লেখক আড্ডায় ‘বাংলা কবিতা: অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ গ্রন্থ নিয়ে আলোচকদের বক্তব্যের জবাব
গৌরচন্দ্রিকা
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ‘লেখক আড্ডা’ নামে কবি ও লেখকদের একটি সংগঠন আমার প্রবন্ধের বই ‘বাংলা কবিতা: অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ নিয়ে ঢাকাস্থ কার্যালয়ে একটা আলোচনা/ আড্ডার আয়োজন করে যেখানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক, কবি, সম্পাদক ও সমালোচক যথাক্রমে শোয়েব শাহরিয়ার, মঈনুদ্দিন খালেদ, এজাজ ইউসুফী, আলমগীর খান, আফরোজা সোমা এবং ফরিদুল আলম। আলোচনাটি ফেসবুকে লাইভ প্রচারিত হয়, ফলে দেশে এবং দেশের বাইরে অনেকেই সেটা দেখার ও শোনার সুযোগ পান। আমি টরোন্টো থেকে ফেসবুকের এই লাইভ আড্ডায় যুক্ত হয়ে আলোচকদের আলোচনা শুনি। বইটিতে দীর্ঘ কলেবরের ৫ টি প্রবন্ধ এবং একটি সাক্ষাৎকার আছে যার ভেতর মাত্র দু’টি প্রবন্ধ নিয়ে আলোচকরা কথা বলেন ও ব্যাখা-বিশ্লেষণ করার অবকাশ পান। এদের মধ্যে তিনজন আলোচক মূলত বইটির নামপ্রবন্ধ ‘বাংলা কবিতা: অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ নিয়েই তাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখেন। তাদের কথা শুনে আমি বুঝতে পারি যে তাদের কেউই প্রবন্ধটি ঠিক করে পড়ে আসেন নি এবং না পড়েই মনগড়া, বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য করেছেন যা শ্রোতাদের কাছে আমার লেখা সম্পর্কে ভুল বার্তা দেয়। স্বভাবতই তাদের কথার জবাব দেয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। আড্ডার শেষে আলোচকদের কথার জবাব দিতে সঞ্চালক আমাকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে না পারায়, আমি বলেছিলাম লিখিতভাবে এর জবাব দেব। ভিডিও থেকে আলোচকদের কথা শুনে, প্রতিটি প্রসঙ্গ নিয়ে লিখিত জবাব দেয়া ছিল সময়-সাপেক্ষ কাজ যা অনুমিত সময়কে ছাপিয়ে যায় এবং এর মধ্যে মহামারী করোনা এসে আমাদের বন্দি করে, মনোযোগ ছিনিয়ে নেয়। লেখাটি এক পর্যায়ে এসে শেষ হয়ে গেলেও, সবার মানসিক স্বাস্থ্য বিবেচনা করে এটি প্রকাশ করার জন্য আমি অপেক্ষা করি। পুরো আলোচনাটি মোট ৩ টি অংশে ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল। আমি আলোচকদের পুরো বক্তব্য বিষয় অনুযায়ী (পয়েন্ট টু পয়েন্ট) সাজিয়ে জবাব দেবার চেষ্টা করেছি এবং সেই সাথে ভিডিওক্রম অনুযায়ী যে-পয়েন্টে তারা কথা বলেছেন তার সময়কালও উল্লেখ করেছি। পাঠকদের কথা ভেবে প্রতিটি পর্বের শেষে আলোচনার ভিডিওগুলো সংযুক্ত করা হয়েছে। লেখাটির আয়তন ও পাঠকদের ধৈর্য্যের কথা বিবেচনা করে সাহিত্যের অনলাইন কাগজ ‘ইরাবতী’ এটি তিন পর্বে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ তার ১ম পর্ব প্রকাশিত হ’ল।
লেখকের জবাব : ১ম পর্ব
প্রথমেই ‘কে শক্তি প্রোষিতভর্তৃকা : জীবনানন্দের মানবসমাজ ও বিশ্বপ্রকৃতি পরিক্রমা’ প্রবন্ধ নিয়ে শোয়েব শাহরিয়ার অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত আলোচনা করেন। জীবনানন্দের ‘শ্যামলী’ কবিতা নিয়ে আমি যে বিশ্লেষণ হাজির করেছি এবং জীবনানন্দের কাব্যভুবনে এক নতুন নারী চরিত্র আবিষ্কারের দাবী করেছি, সেটা শোয়েব শাহরিয়ার সম্পূর্ণ সমর্থন করেন। প্রবন্ধটিকে তিনি বাংলা সাহিত্যের এক স্থায়ী সম্পদ হিসেবে অভিহিত করেন। এই প্রবন্ধটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আলোচক বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ফেলেন, ফলে আর কতটা সময় তিনি কথা বলতে পারবেন এই নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তাই অনেকটা তাড়াহুড়ো করে এই বইয়ের নাম প্রবন্ধ ‘বাংলা কবিতা : অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ নিয়ে তিনি কিছু বিচ্ছিন্ন মন্তব্য করেন যা এই দীর্ঘ প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে সামগ্রিক কোনো মূল্যায়ন উপস্থিত করে নি।
[ভিডিও #২, সময়কাল ০২:৩৭ থেকে শেষ পর্যন্ত এবং ভিডিও #৩, সময়কাল ০০:০০ -১১:৩০]
কিন্তু পরের দু’জন বক্তা মঈনুদ্দিন খালেদ ও এজাজ ইউসুফী শুধুমাত্র ‘বাংলা কবিতা : অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ নিয়ে যে দীর্ঘ আলোচনা করেন তা ছিল আমার চিন্তাকে ভুল, খণ্ডিত ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে প্রবন্ধটির অবমূল্যায়ন করা। কোনো লেখাকে গ্রহণ বা বাতিল করার অধিকার সমালোচকের রয়েছে, কিন্তু সেটা করার জন্য সমালোচকের দায়িত্ব হচ্ছে লেখক তার প্রবন্ধে যেসব তত্ত্ব, তথ্য, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও চিন্তাপদ্ধতিকে অনুসরণ করেছেন তার উল্লেখপূর্বক সেসব যুক্তি সহকারে খণ্ডন করা। অন্যথায় সেটা আলোচকদের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য ও উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আলোচনার সুবিধার্থে, আমি এই প্রবন্ধের মূল চিন্তা আগে সংক্ষেপে বলি, পরে প্রসঙ্গ অনুযায়ী বিভিন্ন অংশে আলো ফেলা যাবে।আধুনিকতাবাদী দর্শন ও শিল্প-সাহিত্যের অন্তিমদশা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে পোস্টমডার্ন জীবনবোধ ও দর্শনের উন্মেষ ঘটে যার দু’টি ধারা : একটি হচ্ছে আধুনিকতাবাদী জীবনব্যবস্থায় মানুষের উপর মানুষের সব রকম কর্তৃত্ব নিরসনের উপায় হিসাবে নৈরাজ্যবাদে আত্মসমর্পণ; অন্যটি হচ্ছে আধুনিকতার অবক্ষয়ী ও খণ্ডবাদী জীবন-দর্শনের বিপরীতে অখণ্ডবাদী জীবনবোধের চর্চা ও উত্তরণের অন্বেষণ যা অঞ্চল বিশেষে উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনায় স্বদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মাটি ঘনিষ্টতায় মুখর। পশ্চিমে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পোস্টমডার্ন চিন্তা-ভাবনা ডালপালা মেলতে থাকে যার অভিঘাত নব্বইয়ের দশকে বাংলা ভূবনে (বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও বহির্বিশ্ব) দৃশ্যগোচর হয় ও পোস্টমডার্ন চিন্তা-চেতনার চর্চা শুরু হয়। বিভিন্ন বাঙালি তাত্ত্বিক ‘পোস্টমডার্ন’ শব্দের পারিভাষিক অনুবাদ করেন যথাক্রমে উত্তরাধুনিক, উত্তর আধুনিক, আধুনিকোত্তর ও অধুনান্তিক। কবিতার ক্ষেত্রে, প্রথমোক্ত ধারা প্রধানত ভাষা ও আঙ্গিকবাদী যেখানে মানুষের উপস্থিতি গৌণ; দ্বিতীয়ধারায় মানুষের উপস্থিতি মূখ্য যা প্রকৃতি ও সর্ব প্রাণসত্তার সাথে নিবিড় বন্ধনে যুক্ত থেকে, ভাষা ও আঙ্গিককে মুক্ত করার প্রেরণায় উন্মুখ। এই দুই ধারার বাইরে, আরেকটি তাত্ত্বিকদল দাবী করেন যে তারা পাশ্চাত্যের ‘পোস্টমডার্ন’ শব্দবন্ধ ও চিন্তাভাবনার সাথে কোনো প্রকার পরিচয় ও বাংলা ভাষায় এই নিয়ে কোনো লেখা প্রকাশিত হওয়ার আগেই, ‘উত্তর আধুনিক’ নাম নিয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে স্বদেশ-ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর দাঁড়িয়ে নতুন চিন্তা-ভাবনার পাটাতন নির্মাণ করেন যা অবক্ষয়ী আধুনিকতার বিরুদ্ধে সক্রিয়। আমার বিবেচনায়, এই তৃতীয় ধারাটির সাথে দ্বিতীয় ধারার মূল প্রত্যয়ে কোনো পার্থক্য নাই।
বাংলা অঞ্চলে বিতর্ক হচ্ছে দু’টো ব্যাপার নিয়ে : একটা হচ্ছে পারিভাষিক ও অন্যটি হচ্ছে ভাবগত। আমি লক্ষ করে দেখেছি যে পারিভাষিক বিতর্কের কোনো সত্যিকার ভিত্তি নেই, কারণ চিন্তার দিক থেকে এক হওয়া সত্ত্বেও পারিভাষিক পরিচয় গ্রহণে তাত্ত্বিকদের মধ্যে মতের পার্থক্য আছে। কিন্তু চিন্তার দিক থেকে যে বিরোধ, তা মূলত প্রথম ধারার সাথে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারার। মঈনুদ্দিন খালেদ ও এজাজ ইউসুফী তাদের উন্নাসিক ও খণ্ডিত পাঠের মাধ্যমে আমাকে প্রথম ধারার প্রবক্তা অর্থাৎ প্রচলিত পশ্চিমী ধারার অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যা খুবই বিভ্রান্তিকর। আমি প্রথম ধারার নামকরণ করেছি ভাষা ও আঙ্গিকবাদী পোস্টমডার্ন ধারা এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারাকে চিহ্নিত করেছি অধুনান্তিক জীবনবাদী ধারা হিসেবে। আমার ব্যক্তিগত অবস্থান অধুনান্তিক জীবনবাদী ধারার পক্ষে যা মঈনুদ্দিন খালেদ ও এজাজ ইউসুফীর মূল চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক নয়, ছোট ছোট কিছু মত পাৰ্থক্য বাদে। বাংলা অঞ্চলে যেহেতু পোস্টমডার্ন নিয়ে চিন্তাভাবনা ও কাব্যচর্চা এই দুই ধারাতেই সক্রিয়, তাই প্রবন্ধ লেখার সময়ে আমি দু’টো ধারাকেই যথাসম্ভব তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি এবং অধুনান্তিক জীবনবাদী ধারার পক্ষে আমার অবস্থান গ্রহণ করেছি। আলোচকরা তাঁদের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় সমালোচনা সহ অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, নিজস্ব মতামত ও সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। আমিও সেভাবে আমার জবাব দিচ্ছি।
মঈনুদ্দিন খালেদ তাঁর আলোচনায় প্রধান যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তা হ’ল পোস্টমডার্ন নিয়ে আমি যা লিখেছি সেটা পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখা অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রেক্ষিত থেকে এই বিষয়কে বিবেচনা করা হয়নি। তিনি বলেছেন, “আমরা যখন মডার্নিজমে গেলাম তখন পশ্চিম, যখন পোস্টমডার্নে গেলাম তখনও পশ্চিম। পোস্টমডার্ন যদি পশ্চিম থেকেই হয়, তাহলে এটা পোস্টমডার্ন কিনা। এটাও তো আমার একটা বড় প্রশ্ন। আমরা যখন পোস্টমডার্ন নিয়ে আলোচনা করি তখন কিন্তু আমরা আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, কবি জসীম উদ্দীন কিংবা মনসুর উদ্দিন তাদের কোনো রেফারেন্স পাই না বা লালন, প্রশ্ন আসতে পারে, এখানে কিন্তু লালন আসেনি; এটা কিন্তু একটা বড় ড্যামেজিং জায়গা বলে আমার মনে হয়েছে। তাহলে কী বুঝতে হবে পোস্টমডার্নের যে উপলব্ধি, সে উপলব্ধি পশ্চিমেরই। আমি মনে করি সেটা পশ্চিমের নয়। […] আমরা পোস্টমডার্ন হতে গিয়ে নিজের সভ্যতার দিকে তাকাই না কেন? আমরা আরেকটু দূরেই যাই, এখন পৃথিবীতে লেখা হচ্ছে darker side of renaissance নিয়ে, রেনেসাঁসের অন্ধকার দিককে নিয়ে। যে লুটপাট, বণিক সভ্যতার কথা বলা হচ্ছে এবং মজার ব্যাপার হল, কেন্দ্র থেকে periphery-তে যাওয়া বা সভ্যতাকে তল থেকে দেখা, অর্থাৎ সড়কে না গিয়ে, মহাসড়কে না গিয়ে আলপথে থাকা। বাংলার জন্য যেটা অনেক জরুরী; জীবনানন্দ দাশও আলপথে ছিলেন। সেই বিষয়টা আমাদের দেশেই যে আলপথের মানুষগুলো গ্রাহ্য হয়নি আশানুরূপভাবে, যৌক্তিকভাবে, যথাযথভাবে; এটা কিন্তু ইউরোপের ক্ষেত্রেও ঘটেছে।”
[ভিডিও # ৩, সময়কাল ১৭:৫৮ -২১:০২]
আপাতত এখানে থামি। পোস্টমডার্ন সম্পর্কে আমার নিজস্ব অবস্থান যে সেই আলপথের মানুষদের সনাক্ত ও প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী তা আমার প্রবন্ধটিকে মঈনুদ্দিন খালেদ তাঁর ভাসা ভাসা, পাতা উল্টে যাওয়া খণ্ডিত পাঠে ধরতে পারেন নি। আমার এই প্রবন্ধের দু’টি পর্ব ─১ম পর্বে ৭ অধ্যায় এবং ২য় পর্বে ৩ অধ্যায় নিয়ে মোট ১০ অধ্যায়ের লেখা। পর্বের অধ্যায়গুলো ধারাবাহিকভাবে না পড়লে বোঝার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমি প্রবন্ধের ১ম পর্বের ২য় অধ্যায়ে, পোস্টমডার্ন প্রেক্ষিত অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে পোস্টমডার্ন বলতে আমরা কী বুঝব তা ব্যাখ্যা করেছি। এখানে আমি স্পষ্ট করে বলেছি যে আধুনিকতার মূল ভিত্তি ব্যক্তিনির্মাণ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ যার জয়গান গেয়ে ইউরোপে রেনেসাঁসের সূত্রপাত হয় যা ব্যক্তি ও সমাজের আলোকপ্রাপ্তি (enlightenment) ও মুক্তির কথা বলে শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে নতুন কর্মযজ্ঞের সূত্রপাত করে। কিন্তু যে আলোকপ্রাপ্তির দাবি করেছিল রেনেসাঁস তা প্রত্যাশিতরূপে সফল হয়নি। কারণ রেনেসাঁসের হাত ধরে আধুনিকতাবাদের আওতায় দু’টি সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হয়, এর একটি ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে বিকাশের সুযোগ পায় বটে, কিন্তু পুঁজির শোষণ ও বৈষম্যের কারণে সেই বিকাশের সুযোগ সমান হয় না। এর প্রতিক্রিয়ায়, মানুষ সমানভাবে বিকশিত হবার সুযোগ তৈরী করার দাবি নিয়ে পৃথিবীর কয়েকটি রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু মানুষকে সমানভাবে বিকশিত করার সুযোগ দিতে গিয়ে জোরপূর্বক সমানভাবে সম্পদহীন করে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজির জন্ম দেয়া হয়। রাষ্ট্র জনগণের হয়ে সব পরিকল্পনা গ্রহণ করতে গিয়ে মানুষের সৃজনশীল বিকাশের সম্ভাবনা ব্যাহত হয়ে যায়। উদ্ধৃতি: “ফলে মানুষ তার স্বাধীন বিকাশের জন্য আধুনিকতাবাদের আওতায় যে দু’টি জীবনব্যবস্থার জন্ম দেয়, তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। উপরন্তু দু-দু’টো বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাও মানুষ প্রত্যক্ষ করে যা আলোকপ্রাপ্ত আধুনিকতাবাদীদের ঘোষিত মানবতাবাদের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ, অথচ তা সংঘটিত হল তাদেরই সৃষ্ট তত্ত্বব্যবস্থার ভেতর। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ অনুভব করল মুক্তিকামী মানুষের দল […] মানবসমাজের বৈচিত্র্যময় বিকাশের স্বার্থে প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টির দাবি নিয়ে আবির্ভূত হলেন পোস্টমডার্ন চিন্তানায়কের দল, যাতে ছোট ছোট উপায়ে সকলেই সাম্য ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে নিজ নিজ কাঙ্ক্ষিত বিকাশ সম্পন্ন করতে পারেন। এই ভাবনাচিন্তার অনিবার্য প্রকাশ জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ সামাজিক সব সম্পর্কের ক্ষেত্রে─এক কথায়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে ফুটে উঠতে শুরু করেছে যার পরিণতি সময়সাপেক্ষ।” [পৃষ্ঠা-১৪] উদ্ধৃতি আর দীর্ঘ করছি না। যে-রেনেসাঁস একদিন পৃথিবী আলোকিত করেছিল, তার ব্যর্থতা থেকেই যে পোস্টমডার্ন চিন্তার জন্ম সেটার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তো আমি শুরুতেই করে নিয়েছি এবং প্রবন্ধের ২য় পর্বে সেটা আরো বিস্তৃত করেছি।
আলপথের মানুষগুলোকে গ্রাহ্য না করার যে অভিযোগ মঈনুদ্দিন খালেদ করেছেন এই প্রবন্ধের বিরুদ্ধে, তার কোনো ভিত্তি নেই। কারণ আমি শুরুই করেছি প্রাচীন বাংলাকাব্য চর্যাপদের উল্লেখ করে যার পদকর্তাগণ ও তাদের রচনার বিষয়, সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন এর প্রথম দৃষ্টান্তমূলক প্রমাণ, “যে-ভাষায় তাঁরা এই গানগুলো লেখেন, তা একইসাথে অন্তত দু’টি স্তরে অর্থ প্রকাশ করে : ঐহিক স্তরে যা জীবন ও সমাজবাস্তবতার চিত্র, আত্মিক স্তরে তা-ই সাধনমার্গের অভিজ্ঞতা হিসেবে বিভিন্ন প্রতীক ও রূপকে প্রকাশিত হয়। অভিজাত সংস্কৃত ভাষার বিপরীতে প্রাকৃত বাংলাভাষায় লিখিত এইসব গানে নিম্নবর্গের মানুষের প্রবেশাধিকার ঘটে এবং তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙক্ষা ও বর্ণবাদী শাসন কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ ফুটে ওঠে।” এর পরেই লক্ষ করুন আমি লিখেছি, “এইভাবে শুরুতেই আধিপত্যকামী, বর্ণবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বাংলার কাব্য যে আত্মপ্রকাশ করেছিল তা হাজার বছরের পথ পেরিয়ে, বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্বে নতুন নতুন শাসন কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াই করে আজও তাকে অগ্রসর হতে হচ্ছে। বাঙ্গালির ভাষা, সংস্কৃতি, জাতিগঠন-প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক সামাজিক মুক্তির সংগ্রামের সাথে তাই বাংলার কবিতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।”[পৃষ্ঠা-১৮] আলপথের মানুষদের কতটা প্রাধান্য দিয়েছি তার উল্লেখ আমার প্রবন্ধেই রয়েছে, “নদী কেন্দ্রিক পলিসমৃদ্ধ সমতল ভূমির কৃষিজীবী বাঙালি জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি যেমন আজকের কবিতায় নতুন মাত্রায় বিধৃত হচ্ছে, তেমনি দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতির উপেক্ষিত অধ্যায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠে আসতে শুরু করেছে অনেক কবির কবিতায়। বাংলা কবিতার মূলধারায় এসে মিশে যাচ্ছে বিভিন্ন আদিবাসী শব্দ, রূপকল্প, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, রূপকথা ও মিথ ইত্যাকার অনুষঙ্গ। এইভাবে কেন্দ্র ও প্রান্তের দূরত্ব ভাঙতে শুরু করেছে। আশি এবং নব্বই দশকেই প্রথম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনকে কবিতায় এভাবে রূপায়িত হতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের কবিদের কবিতায়।” [পৃষ্ঠা-৪০] প্রবন্ধের ২য় পর্বের শেষ অধ্যায়ে, যেসব কবিতা/ কবিতাংশ উল্লেখ করেছি সেগুলোর উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই মঈনুদ্দিন খালেদ আমার বক্তব্যের সমর্থন পেতেন। উদাহরণ: হিরালী/মোহাম্মদ সাদিক, পালকাপ্য/খলিল মজিদ, ধানের রচনা দিলে পত্রে/শিবলী মোকতাদির, ধানবৌ/পরিতোষ হালদার, কৃষি সভ্যতার গল্প/ফারহান ইশরাক, চাষী বউয়ের সাথে যখন বদলায় কবির জীবন/শাহনাজ মুন্নী, কাস্তে নিয়ে/জেনিস মাহমুন, মৎস্যচেতনা: চলা/বায়তুল্লাহ কাদেরী [পৃষ্ঠা ৭৩-৭৫]; জলপতন/জিললুর রহমান [পৃষ্ঠা ৮৩], বড় হও প্রতিমা শিশু/এজাজ ইউসুফী [পৃষ্ঠা ৮৪]; মথুরা ত্রিপুরা/অলকা নন্দিতা, মানুষ হবো না আর ম্রো হবো না/হাফিজ রশিদ খান, সাতবোন চাকমা নারী/শিমুল মাহমুদ [পৃষ্ঠা ৮৬-৮৭] পোস্টমডার্ন নিয়ে লিখতে গেলে যেসব বাঙালি মনীষীদের নাম নেয়া অবশ্য কর্তব্য বলে মঈনুদ্দিন মনে করেন তাঁদের সবার নাম না এলেও, তাঁদের মতো করে যারা ভেবেছেন এমন অনেকের নাম এবং চিন্তার উল্লেখ আমি এই প্রবন্ধে করেছি যা আলোচনা অগ্রসর হলে পাঠক দেখতে পাবেন।
আলোচনার এক পর্যায়ে মঈনুদ্দিন খালেদ শব্দ করে বইয়ের ভূমিকা (নিবেদন) পড়তে শুরু করলেন। ভূমিকায় আমি এই প্রবন্ধের কোনো প্রসঙ্গই অবতারণা করিনি, শুধুমাত্র একটি তথ্য দিয়েছি যে প্রবন্ধটির দু’টি অধ্যায় দু’টি ভিন্ন সময়ে লেখা হয়েছে — ১ম অধ্যায় ছাপা হয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘আবহমান’ পত্রিকায় (২০০৬) এবং ১ম ও ২য় অধ্যায় একসাথে ছাপা হয় ‘ভিন্নচোখ’-এর প্রজন্মের কবিতা সংখ্যায় (২০১৮)। তিনি এই পত্রিকা দু’টোর নাম (আবহমান, ভিন্নচোখ) পড়ে বললেন, “কিন্তু আলোচ্য বিষয়ের ব্যাপ্তি এই পত্রিকাগুলোর নাম দিয়েই হবে না, যদি বলতেই হয় তাহলে অনেকের নামই আসতে হবে।” আমি বুঝলাম চোখ বুলিয়ে যাওয়া পাঠে মঈনুদ্দিন খালেদ মনে করেছেন যে আমি পোস্টমডার্ন নিয়ে যেসব পত্রিকা কাজ করেছে, তার মধ্যে শুধু এই দু’টি পত্রিকার নাম করেছি। কী আর বলব? যেসব পত্রিকা সচেতনভাবে আশি এবং নব্বইয়ের দশকে পোস্টমডার্ন/উত্তর আধুনিকতা নিয়ে কাজ করেছে অথবা নিদেনপক্ষে এই কালপর্বের পরিবর্তনগুলো চর্চা করার চেষ্টা করেছে এমন ৪০ লিটল ম্যাগাজিনের নাম আমি করেছি (একবিংশ, গাণ্ডীব, প্রান্ত, লিরিক, নিসর্গ, দ্রষ্টব্য, লোক, নিরন্তর, অমিত্রাক্ষর, প্রসূণ, নদী, নৃ, কালধারা, সুদর্শনচক্র, ঋতপত্র, মৃত্তিকা, পুষ্পকরথ, নোয়াজার্ক, দ্যুতি, অর্কেস্ট্রা, পাঠকৃতি, ঋতি, সুনৃত, স্রোতচিহ্ন, অর্কিড, ঘাস, বালুচর, মৃৎ, ছাপাখানা, শিলালিপি, ক্যাথারসিস, কারুজ, চালচিত্র, এষণা, ধাবমান, জীবনানন্দ, প্রতিশিল্প, দ্বিতীয় চিন্তা, সমুজ্জ্বল সুবাতাস, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা) যা দেশের বিভিন্ন শহর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। (১ম অধ্যায়, ৭ম পর্ব, পৃষ্ঠা-৪২) এরপর লাফ দিয়ে তিনি কোথায় চলে গেলেন বুঝলাম না, বললেন, “আবুল হাসান বলছেন, নির্মলেন্দু গুণ বলছেন, কিন্তু তিনি (তুষার) কোনো ক্যাটাগরি করেন নি। পোস্টমডার্ন নাকি মডার্ন, হলে কী অর্থে মডার্ন, পোস্টমডার্ন হলে কী অর্থে পোস্টমডার্ন। আমাদের এটাই সবচেয়ে বড় জায়গা ছিল, যেটা বিভাজন করা খুব ডিফিকাল্ট। পোস্টমডার্ন তো আসলে উন্নত দৃষ্টিভঙ্গী, চিন্তার জগতে একটা বড় ঘটনা যেটাকে আমরা পোস্টমডার্ন বলছি এবং পোস্টমডার্নে এন্টি কলোনিয়াল ব্যাপার আছে। কালো ও সাদার দ্বন্দ্ব প্রবাদ প্রবচনে প্রচুর আছে, ‘নদীর জল ঘোলাও ভালো, জাতের মেয়ে কালোও ভালো’ […] যেমন ধরুন জসীম উদ্দীনের মধ্যে পোস্টমডার্নিজম এবং এন্টিকলোনিয়াল এটিচ্যুড এত সুন্দরভাবে আছে, যেহেতু দেশী বাংলার মানুষ, সেইসব জিনিসগুলো এইসব প্রবন্ধে বেশি আসা উচিত। […] আমরা তো তাঁকে অনাধুনিক বলে বাদই দিয়েছিলাম। […] আমার কাছে যে জিনিসটা বারবারই মনে হয়েছে যে একটা ধ্রুপদী আয়োজনের মধ্য দিয়ে বার বার আমাদের সভ্যতাকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে।
[ভিডিও #৩, সময়কাল ২১:০২ থেকে শেষ পর্যন্ত এবং ভিডিও # ৪, সময়কাল ০০:০০ – ০১:২৫]
আমি পোস্টমডার্ন নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার পরেই বাংলাকাব্য প্রাচীন কাল থেকে গত শতাব্দীর ৯০-র দশক পর্যন্ত, বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তার পরিচয় সংক্ষেপে তুলে ধরেছি যাতে বোঝা যায় আমরা আজ যে অধুনান্তিক কবিতার কথা বলছি তার শেকড় কোথায় এবং কীভাবে বিভিন্ন কাব্যপ্রবাহের ভিতর দিয়ে এক অভিন্ন সূত্রে (অভেদ) গ্রন্থিত হয়ে আছে। ১ম পর্বের ৩ অধ্যায়ে প্রাচীন চর্যাপদ থেকে মধ্যযুগের বাংলাকাব্য, ৪র্থ অধ্যায়ে মধুসূদন থেকে রবীন্দ্র-নজরুল আধুনিকতার প্রথম পর্যায় এবং রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতার ২য় পর্যায়, ৫ম অধ্যায়ে ভাষা আন্দোলন-উত্তর বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতা এবং ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে সেই আধুনিকতার অবক্ষয়, ৭ম অধ্যায়ে জীবনবাদী অধুনান্তিক কবিতার বিষয় ও পরিসর নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করেছি। ১ম পর্বের ৫ম অধ্যায়ে লিখেছি, কীভাবে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ববাংলায় অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে যা এই অঞ্চলে বাংলা কবিতায় নিজস্ব আধুনিকতার জন্ম দেয়। উদ্ধৃতি: “২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, ঢাকায় মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র-জনতার মিছিলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার শহীদ হন। এ-ঘটনার অভিঘাত থেকে এ-অঞ্চলের মুসলিম মানস গভীরভাবে উপলব্ধি করে যে ধর্মগত পরিচয়ে তারা যেমন মুসলমান, জাতিগত পরিচয়ে তেমনি তারা বাঙালি। জাতিসত্তা গড়ে ওঠে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও অর্থনৈতিক সংগঠনের ওপর ভিত্তি করে যা কোনো সহসা-উদ্ভূত বিষয় নয়, বরং হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠার ব্যাপার। অনেক ঐতিহাসিক বাঙালি মুসলমানের এই আত্মোপলব্ধিকে তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হিসেবে অভিহিত করে থাকেন যা পরবর্তী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে। এর প্রভাব কবিতার গতিপথকেও পাল্টে দেয়: পাকিস্তানী ভাবাদর্শে যাঁরা কবিতাচর্চা করছিলেন, তাদের পাশাপাশি হাই-মডার্নিস্ট কবিদের মেধা ও মননজনিত আধুনিকবাদী কবিতাচর্চার একটি ক্ষীণধারা সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২) আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪) ও আহসান হাবীব (১৯১৭- ১৯৮৫) প্রমুখের মাধ্যমে সচল ছিল। এবার সেই ধারাটি বেগবান হল এবং পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির ক্রম-অগ্রসরমান স্বাধিকার আন্দোলনের প্রাণস্পন্দনকে ধারণ করে এক স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত আত্মপ্রকাশকে চিহ্নিত করে দিল। বাংলাদেশের কবিতা বলতে আজ আমরা যা বুঝে থাকি, তার ভিত্তিপ্রস্তর এভাবেই রচিত হয়। অবশ্য এঁদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানী ভাবাদর্শের প্রতি অনুরক্ত হন এবং আধুনিক কাব্যাদর্শ থেকে সরে আসেন।”
ষাটের দশকে কবি হিসেবে যাদের আত্মপ্রকাশ, সেই আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণ ক্যাটাগরিক্যালী আধুনিক কবি। শুধুমাত্র এই দু’জন কবি সম্পর্কে নয়, ৫০ থেকে ৭০ দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক কবিদের নাম এবং তাঁদের কাব্যপ্রবণতা সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছি যার দু’টো ধারা, “পঞ্চাশ থেকে সত্তর অবধি কবিদের কাব্যচিন্তায় একধরনের ঐক্য লক্ষ করা যায়─অধিকাংশ কবিই নগরকেন্দ্রিক। যে-দৃষ্টিতে তাঁরা নগর অবলোকন করেন তার কিছুটা তাঁদের অভিজ্ঞতায় নির্মিত, কিছুটা পঠন-পাঠনজনিত বোধের লেন্সে বিবর্ধিত : পাশ্চাত্য কবিদের নগর অভিজ্ঞান থেকে প্রভাবিত, যেভাবে বৈশ্বিক পরিসরে কবি ও পাঠকদের কাছে তৈরি হয়েছিল নগরের ইমেজ। এলিয়টের পোড়োজমির উদ্ভাস অথবা বোদলেরীয় বিবমিষা তাই পঞ্চাশের অনেক কবিই আহরণ করে নেন নিজের প্রিয় ঢাকা শহরটিকে দেখবার অভিপ্রায়ে।” […] নগরচারিতার এই প্রবণতার পাশাপাশি আরেকটি ধারা ক্রিয়াশীল থেকেছে পঞ্চাশ থেকে সত্তর অবধি, যা বেড়ে উঠেছে বাংলার বৃহত্তর লোকজীবন এবং তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, যৌথ অবচেতনা ও শ্রেণীসংগ্রামকে কেন্দ্র করে।” [পৃষ্ঠা ২৯-৩২] আমি এই দ্বিতীয় ধারার (প্রবণতা) সাথেই জীবনবাদী অধুনান্তিক ধারার নৈকট্য দেখতে পেয়েছি এবং তার পক্ষে আমার অবস্থান ব্যক্ত করেছি। এটাই শেষ কথা নয়, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের অভিজ্ঞতা কীভাবে নগরকেন্দ্রিক আধুনিক কবিদের পাশ্চাত্য প্রভাবিত নগরদর্শনকে পরিবর্তন করে নিজস্ব বাস্তবতায় দেখতে সাহায্য করেছিল, সেকথার উল্লেখও প্রবন্ধে রয়েছে। প্রথম ধারায় গুরুত্বপূর্ণ কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, সিকদার আমিনুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ুন আজাদ, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, হেলাল হাফিজ এবং দ্বিতীয় ধারায় আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ রফিক, ওমর আলী, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর নাম উল্লেখ করেছি।
এই প্রসঙ্গেই বলি, মঈনুদ্দিন খালেদ তার আলোচনার শেষের দিকে পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ করে প্রবন্ধের একটি অংশে এসে পড়ছেন, “ষাট ও সত্তরের অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ কবিদের ভিতর মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, ফরহাদ মজহার, কামাল চৌধুরী, নাসিমা সুলতানা, তসলিমা নাসরিন প্রমুখ।”… হ্যাঁ, প্রমুখ দিয়ে আমি অনেককে ফ্রেমবন্দি করতে পারি বা আটকাতে পারি। কিন্তু এই কয়েকটা নামোচ্চারণের মধ্য দিয়ে বিষয়টা দেখা ঠিক হবে কিনা, এটা আমার কাছে প্রশ্ন ! যেমন আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, কামাল চৌধুরী, নাসিমা সুলতানা, তসলিমা নাসরিন … এই (নামগুলো) যদি থাকে, তাহলে প্রবন্ধকারের বিষয়টা একটু বিশ্লেষণ করে বলা দরকার, না হলে আমরা কিন্তু বিভ্রান্ত হব। আপনি লক্ষ করে দেখেন, এখানে তো নির্মলেন্দু গুণ নেই, আবুল হাসান নেই”… (পাশ থেকে সঞ্চালক ফিসফিস করে বললেন, “না আছে!”) তিনি পিছনের দিকে পাতা উল্টিয়ে দেখে বললেন, “উনি আগে টাচ করে গেছেন, কিন্তু তিনি পারম্পর্য রাখেন নি, বলেছেন তিনি নির্মলেন্দু গুণের কথা বলেছেন, পারম্পর্য রেখে বলেন নি, হঠাৎ করে শেষের দিকে বলেছেন।”
[ভিডিও # ৪, সময়কাল ১৭:৪২ – ১৮:৩৩ ]
লেখা না পড়ে পণ্ডিতি ফলানোর এই হচ্ছে করুণ দশা! আমি যে প্রমুখ দিয়ে অনেককে ফ্রেমবন্দি করিনি, বরং এর আগেই ব্যাখ্যাসহ অনেকের নামোল্লেখ করেছি, সেটা উপরের আলোচনাতেই স্পষ্ট। মঈনুদ্দিন একবার বললেন, “আবুল হাসান বলছেন, নির্মলেন্দু গুণ বলছেন, কিন্তু তিনি কোনো ক্যাটাগরি করেন নি।” তিনিই আবার পরে বললেন, “এখানে তো নির্মলেন্দু গুণ নেই, আবুল হাসান নেই” … আবার সেই তিনিই নিজের ভুল ঢাকার জন্য লেখককে দোষারোপ করছেন, “উনি আগে টাচ করে গেছেন … তিনি নির্মলেন্দু গুণের কথা বলেছেন, পারম্পর্য রেখে বলেন নি …।” বুঝুন ঠ্যালা! যে কেউ প্রবন্ধের ১ম পর্বের ৫ম অধ্যায় আগাগোড়া পড়লে দেখতে পাবেন সব কিছুই আমি পারম্পর্য মেনে আলোচনা করেছি। মঈনুদ্দিন খালেদ যে না পড়ে মন্তব্য করেন তার সবচেয়ে বড় প্রমান তিনি দু’বার আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেছেন যে আমি প্রবন্ধে কবি জসীম উদ্দীনের নাম উল্লেখ করিনি। অথচ আমার লেখায় দু’বার কবি জসীম উদ্দীনের নাম এসেছে। উদ্ধৃতি, “বাংলার বিপুল মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়ের জীবন ও ঐতিহ্য যার কাব্যে (নক্সীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট) সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে, তিনি বাংলার প্রাণের কবি জসীম উদদীন।” [পৃষ্ঠা-২৫] ১ম পর্বের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে লিখেছি, “বাংলা কবিতা যেন বাংলার আত্মা থেকেই উৎসারিত হয় এই বোধ থেকেই অধুনান্তিক কবিতা আদি চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের বৈষ্ণব ও শাক্তের অমৃতধারায় অবগাহন করে, লৌকিক কাহিনীকাব্যের রৌদ্রজল গায়ে মেখে পল্লীসাহিত্য ও কবিতার বিপুল ছায়ার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাণভরে সতেজ নিঃশ্বাস নেবার আশায়। মাথার উপরে রবীন্দ্রনাথের অসীম আকাশ ও দূরে-মিলিয়ে-যাওয়া জীবনানন্দ ও জসীম উদদীনের দিগন্ত।” [পৃষ্ঠা-৩৭] পাঠক দেখুন, কবি জসীম উদদীনের শুধু নামোল্লেখই নয়, কত গুরুত্বপূর্ণভাবে তাকে বিবেচনা করেছি, এই উদ্ধৃতি তার প্রমান।
মঈনুদ্দিন খালেদের বিকৃত পাঠ-প্রতিক্রিয়ার একটি উদাহরণ দেব। আমি যা লিখিনি, সেটাও তিনি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আকারে উত্থাপন করেছেন। আমার বইয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধ, ‘কে এই শক্তি প্রোষিতভর্তৃকা: জীবনানন্দের মানবসমাজ ও বিশ্বপ্ৰকৃতি পরিক্রমা’ নিয়ে শোয়েব শাহরিয়ার শুরুতেই যে মনোজ্ঞ আলোচনা করেন, তার সূত্র ধরে মঈনুদ্দিন খালেদ বলেন যে প্রবন্ধটি তিনি আগেও পড়েছেন যখন লেখাটি ‘একবিংশ’র নজরুল-জীবনানন্দ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তার অভিযোগ আমি বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের মানুষ (যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই) যারা মুখে মুখে গান, প্রবাদ-প্রবচন তৈরী করেন তাদের অশিক্ষিত বলে হেয় করেছি। মঈনুদ্দিন খালেদের বক্তব্য : ” তুষার গায়েনকে ধন্যবাদ জীবনানন্দ দেশের কবিতা নিয়ে যেটা করেছেন। এটার সাথে এড করার জন্যই বলছি … আপনি (তুষার) বললেন যে অশিক্ষিত মনের, অক্ষরজ্ঞান নেই। পুরো দেশটার জ্ঞান, মনীষা পুরোটাই তো ওরাল, ওরাল লিটারেচারের দেশ। আপনি গানগুলো বাদ দিলে, প্রবাদ-প্রবচনগুলো বাদ দিলে বাংলাদেশের সভ্যতাকে অনুধাবন করতে পারবেন না।”
[ভিডিও # ৪, সময়কাল ০১:৫৯ -০২:৪৭]
আমি চ্যালেঞ্জ করছি মঈনুদ্দিন খালেদকে, তিনি কী আমার লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাতে পারবেন, কোথায় আমি গ্রামীণ জনপদের মানুষদের অশিক্ষিত বলে হেয় করেছি? জীবনানন্দ দাশের ‘শ্যামলী’ কবিতার প্রথম পঙক্তি, ‘শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতো’─এই শক্তি কে, আমার লেখায় সেই শক্তিকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করি, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার তাঁর রূপকথার বই ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’-তে যে পঞ্চকন্যার (মধুমালা, পুষ্পমালা, কাঞ্চনমালা, মালঞ্চমালা, শঙ্খমালা) লোকগাঁথা সংকলন করেন যার শেষোক্ত কন্যা ‘শঙ্খমালা’ হচ্ছে সেই ‘শক্তি’ যাকে জীবননান্দ দাশ আধুনিক কালের ‘শ্যামলী’-র সাথে তুলনা করেছেন। আমার লেখায়, প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছি যে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’-কে বাঙ্গলার উপন্যাস/বঙ্গোপন্যাস হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। কেন তিনি রূপকথার বই ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’-কে বঙ্গোপন্যাস বলেছেন তার একটা ব্যাখ্যা তিনি এই বইয়ের ভূমিকায় লেখেন যা আমি প্রবন্ধের শেষে টীকা ও তথ্যনির্দেশ-এ উল্লেখ করি। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র লিখেছেন, “বাংলার মুদ্রাযন্ত্র সৃষ্টির পর বাঙ্গলার উপন্যাস জন্মগ্রহণ করিয়াছে। উপন্যাসের কলাকৌশল, চমৎকারিত্ব, ভাষা এবং বর্ণনভঙ্গী হইতে চরিত্রচিত্রণ প্রভৃতি এবং উহার কল্পনার নানামুখী গতি─সমস্তই পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং পাশ্চাত্য আদর্শের মধ্য দিয়া পরিশ্রুত হইয়া আসিয়াছে। ইহার পূর্ব্বে ‘উপন্যাস’ বলিয়া বাঙ্গলায় কিছু ছিল না। যাহা ছিল, আমার দেশ তাহাকে ‘কথা’ নাম দিয়াছিল। এই ‘কথা’, বাঙ্গালীর আপন প্রাণের নিতান্ত নিজস্ব সুরে একান্ত সহজভাবে বাজিয়া যাইত। অথচ, উপন্যাস এক্ষণে যে ক্ষেত্রে যাহা করিতেছে, তাহারও অপেক্ষা বিস্তৃত ক্ষেত্রে, গুরু দায়িত্ব রাশি এই ‘কথা’গুলির উপর ন্যস্ত ছিল। […] বঙ্গীয়সাহিত্য-পরিষদের সংশ্লেষে, বাঙ্গলা ভাষার যে-সকল শ্বাশত বস্তুর সন্ধান আমরা পাই, তন্মধ্যে বাঙ্গলার পল্লীর এই শ্রুতি-সাহিত্য (বা, লোকসাহিত্য), দেশ মর্ম্মের─অধিকাংশেরই অধিকারী। ইহার ‘নিরক্ষরা’ ভাষা, লিখিত ভাষার ন্যায় সুরীতিতে শ্রেণিবিভাগ করিয়া বাঙ্গলার আবালবৃদ্ধ বণিতার চিত্তক্ষেত্রের উপর সাহিত্যের এক বিরাট মন্দির গড়িয়াছিল। […] ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র সহিত সঙ্গতি রাখার নিমিত্ত এবং ‘গীতকথা’র সুর অনেকাংশেই পুরুষকণ্ঠের বলিয়া, কথাসাহিত্য বাঙ্গলার উপন্যাসের─’বঙ্গোপন্যাস’─’ঠাকুরদাদার ঝুলি’ নামকরণ।”
পাঠক দেখুন, এর প্রতিটি শব্দ দক্ষিণারঞ্জন মিত্রর। আমি নিজে থেকে কিছুই লিখিনি এবং দক্ষিণারঞ্জন মিত্রও এই লেখায় কোথাও গ্রামীণ জনপদের মানুষদের অশিক্ষিত বলে হেয় করেন নি, বরং বাংলার এই শ্রুতি-সাহিত্য/লোকসাহিত্য/’কথা’কে পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত উপন্যাসের থেকেও বেশি মূল্য দিয়েছেন। তিনি লিখছেন, “ইহার ‘নিরক্ষরা’ ভাষা, লিখিত ভাষার ন্যায় সুরীতিতে শ্রেণিবিভাগ করিয়া বাঙ্গলার আবালবৃদ্ধ বণিতার চিত্তক্ষেত্রের উপর সাহিত্যের এক বিরাট মন্দির গড়িয়াছিল।” এই বক্তব্যে কী গ্রামীণ জনগণকে অশিক্ষিত বলা হয়েছে, নাকি অক্ষরজ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও তারা যে লিখিত ভাষার শৃঙ্খলা এবং বিন্যাসরীতি প্রয়োগের ক্ষমতা রাখতেন, সেই শক্তি-সামর্থ্যকে শ্রদ্ধার সাথে মূল্যায়ন করা হয়েছে? তাই বলছি, কোনো লেখকের বক্তব্যের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে দেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা কী গর্হিত অপরাধ নয়?
আলোচনার এক পর্যায়ে এ প্রসঙ্গে মঈনুদ্দিন খালেদ আবারও ফিরে আসেন যখন শোয়েব শাহরিয়ারের সাথে তার কিছু কথোপকথন হয় এবং প্রশ্ন তোলেন : “এই বিষয়গুলোকে, পোস্টমডার্ন যেহেতু আমাদের মূল বিষয়, ‘প্রোষিতভর্তৃকা’ আসলে কে? যে নারীর স্বামী বিদেশে থাকে। কোন নারীর স্বামী বিদেশে থাকে? এটা তো এসেছে, আমি যতদূর জানি, রাধা-কৃষ্ণ বিষয় থেকে। কৃষ্ণ যখন নেই, তখনই তো রাধা প্রোষিতভর্তৃকা। তাই না? […] আমার কাছে মনে হয়েছে যে এই বিষয়টিগুলোকে তিনি (তুষার গায়েন) পশ্চিমের ভাবনা থেকে বৈষ্ণব, মঙ্গলকাব্য, পালা এগুলো নিয়ে (যে বলেন নাই, তা নয়,) বলেছেন। বৈষ্ণব এবং শাক্তের কথা বলেছেন। এগুলো খুব জরুরি ! আমি খালি একটা জিনিস বলতে চাই যে এই বিষয়গুলো আমরা আরো সহজ করে বলি না কেন?
[ভিডিও #৪, সময়কাল ১১:০১-১১:৫৭]
জীবনানন্দ দাশের ‘শ্যামলী’ কবিতাটি যদি কেউ মনোযোগ দিয়ে পড়েন এবং তাঁর অন্যান্য যেসব কবিতার উল্লেখ আমি এই আলোচনায় করেছি, তাহলে সচেতন পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন যে জীবনানন্দ পুঁজিবাদের আদি পরিক্রমার ভেতর যে অভিযান ও নি:সঙ্গতা দেখেছিলেন তাকে বাংলার সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা বাণিজ্যযাত্রার সাথে তুলনা করলেই সম্পূর্ণ হয় না, কেননা ‘সুদূর নতুন দেশে সোনা আছে ব’লে যে ‘রক্ত নদী’কে তিনি উৎসারিত হতে দেখেছেন তার সাথে রয়েছে পশ্চিমা পুঁজিবাদী সম্প্রসারণের ঐতিহাসিক সংযোগ যার প্রভাব এসে পড়ছে আমাদের কাল ও অঞ্চলে। সেখানেই আজকের ‘শ্যামলী’ ও সেকালের ‘শক্তি’র সংযোগ। সেটা কৃষ্ণের সাথে রাধার বিচ্ছেদ অর্থে যে প্রোষিতভর্তৃকা, তার কী সম্পর্ক? সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই শব্দকে আমি ব্যবহার করেছি যার সাথে জীবনানন্দ বর্ণিত বণিক সভ্যতার বিকাশ ও সংকটের সম্পর্ক নিহিত। বাংলার রূপকথা, লোকগাথার ভিতর অনুসন্ধান করে আধুনিক কবিতার চরিত্র অনুসন্ধান কী করে পশ্চিমা ভাবনা হয়? এটাই তো প্রাচ্যের দৃষ্টিতে প্রাচ্যকে দেখার চোখ, নিজের শেকড় অনুসন্ধানের প্রত্যয়।
মঈনুদ্দিন খালেদের অভিযোগ, “আরেকটা প্রেক্ষাপট, বিষয় নিয়ে তুষার গায়েন যখন বলছেন, এটার মধ্যেও আমি ধ্রুপদী ডাইসটা দেখতে পেয়েছি। একটু সহজ করে যদি আমরা অনুধাবন করতে চাই, সেটা হচ্ছে এই যে বাউল, বাউল সঙ্ঘ, তারা যে মনীষার গ্রন্থিতে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বেঁধে রেখেছিলেন, রীতিনীতি, ন্যায়-অন্যায় অর্থাৎ বিবেকবোধের যে বিশাল গ্রন্থিতে এই সমাজকে বেঁধে রেখেছিলেন আউল, বাউল, পীর, ফকির, দরবেশ, আমরা আধুনিক হতে গিয়ে অনেক সমালোচনা করে ফেলেছি। সব পীরই খারাপ, আমরা যেমন বলি, এটা যে কত ভুল, আপনি পীর বাদ দিলে বাংলার সভ্যতা বুঝতেই পারবেন না, বাংলাদেশের সভ্যতা বুঝতে পারবেন না, সম্ভব না। দরবেশদের কন্ট্রিবিউশন চিন্তা করেন, ফকিরদের কন্ট্রিবিউশন, বাউলদের কন্ট্রিবিউশন … ‘সুফি-ইজম’ (অনুষ্ঠানের সঞ্চালক শওকত হোসেন শব্দটি পাঞ্চ করেন) … তারপর এর থেকে বেরিয়ে এসে সহজিয়া পথ যেগুলো তৈরী হয়েছে, সেই জিনিসগুলো কিন্তু এইখানে অতটা ক্লিয়ার করা হয়নি। জিনিসগুলো পরিস্ফুট হলে ভালো হ’ত। আমি পোস্টমডার্ন যখন বলছি, দেরিদা, ফুঁকো, বদ্রিলারের মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছি, আমি তাহলে পোস্টমডার্ন হচ্ছি কী করে? […] পার্থক্যটা আপনি দেখেন, ব্যাপকভাবে কবিয়ালদের ব্যাপারটা অনুপস্থিত। কবিয়ালরাই কিন্তু সমাজে কী ঘটছে, পাশ্চাত্য এবং পূর্ব দেশজ, বিশেষ করে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্যের যাপনের মধ্যে যে মূল্যবোধ আছে সেটার সংঘর্ষ, এটা কিন্তু প্রথম নাড়া দেয় কবিয়ালদের মধ্যে। […] পোস্টমডার্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে কবিয়ালরা কী বলছেন, সেটা কিন্তু আমরা উল্লেখ করি না। [ভিডিও # ৪, সময়কাল ০২:৫২-০৫:৪৬ ]
মঈনুদ্দিন খালেদের কাছে প্রশ্ন, আমার প্রবন্ধে কোথায় তিনি আউল, বাউল, পীর, ফকির, দরবেশ নিয়ে সমালোচনা খুঁজে পেয়েছেন? আমার লেখায় কোথায় আমি পীরদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছি? যা আমি লিখিনি, তা নিয়ে এই রকম অভিযোগ তোলার উদ্দেশ্য কী? এর জবাব আমার প্রবন্ধ থেকেই দিচ্ছি, “সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে আরব বণিকদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূত্রে দক্ষিণ-ভারতে হিন্দু-মানস ও সংস্কৃতির সাথে ইসলামী সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া ঘটে এবং কালপ্রবাহে তার অভিঘাত বাংলায় এসে পড়ে। নবম শতক থেকে সুফিসাধকরা এদেশে আসতে শুরু করেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। বর্ণবাদের শিকার নিম্নবর্গের অনেক মানুষ মুক্তির আশায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি সুলতানের বাংলা বিজয়ের পর ইসলামের দ্রুত প্রসার ঘটে। পাশাপাশি হিন্দু ধর্মের দুটো শাখা বৈষ্ণব ও শাক্ত মতবাদ বা সাধনার প্রতিও মানুষের আগ্রহ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। বৈষ্ণব মতবাদ/সাধনা ষোলো শতকে চৈতন্যদেবের ভাবান্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতা অর্জন করে। বর্ণশাসিত হিন্দুসমাজের আচার-সংস্কার ও কঠোর অনুশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে সাম্য, প্রেম ও ভক্তির প্লাবন বইয়ে দেন চৈতন্যদেব যা এক নতুন মানবধর্মের সূত্রপাত করে বসে।” (১ম অধ্যায়-৩য় পর্ব, পৃষ্ঠা ১৮-১৯) আমি এই অধ্যায়ে চর্যাপদের বৌদ্ধ শূন্যবাদ ও তন্ত্র এবং বৈষ্ণববাদের জীবাত্মা-পরমাত্মার তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছি। আলাদাভাবে বাউলতত্ত্ব ব্যাখ্যা না করলেও পাঠক তার যোগসূত্র অনুভব করতে পারেন, কারণ বাংলাদেশের আউল-বাউলরা যে সমন্বয়ধর্মী আধ্যাত্মিকতার চর্চা করেন তার মধ্যে ইসলামের সুফিবাদ, বৌদ্ধ শূন্যবাদ ও বৈষ্ণববাদ একাকার হয়ে আছে। আর বৈষ্ণববাদের চর্চা তো হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কবি ও বাউলদের মধ্যেই রয়েছে। প্রসঙ্গত তার পূর্ব অভিযোগের সূত্র ধরে বলি, আমি যেহেতু আলাদাভাবে কোনো বাউলের নাম লিখি নি, তাই লালন সাঁইজীর নাম প্রবন্ধে আসেনি, কিন্তু বাউলধারার কথা উল্লেখ করায় তিনি স্বাভাবিকভাবেই এর অন্তৰ্ভূক্ত। একইভাবে কবিয়ালদের কথা আমার লেখায় উল্লেখ করেছি। লেখা থেকেই উদ্ধৃতি দিচ্ছি, “মুসলিম কবিরাই সর্বপ্রথম ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত লৌকিক কাহিনী সৃষ্টি করেন। আলাওলের পদ্মাবতী, ছয়ফুল মুল্ক্; দৌলত কাজীর লোর চন্দ্রাণী এবং কোরেশী মাগনের চন্দ্রাবতী এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলা কাব্য যখন রাজসভা ও অভিজাতের সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে বাংলায় জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনে ঢুকে পড়ে তখনই রচিত হয় বাংলার প্রাণের কাব্য পল্লীগীতিকা (পূর্ববঙ্গ গীতিকা, ময়মনসিংহ গীতিকা)। জারি, সারি, মুর্শিদা, ভাটিয়ালি, বাউল, গম্ভীরা, পুঁথি-পাঁচালি, যাত্রাপালা, কবিকথা বাংলার বিস্তীর্ণ কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর একান্ত প্রাণের সৃষ্টি। নাম-না-জানা অসংখ্য গান, পালা পল্লী-প্রান্তরে ছড়িয়ে রয়েছে যার খুব সামান্যই সংগৃহীত হয়েছে। মহুয়া, চাঁদ বিনোদের পালা, দেওয়ান মদিনা, মহীপালের গান, সোনা বিবির পালা, মহিষাল বন্ধু, মানিক তারা, আয়নাবিবি, ভেলুয়ার পালা ইত্যাদি গান ও পালার অধিকাংশ কবি ও গীতিকার নিরক্ষর; কিন্তু তাঁদের স্বতোৎসারিত কবিপ্রতিভা ও অন্তরের ঐশ্বর্যগুণে সৃষ্ট এইসব রচনা (শ্রুতিলিখন) কালজয়ী হয়েছে।” (পৃষ্ঠা ২০) মঈনুদ্দিন খালেদ যেভাবে প্রত্যাশা করছেন যে পোস্টমডার্ন প্রেক্ষিত নিয়ে কথা বলতে গেলে জসীম উদদীনের কবিতা, কবিয়ালদের বাহাস অথবা ময়মনসিংহ গীতিকার চরণ ধরে ধরে টিকা-টিপ্পনী কেটে পাঠকদের মগজে ঢুকিয়ে দিতে হবে, এই লেখার পরিসরে সেটা সম্ভব ছিল না; কিন্তু আমি সবকিছু যথাসম্ভব উল্লেখ করে গেছি। আমার কাজ ছিল বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একটা বিস্তৃত প্রেক্ষাপটকে উন্মুক্ত করা যাতে পাঠক কোথাও গোল হয়ে বসে যাত্রা বা পালা উপভোগ করা নয়, বরং সব নিয়ে সামনে চলার দিক নির্দেশনা পান।
বাংলার আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য এই কালের জীবনবাদী অধুনান্তিক ধারার কবিরা কীভাবে আত্মস্থ করছেন তাদের কবিতায়, সেকথার উল্লেখও রয়েছে আমার লেখায়, “কবিদের ভেতরে অনেকেই লিখছেন মগ্ন চৈতন্যের কবিতা যেখানে আত্মানুসন্ধানের আকুতি থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব ও সত্তা সম্পর্কিত অনুধ্যানের এলাকায় বৈষ্ণব অথবা বাউলতত্ত্বের মরমিয়া দর্শনের সাথে এসে মিশে যাচ্ছে অতি সাম্প্রতিক কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের অধীত জ্ঞান। বস্তুর আণবিক বিশ্ব ও তার অন্তর্নিহিত গতি ও ঘূর্ণন, মহাকাশ, মহাবিশ্ব, টাইম ও স্পেসের অনন্ত রহস্য কবিদের বোধি ও প্রজ্ঞায় এসে নতুন অনুভবের জগত তৈরি করছে। অধিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের যুগপৎ সন্ধিতে দাঁড়িয়ে, আবেগ ও যুক্তির দ্বৈরথে বিকশিত হতে চাইছে অধুনান্তিক কবিতা। বিজ্ঞান-বিজড়িত প্রচুর শব্দ ও অনুষঙ্গ সহজেই গৃহীত হচ্ছে সাম্প্রতিক কবিতায়।” (পৃষ্ঠা ৩৯) প্রবন্ধের ২য় অধ্যায়ের শেষ পর্বে, জীবনবাদী অধুনান্তিক ধারায় বেশ কিছু কবিতা/ কবিতাংশ সংকলিত হয়েছে যেখানে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের ‘হজরত বায়েজিদ বোস্তামীর নিকট প্রার্থনা’ কবিতায় পরম সুফি-সত্তার সাথে জিজ্ঞাসাদীর্ণ মানবসত্তার আলাপ (পৃষ্ঠা ৮৫), তুষার গায়েনের ‘আদিদর্শন’ ও দাউদ আল হাফিজের ‘আনাবাস’ কবিতায় সুফিবাদী জগদ্দর্শনের স্বপ্ন-অভিজ্ঞান (পৃষ্ঠা ৬৮), শান্তনু চৌধুরীর ‘অভয় মিত্রের ঘাটে’ কবিতায় তন্ত্রসাধনার মনস্তত্ত্ব (পৃষ্ঠা ৬৭), মাসুদ খানের ‘পরমাণু’ কবিতায় বৈষ্ণব দর্শন (পৃষ্ঠা ৬৬), মোহাম্মদ সাদিকের ‘হাসান রাজার দিলারা’ কবিতায় (পৃষ্ঠা ৮৫) মরমিয়া দর্শন ও দেহতত্ত্ব ইত্যাদি বাংলার লোকায়ত সাধনমার্গের ঐতিহ্য ধারণ করে কীভাবে নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে তা মঈনুদ্দিন খালেদের পড়ে দেখার সময় হয়নি। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন বাংলায় এখন মানবতাবাদী পীরদের থেকে মানবতা বিরোধী পীর ও ধর্মব্যবসায়ীদেরই রমরমা, যেমন: আটরশির পীর, শর্ষিনার পীর, চরমোনাইয়ের পীর, দেলওয়ার হোসেন সাঈদী প্রমুখ ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার নামে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী কর্মকাণ্ডের হোতা যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার সহযোগী ছিল। শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনেও, সুফিবাদ ও ভাবান্দোলনের কথা বলে মৌলবাদী চিন্তাচেতনাকে তরুণদের মধ্যে উস্কে দেয়ার মতো জ্ঞানপাপী ফরহাদ মজহারকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সমালোচনা এদেরকেই করা হয়ে থাকে, মানবতাবাদী পীর বা আউলিয়াদের নয়।
মঈনুদ্দিন খালেদ যে অভিযোগ করলেন, “আমি পোস্টমডার্ন যখন বলছি দেরিদা, ফুঁকো, বদ্রিলারের মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছি, আমি তাহলে পোস্টমডার্ন হচ্ছি কী করে?” তিনি যদি লেখাটি ঠিকভাবে পড়ে মন্তব্য করতেন, তাহলে দেখতে পেতেন যে প্রবন্ধের ১ম পর্বে আমি সামগ্রিকভাবে বিষয়ের অবতারণা করেছি; দ্বিতীয় পর্বে পশ্চিমা ‘পোস্টমডার্ন’ তাত্ত্বিক (ফার্দিনান্দ দ্য সস্যুর, জাক দেরিদা, মিশেল ফুকো, জাঁ-ফ্রাঁসোয়া লিওতার, রোলাঁ বার্থ, মার্টিন হাইডেগার, য়ূর্গেন হেবারমাস, এডওয়ার্ড সাঈদ, ইহাব হাসান প্রমুখ) ও পশ্চিমানুসারী বাঙালি পোস্টমডার্ন তাত্ত্বিক (মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী, রুদ্র কিংশুক, প্রভাত চৌধুরী প্রমুখ)-এর পাশাপাশি দেশলগ্ন জীবনবাদী উত্তর আধুনিক/ অধুনান্তিক তাত্ত্বিকদের (অমিতাভ গুপ্ত, অঞ্জন সেন, তপোধীর ভট্টাচার্য, কলিম খান,পার্থপ্রতিম বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ) মতবাদ ও ইশতেহার সমূহ উল্লেখ করেছি যাতে বিষয়ের ব্যাপ্তি ও চিন্তার পার্থক্য বুঝতে সুবিধা হয়। বিষয়গুলো ধৈর্য্য ধরে ও মনোযোগ সহকারে পাঠ না করে তিনি কীভাবে এ প্রবন্ধের মূল্যায়ন করবেন?
[চলবে]
লেখক আড্ডার ভিডিও #২ দেখতে ক্লিক করুন
লেখক আড্ডার ভিডিও #৩ দেখতে ক্লিক করুন
লেখক আড্ডার ভিডিও #৪ দেখতে ক্লিক করুন
কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী
জন্ম – ৪ জুলাই ১৯৬৭, বরিশাল। শৈশব থেকেই বাবার চাকরীসূত্রে ঘুরেছেন দেশের বিভিন্ন শহর; মধ্য আশিতে স্নাতক শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান একদা চেতনা সংক্রামক, স্বপ্নরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে। শিক্ষা শেষে নব্বইয়ের শুরুতে দেশে ফিরে স্থাপত্য পেশার পাশাপাশি নিয়মিত কাব্যচর্চা শুরু করেন এবং একবিংশ, নিসর্গ, বিপ্রতীক ইত্যাদি লিটল ম্যাগাজিনসহ দেশের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা ও দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন সাহিত্য, স্থাপত্য, সমকালীন দর্শন ও চিন্তা বিষয়ক প্রবন্ধ। ২০০৬ সাল থেকে উত্তর আমেরিকায় অভিবাসী হিসেবে বসবাস করছেন কানাডার প্রাণকেন্দ্র, সাংস্কৃতিক ও বানিজ্যিক শহর টরন্টো-তে। পেশায় স্থপতি; ‘দ্য ওডেসা স্টেট একাডেমী অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এণ্ড আর্কির্টেকচার’ থেকে স্থাপত্যে স্নাতকোত্তর (১৯৯২) এবং আমেরিকার ‘দ্য নিউইয়র্ক সিটি কলেজ অব দ্য সিটি ইউনিভার্সিটি’ থেকে আরবান ডিজাইন-এ মাস্টার্স করেছেন (২০০৮)।
প্রকাশিত কবিতার বই – নীলভবহ্রদ (১৯৯৭), বৃষ্টির অন্তর ত্রাস (২০০৩), দ্বিমেরুযোজন (২০১২)। যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন অধুনান্তিক বাংলা কবিতার অনুবাদ সংকলন : Postmodern Bangla Poetry 2003, প্রবন্ধের বই – বাংলা কবিতা : অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান (২০১৯)