| 23 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: ধূসর নির্জনতা । পলি শাহীনা

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

সেঁজুতি আজকাল নির্জনতার মধ্যে অহর্নিশ ডুবে থাকে। জাগতিক বিষয়গুলো ওকে তেমন টানে না। সবকিছুতে নিশ্চুপ, নির্লিপ্ত, গা বাঁচিয়ে চলে। নিভৃতবাস এই সময়ে ও নির্জনতার সঙ্গে গল্প করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। গত কয়েক মাস হতে মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে যেতে যেতে সেঁজুতি নির্জনতার মোহে আটকা পড়েছে। এছাড়া অন্য কোন উপায়ও তো নেই। আসলে বাধ্য হয়েই নিজেকে গৃহ কোণে নির্জনতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। 

একটা কঠিনতম বিপন্ন সময়ের ভেতর দিয়ে মানুষ চলছে। সেঁজুতি মাঝেমধ্যে নিজেকে দূর্ভাগা ভাবে এই ভেবে যে – ওর জীবিতকালে এমন কঠিন সময়ের সম্মুখীন হয়েছে বলে। গত একশত বছরেও মানুষ এমন সংকটকালে পড়েনি। মানুষের আয়ু খুবই স্বল্প। এরমধ্যে কত কত দিন, সপ্তাহ, মাস খোয়া যাচ্ছে জীবনের আনন্দঘন মুহূর্ত থেকে। 

জীবনটাকে মনে হয় তপ্ত চৈত্রের উঠোন। কাছের মানুষগুলো রোজ দূরত্ব মেপে দূরে সরে যাচ্ছে।  প্রিয় মুখাবয়ব দিন দিন ঝাপ্সা হয়ে আসছে৷ এরমধ্যে কত কত প্রিয় মুখ ধূলোর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। ভাবতেই বুকের ভেতরটায় হাহাকার জাগে। কী যে ভীষণ একা লাগে! চারপাশে দেয়াল আর দেয়াল, হাসফাঁস লাগে। চরাচরে যেন মহাকালের মতো মস্ত এক তালা ঝুলছে। যে তালার চাবি এখন পর্যন্ত কোন মানুষের কাছে নেই। মানুষ নেই, কোলাহল-ধুলোবালি নেই। বিষন্নতার চাদরে মোড়া নির্জন সময়। বাতাসে করোনার আভাস, শ্বাস নিতেও হাড় হিম হয়ে আসে। শেকল পরা শ্বাসরুদ্ধকর সময়। একটা অচেনা ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। গোটা পৃথিবী বড্ড অচেনা লাগে। সহস্র বছরের প্রাচীন অন্ধকারের তেজ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আতঙ্কে সেঁজুতির আত্মা সর্বদা থরথর কাঁপে। 

সারাক্ষণ সেঁজুতির মনে হয় দরজার ওপাশে কোন একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে, ওর অপেক্ষায়। অন্ধকার নেমে এলে ছায়া আরো স্পষ্ট হয়৷ ছায়া এদিক-ওদিক হাঁটে। পা টিপে টিপে সেঁজুতি দরজার কাছে যায়। পিপহোল দিয়ে দেখে। না, কেউ নেই। সব শূন্য শূন্য লাগে। এই অস্থিরতা কবে ঘুচবে, ও জানে না। 

বাবুই পাখির মত বাবা-মায়ের যত্নে গড়া প্রকান্ড বাড়িটাতে দখল নিয়েছে অন্য কেউ৷ সেঁজুতি এই বাড়ির রাজকন্যা। বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে সেঁজুতির ভালোবাসা, যত্নের সাজ-সরঞ্জাম রয়েছে, অথচ সেঁজুতির চেয়ে এখন সবকিছুতে ওদের অধিকার বেশী। বিষয়টি ও বেশ টের পাচ্ছে। সেঁজুতি স্পষ্ট শুনতে পায়  ওদের হাসি, কথোপকথন, ধ্বনি। ওরা সেজুতির সাথে সমান্তরালে হেঁটে চলে, এ ঘর হতে ও ঘরে। সেঁজুতির নির্জন সময় আজকাল ওদের হৈ-হট্টগোলে ভরে উঠে। করোনাকালীন এই লকডাউনে সেঁজুতি যেন ওদের সঙ্গেই জীবন যাপন করছে। দিন যত গড়াচ্ছে ওদের আধিপত্য তত বাড়ছে। 

ঠিক এই মুহূর্তে সেঁজুতি দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে জানালার পাশে, ঘরের লাগোয়া বারান্দায়। গত দু’দিন একটানা বৃষ্টি হয়েছে। জলমগ্ন শহরের ইটকাঠ-পথঘাট-দেয়ালের চুন সব জুবুথুবু ভিজে আছে৷ জলের দখলে গোটা শহর। একটি বৃষ্টিভেজা রাত আর সেঁজুতি পরস্পরকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে, একাকী। 

গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা চারপাশ, আলো নেই। আচমকা সেঁজুতি টের পায়, পায়ের নীচে জল বাড়ছে৷ কুয়াশা ঘিরে ধরেছে ওকে। সমুদ্রের নীল জল ওর পায়ের পাতা ছুঁয়ে ক্রমশ বাড়ছে। বেসামাল জলের গতি ধীরে ধীরে ওর পা ভিজিয়ে মাথার দিকে ধেয়ে আসছে৷ সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত সেজুতি ক্রমান্বয়ে অতল জলে ডুবে যাচ্ছে৷ ওর শ্বাসরোধ হয়ে আসছে৷ মারা যাচ্ছে। একটু একটু করে মারা যাচ্ছে৷ জল, জল বলে ও চিৎকার করে উঠে। সেঁজুতির গোঙানির মতো শব্দ শুনে ওর মা দৌড়ে এসে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দেয়। 

– জল ! 

– কোথায় জল?  

– জল ছিলো তো মা! বোধহয় সরে গেছে অন্য কোথাও! 

– ডাক্তারকে বলে এবার তোর ওষুদের মাত্রাটা দেখছি বাড়াতেই হবে। দিন দিন অস্বাভাবিক আচরণ বেড়েই চলছে! 

– সুইডিশ তরুণী গ্রেটা থানবার্গের কথা মনে আছে মা? জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অবিলম্বে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতা, বিশ্ব নেতাদের কাছে যে  কিশোরী মেয়েটি আহবান জানিয়েছিলো! ভূমন্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি একটি কিশোরী মনকে ভাবিয়ে তুললেও, বিশ্ব নেতারা ছিলো ভ্রুক্ষেপহীন। করোনা ভাইরাস নাকি ক্ষমতাধর বিশ্ব নেতা-মানব প্রজাতির জন্য কোনটা বেশি ভয়ংকর, মা? 

– মাথায় যে কী হচ্ছে তোর? পাগলামি বন্ধ কর। ঘরে চল।

অশান্ত সেঁজুতির মাথায় হাত বুলিয়ে মা ওকে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়। মেয়ের মুখে গভীর ভয়ের স্পষ্ট মানচিত্র দেখে মা নিজের ঘরে না গিয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়ে। সন্তানের মনের গোপন পাঠোদ্ধার করতে মায়ের কষ্ট হয় না। সেঁজুতির চুলে বিলি কাটতে কাটতে মা বলেন, 

 ‘অনেকদিন হয়েছে তুই একদম ঘরের বাইর হোস না। করোনা প্রতিরোধের যথাযথ নিয়ম মেনে আগামীকাল সকালে আমরা বাইরে হাঁটতে যাবো। তুই কিন্তু এবার না কর‍তে পারবি না। ‘ 

মায়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে সেঁজুতি মায়ের বুকের ভেতরে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে। মা ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে। 

রাত আরো গভীর হয়। সেঁজুতির চোখে ঘুম নেই। ও ইদানীং আগের চেয়েও বেশি ইনসমনিয়ায় ভুগছে। শেষ কবে গভীর ঘুম ঘুমিয়েছে মনে পড়ছে না। সেঁজুতি ঘণ অন্ধকারের বুকে ঘরের সাদা দেয়ালগুলোর দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে কিছু সময় আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবছে। ভাবতে ভাবতে ওর তন্দ্রা লেগে আসে। এবার জল নয় রুমের দেয়ালগুলো আস্তে আস্তে ওর দিকে ঘনীভূত হয়ে আসছে। ওকে চেপে ধরতে চাইছে যেন। ও ভয়ে ঠকঠক কাঁপছে আর বোবার মতো দেয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। 

দিনভর আড়ালে যাদের শব্দ শুনেছে ওরা এখন প্রকাশ্যে সেঁজুতির সামনে বেরিয়ে এসেছে। দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা টিকটিকি, তেলাপোকা, আরশোলা, পিঁপড়া, দলে দলে বেরিয়ে আসছে সেঁজুতির দিকে। আগে ওরা এভাবে কাছে আসার সাহস না পেলেও, আজ বীরত্বের সঙ্গে খুব কাছে এসে অবলীলায় ওর চারপাশে হাঁটছে। আগে সেঁজুতি অকারণে নির্বিচারে যখন তখন পায়ের নিচে ফেলে ওদের মারতো। ওরা প্রাণের ভয়ে সামনে আসতো না। অথচ আজ ওরা একদম ভয় পাচ্ছে না। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে আর সেঁজুতির সামনে এসে নখ, হুল দেখিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। ওদের ভয়ংকর রুপ দেখে মনে হয় এখুনি ওরা ভাগাভাগি করে সেঁজুতির চোখ, নাক, কান, ফুসফুস, কিডনি খেয়ে ফেলবে। ওদের উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছে। একে অন্যের সঙ্গে সন্ধি করছে কে কী খাবে, কিভাবে আয়েশ করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। সেঁজুতি যেমন করে ওদের মেরে উল্লাস প্রকাশ করতো, একইভাবে আজ ওরাও সেঁজুতিকে খুচিয়ে খুচিয়ে মেরে উল্লাস প্রকাশ করবে। প্রতিশোধ পরায়ণ ওদের দলে দলে দেখে আতংকে সেজুতি বরফের মতো জমে যায়। শরীরের অঙ্গ- প্রত্যঙ্গগুলো কাজ করছে না। 

ঘরের দেয়ালগুলো এতক্ষণে চারপাশ থেকে একেবারেই বুকের উপরে চলে এসেছে, সঙ্গে ওরাও। সেঁজুতি বুঝতে পারে ও মারা যাচ্ছে। এত বছর ধরে নির্বিচারে ও যেভাবে ওদের মেরেছে, আজ ওরাও সেঁজুতিকে প্রাণে মেরে ফেলবে। অন্ধকারে ওদের চোখে প্রতিশোধের জ্বলজ্বল আগুন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে৷ একদল পিঁপড়া ওর দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে।

ঠিক তখুনি সেঁজুতির ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। ও জানে পিঁপড়া তার শরীরের ওজনের চেয়েও বিশ গুণ বেশী ওজন বহন করতে পারে। পিঁপড়া একাতাবদ্ধ  প্রাণী। ছোটবেলায় ও দেখেছে কেমন করে ছোট ছোট পিঁপড়ার দল আস্ত একটা মরা সাপ বয়ে নিয়ে যেত বহুদূরে। পিঁপড়া- পোকা মাকড়দের একতার কথা ভেবে ও ঘামতে থাকে। ওদের হাসি আনন্দের শব্দ বেড়েই চলেছে। সেঁজুতির শ্বাস আরো ঘন হয়ে আসছে। 

করুণ চাহনিতে সেজুতি ওদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায়। ওরা একযোগে উচ্চস্বরে ধমক দেয় আর বলতে থাকে, 

 ‘তোমরা স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ প্রজাতি। তোমরা নিজেদেরকে যতই বড় ভাবো না কেন, কিন্তু তোমাদের ক্ষমতা খুব কম, সীমাবদ্ধ। তোমাদের পরিধি মনুষ্য সমাজের মধ্যেই তোমরা সেরা। যা কিছু করছো নিজস্ব গন্ডীর ভেতরেই করছো। তোমরা স্বার্থপর, হিংস্র প্রজাতি। নিজেদের স্বার্থ ছাড়া জগতের অন্য প্রাণদের ভালো-মন্দের খোঁজ রাখো না। নিজেদের প্রয়োজনে অন্য প্রাণদের হত্যা করতে কুন্ঠা বোধ করো না। তোমাদের থাকা না থাকায় এই চরাচর, মহাশূন্যের কিছু যায় আসে না৷ তোমরা নদী ধ্বংস করেছো। শীতকালের মেঘ, কুয়াশা, পাখী, গাছের ছায়া সব সব ধ্বংস করেছো। লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রপ্রধান, জনপ্রতিনিধি আরো কত কী – তোমাদের ঔদ্ধত্য, ক্ষমতার দম্ভ দেখে হাসি পায় আমাদের। তোমাদের অস্তিত্ব সম্ভবত আর অনুমোদন করছে না এই গ্রহ এবং প্রকৃতি, তাই তোমরা আজ গৃহবন্দী। এই গ্রহে আজ তুমি-তোমরা একা এবং নিসঙ্গ। প্রকৃতি অসমতা পছন্দ করে না। প্রকৃতির বাটখারায় সবাই সমান। প্রকৃতি আজ কড়া গন্ডায় সব হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছে তোমাদেরকে। প্রকৃতির নিয়মেই আজ তোমরা অসহায় ঘরবন্দী। ‘ 

একটা রাণী পিঁপড়া উড়ে এসে সেঁজুতির কানের ভেতর সুড়সুড় করে ঢুকে যায়। ও ফূর্তি করতে করতে বলে, 

‘ তোমরা মানুষ আমাদের মতোই একটি প্রাণ মাত্র। তোমার-আমার প্রাণের মধ্যে পার্থক্য নেই কোন। তোমরা-আমরা মিলেই প্রকৃতি ও পৃথিবী। অকোষীয় একটি অনুজীবের কাছে তোমাদের জীবন থমকে গেছে, তোমরা স্বাধীনতা হারিয়েছো। আতঙ্ক তোমাদের নিত্য সঙ্গী। অথচ দেখো আমি চলছি চিরাচরিত নিজস্ব নিয়মে। আমার কোন বিকার নেই কোথাও। তোমরা নিজেদেরকে এই গ্রহের মূল্যবান প্রাণ ভাবতে, অন্য সব প্রাণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে৷ আজ তোমরা অবরুদ্ধ যখন আমি মনের সুখে আনন্দে আছি। তোমাদের জন্য আজ করুণাও হয় না। এই শাস্তি তোমাদের প্রাপ্য । প্রকৃতির অন্য সকল প্রাণকে প্রাপ্য ভালোবাসা থেকে যতটুকু বঞ্চিত করেছো ঠিক ততটুকু শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে৷ ‘ 

বিদ্যুৎ শকের মতো ভয়ের রেখা উঠছে ক্রমাগত সেঁজুতির শিরদাঁড়া বেয়ে। বজ্রপাতের শব্দে তন্দ্রা কেটে যায় ওর। জানালার পর্দা নড়ছে, গ্রীলের ফাঁক গলে শীতল বাতাস ঢুকছে ঘরে, বৃষ্টির ঝরঝর শব্দ আসছে কানে। ঘুম ভেঙে ঝড়ে বিঃধ্বস্ত অসহায় পাখীর মতো কাঁপছে সেঁজুতি। 

 

সন্ধ্যা রাতের মতো বেসামাল সমুদ্রের নীল জল নয়, ওর দু’গাল বেয়ে নোনা জলের নিঃশব্দ প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ আগে দেখা দুঃস্বপ্নের দৃশ্যগুলো এড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে সেঁজুতি। কোনভাবেই দৃশ্যগুলো চোখের আড়াল হচ্ছে না। সাবানের ফেনার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। 

দুঃসহ লাগছে সব। হাসি নেই। কান্না নেই। ক্ষুধা নেই। জীবন যেন তার সমস্ত গতি হারিয়ে ফেলেছে। স্থির সময়ের ধূসর নির্জনতা পাথরের মত চেপে বসেছে সেজুতির বুকে। 

অন্ধকারের আধিপত্য কমে এসেছে। ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুটছে। ভোরের কাঁচা ঘ্রাণ এসে নাকে লাগছে। দেয়ালের আড়ালের শব্দগুলো থেমে গেছে, সঙ্গে সেঁজুতিও থেমে আছে। ওর মাথা ভার ভার লাগে। ইদানীং পড়াশোনার চাপ নেই বললেই চলে, তবুও রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করেছে ওর আপাদমস্তক জুড়ে। গত কয়েকমাস থেকে কাজও করছে না। ও শংকায় টলতে থাকে। 

লম্বা শ্বাস নিয়ে বিছানা ছেড়ে সেঁজুতি জানালার পাশ ঘেঁষে বসে। 

সেঁজুতির ভাবলেশহীন মুখে এসে সকালের রোদ পড়ে। পৃথিবী ও প্রকৃতির বুকে চিকচিক আলো এসে খেলছে। মায়ের হাতে তৈরি ভেনিলা কফির মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছে। এই ঘ্রাণটি সেজুতির খুব প্রিয়। প্রত্যুষে মায়ের হাতে বানানো অমৃতসম কফি আর ফ্রেঞ্চ টোস্টের অপেক্ষায় থাকে সেঁজুতি। 

ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে চতুর্দিক। এই শহরের কোথায় কোন কংক্রিটের ফোঁকরে ফুটেছে এত ফুল, কে জানে! বারান্দায় লাগানো টবের গাছগুলোর সবুজ পাতা বৃষ্টিজলে আরো সবুজ হয়েছে। বৃষ্টির জল শিশিরের মতো জমে আছে পাতার শরীরে। বৃষ্টিজল আর সবুজ পাতার গাঢ় বন্ধুত্ব সেজুতির চোখে আরাম দেয়। রাতভর দেখা স্বপ্নের নীল কষ্ট শরীরের জড়িয়ে বাইরের মনোরম পৃথিবী দেখছে ও। অপরাধের দাবানলে পুড়ছে মনের শরীর। যে প্রকৃতি এত আরাম দেয় চোখে, মনে, সে প্রকৃতিকে মিছেমিছি কত অবহেলা করেছে ও। পায়ের নিচে পিষে মেরেছে কত প্রাণ অকারণে। 

আচমকা একটা তীব্র যান্ত্রিক শব্দ সেজুতির প্রকৃতির সঙ্গে ধ্যান ভঙ্গ করে দেয়। 

করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইটালিয়ান বংশোদ্ভূত হেলেন গত হয়েছেন গত এপ্রিল মাসে। সেঁজুতির বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে কয়েকটি বাড়ি পরেই হেলেনের বাড়ী। সেঁজুতির সাথে হেলেনের সখ্য বেশ কয়েক বছর ধরে। হেলেন বাড়ির আঙ্গিনায় হরেক রকমের ফুলের বাগান করতো। হেলেন ভীষণ প্রকৃতি প্রেমী ছিলেন। কাঁচা ফুল সেঁজুতির পছন্দ। বিভিন্ন সময়ে ও হেলেনের বাগান থেকে ফুল নিয়ে আসতো। অবসরে হেলেন সেঁজুতির সাথে গল্প করতো,  নেইলপালিশ হাতে- পায়ে লাগিয়ে দিতো। হেলেন ওদের ঐতিহ্যগত খাবার পাস্তা রান্না করলে ওকে খেতে দিত। হেলেন বাড়িতে একাকী বসবাস করতেন। দিনের বেলায় অবশ্য তাঁর দেখাশোনার জন্য একজন নার্স থাকতো। 

হেলেনের দুই ছেলে। এক ছেলে পাশের রাজ্য নিউজার্সিতে থাকে। অন্য ছেলে হেলেনের বাড়ির দোতলায় থাকলেও রাতের বেলা হেলেন একাকী নিচের ফ্লোরে ঘুমাতো। বেঁচে থাকাকালীন সকালের এই সময়টা হেলেন সাজি হাতে বাগান থেকে ফুল তুলতো। তাঁর বাগান খুব পরিপাটি, সাজানো গোছানো ছিলো। হেলেন মারা যাওয়ার পর গত কয়েকমাস সেঁজুতি আর ওই বাড়িতে যায় নি। 

হেলেনের বাড়ির সামনে-পিছনে প্রচুর গাছগাছালি রয়েছে। ওরা রাজার মত দাঁড়িয়ে থেকে বুক চিতিয়ে ছায়া দেয় বলে, সেঁজুতি ওদেরকে ছায়া গাছ নাম দিয়েছে। গাছের ফাঁকফোকরে হরেক রঙের পাখি ছিল। হেলেন ওদেরকে পাউরুটি, শস্যদানা খেতে দিত। ওদের কত কী নামও দিয়েছিলো হেলেন। পাখি ছাড়াও কাঠবিড়ালি, পোকামাকড়, প্রজাপতির আবাস্থল ছিল হেলেনের বাড়ির চারপাশে ঘিরে থাকা সবুজের সমারোহে। হেলেন আর ওরা ছিলো একে অন্যের প্রাণের স্বজন। 

হেলেনের মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে সমানভাবে এই বাড়ি ভাগ করে নেয়। পুরনো দোতালা বাড়িটি ভেঙে  দুই ইউনিটের ছয়তলা বাড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় ছেলেরা। ছেলেদের মুখেই শুনেছে কথাগুলো সেঁজুতি। আজ ওরা বাড়ির চারপাশের গাছগুলো কেটে ফেলবে। কারণ গাছের শিকড়, ডালপালা নাকি পানির লাইন, সুয়ারেজ লাইনের জন্য বিপদজনক। বাড়ির নতুন কাজ শুরু করার আগে কোনরকম ক্ষতির আশংকা রাখতে চায় না ওরা। 

ছায়া গাছগুলো এক এক করে নিধন হয়ে যাচ্ছে সেঁজুতির চোখের সামনে। গাছ কাটা মেশিনের তীব্র শব্দ উপেক্ষা করে ভারী মনে ও জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সুখ সুখ মোলায়েম আলোর নরম সকালটি বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। গাছের ডালে থাকা পাখির বাসা ওর চোখের সামনেই প্রাণসহ মাটির বুকে মুখ থুবড়ে পড়ে। ছানাগুলোর গগনবিদারী চিৎকার ওর বুকে এসে তলোয়ারের ফলার মতো বিঁধে। সদ্য গৃহ থেকে উচ্ছেদ হওয়া মা পাখি জমিনে পড়ে থাকা ছানাকে ঘিরে শূন্যে উড়ছে। গৃহহীন কাঠবিড়ালি, প্রজাপতি, পোকামাকড়ের দল দিশেহারার মতো এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। গাছেদের সঙ্গে টুপটাপ ঝরে পড়ছে ওদের আবাসস্থল। 

ওর বুকে কষ্টের মিছিল বইছে। গাছগুলো  সঙ্গে সেঁজুতিও অঝোরে কাঁদছে। ওর ভীষণ অসহায় লাগছে। সেঁজুতির কান্নার শব্দ পেয়ে মা দৌড়ে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। 

– গাছের প্রাণ আছে মা! দেখো ওরা কাঁদছে। 

– মানুষের প্রয়োজনে বেঁচে থাকার তাগিদে দরকার হলে কী করবে? কেন এমন পাগলামি করছিস? মায়ের এমন উত্তর শুনে সেঁজুতির আত্মা থরথর  কেঁপে উঠে। 

– জগতের অন্যসব প্রাণের মতো মানুষও একটি প্রাণ বৈকি আর কিছুই নয়! শুধুমাত্র মানুষ বেঁচে থাকার প্রয়াসে এত এত প্রাণ মেরে ফেলা কী উচিৎ, মা? সামগ্রিক মাপকাঠিতে সমস্ত প্রাণের বিরুদ্ধে মানুষ অপরাধ করছে! এ চরম অন্যায়! মানুষ অন্যায়কারী! সেঁজুতির প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই মায়ের কাছে। তিনি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না। নির্বোধের মতো মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়ের জন্য মায়ের বুকে চিনচিন ব্যথার স্রোত বয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে লকডাউনে ঘরে থেকে থেকে সেঁজুতি কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে। মায়ের নীরব দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলে যায়। সেঁজুতির চিন্তায় মায়ের কপালে বলিরেখা। 

বাচ্চার মতো সেঁজুতি কেঁদেই চলছে। মেয়ের অস্বাভাবিক আচরণ দিনদিন বেড়েই চলছে। মেয়ের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উত্তর দিতে না পারার অপারগতা লুকাতে মা প্রসঙ্গ বদলে বলেন,
 – চল মা আমরা বাইরে যাই, একটু বেড়িয়ে আসি। অনেকদিন ধরে ঘরে থেকে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছি। 

– ভালো লাগছে না মা। তুমি যাও! বাইরের আলো, মানুষ, শব্দ অসহ্য লাগছে! 

– দুপুরে তোর ডাক্তার আছে। এখন না গেলেও খানিক বাদে তো যেতেই হবে৷ 

– আমি যাব না মা। ডাক্তার আংকেলকে বলো আমার এন্টি ডিপ্রেশনের মাত্রা দ্বিগুণ করে দিতে। 

মেয়ের কথা শুনে মা চোখে সব ধোঁয়ার মতো দেখেন। মা জানেন জোরজবরদস্তি করে কোন ফল পাবে না। একবার না বললে সেঁজুতিকে আর রাজি করানো যাবে না। উদাস চোখেমুখে কিছুসময় দাঁড়িয়ে থেকে মা অবসন্ন মনে ঘরের ভেতরে চলে আসেন। দিনের সূর্য ঠিক মাথার উপরে। একটি তপ্ত, নির্জন দুপুর নামে। মা একা বেরিয়ে পড়েছেন সেঁজুতির ওষুধ রিফিলের জন্য। 

এখনকার সকাল-দুপুর-বিকেলগুলো আর আগের মতো নরম- সবুজ, নকশাআঁকা মনে হয় না সেঁজুতির। একটা ঘুড়ি কোথা হতে উড়ে জানালার শার্সিতে এসে বসে। ঘুড়িটি যেন সেঁজুতির দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে চায় ওকে। সেঁজুতি ঘুড়িটির গায়ে হাত দেয়। কোথাও ছেঁড়া নেই। ঘুড়ির শরীরে নাক লাগিয়ে ঘ্রাণ নেয়। বিচিত্র সব ঘ্রাণ লেগে আছে ঘুড়ির শরীরে। পাখীর ঘ্রাণ, পিঁপড়ার ঘ্রাণ, আরশোলা- তেলাপোকার ঘ্রাণ, প্রজাপতি, সমুদ্রের ঘ্রাণ, পোকামাকড়ের ঘ্রাণ সঙ্গে হাহাকারের ঘ্রাণ। নির্বিকার সেঁজুতি ঘুড়ির দিকে চেয়ে আছে। বাতাসে ঘুড়িটি দুলছে আর ঝিরঝির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়। 

সেঁজুতির এই মানুষ জীবন আর ভালো লাগছে না। ও ভাবছে জীবনটা যদি বদলানো যেত ওই প্রাণগুলোর সাথে! এই ইট-পাথর- কাঠের অট্রালিকা ছেড়ে ইচ্ছে করছে ঘুড়ির মতো উড়তে, ওদের সঙ্গে মিলে যেতে। ওর প্রজাপতি, ঝর্ণা, ফুল কিংবা পিঁপড়া  হতে মন চাইছে! ওরা কী সুন্দর! কত বৈচিত্রময় ওদের জীবন! মানুষের জীবন একঘেঁয়েমিতে ভরা। 

নদী হতে ঝর্ণা লাগে, প্রজাপতি হতে রঙ্গিন পাখনা লাগে, ফুল হতে ঘ্রাণ লাগে, পিঁপড়া হতে একতা লাগে – কিন্তু সেঁজুতির তো ওসব কিছু নেই। ওদের জীবন কত সহজ সুখে ভরা, আর মানুষের জীবন জটিলতায় ভরা। 

সেঁজুতির মন খারাপ হলে ও আঁকতে বসে কিংবা বাঁশি বাজায়। ওর বাঁশিতে বিষণ্ণ সুরের মূর্ছনা বাতাসের শরীর বেয়ে অজানায় পাড়ি জমায়।  দু’চোখের জলে বুক ভেসে যেতে যেতে, ওর গৃহত্যাগী হতে মন চাইছে। এমন অদ্ভুত ইচ্ছের কথা মা কিংবা অন্য কোন মানুষকে বলাও যাবে না। বললেই মা আর ডাক্তার মিলে শুধু ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দিবে। ওঁদের কাছে সেঁজুতির এমন ব্যবহার অস্বাভাবিক লাগে। সেঁজুতি আজকাল বুঝে পায় না – কে স্বাভাবিক? ডাক্তার, মা নাকি ও নিজে? 

একটা অন্যরকম অসুখ বয়ে বেড়াচ্ছে সেঁজুতি, যে অসুখের কোন নিরাময় না দিয়ে ডাক্তার শুধু ডিপ্রেশনের ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন অহর্নিশি। সেঁজুতি খুব বুঝে গেছে, ওর এই অসুখের কোন নিস্তার নেই। 

নির্জনতায় মানুষ সবচেয়ে বেশি কথা বলে। সমুদ্র, জল, কেটে ফেলা গাছ, গৃহহীন পাখী, পোকামাকড়, কাঠবিড়ালির সঙ্গে সেজুতি নিভৃতে অনর্গল কথা বলছে। ওদের কষ্ট, দুর্ভোগের ভাষা লকডাউনের গত কয়েকমাসে সেজুতির আয়ত্তে চলে এসেছে। ওরা এখন আর দেয়ালের আড়ালের অচেনা শত্রু নয়, পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠেছে। সেজুতি ওদের হুসহুস শব্দে ভয় পায় না আর। এই করোনাকাল সেঁজুতিকে অপরিসীম জ্ঞান দিয়েছে, জগতের অন্য সকল প্রাণকে উপলব্ধি করার মতো। ওদের কষ্ট দেখলে সেজুতির বুকে রক্তক্ষরণ হয়। এই রক্তক্ষরণ কোন মানুষ দেখে না। সেঁজুতির এই বেদনা কেউ টের পায় না।

 

 

 

One thought on “ইরাবতী গল্প: ধূসর নির্জনতা । পলি শাহীনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত