ওবায়েদ আকাশের জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৩ জুন, বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার সুলতানপুর গ্রামে। একাডেমিক পড়াশোনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশা সাংবাদিকতা। বর্তমানে দেশের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা দৈনিক সংবাদ-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। কবি,সম্পাদক ওবায়েদ আকাশের জন্মতিথিতে ইরাবতী পরিবার জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
কান্না উঠে আসে
আল্পনার মতো কদমগাছ
তুমি দেখে বিস্মিত হবে
এইমাত্র আমার হাড়ের উপর দিয়ে
হেঁটে গেল একদল নিসর্গ প্রেমিক
তাদের হাতে কুকুরের লেজে স্বনির্মিত ফাঁসি
যা কিছু অপ্রার্থিত এখনই ঝুলিয়ে দেবে
আমি একদিন ইটের ওপর থেকে মাথা নামিয়ে
ফুটপাথে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
আর ভুলে গিয়েছিলাম স্ত্রীপুত্র বিবাগী সংসারের কথা
বাবাজি লোকনাথ আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে
গৃহে নিয়ে এলে
সে কী আলোর রক্ত গুঞ্জরিত হতে দেখি ঘরময়
আমি এখন বাঁশঝাড়ের নিভৃতি থেকে প্রতিদিন
সংসারের হাত-পাগুলো কেটে কেটে এনে
নরম কাদার ভেতর ঢুকিয়ে রাখি
প্রবল বর্ষণে বাড়ির চারপাশ দিয়ে ভেসে ওঠে
প্রিয়তমার ভেজা শাড়ি, অসমাপ্ত হাসি…
ভেজা ভেজা শরীরের দিকে তাকানো যায় না
হু হু করে কান্না উঠে আসে
দোদুল্যমানতা
গরম ভাতের ভেতর বাঁশবনের লুকানো ছায়া
একটু একটু করে বাড়ছে
একদিন গরমভাত খেতে গিয়ে আমি সত্যিকারের
তিরস্কৃত হয়েছিলাম
ভাতের ওপর লাফ দিয়ে চড়ে বসেছিল শর্তহীন দুঃসাশন
কাঁচা মাছ, কাঁচা সবজি, লাল ছাগলের শিংওয়ালা মাথা
আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য
উনুন থেকে পরিপাক অবধি অসংখ্য পিঁপড়ের সারি
দুপায়ে মারিয়ে দিয়েছি
অনন্ত কাল ধরে জ্বলছে যে চুলা
আমরা তার নিতান্ত দর্শক ব্যতীত নিকটাত্মীয় নই
আমাদের একদিকে ক্ষুধা অন্যদিকে অগাধ মমতা
মধ্যপ্রাচ্যের রাখাল কিংবা নির্মাণ শ্রমিকের মতো
সম্মুখে সদা দোদুল্যমানতা
বিবিধ পদ্ধতি
তুমি চিৎকার করে মা-বোনের বয়সের দিকে হামলে পড়েছ
অথচ সন্তর্পণে বলা আছে– তোমার একুশ বছর বয়সের কথা
জ্ঞানের ভেতর কি মানুষের গরিমা থাকে?
এই প্রশ্নে আমি বারবার তারুণ্যের সাহায্য প্রার্থনা করেছি
আজকাল খোলা ছাদে বৃষ্টির ভেতর ঘুমিয়ে পড়লে
বজ্রপাতে মৃতের সংবাদ
রাতারাতি চাউর হয়ে যায়
তুমি আলগোছে দুহাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখো আমার মুখ
আমার সৈনিক জীবন তাতে বিমূঢ় হতে থাকে
তবু আমি প্রতিদিন বজ্রপাত উনুনে রেখে
তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসি
একদিন আমার ছোট্ট সন্তান বিদ্যুতের গায়ে হাত দিতেই
তোমার মাতৃস্নেহ জেগে উঠেছিল
কেঁপে উঠেছিল তোমার অপরিণত বয়স আর
প্রতিদিনের সাবধান হওয়ার বিবিধ পদ্ধতি
প্রসঙ্গ নদী
আজকাল নদীর ভেতর খাবার খাদ্য ব্যবহার সামগ্রী নিয়ে
তোমার আমার জন্য ভীষণভাবে ভাবছ–
ভাবছ যে একদা খরস্রোতা নদীতে হাঙর কুমির
কত কিছুই না খেলা করত বিষয়ী মানুষের মুখশ্রী নিয়ে
আজকাল বর্ষান্তে নদীর ফাটল নিয়ে আমি
নদী গবেষণায় একপ্রকার পত্র লিখেছি:
মান্যবরেষু:
১.
নদীর ফাটল থেকে যে সমস্ত মাছ উঠে আসছে
তার দৈর্ঘ্যপ্রস্থ আন্দাজের একপ্রকার জলযন্ত্র আবিষ্কার করুণ
২.
নদী থেকে বিলুপ্ত মাছের কঙ্গালের নিচে
যে সমস্ত সোনার সংসার বিলুপ্ত হয়ে গেছে
প্রতিটি নববধূর হাতে তুলে দিন নিজ নিজ সন্তানের ভার
৩.
আমরা যারা যৌবনে প্রেমিক ছিলম এবং একদিন
প্রমত্ত স্রোতে ভেসে গেছে প্রেমিকার মুখ
এর জন্য অন্তত একটা বিবাহপূর্ব মিলনের ব্যবস্থা করে দিন
৪.
আমরা যারা পলিবাহিত মাঠ আপনার হাতে সমর্পণ করেছিলাম
সীমাহীন উঁকুন থেকে তাদের অন্তত চুলের পরিত্রাণ করুণ
৫.
যে সকল মৃতদেহ যত্রতত্র ফাটলের ভেতর থেকে
হাত পা কিংবা মাথা তুলে আছে, তাদের প্রতিটি অঙ্গ চমৎকার
ভূয়সী প্রশংসাযোগ্য করে দিন
আজকাল প্রতিটি নদীর জন্য এক একটি বার্তা সংস্থা
বা অনলাইন গণমাধ্যম করে তাকে অন্তত ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে
পরিভ্রমণের অবাধ সুযোগ করে দেয়া জরুরি…
নির্বাচিত কথা
বেলপুর থেকে সীমান্তের দূরত্ব আমার জানা নেই
তবু বন্ধুদের আড্ডায় পাণ্ডিত্য ফলাতে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে
একটা দূরত্ব নির্ধারণ করে ফেলি
যেমন ছোট্টবেলায় হাটের দিনে
শুকনো পাটের ঝুটি দেখেই বলে দিতে পারতাম
সম্ভাব্য ওজনের পরিমাণ
টেকো মাথায় রাজ্যির রোদ্দুর এসে চিকচিক করে ওঠে
যতটা সম্ভব মক্ষিকার মতো প্রলুব্ধ হয়ে
ছায়া নেমে এলেই আবার কোথায় হারিয়ে যায়
বংশীবাদনের মতো নির্বাচিত কলা
প্রাগৈতিহাসিক সত্যের মতো অনুভবে জাগিয়ে রাখি
অথচ একদিন তার সুরে সুরে ভেসে
আমি বহু দূর থেকে বহু দূর দেশে
রাজকুমারীর আতিথ্য গ্রহণে অবিশ্বাস্য প্রতিশ্রুত থাকি
এ রাজ্যের কলমের ব্যবহার এখনো শিখিনি আমি
অথচ তোমাকে চিঠি লিখবো লিখবো করে করেই
যে অন্ধ হয়ে এবাড়ি ওবাড়ি চেয়ে চিন্তে খাই
মাইরি বলছি আজকাল আমার কিচ্ছু মনে থাকে না
জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৩ জুন, বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার সুলতানপুর গ্রামে। একাডেমিক পড়াশোনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশা সাংবাদিকতা। বর্তমানে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ:
কাব্যগ্রন্থ : পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ (২০০১), নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ (২০০৩), দুরারোগ্য বাড়ি (২০০৪), কুয়াশা উড়ালো যারা (২০০৫), পাতাল নির্মাণের প্রণালী (২০০৬), তারপরে, তারকার হাসি (২০০৭), শীতের প্রকার (২০০৮), ঋতুভেদে, পালকের মনোবৃত্তিগুলি (কাব্য সংকলন, ২০০৯), বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা (২০০৯), যা কিছু সবুজ, সঙ্কেতময় (২০১০), স্বতন্ত্র ৬০টি কবিতা (কাব্য সংকলন, ২০১০), প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায় (২০১১), ওবায়েদ আকাশের কবিতা ॥ আদি পর্ব (কান্য সংকলন, ২০১১),
অনুবাদ : ‘ফরাসি কবিতার একাল/কথারা কোনোই প্রতিশ্রুতি বহন করে না’ (ফরাসি কবিতার অনুবাদ, ২০০৯)
গদ্যগ্রন্থ : ‘ঘাসের রেস্তরাঁ’ (২০০৮) ও ‘লতাপাতার শৃঙ্খলা’ (২০১২), ।
সম্পাদনা গ্রন্থ : ‘দুই বাংলার নব্বইয়ের দশকের নির্বাচিত কবিতা’ (২০১২)।
সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন : শালুক (১৯৯৯)
পুরস্কার: ‘শীতের প্রকার’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ কবি পুরস্কার ২০০৮’; ‘শালুক’ সম্পাদনার জন্য পেয়েছেন ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার ২০০৯’। ২০১২ সালে লন্ডন থেকে পেয়েছেন সংহতি বিশেষ সম্মাননা পদক।