| 17 জানুয়ারি 2025
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতীর ছোটগল্প: প্রশ্ন । মৌরী তানিয়া

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

ঘুম থেকে জেগে রফিক বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। চারিদিকে পাখিদের কিচির-মিচির শব্দ ভোর হওয়ার জানান দিচ্ছে। ভোরের আলো একটু একটু করে চারিদিকের অন্ধকারকে গিলে ফেলছে। টবে লাগানো টগর গাছের পাশে দাঁড়িয়ে নরম সাদা ধব ধবে আবেশ ছড়ানো ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে একটি সিগারেট ধরায় সে। আজ রফিকের মনে আবারও সেই প্রশ্নটি জাগে। সিগারেটের আগুনটা দু’ আঙুলে ঠেকলে চমকে তাকিয়ে সে দেখল সেটি পুড়ে শেষ হতে চলেছে। তাতে একবারও টান দিয়েছে কিনা সে মনে করতে পারছে না। রফিকের খুব অস্থির লাগছে আজ। বহুবছর পূর্বে আজকের এই দিনেই প্রশ্নটি প্রথম তার মাথায় আসে। সেদিনের পর থেকে পঞ্চাশ বছরের এই জীবনে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে প্রশ্নটি। কিন্তু কোন উত্তর পায়নি সে। রফিক ভাবে, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আমি কি এই প্রশ্নের কোন উত্তর পাব না?

রফিকের বড় আব্বা মানে তার বাবার বড় ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে বকুল। রফিকের কাছে সে বকুল বুবু। বকুলের জন্মের পর বহুবছর পর্যন্ত রফিকের বড়ব্বার আর কোন সন্তান সন্ততি না জন্মানোয় সবাই প্রায় ধরেই নিয়েছিল তার আর কোন সন্তান জন্মাবে না। পরিবারের বড় মেয়ে হওয়ায় সবার খুব আদরের সে। বকুলকে স্কুলে ভর্তি করানো হলো কিন্তু পড়াশুনায় একেবারে মন নেই তার। ক্লাস এইট পাশ করার পর সে বেঁকে বসল আর স্কুলে যাবে না। সবাই তাতেই সায় দিলেন, থাক এক বাবার এক মেয়ে, পড়াশুনা না করলেও ভালভাবেই তার দিন কেটে যাবে। তাছাড়া দেখতে শুনতে মারশাল্লাহ অপরূপ সুন্দরী সে। রফিকের বাবারা দুই ভাই। তার বাবা আর বড়ব্বা। তারা দুই পরিবার একই বাড়িতে থাকে। তবে রান্না-বান্না আলাদা। রফিকরা তিনভাই, একবোন। রফিক সবার বড়।

চাচাত ভাই হলেও বকুলের আট বছর বয়সে বাড়িতে প্রথম রফিকের জন্ম হওয়াই বকুলের কোলে পিঠে করেই মানুষ হয়েছে রফিক। বকুল বুবু রফিককে খুব ভালবাসে। সে সারাক্ষণ তার বকুল বুবুর সঙ্গেই খেলে, বকুল বুবুর সঙ্গেই থাকে। বকুল বুবুই তাকে খাওয়ায়, গোছল করায়, গুন গুন করে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। স্কুলে ভর্তি করানোর পর রফিক বকুল বুবুকে ছেড়ে একদম স্কুলে যেতে চাইত না। সারাক্ষণ বকুল বুবুর কাছে বসে গল্প শোনে। বকুল বুবুর পিঠে বসে ঘোড়া ঘোড়া খেলে। বুবুর চোখ গামছা দিয়ে বেঁধে কানামাছি খেলে। আরও কত কিছু খেলে! সমবয়সি ভাইবোন, বন্ধুদের সঙ্গে তেমন একটা খেলত না রফিক। তার চেয়ে বড় হলেও বকুল বুবুই তার খেলার সাথী, বকুল বুবুই তার মা, বোন সবকিছু। বকুল বুবু মাঝে মাঝে স্কুলে যাওয়ার জন্য রফিককে বকাঝকা করত।
বকুলের বয়স যখন আঠার ছুঁই ছুঁই করছে তখন তার বিয়ের জন্য সবাই অস্থির হয়ে উঠল। লেখাপড়া করলে তবুও একটা কথা ছিল। শ্রেফ বসে থাকা একটা মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে আর থাকা যায় না। কিন্তু রফিকের বড়ব্বার জমি-জমা খাবে কে? পরের ছেলে? মানে বকুলের যদি অন্য অপরিচিত পরের ঘরের কোন ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয় তাহলে তার বড়ব্বার যেটুকু জমি-জমা আছে তা সেই পরের ছেলের অধিকারে চলে যাবে। এসব চিন্তা করে বকুলকে বিয়ে দেয়া হলো তার নিজের খালাত ভাই বরকতের সঙ্গে। কিন্তু এ বিয়েতে বকুলের বিন্দুমাত্র মত ছিল না। এককথায় তার অমতেই বিয়েটা হয়ে গেল।

বকুলের মতো এমন রুপসী মেয়ে বরকতের মতো এমন ঢ্যাংগা, হাবলাকে পছন্দ করবে না এটা খুবই স্বাভাবিক। বরকত দেখতে কালো, ঠ্যাং ঠ্যাংগে লম্বা। শুধু তাই হলে তাও হতো, বুদ্ধি সুদ্ধিও কম বরকতের। সবাই তাকে আড়ালে হাবলা বলেই ডাকে। বকুল বিয়ের আগে মুখের উপর হাবলা বলত বরকতকে। এমন হাবলা একটা ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হবে সে কস্মিনকালেও ভাবেনি। কি করবে! বিয়ে যখন হয়েছে তখন সংসার করতেই হবে। সংসার আর কি! বকুল বহাল তবিয়তে বাবার বাড়িতেই রয়ে গেল। বকুলের স্বামী বরকত ঘরজামাই হয়ে তাদের বাড়ি চলে এল।

বকুলের বিয়ের বছর খানেক পর রফিকের বড়ব্বার একটি ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে। ছেলে জন্মানোর পরও বরকতের ঘর জামাই থাকার বন্দোবস্তটি বলবৎ থাকল। বলবৎ না থেকে উপায় নেই, বরকতরা খুব গরিব, বাড়িঘর, চাল-চুলার কোন ঠিক নেই। অতি আদুরে মেয়ে বকুল সেখানে যেয়ে একরাতও থাকতে পারবে না সেটা সবার জানা। নিজের ভাইয়ের চেয়েও বকুল রফিককেই বেশি ভালবাসে, বেশি আদর করে। বিয়ের প্রায় বছর দুয়েক পর বকুলের একটি ফুটফুটে মেয়ে জন্ম নিল। রফিকসহ বাড়ির সবাই ওকে খুব আদর করে। একমাত্র ভাগনি! দেখতেও বকুলের মতোই। সবার আদর স্নেহে রফিকের ভাগনি বড় হতে লাগল। ভাগনি জন্মানোর পরও রফিকের প্রতি বকুলের আদর একটওু কমেনি।

বিয়ের প্রায় বছর তিনেক পার হওয়ার পর রফিকরা খেয়াল করতে লাগল বকুল সকালে খেয়েদেয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে তাদের বাড়ির কাছে যে রাস্তাটি বাজার থেকে সোজা এসে তাদের পাড়ার মধ্যে ঢুকেছে সেই রাস্তার উপরের সাঁকোতে এসে বসে। দুপুর পর্যন্ত সেখানেই থাকে, দুপুরে খেয়ে মেয়েকে ঘুমিয়ে দিয়ে আবার সেই সাঁকোতে এসে বসে, সূর্য ডুবে যায় তবুও বকুলের বাড়িতে ফেরার হুঁশ থাকে না। আগে যে একেবারে বকুল সাঁকোতে যেত না তা নয়। গরমের দিনে মাঝে মাঝে বিকেল বেলা পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে সাঁকোতে বসে আড্ডা দিত, শীতের সময় সাঁকোতে বসে রোদ পোহাত। কিন্তু এখন সে শুধু বাড়িতে খায় আর সাঁকোতে এসে কুলি ফেলায় অবস্থা। সেই সাঁকো বরাবর বাজারের মধ্যে সাইদুর চেয়ারম্যান তার গুদাম ঘরে বসে ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা করত, গ্রামের লোকজনের বিচার সালিশ করত আর সাঁকো বরাবর গুদাম ঘরের জানালা দিয়ে বকুলের সঙ্গে চোখাচখি করত। ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছরের সাইদুর চেয়ারম্যান দেখতে বেশ সুদর্শন ও যৌবনোদীপ্ত।

বরকত আলাভোলা মানুষ। কিছুই বুঝতে পারে না। বরকত বুঝতে না পারলেও বকুল আর সাইদুর চেয়াম্যানের প্রেমকাহিনী সারা গ্রামের মানুষের মধ্যে চাউর হতে বেশিদিন লাগল না। বকুলের এই প্রেমকাহিনীর জন্য রফিকের বড়ব্বা-বড়ম্মা, রফিকের বাবা সবাই বরকতের আড়লে বকুলকে অনেক বকাবকি করে কিন্তু বকুলের সেই এক কথা, সব মিথ্যা। বিবাহিত মেয়েকে আর কিভাবে শাসন করবে সবাই! মারতে তো আর পারে না। তাছাড়া অতি আদরের মেয়ের প্রতি কঠোর হতেও সাহসে কুলায় না। আল্লাহ না করুক যদি কিছু করে ফেলে! বকুল যতই বলুক মিথ্যা কথা। কিন্তু কথাটা যে মিথ্যা নয় তা বকুলের ন্যাওটা রফিক সেই সাঁকোর পাশে চারিদিকে ডাল পালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিমুল গাছের তলায় শিমুল ফুল কুড়াতে কুড়াতে সাইদুর চেয়ারম্যানের সঙ্গে বকুলের চোখের ঠাড়া টেঁপা দেখে ঠিকই বুঝতে পারে। কিশোর বয়সে পা দিলেও বকুল বুবুর আশে পাশে থাকতেই ভালো লাগে রফিকের। বকুলও যতই প্রেম করুক রফিককে তার সঙ্গে চাই। কিছুক্ষণ রফিককে না দেখলেই অস্থির হয়ে উঠে সে। বৈশাখ মাসের খাঁ খাঁ দুপুরে আগুন ঝরা রোদের ভয়ে যখন সবাই ঘরে থাকে তখন সাঁকোর সামনের জমির সরু আলের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রফিক দেখে, বকুল বুবু আর সাইদুর চেয়ারম্যান একটু দূরে জমির পাশের জঙ্গলে গল্পগুজবে মেতে উঠেছে।

একদিন বকুলের স্বামী বরকত তার বাবার বাড়ি হিন্দা গ্রামে গেল। বাবার বাড়ি থেকে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসার কথা বরকতের। রওনাও দিয়েছিল সেই মোতাবেক। কিন্তু মাঝ রাস্তায় আসার পর কয়েকজন সন্ডা মতো লোক বরকতের সাইকেলটি জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। অসহায় বরকতকে তাই বাকি পথটা হেঁটেই আসতে হয়। আর হেঁটে আসার কারণে কুসুমসরের বিশাল পাকুড় গাছটার কাছে আসতে তার সন্ধ্যা হয়ে যায়। কুসুমসরের সোজা রাস্তাটা বেঁকে যেখানে হিন্দা যাওয়ার রাস্তার সঙ্গে মিশেছে সেই মিলনস্থলেই বিশাল পাকুড় গাছটা যেন পুরা আকাশটা ছেয়ে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছে। ভর দুপুরে বা সন্ধ্যার পর নির্জন এই গাছতলায় গেলে যে কেউ দেখতে পায় পাকুড় গাছের উঁচু ডালে সাদা ধবধবে কাপড় পড়ে বিশাল লম্বা একরাশ চুলের গোছা পিঠে ছড়িয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে সাজেদা পেত্নী। এই গাছটিতেই বহু বছর আগে কুসুমসরের যুবতী মেয়ে সাজেদা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে মরে। আর সেই থেকেই পেত্নী হয়ে সাজেদা এই গাছের ডালে ডালে, পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যা আর ভর দুপুর বেলা সাধারণত সবাই এই পথটা এড়িয়ে চলে, ঘুরে হলেও অন্য পথ দিয়েই যাওয়া আসা করে সবাই।

বরকত ভেবেছিল বেলা থাকতেই কুসুমসরের পাকুড় গাছটা পার হতে পারবে সে। কিন্তু সাইকেল হারানোর পর যে সে বাবার বাড়িতে ফিরে যাবে তারও উপায় নেই। কারণ বকুলের কড়া হুকুম আজই আসতে হবে। পরদিন হাটবার। বকুল বিশাল একটা ফর্দ হাটবারের দিন বরকতকে ধরিয়ে দেয়। বকুল সাজগোজ আর খাওয়া-দাওয়া করতে খুব পছন্দ করে। সারা সপ্তাহের সাজগোজের সরঞ্জাম আর খানাপিনার তালিকায় ভরা থাকে এই ফর্দ। বিয়ের আগে রফিকের বড়ব্বা এই ফর্দ অনুসারে সব জিনিস হাজির করত। বিয়ের পর বরকত এই কাজটি করে। টাকা অবশ্য রফিকের বড়ব্বার তহবিল থেকেই যায়।

যাইহোক ঘুরে অন্য পথে যাওয়ারও উপায় নেই বরকতের। কারণ এদিকের অনেকটা পথ সে পার হয়ে এসেছে। অন্য পথে গেলে তার ফিরতে মাঝরাত হবে। তাই সে কুল-কলমা, দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে কুসুমসরের পাকুড় তলার নীচ দিয়েই আসার সিদ্ধান্ত নেয়। দিনের বেলাতেই এমন ভয়ংকর যে কুসুমসরের পাকুড় তলা, তার তলায় রাতের বেলা দাঁড়ালে যে কাউকে সাজেদা পেত্নীর গলা টিপে ধরবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বরকতকেও তাই করেছে সাজেদা পেত্নী। বরকত প্রাণপনে সেই সাজেদা পেত্নীর হাত থেকে নিজের গলাটা ছাড়িয়ে নিয়ে দেয় এক দৌড়। বেশ রাতে রফিকদের বাড়ির উঠানে এসে দড়াম করে পড়ে যায় সে। রফিকসহ বাড়ির সবাই তাকে ঘিরে ধরে। বড়রা সবাই মাথায় পানি ঢালে, মুখে -চোখে পানি ছিটিয়ে দিলে জ্ঞান ফিরে আসে বরকতের। জ্ঞান ফিরে চোখ একটুখানি খুলেই জড়ানো গলায় বরকত বলে, সা-সা-জে-জে-দা-পে-পে-ত্নী । আবার চোখ বন্ধ করে সে। সবাই বুঝল, রাতের বেলা কুসুসরের পাকুড়তলা দিয়ে আসার কারণে তার এই দশা। সকাল হলে আজহার মওলানাকে ডেকে এনে ঝাড়ফুক দিলেই ঠিক হয়ে যাবে বরকত। রফিকের বড়ম্মা বরকতের কানের কাছে জোরে জোরে আয়তাল কুরছিসহ অনেক সুরা, কুল,কলমা পড়তে শুরু করল। একটু পরেই বরকত চোখ মেলে তাকিয়ে উঠে বসল। রফিকরা সবাই শুতে গেল। বকুল আর বরকতও তাদের ঘরে গেল। হঠাৎ মাঝ রাতের দিকে বকুলের গলা ফাটানো চিৎকারে রফিকরা হুড়মুড় করে উঠে দেখল, বরকতের মুখ দিয়ে সাদা সাদা ফেনা উঠছে, চোখ দুটি যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সারা শরীর কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ নিথর হয়ে গেল বরকত। বাড়ির সবাই বলল, সাজেদা পেত্নীর হাত থেকে বরকতকে বাঁচানো গেল না!

বকুলের অবস্থা খুবই সঙ্গীন। সে চিৎকার করে বিলাপ করছে আর কাঁদছে। বকুলের বিলাপ থেকে রফিকরা জানতে পারল, রফিকের বড়ম্মা দোয়াদরুদ পড়ার পর ঘরে যেয়ে বরকত একটু সুস্থ্য বোধ করলে তার সাইকেল ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাসহ সব বিস্তারিত বলে বকুলকে। এরপর সে বকুলের কাছে ভাত খেতে চায়। বরকতের আসতে রাত হচ্ছিল দেখে বকুল খাওয়ার পর বরকতের জন্য ভাত সাজিয়ে নিয়ে ঘরে রেখে দিয়েছিল। বরকত সেই ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর নাকি সাজেদা পেত্নী আমাকে গলা টিপিস না, মারিস না, আমাকে ছেড়ে দে আরও কি কি সব বলতে শুরু করে বরকত।

বকুলকে কেউ আটকাতে পারছে না। বরকতের লাশের উপর দড়াম করে পড়ছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। সবাই ধরা ধরি করে এনে শুইয়ে দিচ্ছে, কিন্তু না, সে আবারও ছুটে খলায় রাখা বরকতের লাশের উপর আছড়ে পড়ছে। পাগলের মতো কাঁদছে, উপুর হয়ে খলার মাটিতে মাথা আছড়াচ্ছে, হাত পা ছুড়ছে। একটু পর পর মুর্ছা যাচ্ছে। পুরো খলা লোকে লোকারণ্য। রফিকের কাছে মনেহলো, গ্রামের আর দশটা বউয়ের চাইতে বকুল বুবু স্বামীর মৃত্যুতে যেন খুব বেশি ভেঙ্গে পড়েছে, খুব বেশি কান্না-কাটি করছে, খুব বেশি আছাড়ি পিছাড়ি করছে। কারণ গ্রামের অনেক স্বামীকেই তো মরতে দেখেছে রফিক। কিন্তু কারও বউকেই বকুল বুবুর মতো এত ছুটা ছুটি করে স্বামীর বুকে আছড়ে পড়ে কাঁদতে দেখেনি, এত আছাড়ি পিছাড়ি করতে দেখেনি রফিক। রফিকের মনে হলো, আহা! কাঁদবে না! বেঁচে থাকতে বরকত দুলাভাইয়ের সঙ্গে একটু মিষ্টিমুখে কথা বলতে শুনিনি কখনও, সারাক্ষণ শাসনের উপর রাখত বরকত দুলাভাইকে। আর সেজন্যই হয়ত বুবুর আজ এত কষ্ট হচ্ছে। হাজার হলেও স্বামী তো! বকুল বুবু কাঁদছে, রফিকও কাঁদছে। বরকত দুলাভাইয়ের শোকে নয়, বকুল বুবুর কষ্টে কাঁদছে রফিক।

বকুলের এমন গগন বিদারি কান্নার মধ্যে খলা ভর্তি মানুষের ভিড়ে কিছু লোককে ফিসফাস করে বলতে শুনল রফিক, ‘বিষ খাওয়াইছে। সাইদুর চেয়ারম্যানের সাথে লিকা বসার জন্য বিষ খাওয়ায়ে এমন ফেরেস্তার মতো ভাল স্বামীটাক মাগি মারে ফেলছে। এখন আবার ভঙ্গি করোচে। সব ভঙ্গি বুঝলিন, সব ভঙ্গি। সাইদুর চেয়াম্যানের সাথে লিকা বসা লাগবে না মাগির। আল্লায় মাগির বিচার…।’ রফিক চারপাশে তাকিয়ে ঠাহর করার চেষ্টা করল, কে কথাগুলো বলছে। কিন্তু মৌমাছির চাকের মতো ভন ভন করা ভিড়ের মধ্যে কে কথাগুলো বলছে তা বুঝতে পারল না সে। এমনিতেই বকুল বুবুর জন্য কষ্টে রফিকের বুকটা ফেটে যাচ্ছে! তার উপর এমন মিথ্যে অপবাদ! এমন অবান্তর কথা! রাগে রফিকের মাথাটা দপ করে বারুদের মতো জ্বলে উঠল! সেই মুহুর্তে যদি বকুল বুবুকে মিথ্যে অপবাদ দেয়া লোকগুলোকে রফিক দেখতে পেত, তবে নির্ঘাত সে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলত। খলা থেকে ইট, পাথর যা পেত কুড়িয়ে নিয়ে ওদের মাথায় ছুড়ে মারত রফিক। কিন্তু ভাগ্য ভাল লোকগুলোকে রফিক দেখতে পেল না।

কাঁদতে কাঁদতে রফিক ভাবে, আমার বকুল বুবু সাইদুর চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রেম করে সেটা ঠিক, গ্রামে তো অনেককেই এমন প্রেম করতে দেখি আমরা। কেন, আমাদের গোপাল মাষ্টার কত সুন্দর! তারপরও তার বউ হেমন্তর সঙ্গে প্রেম করে না! কে না জানে সেই কথা! আর বকুল বুবুর মতো এমন রুপসী মেয়ের বরকত দুলাভাইয়ের মতো এমন কুৎসিত চেহারার হাবাগোবা স্বামী থাকলে তো প্রেম করবেই। তাতে আমি বকুল বুবুকে একটুও দোষ দেই না। বরং বকুল বুবু যখন সাইদুর চেয়ারম্যানের সঙ্গে গল্প করতে করতে খিল খিল করে হেসে ওঠে তখন দূর থেকে সেই হাসির শব্দ শুনে বুকটা খুশিতে ভরে উঠে আমার। হাসিখুশি বুবুটা আমার বিয়ের পর যেন হাসতে ভুলে গিয়েছিল! খলবলিয়ে বেঁয়ে চলা ভরা নদীটি হঠাৎ শুকিয়ে যেন মরা নদীতে পরিণত হয়েছিল! কতদিন বকুল বুবুকে লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছি! আমি বুঝি বুবুর সেই বুক ভরা কষ্ট! কেন সবাই বকুল বুবুকে তার অমতে জোর করে বরকত দুলাভাইয়ের মতো একটা হাবাগোবা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিল! কেন! কেন! প্রেম করবেই তো বুবু, একশবার করবে, হাজার বার করবে। অনেক যোগ্যতা সম্পন্ন স্বামী থাকার সত্বেও গ্রামের অনেক বউরা প্রেম করে, আর বরকত দুলাভাইয়ের বউ হয়ে বুবু তো প্রেম করবেই। আমার বকুল বুবু প্রেম করতে পারে, বরকত দুলাভাইকে সারাক্ষণ শাসনের উপর রাখতে পারে, বকাঝকা করতে পারে, তবে বকুল বুবু যে নিজের স্বামীকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে একথা আমার বুকে কেউ ছুরি ধরলেও আমি বিশ্বাস করব না কখনও। কুসুমসরের ঐ পাকুড় গাছের সাজেদা পেত্নী প্রতি মাসেই দু-একজনকে যে গলা টিপে মেরে ফেলে সেটা আশপাশের দশ গ্রামের লোকেরা কে না জানে!

খলা থেকে বড় একটা ইট কুড়িয়ে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে রফিক কট মট করে চারপাশে তাকিয়ে, কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করে আর কেউ এমন কুকথা বলছে কিনা। এবার বললে ইট ছুড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলবে তাদের। কিন্তু না, সে দেখল, খলা ভর্তি মানুষের মধ্যে কেউ কেউ তার বকুল বুবুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে কাঁদছে, কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কেউ আবার খোশগল্প করছে।

দিন পনের-বিশের মধ্যেই বকুল স্বামীর শোক সামলিয়ে উঠে আবারও সেই সাঁকোর উপর সারাদিন কাটাতে লাগল। মাস চারেক পর একরাতে বকুল আর সাইদুর চেয়ারম্যানের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের রাত থেকেই সাইদুর চেয়ারম্যান বরকতের মতো ঘরজামাই হয়ে রফিকদের বাড়িতে থাকতে লাগল। সাইদুর চেয়ারম্যানের আগেকার বউ আছে, সেই ঘরে দুই ছেলে, দুই মেয়ে। চেয়ারম্যানের প্রায় নব্বই বিঘা জমি। এছাড়া তার বিশাল ব্যবসা। সঙ্গে চেয়ারম্যানগিরির আয় তো আছেই। প্রতি বছর বছর জমি কেনে সে। বিয়ের বছর দুয়েক পর বকুল চেয়ারম্যানকে একদিন বলল, তুমি মরে গেলে আমাকে দেখবে কে? আমার তো ছেলে নাই। তুমি তোমার কিছু জমি আমার নামে লিখে দাও। বকুলের মেয়ে জন্মানোর সময়ই কিসব জটিলতার কারণে তার জরায়ু কেটে ফেলা হয়েছে। সুতরাং চেয়ারম্যানের ঘরে তার আর কোন সন্তান জন্মানোর আশা নেই। চেয়ারম্যান বকুলকে বলে, আমি তোমার নামে দশ বিঘা জমি লিখে দিব। আমি মরে গেলে তোমার কোন অসুবিধা যেন না হয় সেই ব্যবস্থা করব। বকুল সকালে উঠেই বাড়ির সবাইকে কথাটা বলল। বেশ কবছর কেটে গেল। এরমধ্যে চেয়ারম্যান একবার মাইল্ড স্ট্রোক করে। তবে চিকিৎসা করে এখন সে পুরোপুরি সুস্থ। স্ট্রোক করার কমাস পর বকুল চেয়ারম্যানকে তার জমি লিখে দেয়ার বিষয়টি আবারও বলে। কিছুদিন পর এক সকালে বকুল আহল্লাদে আটখানা হয়ে বলল, আব্বা, চেয়ারম্যান দশ বিঘা জমি আমার নামে লিখে দিছে। আজ রাতে আমাকে জমির দলিল দেখাইছে। রফিকের বড়ব্বা জানতে চাইলেন, ভালভাবে দেখছিস তো মা?
আব্বা যে কি কন! নিজে পড়ে দেখলাম। দলিলে আমার নাম স্পষ্ট লেখা আছে। জমির দলিল কি আমি চিনি না! রফিক ইন্টামিডিয়েট পাস করে রাজশাহী ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। সে যখন ভার্সিটির শেষ বর্ষে তখন তার বড়ব্বা মারা গেলেন। ভার্সিটি শেষ করে রাজশাহীতেই মেসে থেকে চাকরির জন্য হন্নে হয়ে দৌড়াচ্ছে রফিক। ক’মাসের মধ্যে রফিক ব্যাংকে চাকরি পেল। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে বকুল বুবুর জন্য নীল জমিনে গোলাপি আর কচুপাতা রংয়ের সুতার কারুকাজ করা একটা শাড়ি কিনল সে। তিনটি রংই তার বুবুর খুব পছন্দ। সঙ্গে সঙ্গে শাড়িটি পড়ে খুশিতে গদ গদ হয়ে বকুল সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখিয়েছিল। বুবুর সেদিনের সেই খুশিভরা ঝলমলে মুখটা এখনও ভাসে রফিকের চোখের সামনে।

 

 

বকুলের বয়স পয়তাল্লিশ ছুঁই ছুঁই করছে। কয়েকবছর হলো মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে বকুল। কয়েকমাস ধরে রফিক দেখছে তার বকুল বুবু দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। সুন্দর চেহারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চোখ জোড়া ধীরে ধীরে গর্তে ডুবে যাচ্ছে। চেয়ারম্যন আর আগের মতো প্রতিদিন বকুলের কাছে আসে না। বকুলকে নিয়ে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে ছুটছে রফিক। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। বকুল দিনে দিনে হাড্ডিসার হয়ে যাচ্ছে। চেয়ারম্যান আর আগের মতো বকুলের কাছ থেকে শারিরিক ক্ষুধা মেটাতে পারে না বলে কয়েকমাসের মধ্যে বকুলকে তালাক দিল। কিছুদিনের মধ্যে সবাই জানতে পারল, চেয়ারম্যান বকুলকে দশ বিঘা জমি লিখে দিয়েছে বলে যে দলিল দেখিয়েছিল তা ভুয়া। পড়াশুনা বেশিদূর না করার কারণে বকুল বুঝতে পারেনি। আর পড়াশুনা থাকলেও ষড়যন্ত্র করে চেয়ারম্যানের বানানো এই ভুয়া দলিল সহজে কারও বুঝতে পারার কথা নয়।

কথাটি শোনার পর থেকে বকুল শূণ্য দৃষ্টিতে বোবার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু, কোন কথা বলে না। রফিক তাকে বুঝাচ্ছে, বুবু তুমি চিন্তা করো না। আমি আছি তোমার জন্য। তোমাকে আমি কোন কষ্ট পেতে দিব না। আমার জন্য তোমাকে বাঁচতে হবে বুবু! যেভাবেই হোক, যত টাকা লাগুক, আমি তোমাকে সুস্থ করে তুলবই বুবু। তুমি শুধূ ভেঙ্গে পড়ো না। কিন্ত চেয়ারম্যানের দেয়া ধোঁকা আর তাকে ছেড়ে যাওয়ার শোক বেশিদিন সামলাতে পারল না বকুল। মাস দুয়েকের মধ্যে বকুল মারা গেল! বকুল মারা যাওয়ার পর তার লাশকে ঘিরে গ্রামের লোকজন বলাবলি করতে লাগল, নির্দোষ স্বামীকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার শাস্তি বকুল পেল। কথাটি গ্রামের আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সেদিনই প্রথম রফিকের মনে প্রশ্ন জাগে, বকুল বুবু কি সত্যিই তার স্বামীকে বিষ খাইয়ে খুন করেছিল?

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত