জানতে চান তাই তার মুখ দিয়ে বের হয়ে এল। উনি কি বেঁচে আছেন?
ডাক্তার এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না; জানতে চাইলেন, আপনার সাথে পুরুষ মানুষ কেউ নেই? অন্য সময় হলে রুমানা এই প্রশ্নের কড়া জবাব দিতেন। এখন তিনি এদিক-ওদিক মাথা নাড়লেন, না সাথে কেউ নেই।
আপনার ছেলেমেয়েরা? জানতে চাইলেন ডাক্তার সাহেব।
তারা সবাই বিদেশে থাকে।
ও। ছোট্ট করে জবাব দিয়ে ডাক্তার মনিরুজ্জামান আলি সাহেবের অসুস্থতার ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলেন।
আলি সাহেব বেঁচে আছেন তবে অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে, সাথে আগে থেকেই আছে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। সবটা মিলিয়ে অবস্থা ভালো না, শেষ পর্যন্ত কি হয় বলা যায় না। তবে ডাক্তাররা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন, বাকিটা ভাগ্যের হাতে। আস্তে করে বলটা সৃষ্টিকর্তার কোর্টে ঠেলে দিলেন ডাক্তার। তিনি কেবলমাত্র উসিলা। এক সীমাহীন শূন্যতা রুমানার মাথায় ভর করলো। সবকিছু কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, ডাক্তারদের কথাগুলো এতো দুর্বোধ্য হয়!
বাঁচে কি মরে মানুষের এমন অবস্থায় টিকে থাকার জন্য দরকার হতে পারে কৃত্রিম ব্যবস্থা। মেশিনই তখন আজরাইলের সাথে যুদ্ধ করে মূমুর্ষ রোগীকে ফিরিয়ে আনার একমাত্র সহায়। আইসিইউর রোগীদের এই সেবা দেয়ার জন্য দরকার রোগীর নিকট আত্মীয়দের সম্মতি। এখন রুমানার সম্মতির অপেক্ষা, জীবন বাঁচাতেই এই নিয়ম।
নার্স এসে রুমানার সামনে একটা ছাপানো ফর্ম আর বলপেন রাখলেন। পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে কালো কালিতে ছাপা সারি সারি ইংরেজি বাক্য আর নিচে স্বাক্ষর করার জায়গা। একি পড়া সম্ভব! এখন, এই অবস্থায়! আর ডাক্তারি সব কথার মানে কি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে! কলম তুলে স্বাক্ষর করতে গিয়ে রুমানা হাতের কাঁপন টের পেলেন। মনকে শক্ত করলেন, আর তো কোন উপায় নেই। সই করে দিলেন। আইসিইউ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরেছেন এমন কিছু স্মৃতি প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করতে থাকলেন।
আমি কি ওকে একটু দেখতে পারি? অসহায় রুমানার কণ্ঠে আকুতি ঝরে পড়লো।
অবশ্যই দেখতে পাবেন। আমাদের একটু সময় দেন, আমরা ওনাকে সেটেল করেই আপনাকে ডাকবো।
‘মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে এলেন কিনা’ এমন ভাবতে ভাবতে আইসিইউ থেকে বের হয়েই রুমানা দেখলেন করিডোরে তার ভাতিজা রুম্মান দাঁড়িয়ে আছে। ফুপুকে দেখে এগিয়ে এলো রুম্মান। জানতে চাইল- ফুপুম্মা, ফুপার খবর কি?
রুম্মানকে দেখার সাথে সাথেই রুমানা বেগমের চারপাশ অন্ধকার হয়ে এল। দেখতে পেলেন হাসপাতালটার দেয়াল, মেঝে, ছাদ ঝুর ঝুর করে লক্ষ লক্ষ টূকরো হয়ে ঝরে পড়ছে। শরীরটা হাঁটু থেকে, কোমর থেকে, কনুই থেকে, ঘাড় থেকে ধীরে ধীরে টপাটপ ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে। রুম্মান দৌড়ে এসে ফুপুকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরল। রুমানা অস্ফুট স্বরে বললেন- জানি না, মনে হয় বেঁচে আছে।
রুম্মানের একমাত্র ফুপু রুমানার দুই ছেলে এক মেয়ে। তিনজন তিন দেশে। বড়জন রুপু ডেন্টাল সার্জন, থাকে নিউজিল্যান্ডে; মেজজন সপু, থাকে কানাডায়; ছোটজন রুমু, থাকে আমেরিকায়। তাদের কেউই এখন পর্যন্ত জানে না, তাদের বাবা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। রুম্মানের এখন অনেক কাজ। দেশের সবদিক সামলিয়ে বিদেশে খবর দিতে হবে। চিকিৎসার খরচাপাতিও কম নয়, লাইফ সাপোর্ট লাগলে হু হু করে বেরিয়ে যাবে অর্থ-কড়ি। ফুপুর ব্যাংক একাউন্টের একটা হিসাব নিতে হবে, ফুপার একাউন্টতো এই মুহূর্তে কোন কাজে আসছে না। না হলে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে আপাতত ধার-কর্জ করে চালাতে হবে। রুম্মান মোটামুটি নিশ্চিত এই টাকা জোগাড় হবে। টাকা পাওয়ার সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে ফেরত পাওয়ার অনিশ্চয়তা। সন্তানরা বিদেশে থাকে, ভালো অবস্থায় আছে এটাই টাকা ফেরত পাওয়ার বড় গ্যারান্টি। মনে মনে কাজের একটা লিস্টি করলো রুম্মান। ফুপাতো ভাই-বোনদের শূন্যতা পূরণের ভার অনেকদিন থেকেই তার কাঁধে।
ফুপুকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারলে রুম্মান কাজগুলো সহজে সারতে পারে। কিন্তু রুমানা অন্তত একবার স্বামীকে চোখের দেখা হলেও দেখতে চান, তার আগে কোথাও যাবেন না। রুম্মান খাওয়ার কথা বললো, তিনি কিছু খাবেনও না। ঘন্টা দুয়েক পরে আইসিইউ থেকে আবার ডাক পড়লো। এই সময়টুকু কিভাবে পার করেছেন, তা কেবল তিনি জানেন আর তার খোদা জানেন।
এবার আর রুমানা একা নন, সাথে আছে রুম্মান। রুমে ঢুকে রুমানা বেশ ঘাবড়ে গেলেন, গম্ভীর মুখে কয়েকজন ডাক্তার বসে আছেন টেবিলের ওপারে আর এপারে একটা মাত্র চেয়ার। রুম্মান ফুপুকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল। প্রথমবার যখন আইসিইউতে ডাক পড়েছিল তখন ছিলেন একজন ডাক্তার আর এখন কয়েকজন, সবাই একসাথে রুমানার দিকে তাকালেন। আবারও প্রথমবারের সেই অনুভূতি রুমানাকে আরো তীব্রভাবে গ্রাস করলো, মানুষটা কি বেঁচে আছে! ফুপুর অবস্থা বুঝতে পেরে রুমানার কাঁধে হাত রাখলো রুম্মান। সেই হাতের উপর হাত রাখলেন রুমানা, শক্ত করে ধরলেন। যেন নিজেকেই শক্ত করে নিলেন, পরিস্থিতি যাই হোক তার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন।
পরিচিত মুখ পেয়ে রুমানা ডাক্তার মনিরুজ্জামানের দিকে তাকালেন। সারাক্ষণ দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে তার গলা-মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে, বার দুয়েক ঢোক গিলে জিহবা নাড়িয়ে গলা ভেজাবার চেষ্টা করলেন। গলা দিয়ে কোন স্বর বের হচ্ছে না, কোন রকমে উচ্চারণ করলেন- স্যার?
আইসিইউ মানেই সঙ্কটাপন্ন রোগি, ডাক্তার মনিরুজ্জামান জানেন কিভাবে তা সামলাতে হয়; কিভাবে কি বলতে হয়, কি করতে হয়। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ধীর কণ্ঠে শুরু করলেন, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ আলি সাহেবকে দেখেছেন। তারা নিজেরা রোগীর সার্বিক বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ভূমিকা শেষ করে ডাক্তার মনিরুজ্জামান অন্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাদের মধ্য থেকে নিউরোসার্জন মুখ খুললেন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের বিষয়টি তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন। জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে। কিন্তু…
কিন্তু? কি? রুমানা জানতে চাইলেন।
কিন্তু ফলাফল খুবই অনিশ্চিত। অপারেশন করলে ভালো হওয়ার একটা সুযোগ আছে, না করলে কোন আশা নেই। আবার এমনও হতে পারে রোগী বেঁচে গেলেন কিন্তু আগের মতো শারীরিক অবস্থা পেলেন না; হয়তো পুরো শরীরই অবশ হয়ে গেল, হয়তো অপারেশনের পর আর জ্ঞানই ফিরলো না। আসলে এ ধরণের রোগির ক্ষেত্রে কোন কিছুই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে অপারেশন যত দ্রুত করা যায় ততই মঙ্গল, দেরী হলে আর কোন কিছুই করা সম্ভব হবে না।
নীরব রুমানার চোখ ছাপিয়ে অশ্রু নেমে এলো। তিনি কোন কথাই বলতে পারলেন না। তিনি অসহায় দৃষ্টিতে রুম্মানের দিকে তাকালেন। রুমানার সাথে সাথে রুমের সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল রুম্মানের দিকে। ফুপুর অবস্থা বুঝতে পেরে রুম্মানই দায়িত্ব নিল। রুমানার হয়ে মুখ খুললো, আমাদের একটু সময় দিন, জানাচ্ছি।
আপনি পেসেন্টের কে হন? ডাক্তাররা জানতে চাইলেন।
রোগি আমার ফুপা।
রুমানা দাঁড়ানোর চেষ্টা করে চেয়ার ছেড়েই আবার বসে পড়লেন। রুম্মান শক্ত করে ফুপুকে ধরে রুমের বাইরে নিয়ে এল। এরই মধ্যে কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন এসে হাজির হয়েছেন।
আইসিইউ থেকে বের হবার সাথে সাথেই সবাই এগিয়ে এসে রুমানাকে ঘিরে দাঁড়াল। উৎকণ্ঠা আর জিজ্ঞাসা সবার চোখে-মুখে। রুমানা মনে হলো এসব কিছুই দেখছেন না। তিনি নিজের মনেই বললেন, এখন আমি কি করবো? সত্যিই তো, রুমানা এখন কি করবেন; স্বামীর এই অবস্থায় সন্তানেরা যখন থেকেও নেই।
আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে এই নিয়ে গুঞ্জন শুরু হলো। এই বিষয়ে এই কঠিন সময়ে পরামর্শ দেয়া, পাশে থাকা দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু কঠিন সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়াও কম কঠিন নয়, যখন সব কিছুই অনিশ্চিত। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তা বাস্তবায়নের ব্যাপার আছে। শেষমেষ তার ফলাফল কি দাঁড়াবে তাও বিবেচনায় নিতে হবে। আর আলি সাহেবের সন্তানদের কি মত তাও জানতে হবে। অপারেশন করিয়ে আলি সাহেবের মরণ যাত্রা দীর্ঘায়িত ও কষ্টকর করা কি ঠিক হবে, কয়েকজনের এমন মন্তব্যের পিঠে একজন জানালেন, জন্ম-মৃত্যু তো কেবলমাত্র সর্বশক্তিমানের ইচ্ছা নির্ভর। লাখ-লাখ টাকা বিল দিয়ে শেষ পর্যন্ত আইসিইউ থেকে লাশ নিয়ে ফেরার কাহিনী দুই একজন তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শোনালেন। আর এ ক্ষেত্রে হাসপাতালের ভূমিকা যে শাইলকের মতো, সে বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু হালই বা ছেড়ে দেয় কিভাবে, শেষ চেষ্টাতো করতেই হবে; যতক্ষণ শ্বাস ততোক্ষণ আশ। আর সেখানে সন্তানেরা বিদেশে থাকে সেখানে টাকা-পয়সা নিয়ে এতো চিন্তার কি আছে! বাপের জন্য করা তো সন্তানদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তবে প্রবাসী সন্তানদের নিষ্ঠুরতার দুই একটা কাহিনী কারো কারো জানা আছে। তবে নিশ্চয়ই আলি সাহেবের সন্তানেরা এমনটি করবে না।
আত্মীয়-স্বজনদের আলাপের কিছু কিছু রুমানার কানে আসছে। তিনি জানেন, সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে। যেখানে আজরাইল কানের কাছে আর চিকিৎসার ফলাফল অনিশ্চিত সেখানে আগ বাড়িয়ে সিদ্ধান্ত দিতে কেউ এগিয়ে আসবে না। পরামর্শ দেয়ার আগেও অনেক চিন্তা-ভাবনা করবে। কিন্তু তার সন্তানদের কি মত? তাদের তো বাবা, অর্থের মূল যোগানদাতা তো তারা। হঠাৎ রুমানার মনে হল, অনিশ্চিত ফলাফলের শংকায় যদি তারা চিকিৎসা করাতে সায় না দেয়। কিন্তু বাবার চিকিৎসার ব্যাপারে কি তার সন্তানেরা এতোটা হিসাবী হবে, এতোটা নিষ্ঠুর হবে! ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে তারা দুইজন তো কম কষ্ট করেননি। বড় ছেলেটা মেধার গুণে বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়তে গেলেও কম খরচ হয়নি। ছোট ছেলেকে তো সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। মেয়ে তো পরের ঘরে। না, রুমানা আর ভাবতে পারছেন না! মাথাটা জ্যাম হয়ে গেছে, শরীরটা গুলাচ্ছে, বমি বমি লাগছে। নিজেকে মনে হচ্ছে একটা কাঁচের পাত্র, ধীরে ধীরে উপর থেকে শক্ত মেঝেতে পড়ছেন। নিজেকে শক্ত করলেন। হাত নেড়ে রুম্মানকে ডাকলেন। রুম্মানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, তোর ফুপার অপারেশন করতে বল, আমরা রাজি। রুম্মান কিছু বলতে যাচ্ছিল; থামিয়ে দিয়ে বললেন, আল্লাহ ভরসা। মানুষটাতো এখনো বেঁচে আছে।
বাবার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে পৃথিবীর তিন প্রান্ত থেকে আলি সাহেবের তিন সন্তানই দেশের পথে রওনা হলো। বাবার সুস্থতার আশা আর মৃত্যুর আশংকার দোলাচলের ভিতর দিয়ে তারা যখন দেশের মাটিতে পা রাখল ততদিনে আলি সাহেবের অপারেশন হয়ে গেছে। তিনি লাইফ সাপোর্ট নিয়ে আইসিইউর বিছানায় শুয়ে আছেন। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা হাসপাতালে আলি সাহেবের সন্তানেরা অপেক্ষায় থাকে, সুসংবাদের অপেক্ষায়। রুমানা সন্তানদের মতো পারেন না, বেশিরভাগ সময় বাসায় থাকেন। তারপরও প্রতিদিন একবারের জন্য হলেও আইসিইউতে এসে স্বামীকে দেখে যান। যতক্ষণ জেগে থাকেন অনবরত দোয়া-দরুদ পড়তে থাকেন। নিয়ম করে আইসিইউর ডাক্তাররা রোগীর অবস্থা জানান। অনিশ্চয়তা কাটে না, আজ যদি একটু ভালো তো কাল খারাপ। যেদিন কিডনি ভালো কাজ করতে শুরু করে সেদিন ঔষধ দিয়ে হৃদপিণ্ড চালু রাখতে হয়। পরের দিন আবার শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট। ডাক্তাররা রক্তের বিভিন্ন উপাদানের উঠা-নামা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল, ভালো-মন্দের ফিরিস্তি দেন। আশা দেন, আবার অনিশ্চয়তার কথাও বলেন।
এই ভালো এই মন্দ করতে করতে মাসখানেক পার হয়ে গেলে আলি সাহেবের সন্তানেরা একে একে বাবা-মা আর দেশ ছেড়ে রওনা হলো যার যার গন্থব্যে। রুমানাই বা কি করবেন। যতই ইচ্ছা থাক, তার পক্ষে তো সন্তানদের ধরে রাখা সম্ভব নয়। সবারই কাজ আছে, চাকুরি আছে, ঘর-সংসার আছে; তাদের সন্তানদের দেখভালের বিষয় আছে। স্নেহ নিম্নগামী, সন্তানদের প্রয়োজনকেই রুমানা মেনে নিলেন। না মেনেই বা উপায় কি! এই কঠিন সাগরে তার একমাত্র সাথী রুম্মান। আইসিইউ থেকে এইচডিইউ তারপর কেবিন, হাসপাতালে মাস দুয়েকের যমে-মানুষের টানাটানি শেষে আলি সাহেব বাসায় ফিরলেন। আজরাইল এবারের মত ছেড়ে দিলেন বটে, কিন্তু পরিস্থিতি কঠিন করে দিয়ে। আলি সাহেব বেঁচে আছেন, তবে সে না থাকার মতোই। কোন নড়া-চড়া নেই, কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। কাউকে চেনেন কিনা, কিছু বুঝেন কিনা তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারেন। নাকে নল আছে খাইয়ে দেয়ার জন্য, প্রস্রাবের জন্যও নল। বাসায় তার রুমে ঢুকলে মনে মনে হয়, হাসপাতালের কেবিনের ছোট-খাট সংস্করণ। হাসপাতালের মতোই খাট, নেবুলাইজার, রক্তের শর্করা মাপার গ্লুকোমিটার, রক্তচাপ মাপার জন্য স্টেথো আর বিপি মেশিন, বুকের শ্লেষ্মা টেনে নেয়ার জন্য সাকার মেশিন। রুমানা মানুষটাকে জীবিত পেলেন, তার সাথে সাথে পেলেন নিরবিচ্ছিন্ন সেবা-শুশ্রূষার কঠিন দায়িত্ব, আর সার্বক্ষণিক উৎকণ্ঠা। কখন যে কি হয়, এই চরম অনিশ্চয়তা সঙ্গী হলো তার।
এই সবকিছুর সমাপ্তি টানতে আলি সাহেব আরো ছয় মাস সময় নিলেন।
২
আলি সাহেবের বাসার সামনে ধীরে ধীরে ছোট ছোট জটলা তৈরি হচ্ছে। জটলায় দল বেঁধেছে সমবয়সী মানুষেরা। এ রকম একটি দলে আছেন আমিন সাহেব। তিনি আর হাঁটার সঙ্গীরা মিলে গোল হয়ে বসে মৃদুস্বরে কথা বলছেন। আলি সাহেবের সাথে তারা যে সময় কাটিয়েছেন সেইসব ছোট ছোট স্মৃতি তাদের আলাপের মূল বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে ভুলে থাকা অনেক ঘটনা আজ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় অনেকে অবাক বিস্ময়ে একে অপরকে জানাচ্ছেন। বেঁচে থাকতে শেষবারের মত দেখতে না পারার অনুতাপ আর হতাশা কারো কারো কণ্ঠে। জানাজা ও দাফনের কি সিদ্ধান্ত এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা ঘুরেফিরে আলাপে আসছে। মৃত্যুর মূহুর্তে সন্তানের হাতের এক ফোঁটা পানি জুটেনি কপালে! এই সময়ে সন্তানদের কেউই দেশে নেই, এ যে কি কষ্টের, কি বেদনার তা বলার নয়। নিয়তির কাছে মানুষের এই অসহায়ত্ব আলি সাহেবের হাঁটার সঙ্গীদের মধ্যে এক দার্শনিক বোধের পুণর্জন্ম দেয়। প্রত্যেককে একাই ফিরতে হবে, এই নির্মম সত্য পুরো জটলায় ক্ষণিক নীরবতা নিয়ে আসে। সবাই বারবার ‘আলি সাহেব যে একজন ভালো মানুষ ছিলেন’ সেই বিষয়ে একমত হন। একজন এমনও মন্তব্য করেন, আল্লাহ ভালো মানুষদের তাড়াতাড়ি তার কাছে তুলে নেন। এই মন্তব্য তার ভালো মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কিনা, তা তার এবং উপস্থিত কারো মনেই আসে না। কিংবা মনে আসলেও তা বলাটা সমীচীন মনে করেন না। মৃত্যু আলি সাহেবকে কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছে, এমন মন্তব্য করে একজন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
আলি সাহেবের ছেলেদের বন্ধুরা জড়ো হয়েছে বাসার বাইরে। রাস্তার উপরে গাছের ছায়ায় তারা আড্ডা দিচ্ছে। তাদের আলাপ রূপু-সপুকে ঘিরে, বন্ধুরা কি তাদের বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছে। তারা কি আসবে, তাদের আসতে কতদিন লাগবে। বছরের এই সময়ে কি সহজে টিকেট পাওয়া যায়। কোন পথে, কোথায় ট্রানজিটে কেমন সময় লাগে, কত অর্থ ব্যয় হয়। যদি তারা আসে লাশ কোথায় থাকবে, কোন হাসপাতালের হিমঘরে। হিমঘরের খরচটাই বা কেমন, মানই বা কেমন। বন্ধুদের মধ্যে যারা তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা কথা বলতে বলতে সেই স্মৃতির ধাক্কায় হঠাৎ কথা থামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। অন্যরাও যেন তা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে যাচ্ছে। তারপর খানিক নীরবতা। আবার শুরু আড্ডার কোলাহল।
আলি সাহেবের আত্মীয়-স্বজনদের জিজ্ঞাসা, কবর কোথায় হবে। গ্রামের বাড়িতে মসজিদের পাশে বড় পারিবারিক কবরস্থান আছে; দিনে পাঁচবার আজান হবে, নামাজ হবে। সেখানে আলি সাহেবের বাবা-মাসহ মুরুব্বীরা ঘুমিয়ে আছেন। আর এখানে কেইবা আছে, ছেলে-মেয়েরা থাকে বিদেশে। তারা কি আর দেশে ফিরবে, কেউ কি ফিরে তেমন। বাবা-মা না থাকলে কিসের টানে দেশমুখী হবে। তখন তো শহরের এই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া-খায়ের করারও কেউ থাকবে না। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে তো প্রতিদিনই আত্মীয়-স্বজনদের কোন একজন অন্ততঃ কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলবে। আচ্ছা, আলি সাহেব তার কবরের বিষয়ে কোন অছিয়ত করেছেন কি, একজন জানতে চাইলেন। উপস্থিত কেউ তার সদুত্তর দিতে পারল না। রুমানা বেগমকে জিজ্ঞাসা করা যায়। তিনি জানতে পারেন, আলি সাহেব তার কবর কোথায় হবে স্ত্রীকে হয়তো জানিয়েছেন। যদি গ্রামে কবর দিতেই হয়, সেখানে খবর পাঠানো দরকার; কবর খোদাই করতে হবে। বোঝা যায়, অধিকাংশ আত্মীয়-স্বজনের পক্ষপাত দেশের বাড়ির দিকে।
ভোর থেকেই রুম্মান দৌড়ের উপর আছে। লাশের গোসল আর কাফনের ব্যবস্থা সে সাথে সাথেই করেছে। সাথে পেয়েছে রুপু-সপুর কয়েকজন বন্ধুকে। সব সময় এমন কয়েকজন মানুষ পাওয়া যায় যারা দাফন-কাফনের কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে। হোক তা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী। স্থানীয় মসজিদে জানাজার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হলেও দাফন কোথায় হবে তা ঠিক হয়নি। ফুপা কথায় কথায় দুই একবার বলেছিল, মৃত্যুর পর যেন তাকে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়। সেটা কি কথার কথা না তার অছিয়ত নামা রুম্মান নিশ্চিত নয়। ফুপুকে সকালে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে কোন উত্তর পায়নি। এখন জানাটা জরুরি।
রুম্মানের ফোন পেয়ে আলি সাহেবের ছেলে-মেয়েরা দীর্ঘক্ষণ চুপ করে ছিল। মায়ের জন্যই তাদের চিন্তা বেশি। এবার আর কেউ আসতে পারবে না। এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার ছুটি পাওয়া যাবে না। রুম্মান যদিও মামাত ভাই, আসলে সে তো রুমানার ছেলের মতোই। তাই সন্তানের যে দায়িত্ব তা রুম্মানকেই পালন করতে হবে। হয়তো এটা আল্লাহরই ইশারা, একারণেই মামা তার ছেলের নাম একমাত্র বোনের নামের সাথে মিলিয়ে রুম্মান রেখেছিলেন। আর দাফনের বিষয়ে তাদের সবার সিদ্ধান্ত একই রকম; বাবা কি কিছু বলেছিলেন, না বলে থাকলে মার মতই তাদের মত।
রুমানা জানেন স্বামীর শেষ ইচ্ছার কথা। আলি সাহেব চাকুরি পেয়ে তার গ্রাম ছেড়েছিলেন। সেই ছোট্টটি থেকে যৌবনের শুরু পর্যন্ত তিনি ছিলেন গ্রামেরই ছেলে। শহরের জীবন তাকে ধীরে ধীরে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলেছে। প্রথম প্রথম নিয়মিত বাড়ি গেলেও, সময়ের সাথে সাথে তা কমতে কমতে মায়ের মৃত্যুর পর প্রায় বন্ধ হয়েছে। মায়ের প্রতি টান, বাড়ির প্রতি টান নাকি শৈশব-কৈশোরের নস্টালজিয়া; কি কারণে যে তিনি মায়ের পাশে কবর পেতে চেয়েছেন তা রুমানা কখনো জানতে চাননি। মৃত্যু বিষয়ক আলাপে তার অনীহা ছিল, একাকী থাকার ভয় না অন্য কোন কারণে এই অনীহা তা খুঁজতে চাননি। এখন কবর কোথায় হবে আর আলি সাহেবের শেষ ইচ্ছা কি ছিল, তা জানার জন্য সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
রুম্মান ফুপুর কাছে এসে জানতে চাইল, কবর কোথায় হবে। তসবিহের উপর দ্রুত চলতে থাকা তর্জনি ও বুড়ো আঙ্গুল আচমকাই থেমে গেল। রুমানা তার নীরব কান্না আর ধরে রাখতে পারলেন না, ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
ফুপা কি তোমাকে কিছু বলে গেছে? তার কোন ইচ্ছার কথা? রুম্মান জিজ্ঞাসা করলো।
রুমানা কোন কথা না বলে, মাথা দোলালেন। না, তিনি জানেন না।
রুম্মান কি যেন বলতে চাইল। রুমানা চোখের ইশারায় রুম্মানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, দাফন এখানেই হবে। রুম্মানকে কাছে ডেকে এনে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তোর ফুপার কবর এখানেই হবে। দাফনের ব্যবস্থা কর।
আমিন সাহেব একটু অবাক হলেন। তার মনে পড়লো, সকালে হাঁটার দিনগুলিতে আলি সাহেবের সাথে মৃত্যু বিষয়ক আলাপের স্মৃতি। প্রথমবার স্ট্রোকের পর মাঝে মধ্যেই আলি সাহেব বাড়িতে মায়ের কবরের পাশে তার দাফনের ইচ্ছার কথা বলতেন, তার শেষ ইচ্ছা। স্ত্রী রুমানাকে কি সেই কথা বলেননি? নিশ্চয়ই রুমানা তা জানেন না।
আমিন সাহেব ঠিক করলেন আজই তার স্ত্রীকে বলবেন, মৃত্যুর পর তাকে যেন বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। আজই বলতে হবে, বেঁচে থাকার তো কোনই নিশ্চয়তা নেই। কখন কি হয়ে যায় কেউ বলতে পারে!
৩
জানালা দিয়ে তীব্র আলো এসে আমিন সাহেবের রাতের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালো। তিনি চোখ খোলার আগেই সেই বাতি হারিয়ে আবার অন্ধকার নেমে এলো। আবার আলো আবার অন্ধকার, জানালার ওপাশ কেউ একটা হাজার ওয়াটের বাতির আলো তার চোখের উপর ফেলছে আর সরিয়ে নিচ্ছে। তিনি চোখ খোলার চেষ্টা করলেন, মনে হলো চোখের পাতা লোহার মত ভারী। কোন ভাবেই টেনে খুলতে পারছেন না। শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে কোন রকমে চোখের পাতা দুটো একটু ফাঁক করলেন। টের পেলেন জানালা দিয়ে আলো এসে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। নিয়মিত বিরতিতে লাল আলোর একটা স্রোত চারপাশে ঘুরছে। হাত-পা-মুখ নিঃসাড় পড়ে আছে, কোনভাবেই নাড়াতে পারলেন না।
হঠাৎ একটা ছায়া এসে তীব্র আলো থেকে আমিন সাহেবকে আড়াল করলো। আমিন সাহেবের মুখের উপর ঝুঁকে থাকা ছায়া ধীরে ধীরে অস্পষ্ট অবয়ব পেল। চুল, কপাল, নাক, মুখ, ঠোঁট- আলো আধাঁরিতে ধূসর তার স্ত্রীর আবছা চেহারা। ভুলো মন তার, কত কথাই ভুলে যান। কত কথাই মনে রাখতে পারেন না, মনে করে বলতে পারেন না। জরুরি কথাটা বলা হয়নি, মরণের পরে কোথায় ঘুমাতে চান। বলার জন্য মুখ খুললেন, কিন্তু ঠোঁট জোড়া কিছুতেই নাড়াতে পারলেন না; বিন্দুমাত্র না, সকল শক্তি নিঃশেষ করেও না।
তীব্র সাইরেনের শব্দ কানে এলো আমিন সাহেবের, ক্রমশঃ তা আরো তীব্র, আরো তীক্ষ্ণ, আরো প্রবল। আবার ধীর হয়ে থেমে যেতে যেতে আগের তীক্ষ্ণতায় ফিরে এলো। রাতের নীরবতাকে খুন করে রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স।
মিলন কিবরিয়া। কথাকার ও অনুবাদক। পেশায় চিকিৎসক। জন্ম ১৯৬৬। নিবাস ঢাকায়।