সিয়েরা লিওনের হৃদয়ে বাংলাদেশ

Reading Time: 3 minutes

সিয়েরা লিওন পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ। আয়তন ৭১ হাজার ৭৪০ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা প্রায় ৬০
লাখ। সিয়েরা লিওনে বাস করে ১৬টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, যাদের সবার নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি আছে। সাধারণভাবে অধিকাংশ মানুষ নিজেদের মধ্যে ইংরেজীর সঙ্গে স্থানীয় ভাষাগুলোর সম্মিলনে সৃষ্ট ক্রিও নামের একটি শংকর ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করে থাকে। সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি।

১৯৬১ সালে সিয়েরা লিওন স্বাধীনতা পায়। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর দুর্নীতি, অপশাসন,অযোগ্যতার কারণে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো সিয়েরা লিওনের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয়। বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ সিয়েরা লিওনে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যোগ দেয়। বাংলাদেশ থেকে ৭৭৫ জনসেনার প্রথম দলটি সিয়েরা লিওনের দক্ষিণ অঞ্চলে লুঙ্গি নামক স্থানে দায়িত্ব নেয়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকে আরও সেনা সিয়েরা লিওন যান এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন।

একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রায় ৫ হাজার ৩০০ জন সেনা একত্রে সিয়েরা লিওনে কর্মরত ছিলেন।শান্তি প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ দল ২০০৫ সালে ফিরে আসে। সর্বমোট প্রায় ১২হাজার সেনা সিয়েরা লিওনে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ সেনাদল তাদের নিয়মিত সামরিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার জন্য বিবদমান বিভিন্ন জাতির মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। যোগাযোগের মাধ্যমে হিসেবে সাধারণ সেনারা ইংরেজী ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাও ব্যবহার করতে থাকেন। বাংলা ভাষা স্থানীয় লোকজনের অপরিচিত হওয়ায় বাঙালি সেনারা তাদের ধৈর্যের সঙ্গে তা শেখাতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করে খুব আগ্রহের সঙ্গে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে তারা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হতে থাকে।

 

২০০২ সালে আমাদের ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়, ঠিক ওই বছরই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ সিয়েরা লিওন বাংলা ভাষাকে তাদের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়।

লক্ষ করা যায়, ২০০২ সালের মধ্যে যেখানেই বাংলাদেশি সেনাদল আছে, সেখানেই স্থানীয়রা বিশেষত তরুণ-
তরুণীরা বাংলায় কথা বলতে পারছে। বিভিন্ন সভায় স্থানীয়রা বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয়দের বাঙালি নাচ ও গান পরিবেশন করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ সেনাদলের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষা জনপ্রিয়তা পায়। স্থানীয়রা কাজ চালানোর
মতো বাংলা ভাষা শিখে নেওয়ার ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশ পুনর্গঠনে বাংলাদেশ সেনাদল অন্যদের
চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়।

সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ৩১টি দেশের সেনাদল কর্মরত ছিল। প্রায় প্রতিটি দেশের সেনাদল যুদ্ধরতবিভিন্ন বিদ্রোহী দলের আক্রমণের মুখোমুখি হলেও বাংলাদেশ সেনাদল এ বিষয়ে ছিল ব্যতিক্রম; কারণ, বাংলাদেশি সেনাদল তাদের দায়িত্বের প্রতি সব সময় নিষ্ঠাবান ছিল, উপরন্তু সাধারণ মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করত। ফলে বাংলাদেশি সেনাদের বাংলা ভাষাকে স্থানীয়দের মধ্যে প্রচারের উদ্যোগটি সহজেই সফলতা পায়। শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশ গঠনে বাংলাদেশি সেনাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট আহমদ তেজান কাববা বাংলা ভাষাকে সিয়েরা লিওনের অন্যতম সরকারিভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েকটি রাজ্য ব্যতীত আর কোথাও বাংলা ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে এই প্রথম স্বীকৃতি পায়। প্রেসিডেন্ট কাববা বাংলাদেশ সেনাদলের নির্মিত ৫৪ কিলোমিটার সড়ক উদ্বোধন কালে এই ঘোষণা দেন।

বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি ওলুয়েমি আদেনজি, জাতিসংঘ বাহিনীর কমান্ডার লে.জেনারেল ড্যানিয়েল ইসমায়েল ওপান্ডেসহ আরও অনেকে। বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট
কাববা ২০০৩ সালের ২১ অক্টোবর তিন দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে আসেন। সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা ঘোষণা দেওয়ায় বাংলা ভাষা একটি ভিন্ন মাত্রা পাওয়ার সম্ভবাবনা দেখা দেয়, যদিও তা কাজে লাগানো হয়নি। সিয়েরা লিওন এগিয়ে এলেও আমাদের তরফ থেকে বাংলা ভাষার প্রচার- প্রসারে সিয়েরা লিওনেরসঙ্গে যে পরিমাণ সাংস্কৃতিক বিনিময় হওয়া প্রয়োজন ছিল তা হয়নি, তবে সময়
এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

কিছু জানা অজানা তথ্য:

  • সিয়েরা লিওনের সাংবিধানিক নাম সিয়েরা লিওন প্রজাতন্ত্র।
  • সিয়েরা লিওনের উত্তর সীমান্তে গিনি, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে লাইবেরিয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের দিকে আটলান্টিক মহাসাগর অবস্থিত।
  • সিয়েরা লিওনের বৃক্ষহীন তৃণভূমি অঞ্চল থেকে রেইনফরেস্ট পর্যন্ত একটি বিচিত্র পরিবেশের গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু বিদ্যমান।
  • সিয়েরা লিওনের মোট আয়তন ৭১,৭৪০ বর্গকিলোমিটার (২৭,৬৯৯ বর্গমাইল) এবং এর মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬ মিলিয়ন ।
  • ফ্রিটাউন সিয়েরা লিওনের রাজধানী, সর্ব বৃহত্তম শহর এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র। বো সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।
  • সিয়েরা লিওন উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল চারটি ভৌগলিক অঞ্চলে বিভক্ত, যেগুলো আবার ১৪টি জেলায় বিভক্ত।
  • সিয়েরা লিওনে প্রায় ১৬টি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে, যাদের প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা ভাষা ও রীতিনীতি। দুটি বৃহত্তম ও সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতিগোষ্ঠী হল তেমনে ও মেন্দে।
  • সিয়েরা লিওন একটি নামমাত্র মুসলিম দেশ, যদিও খ্রিস্টান সংখ্যালঘুরা যথেষ্ট প্রভাবশালী। সাধারণভাবে দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০% মুসলিম, ৩০% আদিবাসী বিশ্বাসী এবং ১০% খ্রিস্টান ধর্মীয়।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>