এখন কোনকিছুই নিজের ইচ্ছেমতো করা যায় না। পারেন না। মাহমুদ হাসান দিনকাল বোঝেন। বয়স হলে সোনালি দিন হারিয়ে যায়। নতুন প্রজন্মের কাছে ছেড়ে দিতে হয় সবকিছু। তারা অন্য মানুষ। মন-মানসিকতায় ভিন্ন। সুতরাং কেউ সম্মান রক্ষায় কথার মূল্য দেবে বাহুল্য আশা। ইচ্ছের প্রতিফলন সহজে হয় না। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের কী মূল্য? তবু কয়েকবার আবদারের মতো অনুনয় সাধেন। যদি কাজ হয়। তার দু-চোখ সরু। চেহারা বিষাদ-করুণ। নিশ্চুপ শুকনো দীর্ঘশ্বাস। মন পোড়ে। মন মানে না। তিনি মায়ার বাঁধনে বন্দি। স্বপ্নমায়া জীবন। এই তো জগৎ সংসার। তিনি একজন পুতুল। পুতুলের কোনো অনুভূতি থাকে না। সাধ-আহ্লাদ-ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই।
তারপর পাণ্ডুর দৃষ্টি অকারণ এদিক-ওদিক ঘুরে এল। ড্রইংরুম পরিপাটি সাজানো। উত্তরে বিশাল স্ক্রিন এলইডি টিভি। শো’কেসের উপর ডাবল চেম্বার টেপরেকর্ডার। ডলবি মিউজিক সিস্টেম। তার নিচে ডিভিডি প্লেয়ার। বই-সিডি-ডিভিডির সংগ্রহ। পুব-দেয়ালে কোনো সংগীত শিল্পীর প্রমাণ-সাইজ পোস্টার। কাঁচাপাকা লম্বা চুল। কঠোর-রুক্ষ দৃষ্টির সঙ্গে স্মিতহাসি অদ্ভুত রহস্যময় লাগে। হাতে স্প্যানিশ গিটার। সোনালি-কমলা গোধূলি পটভূমিতে মায়াময়। আমেরিকান কোনো কান্ট্রি সিঙ্গার হবেন। যারা গান শোনে তাদের মন নরম হয়। শফিকের চেহারা কঠোর। মাহমুদ হাসান গলাতে পারলেন না। তার দু-চোখ মোজাইক মেঝেয় নেতিয়ে পড়ে।
অনেক আশা নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। চারশ কিলোমিটার পথ। দশ-এগারো ঘণ্টার বাসযাত্রা। সিটে ঠায় বসে থাকেন। ডায়াবেটিসের কারণে প্রস্রাবের ঘন ঘন চাপ। বাস তো তার কথায় থামে না। শেরপুরে ফুড-ভিলেজে কুড়ি মিনিট যাত্রা বিরতি। মানুষজন খেতে নেমে যায়। তিনি রিফ্রেশমেন্ট রুমে ছুটে গিয়ে স্বস্তি খোঁজেন। সেখান থেকে বেরিয়ে আকাশ দেখা। রাতের আকাশ। ছায়াবীথি। আকাশগঙ্গা। সেই মহাশূন্যের এককোনায় পৃথিবী। বিশাল জগত। এখানে অন্ধকার কোনো বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন। কেন? কী জন্য? কেন এই জনম? অকারণ মন-ভাবনা। তারপর বাস টাঙ্গাইলের রাস্তায় উঠে এলে আবার চাপ। উপায় কিছু নেই। কষ্ট করতে হবে। রাতের দেয়াল ভেদ করে ভোরের ঝাপসা আলো দেখা যায়। মনের মধ্যে আকাঙ্ক্ষার সূক্ষ্ম আলোকরেখা উঁকি। সারারাত বাইরের নিকষ অন্ধকার দেখলেন। কখনো দূরের আলো-আঁধার ঘরবাড়ি। আলোকিত হাটবাজার। দোকানপাট। মানুষজন। অজানা অচেনা পথ। সে-সবের মধ্য দিয়ে গন্তব্য। যেতে হবে। মেয়ের জন্য মন পোড়ে। প্রায়শ কাজ ভুলে যান। ভুল হয়। কোথায় দাঁড়িয়ে নাকি বসে আছেন বোধ থাকে না। আকাশে অকারণ দৃষ্টি মেলে রাখেন। চোখ জ্বালা করে। অবাধ্য নোনা জল দৃষ্টি ভেজায়। একলা বিশুষ্ক অশ্রু-কান্না। সবকিছু বুকের গহিনে লুকিয়ে রাখা। গোপন। কতদিন পারবেন জানেন না। একদিন বেরিয়ে গেলে কী হবে? মিলা প্রেশারের রোগী। কোনো বড় সমস্যায় পড়ে গেলে বিপদ। এসব ভাবনায় বুকে পাথর বেঁধে সহ্য করতে হয়। উপায় নেই। শেষে একদিন কথা বেরিয়ে গেল।
রাতে ঘুম হয় না। সারাদিনের যতটুকু ক্লান্তি-অবসাদ, রাত নয়-দশ এলে শরীর গড়িয়ে পড়ে; দু-চোখ বন্ধ। ঘুম হয়…হয় না। বিবিধ দুঃস্বপ্ন হানা দেয়। কখনো মধ্যরাত অথবা ভোর-ভোর ফ্যাকাশে আলো চোখ খুলে যায়। দেয়ালে অন্ধকার ছায়া। তাকিয়ে থাকেন। এপাশ-ওপাশ। অবশেষে টেবিল-ল্যাম্প অন করে বই দেখেন। পড়ার মন নেই। কবে কখন হারিয়ে গেছে জানা নেই। কোনোদিন হাজার স্মৃতি মন এলোমেলো করে দেয়। ভাবনা বিভোর স্থির সময়। পাবলিক লাইব্রেরির দোতলায় পুব-দক্ষিণের ঘর। এককোনায় বসে আছে বালক। সে বই পড়ে। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে অভিযান। মঙ্গল গ্রহের মানুষ। অ্যালিয়েনের সঙ্গে গল্প-আলাপ। বিজ্ঞানের জটিল সূত্র-সমস্যা-সমাধান। বালক চাঁদের শুকনো মাটিতে হেঁটে বেড়ায়। চরকাকাটা বুড়ি নেই। আকাশ কালো অন্ধকার। কখনো উল্কা আছড়ে পড়ে। আগুনের টুকরো। মহাশূন্যে লক্ষ তারার মিছিল। ছায়াপথ। হায় কি অনন্ত রহস্য! তার মধ্যে কত ক্ষুদ্র মানুষের জীবন। একবিন্দু বৃষ্টি। সেখানে জীবন ছটফট করে। তারপর বাষ্প হয়ে ভেসে যাওয়া। কিছু নেই…শূন্য তেপান্তর। সেই শূন্য প্রাণের কত আকুলতা। কত আবেগ। চাওয়া-পাওয়া হিসাবের খেরোখাতা। সুখ-দুঃখ। আনন্দ-বেদনা। বইয়ের পাতায় কালো অক্ষরের সাজানো লাইন ঝাপসা হয়ে যায়।
মিলা বিছানা ছেড়ে নামেন। বাথরুমে এগোতে পেছন ফিরে তাকান। ফ্যাকাশে-পাণ্ডুর চেহারা। ভেজা করুণ চোখ।
‘নিলুকে দেখতে ইচ্ছে করে। কেমন আছে মা আমার?’
‘কোনো স্বপ্ন দেখেছ?’
‘স্বপ্ন সে তো…ভালো লাগে না। মন খাঁ-খাঁ করে। দেখতে ইচ্ছে হয়।’
‘নিলুর মা, আমারও মন পোড়ে; দেখি একদিন ঢাকায় যাব। বেতন-টেতন পাই।’
‘কদিন ধরেই মন কেমন-কেমন করে। এমন তো হয় না। নিলুর কিছু হল না তো?’
‘তুমি অত ভেবো না। টেনশন কিসের? নিলু ভালোই আছে। মন্দ কিছু হলে খবর পেতাম না? শফিক তো ভালো ছেলে।’
মুখে বললেন বটে। যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টাও থাকে। মনে যে ঝড় বয়ে যায়, বৃষ্টি-শিলাবৃষ্টি-বজ্রপাত; টু-শব্দ হল না। সকল তাণ্ডব বুকের পাঁজরেই আবদ্ধ থাক। যেমনভাবে কত আশা-আকাঙ্ক্ষা মুছে দিয়েছেন। ভুলে গেছেন। এখন যে করে হোক মেয়ের কাছে যেতে হবে। দিন কয়েকের জন্য নিয়ে আসবেন। আজকাল যখন-তখন ট্রেন বা বাসে উঠে বসার তাগিদ জাগে। কোন্ কোচ কখন ছাড়ে? আসাদ গেট না গাবতলি অথবা মহাখালি? কোথায় নামলে সুবিধে? দু-একজনের কাছে সময়-শিডিউল-ভাড়া ইত্যাদি জেনে নেয়াও হল। সমস্যা…হাতে টাকাপয়সা নেই। ঢাকা যেতে-আসতে অন্তত হাজার তিনেকের ধাক্কা। মেয়ে-জামাই বাড়ি গেলে আরও কিছু। তিনি দিন গুনে গুনে সপ্তাহ অপেক্ষা করেন। অবশেষে সেদিন বেতন তুলে বাড়ি ফিরে খুব চঞ্চল-অস্থির।
‘নিলুর মা আমার ব্যাগ গুছিয়ে রাখো। একটা সার্ট, লুঙ্গি আর টুথব্রাশ। বোতলে পানি। মেয়েকে দেখতে যাব…না না আনতে যাব। রাতের বাস।’
মিলা এগিয়ে এসে চমকে-থমকে অস্থির। থালাবাসন পরিষ্কার করছিলেন। তখনো একহাতে প্লেট অন্যহাতে স্ক্র্যাব-প্যাড। খেয়াল নেই। চোখে-মুখে খুশির আভাস। মাহমুদ হাসানের মন ভরে গেল। অনেকদিন এমন উজ্জ্বল মুখছবি দেখেননি। মিলা কাছে এসে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করেন, –
‘একাই যাবে?’
‘তেমন টাকা তো নেই। তা ছাড়া তুমি মেয়েমানুষ, কোনোদিন ঢাকা যাওনি, অনেক দূরের পথ; কোথায় কীভাবে নিয়ে যাব? নিলুর জন্য দুটো দিন না হয় ধৈর্য ধরো।’
‘আচ্ছা।’
মাহমুদ হাসান অবশেষে নিশ্চুপ দীর্ঘশ্বাস না ছেড়ে পারলেন না। আশাহত চেহারার অর্থ বোঝেন। মিলাকে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়, কিন্তু অল্প কয়েকটি টাকা; সাহস বা ভরসা কম। কোনোদিন স্ত্রীর কোনো সাধ-আহ্লাদ পূরণ করতে পারেন নাই। তেমন করে কোনো চাওয়া নেই মিলার। অল্পেই খুশি। ত্রিশ বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। মানুষটি জীবনের প্রত্যেক মুহূর্ত বেঁধে রেখেছেন। তার নিশ্বাসে না বলা অনেক কথা সহজে বুঝতে পারেন। মাহমুদ হাসানের মন বিমর্ষ অন্ধকার হয়ে গেল। এখন তবে কী করবেন? উপায় নেই। একাই যেতে হবে। এভাবেই জীবন চলে যায়।
বেসরকারি শিক্ষকতার চাকরি। চল্লিশ-পয়তাল্লিশ দিনের মাস পেরোলে কিছু টাকা হাতে আসে। পরিবারের বিবিধ খরচ মিটিয়ে তেমন অবশিষ্ট থাকে না। ঢাকা যাওয়া মানে ফিরে এসে ধারকর্জ করতে হবে। সংসারে আরও দু-জন ছেলেমেয়ে আছে। টাকা রাখতে হয়। পড়ালেখা-খাওয়া খরচ ইত্যাদি।
একদিন কলেজ শেষে ফেরার পথে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত অনেক কথা হল। শামীম আকন্দ রসায়নের প্রভাষক। কলেজের ধারেকাছে বাড়ি। যেতে যেতে জিজ্ঞেস করেন, –
‘মাহমুদ ভাই আপনার বড়মেয়ে কী পড়ছে? কতদূর কী?’
‘এই তো থার্ড ইয়ার, অথচ পাঁচ বছর হতে চলল। ইংরেজি। বুঝলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা বেশ কষ্টের।’
‘বাহ্ ভালো সাবজেক্ট! রাজশাহি বা ঢাকা ইউনিভার্সিটি দিতেন। এতদিনে বেরিয়ে আসত।’
‘সে-রকম আর্থিক অবস্থা থাকলে সমস্যা হতো না ভাই। কী আর করা যাবে।’
‘আর দুটো কী করে?’
মাহমুদ হাসান এই গল্প অনেকবার করেছেন। একই বিষয় বারবার বকতে ভালো লাগে না। বিরক্তি আসে। তারপরও কথা বলতে হয়। গভর্নিং বডির লোক। শিক্ষক প্রতিনিধি। ফাউন্ডার ডনর। আলাপ না করলে উলটো মানে হতে পারে। কোনো কোনোসময় অন্য সদস্য বেতন কত পান জিজ্ঞেস করে বসেন। কার বেতন কত জিজ্ঞেস করতে নেই। খারাপ লাগে। তিনি জবাব দেন। গ্রামের মানুষ সেন্সিটিভ। চোখ ওলটাতে সময় নেয় না।
‘ছেলে হিসাববিজ্ঞানে প্রথম বর্ষ। ওর উপরে ছোটমেয়ে। ইন্টার দেবে। সাপোর্ট দিতে পারছি না ভাই। ওরা বেশ মেধাবী…উদ্যোগী। নিজের কাজ মনোযোগ দিয়ে করে। আমি তো ফাঁকিবাজ ছাত্র ছিলাম।’
‘কি যে বলেন! আপনি তেমন ছিলেন নাকি? দায়িত্বশীল মানুষ। অনেককিছু পড়েছেন। মেয়ের তো বিয়ে দিতে হবে। প্রস্তুতি কেমন?’
‘তেমনকিছু করতে পারিনি শামীম ভাই। বড় টেনশনে আছি। সোনার ভরি ষাট হাজার উঠে গেল। যে আয় করি তাতে ঠিকমতো চলা দায়। জায়গাজমিও নাই। কি যে করি!’
‘জমিজমা নাই…বলেন কি? একজন রিকশাওয়ালারও তো দু-চার কাঠা জমি আছে। কী করলেন আপনি?’
মাহমুদ হাসানের মন খারাপ হয়ে গেল। কী বলবেন? পড়ালেখা শেষে সরকারি চাকরির চেষ্টা করেছেন। তদবির করতে ছাড়েননি…তকদিরে জুটল না। মুক্তিযোদ্ধা বা সন্তান-নাতি নন। টাকার জোর ছিল না। মামা-চাচা-রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক কিছু নেই। কয়েক ডজন পরীক্ষা-ইন্টারভিউ দিয়েছেন। এভাবে সাতাশ বছরের সীমারেখা শেষ। তারপর? সেই ইতিহাস মনে করতে চাইলেন না। সময়ের কাজ সময়ে করতে না পারলে কোনোকিছু হয় না। এ তার দোষ, ভাগ্যলিপি; অন্য কারও নয়। নিজেকে যতই দক্ষ ভাবুন না কেন, এই সংসারে কোনো মূল্য নেই; অযোগ্য মানুষ। তিনি শামীমের দিকে অপাঙ্গে তাকালেন। একমুহূর্ত। তারপর আশপাশের দৃশ্য। আকাশ-দিগন্ত। ফসলের ক্ষেত। অনেক দূরের সবুজ-শ্যামল ছায়াঘন গ্রাম। গাছগাছালির মেঘলা দৃশ্যপট। এই মায়াময় পৃথিবীতে একটুকরো জমি নেই তার। বুকে শূন্য ধু-ধু মরুভূমি। বিশুষ্ক হাহাকার। তেপান্তরের মাঠ কি এরচেয়ে প্রলম্বিত, দূর আরও দূর; কতদূর চলে গেছে? সময়ের ও-প্রান্তে ভিন্নমাত্রায়? তিনি সেই প্রান্তর পেরিয়ে যান। কেউ তো পেছন থেকে ডাক দিল না। মায়াকণ্ঠে বলে উঠল না, ‘মাহমুদ…এই মাহমুদ, মাহমুদ হাসান; পেছন ফিরে তাকা বাবা।’ তিনি ঘুরে তাকালেন। বাবাকে একনজর দেখার অদম্য সাধ। কেউ নেই। শূন্য খাঁ-খাঁ তেপান্তর। অনেক কষ্ট করেছেন বাবা। কোনোদিন তবু কষ্টের কোনো দাগ মুখছবিতে দেখা গেল না। কেমন করে পেরেছেন? জানতে ইচ্ছে হয়। আজ তিনিও বাবা। অনেক বিষাদ বুকে চেপে রাখেন। জীবন-বেঁচে থাকা-কষ্ট গল্পপাঠ ভারবাহী পশুর মতো বয়ে বেড়ান। অথবা পালিয়ে যান। অস্তিত্বের পলায়ন। চোখে-মুখে কষ্টের জলছাপ। তিনি আরও একবার পেছন ফিরে তাকান। পাথর হতে মনঃসাধ। পাথর হলেন না। এই বেঁচে থাকা ব্যর্থনীল যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। অনেক ঊর্ধ্বে চলে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। পারলেন না। তিনি তো পাথর। তার দৃষ্টি ঝাপসা।
‘মাহমুদ ভাই মেয়ের বিয়ে দেবেন? আমার হাতে ভালো ছেলে আছে। ঢাকায় থাকে। ইউনিভার্সিটির টিচার। মা-বাবা কেউ নেই। একটি বোন। আমেরিকায় সেট্ল্ড।’
‘এ তো অনেক বড় সন্বন্ধ! আমার হাত কি অতদূর যাবে?’
‘সেই ভাবনা নাই। ছেলের মামা আমার বন্ধু-মানুষ। ওদের টার্গেট সুন্দর চরিত্রের মেয়ে। শিক্ষিত। আপনার মেয়েকে দেখেছি। লক্ষ্মী প্রতিমা।’
মাহমুদ হাসানের বুকে সাগরের ঢেউ। আকাশসীমা ছুঁয়ে থাকা জল-কল্লোল। চিকমিক বালিয়াড়ি। মন অকারণ স্বপ্ন-বিলাসী হতে চায়। লোভী। এরকম একটি সন্বন্ধ, জামাই পেলে; মেয়ে তার সুখী হবে নিশ্চয়। বিত্ত-বৈভবে কোনো কষ্ট থাকে না। এখন তবু জিজ্ঞাসা…ছেলে কেমন? ড্রাগ-অ্যাডিক্ট বা অন্যকিছু? আজকাল মানুষ চেহারায় মুখোশ সেঁটে গরিব ঘরের মেয়ে বিয়ে করে। মাস দু-চার পর বিদেশ নিয়ে যায়। তারপর কোনো খোঁজ থাকে না। খবর পাওয়া যায় না। কী হয় তাদের? তিনি ভাবনা-দুভার্বনার রেশ টেনে ধরেন। কী-সব যা-তা চিন্তা আসে। কেন ভাবেন? শামীম আকন্দ কাঁচা কথা বলবেন? এই সন্বন্ধ হাতছাড়া হয়ে গেলে পস্তাতে হবে। সবসময় সুযোগ আসে না। কোনোকিছু ভালোর জন্য একটু ঝুঁকি তো নিতে হয়। অবশ্য বিয়ের ব্যাপার। খোঁজখবর নিয়েই কাজ। তিনি ভাবনার দোলায় কিছু বলতে পারলেন না। চোখের সামনে দিয়ে বাস চলে গেল। একদৃষ্টিতে সহকর্মীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।
‘এ তো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া রে ভাই, বিশ্বাস হতে চাইছে না।’
‘আপনি সম্মতি দিলে পাত্রকে আসতে বলি। মেয়ে দেখে যাক। আর নিশ্চিত থাকেন, কোনোরকম যৌতুক নেবে না; কঠোর আদর্শবাদী ছেলে।’
মাহমুদ হাসান এই একটি কথায় দুর্বল হলেন। সৎ আদর্শবান মানুষ, এরা আর যা হোক; মাথা উঁচু করে বাঁচে। তারপরও সময় দরকার। বাড়িতে আলাপ করতে হয়। টাকার সংস্থান। সবকিছু ঠিকঠাক হলে তবেই…।
প্রায় ছয় মাস, নিলুর বিয়ে হয়ে গেছে। শফিক ভালো ছেলে। যেমন দেখতে, সুন্দর কথাবার্তা; পরিচ্ছন্ন আচরণ। অচেনা কোনো আকর্ষণের দ্যুতি। মাহমুদ হাসানের পছন্দ। তাই যেমনভাবে খোঁজখবর নেয়ার কথা ভেবেছিলেন, আবশ্যকতা পান নাই; নিলুর সঙ্গে মানাবে। ফেস ইজ দ্য ইন্ডেক্স অব মাইন্ড। এমন জামাই পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা ছিল। তেমন বিষাদ-মেঘ নেই, একদিন পরের বাড়ি যেতে হবে, আপন করে নিতে হবে; জানে। তারপর মন হালকা উদাস। একটু বোধকরি দায়মুক্তি-পুলক। মাহমুদ হাসান এখন কোথাও কোথাও গর্বের সঙ্গে বলেন, শফিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। বেসরকারি একজন প্রভাষকের মেয়েজামাই কত বড় পদে আছে, এ তার নিজের অহংকার। মেয়ে সুখে আছে মনে বিশ্বাস। তিন মাস পর ঢাকায় আসেন। শফিক অনেক যত্ন-আত্তি করে। কি খাওয়ায় আর কি না খাওয়ায়! নিজ হাতে পরিবেশন। নিলুর দৃষ্টিতে আনন্দ-খুশি। এতকিছু দেখেশুনে মন তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। আনন্দে দু-চোখ বারবার ভিজে যায়। আহা কত কষ্ট করেছেন! কত কষ্ট সয়েছে কলিজার টুকরা। আদরের মেয়ে! কলেজের বেতন আর আনুষঙ্গিক খরচের জন্য সন্ধের সময় টিউশনি যায়। তিনি আশঙ্কা-ভাবনায় আধমরা থাকেন। শহরের রাস্তা-অলিগলি রিকশা-বাস-ট্রাক, ভিড়-যানজট, নানান মানুষজন, ভয় লাগে; হাজার অপরাধ। নিষেধ করতে পারেন না। ক্ষমতা নেই। মেয়ের অনেক কাজে লাগে দু-আড়াই হাজার টাকা। তারপরও একদিন বলে ফেলেন, –
‘মা টিউশনিটা বিকেলের দিকে শিডিউল করে নেয়া যায় না?’
‘তখন তো ওরা স্কুলের টিচারের কাছে পড়ে। সেই টিচারের আবার অনেক দাম।’
‘বেশ ধনী পরিবারের সন্তান?’
‘ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে বুঝতে পারছ না। আমাদের পোড়াকপাল কোথায় পড়ি…।’
তিনি নিশ্চুপ-স্থির। কী বলবেন? নিজের অক্ষমতা জেগে ওঠে। পরিবারে সকলের টাকা দরকার। এটা-ওটা বিবিধ প্রয়োজন-চাহিদা। সবদিক সামলানো যায় না। পারেন না। এজন্য মৌন অভ্যেস। জীবনে কত না প্রত্যাশার মৃত্যু। কত জায়গায় অপমানিত হন। সন্তানের কাছে হতে চান না। কিন্তু স্নেহ-উদ্বেল মন কথা শোনে? বিভ্রান্তির মায়াজাল। মন মানে না। মেয়ের কষ্ট বুকে এসে লাগে। শেলের তীব্র আঘাত আছড়ে পড়ে। অবশেষে একদিন বলেই বসেন, –
‘টিউশনি করার দরকার নেই মা। তোর বদলে বরং আমি যাই, ওরা মেনে নেবে না?’
‘তুমি পারবে না বাবা, অঙ্ক আছে। সেও ইংরেজিতে।’
অবশ্যই না। তিনি পারবেন না। অঙ্ক ভালো বোঝেন না। ইংরেজি অঙ্ক। মাল্টিপ্লাই, ডিভাইডেশন, ইকুয়েশন ইত্যাদি আরও দুর্বোধ্য। এখন আগের ফরমুলা নেই। অঙ্ক আতঙ্কের নাম। জীবন সেও তো অঙ্ক। সরল অঙ্ক। রুটওভার-ফার্স্ট ব্র্যাকেট-সেকেন্ড ব্র্যাকেট কত কি! কোথাও একবার ভুল হয়ে গেলে সকলি গরল ভেল। অঙ্ক না জানা মানুষের অস্তিত্ব অর্থহীন। তিনি কোনো সান্ত্বনা বা বিকল্প অবলম্বন খুঁজে পেলেন না। নিলু বলে, –
‘তুমি অযথা উদ্বেগ করো না বাবা। কত মেয়ে কাজ করছে। অনেক রাতে ঘরে ফেরে তারা। সবসময় দুশ্চিন্তা-ভয় করো কেন? অযথা প্রেশার বাড়ে।’
‘তুই একটু দেখেশুনে চলিস মা।’
আজ ডাইনিং’এ বসে মেয়ের হাসি-উজ্জ্বল মুখছবি, আদর-যত্নের চঞ্চল ব্যস্ততায় আত্মহারা মাহমুদ হাসান। মিলাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারতেন। একটু হয়তো কষ্ট হতো। কেন সঙ্গে নিলেন না? এই আনন্দ-সুখে যে অংশ আছে তারও। শফিক পরদিন অনুমতি নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরে দেখায়। শপিং কমপ্লেক্স ঘুরে দামি পাজামা-পাঞ্জাবি কেনা হয়। শাশুড়ির জন্য শাড়ি। শ্যালক শ্যালিকার প্যান্ট-সার্ট-থ্রিপিস ইত্যাদি। মাহমুদ হাসান এসব দেখে মনে মনে খুশি হলেও বিব্রত। জীবনে কারও কাছে থেকে কোনোদিন কোনোকিছু নেননি। কোনোকিছু পাননি। নিজের সীমাবদ্ধ দুনিয়ায় বিলাসিতা নেই। সাধ আর সাধ্যের যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ ছিল না। তাই অনেককিছু পেয়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেলেন। শফিকের সে-সবে দৃষ্টি নেই। সে দু-হাতে টাকা খরচ করে খুশি হতে চায়। অকারণ অনুযোগ।
‘মাকে নিয়ে আসলেন না কেন বাবা? বেশ হতো! দেখার কত জায়গা আছে, দেখে যেতে পারতেন।’
‘এবার নিয়ে আসব বাবা। তোমার শাশুড়ি খুব খুশি হবে।’
‘আমার আর কে আছে বলেন? এখন আপনারাই আমার বাবা-মা।’
মাহমুদ হাসান গাড়ির নরম সিটে নিজেকে এলিয়ে দিলেন। হিম-কুয়াশা শীতল। মন জুড়োয়। আবেগ-আনন্দে ভরে ওঠে। তিনি দু-চোখ বুজে অদৃশ্য নিয়ন্তার প্রতি গলে গেলেন। মেয়ে তার সুখে আছে। শামীম আকন্দের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তার কাছে অনেক অনেক ঋণ। এবার কলেজে গিয়ে ঢাকা বেরিয়ে যাওয়ার গল্প করবেন। তার হাত ধরে ধন্যবাদ, ধন্যবাদ নয়; আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। তার কল্যাণেই তো এই সন্বন্ধ হল।
নিলু পরদিন সুটকেসে কেনাকাটা সকল জিনিস ভরে দেয়। বিদায়ের মুহূর্ত আসে। মন বিষাদ-বিমর্ষ। মাহমুদ হাসান উপলব্ধি করেন, মন হালকা; তেমন দুঃখ নেই। নির্ভার মেঘ-পালক সুখ। তিনি অনেক আদরে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আবেগপ্রবণ মানুষ। দুর্বল-কাতর মন, মনের গতি ধরে রাখতে পারে না; বিচ্ছেদ বেদনা বুকে আছড়েই পড়ে। মন্থর কষ্টে টেনে টেনে বলেন, –
‘ভালোভাবে থাকিস মা, এখন এটাই তোর সংসার। জামাই খুব ভালো মানুষ। নিশ্চয়ই কোনো পুণ্য বলে তোর এমন বর মিলেছে।’
‘তুমি দোয়া করো বাবা।’
নিলু ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বুঝি! তিনি মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিলেন। অনেক কষ্ট করেছে মেয়ে তার। বড় মেয়ে, মেয়ে নয়; ছেলে। ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটনের সঙ্গে পরিচয়। কে জানে ছোট ছোট কত স্বপ্ন মন থেকে মুছে ফেলেছে। মাহমুদ হাসানের দৃষ্টি ঘোলাটে-ঝাপসা। চোখ বুজে কী ভাবেন? একমুহূর্ত নাকি অনন্তকাল? তিন ছেলেমেয়ে। কেউ কোনোদিন কোনো অভিযোগ করেনি। পিতার গরিবি-অক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তিনি শোনেন নাই। যত হতাশা-ক্ষোভ নিজের প্রতি নিজে করেছেন। কাঁধে ব্যর্থতার সকল দায়, কত আঘাত; নির্ঘুম রাতের দেয়ালে খেরোখাতা-হিসাবনিকাশ। অন্তর পুড়ে কাঠ-কয়লা-ছাই। কখনো বিশুষ্ক অশ্রু মুছে ফেলেছেন। আজ পরম খুশি অথবা বিষাদ মুহূর্তে সে-সব কথা মনে আসে। চোখ ভারী হয়। আকাশে মেঘলা বাতাস। শেষে দু-একটি দরকারি বা অবান্তর কথা বলে গাড়িতে বসেন। শফিক নিজে ড্রাইভ করে আসাদগেট নিয়ে এল। কোচ যতক্ষণ ছেড়ে না যায় বসে থাকল। তিনি ফিরে যাবার তাগিদ দিলেন। সে নড়ে উঠল না।
‘বাবা দূরের পথ, দেখেশুনে যাবেন। মোবাইল করবেন। আমি যদি মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করি, প্লিজ রাগ করবেন না। নিলু আমার উপর অভিমান করবে। এটা আমার দায়িত্ব।’
‘বেশ বাবা বেশ, তুমি উতলা হয়ো না; জানিয়ে দেব।’
তখন গোধূলি আকাশ। একটি কোনায় দিঘল চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার আলো। কোত্থেকে আচমকা ফুরফুরে বাতাস শুরু হয়। দূরাগত সংগীতের মতো কোনো সুবাস ভেসে আসে। অচেনা ফুল গাছ। মন উন্মাতাল। গত দু-একটি দিনের পল-অনুপল স্মৃতি জেগে উঠবার সুযোগ পায়। আহা কোনো কষ্ট নেই! কোনো অভিযোগ নেই। সবকিছু আগে থেকে লেখা জীবনের অধ্যায়। তিনি শুধু পথ হেঁটে যান। তেপান্তর মাঠ। আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘের মেলা। এই নিয়তি। মেয়ে তার সুখে থাক। আনন্দে হেসে উঠুক প্রাণ। নিজের জন্য এই চাওয়া তার।
তারপর চলে গেছে অনেকগুলো দিন। বারো-তেরো সপ্তাহ। তিন-চার মাস। আজ মাহমুদ হাসান ঢাকায় ড্রইংরুমে বসে সেই আনন্দ খুঁজে পান না। গতকাল ভোর-সকালে পৌঁছেছেন। শফিক দু-একটি ছাড়া তেমন কথা বলেনি। মুখ-চোখ গম্ভীর। নিলুর মুখছবি মেঘলা-বিষাদ। চোখের কোলে কালি। চিন্তার জলছাপ। তাকে দরজায় দেখে খুব ব্যস্ত এগিয়ে এল। তারপর আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করে, সবাই ভালো আছে তো? আর কোনো কথা নেই।
মাহমুদ হাসান একটু ধাক্কা খেলেন। সময়ের গতিপথে কতকিছু বদলে যায়, বোঝা যায়; বোঝা যায় না। নিলু তো এমন নয়। নিশ্চয় কিছু হয়েছে। সঙ্গীবাঁধা জীবনে দু-জন মানুষের কতকিছুই তো হয়। তার ত্রিশ বছরের অভিযাত্রায় কম হয়নি! সংসারে মান-অভিমান, কাছে আসা-দূরে থাকা সহজ বিষয়। মানুষের বেঁচে থাকায় হয়তো এর প্রয়োজন আছে। অবশেষে সকল জিজ্ঞাসা রহস্য থেকে গেল। মন অন্যচিন্তা-দুশ্চিন্তা ঘোরে সুড়ঙ্গ-গহ্বরে নেমে যায়। বিগত তিন মাস অস্থির-যন্ত্রণার সময়কাল। মন ছটফট করে। বুকে খাঁ-খাঁ শূন্য হাহাকার। কোনো স্বস্তি নেই। শান্তি নেই। কোনো খবর পান না। মোবাইলে কল দিলে অপরদিক বন্ধ। আকস্মিক কখনো কথা হয়। মিলা নিয়মমতো কল দিয়ে দিয়ে হতাশ। ভাবনা-ব্যাকুল। কোনোদিন চঞ্চল শান্তি। স্বস্তির সময়। মোবাইলে কথা হয়। অনেক গল্প-কাহিনি। সেই গল্পের পুঙ্খানুপুঙ্খ শোনা চাই। কোনোকিছু বাদ পড়ে না। এমনকি দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছে জানতে সাধ হয়।
এরপর কয়েকদিন-সপ্তাহ মোবাইল বন্ধ। কোনো খবর পাওয়া যায় না। অস্থির-উৎসুক মন নম্বর ডায়াল করে করে শোনে যন্ত্রের বাণী: আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে; অনুগ্রহপুর্বক…। তিনি সময় নিয়ে বারবার কি-প্যাডে আঙুল রাখেন। একই প্রত্যুত্তর শোনা যায়। উদ্বেগ অস্থিরতা বাড়ে। কাজে মনোযোগ রাখতে পারেন না। কখনো ক্লাসে লেকচার মাঝপথে থেমে যায়। মন কথা শোনে না, আনমনা হয়; দৃষ্টি বাইরে দিগন্তরেখায় কী খুঁজে চলে। কোনোদিন বিকেলে বাসায় ফিরে অধীর-আগ্রহে জিজ্ঞেস করেন, কোনো কথা হল কি না; ফোনে পাওয়া যাচ্ছে কি? মিলার আশাহত-বিষাদ মুখ। জবাব পেয়ে যান। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বড় সংক্রামক। শেষে তার মনেও যদি জমে ওঠে? ভয় লাগে। কখনো আনমনে বিড়বিড় করেন। অটো-সাজেশন সান্ত্বনা। ওরা ব্যস্ত আছে। শফিক বিরক্ত হয় কি না? মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা ভালো আছে। আহা ভালো থাক! তিনি অযথা দুশ্চিন্তা পোষেন। কেন এমন হয়? তারপর কত প্রবোধ যুক্তি-খোঁড়াযুক্তি আসে। অন্ধকার সুড়ঙ্গে হাতড়ে হাতড়ে আলোরেখা অনুসন্ধান। মন মানে না। ঘোরপ্যাঁচ ভাবনা-দুর্ভাবনায় অনুমান ছক আঁকা। মিলার মনেও কি ঝড় বয়ে যায়? অনেক চাপা স্বভাব। কষ্টের কথা বলে না। এখন দু-জন দু-জনের ঝড় দেখেন। অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সময়কাল।
মাহমুদ হাসান জানালায় দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ-স্থবির। জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে চলেন। এমন কী হতে পারে? অসময়ে এসে পড়েছেন? শফিকের চাকরি বা ব্যবসার কোনো ঝামেলা? ভাবনা জট পাকিয়ে যায়। খেই মেলে না। শহরের ইট-পাথর দেয়াল। রাস্তায় মানুষজনের ভিড়। কত জীবন। সকলে কাজ করে। তাদের নিজ নিজ স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা আছে। সমস্যা-দুঃখ-কষ্ট। সে-সবের মধ্যে কখনো সুখ উঁকি দেয়। অপার আনন্দ-শান্তি। মানুষ বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকতে হয়। তার নিজের কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। তিনি বেঁচে আছেন। সন্তানের একটু সুখ সামান্য আনন্দ দেখতে সাধ হয়। তাদের একটু কষ্ট বুকে এসে আঘাত করে। কেন বেঁচে আছেন? কত দিন হয়ে গেল কোনো যোগাযোগ হয় না। মোবাইল বন্ধ থাকে। মোবাইল কেন বন্ধ রাখা হয়? সেই জিজ্ঞাসা আকুলিবিকুলি করে। ঠোঁটে এসে থমকে দাঁড়ায়। অথচ এই কথাই প্রথমে জানবেন, নিশ্চিত ভাবনা ছিল।
সকল রহস্যের কিছু ধারনা ডাইনিং’এ বসে পাওয়া যায়। রোদ-উজ্জ্বল দুপুরের আকাশ। তিনতলার বিশাল জানালা। মন-ভোলানো বাতাস ধীরে ধীরে বয়ে আসে। আশপাশে হইহই শব্দ-চিৎকার নেই। চারিদিক নিজ্ঝুম-চুপচাপ। নিলু খাবার সাজায়। চীনামাটি প্লেটে স্টিল চামচের টুং টুং জলতরঙ্গ। অসম্ভব নীরবতার ভাঁজে অকথিত কথামালা উঁকি দিতে চায়। চোখ মেলে তাকাতে উন্মুখ। এই মোহন সময়ে কোত্থেকে এক শুঁয়োপোকা পিঠে হেঁটে বেড়াতে শুরু করে। উপর-নিচ ওঠা-নামা। মাহমুদ হাসান ক মুহূর্ত অপলক তাকিয়ে থাকেন। তার আদরের নিলু, মা-জননী; এমন অচেনা লাগে কেন? আনন্দ-হাসি মুখছবিতে অন্ধকার ছায়া। কেন এত গম্ভীর দেখায়? কোথায় ছন্দপতন? তিনি কিছু বলতে গিয়েও পারেন না। টেবিলের ওই প্রান্তে শফিক। বয়সি মানুষের মতো রাশভারী, রহস্যময়; কে জানে! দুর্বোধ্য মনে হয়। মাহমুদ হাসান কী করেন। এরমধ্যে আকস্মিক সেই পুরোনো ক্ষত জেগে ওঠে। তিনি একজন গরিব পিতা। সামান্য শিক্ষক। কোত্থেকে বাতাসে উদাসী ছায়াঢেউ। খারাপ লাগে। মন কত অসহায়। কয়েকবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে সহজ হওয়ার চেষ্টা। সব বিফল। নিলু প্লেটে তরকারি দেয়। তারপর আচমকা বলে, –
‘বাবা তোমার জামাই তো আমেরিকা যেতে চায়। ওখানে আপা আছেন। সেখানে থাকবে। আমাকেও নিয়ে যাবে।’
মাহমুদ হাসান চমকে উঠলেন। আঙুল দিয়ে ভাত নেড়েচেড়ে নিচ্ছিলেন। আচমকা বজ্রপাতে সবকিছু, এমনকি সময় স্তব্ধ স্থির হয়ে গেল। এতক্ষণ মনের কোনায় কোনায় নিশ্চুপ-তাণ্ডব ঝড়, অস্বস্তি-অপেক্ষার অনুপল-পল গোনা; সব খানখান ভেঙে পড়ে। এই কারণে মেয়ের মন বিষণ্ন-উদাস। জামাই গম্ভীর। তিনি কী বলবেন মুখে ভাষা নেই। শব্দ খুঁজে পান না। নিলু বলে চলে।
‘তোমার জামাইকে বলো না বাবা…এখানে সমস্যা কোথায়? ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। কত সম্মান। গবেষণার কাজ তো এখানেও করা যায়…নাকি?’
কী বলবেন? তিনি হতবিহ্বল-নির্নিমেষ বারবার দু-জনের দিকে তাকান। কোনো শব্দ নেই। কী বলা যায়? কলেজের সামান্য শিক্ষক। তার লেকচার ছাত্রছাত্রি পিনপতন নীরবতায় শোনে। তিনি কথার পিঠে কথা সাজিয়ে সাহিত্য পড়ান। বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের বিবিধ রচনার সহজ ব্যাখ্যার প্রয়াস। কত দৃষ্টান্ত কত চিত্রকল্প এঁকে যান। সবাই স্থির-নিশ্চুপ শোনে। সেখানে মুগ্ধতা আছে কিনা জানা নেই, কোনোদিন খুঁজে দেখেননি; আজ কী বলবেন ভাষা খুঁজে পান না। নিজের মধ্যে শব্দ-বাক্য হাতড়ে চলেন। অবশেষে উপসংহার। যখন বুকে অনেক কথা, কত না আবেগ ঝরনার মতো গতিময়; ভাষা হারিয়ে যায়। সে-সময় কেন জানি ভয়ংকর দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা জড়ো হতে থাকে। তেপান্তর মাঠ শূন্য হাহাকার। চোখের সামনে কালো পরদা ঝুলে পড়ে। অন্ধকার গহ্বর। তিনি কাউকে খোঁজেন। দেয়ালের স্যাঁতসেঁতে পরিসীমায় স্পর্শ রেখে হাতড়ে যান। নিলু নেই…নিলু নেই। কোথায় হায় মা-জননী তার? কোথায়? কোথায়? অন্ধকার ধীরে ধীরে আরও প্রগাঢ় হয়। তিনি ডুবে যান। ডুবে যেতে থাকেন। আকস্মিক মিলার উদ্বেগ-আকুল মুখছবি। পাণ্ডুর বিকেলের শূন্য দিগন্ত। কী বলবেন তাকে? কী নিয়ে বেঁচে থাকবেন?
তার কোলে শিশু। মহাশূন্য থেকে নেমে আসা পরি। আবেগ-ভালবাসা। এই পৃথিবী-আকাশ-বাতাস। বেঁচে থাকা আনন্দ অস্তিত্ব। সুখ-শান্তি। শিশুর মুখে হাসি আকাশের রোদ-ঝিলিক। অভিমানে বিষাদ বাতাস। কোলে কোলে বুকে বুকে বড় হয় মেয়ে তার। মিলার সঙ্গে রাত জেগে জেগে জ্বর-কপালে জলপট্টি। রাত পাহারা চোখ ঘুম ভুলে যায়। একচিলতে হাসি অসীম আনন্দের জন্য দিনযাপনের রোদ-বৃষ্টি-হিমকুয়াশায় কত না ছুটোছুটি। আধভাঙা সাইকেলে স্কুলে পৌঁছে দেয়া। দায়িত্ব নয়…আমোঘ মায়া। তার জীবন। মেয়ে বড় হয়। তিনি মায়াময় মুখছবিতে নিজের ছবি আঁকেন। স্বপ্ন দেখেন। যে-সকল ইচ্ছে-স্বপ্ন-সাধ অধরা থেকে গেল, স্পর্শ করতে পারেননি; মেয়ে খুঁজে পাবে। কেউ কেউ বলে, বাপের আহ্লাদি মেয়ে; প্রতিচ্ছায়া। অতি-আদর…অতি-মায়া। তিনি জানেন, যে যা বলুক; মেয়ে তার কী? বুকের খাঁচায় বেঁধে রাখা জীবন-স্পন্দন। সেই মেয়ে একদিন দূরে চলে যাবে। বিয়ে হবে। সমাজ এবং সামাজিকতা। নিয়মকানুন-রীতিনীতি অনুসরণ করতে হয়। তার নিজের জীবন আছে। সেভাবে নিলুর বিয়ে হয়ে গেল। বিদায়ের দিনক্ষণ। মেয়েকে কারে তুলে দিয়ে গোপনে চোখ মোছেন। বুকের পাঁজর ভেঙে যায়। কেউ খাবলা মেরে হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে নেয়। সমাজ-সংসারে এমন নিয়ম কে করেছে? কেন? আহা সেই কষ্ট তার নিজের! জগতে যে কষ্টেরও দরকার আছে। মেয়ে তার সুখে থাক। নিলু সুখী হোক। এ ছাড়া কী চাইবেন? সন্তানের নিরাপদ আনন্দ-জীবন। সেই মেয়ে আমেরিকা চলে যাবে। সেখানে কী অবস্থায় থাকবে? তিনি কীভাবে বাঁচবেন? অস্বস্তি-দুর্ভাবনায় ভাবনা জট লেগে যায়। সব গুলিয়ে ওঠে। মাথা ঝিমঝিম দৃষ্টি অন্ধকার ঘোলা। একবার মনে হয় পড়ে যাবেন। সে-সময় শফিক কথা বলে উঠে, –
‘এখানে কোনো লাইফ আছে বাবা? জুলি আপা আমাদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট বুক করেছে। ওখানে কোনো ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট-গ্রাজুয়েট ও থিসিস করব। নিলুও পড়বে। চার-পাঁচ বছর। তারপর ফিরে আসা যাবে।’
মাহমুদ হাসানের চোখ ভেজা। কোনো শব্দ নেই। আধপেটা উঠে পড়েন। মেয়ের দিকে তাকাতে ভয় করে। জামাইয়ের দিকে সাহস হয় না। পরাজিত কাঁধভাঙা মানুষ। মাথানিচু চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ান। শরীর থিরথির কাঁপে। অনেক চেষ্টায় বেসিনে যেতে যেতে ক্ষণেক থেমে বলেন, –
‘ওর মায়ের সাথে একটু কথা বলি বাবা। কিছুদিন থাকো।’
‘এখনই কোথায় যাওয়া হচ্ছে, অনেক ফরমালিটি আছে; এসব সারতে মাসখানেক লেগে যাবে।’
মাহমুদ হাসান কিছু স্থির, নিজেকে সামলে নিয়েছেন; অথবা পেরেছেন। এই তো নিয়ম। জগতে মেয়েদের কত জায়গায় যেতে হয়। কতকিছু মানিয়ে নেয়া। মন থেকে আশা-আকাঙ্ক্ষা মুছে ফেলা। ভুলে যেতে হয়, অথবা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা; সে যে কারও সহযাত্রিণী…সহধর্মিণী। স্বামীর সংসারই আসল জায়গা তার। রামের সঙ্গে সীতাকেও বনের গহিন জঙ্গলে যেতে হয়েছে। তিনি অহেতুক উদ্বিগ্ন হন। এসব ভেবে ভেবে সহজ মন নিজেকে দুর্বল-এসকেপিস্ট বলে শাসন করেন। অবশেষে আবদার।
‘বাবা এই কদিনের জন্য নিলুকে নিয়ে যাই। তোমার শাশুড়ি দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। ছোট ভাইবোন দুটোও জিজ্ঞেস করে।’
‘এখন যে তার থাকা দরকার বাবা। এখানে-ওখানে বিবিধ কাজ। বাবা জীবনে বারবার সুযোগ আসে না। এই সুযোগ নিতে না পারলে সারাজীবন অনুশোচনা করতে হবে।’
‘আমি নাহয় দু-চারদিন পর নিয়ে আসব।’
‘এ সপ্তাহে অনেক কাজ বাবা। ইমিগ্রেশন কাগজপত্র-পাসপোর্ট ইত্যাদি। আমি বরং আগামী সোমবার নিয়ে যাই।’
‘সেই ফরমালিটি দু-দিন পরে করলেও তো হয় বাবা।’
কোনো জবাব নেই। কোনো কাজ হবে না। মাহমুদ হাসান আহত হলেন। হাজার আনন্দের রংধনু আকাশে বর্ণহীন জীবন। একলা ঘুড়ির মতো খাঁ-খাঁ ভেসে যান। কখনো রোদের তাপদাহ, মেঘের হিম-কুয়াশা স্পর্শ; কখনো বৃষ্টিজল কান্না। নিজেকে তেমনভাবে সাজাতে শিখেছেন। কণ্ঠ ধরে আসে। দুপুরের নিজ্ঝুম ধীরলয় বাতাসে বুঝতে দিতে চান না। কেউ না জানুক। তার চোখ-মুখ গম্ভীর। বিষাদ-মেঘ আকাশ। অপাঙ্গে একমুহূর্ত দেখেন, নিলু তাকিয়ে আছে। সেই চোখে আদর তুলে দিতে ভয় লাগে। এখন যে…মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কী করবেন? নিলু একফাঁকে খুব কাছে এসে হাত ধরে তার। অস্ফুটে বলে উঠে, –
‘বাবা তুমি চিন্তা করো না…আমি ভালো থাকব।’
তিনি জবাব দিতে পারেন না। অনেক কথার যেমন কোনো উত্তর নেই, কোনো সান্ত্বনাও থাকে না; তার খুব কষ্ট হয়। কী করে বোঝাবেন? কী করবেন? বাবা না হলে বাবার কষ্ট কেউ বোঝে না। নিলুর দিকে তাকান। মেয়ে তার ভালো থাক। সে ভালো থাকবে। তিনি সামান্য মানুষ। জীবনে কারও কোনো ক্ষতি করেন নাই। কারও মন্দ চান নাই। তেপান্তর একলা পথে আপনমনে হেঁটে গেছেন। নিজের কাজ, সহজ কিংবা কঠিন; চেষ্টা করেছেন। কারও সঙ্গে নিজের তুলনা করেন নাই। যতটুকু সন্ধের ছায়া কিংবা পূর্ণিমার আলো আজলায় তুলে নিয়েছেন, কোনো দুঃখ কোনো ক্ষোভ নেই; এই তো জীবন। এই তার পুণ্য। সেই সঞ্চয়ে মনে শক্তি খোঁজেন, কোনো অবলম্বন; মেয়ে তার ভালো থাক। তিনি গোপনে মুখ নিচু দৃষ্টি লুকোন।
আজ তিন-চার সপ্তাহ কোনো খবর জানেন না মাহমুদ হাসান। ইদানীং মোবাইল আবার বন্ধ থাকে। সময়-অসময়ে একাগ্র চেষ্টা চলে। পাওয়া যায় না। একদিন শামীম আকন্দের সঙ্গে গল্প হয়। তিনি দু-একটি কথা বলে অতিব্যস্ত অন্যপাশে সরে যান। পরীক্ষার খাতা দেখছেন। তাকে বিরক্ত করা যায় না। মন বিক্ষিপ্ত-অস্থির। সময় উদ্ভ্রান্ত বিষময়। মাহমুদ হাসান কী করেন। অমঙ্গল নানান ভাবনা-দুর্ভাবনায় চোখ-মুখ বিশুষ্ক শূন্য বালুচর। বেঁচে থাকা দিনকাল তবু চলে যায়। মিলা এক বিকেলে বলেন, –
‘তোমার জ্বর চলছে মনে হয়। বুঝতে পারো না? গতরাতে অনেক তাপ দেখলাম। একবার প্রেশার চেক করো। ব্লাড সুগার লেভেল বেড়ে গেল নাকি? ট্যাবলেট নিতে তো দেখি না।’
‘এই বয়সে তাপ ওঠানামা কোনো ব্যাপার না। প্রেশার ঠিক আছে। তোমাকে বরং ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।’
অনেক কথা কথায় কথায় এসে যায়। নিলু কবে আসবে? কোন্ মাসে ফ্লাইট? জীবনে আর দেখা হবে কি? জিজ্ঞাসার শেষ নেই। মাহমুদ হাসান স্বাভাবিক থাকেন। প্রাণান্ত চেষ্টা। বকবকানো যায় না। বেসামাল দু-একটি কথা ভড়কে দিতে পারে। মধ্যরাতে আচমকা জেগে ওঠেন। উদ্ভট দুর্ভাবনা-আতঙ্ক-আশঙ্কার স্বপ্নছবি তাড়া করে। মন অস্থির-বিমর্ষ-বিহ্বল। সেই কষ্ট তার নিজের। কারও বুকে অস্থিরতা জাগাতে চান না। এই গরমে শীত লাগে। হিম-কুয়াশা ঠান্ডা। শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। আলোছায়া দেয়ালে কত স্মৃতি কত ঘটনা দেখা যায়। তিনি নিলুর মুখছবি খোঁজেন। কেমন আছে মেয়ে তার? এভাবে একদিন সত্যি জ্বর এসে গেল। প্রচণ্ড উত্তাপ। মাথা ভার ভার বোধহীন টলমল। প্রাণ তেতো। তেপ্পান্ন বছর বয়সি মানুষের কাছে জ্বর দাপটে আসে। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দুর্বল করে দেয়। জীবনে কতবার ফ্লু-টায়ফয়েড-ম্যালেরিয়ায় ভুগেছেন। সামলে নিতে পারেন। প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক, কিন্তু এবার কাহিল। মনের সঙ্গে শরীরের অদ্ভুত যোগাযোগ!
তারপর যথানিয়মে কলেজ যান। ক্লাস নেন। টিচার্স রুমে বসে দৈনিক কাগজের পাতা ওলটান। কত অপরাধ-বীভৎস-নৃশংস খবর। প্রতিদিন কেন জানি এসব খবরই আসে। প্রতারণা বিবাহ। অভিনব কৌশলে মানবপাচার। শিশু-নারী বিক্রয়। ধর্ষণ-নির্যাতন-গুম-অপহরণ-হত্যা। অ্যাসিড ঝলসে দেয়া। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবচ্ছেদ। মানব অঙ্গের বাজার। খবর পড়েন। মন চঞ্চল-অস্থির হয়। অবশেষে খবরের কাগজ হাতে আর তুলে নেন না। ভয় লাগে।
টিচার্স রুমে অনেক গল্প-আলাপ হয়। চাল-ডাল-তেলের দাম। বাসভাড়া। বিদ্যুৎ বিল। টাইমস্কেল-বোনাস। নদী-পানি-আবহাওয়া। রাজনীতির হালচাল। আওয়ামী লীগ-বিএনপি। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি-কূটকৌশল। আলোচনার শেষ নেই। তিনি আগের মতো মেতে ওঠেন না। কেউ কিছু বললে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’। চুপচাপ-নিশ্চুপ। বাসায় এসে টিভি দেখা নেই। খবর কিংবা ক্রিকেট মরে গেছে। উঠে গেছে মন। চোখ উদাস-গম্ভীর। তিনি বারবার থেমে থেমে মোবাইলে কল দেন। বেজে ওঠে যান্ত্রিক কণ্ঠ: ‘দুঃখিত আপনি যে নম্বরে ডায়াল করেছেন তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে…অনুগ্রহ করে একটুপর আবার ডায়াল করুন।’ একদিন সাদিকুল হককে অনুরোধ করেন। ইংরেজির শিক্ষক। শিক্ষা ভবন-ঢাকা যাবেন। তাকে অনুরোধ, এই তাদের ঠিকানা; যদি সময়-সুযোগ হয় একটু দেখে আসেন। কেমন আছে তারা? একটু খবর-অনেক মূল্য। সাদিকুল হক সময় পান না। মাহমুদ হাসান কাউকে কিছু আর বলেন না। সবসময় অজানা তাগিদ-অচেনা উপলব্ধি। নাইটকোচ রাস্তায় ছুটে চলে। এলোমেলো যাত্রা। ঝাঁকুনি টার্ন। বাইরে অন্ধকার। পথ ফুরোয় না। তার পাশে কে? মিলা কি ঘুমোয়? বমি করে করে ক্লান্ত অসহায়। নিশ্বাসের মিহি শব্দ। মাহমুদ হাসান সহসা হাতে-পায়ে চমকে ওঠেন। কলেজের করিডোর ধরে একঝাঁক ছেলেমেয়ে গল্প-মুখর হেঁটে যায়। স্বপ্নের ঘোর ভাঙে। এখনো বেতন হয়নি। টাকা তেমন নেই। আশপাশে কারও কাছে ধারকর্জ করবেন? লজ্জা আসে। কখনো মনকে বোঝান। এত উতলা হওয়ার কী আছে?
এরশাদ ঘণ্টা দেয়। চতুর্থ পিরিয়ড। ফার্স্ট ইয়ারে বাংলা ক্লাস। মাহমুদ হাসান বারান্দায় পুবে হেঁটে চলেন। কাঁধভাঙা বৃদ্ধ মানুষ। বিশুষ্ক মরুভূমি দৃষ্টি। এপ্রিলের রোদ। ক্লাসে এসে টেক্স্ট বই বের করেন। আজ গল্প। লাইনের পর লাইন পড়া হয়। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। গল্পের মধ্যে হারিয়ে যান। মন-উন্মন। আকাশ-দিগন্ত তেপান্তর মাঠ। একজন পিতা এগিয়ে যান।
‘যেন ঘুষ দিতেছেন, এমনিভাবে আমার হাতে একখানা একশো টাকার নোট গুঁজিয়া দিয়াই আমার শ্বশুর দ্রুত প্রস্থান করিলেন। আমার প্রণাম লইবার জন্য সবুর করিলেন না। পিছন হইতে দেখিতে পাইলাম, এইবার পকেট হইতে রুমাল বাহির হইল।’
মাহমুদ হাসান এখানে এসে আচমকা থমকে গেলেন। কতবার পড়েছেন মনে নেই। আজ বুকের কোনায় ডুবে থাকা যন্ত্রণা ভেসে ওঠে। স্বপ্ন-জাগরণে জেগে থাকা কোনো গোপন আকাঙ্ক্ষার লাশ। নিলুকে কিছু দিতে পারেননি। কত বাবা মেয়ের জন্য কত কী করে। কতকিছু দেয়। সোনার গহনা-আসবাবপত্র-নগদ ক্যাশ…আরও কত কি। তিনি গরিব শিক্ষক। কোনো সঞ্চয় নেই। বিয়ের আপ্যায়ন ও বিবিধ খরচ জোগাতে এনজিও আর মহাজনি ঋণ করতে হল। মোটা অঙ্কের টাকা। সেই টাকা পরিশোধ হবে কি না কে জানে।
বইয়ে জেগে থাকা লাইনগুলো কথা বলে। অস্ফুট গুনগুন স্তব দিগন্তে মিশে যায়। এলোমেলো ঝাপসা ঝিলমিল। তিনি চশমা খুলে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেন। আকাশের সীমা ছুঁয়ে রোদেপোড়া মাঠ। ইপিল-ইপিলের মাথা-উঁচু শিখর মেঘ হয়ে যায়। একটু শীতল বাতাস। হিম হিম শান্তি ঘুম। আজ মন গাছ হতে চায়। গাছের মতো নিশ্চুপ-বোবা কষ্ট ধারণ। অনেক কষ্ট করলেন। তারপর কোথায় আছেন, কোনদিকে তাকান; মনে নেই। সব ভুলে গেছেন। ভুল হয়ে যায়। চোখের সামনে শুধু গাছ। জামরুল গাছে বেগুনি ফুল। কৃষ্ণচূড়া লালে লাল। রুপোলি আকাশ। প্রচণ্ড রোদ ভেসে আসে। তিনি আনমনা-স্থির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন। আশপাশে কোনো নদী বয়ে যায়। বুকের ওপার হতে অস্ফুট কান্নার জলঢেউ। তিনি স্বার্থপরের মতো অক্ষম পিতাকে খুঁজে চলেন। পড়াতে পারলেন না। গলা ধরে এল। নিলুকে কতদিন দেখেন না। চোখের সামনে মেয়ে নেই। শেষবার দেখে আসা করুণ মুখছবি। বড় অসহায় লাগে। কী করা যায়? তিনি নিশ্চুপ-মৌন বেরিয়ে গেলেন। টেবিলে বাংলা টেক্স্ট পড়ে রইল।
টিচার্স রুমে বসলেন না। আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে মাঠ পরিসীমা। ফুলের বাগান। চেনা-অচেনা ফুল। হালকা বাতাসে দোল খায়। মন-বিভোল সৌরভ। দুপুরের তাপদাহ। দূরে-বহুদূরে ঝাঁ-ঝাঁ আলো। পথহারা দিগ্ভ্রান্ত চোখ। শ্রুতিতে কোনো গুঞ্জন ওঠে। কে…কে? কে কোথায় কাঁদে? এদিক-ওদিক বিভ্রান্ত দৃষ্টি। অবশেষে আকাশে চোখ। একটি উড়োজাহাজ পুব হতে পশ্চিমে ভেসে যায়। শব্দতরঙ্গ। কোথায়…কোন্ অভিযাত্রায় ভেসে চলে? আমেরিকা? সেই মহাশূন্যযানে কোনো সিটে আদরের নিলু বসে আছে? তিনি জানেন না। কোনো খবর নেই। উতল-ভাবনায় মন বিহ্বল ভেঙে যায়। ভেঙে পড়ে। কোথায় আছে নিলু? কেমন আছে তার কলিজার টুকরা…আত্মজা? তার দৃষ্টি অশ্রুসজল-ঘোলা ঝাপসা।
সহসা সব ভুলে ফুঁপিয়ে ওঠেন।
প্রভাষক, ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট
প্রকাশিত বই: ছোটগল্পের নির্মাণশৈলী (সাহিত্য ও সাংবাদিকতা),অস্তিত্বের পলায়ন (গল্প), ভয় (গল্প), অযোগ্যতার সংজ্ঞা (গল্প), পিঙ্গল বিকেলের আয়নায় (গল্প), রাত পাহারা চোখ (গল্প), গোপনীয়তার অলিগলি(গল্প),
প্রকাশক: জয়তী বুকস, ঢাকা।