| 20 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

সাধন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প : বাস্তবের বিপ্রতীপ স্বর । পুরুষোত্তম সিংহ     

আনুমানিক পঠনকাল: 23 মিনিট

                                      

‘’আমি খাঁচার ইঁদুর হতে চাই না বলেই লেখি চলেছি।‘’ – ‘কেন লিখি’ শীর্ষক জবানবন্দিতে সাধন চট্টোপাধ্যায়ের এই বয়ান থেকে তাঁর সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি, অভিমুখ স্পষ্ট হয়ে যাবে। এ যাবৎকালে লেখা ছয়শ এর অধিক গল্পের অধিকাংশই লিট্ল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। সে যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘নন্দন’ পত্রিকার হাত ধরে। এই তেষট্টি বছরে তিনি নিজেই বারবার নিজেকে ভেঙে নির্মাণ করে নিয়েছেন। বাজারি পত্রিকার কাছে মাথা নত করে সাহিত্যকে পণ্যায়ন করে তোলেননি। নিজের মর্জি মতো সাহিত্যের দায়বদ্ধতা কোথায় তা নিজেই জেনে নিয়েছেন। সেই দায়বদ্ধতার প্রকাশ তো লিট্ল ম্যাগাজিন ছাড়া সম্ভব ছিল না। ‘গল্প সমগ্র ২’ এর ভূমিকায় সে সত্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে –‘’আমার প্রায় সব লেখাই লিট্‌ল ম্যাগাজিনে –খ্যাত, উনখ্যাত, অখ্যাত, পশ্চিমবাংলায় ছড়িয়ে থাকা পত্রিকাগুলোয় মুদ্রিত।‘’ প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মনোনয়ন’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে। এরপর একে একে ‘নাগপাশ’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘মহারাজা দীর্ঘজীবী হোন’ ‘বেলা অবেলার কুশীলব, ‘গল্পসংগ্রহ’, ‘সাধন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প’, শ্রেষ্ঠ গল্প ও খণ্ডে খণ্ডে ‘গল্প সমগ্র’। গল্প প্রবেশের আগে তাঁর সাহিত্যভাবনার স্বরূপ জানা জরুরি। ‘কেন লিখি’ শীর্ষক বয়ানে জানিয়েছেন –

‘’আমার স্বভাবে কোনো সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভ্যেস নেই। কোনো কিছুকেই চুড়ান্ত বলে ধরে নিতে দ্বিধাবোধ করি। সামান্য ক্ষিপ্রতা ও সংশয় আমার সাফল্য-ব্যর্থতায় সর্বদা খেলা করে বেড়ায়। তাই কোনো একটা বিশেষ কায়দায় বা ঢংয়ে গল্প লিখে হাততালি-প্রশংসা জোটার পর, নিজেকে নতুন করে ভাঙার জন্য আকুল হয়ে উঠি। এ পর্যন্ত ছয়শ গল্প লিখেছি – কখনই শৈলী বা বিষয়ে পুনরাবৃত্তি করিনি। গাঁটের কড়ি হিসেবে সাফল্যকে আঁকড়ে ধরে রাখতে ক্লান্ত বোধ হয়। নব নব রাস্তায়, নিজেকে বদলাবার মধ্য দিয়ে যেটুকু স্বীকৃতি আসে – তাই-ই আমার পাথেয়।‘’ ( কী লিখি, কেন লিখি, সোপান, পৃ. ৪০ )

 এই প্রাককথন তাঁর গল্পসরণির ক্রমবিবর্তন লক্ষ করলেই পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। প্রকরণ গত বিবর্তন তো আছেই, সেই সঙ্গে ভাষা, সময়ের নানা সূক্ষ্ম পরিবর্তন তিনি বারবার ফুটিয়ে তুলেছেন। নির্মাণ শিল্প থেকেই বিনির্মাণে এগিয়ে গেছেন। আর এই এগিয়ে চলার পথে নিজেকে বারবার ভেঙে চলেছেন। নিজের অস্তিত্বের মধ্যেই যেন টের পেয়ে গেছেন সময়ের শিল্প হিসেবে গল্পের প্রকরণ কেমন হবে। নিজের ভাবনাবিশ্বের যাবতীয় অভীপ্সা স্পষ্ট করে দেন –‘’নিজেই আবার নিজেকে অতিক্রম করেছি। এই নিঃশব্দ লড়াইতে লেখককে ভয়ানক আত্মবিশ্বাসী হতে হয়।‘’( উত্তরাধিকার, সাম্প্রতিক বাংলা গল্প সংখ্যা, ১৯৯৬, পৃ. ২১ ) শুধু প্রকরণই নয় গল্পের চোরাস্রোতে সময়, সমাজ, ব্যক্তি- সমষ্টির ভাবনা বলয়ে যে ক্ষতগুলি বারবার উঁকি দিয়ে চলেছিল তার যে দোলাচলতা তাই ধরতে চেয়েছেন। আবার কখনও লিখেছেন –‘’আখ্যান রচনার ভবনে ইন্দ্রিয় বাস্তব ও শিল্প বাস্তবকে সাজানো গোছানো করে তুলে ধরতে গিয়ে নিজেকে বদলাতে হয়েছে বারবার।‘’ এ ক্রমবিবর্তন গল্পপাঠেই সচেতন পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে সে বয়নকে নিজেই যেমন ভেঙে দিতে চেয়েছেন তেমনি পাঠককেও প্রস্তুত করে দিতে চান। পাঠকও যেন সেই বয়নকে ভেঙে নিজেই নতুন সৃষ্টি সন্ধানে এগিয়ে যাবে, তাই ‘কেন এ অক্ষরস্বপ্ন’ জবানবন্দিতে লেখেন –‘’লেখক সৃষ্টি করে, নাকি পাঠকের মনে নব নব সৃষ্টির ইন্দ্রজাল উস্‌কে দেয় মাত্র। কেন এ-অজানা জিজ্ঞাসা ? কেন মানুষের জীবনে সাহিত্যের আত্মীয়তা দরকার ? এই মানুষের একটা টুকরো তো ভোগ, যৌনতা, সুখের লেইতে লেপটে থাকতে পারে। তবুও কেন হৃদয়ের অতৃপ্তি, নতুন কিছু খোঁজা ?’’ ( নীললোহিত, সেপ্টেম্বর ২০০২, সাধন চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা, পৃ. ৩৮১ ) এবার তাঁর গল্পভুবনে প্রবেশ করা যাক –

                                                                    ‘স্টীলের চঞ্চু’ গল্পটি ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকায় ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। লেখক সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণাত্ম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ গল্পে অবতীর্ণ হয়েছেন। আপাত ভাবে আমাদের নবীন প্রজন্মের চিন্তাভাবনাগুলি যে কত ভুল তা প্রতিপন্ন করেন। একটি সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চাইলেও তা যে সম্ভব নয়, সমাজব্যবস্থার ভিত্তি যে বহু ভিতরে অবস্থিত, তা চেষ্টা করলেও উপরে ফেলা সম্ভব নয়। অথচ সেই চেষ্টা কেউ কেউ করেছে। যা পুরাতন সবই ভিত্তিহীন তেমন তো নয়, আবার যা পুরাতন সবই ভালো তাও নয়। সেই ফিউডল নির্ভর সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে গিয়ে রুনু নিজেরই বিপর্যয় ডেকে এনেছে। লেখক এ গল্পে দুটি প্রজন্মের কথা ফুটিয়ে তোলেন। পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের আপাত চেষ্টা থাকলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। তবে রুনুর সব চিন্তাই যে যুক্তিহীন তা নয়। কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের পথ সেটা নয়। একটি সমাজের ভিত্তি যেহেতু গভীরে তা স্বল্প সময়ে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, পরিবর্তনের সঠিক পথও রুনুরা জানেনা।  একটা শ্রেণি কাকের মতো সমাজকে শোষণ করে চলেছে সত্য, কিন্তু সে পরিবর্তন খুব সহজে সম্ভব নয়। লেখক আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সমস্যার গভীর মর্মমূলে আঘাত করেন। কিন্তু সেখান থেকে পরিত্রাণের সঠিক কোন পথ দেখাননি। লেখকের কাজও সেটা নয়। মধ্যবিত্ত ভূপতি বাড়ুজ্যে বহু পরিশ্রম করে নিজের সংসার দাঁড় করিয়েছেন, ছেলে চাকরি পেয়েছে, ভেবেছেন এবার কিছুটা শান্তিতে কাটাবেন। ফলে ঘুণধরা সমাজের কথা আজ তিনি ভাবতে রাজি নন। সমাজকে বাদ দিয়ে তিনি ব্যক্তি সংসার নিয়ে সুখে থাকতে চান। সময়ের রহস্য থাবা থেকে কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলেও তো কারও কারও দৃষ্টিতে পরে। ভূপতিরা যৌবনে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল, পরে সংসারে প্রবেশ করেছে। কিন্তু এত বছরের সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলা সম্ভব নয়। তেমনি যৌবনের বিপ্লবী চেতনা বয়সের ভারে স্তিমিত হয়ে আসে। ভূপতি আজ নিজের সংসার নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করেছে। অথচ পুত্র দেখেছে নতুন দিনের স্বপ্ন –

‘’ওরা শুধু ছেঁড়া কাঁথায় তালি লাগাবার কথা বলে। সমাজ ওষুধের মূল খোঁজে না। সমাজ পুরো পাল্টে না গেলে কোনো কিছুর সমাধান হবে না। মাঝপথে কিছু নেই। ঐ কাক এবং স্টীলের ঝকঝকে চঞ্চুই তার প্রমাণ। অথচ মানুষষগুলো অন্ধ।‘’ ( গল্প সমগ্র ২, করুণা, প্রথম প্রকাশ -২০১১, পৃ. ১৫০ )

 কাক ও স্টীলের চঞ্চু প্রতীক ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। একটা শ্রেণি সমাজকে শোষণ করেছে। সেখানে থেকে পরিত্রাণের পথ আবিষ্কার করতে চেয়েছিল রুনু ও তাঁর সঙ্গীরা। কিন্তু সে পথ ছিল ভুল। সমাজ ব্যবস্থার পুরো কাঠামোটাই যে এক ভিত্তিহীন অলীক বাস্তবের ওপর দাঁড়িয়ে আছে লেখক তা দেখান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুঞ্জয় দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের বাঁচাতে গিয়ে নিজেই মৃত্যু বরণ করেছিল। এ গল্পে রুনুও পরিণতি তেমনই। তাঁর উপলব্ধি ‘’ঘুম কিছু কনডিশনের ওপর নির্ভর করে ? সমাজ না বদলালে কেউ সুস্থভাবে ঘুমোতে পারবে না ?’’ (তদেব, পৃ. ১৫৩) সেই সুস্থ সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল সে। চাকরি ছেড়ে নতুন দিন আনার চেষ্টা করেছিল। বুর্জোয়া উৎপাদন, ফিউডাল শ্রেণি, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা পাল্টে দিতে গিয়ে নিজেই মৃত্যুবরণ করেছে। সমাজকে দংশন করা কাকের চঞ্চুকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেই মৃত্যু ঘটিয়েছে। লেখক এ গল্পে মধ্যবিত্ত জীবনের অন্তরমহলে প্রবেশ করেছেন। পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সমাজ ব্যবস্থার প্রকৃত ক্ষত চিহ্নিত করেছেন। অথচ এ ব্যবস্থার পরিবর্তন যে সম্ভব নয়, তবে মাঝেমাঝে এমন চরিত্র নতুন দিনের স্বপ্ন দেখবে, আবার হারিয়েও যাবে সেই অনাগত ভবিষ্যতের স্বরূপ পাঠককে দেখিয়ে দেন।


আরো পড়ুন: সৈকত রক্ষিতের গল্প : ভিন্ন ভুবনের আখ্যান । পুরুষোত্তম সিংহ


 

                                  মধ্যবিত্তের আত্মপ্রত্যয়ী বিবেক পাল্টানোর চেষ্টা করলেও পাল্টানো সম্ভব নয়। যে আত্ম-অহংকার, ঔদ্ধত্য, ক্ষমতার লিপ্সা নিয়ে মধ্যবিত্ত বেঁচে থাকে তা যে কত মেকি তা প্রতিপন্ন করেছেন ‘রদবদলের পৃথিবী’ গল্পে। মধ্যবিত্তের বিবেক সময়ের বিবর্তনে খুব যে পাল্টে যায় তা নয়। আসলে রক্তের ভিতরে যে বহমান সত্য চিরকাল সঞ্চিত হয়ে আছে তার পরিবর্তন খুব ধীর গতিতে ঘটে। তবে সময়ের পরিবর্তনে, অবস্থার পরিবর্তনে মানুষের চেতনা সামান্য পাল্টায়। সেই পরিবর্তনই লক্ষ লেখকের। ডি.আই অফিসার কে.পি সান্যাল ছিল এক ক্ষমতা পরায়ণ মানুষ। চেয়ার, অর্থ, ক্ষমতাই তাঁর একমাত্র অহংকার। সেখানে মানুষ, মানুষ বলে বিবেচিত হত না। ক্ষমতার অহংকারে তাঁর বিবেকবোধ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। হেডমিস্ট্রেসদের অপদার্থ প্রমাণ করতেই তাঁর একমাত্র সুখ, ক্ষমতা বলে অন্যায় অর্থ নিতেও পিছপা হননি। কিন্তু কেস হওয়ায় চাকরি ঝুলে আছে। আজ বই ব্যবসায় নেমেছে সে। স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষকদের কাছে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। ক্ষমতার ঔদ্ধত্য ব্যবহারকারী মানুষের ক্ষমতা চলে গেলে কোন পরিণতি ঘটে তা লেখক দেখিয়েছেন। মূল্যবোধহীন মানুষ ক্ষমতাকে কীভাবে ব্যবহার করে, ক্ষমতার লিপ্সা মানুষকে কোন পর্যায়ে নামিয়ে আনে তা লেখক দেখান। ফলে অসুস্থ সন্তানও অসহ্য হয়ে ওঠে সান্যালের কাছে। ‘মানুষ আদতে অসৎ’, ‘ঘনিষ্ঠতায় স্ট্যাটাস মুছে যায়’ – এই যে মূল্যবোধের ভাঙন, মধ্যবিত্তের অবক্ষয়, আমি সর্বস্ব মানসিকতা ও সর্বস্ব গ্রাস করার এক অনমনীয় মানসিকতা তা ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন লেখক। সান্যাল বাবু আবার চাকরিতে নিয়োগ হয়েছেন, চেয়ার ফিরে পেয়েছেন। স্বভাব সামান্য বদলালেও, পুরোপুরি বদলায়নি –

‘’বলেই বাইরের ব্যাপারটা মুখের তুচ্ছ মুদ্রায় উড়িয়ে দিলেন। চলে যেতেই, ঘরের বাতাসে পড়ে রইল প্রসাধনের হালকা গন্ধ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মি. সান্যাল হঠাৎ বেয়ারাকে ডাকিয়ে ফাইলটা নিয়ে কী ভাবলেন যেন। মন্ত্রীর রেফারেন্স। ঠোঁট চাপলেন, কলমের ডগায় কপাল ঠুকলেন চোখ বুজে, শেষে সই করলেন – যাতে বুধবারই পেয়ে যায় লিলি চৌধুরী। আর তখনই, অদৃশ্য ঘরটুকু মুছে যেতেই হায় হায় করলেন – ও-ফাইল তো সই করার কথা নয় ? এত সহজে ?…’’ ( তদেব, পৃ. ১০০ )

 ক্ষমতাই মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। লেখক শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র তুল ধরেন। অবসর কালে সান্যালের আক্ষেপ ‘পৃথিবীটা আদৌ বদলায়নি’। আসলে বদলের দায়িত্ব যাঁদের ওপর ছিল তাঁরাই যে ঘুণধরা মানসিকতা নিয়ে বিরাজ করছে তা বোঝনি। ক্ষমতার পরিবর্তন হয় কিন্তু মানসিকতা পাল্টায়না। ভারতীয় তথা বঙ্গীয় রাজনীতি যেন এক মহাভারত। সে ইতিবৃত্তের শেষ নেই। তার রন্ধে রন্ধে কত ফাঁক, কত অন্যায়, অত্যাচার তার একটি দৃষ্টান্ত লেখক তুলে ধরেছেন। সেই ক্ষমতাভোগ আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে সান্যালের ইংরেজি মহাভারত অনুবাদের মধ্য দিয়ে।

      যে মূল্যবোধহীনতার মধ্য দিয়ে মানুষের বসবাস, মানবিক সম্পর্কগুলি কীভাবে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ কীভাবে আমিত্বের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ছে, মানুষের শুভ বোধগুলি কীভাবে সময়ের কাছে পরাজিত হচ্ছে – সময়ের এই রহস্যগুলি লেখককে বিশেষ করে ভাবিয়েছে। সময় নামক এক বৃত্ত মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই বৃত্তে মানুষ কীভাবে হারিয়ে যায়, কর্মক্ষমতাহীন মানুষের যে কোন মূল্য নেই, অথচ অর্থ সম্পর্ককে কীভাবে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, লালসা মানবিক সম্পর্কে কীভাবে মূল্যহীন করে তোলে, পারিবারিক সম্পর্কগুলি ভেঙে দেয় , সময়ের সেই অন্তঃসারশূন্যতা বড় হয়ে উঠেছে ‘সময়ের ঘর-বাড়ি’ গল্পে। সময়ের পরিসর নিয়েই তো কথাসাহিত্যের যাবতীয় কার্যকলাপ। লেখক সময়ের বিবর্তনের চিত্র আঁকবেন সেটাই স্বাভাবিক। সময়ের বিবর্তনে ব্যক্তি সহ সমষ্টির মানুষের এক প্রকৃত চিত্র এ গল্পে উঁকি দিতে দেখি। কর্মহীন মানুষের মূল্য যে নিছকই শূন্য, সমাজের কাছে সে মানুষ বর্জিত তা লেখক রূঢ় বাস্তবের মধ্য দিয়ে প্রতিপন্ন করেন। গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদেই লেখক সময়ের যাবতীয় অন্তঃসারশূন্যতা ভেঙে দেন –‘’আসলে করুণা চায় বিমলেন্দু মরে যাক ! তাহলেই সুযোগ। জমানো টাকাগুলো হাতিয়ে বাকি জীবন ফুর্তি-বিলাসে কাটিয়ে দেবে…।‘’ ( তদেব, পৃ. ৪৫ ) সময় বিভঙ্গে মানুষের অন্তঃসারশূন্যতা কত ভিত্তিহীন,  আজকের দাম্পত্য সম্পর্ক কোন সত্যের ওপর টিকে আছে তা লেখক পর্যায়ক্রমে দেখান। বিমলেন্দু অভাবের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠেছে। সংগীতে দারুণ কণ্ঠ থাকলেও নিম্নবিত্তের কারণে স্কুলে শিক্ষকতা করতে বাধ্য হয়েছে। বোনদের বিবাহ দিয়েছে, বাড়ি করেছে। বিবাহ করতেই প্রতারিত হয়। স্ত্রী করুণার আগেই কোন পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। বাড়ির ভাইবোনদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে দাদা আগেই চলে গিয়েছিল কিন্তু মাতার মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ নিয়ে গেছে, বোনরা কোন প্রতিবাদ করেনি। আজ সে ক্যান্সারে আক্রান্ত, স্ত্রী বেতনের কারণে জোড় করে স্কুলে পাঠিয়েছে। ক্লাস নিতে পারেনা বলে শিক্ষকদের কাছে প্রতিপদক্ষেপে অপমানিত হতে হয়েছে। এই বিমলেন্দুর প্রতি কেউ করুণা করেনি। আজ সে বাতিল মানুষ। সময় বুঝি মানুষের কর্ম ও অর্থকে মনে রাখতে চায়, ব্যক্তির কোন মূল্য সময়ের কাছে নেই , লেখক তা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেন। বিমলেন্দু সহ বেশ কিছু পুরাতন শিক্ষকের আজ আশ্রয় হয়েছে বাতিল ঘরে।

              সময়ের নারকীয়তা মানুষের আদর্শকে ধ্বংস করে বিপর্যয়ের কোন রসাতলে নিয়ে যায় তা লেখক দেখান। সারাজীবন আদর্শকে সত্য বলে মানা বিমলেন্দুর এই ট্র্যাজিক পরিণতির মধ্য দিয়ে লেখক সময়ের চোরাস্রোতে ব্যক্তি মানুষের ভেসে যাওয়া আবিষ্কার করেন। পরিবার থেকে সহকর্মী কেউই তাঁর প্রতি সহানুভূতি অনুভব করেনি। বাতিল মানুষের কোন মূল্য সময়ের কাছে নেই। গল্পের শেষে লেখক উচ্চারণ করে যান –‘’এই সময়ের ঘরবাড়ি ভিজছে, চুপসে আছে কিংবা আত্মগর্বে মাথা তুলে। পশুর চোখ গাঁথা। রাস্তায় কেউ জিজ্ঞেস করল না, বিমল এভাবে ভিজছে কেন। বিদ্রূপের হাসি দিয়ে পরিচিতরা চলে যায়। বিমলেন্দু ক্লান্তিতে হাঁসফাঁস করে। অন্ধকার বাতিল এক ঘরে বসে আছে। কেউ তালা খুলে দিয়ে যায়নি।‘’ ( তদেব, পৃ. ৫৫) যে মানুষ কোনদিন বিশুদ্ধ সংগীত ছাড়া অন্য কিছু গায়নি, অথচ স্ত্রী এসে সে আদর্শকে ধ্বংস করে দিল। তেমনি তাঁর ছাত্ররা গান শিখে তাঁকে কিছুদিনের মধ্যেই অস্বীকার করল। যে বিশ্বাসহীন ঘুণধরা সময় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আজকের পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে আর্দশের কোন মূল্য নেই, লেখক তা স্পষ্ট দেখিয়ে দেন। স্ত্রীর নাম করুণা, অথচ সে সারাজীবন কাউকে দয়া করেনি, স্বামীর সঙ্গে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে, সময়ের এক গভীর রহস্য লেখক উন্মোচন করে যান।

                                  বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, ধর্ম – বিজ্ঞানের সংঘাতে নতুন প্রজন্ম যখন বেরিয়ে আসতে চাইছে তখনই রাষ্ট্র ধর্মের দিকে আরও বেশি করে এগিয়ে যাচ্ছে। সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘মূর্তির মানুষ’ গল্পটি ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। আজকের সমাজ ও সময় বীক্ষায় এ গল্প নতুন সত্য নিয়ে উপস্থিত হয়। আজকের রাষ্ট্র যেখানে মূর্তি গড়তে ব্যস্ত, রাষ্ট্র যখন নিজেই ধর্মের বশবর্তী নিয়ে নিজের অন্ধকার স্বরূপ ফুটিয়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর তখন এ গল্প বহুপাঠের দাবি করে। সাধন চট্টোপাধ্যায় সামাজিক সত্যগুলিকে সামনে রেখেই গল্পের আখ্যানে প্রবেশ করেন। সেই সত্যের ভিতর প্রবেশ করিয়ে দেন সময়ের ভাষ্য। নবীন –প্রবীণের দ্বন্দ্ব, পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব এ গল্পেও বর্তমান। সেই সঙ্গে আছে মূল্যবোধহীনতা, সংস্কার, প্রথা, সামাজিক নিয়মগুলিকে ভেঙে এগিয়ে যাবার প্রচেষ্টা। সামাজিক গণ্ডি বা ধর্মের বেড়াজালে বদ্ধ প্রাচীন সমাজ থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া অবশ্যই প্রশংসনীয় কিন্তু প্রথা ভাঙতে গিয়ে বর্তমান প্রজন্ম যে মূল্যবোধহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা লেখক বড় করে তোলেন। অশিক্ষিত পিতা-মাতা মানেই তাঁদের ধারণাগুলি সব যে ভুল তা তো নয় ! কিন্তু আজকের প্রজন্ম শিক্ষার আলোয় দীক্ষিত হয়ে, বিজ্ঞান চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে পুরোনো ধারণাগুলি নস্যাৎ করে দিচ্ছে, আর তা দিচ্ছে কুৎসিত ভাষায়, বিবেককে বলি দিয়েই। প্রাণতোষের পিতা বৃন্দাবন চক্রবর্তীর জন্ম শাক্ত বংশে। শাক্তদের রক্তে এক গুপ্ত ‘সংগুপ্ত জিঘাংসা বহমান’ বলে পুত্রের ধারণা পিতাও খুনি। এই ধারণাকে পুত্র মনের মধ্যে লালিত করে তুলেছে। ফলে পিতার কোন কার্যই তাঁর পছন্দ হয়নি, বরং সন্দেহ জেগেছে। বৃন্দাবনের জন্ম শাক্ত বংশে হলেও সে ধর্মীয় মানুষ ছিল না। তবুও পুত্রের কাছে প্রতি পদক্ষেপে অপমানিত হতে হয়েছে –

‘’সামান্য খুদকুঁড়ো, সারাজীবন ধরে যা জমিয়েছিলেন, শেষ। এখন ছেলের মুখাপেক্ষী। বৃন্দাবন অবশ্য ছেলের এই বিদঘুটে ধারণা সম্পর্কে সচেতন নন ; তবে বোঝেন সামান্য খুঁটিনাটি ব্যাপারেও প্রাণতোষ বাবকে কি তীব্র অপমান ও অবহেলা করে ! মাঝে মাঝে বৃন্দাবনের সনাতন ক্রোধ অতীত গুহা ফুটে যে বেরোয় না এমন নয়, আপ্রাণ চেষ্টায় সংযত রাখেন তা। বউয়ের জন্য। ভাগ্যের দোষ ছাড়া কোনো কারণ খুঁজে পান না।‘’ ( তদেব, পৃ. ১১৪ )

প্রজন্মের ব্যবধানে মানুষের চেতনার একটা নির্দিষ্ট বিকাশ থাকে। তাই একটি মানুষ প্রগতিশীল কিনা তা সময়ের মানদণ্ড দিয়ে বিচার করতে হবে। আজকের প্রজন্মের প্রগতিশীলতার সঙ্গে পঞ্চাশের দশকে জন্ম নেওয়া মানুষের প্রগতিশীলতার বিচার হতে পারেনা। শাক্ত পরিবারে জন্ম হলেও প্রগতিশীল মানুষ বৃন্দাবন চক্রবর্তী। পিতার প্রগতিশীলতা সন্তান বিচার করতে চেয়েছে আজকের প্রেক্ষাপটে। তেমনি রয়েছে আজকের প্রজন্মের নষ্ট সময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। প্রাণতোষের পাঠ্য পত্রিকা লেখকের ভাষায় –‘’অমুক মানুষের নুনু কাটিয়া ফেলা পবিত্র’-মার্কা পত্র-পত্রিকা।‘’ (তদেব, পৃ. ১১৬ )  সে আজকের প্রজন্মের যুবক। প্রেমিকার বাড়ি গিয়ে চুমু খেতেও তাঁর লজ্জা নেই, বরং মনে হয় এই মানুষগুলি সংস্কারে ডুবে আছে। সে সর্বদা হাস্য রসিক। এই হাসির জন্য ইনক্রিমেন্ট তো বন্ধ হয়েছেই, এমনকি উপমা জুটেছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী, বিপজ্জনক ব্যক্তি’। ব্যক্তি কীভাবে সময় ও সমষ্টির গোলকধাঁধায় পিষ্ট হয় তা যেমন লেখক দেখান তেমনি ব্যক্তি নিজেও যে সচেতন নয় তাও জানান। লেখকের বয়ান অনুসারে জীবন হল –‘’থালা-বাসনের মতো জীবনকেও প্রতিদিন মাজতে ঘষতে হয়।‘’- এই ঘষা মাজা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সবার পক্ষে সম্ভব নয়, ফলে কেউ কেউ পিছিয়ে যায়। অথচ এ পরিবর্তন সত্য। তবে সময়ের পরিবর্তন গুলি সবই যে ঠিক তা নয়। সেখানেই ব্যক্তির বিদ্রোহ। আর আজকের সমাজে প্রতিবাদী মানুষ ক্রমেই একলা হতে থাকে। মূর্তি বসানো মেনে নিতে পারেনি প্রাণতোষ। রাষ্ট্র শুধু মূর্তিই তৈরি করেনা, মানুষের চেতনাকে লুপ্ত করে জড়বত করে তোলে। সময়ের বীক্ষায় এ গল্প নতুন সত্য নিয়ে উদ্ভাসিত হয়।

                                         সময়ের বিবিধ রূপ তো একজন সৎ লেখককে আঘাত করে। সময় যন্ত্রণা লেখক যেমন উপলব্ধি করবেন, তেমনি সময়ের চোরা স্রোতে নানা পরিবর্তন লেখককে অঙ্কন করে যেতে হয়। তেমনই এক গল্প ‘কাল, আজ এবং কাল’ ( মুক্তাক্ষর,১৯৯৩ ) গল্প। একটি মধ্যবিত্ত জীবনকে সামনে রেখে এ গল্পের ক্যানভাস গড়ে তুলেছেন। জীবনের অপরাহ্ন সময়ে পৌঁছে শৈল, দীপুদের চেতনায়  অতীতের কথা যেমন ভেসে এসেছে, বর্তমানের যাপনচিত্র নিয়ে তো ভাবছেই তেমনি ভবিষ্যতের জন্যও সঞ্চয় করে রেখে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত বাঙালির সর্বদা ধারণা ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’। তবে দুই বোনের মধ্যেও ঈর্ষা আছে। নারী সুলভ এ ঈর্ষা স্বাভাবিক। শৈল ভাবে দীপু হয়ত জীবনে সবসময় একটু বেশি পেয়েছে। দুটি নারীকে সামনে রেখে লেখক বাঙালি জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের গল্প শোনাতে চেয়েছেন। শেকড় ছাড়া মানুষের পৃথক অস্তিত্ব থাকে না। ফলে তাঁরা নিজের অতীতে ফিরে গেছে, তবে গল্পের আখ্যানে অধিকংশ পরিসর জুড়ে আছে নিজেদের বর্তমান জীবনের কথা। তবে শুধু বর্তমান নিয়ে ভাবলেই তো নিজের অস্তিত্ব, বংশ টিকে থাকবে না, তাই ভবিষ্যতেও নজর দিতে হয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শৈল, দীপুরা অর্থ সঞ্চয় করে রেখে যাচ্ছে। শুধু অর্থই নয় শৈলরা শৈশবে যে ‘পরানকথা’ শুনেছিল দিদিমার কাছে, আজ সে দিদিমা হয়ে ভবিষ্যতের কাছে সঞ্চারিত করে দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবেই নিজেদের ঐতিহ্য টিকে থাকে। জাতির ইতিহাস সময় থেকে সময়ান্তরে পৌঁছে যায়। গল্পের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন অলীক বাস্তবতায় –

‘’এরা দুজন, রুগ্ন ঘোড়াটা এবং ভূতসর্বস্ব বুরখা। মাঝে মাঝে সে অদ্ভুত শব্দ করছিল মুখে। শৈল চারপাশের পরিবেশ ও নির্জনতায় বিহ্বল। নানারকম বিশ্বাস ও ভাবনায় মিহি চন্দ্রালোকপথে হঠাৎ সে পরী হয়ে গেল। অদ্ভুত দুটি ডানা পেয়ে উড়তে থাকে। যেন এতদিন সে পথ হারিয়ে ছিল। দুপুরে খাওয়ার টেবিলে লাইলি, আদিনাথ, বাবা এবং কত মানুষ একঘরে বসেছিল। এই মুহূর্তে অদ্ভুত ডানা দুটি মেলে এমন সব পরিচিত ও আত্মীয়দের মুখ ছুঁয়ে গেল, যারা পৃথিবীতে আসবে। ডানাজোড়ায় আলো পড়েছে। শৈলর যাত্রাপথ জেটপ্লেনের মতো আকাশে শুভ্রখচিত হয়ে রইল।

অন্ধকারে দীপু দেখে অসুস্থ পরমেশ দরজায় উৎকণ্ঠিত। ‘আমায় ভুলে গেছলে?’ চিৎকার করছে।অথচ পথ যেন শেষ হয় না, ঘোড়াটি নড়ে না, বুরখা যেন ভুলে গেছে বাড়ি পৌঁছতে হবে। কিন্তু শৈল কিছুই দেখতে পেল না। পরমেশ, দুর্গবাড়ি টাঙ্গা, দীপু-সব লুপ্ত। কেবল অলকেশ এবং মায়াকে লুকিয়ে মধ্যরাতে চুপিচুপি জয়ার দুটি বেঁধে, ছোট্ট চুম্বনে বলল ‘আমি মরলে কাঁদবি না ত !’’ ( তদেব, পৃ. ১৮০ )

জীবন একটা বিচ্ছিন্ন অংশ। বলা যেতে পারে সময় প্রবাহ। তার দুটি দিক। অতীত ও ভবিষ্যৎ। এর কেন্দ্রবিন্দুতে আছে বর্তমান। বর্তমানকে নিয়েই তার যাবতীয় ভাঙাগড়া, কিন্তু সেই ভাঙাগড়াকে সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজন অতীত ও ভবিষ্যৎ। এর ভিত্তিমূলে রয়েছে বিশ্বাস। তবে সে বিশ্বাসকে সবসময় যে টিকিয়ে রাখা যায় তা নয়, তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে, আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন বুনে চলে।

‘অনুকূল আবহাওয়ায়’ গল্পের সূচনা বাক্যেই গল্পকার জানিয়ে দেন –‘’মরণীবালা দাসী এই সংসারের পাট চুকিয়ে আগামী মাঘের এক বিকেলে বিদায় নেবে।‘’ ( তদেব, পৃ. ২১২ ) সে বিদায় নেবার কাহিনি তিনি পর্যায় ক্রমে গড়ে তুলেছেন। নিম্নবিত্ত পরিবারের বেঁচে থাকা, সংগ্রাম, সেই সঙ্গে সময়ের পরিবর্তনে অন্দরমহলে কীভাবে বিবর্তন ঘটে যাচ্ছে তা লেখক পর্যায় ক্রমে এগিয়ে যান। একজন লেখক তো সমাজতাত্ত্বিক বিবর্তনে বিশেষ নজর দেবেন। সাধান চট্টোপাধ্যায়ের গল্পবিশ্বে সে বিবর্তন স্পষ্ট ফুটে ওঠে। চলমান সময়ের রন্ধে রন্ধে কীভাবে বিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, মানুষের অন্তরসত্তা কীভাবে বদলে যাচ্ছে, সময়, সমষ্টির চাহিদা মানুষের ভিতরে কীভাবে প্রবেশ করে যাচ্ছে, অথচ সে চাহিদা মানুষ পূরণ করতে পারছে না, এই পারা-না পারার দ্বন্দ্ব তিনি উপলব্ধি করেছেন। মূল্যবোধহীনতার চিত্র এ গল্পেও আছে, তবে এর জন্য সবিতাদের দোষ দেওয়া যায়না। যেখানে ক্ষুধাই শেষ সত্য, সেখানে মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। নিম্নবিত্তের যাপনচিত্রেও যে পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, সেখানে অর্থহীনতা থাকলেও সময়ের স্রোতকে অস্বীকার করা যে সম্ভব হচ্ছে না তা লেখক দেখান। মরণীবালা নাতির নাম রেখেছিলেন তিলকচাঁদ। বংশের ঐতিহ্য ধরে রাখতে, স্বামী নিমাইচাঁদ, পুত্র মানিকচাঁদ ও নাতি তিলকচাঁদ। কিন্তু পুত্রবধূ সবিতা সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করার সময় ‘চাঁদ’ শব্দটিকে বাদ দিয়ে দেন। ঐতিহ্য ও নিম্নবিত্তের চালচিত্র আধুবিকতার প্রবেশ লেখক দেখেন, আমাদের দেখান। তিলক, ছায়া স্কুলে পড়ে। ঠাকুমার কাছে তিলক বায়না করেছে স্টিকারের জন্য। মরণীবালার মনে হয়েছে এগুলোও বুঝি শিক্ষার অঙ্গ। তেমনি ছায়া একবার ফেল করে। এবারও মরণীবালা ভাবে ফেলও বুঝি শিক্ষার অঙ্গ। নিম্নবিত্ত পরিবারে সংসার চালাতে সবিতা ক্লান্ত। মদ্যপানকারী স্বামী সেভাবে অর্থ রোজগার করেনা। সবিতা তাই একসময় আক্ষেপ করে কন্যাকে বলে –‘বাসনমাজিয়ের ঝি বাসনমাজবি !’ গ্রাম পাল্ট শহর হয়ে যাচ্ছে, মিউনিসিপ্যালিটি এলাকা গড়ে উঠছে, চারপাশের বাড়িঘর বদলে যাচ্ছে। কিন্তু মরণীবালার পরিবারের চিত্র পাল্টায়নি। তবে যেটা পাল্টেছে তা হল মনন। আগে যে মরণীবালা খিস্তি খেউড় করত , তা আজ বন্ধ। নাতিদের তপশীলি জাতির জন্য অনুদানের ব্যবস্থা, সংসারের জন্য সামান্য শাক পাতা বিক্রি করে অর্থ জোগানের চেষ্টা সবই সে করেছে। একদিন বৃষ্টিতে বাজারে গিয়ে চেতনা লোপ পেলেও মানুষের সাহায্যে রক্ষা পেয়েছে। সেই সেবার কাহিনিই মরণীবালা নানাভাবে বলে। আসলে নগর বা গ্রামের কাহিনি নানা ভাবে গড়ে ওঠে। তেমনি সময় পরিবর্তনের চিত্র মানুষ যখন কথকথার ঢঙে বহন করে চলে তার বহু স্বর উঠে আসে। সত্য কাহিনির রূপান্তরের মধ্য দিয়েই একটি সময়ের আংশিক চিত্র সমায়ন্তরে পৌঁছে যায়। সময়ের সামাজিক বিবর্তন অঙ্কন করা যেহেতু ঐতিহাসিকের কাজ নয়, তা একজন লেখককেই করতে হয়। আর সে ইতিবৃত্ত লিখতে গিয়ে কাহিনির অন্তর্বয়ন পাল্টে যায়, সত্যের ভিতর থেকে উঁকি দেয় একাধিক সত্য। সে সত্যের পুরোপুরি বাস্তব ভিত্তি সবসময় যে আছে তা নয়, তবে সত্যকে অস্বীকার করাও সম্ভব নয়। লেখক সামাজিক দৃষ্টি থেকে সময় ও সমাজের গভীরে থাকা বয়ানকে সামনে রেখেই অন্তর্বয়ানে এগিয়ে যান। লেখকও সে সত্য স্পষ্ট করে দেন গল্পের আখ্যানে –

‘’এই সব ভাবতে- ভাবতে বিজুর দোকানে ফের গত রাতের কাহন গাইতে থাকে। বিজুর দোকানের বেঞ্চে গপ্প মারার লোকের অভাব নেই। সবাই মরণীবালাকে নিয়ে পড়ল এবং যতবার নতুন মুখ আসে তখনই গোড়া থেকে কাহিনি শুরু করতে হয়। এইভাবে, পুনঃপুন বিবৃতিতে কাহিনির অন্তর্বয়ন ক্রমশ পালটে-পালটে যায়। মজার খোরাক হিশেবে তখন এরা ধরে নেয় গত রাতে ঘোর বৃষ্টির সুযোগে মরণীবালা যে তাড়ি খেয়েছিল, খোঁয়াড়ি রয়ে গেছে। আর বহুবার বর্ণনায় বুড়ির কাছে কাহিনির অন্যান্য পরম্পরায় তুচ্ছ হয়ে ক্রমে বদলে যায়।“ ( তদেব, পৃ. ২১৮ )

 এভাবেই কাহিনি সময় থেকে সময়ান্তরে পৌঁছে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন কাহিনি। এই সত্য-অর্ধসত্যের মধ্য থেকে পরবর্তীকালের লেখককে সময়ের স্বর ভেঙে দিতে হয়। কাহিনির ভিতরে যে সত্য লুকিয়ে আছে তা অনুসন্ধানে নানা অনুমানে যেতে হয়, সেখানে আবার নতুন বিভঙ্গ রচিত হয়। মানুষের সেবার কথা মরণীবালা নিজেই বারবার পাল্টে নতুন করে বলেছে। অথবা বলতে বলতে কিছু বাদ গেছে । মরণীবলার কাহিনি ছায়া, তিলকরা হয়ত আবার নতুন করে বলবে। তবে এই কাহিনির রূপান্তরের মধ্যে যা স্পষ্ট হল তা অভাব। মরণীবালা অভাবেই মরেছে। এমনকি সে সত্যের আবার নানা রূপ। সে অভাব আবার নিদারুণ হয়ে ওঠে সবিতার ভাত রান্না ও মরণীবালার মৃত্যুর প্রসঙ্গে –‘’সবিতা উনুনে পাতা গোঁজে আর ভাবে, ভাতগুলো ফেলে দিতে না হয় ! … হয় এক্ষুনি মর… নয় বিকেলে !… আপদ বিদায় নিলে বাঁচি !’’ যেখানে ক্ষুধাই শেষ সত্য, সেখানে মূল্যবোধের ধারণা গুলি টিকে থাকা যে সম্ভব নয় তা লেখক বড় করে তোলেন।

              ‘অতিক্রমণ’ গল্পের সূচনাই হয়েছে ‘‘আজ সেই মুহূর্তে, কালচক্রের সামান্য ক্ষণে, ব্যস্ত দিনটির গম্ভীর মধ্যাহ্নে আবু তালেবের আড়াই কুড়ি বছরের পুরনো হৃৎপিণ্ডটা বন্ধ হয়ে গেল ….”( তদেব, পৃ. ৯ ) এ গল্পের রচনাকাল ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ। সাধন চট্টোপাধ্যায় প্রথম থেকেই বাস্তবের স্বর, সময়ের স্বরটিকে ভাঙতে চেয়েছেন। এই কার্যকলাপ দীর্ঘদিন ধরে ঘটে চলেছে। সময়ের অধিস্বরকে ভেঙে গল্পের ভিতরে প্রবেশ করেছেন। নিজেই জানিয়েছেন একই কাহিনি নিয়ে দ্বিতীয় বার গল্প লেখেননি। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে ( প্রথম গল্প ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ) তিনি সময়ের অধিস্বরকে ভেঙে চলেছেন। সময়ের রন্ধে রন্ধে যে পরিবর্তন ও ক্ষমতার কার্যকলাপ ঘটে চলেছে তা চিত্রিত করেন। এই চিত্রকল্পে গল্পের আখ্যানের ধরণ ও টেকনিক পাল্টেছেন বটে কিন্তু ভিন্নমুখী কাহিনিও যেন একই বয়ানের দিকে এগিয়ে যায়। সময় নামক মহানিয়ন্ত্রকের চাবিকাঠি থেকে আমরা কেউ যেন মুক্ত নই। এ গল্পে আছে কারখানার শ্রমিকের মৃত্যু। মালিক পক্ষের ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার ও শ্রমিকদের বিদ্রোহ। মালিক পক্ষ নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে ক্যাসুয়াল শ্রমিক নিয়োগ, দিনের পয়সা দিনেই, ফলে শ্রমিকর ঝুঁকির কোন দায়িত্ব তাদের নেই, যেহেতু কারখানার খাতায় তাদের নাম তোলা হয়না। কারখানার শ্রমিক খোদাবক্স। গ্রামের আবু তালেবের দীর্ঘদিন কাজ নেই। কাজের সন্ধানে সে আজ কারখানায় ক্যাসুয়াল শ্রমিক হিসেবে যোগদান করেছিল। কিন্তু কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হয়। মালিক পক্ষ ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করেছে। সে সময়ই শ্রমিকরা গর্জে উঠেছে। প্রসঙ্গত আমরা মনে করতে পারি অমর মিত্রের ‘নিরুদিষ্টের উপখ্যান’ উপন্যাসের কথা। এ গল্প লেখার দশ বছর পর সে উপন্যাস লেখা। লকআউট কারখানার শ্রমিক বৈরাগী মণ্ডল চেয়েছিল কারখানা খুলুক। কিন্তু মালিক পক্ষ বন্ধ কারখানা তুলে দিয়ে আবাসন করতে চায়। মালিক পক্ষ পুলিশের সহায়তায় বৈরাগীর মৃত্যু ঘটিয়েছিল। ক্ষমতার কাছ শ্রমিকরা তো নিছক সংখ্যামাত্র। যে সংখ্যাতত্ত্বের ইঙ্গিত রবীন্দ্রনাথ ‘রক্তকরবী’ তে দিয়েছিলেন, আজ সময় পরিবর্তনে তা আরও নির্মম হয়েছে। আজ মালিক পক্ষ সংখ্যাকেও স্বীকার করতে ইচ্ছুক। সময়ান্তরে শোষণের ভাষ্যের রূপ যেভাবে বদলে যাচ্ছে তা লেখক চিহ্নিত করেন। প্রতিবাদ যে নেই তা নয়। কিন্তু ক্ষমতার শক্তির কাছে শ্রমিকের প্রতিবাদের মূল্য কতটুকু ? কারখানায় শ্রমিকরা প্রতিবাদ করেছে ক্ষতিপূরণের জন্য, শেষে মালিক পক্ষ রাজি হয়েছে –

‘’ক্ষতিপূরণ দিতে কোম্পানি এখন রাজি। এই মুহূর্তে সে পুলিশের হাতে আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টা তুলে দিতে পারতেন, কিন্তু সব সিদ্ধান্তই গতানুগতিক নয়। সময়কে আরও সূক্ষ্ম বিচার করে অনেকে, দৃষ্টি অনেকেরই সুদূরপ্রসারী। বাইবেলের শাসিত সমুদ্রের মতো ওনার এ-সিদ্ধান্তে মজুররা শান্ত হয়ে গেল।‘’ ( তদেব, পৃ. ১৪ )

 এই যে ‘সময়ের বিচার’ ও ‘দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী’ তার ওপর লেখক জোড় দেন। আর তা নির্ভর করে ক্ষমতার ওপর। মালিক পক্ষ জানে কোন ঘটনার পরিণতি কী হতে পারে। আবু তালেবের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ না হলে মালিক পক্ষ কোন ক্ষতিপূরণই স্বীকার করত না। কিন্তু সে ক্ষতিপূরণ পরিবার পাবে কিনা তা আমাদের জানা নেই। গল্পের বয়ানে লেখক তা রাখেননি। সে পরিসর নিয়ে ভিন্ন আখ্যান রচিত হবে এটাই হয়ত লেখকের বিধেয়। তবে গল্প শেষ হয়েছে এক শ্রেণিচেতনায়। খোদাবক্সের মুখে শুনতে পাই –‘’মরিজানকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে-কাঁদিসনে বউ। আমরা তো মরিনি। বাঁচিয়ে রাখবো তোদের । দুঃখ করিস না।‘’ এক মানবিক সত্তায় উত্তীর্ণ করতেই চরিত্রের মুখে এ সংলাপ নির্মাণ করতে হয় লেখককে। শুভবুদ্ধি, মানবিক চেতনা যে এখনও লোপ পেয়ে যায়নি তা বুনে চলেন। কিন্তু এ সত্যের ভিত্তি কী ? যে নিজেই শ্রমিক, যে নিজেই যে কোনদিন বেকার হয়ে যেতে পারে, মৃত্যু ঘটতে পারে সে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখবে আর একটি পরিবারকে ? সময়ের ভিতর থেকে তিনি গল্পের বয়ানকে বহু গভীর নিয়ে যান। যেখানে বহু প্রশ্নের মুখোমুখি পাঠককে দাঁড়াতে হয়।

                           ‘মেহগনি’ গল্পটি ‘অনীক’ পত্রিকায় ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। পরিবর্তিত সামন্ততান্ত্রিক চেহারার নিষ্ঠুর রূপ এ গল্পে লেখক ফুটিয়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলেও কৌটা গরম করেও তা নির্গত হতে পারে – গল্পকারের এই বয়ান থেকে ভিন্ন স্বরের আভাস পাঠক পেয়ে যাবেন। কিন্তু নির্মম বাস্তবকে ফুটিয়ে তুলতে, বাস্তবের সমস্ত স্তরকে ভেঙে দিতে সেই সোজা আঙুলে ঘি ওঠার প্রন্থাতেই এগিয়ে যেতে হয়। পুলিশ অফিসার পাণ্ডে যখন জানায় –‘’চৌধুরী, একটা আইন আছে’’, প্রতুত্তরে আসে ‘ও আপনার কিতাবে লিখে রাখুন’’ ( তদেব, পৃ. ২১ ) ভারতবর্ষের অবহেলিত নিম্নবিত্তকে শোষণ করতে কোন আইন প্রয়োজন হয় না। সামন্ততান্ত্রিক চেহারার সে ভাষ্য ফুটে ওঠে শিউকান্ত চরিত্রে। সেই বৃত্তের সুবিধা নিয়েছে পুলিশ অফিসার পাণ্ডে। বুধনরা যে প্রতিবাদ করেনি তা নয়, কিন্তু সে প্রতিবাদ ভিত্তিহীন হয়ে যায়। আসলে গল্পকার বাস্তবের অধিস্বরকে ভেঙে দেন। সমান্তরাল পাঠ এ গল্পে অনুপস্থিত। সে পাঠ আর গভীর হয়ে ওঠে লেখকের ভাষা ব্যবহারে। এ গল্প পড়তে গিয়ে সমালোচক তপোধীর ভট্টাচার্যের মনে এসেছে  মিশেল ফুকোর মন্তব্য। আমরা এখানে তা আর একবার স্মরণ করি –

‘’The individual is not to be concerived of as a sort of elementary nucleus on which power comes to fasten… in fact, it is already one of the prime effects of power that certain bodies, certain gestures, certain discourses, certain desires come to be identified and constituted as individuals.” ( ছোটগল্পের বিনির্মাণ, অঞ্জলি পাবলিশার্স, পৃ. ১৪৩ )

                     ( ২ )

‘আমার ভাবনা বলে কিছু নেই ‘ প্রবন্ধে লেখক আমাদের জানিয়েছেন –‘’আমাদের তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যে গল্প একটি থাকতেই হবে। তবে কাহিনি- রেখাটি কে কত সূক্ষ্ম করে নিতে পারেন কিংবা বয়নপদ্ধতি কার কতখানি মজবুত হবে, সে পরীক্ষা-নিরীক্ষা যার-যার তার-তার। এছাড়া কোনো সাহিত্য সজীব থাকে না বা নতুন মাত্রা লাভ করে না। তাই বলে, অর্থহীন পরীক্ষার কেদ্দানি পাথরের বুকে শস্য ছড়ানোর নামান্তর মাত্র।‘’ ( উত্তরাধিকার, তদেব, পৃ. ২০ ) গল্পের আখ্যান নিয়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি গল্প লিখতে চেয়েছেন। গল্পের ফর্মকে ভাঙলেও আখ্যানে এক চরম বাস্তবতার মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন। তাঁর মূল লক্ষ আখ্যান। সে আখ্যান গড়ে তোলার জন্য তিনি নানা কৌশল আয়ত্ত করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি জীবনের সত্যে উপনীত হতে চেয়েছেন, যেখানে সময় যন্ত্রণা প্রবল ভাবে উঁকি দিয়েছে। ‘র‍্যাংক্‌ নম্বর ২১’ ( পরিচয়, ১৯৮৯ ) গল্পের সূচনাতেই সময়ের স্বর ভেঙে দেন –‘’তারপর সময় চলে গেল কত দূরে ! দিন-মাস-বছরের চিহ্নে, অমোঘ স্রোত একদণ্ড দাঁড়াল না কারও জন্য। ছুটল অব্যর্থ নিশানায়…” ( তদেব, পৃ. ৮৬ ) সময়ের স্রোত মানুষকে ছুটিয়ে নিয়ে চলে, সেখানে প্রাপ্তির জন্য মানুষ ক্রমেই ছুটে চলে। সময়ের অমোঘ রহস্যকে ধরতে লেখক এখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ফর্মে গল্পকে সাজিয়ে নিয়েছেন। এই স্রোত মানুষকে মূল্যবোধহীনতার কোন পর্যায়ে নিয়ে যায় তা লেখক ধাপে ধাপে দেখান। আজকের মানুষ ক্রমাগত প্রতিষ্ঠা লাভের দিকে ছুঁটছে। সন্তান তো ছুঁটছেই, সেই সঙ্গে পিতামাতাও ছুঁটছে। এই দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বাড়ি থেকে। পিতামাতাই সন্তানের মনে সাফল্যের বীজ, জীবনে প্রতিষ্ঠা ও ক্রমাগত সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ওপরে ওঠার পথ আবিষ্কার করে দিয়েছেন। সমরেন্দ্র ও অনুরাধার একমাত্র লক্ষ ছিল সন্তান মানুষ করা। শুধু মানুষ নয় প্রতিবেশী প্রদীপের থেকে সুমন যেন সব ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে। পড়াশোনা থেকে খেলাধূলা সবক্ষেত্রেই প্রদীপের থেকে বেশি পাওয়া চাই। কেননা পিতামাতার কাছে –‘’জীবনটা কম্পিটিশন। সেখানে কেবল তুই স্বয়ং। বাকি সব মিথ্যে। এ যুগে তা যদি না বুঝিস, মার খাবি। দয়া-মায়া দেখবার অনেক সময় পাবে জীবনে, ও-জন্য নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয় না।‘’ ( গল্প সমগ্র, ২য়, পৃ. ৮৮ ) সে লড়াইয়ে প্রদীপের কাছে সে হারলেও জয়েন্টে জিতেছে। তাঁর র‍্যাঙ্ক ২১, প্রদীপ ১০৩। এরপর সাফল্যের পর সাফল্য, কর্মজীবনের ধাপে ধাপে উন্নতি। সেই উন্নতির যুপকাষ্টে সে ভুলে গেছে কর্তব্যবোধ। সময় ও চাহিদের যুগলমিলন তা হারাতে বাধ্য করেছে। পিতামাতার আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে বিসর্জন হতে চলেছে। বর্তমান সময়ের এক অন্তঃসারশূন্যতা লেখক বুনে চলেন। আজ সুমন সংসার নিয়ে ব্যস্ত, পিতামাতার প্রতি তাঁর কোন দায়িত্ব নেই। সে বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ গড়তে সচেষ্ট, অতীতের দিকে তাঁর তাকানোর সময় নেই। বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকেই মানুষ এগিয়ে যেতে চায় কিন্তু যে ভিত্তির ওপর বর্তমান গড়ে উঠল তার কি কোন মূল্য নেই ! পিতা-পুত্র-নাতি ( সমরেন্দ্রনাথ, সুমন, দীপ ) কে সামনে রেখে লেখক অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের এক ধ্রুব সত্য এঁকে চলেছেন। সেদিনের ছাত্র সুমন আজ পিতা, তাঁর চোখে সন্তান মানুষ করার স্বপ্ন, তেমনি দীপের চোখে স্বপ্ন ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার। এই এগিয়ে যাওয়া, প্রতিষ্ঠার মধ্যে মানবিক সম্পর্কগুলি কীভাবে ধ্বংস হয়ে যায় তা লেখক দেখান –

‘’ওটাই ছিল সুমনের শেষ চিঠি। পঁচিশ হাজারের ড্রাফট চেয়ে সমরেন্দ্রনাথ খোলাখুলি খোঁচা দিয়েছিলেন তোমার উন্নতি ও সাফল্যে বাপ-মায়ের কোনো ইনভেস্টমেন্ট নেই, বলতে চাও ? তোমাকে তৈরি করতে আমি মাঝেমাঝে অন্ধকারে নেমে অর্থ রোজগার করেছি। অস্বীকার করতে পারো ? ভুলে যেও না, একজনের উন্নতির পেছনে সংসারের অনেক মানুষের অবদান থাকে।

সুমনের উত্তরও ছিল প্রত্যক্ষ সরাসরি।

-সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে লাভ নেই বাবা। ভবিষ্যৎ আমার শেষ হয়নি এখনও, তুমি গড়ে দেবে তা ? আমাকেই দেখতে হবে। আমার ক্যালিবার অস্বীকার করতে চাও আজ – সে তোমার রুচি। আমি মনে করি, জীবনে কারও ঋণের মুখাপেক্ষি নয়। সবটুকু মেধা এবং শ্রমের। কারো দায়বদ্ধতা নেই কাছে আমার।‘’( তদেব, পৃ. ৯১, ৯২ )

 এই যে মূল্যবোধহীনতা এবং যাপিত জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার জন্য দায়ী অতীত। পিতামাতাই সে উচ্চাকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করে দিয়েছিল। তা আজ মহিরুহ হয়ে উঠেছে। এর উচ্ছেদ আর সম্ভব নয়। সমরেন্দ্র, অনুরাধারা জীবনে মূল্যবোধের পাঠ দেয়নি, জীবন মানে তাঁরা বুঝেছে কম্পিটিশন, তারই নামান্তর এই বোধ। পিতা মৃত্যুসজ্জায়। সুমন এলেও ফিরে যেতে হচ্ছে। ভেবেছিল টিকিট বাতিল করে থেকে যাবে, কিন্তু পুত্র অনড়। অতীতকে বাদ দিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সাফল্য যুদ্ধ বড় হয়ে উঠেছে –

‘’সুমন নিরুত্তর। বিপদে সিদ্ধান্ত গোলমাল হয়ে যায়। দীপ ক্ষুদ্ধ। এ-ঘরে বাবাকে ডেকে বলে- আমাকে ফোরতেই হবে ড্যাডি।

-কেন ?

-কাল আর স্কুল মিস করব না।

-আমার অবস্থটা বোঝো দীপ !

– দীপ ঠোঁট ফুলিয়ে জবাব দিল-আমারটা ?’’ ( তদেব, পৃ. ৯২ )

যে সুমনকে নিয়ে পিতামাতা চিন্তিত ছিল, অথচ তাঁর সন্তান আজ নিজেই ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নিয়েছে। সময়ের বিবর্তনে মানুষের চেতনা বোধ কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে তা লেখক দেখান। মানুষ কীভাবে নিজের শেকড়কে অস্বীকার করে দিতে চাইছে। অতীতকে বাদ দিয়ে বর্তমান সর্বস্ব করে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। আজকের বর্তমানই কাল অতীত হয়ে যাবে। কালের চক্রগ্রাসে সুমন হয়ে যাবে অবসরপ্রাপ্ত। পৌঁছে যাবে বাতিলের খাতায়। সময়ের মূল্যবোধহীনতা, সমস্ত অস্বীকার করে ‘আমি’ সর্বস্ব হয়ে বেঁচে থাকা কত অর্থহীন তা লেখক প্রতিপন্ন করেন। প্রদীপের কোন খবর আমরা জানি না । ছোটোগল্পের ধর্ম বজায় রাখতে লেখকের আর প্রদীপের প্রয়োজন হয়নি। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে সময়ের ভাঙাগড়া, জীবনের চলমানতা, কোনটা অস্বীকার করে বেঁচে থাকার চেষ্টা যেন আর এক গোলকধাঁধায় এগিয়ে যাওয়া, সেই সত্য লেখক প্রতিপন্ন করে তোলেন।

                     গল্পের চোরাস্রোতে তিনি সময় চিহ্নের রূপরেখা অঙ্কন করে যান। গল্পের আখ্যান সাজান এমনভাবে যার নিচ দিয়ে সময় স্রোত প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। নদীর চরে বালি খুঁড়লেই যেমন জলের সন্ধান পাওয়া যায়, অথচ সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে ধূ ধূ বালি ঠিক তেমনই। আখ্যানে তিনি গল্প বলে চলেন ঠিকই কিন্তু ভিতর দিয়ে সময় পর্বের এক সমান্তরাল পাঠ এগিয়ে যায়। সেই সময়ের মন্থনজাত রহস্য মাঝে মাঝে যেমন উঁকি দেয় তেমনি আখ্যানে পাঠককে সচেতন করে দেবার জন্য কখনও সে পাঠ উঠে আসে। ‘চব্বিশ ফুট’ ( অনুষ্টুপ, ১৯৮৫) গল্পের অন্তিমে শুনতে পাই –‘’ত্রিলোকি যাদব বিস্ময়কর প্রত্যাশা নিয়ে চব্বিশ বছরের পুরনো ভিতের উপরই দাঁড়িয়ে আছে। মণিবাবু শুধু দুই যুগের ব্যবধানে ধাপে ধাপে চব্বিশ ফুট উঁচুতে এখন কাগজটা মুখে জড়িয়ে উটপাখির মতো নির্জনতায় মুখ গুঁজে রইলেন।‘’ ( তদেব, পৃ. ৩০ ) সময়ের ব্যবধানে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের চালচিত্র লেখক অঙ্কন করেন। নিম্নবিত্ত যেন স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে চায়, উচ্চবিত্ত সাফল্যের সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে উঠতে ভুলে যায় নিজের ঐতিহ্য, স্মৃতি। গল্পের বয়নে পাই  চব্বিশ বছর আগে মণিময়ের বাড়ির ভিত খননে এসেছিল ত্রিলোকি যাদব। আজ চব্বিশ বছর পর আবারও সেই বাড়িতে মজুরিবৃত্তি করতে এসেছে। এই চব্বিশ বছরে ত্রিলোকি যাদবের কোন পরিবর্তন হয়নি, অথচ মণিময় বাড়ির ভিত আজ তিন তলায় পৌঁছেছে। ত্রিলোক মাটিতেই রয়ে গেছে, মণিময় মাটি থেকে চব্বিশ ফুট ওপরে উঠে গেছে। ত্রিলোক মাটি থেকে অতীতের স্মৃতিময় দিনগুলিতে ফিরে গেছে, মণিময়ের ফেরা সম্ভব নয় উঁচু থেকে স্মৃতিতে ফেরা। চব্বিশ বছরে উচ্চবিত্ত বলেই মণিময়ের নানা স্মৃতি, কোনটি তিনি মনে রাখবেন ? চব্বিশ বছরে বহুবার বাড়ি নির্মাণে শ্রমিক এসেছে, কাকে তিনি মনে রেখবেন ? অথচ ত্রিলোকের স্মৃতি একটি কোটকে কেন্দ্র করে, যা দিয়েছিল মণিময়। উচ্চবিত্তের স্মৃতিহীনতাই শুধু নয়, মণিময় আজ নিচে চোখ দিয়ে দেখেওনি, দেখার প্রয়োজন মনে হয়নি। অথচ ত্রিলোক তাকিয়ে আছে উপরের দিকে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে, কাজ হারানো, জমি ভাগে সামান্য চাষের মধ্যে দিয়ে লেখক বয়নের বিপরীত সত্য আবিষ্কারে যেমন মত্ত থাকেন তেমনি বয়নের ভিতরে ঘটে যাওয়া বর্তমানের মধ্য দিয়ে সময় রহস্য কীভাবে থাবা বসাচ্ছে তা পাঠককে দেখিয়ে দেন। অর্থের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক তো ভেঙেচুরে যাচ্ছেই তেমনি মানুষ আর মানুষ বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে না। সাধন চট্টোপাধায় শুধুই আখ্যানই লিখে চলেন না তিনি একটি কার্যক্রম ঘটিয়ে চলেন বয়নের মধ্যে। ভিত তৈরির সময় যে মণিময় নানা কাহিনি শুনতো ত্রিলোকের কাছে আজ আর ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেনি। লেখক আখ্যানে মণিময়ের কাছে স্পষ্ট করে দেননি ত্রিলোকের চিত্র। ব্যক্তি হারিয়ে গিয়ে নিছক সংখ্যাতে পরিণত হয়েছে। এ বাড়ি তৈরিতে কত শ্রমিক এসেছে, কাকে মনে রাখবেন তিনি ? নিম্নবিত্ত মানুষ কীভাবে আত্মপরিচয় হারিয়ে নিছক শ্রেণিতে পরিণত হয়ে যায়, সেই ধ্রুব সত্য তিনি বপন করে চলেন।

                                  ‘রতাউনি’ গল্পটি ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন সংকট, অর্থের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রের রূপবদল লেখক দেখিয়েছেন। গল্পের শেষে আভা অনেকটা কটাক্ষের সঙ্গে ফুলমতিয়াকে জানায় –‘’দুনিয়ায় কে আস্‌লি রতাউনি ?’’ ( তদেব, পৃ. ৪৫ ) এক গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি পাঠকে দাঁড় করিয়ে দেয়। তাঁর এ ব্যঙ্গ ছিল স্বামী ইন্দর সিংহের প্রতি। কিন্তু এই ব্যঞ্জনা বোঝেনি ফুলমতিয়া। তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভবও নয়। এ গল্পের আখ্যানে আছে দুটি পরিবারের চিত্র। সুখরাম ও ফুলমতিয়া, ইন্দর সিং ও ফুলমতিয়া। একসময় ইন্দর সিং ছিল দরিদ্র, পরিশ্রম করে সম্পত্তি গড়ে তুলেছে। বহু গোরু সহ জমি কিনেছে। সুখরামের কাছে একসময় সাহায্য পেয়েছিল ইন্দর সিং। আজ ইন্দর সিংহের ভৃত্য সুখরাম। তাঁর সংসারে নিত্য অভাবের চিহ্ন বর্তমান। তবে সে কখনও ইন্দর সিংকে হিংসা করেনি। তবে ইন্দর সিংহের হয়েছে আরও চাই মানসিকতা। অর্থ কীভাবে মানুষের চরিত্র পাল্টে ফেলে, মানবিক বোধগুলিকে ধ্বংস করে, শুভবোধগুলিকে হারিয়ে ফেলে পশুত্বের বৃত্তি লাভ করে লেখক তা নির্মাণ করে চলেন। ক্ষমতা কীভাবে শ্রেণি চরিত্র পাল্টে ফেলে, নিজের ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে আরও চাই মানসিকতার দিকে নিয়ে যায় তা লেখক দেখিয়ে দেন। তবে চরিত্রের পরিণতি ঘটাননি, আভার ব্যঙ্গবানে জীবনের সত্য ফুটিয়ে তোলেন। ইন্দর সিংহের গোরু বাচ্চা দিয়েছে। সুখরাম আসতে পারেনি রাতের বেলায়। সে ‘রতাউনি’ – রাতে দেখতে পায়না। কিন্তু মনে বেদনা আছে গেলে পাঁচ টাকা বেশি বাড়তি পেত। কিন্তু পরের দিন সকালেই এসেছে। কেউ বলেছিল গোরু বাচ্চা দেওয়ার পর প্রথম দুধ ‘ফেন্‌উস’ খেলে রাতকানা রোগ সেরে যাবে। তাই সে আভার কাছে সে দুধু চেয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু অভাবের তাড়নায় সন্তনরাই সে দুধ খেয়ে নেয়। সে দুধের কোন মূল্য নেই, তা জলে ফেলে দিতে হয় সংস্কার বশত। কিন্তু সে দুধ একজন কিনতে চেয়েছিল। সামান্য অর্থ হাতছাড়া হওয়ায় ইন্দর সিং স্ত্রীকে প্রহার করে। সেই মুহূর্তে ফুলমতিয়া এসেছে নিজের সন্তানদের দুধ খেয়ে নেওয়ার ইতিবৃত্ত জানাতে ও আরও কিছু ‘ফেন্‌উস’ এর আশায়। আভা রক্তমাংসের নারী, দুধের জন্য অর্থ লোকসানের প্রসঙ্গে স্বামীর কথার উত্তরে সে বলেছিল –‘’আমাদের ভগবান আছে, আর সুখরামুয়ার জন্য আমরা আছি। ওকে দেখাটাও আমাদের কাজ।‘’ (তদেব, পৃ. ৪৪ ) এই মানবিকতা বোধের কোন মূল্য নেই স্বামী ইন্দর সিংহের কাছে। সে বোঝে অর্থ। অর্থ মানুষকে কোন পর্যায় থেকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায় লেখক তা আবিষ্কার করেন। এ সংসারে দাম্পত্য অভিমানের কোন পরিসর নেই, তাঁরাও সংগ্রাম করেই সংসার গড়ে তুলেছে, তবুও সামান্য অর্থের জন্য স্বামী ইন্দর সিংহের যে অমানবিকতা তা মেনে নিতে পারেনি। সামান্য একটি ব্যঙ্গেই নিজের যাবতীয় ক্ষোভ প্রকাশ করে দিয়েছে। শুভবোধগুলি ধ্বংস হয়ে গেলেও সবাই যে এখনও মানবিকতা হারিয়ে ফেলেনি সে সত্য লেখক প্রতিষ্ঠা করেন, আভা সে জীবনসত্যের বার্তাগুলি আমাদের আরও একবার নতুন করে জানান দিয়ে যায়।

                                         ‘পিতা’ (অনুষ্টুপ, ১৯৮৯ ) গল্পে লেখক হীরালালের মনস্তাত্ত্বিক চিত্রণে নজর দিয়েছেন। কিন্তু সেই মনস্তত্ত্বের মধ্যে ভয়ংকর ভাবে উঁকি দিয়েছে সময়যন্ত্রণা। সমাজের গভীর তলদেশে থাকা মানুষের ক্ষোভ, বেদনা, অভিমানগুলি তিনি এ গল্পে নির্মাণ করে চলেন। কারখানা বন্ধ, বহু শ্রমিক বেকার হয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে কারখানার সব সুযোগ সুবিধাগুলি বন্ধ, পুত্রের মাথা ফেঁটে যাওয়া, পিতার নীরবতা, পুত্রের রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কাজ করতে যাওয়া হীরালালের সামনে আরও এক বৃহৎ সত্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। বাতিল মানুষ সময়ের গ্রাসে আবার কীভাবে প্রয়োজন পড়ছে লেখক তা দেখান। বৃদ্ধ হীরালাল কর্মহীন হয়ে পড়েছিল, বস্তিতে রোজগার নেই বলে পুরোহিতের আর ডাক পড়ে না, সংসারে সে সামান্য বাতিলের দলেই পড়েছিল কিন্তু পুত্রের কাজের সন্ধানে চলে যাওয়ায় আবার প্রয়োজন হয়েছে। পুত্রের রক্তই যেন প্রয়োজনের গুরুত্ব জানিয়ে দিচ্ছে। লেখক অত্যন্ত সচেতন ভাবেই বয়ন করেন –

‘’ছমছমে একাকীত্বে শুয়ে শুয়ে ভাবে সংসারে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবার পেছনে লুকিয়ে আছে রক্ত – তারই আত্মজের। খুব খাটো লাগে নিজেকে। পাপ ! বরঞ্চ নীরব অপ্রয়োজনীয়তাটুকু ভাল ছিল অতীতের। এ অন্ন নোনতা ! এ মর্যাদা বড্ড নিষ্ঠুর ! চোখ ফেটে জল আসে। চোখে ভাসে শম্ভুর করুণ মুখ।‘’ (তদেব, পৃ. ৭৮ )

পুত্রবধূ শিপ্রা ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছে কিছু রোজগার করলে ভালো হয়। তাছাড়া ভিন্ন পথ নেই। নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনসংকটকে লেখক বড় করে তুলেছেন। কর্মহীন মানুষের কোন মূল্য নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে থাকে না তা জানে হীরালাল। বসে বসে অন্ন ধ্বংস করা যে অন্নের মর্যদাহানী করা তা সে জানে। কিন্তু আজ শরীর আর সাড়া দেয়নি। একদিন কর্ম ফিরে যাবার চেতনা, অন্যদিকে অবসন্ন শরীর – এই দোলাচলতায় সে ভোগে। বিদ্ধস্ত মন নিয়ে কুঠুরিতে চলে যায়।

              ‘শব্দের প্রতিমা’ গল্পটি ‘শারদীয় ওভারল্যাণ্ড’ পত্রিকায় ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। যিনি ‘জলতিমির’ নামক উপন্যাস লিখেছেন তাঁর ছোটোগল্পের বয়ানে পরিবেশ সম্যসার দিকগুলি প্রাধান্য পাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রযুক্তির জগতে দ্রুত থেকে দ্রুততর যাত্রার জন্য আমরা ট্রেন ব্যবহার করছি। একজন লেখক ঘটমান বর্তমানে প্রতিফলিত সমস্যা জর্জর প্রতিবেদনকেই আখ্যানে পরিণত করবেন এটাই স্বভাবিক। লেখক অনুঘটক রূপে বাস্তবতার পাঠকে সামনে রেখে নব্য বাস্তবতায়  পাঠককে পৌঁছে দেবেন। এখানেই একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতা। সাধন চট্টোপাধ্যায় সামাজিক ক্ষতগুলিকে শুধু চিহ্নিতই করেন না, বাস্তবের প্রতিবেদনকে সামনে রেখে স্বতন্ত্র বয়ান নির্মাণে এগিয়ে যান, সেখানে বাস্তবতা অবশ্যই থাকে কিন্তু পাঠককে ভিন্ন পরিসর খুলে দেয়। এ গল্পের সূচনাবিন্দুতেই তিনি পাঠককে একটি সংবাদ জানিয়ে দেন –

‘’অকালবোধনে রামচন্দ্র আপন কোমললোচন নিবেদনে উদ্যত হলে, শব্দের প্রতিমারা জেগে উঠেছিল। শপথ নিয়েছিলে, বস্তুজগৎ তাঁরাই প্রতীয়মান করবেন মানুষের অন্তরে। রামচন্দ্র নয়নমণ্ডিত থেকে গেলেও, শব্দের প্রতিমারা আজও আছেন। প্রতিদিন দৃশ্যময়তার আড়ালে রচনা করছেন আপন পৃথিবী ; তাঁর সন্তানদের জন্য – যারা আলোর আর্শীবাদবঞ্চিত।‘’ ( তদেব, পৃ. ১৪১ )

 এই যে ‘নতুন পৃথিবী রচনা’ ও ‘আলোর আর্শীবাদবঞ্চিত’ এই শব্দবন্ধদুটিকেই লেখক বিশ্লেষণ করেছেন গল্পভুবনে। রেলস্টেশনে বসবাস শ্রীপতির। ক্রমাগত শব্দ বর্ষণে সে নতুন পৃথিবীর সন্ধান পায়নি। সে সব শব্দ শুনতে পায়। একদিকে প্রযুক্তির জগতে নতুন সভ্যতার হাতছানি, অন্যদিকে স্টেশনে পড়ে থাকা মানুষ। এই মানুষগুলি আগে গ্রামে ছিল। পৃথিবীর ধ্বনিময় শব্দ, বাতাসের কলতান, পাখির কূজন শুনে মুগ্ধ হত। মনে ভাবে আবার যদি ফিরে পাওয়া যেত সে জীবন। কিন্তু এই স্বপ্নাকাঙ্ক্ষায় জল ঢেলে দিচ্ছে রাজধানী এক্সপ্রেসের শব্দ। ক্রমাগত শব্দ বর্ষণে একসময় শ্রীপতির সমস্ত চেতনা হারিয়ে যেতে থাকে। বাস্তবের এই প্রতিবেদনকে লেখক গল্পে পরিণত করেন। কোন আবেগ নয়, গল্পের ভিতরে শব্দের ঘূর্ণনে বা শব্দের বৃত্তাকার পথে কীভাবে সভ্যতা ক্রমগ্রাসমান পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা দেখিয়ে দেন। এ চলার বিরাম নেই, শ্রীপতিরাই হয়ত একসময় হারিয়ে যাবে, সেদিন লেখককে হয়ত আবার নতুন আখ্যান লিখতে হবে।

‘আইন-বেআইন’ (অনুষ্টুপ, ১৯৮১ ) গল্পে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নামে যে চুড়ান্ত বেআইনি ব্যবস্থা প্রাধান্য পায় তা ফুটে ওঠে। যাদের হাতে আইন রক্ষার দায়িত্ব তারাই বেআইনির পথ আবিষ্কার করে। এই মূল্যবোধের অবক্ষয় তা সমাজকে ক্রমেই পঙ্কিল স্তরে নিয়ে চলেছে। এ গল্পের দুটি দিক। একদিকে আধিয়ার পূর্ণ সহ গ্রামের সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে বিট্‌বাবু সহ অন্যান্য অফিসাররা। বন থেকে কাঠ চুরি চলে। অভাবই এ পথে নামাতে বাধ্য করেছে পূর্ণদের। পরিবেশ, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা এঁরা বোঝেনা। বোঝা সম্ভবও নয়। যেখানে ক্ষুধাই একমাত্র সত্য সেখানে প্রকৃতি রক্ষার কোন প্রশ্ন আসেনা। তাঁদের এই কার্যকলাপকে সঙ্গত ভাবেই বেআইনি মনে হয়না। অন্যদিকে আছে বিট্‌ অফিসাররা, যাঁদের হাতে অরণ্য রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে প্রশাসন। এঁরা কাঠ চোরাচালানে তো নিযুক্তই তেমনি সাধারণ মানুষ কাঠ চুরি করলে নানা ঘুষ নিয়ে ছাড়েন। এই ঘুষ নেওয়া তাঁদের কোন বিবেক দংশন করেনা। আধিয়ার পূর্ণের কন্যার বিবাহ। তাই চুরি করা কাঠ দিয়ে সে রাতারাতি ঘর তৈরি করে ফেলে। তাঁর ছিল চারটি মোরগ। চরম অভাবেও তা বিক্রি করেনি, কেননা কন্যার বিবাহতে মানুষদের ভোজন করাবে বলে। আজ এসেছে বিট্‌ অফিসার। চুরির অপরাধে পূর্ণকে ধরেছে, ঘুষ হিসেবে দুটি মোরগ অথবা পঞ্চাশ টাকা নচেৎ গ্রেফতার হয়ে যাবে। অফিসারের কথায় শেষ পর্যন্ত পূর্ণ দুটি মোরগ তুলে দেয়। গল্পের আখ্যান এটুকুই। কিন্তু লেখক এ আখ্যানের ভিতর দিয়ে সামাজিক বাস্তবতার ওপর যেমন নজর দেন তেমনি শাসন ব্যবস্থার শূন্য দিকগুলি চিহ্নিত করেন। যে বিট্‌ অফিসার বন ধ্বংসের প্রসঙ্গ তুলেছিল –‘’জঙ্গলটা শেষ করবি ? জানিস, কেন বৃষ্টি কম হয় ? জমিতে ফসল ফলে না ? বাতাসে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে ? মুখ্যুর মরণ, বুঝবি কোত্থেকে ? গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করছিস।‘’ ( তদেব, পৃ. ৩১২ ) –তিনি পাখি ( মোরগ ) গুলি ভোগের জন্য নিয়ে গেছে। আইন তো শুধুমাত্র গরিব মানুষদের জন্য, আইনের নানা নিয়ম, রীতি দেখিয়ে গরিব মানুষকে শোষণ করা যায়, সে বৃত্তের বাইরে অবস্থান করে ধনি মানুষেরা। ধনী মানুষের জন্য কোন আইন নেই। গরিব মানুষের বেআইন যেন ধনী মানুষের কাছে আইন হয়ে ওঠে। এই যে দ্বিধাবিভক্ত সমাজ ব্যবস্থা, এর মর্মমূলে যেমন আঘাত করেন তেমনি ভারতবর্ষের প্রান্তিক মানুষের প্রকৃত স্বরূপ স্পষ্ট করে তোলেন।

                                         সাধন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে যৌনতার প্রসঙ্গ তেমন নেই, অন্তত গল্পসমগ্র ( দ্বিতীয় খণ্ড ) পাঠে । তিনি নিছক কাহিনি বলে যান না। কাহিনির ভিতর থেকে আরও এক কাহিনি উঠে আসে। যেখানে সময়, সমাজ ওতপ্রোতভাবে উঁকি দিয়ে। বাস্তবের প্রতিবেদনকে সামনে রেখেই তিনি ভিন্ন বাস্তবে এগিয়ে যান। বাস্তবের প্রতিবেদন হিসেবে বিকল্প বাস্তব যখন অধিবাস্তবের স্বর নিয়ে উপস্থিত হয় তখনই রচিত হয় বিপ্রতীপ বাস্তব। সেই বাস্তবের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সময়ের আধুনিকতা। আর সে আধুনিকতাকেই নানা পরিসরে নির্মাণ করে চলেন গল্পকার সাধন চট্টোপাধ্যায়।

 কৃতজ্ঞতা –অধ্যাপক জয় দাস 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত