| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতীর বর্ষবরণ ১৪২৮

বর্ষবরণ সংখ্যা: পনেরজন কবির পনেরটি বাংলা কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট
আফ্রিকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উদ্‌ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে
স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত,

   তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে
        রুদ্র সমুদ্রের বাহু
   প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
     ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা-
বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়
        কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।
        সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি
          সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য,
     চিনছিলে জলস্থল-আকাশের দুর্বোধ সংকেত,
        প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু
     মন্ত্র জাগাচ্ছিল তোমার চেতনাতীত মনে।
          বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে
                 বিরূপের ছদ্মবেশে,
         শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে
আপনাকে উগ্র করে বিভীষিকার প্রচণ্ড মহিমায়
           তাণ্ডবের দুন্দুভিনিনাদে।।
                  হায় ছায়াবৃতা,
              কালো ঘোমটার নীচে
      অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ
             উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
                 এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
                    এল মানুষ-ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
                  সভ্যের বর্বর লোভ
          নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
    তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
       পঙ্কিল হল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,
          দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
               বীভৎস কাদার পিণ্ড
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।
সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়
          মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা
    সকালে সন্ধ্যায়, দয়াময় দেবতার নামে;
         শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;
            কবির সংগীতে বেজে উঠছিল
                 সুন্দরের আরাধনা।।
                   আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে
   প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,
      যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল-
         অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,
                 এসো যুগান্তরের কবি,
           আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
              দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;
              বলো ‘ক্ষমা কর’-
                  হিংস্র প্রলাপের মধ্যে

সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।।

সামান্য একটা সরলরেখার জন্য মাথা খুঁড়ছি
পাচ্ছি না।
পৃথিবীতে কোথাও একটা সরলরেখা নেই।
আকাশ অপরাজিত-নীল কিন্তু গোলাকার,
দিগন্তও চক্রনেমিক্রম।
নদী আঁকাবাঁকা, পাহাড় এবড়ো-খেবড়ো
হ্রদ চ্যাপটা, উপকূল বুকে-হাঁটা সরীসৃপের মতো খাঁজ-কাটা।
কুকুরের লেজ কুণ্ডলী, হরিণের শিং ঝাঁকড়া
গোরুর খুর দ্বিধা, আর গ্রান্ডট্রাংক রোড উধাও কিন্তু এলোমেলো।
সৃষ্টিতে সরলরেখা বোধহয় এখনও জন্মায়নি
যত দাগ, সব হয় ডিম, নয় নারকোল, কলার মোচা
বৃত্ত, উপবৃত্ত ইত্যাদি;
একটাও সোজা নয়।কোন মানুষই সোজা নয়,
তাই বোঝা শক্ত
মাথার ওপর সূর্য— জবাকুসুম—
তিনিও সোজা চলেন না,
উত্তরায়ণ থেকে দক্ষিণায়ন
মাতালের মতো টলছেন
সোজা কিছুই চোখে পড়ছে না।
তোমার চোখের ঈষৎ-ভাষাও
আমার বুকের মধ্যে এসে কেমন যেন বেঁকে যাচ্ছে,
আর আমার সহজ ইচ্ছেটাও তোমার দ্বিধার মধ্যে
কেবলই কৌণিক—সামান্য একটা সরলরেখার জন্য
আমরা বসে আছি।

অদ্ভুত আঁধার এক

জীবনানন্দ দাশ

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহত্ব সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

যৌবন-চাঞ্চল্য
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
ভুটিয়া যুবতি চলে পথ;
আকাশ কালিমামাখা কুয়াশায় দিক ঢাকা।
চারিধারে কেবলই পর্বত;
যুবতী একেলা চলে পথ।
এদিক-ওদিক চায় গুনগুনি গান গায়,
কভু বা চমকি চায় ফিরে;
গতিতে ঝরে আনন্দ উথলে নৃত্যের ছন্দ
আঁকাবাঁকা গিরিপথ ঘিরে।
ভুটিয়া যুবতি চলে পথ।
টসটসে রসে ভরপুর–
আপেলের মত মুখ আপেলের মত বুক
পরিপূর্ণ প্রবল প্রচুর;
যৌবনের রসে ভরপুর।
মেঘ ডাকে কড়-কড় বুঝিবা আসিবে ঝড়,
একটু নাহিকো ডর তাতে;
উঘারি বুকের বাস, পুরায় বিচিত্র আশ
উরস পরশি নিজ হাতে!
অজানা ব্যাথায় সুমধুর–
সেথা বুঝি করে গুরুগুরু!
যুবতি একেলা পথ চলে;
পাশের পলাশ-বনে কেন চায় অকারণে?
আবেশে চরণ দুটি টলে–
পায়ে-পায়ে বাধিয়া উপলে!
আপনার মনে যায় আপনার মনে গায়,
তবু কেন আনপানে টান?
করিতে রসের সৃষ্টি চাই কি দশের দৃষ্টি?
–স্বরূপ জানেন ভগবান!
সহজে নাচিয়া যেবা চলে
একাকিনী ঘন বনতলে–
জানি নাকো তারো কী ব্যাথায়
আঁখিজলে কাজল ভিজায়!

নতুন বছরের সকাল
ভূমেন্দ্র গুহনতুন বছরের সকালবেলাটা আর তেমন নরম নেই এখন, পেকে উঠছে ধীরে |
খাবার-টেবিলে বসেছি যখন, খাবার মুখের কাছে উঠেছে যখন, প্রায় তখনই
ঝড় উঠল বাইরে, জানালার ঠিক বহির্মুখে, দরজায় |
আমাদের হতদরিদ্র মলিন গ্রামটিতে, যা কিনা আমাদের অতিযাপিত
অভ্যাসগুলির মতো একটেরে ও খোঁড়া |হঠাৎ—-নিদারুণ —বাজ পড়ল কাছে ; পাতা উড়ল ধারালো তীরের মতো ক্ষিপ্র ;
জল পড়ল জ্বলন্ত ফোস্কার মতো গোল পাতলা, দিনগত পাপক্ষয়ে আমার যে-বউটি—
তার খসখসে চামড়ায়, উঠোনে খেলে বেড়ানো আমার যে বেরিবেরি-হওয়া ছেলেটি
হাবাগোবা রুগ্ ণ ধুলোমাখা – এক্কেবারে তার খড়িওঠা ক্ষীণ শরীরটির উপরে ;
ঝড় জল বাজ ঘূর্ণি ছেলেটিকে শোলার মতো প্রায় রাস্তার শিখার উপরে উড়িয়ে নিল,
সমন ধরিয়ে দিল হাঘরে, খুন ক’রে ফেলবে,. ঠিক খুন ক’রে ফেলবে, এ-রকম ভাবে
ডেকে নিতে গেল তাকে বধ্যভূমিতে—-বিদ্যুতের ঝকঝকে খাঁড়া লাফাতে লাগল, দেখলুম ;
ফেটে যেতে লাগল আগুনের গোলাগুলি, দেখলুম ;
আরও আমি দেখলুম, ছেলেটি অসাড় অশক্ত প’ড়ে থাকল ব’লে সে
আগুনের ভিতরের নীল শাঁসের মতো একটি উজ্জ্বল ছবি হয়ে উঠতে লাগল চুপিসারে |

এবং আমাদের অস্তিত্বের একগুঁয়ে সব কাঠামোগুলি তখন
ভেঙে পড়তে লাগল, গড়িয়ে যেতে লাগল উড্ডীন দেয়ালের গুহাচিত্রে, বাইরে |
রঞ্জনরশ্মিসিদ্ধ একটি আলোকচিত্র গড়ে উঠল— হাড় মাস রক্ত
একটি নিটোল অবশিষ্ট ছায়া মাত্র তখন—- হাড় মাস রক্ত ও হৃৎপিণ্ড
তার বেশি সে-সব আর কিছু মাত্র নয় |

মূলত বিভিন্ন কিন্তু সমষ্টিভাষিত একটির পর একটি অনস্তিত্বে চেহারা
তারপর প্রতিভাত হতে দেখতে লাগলুম আমি : ধুলোমোড়া তবু ভিজে গ্রামের সেই রাস্তাটি,
সিঁড়িঘরের নিচের কাতর বেড়ালছানাগুলি, চড়ুই পাখিগুলি জলে-ভেজা ঘুলঘুলিতে,
দারাপুত্রপরিবার — এবং আমি— কপালের বিলীয়মান দইয়ের ফোঁটার মতো সেই
স্বাতন্ত্র্য বা নিজস্বতা, যা এই মুহূর্তে ঝড়েজলে দাপাতে-থাকা প্রাচীন বটগাছের
শিকড়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে আগাগোড়া, উড়ে যাচ্ছে তারপর কৃষ্ণচূড়ার থেকে দূরে মেঘে
তারপর নেমে আসছে আবার দীর্ঘ শরবনের বিস্ফারিত ফলকগুলিতে—-

সময়ের দীন বালুকণাগুলি এখন বিশ্লিষ্ট হচ্ছে, হয়ে গিয়ে স্বচ্ছ ঘাসের মতো হচ্ছে সব |
নিজেরাই হয়ে উঠছে, কী হয়ে উঠতে পারে স্বাবলম্বে নিজেরাই ঠিক ক’রে নিচ্ছে তারা |
এবং সব উজ্জ্বলতা ও অহঙ্কার, স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য, যা উপার্জিত হয়েছে আমার
সব খোঁড়া হয়ে যাচ্ছে—- জাদুকরের অবিনশ্বর সেই হাড়ের লাঠিটি ন’ড়ে উঠছে ব’লে,
গ’লে যাচ্ছে সব শরীর, একাকার হয়ে যাচ্ছে সব অকাল-অন্ধকারে
.           এখন শুধু নিস্তব্ধতা, অনিশ্চয়তা ও অনির্ণয়
.           ছেলেটির অমৃত অসাড় বিবর্ণ ইচ্ছাগুলির মতো যেন
.           এখন সব স্বচ্ছ ও স্ফুরিত ও বর্ণহীন |

আমার পরিচয়
সৈয়দ শামসুল হক
আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।
এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।

শান্তিহীন: একটি –

ভাস্কর চক্রবর্তী

বিরক্তিভরা দিনগুলাে আমি আজ উপহার পাঠাচ্ছি তােমাকে।
দুঃস্বপ্নের শতসহস্র রাত
আমার ভাঙা চশমাগুলাে-রাত্রিবেলায় জলে-ভেজা ভৌতিক ঘড়ির শব্দ-
সমস্ত কিছুই, ফুলের তােড়ার মতাে,
আমি আজ তুলে দিতে চাইছি তােমার হাতে।
আমি দশ-পয়সা ফেলে দিয়েছি যন্ত্রে আর জেনে নিয়েছি আমার ভাগ্য
আমি সারারাত দরজা থেকে দরজায় বিছানা খুঁজে ফিরেছি—
স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমার হাত ছুটে চলেছে তােমার মুখের দিকে
স্বপ্নে দেখেছিলাম, গানে-গানে ঢেকে গ্যাছে আমার সারা শরীর
আজকাল শুধুই সাদা দিনগুলাের কথা মনে পড়ছে আমার
আজকাল সারাদিনই ডাক-পিওনের পেছন-পেছন আমি ঘুরছি
—আমার চিঠি কোথায় ?

গভীর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন আমি জিগ্যেস করি— ‘তুমি কে?
সারাজীবন আমার কোনাে কাজ ছিলাে না
কোথাও কোনােদিন হাতছানি ছিলাে না কোনো।
আমি টেবিল থেকে শুধুই মানুষের ফেলে যাওয়া দেশলাই জড়াে করেছি
গঙ্গার মাটি দিয়ে সারিয়েছি উনুন
লিফটে চেপে, আমি দুঃখ-কে নিয়ে সটান ঢুকে পড়েছি দশতলার ফ্ল্যাটে।
—এটা কি সত্যি যে আমি মরতে চাই
এটা কি সত্যি যে আমি মরতেই চই
বেঁচে-থাকার জন্যে, তুমি বলাে, আমি কি পাশ ফিরে শুইনি বিছানায় ?

কেউ কথা রাখেনি
 সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।
মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?
একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী।
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!

 চৈত্রে রচিত কবিতা

উৎপল কুমার বসু

নিঃসঙ্গ দাঁড়ের শব্দে চলে যায় তিনটি তরণী।

শিরিষের রাজ্য ছিল কূলে কূলে অপ্রতিহত যেদিন অস্ফুট শব্দে তারা যাবে দূর লোকালয়ে আমি পাবো অনুপম, জনহীন, উর্বর মৃত্তিকা

তখন অদেখা ঋতু বলে দেবে এই সংসার দুঃখ বয় কৃষকের। যদিও সফল প্রতিটি মানুষ জানে তন্দ্রাহীনতায় কেন বা এসেছো সব নিষ্ফলতা, কবিতা তুমিও,

নাহয় দীর্ঘ দিন কেটেছিল তোমার অপ্রেমে—

তবুও ফোটে না ফুল। বুঝি সূর্য যথেষ্ট উজ্জ্বল নয়। বুঝি চিরজাগরূক আকাশশিখরে আমি ধাতুফলকের শব্দ শুনে—- সূর্যের ঘড়ির দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি

এখনি বিমুক্ত হবে মেঘে মেঘে বসন্ত-আলোর নির্ভার কৃপাকণা। সমস্তই ঝরেছিল — ঝরে যাবে— যদি না আমার যদি না আমার মৃত্যু ফুটে থাকা অসংখ্য কাঁটায়।

আসলে মৃত্যুও নয় প্রাকৃতিক, দৈব অনুরোধ। যাদের সঙ্কেতে আমি যথাযথ সব কাজ ফেলে যাবো দূর শূন্যপথে— তারা কেমন বান্ধব বলো কোন্ ঘড়ি? কোন্ সূর্যরথ?

হয়ত প্রকৃত ঐ নগ্ন জলধারা— যখন দুপুর কাঁপে গ্রীষ্মের নতুন সাবানে। ওদের দেবতা বলে আমি মানি। ওদের ঘড়ির সমস্ত খঞ্জনপাখা লক্ষবার শোনায় অস্ফুটে— আমার বন্ধু কি তুমি? আমি কি তোমার?

কেন যে এখনো নই প্রাকৃতিক দুঃখজটাজাল? আমার নিয়তি তুমি ঈর্যা করো—- আমার স্মরণে যাও দূর তীর্থপথে, ভুল পথে — রক্তিম কাঁটায় নিজেকে বিক্ষত করো | রোমিও — রোমিও —

কেন শূন্যে মেঘলীন কম্পিত চাদর উড়ে গেলে—- অনির্বাণ, স্থির নাটকের যারা ছিল চারিত্রিক, নেপথ্যে কুশল, প্রেম চেয়েছিল, দুঃখ, তারা একে একে অম্লান ঝরে যায়?

তবে কি আমিও নই তেমন প্রেমিকা?

বহুদিন ছুঁয়ে যায় বর্তুল, বিস্মৃত পৃথিবী লাটিম সূর্যের তাপে নানা দেশ—বিপুল শূন্যতা— সে যেন বিচিত্র আলো দিয়েছিল আমার ঘরের গবাক্ষবিহীন কোনো অন্ধকারে— একদিন —শুধু একদিন।

তখন, প্রবল মুহূর্তে আমি জেনেছি অনেক— সমুদ্র কেমন হয়। কাকে বলে দুর্নিরীক্ষ্য তরু। আমি কেন রুগ্ন হই | তুমি দূর স্খলিত তারার কেন বা সমাধি গড়ো বনে বনে।

অথচ আঁধারে ফিরি আমি ক্লান্ত প্রদর্শক আলো, যারা আসে সহচর রক্ত-লাল, গমের সবুজ, তারা কেউ ধূর্ত নয়—দয়াশীল, বিনীত ভাষায় বলে, ‘তুমি ভুলে যাও সমস্ত জ্ঞানের ভার— সমস্ত অক্ষর।’

এখনি বৃষ্টির পর আমি পাবো জ্যোত্স্না-ভালোবাসা। কেননা মেনেছি আমি শোকাকুল তুমিও বন্দিনী অজেয় শকটে তার। কোনো কোনো রথ একা যায় ভ্রান্ত পথে— অন্ধকারে —চালকবিহীন—

যেখানে সুদীর্ঘ রাত ওড়ে নীল গন্ধের রুমালে যেখানে জলের মতো পরিসর, অফুরন্ত বায়ু ধুয়ে দেয় বনস্থলী, বালুতট—-দীর্ণ হাহাকার

তুলেছিলে শূন্যতায় পাহাড়ের উর্বর মৃত্তিকা, তুমি দুঃখ, তুমি প্রেম, শোনেনি সতর্কবাণী। যেন স্রোত সহসা পাথরে রুদ্ধ হল। এবং স্খলিত বহু রথ, পদাতিক দেখে আমি মেনেছি এখন

প্রতিটি বৃষ্টির পর ছিন্ন হও তুমি, ভালোবাসা।

পৃথিবীর সব তরু প্রতিচ্ছায়া খুলে দেয় বসন্তের দিনে। যখনি তোমাকে ডাকে ‘এসো এসো বিদেহ কলুষ’, কেন যে লুন্ঠিত, নীল পরিধান খুলে তুমি বালিকার স্পষ্টতায় কাঁদো— বসন্তই জানে।

তবুও আমার স্বপ্ন দুপুরের —-ঘুমন্ত রাতের — প্রবল নদীর জলে ধরে রাখে নীল যবনিকা— সে তোমার পরিচ্ছদ, অন্তরাল, হয়ত বা যেটুকু রহস্য আমি ভালোবাসি বালিকা কিশোর শরীরে —

এখন বিনিদ্র রাতে পুড়ে যায় সব মোমবাতি! এবং অলেখা গান নিষ্ফলতা বয়েছিল কত দীর্ঘ দিন সে নয় প্রেমের দুঃখ ? তবু সতর্কতা ভেঙে ফেলে সুন্দরের প্রিয় পুষ্পাধার বলেছিল, ‘এই প্রেম অন্তিমের, সমস্ত ফুলের’

 যেন দূর অদেখা বিদ্যুতে তুমি পুড়ে যাও তুমি সুন্দর নিয়তি যেন জল, ঝোড়ো রাতে জ্বলে একা বজ্রাহত তরু তুমি সুন্দর নিয়তি মৃতেরা নিষ্পাপ থাকে। কারো নামে অচ্ছোদসরসী— তুমি বিরূপ নিয়তি রাখো দূর মেঘপটে যত ক্রোধ, অকাম কামনা তুমি সুন্দর নিয়তি ফিরে দাও দীর্ঘ ঝড় মদিরায় প্রাচীন কুঞ্জের তুমি সুন্দর নিয়তি।

মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়
জয় গোস্বামী
বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো
বেণীমাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?
বেণীমাধব, মোহনবাঁশি তমাল তরুমূলে
বাজিয়েছিলে, আমি তখন মালতী ইস্কুলে
ডেস্কে বসে অঙ্ক করি, ছোট্ট ক্লাসঘর
বাইরে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি
আলাপ হলো, বেণীমাধব, সুলেখাদের বাড়ি
বেণীমাধব, বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো
শহর থেকে বেড়াতে এলে, আমার রঙ কালো
তোমায় দেখে এক দৌড়ে পালিয়ে গেছি ঘরে
বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে
কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জরী
সন্ধেবেলা পড়তে বসে অঙ্কে ভুল করি
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন ষোল
ব্রীজের ধারে, বেণীমাধব, লুকিয়ে দেখা হলো
বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতদিনের পরে
সত্যি বলো, সে সব কথা এখনো মনে পড়ে?
সে সব কথা বলেছো তুমি তোমার প্রেমিকাকে?
আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো!
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চেখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।
রাতে এখন ঘুমাতে যাই একতলার ঘরে
মেঝের উপর বিছানা পাতা, জ্যো‍‍‌ৎস্না এসে পড়ে
আমার পরে যে বোন ছিলো চোরাপথের বাঁকে
মিলিয়ে গেছে, জানি না আজ কার সঙ্গে থাকে
আজ জুটেছে, কাল কী হবে? – কালের ঘরে শনি
আমি এখন এই পাড়ায় সেলাই দিদিমণি
তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?
কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?

ঠোটের রং টেরাকোটা 

পিনাকী ঠাকুর

তােমার রত্নগুহার ম্যাপ এখনও খুঁজে পাইনি
এদিকে শ্যাওলা জমে যাচ্ছে আমার শরীরে !রাতের পর রাত ঘুরে বেড়িয়েছি মৃত শহরের রাস্তায়
খেলতে গিয়ে মরতে বসেছি চিনেপাড়ারঝাপসা গলিতে
দোকান থেকে পার্ক স্ট্রিটের কবর
লালদিঘির পাশে আলেয়া দুর্গের ধ্বংসাবশেষ
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হিস্ট্রি চ্যানেল…
আমার চোখে শ্যাওলা জমে যাচ্ছে, পিছনে ছুটছেইতিহাসের অশরীরী আতঙ্কচোরা লণ্ঠন, শাবল, গাঁইতি, কম্পাস আর নােটবুকে

আমার রুকস্যাক ভারী হয়ে উঠেছে
আজ সন্ধ্যার হঠাৎ আবছায়ায় তােমার ঠোঁটের

টেরাকোটা-রং দেখে আমি বুঝতে পারলাম
তােমার রত্নগুহার কোনও ম্যাপ নেই, ছিলও না, কেবল

সংকেত ওই টেরাকোটা
হাজার হাজার মন্দিরের মধ্যে কোথায় সেই রত্নগুহা

যাকে পাহারা দেয় এক ভয়ংকর সাপ
মন্দিরের চূড়ায় গাছ গজিয়ে গিয়ে ফাটল ধরেছে
সেই রত্নগুহার মধ্যে দিয়েই বয়ে যাচ্ছে অন্ধকার নদী

যার বালিতে সােনার গুঁড়াে…

আজ রাস্তার পাগল কামড়ে দিচ্ছে তােমার ঠোঁটের

টেরাকোটা
মনেই কামড়ে দিয়ে ম্যাপ খুঁজছে আবার

তুমি বুঝতে পারছ যদি, চিৎকার করছ না কেন?

ছাড়পত্র
সুকান্ত ভট্টাচার্য
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।।

অন্ধ মেয়ে
 সুকুমার রায়
গভীর কালো মেঘের পরে রঙিন ধনু বাঁকা,
রঙের তুলি বুলিয়ে মেঘে খিলান যেন আঁকা!
সবুজ ঘাসে রোদের পাশে আলোর কেরামতি
রঙিন্ বেশে রঙিন্ ফুলে রঙিন্ প্রজাপতি!
অন্ধ মেয়ে দেখছে না তা – নাইবা যদি দেখে-
শীতল মিঠা বাদল হাওয়া যায় যে তারে ডেকে!
শুনছে সে যে পাখির ডাকে হরয কোলাকুলি
মিষ্ট ঘাসের গন্ধে তারও প্রাণ গিয়েছে ভুলি!
দুঃখ সুখের ছন্দে ভরা জগৎ তারও আছে,
তারও আঁধার জগৎখানি মধুর তারি কাছে।।

অবনী বাড়ি আছো
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
অবনী বাড়ি আছো
অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’
আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছ?’

তোমার ক্ষমায় স্নাত 

অমিতাভ দাশগুপ্ত

 মেঘের খোঁপায় ফুটেছে আলাের ফুল,
তােমাকে কি দেব অনন্য উপহার ?
কোন ঘাটে পার
হ’তে চেয়েছিলে খুঁজে অনুকুল হাওয়া,
নাবিক বাছাে নি, এ-নৌকো বেয়ে যায় কি সুদূরে যাওয়া
ভাবাে নি, নরম অঞ্জলি মেলে ফুল
ভাসালে জোয়ারে রাজহাঁস বলে – সব ভুল, সব ভুল!

কেবল কথায় বহে গেল বেলা
জল ঝরে গেল মেঘে,
বুকের গভীরে কি শঙ্কা ছিল জেগে
বলে নি বাচাল মুখ,
কথার সাঁকোয় হৃদয়ের আসা-যাওয়া
হয় নি, সমুসুক
অধীরতা প্রাণে এসে ফিরে গেছে পাহাড়তলির হাওয়া।

এখন জেনেছাে, নীরবতা কত ভালাে,
ক্ষীণ সম্বল নিবিড় আঁচলে ঢেকে দিলে, অনুপমা,
বুঝেছ, আমার সকলই চাতুরি, ছল-
জলপ্রপাতে ধাবিত তােমার চোখের তরল ক্ষমা।

রঞ্জিনীকে লেখা আমার চিঠি
শ্রীজাত
রঞ্জু সােনা,
তােমার ই-মেল পড়ি না আর। এই অসীমে
হপ্তাপিছু দশ টাকা যায় ট্যাঁক থেকে

ইংলিশ বাদ। বাংলা চালু। শহরে সব রাস্তা চালু
গড়াই, আবার ফিরেও আসি এক ঠেকে।আকাশ ভরা সূর্য তারা, হাওয়ার তখন কী আস্কারা
বুঝিনি, তাও এগিয়ে গেছি চোখ বুজে
ঠেকতে ঠেকতে এখন জানি, দুধ কা দুধ-পানি কা পানি
জীবনে সব স্টেপ নিতে হয় লােক বুঝে।
যে কোন চুলােয় ঘাপটি মেরে কার কফিনে ঠুকছে পেরেক
কে কার ঘাড়ে নল রেখেছে বন্দুকের….
তবু তাে প্রেম সর্বনাশী, পুজোর চাঁদা তুলতে আসি
সাহস পেতে সঙ্গে রাখি বন্ধুকে।অসীম কালের যে-হিল্লোলে তােমার বাবা দরজা খােলে
দেখেই আমার প্রাণ উবে যায়, রঞ্জিনী
বিকেল করে ঘুরতে বেরােই, স্টিমার চেপে গঙ্গা পেরােই
আমি..তুমি..দাশকেবিন আর মঞ্জিনিস
বেকার ছেলে প্রেম করে আর পদ্য লেখে হাজার হাজার
এমন প্রবাদ হেব্বি প্রাচীন অরণ্যে
কিন্তু তার আড়ালের খবর? জবরদখল? দখলজবর?
হাজারবার মরার আগে মরণ নেই।কান পেতেছি চোখ মেলেছি যা দেখেছি চমকে গেছি
থমকে গেছি পাড়ার মােড়ে রাতদুপুর
ঝাপটাতে ঝাপটাতে ডানা পাখি পায় দৈনিক চারানা
কাপড় কিনলে হয় না মুখের ভাতটুকু।

প্রাতঃকৃত্য করছি বসে, এই সময় কে জমিয়ে কবে
লাথ ঝেড়েছে কাজলকালাে পশ্চাতে
একেই দু-দিন হয় না, শক্ত, তার ওপরে চোটে র রক্ত-
খুব লেগেছে। কিন্তু আমি, বস, তাতে
রাগ করিনি।ক্ষমাই ধর্ম। শঙ্খ ঘােষের ‘কবির ধর্ম’
গায়ে চাপিয়ে ঘুরে মরেছি কলকাতায়
ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছি…হাত-পা দিয়ে ঘুম তাড়াচ্ছি…
বেঁচে ফিরছি, সেটাই তাে আসল কথা।

টাকা খুঁজছি নােংরা হাতে, ঠাণ্ডাঘরে, কারখানাতে
তুমি হতাশ, আমিও শালা বিরক্ত
দেয়াল দেখে খিস্তি করি…কোলবালিশ জড়িয়ে ধরি…

কান্না আসে। এ কোনদেশি বীরত্ব?
বাড়ির লােকের উত্তেজনা-‘কেন কিছু একটা করছ না?”
যেন আজো বেকার আছি শখ করে।
তবু এমন দেশপ্রেম, যে এমপ্লয়মেন্ট -এক্সচেঞ্জে
নাম লিখেছি সােনাবরণ অক্ষরে
তুমি বরং সেটল করাে-গঙ্গারামকে পাত্র ধরাে
ফরেন কাটো। দুঃখ পাব, সামান্যই…
আমায় নিয়ে খেলছে সবাই, সুযােগ পেলেই মুরগি জবাই
তুমি তােমার। আমি তাে আর আমার নই
ঢপের আকাশ, সূর্য, তারা…স্বপ্নগুলাে বাস্তুহারা
এবার থেকে নৌকো বুঝে পাল তুলাে
আজ এটুকুই। সামলে থেকো, আমায় ছাড়াই বাঁচতে শেখােআদর নিও-
ইতি
তোমার
ফালতু লােক
রঞ্জিনীকে লেখা আমার চিঠি কবিতা আবৃত্তি 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত