| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

গল্প: বাজনা বাজে । স্বপ্নময় চক্রবর্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 17 মিনিট
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ করতে পারে না। বারবার ঠাইনাড়া হতে হয়। যেমন আজকের এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাখা সকালে জানলার ধারটায় এক পেয়ালা চা হাতে নিয়ে ওধারের বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল কচি উড়ন্ত কাক-সহ উপভােগ করছিল বিজন, ডােবাটার কচুরিপানার সবুজে একটা ব্রাউন ব্রেডের খালি প্যাকেট চিকচিক। এই ফাঁকাটুকুর লােভেই এই ফ্ল্যাটটা কেনা। ডােবার ওপারে মােবাইল টাওয়ার সমেত ছ’তলা বাড়িটায় জড়িয়ে তখনও ভৈরবী রাগিণী। দৃশ্যটা অবলােকন করছিল বিজন, তখনই ‘অ কাকু, সরুন, ঝাট দেব।’ সােফায় বসলেও উঠতে হবে, কারণ বৌদির হুকুম আছে সােফা সরিয়ে ঝাড়ু দিতে হবে এবং মুছতে হবে। সুতরাং ডাইনিং টেবিলে গিয়ে চা টুকু শেষ করতে হয়। যদি তখনও চা টুকু শেষ না হয়, তখন ডাইনিং টেবিলের তলদেশ আক্রান্ত হলে পুনরায় সােফা কিংবা বেতের চেয়ারে ফিরে যেতে হয়। চা টা নিজেই বানায় বিজন, কারণ ওর স্ত্রী সবিতা প্রভাতকালে ধর্মকর্ম করে। ক্রিয়াকর্মের শেষে শঙখ বাজে যখন, তখন বেলা আটটা। এতক্ষণ কি ‘চাতক হয়ে থাকা যায় নাকি? চা বানানাের সময়টা এদিক ওদিক করেও লাভ হয়নি। পম্পিও অদ্ভুতভাবে ঝাড়ু দেবার সময়টা এদিক করে নেয়, এবং ঠিক জানালার ধারে বসার সময়টাতেই সমাপতন হয়। বিজন কতবার ভেবে ছিল আপনা ভুলিয়া, সকাল বেলাতে যাবে ঘর ছেড়ে চলিয়া। বাইরে যদুর দোকানে চা খাবে। ওখানে বেঞ্চি আছে। প্রভাতবায়ু। সেবীরা ওখানে বসেই চা পান-সহ পারস্পরিক প্রেশার-সুগার সম্পর্কিত তথ্য বিনিময় করে। কিন্তু প্রভাতের ভৈরবী রাগিণী মণ্ডিত আলস্যে লুঙ্গি ছেড়ে পাজামা পরতে ইচ্ছে করে না, আর লুঙ্গি পরে ঘরের বাইরে যে বেরুনােটা নিতে পারে না বিজন। তাই বাধ্যতাবশতই বিছানায় বসে অতি সাবধানে চা খেতে হয় বিজনকে, চায়ের সুখ চাপা পড়ে যায় একদম। চায় কা হ্যায় দো ইয়ার, নিমকিন অওর নিউজ পেপার। বিজনের বস বলেছিল। তিন ইয়ারও হতে পারে, সেটা জানালার ধার। চায়ের মজাটা একেবারেই পাচ্ছে না বিজন এই পম্পির কারণে। গরম চা, সঙ্গে গরম খবর কাগজ আর নরম আলাে, একসঙ্গে জুটছেই । পম্পি বড় সকাল সকাল আসে। তখনও খবর কাগজওলা কাগজ দেয় না। চা খাওয়া শেষ হয়ে যায়। তারপর কাগজ এলে যাবতীয় ধর্ষণ এবং স্ক্যাম কথা চা ছাড়াই পড়তে হয়। বিজনের বস যে চায়ের ইয়ার হিসেবে নিমকিন-এর কথা বলেছিল, সেটা প্রতীক। আসলে এইসব খবরগুলােই নিমকিন। দশ বছরের বালিকার অভিভাবক বত্রিশ সপ্তাহের জ্বণনাশের জন্য অভিযুক্ত। স্বামীকে বিষ খাইয়ে প্রেমিকের সঙ্গে সিনেমা দেখে ফিরে মৃত স্বামীকে দেখে চিৎকার, কী সর্বনাশ হল…। এই তাে, এগুলােই তাে নিমকিন। আগামী বছরের যাত্রা—পতি আর পায় না সতী, কিংবা হাসতে হাসতে ঢালছে বিষ।। ঘরদোর মােছামুছি শেষ হলে পম্পি রান্নাঘর…সরি, কিচেনের সিংক-এর সামনে দাঁড়িয়ে বাসনটাসন মাজে। বাইরের কম্পিউটার টেবিলে ওর মােবাইল থাকে। বিজন এই সময় রেডিওটাও চালিয়ে রাখে। রেডিওর সকালের রবীন্দ্রসঙ্গীতটা শােনা ওর বহুদিনের অভ্যেস। কোথায় সেইসব শিল্পীরা, সুচিত্রা, কণিকা, সাগর সেন, সুবিনয়…। সব কিছুর স্ট্যান্ডার্ড পড়ে গেছে। সারা দুনিয়া জুড়ে, সব কিছুর। সব বিশ্বায়নের ইয়ে। খুব বিরক্ত হয় বিজন বড়াল, যখন মধুর রূপে বিরাজ হে বিশ্বরাজ-র মাঝখানে হঠাৎ উল্লুকা পাটঠা রে… উল্লুকা পাটঠা বেজে ওঠে। ওটা পম্পির মােবাইল থেকে আসে। ওটা ওর কলার টিউন। বিজন বলেছে- এটা কী ঢুকিয়েছিস তাের মােবাইলে? পম্পি বলে— দারুণ গান কাকু, অরিজিৎ সিং। জগ্না জাসুস সিনেমার গান। বিজন বলে- বাজে গান, একদম বাজে গান। এটা পেলি কোথায়? ও বলে- ওমা! পেতে অসুবিধে কী আছে? আমার মােবাইলে ছশাে গান লােড করা আছে, তার থেকে একটা লােড করে কলার টিউন করে নেয়া যায়। বিজন লক্ষ্য করেছে এই মেয়েটার মােবাইল ওর নিজের মােবাইলটার চেয়ে দামি। বিজনের মােবাইলটা হল পুরনাে নােকিয়া। এটার মধ্যে এদের নিজস্ব কলার টিউন ভরা আছে। সবিতার মােবাইলও তাই।
 
বিজন বলে— এরকম উল্লুকা পাটঠা শুনতে ভালাে লাগে না সকাল বেলা। তুই একটা পাল্টা।
 
– তবে লুঙ্গি ড্যান্স লাগিয়ে দিই?
 
হি হি করে হাসে পম্পি। বড্ড ফাজিল ও। বিজন বলে- তুই ইয়ারকি করছিস আমার সঙ্গে? সাহস তাে কম নয়! ও জিভ কাটে দাঁতে। দাঁতে জিভ কাটলে ওকে বেশ অন্যরকম লাগে। বেশ একটা লাস্য লাস্য ভাব। ফ্যাশন টিভিতে দেখেছে মডেলরা এরকম দাঁতে জিভ কেটে…। বেশ লজ্জা পাঞ্চ করা সেক্স…।
 
ও বলে- তবে বলেদিন না কী গানটা কলার টিউন করব?
 
– আমি কী করে জানবাে তাের মােবাইলে কী কী গান আছে।
 
– বললাম তাে অনেক গান আছে। ছশাে। ‘বােল রাধা বােল’ থেকে ‘মর্দ নে বহুত দর্দ পয়দা কর দেতি’, ‘রঙ দে তুঝে গেরুয়া’ও আছে।
 
– রঙ দে গেরুয়া ? আশ্চর্য হয় বিজন।।
 
— শুনবেন?
 
– আজ থাক। দেরি হয়ে গেছে। ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে তাে…।।
 
পম্পির ছেলের নাম প্রতিজ্ঞা। এ ধরনের মেয়েদের সন্তানের নাম এরকম হয় না। অরুণ, বরুণ, উত্তম, প্রসেনজিথ…পার্থ অমিতাভও হতে পারে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা নামটা ব্যতিক্রম। পম্পি আবার রফলাটাও ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারে। পােতি বাদ বলে না, পােত্যেক দিন বলে না, যেদিন ছেলেটাকে প্রথম নিয়ে এলাে পম্পি, সাদার উপর নীল চেক শার্ট, নীল টাই, কালাে হাফপ্যান্ট, স্কুলের ইউনিফর্ম আর কি, নাম জিজ্ঞাসা করেছিল বিজন। বাংলায়। ছেলেটা কোমরে হাত দিয়ে বলেছিল, মাই নেম ইজ প্রতিজ্ঞা বিশ্বাস। স্কুলে বােধ হয় এরকমই শিখিয়েছে। ক্লাস ওয়ানের এই ছেলেটা একদম স্পষ্ট উচ্চারণে বলেছিল প্রতিজ্ঞা।
 
বিজন পম্পিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তাের ছেলের এই নাম কে দিল রে? একদম আলাদা। পম্পি বলেছিল- কেন, আমিই তাে দিয়েছি। তারপর একটু থেমে, নীচু হয়ে সােফার তলা থেকে সিগারেটের একটা অবশিষ্টকে ঝাঁটা দিয়ে টেনে এনে, একটা চোখ খানিকটা কুঞ্চিত করে- যাকে চোখ মারা বললেও বলা যায়, কিন্তু না বলাই ভালাে, বলেছিল- খাবেন না, খাবেন না… কাকিমা রাগ করে…। অবশ্য কাকিমাকে বলব না…। তারপর বলেছিল আমার ছেলের নামটা পছন্দ হয়েছে কাকু?
 
বিজন বলল– বললাম তাে নামটা খুব আনকমন।।
 
পম্পি বলল- আসলে না কাকু, নামটা আমি টুকেছি। একটা ফ্ল্যাট আছে না ওধারে, স্বপনদীপ, ও বাড়ির ছেলের নাম প্রতিজ্ঞা। আমার ছেলের আগে নাম দিয়েছিলাম চন্দন। কিন্তু ইস্কুলে ভর্তির সময় প্রতিজ্ঞা করে দিলাম। নামটা আমার খুব পছন্দ। আর এজন্যই কিন্তু আমার বাড়ির কাজটা গেল। বাড়ির
 
ঝিয়ের ছেলে আর মনিবের ছেলের এক নাম ওদের পছন্দ হয়নি। ছেলের ইস্কুল না থাকলে ওদের বাড়িতে নিয়ে যেতাম ছেলেকে, ওকে বসিয়ে রেখে কাজ করতাম, হাতে একটা চিপস কিংবা ছােটো ক্যাডবেরির চকোলেট ধরিয়ে দিতাম মাঝে মাঝে। এটা ওদের পছন্দ হত না। তার ওপর আবার সাইকেলে যাই।
 
একদিন চুনাে মাছ কুটতে বলেছিল। আগেও দু’দিন এমনি কুটে দিয়েছি, মাছ কোটা ‘কনটাক্টে’ ছিল না। বললাম মাছ কুটতে হলে মাইনে বেশি দিতে হবে।
 
তখন বলল পয়সার বড্ড খাই তাের। পয়সা তাে নষ্ট করিস। ছেলেকে ক্যাডবেরি, চিপস খাইয়ে ফুটুনি দেখাস… এরকম আনসান কথা…। বললাম নিজের
 
রােজগারের পয়সা যা খুশি করব। তােমরা বলার কে। তা বলল- যত বড়াে মুখ নয় তত বড়াে কথা… এই সব। বলল এত ফুটুনিওলা কাজের মেয়ে দরকার নেই। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নেই… এই সব বলে লাস্টে কী বলল জানেন কাকু, আমাদের বাড়ির ছেলের নামে নিজের ছেলের নাম দেওয়া
 
হয়েছে… এত বড় আস্পদ্দা…।
 
যাক গে। কাজ গেছে যাক। আমাদের কি কাজের অভাব আছে নাকি? নামটা তাে নিয়ে নিয়েছি। বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতিজ্ঞাটা হেভি মানায়, তাই না কাকু?
 
এই মেয়েটা কথাবার্তা বিজনের সঙ্গেই বলে। সবিতার সঙ্গে খুব একটা কথাবার্তা হয় না। কারণ সকালে যখন আসে ও কাজ করতে , সবিতা তখন ঠাকুরের সামনে। ওখানেই অনেকটা সময় কাটায়। দুপুরের রান্নাটা সবিতাই করে কোনওরকমভাবে। রাত্রে রুটি কেনা হয়। একেবারেই একঘেয়ে জীবন। জীবনে
 
বৈচিত্র্য আনবার জন্য কী করা উচিত ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বিজন। জেসপ কোম্পানিতে চাকরি করত, কেরানির চাকরি দিয়ে শুরু করেছিল, প্রমােশনও হয়েছিল দুটো। কিন্তু কোম্পানিটার তাে বারােটা বেজে গেল। টাকাপয়সা কিছু দিয়ে বিদেয় করে দিল। কিন্তু সেই টাকাপয়সায় কদিন চলে? বাড়িতে একটা রুগ্ন মেয়ে। ওর ওষুধের খরচই মাসে আড়াই হাজার। তার উপরে বিধবা মা।।
 
মেয়েটার ছােটোবেলা থেকেই ফিট হয়ে যাবার রােগ। মৃগি। ডাক্তাররা ‘সেস’ বলে। ক্রনিক এপিলেপটিক স্ট্রোক। প্রতিটি স্ট্রোকে কিছু মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হয়ে যায়। সপ্তাহে দু-তিনবার করে ফিট হয়ে যেত মেয়েটা।
 
ডাক্তার কি কম দেখানাে হয়েছিল নাকি! বড়াে বড়াে নিউরােলজিস্ট, নাম করা হােমিওপ্যাথ, এমনকী বুজরুকি জেনেও সন্ন্যাসীর ওষুধ… কিছু হয়নি। এক ফকির বাবা ছিল, কোনও এক পীরের খাদেম, মাথায় ফু দিয়ে যাবতীয় মাথার রােগ সারায়। ওখানেও নিয়ে গিয়েছিল বিজন, বছর কুড়ি আগে। বিজন তখন তুখােড় ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। ঘাের বামপন্থী। প্রচুর লাল সেলাম দেয়া নেয়া করে। ওই পীরের ডেরায় জেসপের এক ফোরম্যানের সঙ্গে দেখা। ও অবাক হয়ে বলেছিল, সে কী ? আপনিও এসব জায়গায় ? বিজন বলেছিল- আর বলবেন না, সােভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাবার পর সমস্ত কিছু কেমন তছনছ হয়ে গেছে। সােভিয়েতের কথা সবিতাকেও বলেছিল। ভি আর এস যখন হল, কিছু টাকা পেল এক লপ্তে, কী করবে বুঝতে পারছিল না, চৌবাচ্চায় যদি ঢােকার পাইপ না থেকে শুধু বেরােবার পাইপটাই থাকে, ফাঁকা হতে কতক্ষণ? একটা রেস্টুরেন্ট করেছিল জেসপের আর এক ভি আর এস-ওলার সঙ্গে। একটা বড়াে পােলট্রির মরে যাওয়া মুরগি আসত ওখানে। টেলিফোনের কথাবার্তা শুনে ফেলেছিল সবিতা। সবিতা বলেছিল- এসব কী করছাে? এরকম কোরাে । বড়াে বড়াে কথা বলতে… | সবিতাকে ও বলেছিল—কী করব বল, সােভিয়েতের পতনের পর না…। ঠিক আছে, আর করব না। একবার আনিয়ে দেখছিলাম…। মার্জিনটা একটু বেশি থাকে।
 
শেষ অব্দি অবশ্য রেস্টুরেন্টটার মধ্যে থাকতে পারেনি বিজন। ওর পার্টনারকেই নিজের অংশটুকু বিক্রি করে দিয়েছিল। তখন ‘সারদা’র এজেন্ট হবার প্রস্তাব এসেছিল। জেসপের অনেকের হাতেই তখনও কিছু কিছু টাকা ছিল। সবাই বেশি সুদ খুঁজছিল। ওর একজন কমরেডই প্রস্তাবটা দিয়েছিল। ভাগ্যিস রাজি হয়নি। সঞ্চয়িতার স্মৃতিটা ওকে বাঁচিয়ে ছিল। স্মৃতিই বাঁচায়, আবার স্মৃতিই কখনও মারে। বিজনের বাবাকে স্মৃতিই মেরেছিল। ওর বাবা বেঁচে ছিল তখন।
 
দ্যাশের বাড়ি দ্যাশের বাড়ি করত। একবার পাশপাের্ট-টাসপাের্ট করে বাবাকে নিয়ে গিয়েছিল বরিশাল, উনিশশাে নব্বই নাগাদ। বিজনও ওই প্রথম যাচ্ছে বাংলাদেশ। একান্ন সালে চলে এসেছিল ওরা। বিজনের জন্ম উনিশশাে তিপ্পান্ন সালে।
 
ঢাকা থেকে রাত্তিরের স্টিমারে বরিশাল। গাড়ি নিয়ে বনারিপাড়া। বাবার স্মৃতিই তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তারপর খুঁজে বের করল ছেড়ে আসা বাড়ি। চেঁচাতে লাগল, এই তাে সেই গাব গাছখান, কঁঠাল গাছ কত বড়াে হইছে। পিছাড়ার খাল কই, পিছাড়ার খাল! যারা ছিল তারা বাড়ির পিছনে নিয়ে গেল। একটা খালও ছিল। বাবা হেঁকে উঠল- অ কামরুদ্দিন- নৌকা লইয়া গেলি কই? ওপারের মসজিদ থেকে আজান আসছিল। বাবা বলল, বুঝছি, জোহরের নামাজে গেছস! আমি খাড়াইয়া রইলাম… যা লইয়া আয়…। সেটাই বাবার মাথাখারাপের প্রথম লক্ষণ। কোনওরকমে বাড়ি নিয়ে এসেছিল বিজন। তারপর স্মৃতি নিয়ে গােলমাল। কখনও স্মৃতিভ্রংশ। স্মৃতিহীন, কখনও স্মৃতিতাড়না। প্রফুল্লনগর কলােনিতে ওদের বাড়ি ছিল। ওর বাবা কামরুদ্দিন রে… নৌকা কই’ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে দমদম রােডে চলে যায়। এঁকেবেঁকে ছােটা এক নব্যযুবকের মােটর সাইকেলের ধাক্কায় পড়ে যায়, বাঁচেনি। তখনও চাকরিটা ছিল বিজনের।
 
কলােনির সবাই পাট্টা পেতে থাকে ১৯৯৩ থেকে। বিক্রি করার অধিকারও জন্মায়। ২০০০ সালের পর থেকে ফ্ল্যাট তৈরি হতে থাকে। বিজনের প্লটটা ফ্ল্যাটবাড়ি হবার যােগ্যতাসম্পন্ন ছিল না। সরু রাস্তার ভিতরে। ওদের ভাষায় ‘চিপায় ফান্দাইন্যা ঘর’। তাই ওখানে ফ্ল্যাটবাড়ি হয়নি। ফ্ল্যাটে না থাকলে নিজেকে কেমন ছােটো ছােটো লাগে। এই সব মানসিকতাও হয়তাে সােভিয়েত রাশিয়ার পতনের পরেই জন্মেছে। পৈত্রিক বাড়িটা চার কাঠার প্লটে ছিল। ওটা বিক্রি করে এই ফ্ল্যাট। এখানে পুরনাে স্মৃতিটিতি থম মেরে নেই কোথাও। আগের ‘চিপায় ফান্দাইন্যা’ ঘরে ওসব ছিল, বারান্দায় ছিল, চক দিয়ে রাক্ষস আঁকা, লক্ষীপুজোর ধানের ছড়া আঁকা, মাঝে মাঝে লমীর পা। ছেলেমেয়ের হামাগুড়ি…।
 
মেয়েটা দিব্যি হামাগুড়ি দিত। হাঁটি হাঁটি পা পা-ও করেছে। ইস্কুলেও ভর্তি হয়েছিল, কিন্ডারগার্টেন-এ। জেসপ হল সাহেবি কোম্পানি। জেসপের হেডক্লার্কের মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে না তাে গিরিবালা বালিকা বিদ্যালয়ে নাকি? মাথা দুলিয়ে রাইমস পড়ত… হিকোরি ডিকোরি ডক, দি মাউস রানস আপ দি ক্লক। মেয়ের সঙ্গে এক দুই খেলা… ওয়ান টু বাকল মাই শু, থ্রি ফোর নক দি ডাের… দরজায় শব্দ করত তিন চার, চারবার… আহা তােমার সঙ্গে প্রাণের খেলা…
 
কলােনির মেয়েদের এরকম নাম হয় না। সবিতা রেখেছিল। ওর ছ’বছর বয়সে প্রথম ফিটটা হয়। পরপর তিন দিন। গার্ডিনাল ইত্যাদি ওষুধপত্র খেয়ে কোনও লাভ হল না। এটা নাকি একটা বিচ্ছিরি ধরনের মৃগি রােগ, জন্মের সময় মস্তিষ্কের একটা অংশের ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। হা, ওর ফরসেপ ডেলিভারি হয়েছিল। তখনও ফরসেপ প্রচলিত ছিল। সাঁড়াশি ধরনের একটা যন্ত্র দিয়ে সন্তানকে টেনে নেওয়া। একেবারে বাচ্চা বেলায় কেন ফিট হত না, কেন ছ’বছর বয়সের পর থেকে হত বিজন জানে না। ডাক্তাররা বলেছিল, এরকম হয়।
 
স্কুলে কয়েকবার ফিট হওয়ার পর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হল। বাড়িতে কিছুটা লেখাপড়া করেছে। কিন্তু ওর বারাে-তেরাে বছর বয়সের পর থেকেই ঠিকমতাে হাঁটতেই পারত না। সবিতা আটকে গেল। কোথাও বেড়াতে যেতে পারত না। বাবার মৃত্যুর পর মা এবং মেয়েকে বহুদিন সামলেছে সবিতা। মা গত হয়েছেন চার বছর আগে। এই ফ্ল্যাটটা কেনা হল বছর দুই। এটাকে নিজের বাড়ি ভাবতে পারত না। বলত, কবে বাড়ি যাবে বাবা। মেয়েটা ওর ছ-সাত বছরের স্মৃতি আঁকড়ে ছিল ওর আঠাশ বছর বয়স পর্যন্ত, মানে, মৃত্যু অব্দি আর কি। কলােনির ঘরের বারান্দায় ব্যাঙ লাফালে ও বড়াে বয়সেও হাততালি দিয়ে বলত, ছিপ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে মাছ নিয়ে গেল চিলে। ওর কথাটাও জড়িয়ে গিয়েছিল শেষের দিকে। ফেলে আসা নার্সারি রাইম বলত, কী বলত বােঝা যেত না। ব্যা-ব্যা করে থেমে গেছে কতবার, ব্ল্যাকশিপ বলতে পারেনি। আবার সুর করে মাঝে মাঝে আপন মনে বলত, আইককিরিম…। সেই আইসক্রিমের ফেরিওয়ালার ডাক।
 
মেয়েটা মারা গেছে মাস তিনেক হল। আর পম্পি এসেছে মাস চারেক। আগেকার কাজের মেয়েটা বলল এসব কাজ আর করবে না, বাজারে সেটিং করেছে। মাছ কুটবে। এতে অনেক বেশি ইনকাম। আজকাল বাড়ির বউরা মাছ কুটতে পারে না। কিন্তু ছােটো মাছ খাওয়ার শখ থাকে অনেকের, তাই মাছ কুটনির এখন খুব কদর। মরিয়া হয়ে লােক খুঁজতে হয়েছে। চায়ের দোকানে মাঝেমধ্যে বসে বিজন, চা খায়। ওখানেই বিজন দেখেছিল সাইকেলের সামনের রডে চাপিয়ে স্কুল ইউনিফর্ম পরা একটি ছেলেকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা মেয়ে। চায়ের দোকানের কেউ বলেছিল-অবস্থা দেখেছেন ? ঝি-টিরাও ওদের বাচ্চাদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছে। মাতৃভাষার মাতৃদুগ্ধর ছানা কেটে গেছে।
 
পরদিনই এই সময়ে রাস্তায় গিয়ে মেয়েটাকে থামায়।
 
আগে যে কাজ করত, তার চেয়ে বেশি টাকাতেই রফা হল। কী করা যাবে।
 
মেয়েটা কাজে কিন্তু চটপটে। সালােয়ার কামিজ পরে আসে। ওড়নাটা পেঁচিয়ে নিয়ে কাজ করে। ওর ছেলেকেও নিয়ে এসেছে কয়েক দিন।
 
একদিন কোনও কারণে স্কুল বন্ধ ছিল। ও জানত না, স্কুল ইউনিফর্ম পরা বাচ্চাটা ফেরার সময় এসেছিল। বাচ্চাটাকে বিজনের মেয়ে অবাক হয়ে দেখল, তারপরই হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, জাইলােফোন! জাইলােফোন!
 
কেন জাইলােফোন কেউ বুঝতে পারেনি। বিজন মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কোথায় জাইলােফোন? মেয়েটা পম্পির ছেলের দিকে আঙুল উঁচিয়ে রইল।
 
ও জাইলােফোন?
 
মেয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যা তাে। ওই তাে, ওই তাে জাইলােফোন।
 
পম্পির ছেলের জামায় লাগানাে স্কুলব্যাজটার দিকে ওর আঙুল। ও আবার বলল, একস ফর জাইলােফোন।
 
পম্পির ছেলের জামার ব্যাজে বড় করে লেখা। ওদের স্কুলের নাম জেভিয়ার গার্ডেন। X দিয়েই তাে জেভিয়ার লিখতে হয়। পম্পির ছেলেটা তখন
 
বলেছিল- আমিও জানি, একস ফর জাইলােফোন। কিন্তু আমি জাইলােফোন দেখিনি। ওটা কী?
 
পম্পি বলল, আমিও দেখিনি কাকু। কী ওটা? ছবি দেখে কিছু বুঝতে পারিনি কাকু।
 
বিজন বলেছিল— ওটায় মিউজিক বাজে। মিউজিক।
 
বর্ষা যখন ছােটো ছিল, বর্ষাও বলেছিল, জাইলােফোন কী বাবা? বিজন বলেছিল, ওটায় মিউজিক হয় মিউজিক। একটা জাইলােফোন কিনেও এনেছিল বিজন। খুব খুশি হয়েছিল মেয়ে। স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। স্কুল থেকে একটা জাইলােফোন রাইমও শিখে এসেছিল। জাইলােফোন ডিং ডং ডিং ডিপল ডিপল ডাম্পলিং… আরও কী সব ছিল। লাস্ট লাইনটায় একটা কিং ছিল যদুর মনে পড়ে।
 
পম্পির ছেলের জামার ব্যাজের X অক্ষরটা বর্ষাকে জাইলােফোনের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল। মাঝে মাঝেই বলত, ডিং ডং ডিং।
 
মেয়েটা পড়ে গিয়েছিল। ঠুকে গিয়েছিল মাথা। সবিতা বাথরুমে তখন। মাথার ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল- ডিডল ডিডল ডাম্পলিং। কোমায় চলে গিয়েছিল। হাসপাতালে। কী আশ্চর্য, জাইলােফোন রাইমস-এর শেষ লাইনটা মনে পড়ে গিয়েছিল বিজনের, হিয়ার এরাইভড আওয়ার কিং। টিরিং ডিরিং ডং ডিং। রাজা এসে গেছে।
 
পম্পি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল বিজনকে কাকু হােয়েল মানে তাে তিমি, তাই তাে!
 
-হু
 
— তিমি কি করে দেখাব ছেলেকে?
 
– কেন? তিমি দেখাতে যাবি কেন?
 
– আরে ছেলের বইতে আছে যে। এ ফর আপেল বি ফর বুক সি ফর ক্যাট সব ঠিক আছে। আই ফর আইসক্রিম অনেক খাইয়েছি। কে ফর ক্যাঙারু জেড ফর জেবরা দেখিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ডব্লু ফর হােয়েল আর একস ফর জাইলােফোনটা দেখাতে পারিনি।
 
বিজন বলল-ডব্লু ফর ওয়াচ দেখিয়ে দে।
 
-ভালাে বলেছেন তাে, বইতে নেই কিন্তু।
 
বিজন বলে, না থাকুগ গে। ডব্লু এ টি সি এইচ। ওয়াচ। সত্যিকারের ওয়াচ দেখিয়ে দে, ব্যাস।
 
– আর, একস? একস দিয়ে আর কিছু হয় না?
 
একস একটা আশ্চর্য শব্দ। রহস্যমাখা শব্দ। অঙ্ক করার সময় অজানা সংখ্যাকে সব সময় একস ভাবা হয়। লেট আস সাপােজ একস ইজ দ্যা আননােন নাম্বার। একস এর মান বাহির কর…।
 
যুগের পর যুগ চলে গেল। কত রহস্য সমাধান হয়ে গেল। কিন্তু আজও X is unknown কিন্তু XX, XXX কী জানা হয়ে গেছে।
 
বর্ষার মৃত্যুর পর সবিতা আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে মেয়েকে নিয়ে অনেকটাই সময় চলে যেত। ওকে স্নান করানাে, ধরে ধরে হাঁটানাে, জামা পরানাে, গল্প করা। এখন সব ফঁকা। সংসারটা যেন বন্ধ হয়ে যাওয়া জেসপ কারখানা হয়ে আছে। সবিতাকে বলেছে বিজন- এখন তাে আর কোনও পিছুটান নেই, একটু ঘুরেটুরে আসতে পারি তাে, কাছেপিঠে, দীঘা পুরী…। মাথা সামান্য হেলিয়েছে সবিতা, এর বেশি কিছু নয়। সবিতা বইটই পড়ে, কথামৃত, সারদামণি, শরৎচন্দ্রের বইও আছে বাড়িতে। বােধহয় আশাপূর্ণা দেবীর বইও আছে কটা। বিজনের অত পড়তে-টড়তে ভালাে লাগে না। খবর কাগজটা ভালাে করে পড়ে। সব পড়ে। বিজ্ঞাপন, নিরুদ্দেশ, শােকসংবাদ সব। আর সকালবেলায় রেডিও শােনে। পুরনাে অভ্যেস।
 
সন্ধের দিকে একটু আড্ডা মারতে যায় পাড়ায়। বাড়িতে এলে সিরিয়াল কখনও সবিতার সঙ্গে। ঠিক থই পায় না। কে আগের বউ কে পরের বউ কিংবা কে চক্রান্তের শিকার হচ্ছে গুলিয়ে যায়। সবিতাও যে সব ঠিকঠাক হিসেব রাখে তাও নয়। ওরা দেখে না, চেয়ে থাকে। এভাবেই দিন যায়, রাত্রি আসে, রাত্রি। যায় দিন। কোথাও আগুন জ্বলে, কোথাও দাঙ্গা হয়, কোথাও মিসাইল হানা, কোথাও লােহার রড ঢুকে যায় নারী অঙ্গে। ওরা চেয়ে থাকে।
 
পম্পি এলে তবু যা হােক কিছু কথাবার্তা। পম্পি জিজ্ঞেস করে ছােলার কল বেরােলে কি ছােলায় ভিটামিন বাড়ে? কখনও, ব্রাহ্মী শাক খেলে কি বুদ্ধি বাড়ে?
 
ওর ছেলের জন্যই ভাবে। ওর ব্যাগে একদিন স্ট্রঙ্গার টলার আর শার্পার হবার গুঁড়াে ভর্তি বাক্সো। বিজন বলে তার চেয়ে দুধ খাওয়া না, এত দাম দিয়ে এসব কিনিস কেন? ও বলে দুধে তাে ভেজাল। টিভিতে দেখিয়েছে। আর এগুলাে কি এমনি এমনি বিককিরি হয়? নিশ্চয়ই গুণ আছে। ফর্সা হবার ক্রিমও একদিন দেখেছে ওর ব্যাগে। এটা কার জন্য কেনে? ছেলেকে ফর্সাও করবে নাকি? নাকি নিজের জন্য? এসব জিজ্ঞাসা করা যায় না। ওর ব্যাগের ভিতরে কী আছে সেটা ওর ব্যাপার। ব্যাগে উঁকি মারা যায় না।
 
সেদিন ওর ব্যাগের থেকে বেরুল ‘মা আমায় ঘুরাবি কত। পম্পি দুষ্টু দুষ্টু হেসে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করল। ফোনটা বের করতে গিয়ে কিছু পড়ে গেল। একটা চৌকো মতাে প্লাস্টিক পাউচের মতাে। ওর মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল হঠাৎ। তাড়াতাড়ি করে ওটা কুড়িয়ে নিল। ব্যাগে রেখে দিল। বিজন জিজ্ঞাসা করেনি কিছু, ও নিজেই বলল, শ্যাম্পুর পাউচ। শ্যাম্পুর পাউচ তাে এত হামলে পড়ার কী ছিল! মরুক গে যাক। বিজন বলল, তাের কলার টিউনটা যে পাল্টালি বড়াে?
 
পম্পি আবার মুখে মুচকি হাসি এনে বলল- তােমার জন্যই তাে পাল্টালাম। বলেছিলে না এসব বাজে গান ভালাে লাগে না.. তাই ঠাকুরের গান লাগালাম, তােমার সঙ্গে খুব ফিট করবে। আমি তাে তােমায় ঘুরােই তাে, একবার বেতের চেয়ারে আবার সােফার চেয়ারে…
 
এই সব রসিকতা মন্দ লাগে না বিজনের। ও তাে বর্ষারই বয়সী। বর্ষা যদি ঠিকঠাক সুস্থ থাকত, এরকমই খুনসুটি করত। বর্ষার ঘরে হয়তাে পম্পির ছেলের মতােই একটা নাতি হত বিজনের।
 
মেয়েটার সবই ভালাে, তবে একটু কামাই করে। মাসে চারদিন ছুটি এখন নিয়ম হয়ে গেছে। এ নিয়ে আর কোনও তর্ক নেই। সবাই নিচ্ছে। এর বাইরেও দু-তিন দিন কামাই করে দেয়। ছেলের অসুখের কথা বলে, কখনও বা মন্দিরের কথা বলে। এইসব ছুটি সংক্রান্ত কথা সবিতার সঙ্গেই হয়। সবিতাকে ফোন করে বলে দেয়- সক্কালবেলা উঠে মনটা খুব দক্ষিণেশ্বর করছে, ছেলেকে নিয়ে কালীদর্শনে যাব ভাবছি, যাই?
 
কখনও বলে, ছেলে বায়না করেছে কুমােরটুলিতে ঠাকুর গড়া দেখতে যাবে। একটু নিয়ে যাই? বিকেলে যেখানে রান্নার কাজ করি, ওখানে কামাই দিলে মাইনে কেটে নেয়। একটু যাই?
 
ওরা মাইনে কাটে না। এ জন্যই পেয়ে বসেছে।
 
চায়ের দোকানে অনেকে বলে, এদের যত লাই দেবে তত মাথায় উঠবে। কথাটা মিথ্যে নয়, বিজন ব্যক্তিগতভাবে চায় কামাই করলে মাইনে কাটা উচিত। মাসে চারদিন ছুটি দিচ্ছে। তা ছাড়া মে ডে-র দিন, পয়লা মে এক্সট্রা ছুটি দিয়ে দেয় বিজন। বহুদিন থেকে। সােভিয়েত রাশিয়া ভেঙে পড়ার আগেও দিয়েছে, পরেও দিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া বিজয়াদশমী, পঁচিশে ডিসেম্বরও ছুটি। এগুলাে এক্সট্রা। এতটা সুবিধে দেয়া হয়। এরপর কামাইয়ের মাইনেটা নিশ্চয়ই কাটা উচিত। সবিতাকে বলেছে মাইনে কাটার কথা। সবিতা বলে- থাক গে, ওইটুকু কাজ আমার করে নিতে কীই বা কষ্ট। এতটা উদার টাইপের তাে ছিল না সবিতা, বরং কাজের লােকের সঙ্গে সবিতাই খিটিমিটি করত, বিজন বলত- থাক না, ছেড়ে দাও। একটা মৃত্যু একটা জীবনকে পাল্টে দিয়েছে অনেক।
 
আগেকার সবিতার অনেকটাই যেন মৃত।
 
সবিতা এখন বড় বেশি বাক্যহীন। বিজন বােধহয় বেশি কথা বলছে। বাড়িতে বলার সুযােগ নেই, তাই বাইরে। বাজারে বেশি সময় নিচ্ছে, দরাদরি করছে,সেদিন খামােকা একটা লােকের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়াল। লােকটার মুখ চেনা। এ দিকেই থাকে কোথাও। মাছওলা-সজিওলাদের সঙ্গে তুই-তােকারি করে।
 
সে অনেকেই করে, তবে ওর কথাবার্তার কায়দাই আলাদা। তুড়ি মেরে বলে- মােটা পেটির মাছটা তুলে রাখবি। একদিন কয়েকটা ট্যাংরা বেছে আলাদা করে রেখেছিল বিজন, একটু পেট মােটা দেখে, সমভাব্য ডিম প্রত্যাশ্যায়। লােকটা এল, বলল, এগুলাে আমায় দিয়ে দে…। মাছওলা বলল- এগুলাে একজন বেছে রেখেছে। লােকটা বলল, যেই বাছুক আমি নেব, টাকা বেশি দেব। বিজনের সঙ্গে তখনই লাগল। বিজন বলল, কী টাকা দেখাচ্ছেন। লােকটা বলল, পারলে আপনিও দেখান না। এইভাবেই শুরু। তারপর দেখে নেব, বুড়াে বলে কিছু বললাম না…ইত্যাদি। সােভিয়েত রাশিয়া কিংবা বামফ্রন্টের পতনের এত পরেও কিন্তু ওই মাছওলাটি লােকটাকে বলেছিল, আপনি যতই বেশি টাকা দেন না কেন, আমি এই কাকুকেই দেব, উনি আগে বেছে রেখেছেন।
 
বিজন একদিন পম্পিকে দেখল রাস্তায় ওই লােকটার সঙ্গে। লােকটা একটা ক্যাডবেরির বার দিল পম্পিকে। পম্পি ব্যাগে ঢােকাল। তারপর ওরা আর একটু এগােল, পাশাপাশি। লােকটা রিকশায় উঠে গেল। উঠে হাত নাড়ল হালকা করে। বিজন তখন পম্পির একেবারে সামনে। বিজন বলল, লােকটা কে পম্পি?
 
পম্পি বলল, প্রতিজ্ঞার বাবা।
 
যেন উপর থেকে পড়ল বিজন, যেন বাস্ট করল কিছু, যেন কেঁপে উঠল মাটি।
 
এই লােকটা প্রতিজ্ঞার বাবা ? তাের বর অ্যাকসিডেন্টে কবে মারা গেছে? এইবার পম্পি হেসে উঠল। বলল, না কাকু, এ হল অরজিনাল প্রতিজ্ঞার বাবা, যে বাড়িতে কাজ করতাম। ওর থেকেই তাে আমার ছেলের নামটা টুকেছিলাম।
 
বিজন যেন একটু ধাতস্থ হল। ও! তাই বল। কিন্তু ও বাড়ি থেকে তাের কাজটা চলে গিয়েছিল না? মাথা চুলকে জিজ্ঞাসা করল বিজন। হ্যা, ওটা তাে ও বাড়ির বৌদির জন্য। দাদাবাবু কিন্তু ভালাে। আমার ছেলেকে খুব ভালােবাসে।
 
পম্পির বরের নাকি বাইক অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। বিশদ জিজ্ঞাসা করেনি। চায়ের দোকানের আসরে কেউ বলেছিল পম্পির স্বামী ড্রাগ পেডলার ছিল। ও খুন হয়েছিল। বিশদ জানে না। একবার একটু জিজ্ঞাসা করেছিল। ও বলেছিল, ও সব কথা ছেড়ে দিন। ভাল্লাগে না। আর খুঁচিয়ে কী হবে? আর জিজ্ঞাসা করেনি কখনও।
 
ফোনে একদিন বলতে শুনেছে, পম্পি বলছে– মাথা খারাপ? আর ফাদে পড়ি, বেশ আছি, বিন্দাস, স্বাধীন। বােঝাই যাচ্ছে বিয়ের কথা বলেছিল কেউ। ওর সখীস্থানীয়।
 
পম্পির ব্যাগটার মধ্যে একটা জিজ্ঞাসাচিহ্ন ঢুকে আছে মনে হয় বিজনের। ওর ভিতরে যেন একটা এক্স, একটা আননােন কিছু অস্তিত্ব। খুলতে লােভ হয়। আবার কি ক্যাডবেরি বার পাবে, চিপস, কিংবা কোনও উপহার ? কিছুদিন হল পম্পি চুল ছােটো করেছে। খুব ছােটো নয়, ডিজাইন। সামনে কয়েকটা লকলক করে, পিছনে ঢেউ। গার্ডার বাঁধা। ওই লােকটার হাত নাড়ানােটা ভালাে লাগেনি বিজনের লােকটার উপর রাগ বেড়ে যায়। রাস্তায় দেখতে পেলে কপাল কুঁচকে যায় বিজনের। ভিতরে ভিতরে শ্লোগান ওঠে, কালাে হাত ভেঙে দাও। পম্পির উপরও একটু রাগ হয়। রাগ, নাকি জেলাসি? কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছে। পম্পির মােবাইল থেকে এখন আগের মতাে উল্লুকা পাটঠাই বাজে।
 
একটা সকালে পম্পি ওর ছেলেকে নিয়ে এল। সকালেই ফোন করে বলেছিল আসছে। ইউনিফর্ম পরা নয়, এমনি। জামা-প্যান্ট। সঙ্গে দুটো বই, খাতা। সবিতাকে আগেই বলা ছিল- ওর নিজের কাকিমার শরীর খুব খারাপ, বাঁচবে না, চোখের দেখা দেখতে যাবে, গুমা হাবড়ার ওধারে। ছেলের ইস্কুলে ছুটি পড়েছে, এখানে থাকুক। ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। সবিতা বলেছিল, থাকুক না। পম্পি বলে গেল, একদম গুড বয় হয়ে থাকবে। দুষ্টু করবে না। দিদার কথা শুনবে। এইটের টেবিল আর নাইনের টেবিল মুখস্ত করবে। সাম অঙ্কগুলাে করে রাখবে, কেমন ?
 
বিজন লক্ষ্য করল- ‘দাদুর কথা শুনবে’ বলল না ও।
 
পম্পির বােধহয় এবার মনে হল এটা ঠিক হল না, তাই আবার বলল ছেলেকে যেন একটু ভ্রমসংশােধন, যেন লেজার বুক-এর একটা পৃষ্ঠা ছেড়ে গেছে, ‘দাদু-দিদার কথা শুনবে কিন্তু। বলেই বিজনের দিকে কটাক্ষ। সেই কটাক্ষে ভাসছে একটা X।
 
এর আগেও একবার ছেলেটা এখানে ছিল সারা দুপুর। ভালােই লাগে। গল্প শুনতে চেয়েছিল। খরগােশ কচ্ছপের গল্প বলেছিল বিজন, হাঁসের পেটের সােনার ডিমের গল্প, বােতল রাক্ষসের…। কত দিন পর এসব…। বর্ষাকে বল তাে।
 
আজ সবিতা ওর কাছ থেকে ছড়া শুনতে চাইল।।
 
‘খােকা যাবে শ্বশুরবাড়ি জানাে? ও বলল , ওটা তাে ছােটোবেলায় শিখেছি। এখন কী শিখেছাে? ছেলেটা বলল
 
— এ্যান এ্যাপল এ ডে
 
কিপস দ্যা ডক্টর অ্যাওয়ে
 
এ্যাপল ইন দি মর্নিং
 
ইজ ডক্টরস ওয়ার্নিং।
 
— রােজ আপেল খাও তুমি প্রতিজ্ঞা ?
 
ও বলল, রােজ না, মাঝে মাঝেই খাই।
 
ফ্রিজ থেকে একটা লাল টুকটুকে আপেল বের করে দিল সবিতা।
 
আরও রাইমস বলল প্রতিজ্ঞা। এইট ওয়ান জা এইট, এইট টু জা সিক্সটিন… মুখস্ত হতে কতক্ষণ লাগে? ওর ‘সাম অঙ্ক’– মানে যােগ করাও হয়ে গেল।
 
দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেল।
 
আগের দিন ও বিকেলের দিকে এসেছিল, রাত ন’টায় নিয়ে গেছে। কিন্তু আজ দুপুরে এখানে।
 
ও কি একসাথে খাবে, টেবিলে? নাকি মেঝেতে থালা দেবে সবিতা? টেবিলেই ভাতের থালা বেড়ে নিল। সবিতাকে পাল্টে দিল একটা মৃত্যু?
 
বেশ ফুটফুটে কিন্তু ছেলেটা।
 
সবিতা জিজ্ঞেস করেছিল- কী খেতে সবচেয়ে ভালাে লাগে, ও বলেছিল, ডিম। সবিতা তাই একটা ওমলেট করে দিল। খেতে বসে জানাল, মাও ওকে রােজ ডিম খেতে দেয়, কিন্তু মা রােজ খায় না। মাঝে মাঝে মাছ ভাজা খায়। কিন্তু ওর মায়ের খুব ভয় গলায় যদি কাটা ফুটে যায়। তাই ওর মা মাছ খায় না।
 
ওর একদম ভয় নেই। বড়াে হয়ে ও পুলিশ হবে। ওকে সবাই ভয় করবে, ড্রাইভারও হতে পারে, কানাইকাকুর মতাে, সাঁ করে গাড়ি চালাবে বেশ, কিন্তু সামনের জন্মে টিকটিকি হবে… হি হি… টিকটিকি খুব ভালাে লাগে। কী সুন্দর দেয়াল বেয়ে ঘােরে..। ফ্যালাট বাড়ি খুব ভালাে। কল খুললেই জল। বস্তিবাড়ি ভালাে না। জল তুলে রাখতে হয়। মা বলেছে একটা ফ্যালাট বাড়ি কিনবে। ছােটো, একখানা ঘর। ওয়ান রুম, ওয়ান রুম।
 
ফোনটা তখনই এল সবিতার ফোনে। খাওয়ার টেবিল ছেড়ে ফোনটা ধরল সবিতা। সবিতার মুখটা পাল্টে গেছে। ও বলছে, সে কী? এ সব কী বলছেন?
 
কেমন আছে এখন? স্বপনদীপটা কোথায়? হ্যা, তারকনাথ তাে চিনি… ওটার পাশের রাস্তা… তারপর…?
 
বােঝাই যাচ্ছে কিছু একটা গন্ডগােল হয়েছে। সবিতার মুখে জমে থাকা স্থির অন্ধকার যেন পাক খাচ্ছে এখন। বাচ্চাটাকে জিজ্ঞাসা করে, তাের মা তােকে কী বলে গিয়েছিল ? ছেলেটা বলে- বলেছে খুব দরকারি কাজে যাচ্ছি, আসার সময় তাের জন্য একটা জাইলােফোন নিয়ে আসব। কালকে ইস্কুলে একটা মেয়ে নিয়ে এসেছিল, কী সুন্দর ডিং ডং হয়, সবাইকে একবার করে বাজাতে দিয়েছে। আমাকে দেয়নি, বলেছে ঝিয়ের ছেলের বাজাতে হবে না।
 
সবিতা বিজনকে বলল, বেরােতে হবে চলাে। স্বপনদীপ নামে একটা ফ্ল্যাট, তারকনাথ সুইটস-এর পাশের গলি, চেনাে?
 
বিজন তাে জানে অরিজিনাল প্রতিজ্ঞা ওখানে থাকে। প্রতিজ্ঞার বাবাই তাে একদিন রিকশায় উঠে…। সবিতা বলল- ওখানে যেতে হবে।
 
— কেন?
 
এই ডুপ্লিকেট প্রতিজ্ঞার দিকে একবার তাকাল সবিতা, বলল, চলাে, বলছি।
 
সবিতার মুখের পাক খাওয়া অন্ধকারের মধ্যে এখন অন্য কী যেন। বেশ ক’দিন কারখানা বন্ধ থাকার পর মােটর ঘুরল যেন। বর্ষা অসুস্থ হয়ে গেলে এরকম চঞ্চল হয়ে যেত সবিতা।
 
বিজন কিন্তু বলতে যাচ্ছিল।
 
ওর মুখের সামনে সবিতার হাতের পাঁচ আঙুল। নিষেধ। বরাভয় মুদ্রাও অনেকটা এরকম। বাচ্চাটাকে বলল, তুমি এখানে থাকো। আমরা এক্ষুনি আসছি।
 
চুপ করে শুয়ে থাকো খাটে।
 
তালাটা বাইরে থেকেই বন্ধ করল সবিতা। বলল, পম্পির বিপদ হয়েছে কিছু।
 
স্বপনদীপ। চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। বাড়ির সামনে একটা ছােটো জটলা।
 
–আপনিই সবিতা কাকি?
 
সবিতা মাথা নাড়ে।
 
– পম্পির কাকিমা হন, নাকি পাতানাে ?
 
— ধরে নিন কাকিমাই হই।
 
— ওকে, ঠিক আছে। ধরে নিলাম। আপনারা জানতেন না ও দেহ বিক্রি করে? একেবারে রেডহ্যান্ড ধরা হয়েছে। ওর মােবাইলের কল লিস্ট দেখলাম, লাস্ট ফোন আপনাকে করা। সবিতা কাকি। তাই এখানেই ফোন করলাম। উপরে চলুন। সেকেন্ড ফ্লোর।
 
মেঝেতে শুয়ে আছে পম্পি। এলােথেলাে চুল। চোখ বােজা, মুখ খােলা, মুখ থেকে রক্ত। ওর লাল ব্যাগটাও খােলা। ব্যাগের ভেতর থেকে এইমাত্র বেরিয়ে এল উল্লুকা পাটঠা… পাটঠা উল্লুকা…।
 
বিজন হতবাক। ব্যাপারটা কী? সবিতা বসে পড়ে মেঝেতে। পম্পিকে ডেকে ওঠে। ধাক্কা দেয়। পম্পি চোখ খােলে। কিছু বলতে চায়। ঠোট নড়ে। বােঝা যায় রক্তটা মুখের ভিতরের নয়, ঠোট ফেটে গেছে।
 
অনেকেই কথা বলতে থাকে। একজন মােটাসােটা বছর পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের মহিলাই বেশি কথা বলছিল। সে বলল- তক্কে তক্কে ছিলাম, আজ ধরেছি। জানা গেল ও প্রতিজ্ঞা নামক ছেলেটার মা।।
 
প্রতিজ্ঞা এখন এ ঘরে নেই। ও নােংরা পরিবেশের বাইরে একটা ভালাে পরিবেশে আছে। পম্পি এই বাড়িতে আগে কাজ করত। এ বাড়ির ব্যাটাছেলের সঙ্গে লটরপটর করত বলে ওকে তাড়ানাে হয়েছে। তা সত্ত্বেও এই হারামজাদি ঘরে আসত। বাড়ির ব্যাটাছেলেটাকে ‘তুক’ করেছিল। ছেলে ভালাে ইস্কুলে পড়ে, দূরে। বাড়ির গিন্নিই নিয়ে যায়। কখনও ওখানে থেকে ছুটি হলে নিয়ে আসে। কখনও কাছেই বােনের ফ্ল্যাটে চলে যায়। এইকে মেয়েটা ঢােকে। সন্দেহ হয়েছে, কিন্তু হাতেনাতে ধরতে পারেনি। এখন স্কুল ছুটি, ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিল। থাকবার জিনিসপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে স্বামীকে বলেছিল, আজ থাকবে, সাবধানে থেকো, রাত্তিরের রান্নাবান্না ফ্রিজে রইল। হঠাৎ দুপুরে চলে এসেছে। বাইরে থেকে তালাবন্ধ ছিল, ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে খুলেছে। এবং হাতেনাতে ধরেছে। ভদ্রমহিলা রাগ সামলাতে না পেরে বাঁশের লম্বা ফুলদানিটা দিয়ে বেদম পিটিয়েছে। তারপর ফ্ল্যাটের অন্য বউরাও মেরেছে। একটু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, এখন ভালাে আছে।।
 
সবিতা, জিজ্ঞাসা করল ব্যাটাছেলেটা কোথায় ?
 
ও তাে পালিয়েছে। সে সব পরে ওর সঙ্গে বুঝে নেব। একে আপনারা সামলান।
 
একজন মাঝবয়সী পুরুষ মানুষ বলল- আমিই এই ফ্ল্যাটের সেক্রেটারি। পুলিশে খবর দেয়া হয়নি, কারণ ফ্ল্যাটের একটা প্রেস্টিজ আছে তাে। মেয়েটার যে এরকম চরিত্র খারাপ, আপনারা আগে বােঝেননি কিছু?
 
বিজন ভাবে এবার ওর আর চুপচাপ থাকা উচিত নয়। ও বলে– আমরা কী করে বুঝব? ও তাে আমাদের বাড়িতে ঘর মােছা বাসন মাজার কাজ করত। আমাদের কাকা-কাকি বলত, ব্যস। আমাদের বলছেন কেন? সেই মহিলাটি বলল, কাকে বলব তবে? কাউকে তাে বলতে হবে। ফোনের কনট্যাক্টে গিয়ে এতে প্রথমেই অলােক রায় এল। টিপলাম, ফোন ধরেই লােকটা বলল, কী খবর ডার্লিং…কী বলব। এ বহুত ব্যাটাছেলেকে নষ্ট করেছে। দেখলে বােঝা যায়। কত বড় আস্পদ্দা, আমার ছেলের আনকমন নামে নিজের ছেলের নাম দিয়েছে…।
 
বাড়ির সেক্রেটারি বলল, মেয়েটা চরে খায়। দেখবেন ওর ব্যাগে কী সব, উকি মারুন একবার…।।
 
বিজন দেখল চৌকো পাউচ কয়েকটা, যেটা একদিন ওর ব্যাগ থেকে পড়ে গিয়েছিল, তাড়াতাড়ি তুলে রেখেছিল, যা শ্যাম্পুর পাউচ ভেবেছিল বিজন…।
 
— দেখলেন?
 
বিজন নিজেকে অপরাধমুক্ত করার চেষ্টায় বলল, ছিঃ।… আমিও রাখব না ওকে।
 
বাড়ির সেক্রেটারি বলল- ওকে নিয়ে এখন কী করব বলুন। ওর বাড়ি তাে চিনি না আমরা। রাস্তায় ফেলে দেয়া যায় না তাে…। এখানে থাকলে আবার কেউ হয়তাে এর গায়ে হাত চালিয়ে দেবে…।
 
সবিতা বলল- হাত চালালেই হল? ও যা করেছে ওর একার ইচ্ছেতে হয়নি। ওকে মারতে পারেন না আপনারা। এই বাড়ির পুরুষ মানুষটির দোষ আরও বেশি। যাক গে, আমিই নিয়ে যাচ্ছি ওকে। এখানে রাখা যাবে না।
 
বিজন দেখছে সবিতা কীরকম নড়ে উঠছে, আবার বেঁচে উঠছে, ওর চিবুক, চোখ, হাত সব কিছুই কীরকম ফুল ব্যাটারি।
 
সবিতা বলল- একটা টোটো গাড়ি দেখাে তাে…।
 
রাস্তার বড়াে স্টেশনারি দোকানের সামনে টোটো থামিয়ে একটা জাইলােফোন কিনল সবিতা।
 
বিজন বলল, বাচ্চাটাকে জাইলােফোন দিচ্ছ দাও, কিন্তু পম্পিকে বাড়িতে ঢােকাচ্ছ কেন?
 
সবিতা বলল, ক’টা দিন বাঁচতে পারি তাে আবার।
 
বিজন বলল, কিন্তু মেয়েটা তাে ইয়ে…।
 
সবিতা বলল, তুমি কি কম ইয়ে? কিংবা আমি? শরীর বেচে তাে? কিন্তু শরীরই তাে বেচে।
 
আত্মা তাে নয়। সত্তা তাে নয়…
 
এখন বিছানায় শুয়ে আছে পম্পি। ওর ছেলের আঙুলে বাজছে ডিং ডং। ডিডল ডিডল ডাম্পলিং।
 
আর সবিতার শরীরের হাড়পাঁজরার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে ধাতব ডিং ডং-এর অলৌকিক বাজনা।

One thought on “গল্প: বাজনা বাজে । স্বপ্নময় চক্রবর্তী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত