Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla golpo Palash Mazumder

ইরাবতীর ছোটগল্প: প্রতিশোধ | পলাশ মজুমদার

Reading Time: 7 minutes

এক

বেসরকারি একটি সংস্থার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাজশাহীতে যোগদানের কয়েকদিনের মধ্যে লোকটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, তা-ও বছর পাঁচেক আগের কথা। আমি তখন থাকতাম সাহেববাজারে। একটি পরিবারের সঙ্গে সাবলেটে; এক বন্ধু ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। পরিবারটি তার খুব কাছের। কিছুদিনের জন্য রাজশাহী যাচ্ছি বলে পরিবার সঙ্গে নিয়ে যাইনি; আমার স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকত ঢাকায়। অফিস আর বাসা ছিল কাছাকাছি। একা থাকতাম বলে অফিসের পর বাসায় ফেরার তাড়া থাকত না; ঘুরতে বের হতাম উদ্দেশ্যহীন। শহরে আমার সবচেয়ে প্রিয় স্থান ছিল পদ্মার পাড়। কেন জানি সেখানে গেলে ভালো হয়ে যেত মনটা। কখনো কাজ না থাকলেও চলে যেতাম। সময় কাটাতাম নদীর দিকে তাকিয়ে।শেষ বিকেলে হাঁটতে বের হতাম মূলত পদ্মার আকর্ষণে; প্রেয়সীর মতো মায়াবী পদ্মা যেন আমাকে ডাকত হাতছানি দিয়ে। সে দিনগুলো আজও আমার স্মৃতিতে জাগরূক।

প্রায় সময় খেয়াল করতাম, এক প্রবীণ বসে থাকতেন পার্কের বেঞ্চে। আর কী যেন ভাবতেন আনমনে! কখনো বন্ধ রাখতেন চোখ। হয়তো ভাবতেন ফেলে আসা দিনের কথা। কিংবা ফিরে তাকাতেন দীর্ঘ জীবনের দিকে। এক পা না থাকলেও লোকটিকে আমার কখনো অসুখী মনে হতো না। কেমন যেন সুখী সুখী ভাব ছড়িয়ে থাকত মুখমন্ডলে। অথচ দুই পা থাকা সত্তেও আমি প্রায়ই বিমর্ষ থাকতাম। বৃদ্ধের চেহারায় স্পষ্ট ছিল আভিজাত্যের ছাপ। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের বহিঃপ্রকাশ। এজন্য বয়স কাবু করতে পারেনি মানুষটিকে। চুল-দাড়ি সব সাদা হলেও শরীর ছিল বেশ সুঠাম। তাঁর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হতো কখনো। দুজনে মৃদু হাসি বিনিময় করতাম তখন। লোকটির মধ্যে এমন কিছু দেখতে পেতাম যা আকৃষ্ট করত আমাকে। তা ছাড়া আমার মনে হতো, কোথায় যেন তাঁকে দেখেছি; কিন্তু কোথায় দেখেছি তা মনে পড়ত না।

এক বৈকালিক ভ্রমণের সময় উপযাজক হয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। তিনি নিজের সম্পর্কে প্রথমে কিছু বলেন না। যখনই শুনলেন যে, আমার বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে, তখন তাঁর মধ্যে লক্ষ করি বিস্ময়কর পরিবর্তন। একটু নড়েচড়ে বসেন; আমার দিকে তাকান গভীর মনোযোগে। একটু একটু করে পড়ার চেষ্টা করেন আমাকে। কৌতুহলী হয়ে জেনে নেন আমার কুষ্ঠি-ঠিকুজি।

আমার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ দেখে সন্দেহ জাগে মনে। আমিও তাঁকে কিছু প্রশ্ন করি। একপর্যায়ে তিনি বলতে বাধ্য হন তাঁর আদিনিবাসের কথা। বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে অবশেষে বলেন, তোমার বাবা ছিলেন আমার বন্ধু। এবার তাঁর চেহারা আমার স্মরণে আসে। দুইজন মানুষকে এক জায়গায় মেলাতে পারি। ছোটবেলার কথা মনে করে তাঁকে প্রশ্ন করি, আপনার নাম স্বপন, তাই না?
তোমার বুঝি মনে আছে আমার কথা? তিনি আমাকে বলেন।
আবছা আবছা মনে আছে। তখন তো অনেক ছোট ছিলাম। আংকেল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে পারি?
অবশ্যই পারো। কী জানতে চাও।
আপনি কেন বাড়ি ছাড়লেন? কী সমস্যা হয়েছিল তখন? যদিও বিভিন্নজনের কাছে আপনার বিষয়ে বিভিন্ন কথা শুনেছি। আপনার কথা বাবা-মা এখনো মাঝে মাঝে বলেন।
যাক। মনে রেখেছে তাহলে।
বলুন না আপনার বাড়ি ছাড়ার কারণ কী ছিল? আমি আবার প্রশ্ন করি।
সব বলব। তবে আজ নয়। আরেকদিন।
আমি আর কথা বাড়াই না। বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসি। তবে মন থেকে তাঁকে কিছুতে মুছতে পারছিলাম না। বারবার ফিরে যাচ্ছিলাম আমার শৈশবের সেই দিনগুলোতে।

 

দুই

অনেকদিন আগে আমাদের গ্রামের একজন মানুষ নিরুদ্দেশ হয়েছিল।আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে জমা আছে তাঁর কথা। আমরা তাঁকে ডাকতাম স্বপন কাকু বলে। মনে আছে, মানুষটির ডান পা ছিল না। তাঁর পায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বাবা বলতেন, যুদ্ধের সময় পা হারিয়েছেন তিনি। বিলোনিয়ার যুদ্ধে তাঁর ডান পায়ে গুলি লাগে। পরে সেই পা অপারেশন করে কেটে ফেলতে হয়েছিল। কারো মুখে শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকাররা তাঁর নামে এই অপবাদ রটিয়েছিল যে তিনি দেশ ছেড়ে-যাওয়া অনেক হিন্দুর সম্পদ দখল করেছেন; শাস্তি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধারাই কেটে দিয়েছিল তাঁর পা; তিনি আসলে মুক্তিযোদ্ধা নন। তবে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে তাঁর নামে কটুকথা বলতে শুনিনি; বরং মুক্তিযোদ্ধা বলেই স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁকে।

মুক্তিযোদ্ধা নয়, একজন মানুষের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে এলাকাবাসীর কৌতুহল ছিল সীমাহীন। অবশ্য গ্রামের মানুষের কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধার আলাদা কোনো মূল্য ছিল না; তাদের কাছে সব মানুষ সমান। অন্য সব বিষয়ের মতো একসময় সবাই ভুলে যায় ওই মানুষটির কথা। আমাদের সঙ্গে তাঁর একরকম পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন বাবার সহপাঠী। ছোটবেলার খেলার সাথিও। আমার ছেলেবেলায় বাবার কাছে প্রায়ই আসতেন তিনি; গল্প-গুজবে মেতে বেশ সময় কাটাতেন। সেই আড্ডায় জড়ো হতেন তাঁদের আরও কয়েকজন বন্ধু; স্বপন কাকু থাকতেন আড্ডার মধ্যমণি। খুব আমুদে লোক ছিলেন তিনি। বাবা মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতেন তাঁর বাড়িতে। দেখতাম, সারা ঘরে কেবল বই আর বই। কখনো দেখতাম তিনি গভীর মনোযোগে পড়ছেন। বাবার কাছে জেনেছিলাম,তাঁর একমাত্র কাজ বই পড়া। টাকা-পয়সার সমস্যা না থাকায় কিংবা তিনি একা বলে কোনো জীবিকা গ্রহণ করেননি। সেই বয়সেও আমার কাছে বই পড়ার দৃশ্যটি ভীষণ ভালো লাগত। তিনি কি আমার অবচেতন মনে বুনে দেননি বই পড়ার বীজ!

দেখতে সুদর্শন হলেও তিনি তখন বিয়ে করেননি। অথচ বয়স হয়ে গিয়েছিল পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই।তাঁর এই চিরকৌমার্য নিয়ে অনেক কাহিনি মানুষের মুখে মুখে ছিল। কেন জানি, তাঁকে নিয়ে গল্প করতে মজা পেত অনেকে। কেউ বলত, রাজাকাররা কেটে দিয়েছিল তাঁর পুরুষাঙ্গ। অন্য কথাও বলতকেউ কেউ। সেখানে থাকত বাজে ইঙ্গিত।কেউ বলত, প্রেমে ব্যর্থতাজনিত কারণে তিনি বসেননি বিয়ের পিঁড়িতে। তাঁর গ্রামত্যাগ নিয়েও অনেকে বিভিন্ন কথা বলত। তিনি তেরো বছর বয়সী একটি ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন। সম্পত্তির কারণে তাঁর ভাইয়েরা কৌশলে গায়েব করে ফেলে ছেলেটিকে। কারও ধারণা, ছেলে হারানোর বিষয়টা তাঁকে বেশ কষ্ট দিয়েছিল বলে তিনি আর গ্রামে থাকতে চাননি। কেউ ব্যঙ্গ দিয়ে বলত, পাপ ঢাকার জন্য তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। আসলে তিনি ছিলেননপুংসক। সেজন্য বিয়ে করেননি। বিয়ে না-করা একজন পুরুষকে সমাজ কি ভালো চোখে দেখে? সমাজে থাকতে হলে সমাজের একজন হয়েই যে চলতে হবে। সমাজের নিয়মকানুন মেনে। সমাজের হাত থেকে বাঁচতেই তিনি গ্রাম ছেড়েছেন।

কেউ বলত, তিনি ভেতরে ভেতরে নাস্তিক ছিলেন। তা না হলে কখনো নামাজ পড়তেন না কেন। একবার গ্রামের মাতব্বর সালিস ডেকে তাঁকে শুক্রবারে মসজিদে যেতে বাধ্য করেন। শাসিয়ে না কি তাঁকে বলা হয়, যদি নামাজ না পড়েন, আপনি গ্রামে থাকতে পারবেন না।এই বিষয়টির নির্ভরযোগ্য ভিত্তি ছিল। তাঁর গ্রাম ছাড়ার পেছনে এটাই হয়তো প্রধান কারণ। অন্য কারণগুলো ছিল তার অনুষঙ্গ। এমন আরও অনেক কথা আজও ভাসে আমাদের গ্রামের বাতাসে। বিশেষ করে প্রবীণদের মুখে।

 

তিন

ওই দিন পদ্মার পাড়ের বেঞ্চে বসে স্বপন কাকুর সঙ্গে আমার খুব বেশি কথা হয়নি। বিদায়কালে তিনি আমাকে অনুরোধ করে বললেন, তাঁর ইতিহাস যেন আমি রাজশাহীর মানুষজনকে না বলি; এমনকি আমাদের গ্রামের মানুষকেও তাঁর এখানকার কোনো কথা না জানাই। তাঁকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললাম, অবশ্যই সব কথা গোপন রাখব। আপনি আমার প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারেন। পর মুহূর্তে তাঁকে বললাম, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আপনার জীবনসংগ্রামের কাহিনি আমাকে বলতে পারেন। মানে কীভাবে এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছেন।কৌত‚হল থেকে জানতে চাচ্ছি। ইচ্ছে না থাকলে বলার দরকার নেই। বিনয়ের সঙ্গে তিনি বললেন, তুমি আগামী শুক্রবার সকাল দশটায় আমার বাড়ি এসো। তখন বলব সব কথা। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। মনে থাকে যেন।

ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে যাই আমি। বাড়িটি চিনতাম। ওই বাড়ির সামনে দিয়ে আমি অনেকবার হেঁটেছি।তখন দৃষ্টিনন্দন বাড়িটির দিকে তাকিয়ে দেখতাম বারবার। রাস্তার মানুষজনকেও তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। এমন রাজপ্রাসাদতুল্য বাড়ি যে রাজশাহী শহরে খুব কম আছে। আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তিনি ভেতরে নিয়ে যান। নিচতলার ড্রয়িংরুমে বসার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার সামনে হাজির হয়ে যায় নানা পদের খাবার। বুঝতে পারি আমার জন্য আগেই তৈরি করে রাখা হয়েছে। কিংবা এমন অভিজাত পরিবারে এসব খাবার সবসময় থাকে। তাঁর পীড়াপীড়িতে সেখান থেকেসামান্য কিছু মুখে দিয়ে বললাম—আংকেল, আমি খেতে আসিনি। এসেছি আপনার গল্প শুনতে।
তিনি বললেন—আগে কিছু খেয়ে নাও। সব কথা বলব। সারাদিন তো পড়ে আছে। তোমাকে পেয়ে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আজ তোমাকে ছাড়ছি না সহজে। তাঁর কণ্ঠে আন্তরিকতা আর আবেগ একসঙ্গে ঝরে পড়ছিল, যা আমাকে মুহূর্তে স্পর্শ করে। এমনভাবে আমার সঙ্গে কাউকে কখনো কথা বলতে দেখিনি। মনে হয়েছিল, তাঁর কাছে আমি শিশু। যেভাবে ছোটবেলায় আমাকে এটা-ওটা খাওয়াতেন, তেমনই করলেন সেদিন।
তারপর পুরো বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখালেন। কথায় কথায় জানালেন, তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন গত বছর। ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে। তাঁকে দেখাশোনা করে কাজের লোক আর কর্মচারীরা। ঘরে বসেই সবকিছু তদারকি করেন তিনি। তাঁর বলা কথাগুলো আমার কাছে রূপকথার মতো লাগে। এ যে আলাউদ্দিনের আশ্চর্যপ্রদীপের কাহিনিকে হার মানানোর মতো ব্যাপার। তন্ময় হয়ে শুনতে থাকি আমি।

 

চার

আমি যেদিন রাজশাহীর মাটিতে পা রাখি, পকেটে একটি টাকাও ছিল না। কপর্দকশূন্য। এদিকে খিদায় জ¦লছিল পেট। বাড়ি ছাড়ার পর প্রথমে ভেবেছিলাম, ঢাকায় আত্মগোপন করে থাকব। পরক্ষণে ভাবলাম, আমাকে এমন কোথাও চলে যেতে হবে যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না। এ-রকম চিন্তা থেকে চেপে বসেছিলাম রাজশাহীর ট্রেনে। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের পাশের একটি রেস্টুরেন্টের মালিককে অনুরোধ করে বললাম, আপনি যদি থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে আমাকে একটি কাজ দেন, আমি তা করব; কোনো টাকা দিতে হবে না। আমাকে আপাদমস্তক দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ কাজের ব্যবস্থা করে দেন। আমার মন আপ্লুত হয়ে ওঠে কৃতজ্ঞতায়। ভদ্রলোকের নাম ছিল ওসমান গনি চৌধুরী। রাজশাহীর স্থানীয় লোক। আমার থেকে বয়সে কিছুটা ছোট হবেন হয়তো!

কিছুদিন পর তিনি আমাকে ক্যাশে বসতে দেন; লক্ষ টাকার চেক দিয়ে টাকা তোলার জন্য পাঠান ব্যাংকে। আমি জানতাম, তিনি আসলে আমাকে পরীক্ষা করার জন্যই এসব করতেন। তাঁর সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম আমি। দিন দিন আমি তাঁর বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠি। আমার মধ্যেও প্রকাশ পায় স্বাভাবিকতা। একসময় পরিবারটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই আমি। আমার রাজশাহীতে আসার মাস ছয়েক পর পুঠিয়ার কাছে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারাত্মক জখম হন; তিনদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে মৃত্যুবরণ করেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মারা যাওয়ার সময় গনি সাহেব আমাকে হাত ধরে অনুরোধ করেন, আমার বাচ্চাগুলোকে আপনি দেখে রাখবেন; তাঁরা স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত ওদের অভিভাবক হয়ে আপনি তত্ত্বাবধান করবেন আমার সব বিষয়-আশয়। তাঁর স্ত্রীর সম্মতি নিয়ে আরও অনুরোধ করেন, আমার কিছু হয়ে গেলে আপনি আমার স্ত্রীকে বিয়ে করবেন। তাঁকে তখন আমি কথা দিয়েছিলাম।

তারপর থেকে আমার সমস্ত মনোযোগ ছিল ব্যবসায়ে। অন্য কোনোদিকে সময় দিইনি। ঠিক ভাবে ঘুম পর্যন্ত যেতাম না। ব্যবসা বাড়াতে বাড়াতে গড়ে তুললাম চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। অল্প সময়ে ব্যবসা অবিশ্বাস্য রকমভাবে সম্প্রসারিত হয়। আমার সততার সুনাম এত ছড়িয়েছিল যে, রাজশাহী শহরের ব্যাংকের ম্যানেজাররা এক রকম জামানতহীন ঋণ দিয়ে আমার পাশে দাঁড়ান। তাঁদের সহযোগিতা না পেলে এতদূর হয়তো আসতে পারতাম না। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিধি।

 

পাঁচ

রাজশাহী শহরে ‘স্বপন চৌধুরী’ এক নামে পরিচিত। তাঁকে চেনে না এখানে এমন মানুষ খুব কম। চিনতেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। ফুল ফুটলে সুবাস যে ছড়াবেই, তা বনের যত গভীরে ফুটুক না কেন। একজন মুক্তমনা পরিচ্ছন্ন মনের আলোকিত মানুষ হিসেবে শহরবাসী তাঁকে দেখত শ্রদ্ধার চোখে। কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বলে আমি তাঁর ব্যাপারে এসব জানতে পেরেছিলাম। তিনি হিন্দু না মুসলমান, তা এখানকার কেউ জানত না; কারণ ‘স্বপন চৌধুরী’ নাম দেখে তা বোঝার উপায় নেই। ধর্মীয় পরিচয়ের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিতেন না। কখনো বলতেন, আমি একজন মানুষ। এটাই আমার পরিচয়। এ-কথার পর আর কিছু বলার সাহস কেউ পেত না। তিনি সহজে ঘনিষ্ঠ হতে চাইতেন না মানুষের সঙ্গে। রাশভারী স্বভাবের মানুষ বলে সবাই তাঁকে সমীহ করে কথা বলত।

তিনি মসজিদ, মন্দির বা গির্জায় কখনো যেতেন না। এমনকি দান করতেন না কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। কেবল দাতব্য ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে দান করতেন।তিনি যে একজন সৎ মানুষ এই ব্যাপারে কারও কোনো সন্দেহ ছিল না।একটিও অবৈধ টাকা নেই তাঁর সম্পদে। তিনি কোনো মানুষকে কখনো ঠকাননি। বরং উদার হাতে দান করেছেন গরিব-দুঃখী মানুষজনকে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে তাঁর উৎসাহের কমতি ছিল না। তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করতেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অনেক প্রতিষ্ঠানকেও। সহযোগিতার আশায় তাঁর কাছে আসা কাউকে কখনো বিমুখ করতেন না। একটি বিষয় খেয়াল করেছিলাম, স্বপন কাকু যে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধে যে তিনি পা হারিয়েছেন, তা রাজশাহীর মানুষজন জানত না। তিনি এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেননি কখনো। সার্বিক কর্মকান্ড দেখে বুঝতে পারলাম, তাঁর মানবপ্রেম সাংঘাতিক। তাঁর সব গুণকে ছাপিয়ে যায় মানুষের প্রতি ভালোবাসা। তিনি বলতেন, মানবপ্রেমই দেশপ্রেম। ঈশ্বর প্রেম। মানুষের সেবা করলে আলাদা করে ঈশ্বরকে ডাকার প্রয়োজন নেই। লৌকিকতা ধর্ম নয়। তিনি মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য করতেন না। সব মানুষকে দেখতেন সমান চোখে।

 

ছয়

সেদিনের পর থেকে দুজন একই সময়ে হাঁটতে বের হতাম। প্রায় প্রতিদিন আমাদের দেখা হতো। কথা হতো।আড্ডায় আড্ডায় অসম বয়সি দুজন মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে চমৎকার বন্ধুত্ব। আমাকে পেয়ে তিনি যেন ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর হারানো জীবন। আলাপে বেশি থাকত তাঁর ফেলে আসা দিনের কথা। আমি প্রশ্ন করে করে কথা বের করতাম। একটা প্রসঙ্গ একবার উঠলে সহজে তিনি শেষ করতে চাইতেন না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেবল শুনতাম।

 

সাত

ছয় মাসের মাথায় হঠাৎ আমার বদলির অর্ডার হয়ে যায়।আবার ফিরতে হবে ঢাকায়। হেড অফিসে।স্বপন কাকুকে এই কথা জানানোর পর গম্ভীর হয়ে যান তিনি। এই অবস্থায় কথা ঘুরিয়ে আমি অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই। তিনি তা বুঝতে পেরে স্মিত হাসেন—তুমি দেখছি ঠিক তোমার বাবার মতো। মনের মধ্যে ঘুরপাক খেলেও এতদিন যে প্রশ্নটি করার সাহস পাইনি, বিদায়কালে তা করে বসি।—আংকেল, আপনার কি একবারও জন্মভিটায় যেতে ইচ্ছে করে না? সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখ আবার অন্ধকারে ঢেকে যায়। কী ভেবে যেন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন—বুকের ভেতর যে আগুন জ¦লছে, তা মরলেও নিভবে না। গ্রামের যে স্মৃতি আমার মনের মধ্যে আছে, তা নিয়েই আগামী দিনগুলো পার করে দিতে চাই। দেশের জন্য এত কিছু করলাম, পরিণামে আমি কী পেয়েছি? তাঁর কথায় ঝরে পড়ছিল আবেগ। তাঁকে স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, আপনাকে তো সবাই সফল মানুষ হিসেবে জানে। কী নেই আপনার? অর্থ-বিত্ত, সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবই তো পেয়েছেন এক জীবনে। তবু আপনি এমন কথা কেন বলছেন? আমার মুখের দিকে নিস্পলক চেয়ে থাকেন তিনি। কোনো কথা বলেন না। চোখের কোণে চিকচিক করছিল অশ্রু। আমি আবার প্রশ্ন করি—আংকেল, আপনি কি ভালো নেই? এবারও তিনি নিরুত্তর।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>