বর্ষবরণ সংখ্যা: পনেরজন কবির পনেরটি বাংলা কবিতা
উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে
স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত,
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।।
পাচ্ছি না।
পৃথিবীতে কোথাও একটা সরলরেখা নেই।
আকাশ অপরাজিত-নীল কিন্তু গোলাকার,
দিগন্তও চক্রনেমিক্রম।
নদী আঁকাবাঁকা, পাহাড় এবড়ো-খেবড়ো
হ্রদ চ্যাপটা, উপকূল বুকে-হাঁটা সরীসৃপের মতো খাঁজ-কাটা।
কুকুরের লেজ কুণ্ডলী, হরিণের শিং ঝাঁকড়া
গোরুর খুর দ্বিধা, আর গ্রান্ডট্রাংক রোড উধাও কিন্তু এলোমেলো।
সৃষ্টিতে সরলরেখা বোধহয় এখনও জন্মায়নি
যত দাগ, সব হয় ডিম, নয় নারকোল, কলার মোচা
বৃত্ত, উপবৃত্ত ইত্যাদি;
একটাও সোজা নয়।কোন মানুষই সোজা নয়,
তাই বোঝা শক্ত
মাথার ওপর সূর্য— জবাকুসুম—
তিনিও সোজা চলেন না,
উত্তরায়ণ থেকে দক্ষিণায়ন
মাতালের মতো টলছেন
সোজা কিছুই চোখে পড়ছে না।
তোমার চোখের ঈষৎ-ভাষাও
আমার বুকের মধ্যে এসে কেমন যেন বেঁকে যাচ্ছে,
আর আমার সহজ ইচ্ছেটাও তোমার দ্বিধার মধ্যে
কেবলই কৌণিক—সামান্য একটা সরলরেখার জন্য
আমরা বসে আছি।
জীবনানন্দ দাশ
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহত্ব সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
ভূমেন্দ্র গুহনতুন বছরের সকালবেলাটা আর তেমন নরম নেই এখন, পেকে উঠছে ধীরে |
খাবার-টেবিলে বসেছি যখন, খাবার মুখের কাছে উঠেছে যখন, প্রায় তখনই
ঝড় উঠল বাইরে, জানালার ঠিক বহির্মুখে, দরজায় |
আমাদের হতদরিদ্র মলিন গ্রামটিতে, যা কিনা আমাদের অতিযাপিত
অভ্যাসগুলির মতো একটেরে ও খোঁড়া |হঠাৎ—-নিদারুণ —বাজ পড়ল কাছে ; পাতা উড়ল ধারালো তীরের মতো ক্ষিপ্র ;
জল পড়ল জ্বলন্ত ফোস্কার মতো গোল পাতলা, দিনগত পাপক্ষয়ে আমার যে-বউটি—
তার খসখসে চামড়ায়, উঠোনে খেলে বেড়ানো আমার যে বেরিবেরি-হওয়া ছেলেটি
হাবাগোবা রুগ্ ণ ধুলোমাখা – এক্কেবারে তার খড়িওঠা ক্ষীণ শরীরটির উপরে ;
ঝড় জল বাজ ঘূর্ণি ছেলেটিকে শোলার মতো প্রায় রাস্তার শিখার উপরে উড়িয়ে নিল,
সমন ধরিয়ে দিল হাঘরে, খুন ক’রে ফেলবে,. ঠিক খুন ক’রে ফেলবে, এ-রকম ভাবে
ডেকে নিতে গেল তাকে বধ্যভূমিতে—-বিদ্যুতের ঝকঝকে খাঁড়া লাফাতে লাগল, দেখলুম ;
ফেটে যেতে লাগল আগুনের গোলাগুলি, দেখলুম ;
আরও আমি দেখলুম, ছেলেটি অসাড় অশক্ত প’ড়ে থাকল ব’লে সে
আগুনের ভিতরের নীল শাঁসের মতো একটি উজ্জ্বল ছবি হয়ে উঠতে লাগল চুপিসারে |
এবং আমাদের অস্তিত্বের একগুঁয়ে সব কাঠামোগুলি তখন
ভেঙে পড়তে লাগল, গড়িয়ে যেতে লাগল উড্ডীন দেয়ালের গুহাচিত্রে, বাইরে |
রঞ্জনরশ্মিসিদ্ধ একটি আলোকচিত্র গড়ে উঠল— হাড় মাস রক্ত
একটি নিটোল অবশিষ্ট ছায়া মাত্র তখন—- হাড় মাস রক্ত ও হৃৎপিণ্ড
তার বেশি সে-সব আর কিছু মাত্র নয় |
মূলত বিভিন্ন কিন্তু সমষ্টিভাষিত একটির পর একটি অনস্তিত্বে চেহারা
তারপর প্রতিভাত হতে দেখতে লাগলুম আমি : ধুলোমোড়া তবু ভিজে গ্রামের সেই রাস্তাটি,
সিঁড়িঘরের নিচের কাতর বেড়ালছানাগুলি, চড়ুই পাখিগুলি জলে-ভেজা ঘুলঘুলিতে,
দারাপুত্রপরিবার — এবং আমি— কপালের বিলীয়মান দইয়ের ফোঁটার মতো সেই
স্বাতন্ত্র্য বা নিজস্বতা, যা এই মুহূর্তে ঝড়েজলে দাপাতে-থাকা প্রাচীন বটগাছের
শিকড়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে আগাগোড়া, উড়ে যাচ্ছে তারপর কৃষ্ণচূড়ার থেকে দূরে মেঘে
তারপর নেমে আসছে আবার দীর্ঘ শরবনের বিস্ফারিত ফলকগুলিতে—-
সময়ের দীন বালুকণাগুলি এখন বিশ্লিষ্ট হচ্ছে, হয়ে গিয়ে স্বচ্ছ ঘাসের মতো হচ্ছে সব |
নিজেরাই হয়ে উঠছে, কী হয়ে উঠতে পারে স্বাবলম্বে নিজেরাই ঠিক ক’রে নিচ্ছে তারা |
এবং সব উজ্জ্বলতা ও অহঙ্কার, স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য, যা উপার্জিত হয়েছে আমার
সব খোঁড়া হয়ে যাচ্ছে—- জাদুকরের অবিনশ্বর সেই হাড়ের লাঠিটি ন’ড়ে উঠছে ব’লে,
গ’লে যাচ্ছে সব শরীর, একাকার হয়ে যাচ্ছে সব অকাল-অন্ধকারে
. এখন শুধু নিস্তব্ধতা, অনিশ্চয়তা ও অনির্ণয়
. ছেলেটির অমৃত অসাড় বিবর্ণ ইচ্ছাগুলির মতো যেন
. এখন সব স্বচ্ছ ও স্ফুরিত ও বর্ণহীন |
শান্তিহীন: একটি –
ভাস্কর চক্রবর্তী
বিরক্তিভরা দিনগুলাে আমি আজ উপহার পাঠাচ্ছি তােমাকে।
দুঃস্বপ্নের শতসহস্র রাত
আমার ভাঙা চশমাগুলাে-রাত্রিবেলায় জলে-ভেজা ভৌতিক ঘড়ির শব্দ-
সমস্ত কিছুই, ফুলের তােড়ার মতাে,
আমি আজ তুলে দিতে চাইছি তােমার হাতে।
আমি দশ-পয়সা ফেলে দিয়েছি যন্ত্রে আর জেনে নিয়েছি আমার ভাগ্য
আমি সারারাত দরজা থেকে দরজায় বিছানা খুঁজে ফিরেছি—
স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমার হাত ছুটে চলেছে তােমার মুখের দিকে
স্বপ্নে দেখেছিলাম, গানে-গানে ঢেকে গ্যাছে আমার সারা শরীর
আজকাল শুধুই সাদা দিনগুলাের কথা মনে পড়ছে আমার
আজকাল সারাদিনই ডাক-পিওনের পেছন-পেছন আমি ঘুরছি
—আমার চিঠি কোথায় ?
গভীর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন আমি জিগ্যেস করি— ‘তুমি কে?
সারাজীবন আমার কোনাে কাজ ছিলাে না
কোথাও কোনােদিন হাতছানি ছিলাে না কোনো।
আমি টেবিল থেকে শুধুই মানুষের ফেলে যাওয়া দেশলাই জড়াে করেছি
গঙ্গার মাটি দিয়ে সারিয়েছি উনুন
লিফটে চেপে, আমি দুঃখ-কে নিয়ে সটান ঢুকে পড়েছি দশতলার ফ্ল্যাটে।
—এটা কি সত্যি যে আমি মরতে চাই
এটা কি সত্যি যে আমি মরতেই চই
বেঁচে-থাকার জন্যে, তুমি বলাে, আমি কি পাশ ফিরে শুইনি বিছানায় ?
চৈত্রে রচিত কবিতা
উৎপল কুমার বসু
১
নিঃসঙ্গ দাঁড়ের শব্দে চলে যায় তিনটি তরণী।
শিরিষের রাজ্য ছিল কূলে কূলে অপ্রতিহত যেদিন অস্ফুট শব্দে তারা যাবে দূর লোকালয়ে আমি পাবো অনুপম, জনহীন, উর্বর মৃত্তিকা
তখন অদেখা ঋতু বলে দেবে এই সংসার দুঃখ বয় কৃষকের। যদিও সফল প্রতিটি মানুষ জানে তন্দ্রাহীনতায় কেন বা এসেছো সব নিষ্ফলতা, কবিতা তুমিও,
নাহয় দীর্ঘ দিন কেটেছিল তোমার অপ্রেমে—
তবুও ফোটে না ফুল। বুঝি সূর্য যথেষ্ট উজ্জ্বল নয়। বুঝি চিরজাগরূক আকাশশিখরে আমি ধাতুফলকের শব্দ শুনে—- সূর্যের ঘড়ির দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি
এখনি বিমুক্ত হবে মেঘে মেঘে বসন্ত-আলোর নির্ভার কৃপাকণা। সমস্তই ঝরেছিল — ঝরে যাবে— যদি না আমার যদি না আমার মৃত্যু ফুটে থাকা অসংখ্য কাঁটায়।
২
আসলে মৃত্যুও নয় প্রাকৃতিক, দৈব অনুরোধ। যাদের সঙ্কেতে আমি যথাযথ সব কাজ ফেলে যাবো দূর শূন্যপথে— তারা কেমন বান্ধব বলো কোন্ ঘড়ি? কোন্ সূর্যরথ?
হয়ত প্রকৃত ঐ নগ্ন জলধারা— যখন দুপুর কাঁপে গ্রীষ্মের নতুন সাবানে। ওদের দেবতা বলে আমি মানি। ওদের ঘড়ির সমস্ত খঞ্জনপাখা লক্ষবার শোনায় অস্ফুটে— আমার বন্ধু কি তুমি? আমি কি তোমার?
কেন যে এখনো নই প্রাকৃতিক দুঃখজটাজাল? আমার নিয়তি তুমি ঈর্যা করো—- আমার স্মরণে যাও দূর তীর্থপথে, ভুল পথে — রক্তিম কাঁটায় নিজেকে বিক্ষত করো | রোমিও — রোমিও —
কেন শূন্যে মেঘলীন কম্পিত চাদর উড়ে গেলে—- অনির্বাণ, স্থির নাটকের যারা ছিল চারিত্রিক, নেপথ্যে কুশল, প্রেম চেয়েছিল, দুঃখ, তারা একে একে অম্লান ঝরে যায়?
তবে কি আমিও নই তেমন প্রেমিকা?
৩
বহুদিন ছুঁয়ে যায় বর্তুল, বিস্মৃত পৃথিবী লাটিম সূর্যের তাপে নানা দেশ—বিপুল শূন্যতা— সে যেন বিচিত্র আলো দিয়েছিল আমার ঘরের গবাক্ষবিহীন কোনো অন্ধকারে— একদিন —শুধু একদিন।
তখন, প্রবল মুহূর্তে আমি জেনেছি অনেক— সমুদ্র কেমন হয়। কাকে বলে দুর্নিরীক্ষ্য তরু। আমি কেন রুগ্ন হই | তুমি দূর স্খলিত তারার কেন বা সমাধি গড়ো বনে বনে।
অথচ আঁধারে ফিরি আমি ক্লান্ত প্রদর্শক আলো, যারা আসে সহচর রক্ত-লাল, গমের সবুজ, তারা কেউ ধূর্ত নয়—দয়াশীল, বিনীত ভাষায় বলে, ‘তুমি ভুলে যাও সমস্ত জ্ঞানের ভার— সমস্ত অক্ষর।’
৪
এখনি বৃষ্টির পর আমি পাবো জ্যোত্স্না-ভালোবাসা। কেননা মেনেছি আমি শোকাকুল তুমিও বন্দিনী অজেয় শকটে তার। কোনো কোনো রথ একা যায় ভ্রান্ত পথে— অন্ধকারে —চালকবিহীন—
যেখানে সুদীর্ঘ রাত ওড়ে নীল গন্ধের রুমালে যেখানে জলের মতো পরিসর, অফুরন্ত বায়ু ধুয়ে দেয় বনস্থলী, বালুতট—-দীর্ণ হাহাকার
তুলেছিলে শূন্যতায় পাহাড়ের উর্বর মৃত্তিকা, তুমি দুঃখ, তুমি প্রেম, শোনেনি সতর্কবাণী। যেন স্রোত সহসা পাথরে রুদ্ধ হল। এবং স্খলিত বহু রথ, পদাতিক দেখে আমি মেনেছি এখন
প্রতিটি বৃষ্টির পর ছিন্ন হও তুমি, ভালোবাসা।
৫
পৃথিবীর সব তরু প্রতিচ্ছায়া খুলে দেয় বসন্তের দিনে। যখনি তোমাকে ডাকে ‘এসো এসো বিদেহ কলুষ’, কেন যে লুন্ঠিত, নীল পরিধান খুলে তুমি বালিকার স্পষ্টতায় কাঁদো— বসন্তই জানে।
তবুও আমার স্বপ্ন দুপুরের —-ঘুমন্ত রাতের — প্রবল নদীর জলে ধরে রাখে নীল যবনিকা— সে তোমার পরিচ্ছদ, অন্তরাল, হয়ত বা যেটুকু রহস্য আমি ভালোবাসি বালিকা কিশোর শরীরে —
এখন বিনিদ্র রাতে পুড়ে যায় সব মোমবাতি! এবং অলেখা গান নিষ্ফলতা বয়েছিল কত দীর্ঘ দিন সে নয় প্রেমের দুঃখ ? তবু সতর্কতা ভেঙে ফেলে সুন্দরের প্রিয় পুষ্পাধার বলেছিল, ‘এই প্রেম অন্তিমের, সমস্ত ফুলের’
৬ যেন দূর অদেখা বিদ্যুতে তুমি পুড়ে যাও তুমি সুন্দর নিয়তি যেন জল, ঝোড়ো রাতে জ্বলে একা বজ্রাহত তরু তুমি সুন্দর নিয়তি মৃতেরা নিষ্পাপ থাকে। কারো নামে অচ্ছোদসরসী— তুমি বিরূপ নিয়তি রাখো দূর মেঘপটে যত ক্রোধ, অকাম কামনা তুমি সুন্দর নিয়তি ফিরে দাও দীর্ঘ ঝড় মদিরায় প্রাচীন কুঞ্জের তুমি সুন্দর নিয়তি।
ঠোটের রং টেরাকোটা
পিনাকী ঠাকুর
খেলতে গিয়ে মরতে বসেছি চিনেপাড়ারঝাপসা গলিতে
দোকান থেকে পার্ক স্ট্রিটের কবর
লালদিঘির পাশে আলেয়া দুর্গের ধ্বংসাবশেষ
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হিস্ট্রি চ্যানেল…
আমার চোখে শ্যাওলা জমে যাচ্ছে, পিছনে ছুটছেইতিহাসের অশরীরী আতঙ্কচোরা লণ্ঠন, শাবল, গাঁইতি, কম্পাস আর নােটবুকে
আমার রুকস্যাক ভারী হয়ে উঠেছে
আজ সন্ধ্যার হঠাৎ আবছায়ায় তােমার ঠোঁটের
টেরাকোটা-রং দেখে আমি বুঝতে পারলাম
তােমার রত্নগুহার কোনও ম্যাপ নেই, ছিলও না, কেবল
সংকেত ওই টেরাকোটা
হাজার হাজার মন্দিরের মধ্যে কোথায় সেই রত্নগুহা
যাকে পাহারা দেয় এক ভয়ংকর সাপ
মন্দিরের চূড়ায় গাছ গজিয়ে গিয়ে ফাটল ধরেছে
সেই রত্নগুহার মধ্যে দিয়েই বয়ে যাচ্ছে অন্ধকার নদী
যার বালিতে সােনার গুঁড়াে…
আজ রাস্তার পাগল কামড়ে দিচ্ছে তােমার ঠোঁটের
টেরাকোটা
মনেই কামড়ে দিয়ে ম্যাপ খুঁজছে আবার
তুমি বুঝতে পারছ যদি, চিৎকার করছ না কেন?
তোমার ক্ষমায় স্নাত
অমিতাভ দাশগুপ্ত
মেঘের খোঁপায় ফুটেছে আলাের ফুল,
তােমাকে কি দেব অনন্য উপহার ?
কোন ঘাটে পার
হ’তে চেয়েছিলে খুঁজে অনুকুল হাওয়া,
নাবিক বাছাে নি, এ-নৌকো বেয়ে যায় কি সুদূরে যাওয়া
ভাবাে নি, নরম অঞ্জলি মেলে ফুল
ভাসালে জোয়ারে রাজহাঁস বলে – সব ভুল, সব ভুল!
কেবল কথায় বহে গেল বেলা
জল ঝরে গেল মেঘে,
বুকের গভীরে কি শঙ্কা ছিল জেগে
বলে নি বাচাল মুখ,
কথার সাঁকোয় হৃদয়ের আসা-যাওয়া
হয় নি, সমুসুক
অধীরতা প্রাণে এসে ফিরে গেছে পাহাড়তলির হাওয়া।
এখন জেনেছাে, নীরবতা কত ভালাে,
ক্ষীণ সম্বল নিবিড় আঁচলে ঢেকে দিলে, অনুপমা,
বুঝেছ, আমার সকলই চাতুরি, ছল-
জলপ্রপাতে ধাবিত তােমার চোখের তরল ক্ষমা।
শ্রীজাত
তােমার ই-মেল পড়ি না আর। এই অসীমে
হপ্তাপিছু দশ টাকা যায় ট্যাঁক থেকে
গড়াই, আবার ফিরেও আসি এক ঠেকে।আকাশ ভরা সূর্য তারা, হাওয়ার তখন কী আস্কারা
বুঝিনি, তাও এগিয়ে গেছি চোখ বুজে
ঠেকতে ঠেকতে এখন জানি, দুধ কা দুধ-পানি কা পানি
জীবনে সব স্টেপ নিতে হয় লােক বুঝে।
যে কোন চুলােয় ঘাপটি মেরে কার কফিনে ঠুকছে পেরেক
কে কার ঘাড়ে নল রেখেছে বন্দুকের….
তবু তাে প্রেম সর্বনাশী, পুজোর চাঁদা তুলতে আসি
সাহস পেতে সঙ্গে রাখি বন্ধুকে।অসীম কালের যে-হিল্লোলে তােমার বাবা দরজা খােলে
দেখেই আমার প্রাণ উবে যায়, রঞ্জিনী
বিকেল করে ঘুরতে বেরােই, স্টিমার চেপে গঙ্গা পেরােই
আমি..তুমি..দাশকেবিন আর মঞ্জিনিস
বেকার ছেলে প্রেম করে আর পদ্য লেখে হাজার হাজার
এমন প্রবাদ হেব্বি প্রাচীন অরণ্যে
কিন্তু তার আড়ালের খবর? জবরদখল? দখলজবর?
হাজারবার মরার আগে মরণ নেই।কান পেতেছি চোখ মেলেছি যা দেখেছি চমকে গেছি
থমকে গেছি পাড়ার মােড়ে রাতদুপুর
ঝাপটাতে ঝাপটাতে ডানা পাখি পায় দৈনিক চারানা
কাপড় কিনলে হয় না মুখের ভাতটুকু।
প্রাতঃকৃত্য করছি বসে, এই সময় কে জমিয়ে কবে
লাথ ঝেড়েছে কাজলকালাে পশ্চাতে
একেই দু-দিন হয় না, শক্ত, তার ওপরে চোটে র রক্ত-
খুব লেগেছে। কিন্তু আমি, বস, তাতে
রাগ করিনি।ক্ষমাই ধর্ম। শঙ্খ ঘােষের ‘কবির ধর্ম’
গায়ে চাপিয়ে ঘুরে মরেছি কলকাতায়
ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছি…হাত-পা দিয়ে ঘুম তাড়াচ্ছি…
বেঁচে ফিরছি, সেটাই তাে আসল কথা।
টাকা খুঁজছি নােংরা হাতে, ঠাণ্ডাঘরে, কারখানাতে
তুমি হতাশ, আমিও শালা বিরক্ত
দেয়াল দেখে খিস্তি করি…কোলবালিশ জড়িয়ে ধরি…
বাড়ির লােকের উত্তেজনা-‘কেন কিছু একটা করছ না?”
যেন আজো বেকার আছি শখ করে।
তবু এমন দেশপ্রেম, যে এমপ্লয়মেন্ট -এক্সচেঞ্জে
নাম লিখেছি সােনাবরণ অক্ষরে
তুমি বরং সেটল করাে-গঙ্গারামকে পাত্র ধরাে
ফরেন কাটো। দুঃখ পাব, সামান্যই…
আমায় নিয়ে খেলছে সবাই, সুযােগ পেলেই মুরগি জবাই
তুমি তােমার। আমি তাে আর আমার নই
ঢপের আকাশ, সূর্য, তারা…স্বপ্নগুলাে বাস্তুহারা
এবার থেকে নৌকো বুঝে পাল তুলাে
আজ এটুকুই। সামলে থেকো, আমায় ছাড়াই বাঁচতে শেখােআদর নিও-
ইতি
তোমার
ফালতু লােক
