| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ সাহিত্য

বই না পড়ে অর্থোদ্ধার, আলো নয় তা অন্ধকার (শেষ পর্ব) 

আনুমানিক পঠনকাল: 18 মিনিট

লেখক আড্ডায় ‘বাংলা কবিতা: অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ গ্রন্থ নিয়ে আলোচকদের বক্তব্যের জবাব 

গৌরচন্দ্রিকা 

শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ‘লেখক আড্ডা’ নামে কবি ও লেখকদের একটি সংগঠন আমার প্রবন্ধের বই ‘বাংলা কবিতা: অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ নিয়ে ঢাকাস্থ কার্যালয়ে একটা আলোচনা/আড্ডার আয়োজন করে যেখানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক, কবি, সম্পাদক ও সমালোচক যথাক্রমে শোয়েব শাহরিয়ার, মঈনুদ্দিন খালেদ, এজাজ ইউসুফী, আলমগীর খান, আফরোজা সোমা এবং ফরিদুল আলম। আলোচনাটি ফেসবুকে লাইভ প্রচারিত হয়, ফলে দেশে এবং দেশের বাইরে অনেকেই সেটা দেখার ও শোনার সুযোগ পান। আমি টরোন্টো থেকে ফেসবুকের এই লাইভ আড্ডায় যুক্ত হয়ে আলোচকদের আলোচনা শুনি। বইটিতে দীর্ঘ কলেবরের ৫ টি প্রবন্ধ এবং একটি সাক্ষাৎকার আছে যার ভেতর মাত্র দু’টি প্রবন্ধ নিয়ে আলোচকরা কথা বলেন ও ব্যাখা-বিশ্লেষণ করার অবকাশ পান। এদের মধ্যে তিনজন আলোচক মূলত বইটির নাম প্রবন্ধ ‘বাংলা কবিতা : অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ নিয়েই তাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখেন। তাদের কথা শুনে আমি বুঝতে পারি যে তাদের কেউই প্রবন্ধটি ঠিকভাবে পড়ে আসেন নি এবং না পড়েই মনগড়া, বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য করেছেন যা শ্রোতাদের কাছে আমার লেখা সম্পর্কে ভুল বার্তা দেয়। স্বভাবতই তাদের কথার জবাব দেয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। আড্ডার শেষে আলোচকদের কথার জবাব দিতে সঞ্চালক আমাকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে না পারায়, আমি এর লিখিতভাবে জবাব দেবার কথা বলি। ভিডিও থেকে আলোচকদের কথা শুনে, প্রতিটি প্রসঙ্গ নিয়ে লিখিত জবাব দেয়া ছিল সময়-সাপেক্ষ কাজ যা অনুমিত সময়কে ছাপিয়ে যায় এবং এর মধ্যে মহামারী করোনা এসে আমাদের বন্দি করে, মনোযোগ ছিনিয়ে নেয়। লেখাটি এক পর্যায়ে এসে শেষ হয়ে গেলেও, সবার মানসিক স্বাস্থ্য বিবেচনা করে এটি প্রকাশ করার জন্য আমি অপেক্ষা করি। পুরো আলোচনাটি মোট ৩ টি অংশে ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল। আমি আলোচকদের পুরো বক্তব্য বিষয় অনুযায়ী (পয়েন্ট টু পয়েন্ট) সাজিয়ে জবাব দেবার চেষ্টা করেছি এবং সেই সাথে ভিডিও ক্রম অনুযায়ী যে-পয়েন্টে তারা কথা বলেছেন তার সময়কালও উল্লেখ করেছি। পাঠকদের কথা ভেবে প্রতিটি পর্বের শেষে আলোচনার ভিডিওগুলো সংযুক্ত করা হয়েছে। লেখাটির আয়তন ও পাঠকদের ধৈর্য্যের কথা বিবেচনা করে সাহিত্যের অনলাইন কাগজ ‘ইরাবতী’ এটি তিন পর্বে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আজ তার শেষ পর্ব প্রকাশিত হ’ল। 


লেখকের জবাব: শেষ পর্ব 

এজাজ ইউসুফী বলেছেন: “আজকে আধুনিক কবিতা এমন এক চূড়ায় অবস্থান নিয়েছে, সেখান থেকে তার পতন শুরু হয়েছে, তার অবক্ষয় শুরু হয়েছে, তার নঞর্থকতার মধ্য দিয়ে, তার রিরংসা, যৌনতা, তার শব্দের সংকুচিত করবার যে প্রবণতা, সবকিছুর মধ্য দিয়ে সে নিজেকে ডিক্লাইনে নিয়ে গেছে, পতন হচ্ছে তার। এই পতন থেকে আমরা যারা বাংলা বাংলা কবিতার এক হাজার বছরের ইতিহাসকে আমরা নিজেদের মধ্যে ধারণ করি, অনুভব করি, সবাইকে নিয়ে আমাদের চেষ্টা হচ্ছে যে এটির মধ্য দিয়ে উত্তর আধুনিক চেতনা — এই ‘উত্তর’ পোস্টমডার্ন অর্থে নয়, ‘পোস্ট’ বাংলা করলে ‘উত্তর’ হয়, কিন্তু এটি এসেছে আমাদের প্রাচীন ভারতীয় ‘উত্তর’ অর্থাৎ উত্তরণ থেকে, আমরা আধুনিকতার যে শিখর স্পর্শ করেছি, সেটির ডিক্লাইন হচ্ছে, অধঃপতন হচ্ছে, সেখান থেকে আমরা উত্তরণ চাই। সে অর্থে আমরা বাংলা কবিতাকে স্বভূমির দিকে নিতে চাই এবং স্বসমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। শাহিদ আনোয়ার প্রথম সংখ্যায় লিখেছিলেন, “আমরা আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হয়েছি, কে আর আছে এমন সুন্দর”… এটা আধুনিক কবির পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না, আল্লাহ শব্দটি তাদের কাছে পরিত্যাজ্য ছিল।” 

ভালো কথা ! এজাজ যদি আমার লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়তেন তাহলে দেখতে পেতেন যে প্রবন্ধের দ্বিতীয় পর্বে তার প্রদত্ত ‘উত্তর আধুনিক’ শব্দের এই ব্যাখ্যা আমি উল্লেখ করেছি যা অঞ্জন সেন তাঁর ‘উত্তর আধুনিকতা’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন: ‘উত্তর আধুনিক’ শব্দটি নিয়ে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে কিছু প্রশ্ন উঠেছে, বিতর্কও হয়েছে। কেউ কেউ ইয়ুরোপ আমেরিকার POST MODERNISM-এর আদলে উত্তর আধুনিকতাকে তার কার্বন কপি বলে ভেবেছেন। ‘উত্তর’ শব্দটি অনেকান্ত অর্থবাচক, পরবর্তী একটি অর্থ, প্রচলিত অর্থ। কিন্তু কোনো শব্দের অর্থই অনড় অচল নয়। শব্দের অর্থও পরিবর্তিত হয়। ‘উত্তর’ শব্দটি ভারতীয় দর্শন থেকে নেওয়া, সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা এই শব্দটির ব্যবহার করেছি ‘উত্তরণ ঊর্ধ্বে’ অর্থে। অর্থাৎ আধুনিকতা থেকে উত্তরণ (ইউরোকেন্দ্রিক-ঔপনিবেশিক আধুনিক)-আধুনিকতার ঊর্ধ্বে। … উত্তর আধুনিকতাও এভাবে উত্তর শব্দের আরেকটি অর্থ তৈরী করেছে। পশ্চিমের সাহিত্যতত্ত্ববিদদের অনেকেই মনে করেন ইয়ুরোপ আমেরিকা ভূখণ্ডের বাইরে নোতুন কোন সাহিত্যভাবনা, সাহিত্যতত্ত্ব থাকতে পারে না, থাকলে তা পশ্চিমেরই অনুসরণ। বাঙালির উত্তর আধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব এ বিষয়ে সামান্য হলেও একটি প্রশ্ন তুলতে পেরেছে। অগাষ্ট ১৯৯১-তে জাপানের টোকিও-এ অনুষ্ঠিত তুলনামূলক সাহিত্যের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উত্তর-আধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব আলোচিত হয়। ঐ সম্মেলনের বিদায়ী সভাপতি বিখ্যাত সাহিত্যতত্ত্ববিদ ডি ডাব্লু ফকেমা উত্তর আধুনিকতাকে ‘UTTAR MODERNISM’ বলে আখ্যাত করেছেন।” প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে প্রবন্ধের ১ম পর্বে আমি বিষয়ের (পোস্টমডার্ন/ উত্তর আধুনিক/ অধুনান্তিক) সামগ্রিক ব্যাখ্যা করেছি ; দ্বিতীয় পর্বে পশ্চিমানুসারী ‘পোস্টমডার্ন’ এবং স্বভূমির জীবনবাদী অধুনান্তিক (উত্তর আধুনিক) ধারার বিভিন্ন মতবাদ ও ইশতেহার উল্লেখ করেছি। এতে অন্তৰ্ভূক্ত হয়েছেন উল্লেখযোগ্য পশ্চিমী ও বাংলাভাষী ‘পোস্টমডার্ন’ এবং বাংলার নিজস্ব ধারার উত্তর আধুনিক/ অধুনান্তিক তাত্ত্বিকবর্গ। বিষয়গুলো ধৈর্য ধরে, মনোযোগ সহকারে আলোচকদের পাঠ করা দরকার ছিল। এজাজ কবিতাকে স্বভূমি ও স্ব-সমাজের দিকে নিতে চান এবং স্ব-সমাজ বলতে তিনি ধর্মীয় পরিচয় অর্থাৎ মুসলমান সমাজের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি ‘লিরিক’-এর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত কবি শাহিদ আনোয়ারের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন যে আল্লাহ শব্দটি আধুনিক কবিদের কাছে পরিত্যাজ্য ছিল। তাঁর এই অভিযোগ কতটা সত্য? প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আমার প্রবন্ধে কোথাও কী বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠির জীবনাচার, ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি কবিতায় গৃহীত/ চর্চিত হওয়া নিয়ে কোনো সমালোচনা বা সংশয় প্রকাশিত হয়েছে? হয়ে থাকলে সেটা উল্লেখ করুন এবং না হয়ে থাকলে এই প্রসঙ্গের অবতারণা করার কী অর্থ? দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ইসলাম ধর্মের অনুষঙ্গ যতক্ষণ পর্যন্ত জীবন ও সংস্কৃতির অনিবার্য প্রকাশ হিসেবে বাংলা কবিতায় এসেছে, ততক্ষণ এই নিয়ে কেউ কোনো সমালোচনা করেনি। সমালোচনা হয়েছে যখন তাকে বাংলার সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির প্ৰতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে এবং ধর্মভিত্তিক সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চাকে কৃত্রিমভাবে জারি করার চেষ্টা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ইসলামী সাহিত্য করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল যার বরকন্দাজ ছিলেন ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা, তালিম হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান খান প্রমুখ তা ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে উত্থিত অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী সাহিত্য-সংস্কৃতির জোয়ারে ভেসে যায়। তার অর্থ এই নয় যে আধুনিক কবিদের লেখায় ইসলামী শব্দ, মিথ, রূপকল্প ইত্যাদি অবাঞ্ছিত হয়ে গিয়েছিল। নজরুলের অজস্র কবিতায় ইসলামী শব্দ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ‘আল্লাহ’ শব্দের ব্যবহার হয়েছে, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেনি। নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘খেয়াপাড়ের তরণী’-তে আল্লাহ শব্দের উচ্চারণ তো আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে আছে, ‘কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা/ দাড়ি মুখে সারি গান লা-শরিক আল্লাহ।’ নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ‘দাস বংশ’-এ দেখুন আঞ্চলিক ভাষার সংলাপে ‘আল্লাহ’ শব্দের প্রয়োগ : “হায়াৎ-মউত, রিজিক-দৌলত সবই তো আল্লাহর হাতে,/ বুজলা জমিলা বিবি, আহ, কাছে আহ, ভয় পাও কেরে?” এইভাবে খুঁজলে বহু আধুনিক কবির কবিতায় ‘আল্লাহ’ শব্দের যথাযথ প্রয়োগ খুঁজে পাওয়া যাবে। আল মাহমুদ তাঁর কাব্যজীবনের প্রথম দিকে সোনালী কাবিন, লোক-লোকান্তর, কালের কলস ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে সরল ধর্মবিশ্বাসের অনুষঙ্গ হিসেবে প্রচুর ইসলামী শব্দ, মিথ, রূপকল্প ব্যবহার করেছেন যা গৃহীত ও প্রশংসিত হয়েছে, কিন্তু তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন যখন লৌকিক ধর্মবিশ্বাসের সরল সৌন্দর্য ভেঙে মৌলবাদী চিন্তাচেতনার প্রচারক হয়েছেন। আমি নিজেও বেশ কিছু কবিতায় ইসলামী মিথের ব্যবহার করেছি যার মধ্যে অন্যতম ‘আদিদর্শন’, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীলভবহ্রদ’-এর দীর্ঘতম কবিতা, যার অংশ বিশেষ এই প্রবন্ধে উদ্ধৃত হয়েছে। 

এজাজ ইউসুফী আমার বইটি দেখিয়ে বলেন: “এখানেও যে সমস্ত কবিতা পোস্টমডার্ন বলে ছাপা হয়েছে, সেখানেও দেখবেন যে আমাদের জীবনের কথা বলা হচ্ছে, আমাদের প্রাচীন সমাজের কথা বলা হচ্ছে, মিথের বিনির্মাণ করা হচ্ছে, আমাদের সংস্কৃতির কথা বলা হচ্ছে, ধর্মের অনুষঙ্গের কথা বলা হচ্ছে এবং আমাদের যে রিচুয়ালগুলো আছে এবং আমাদের ফকির, দরবেশ … এবং আমাদের, আমরা যে, ওরা পশ্চিমারা খুব কঠিনভাবে দর্শনবাদী, আমরা সবসময় আবেগবাদী, আমরা সবসময় মরমীবাদী। সেই মরমী বিষয়গুলো এখন যদি আধুনিকরা বলে তুমি মরমীবাদ মানে অনাধুনিকতা, পশ্চাৎপদতা, ওই যে কুপমণ্ডুকতা, আমরা সেটি মানতে রাজী না। […]  আমরা মডার্নিজমকে ছাড়িয়ে গিয়ে, তার উত্তরণের যে প্ৰচেষ্টা নিয়েছি সেটিকে না করে, আবারও ড. আনিসুজ্জামান একটি লেখা লিখেছিলেন অঞ্জন সেনের একটি প্রবন্ধ পড়ে ‘হাস্যমুখে দাস্যসুখ’, আমাদের এই বাঙালির যে হাস্যমুখে দাস্যসুখ অর্থাৎ আবারও আমরা পশ্চিমের যে দার্শনিক ভাবনা, চিন্তাভাবনা সেটিতেই আবার মাথা ঢুকাব?” 

আমি এর আগেই মঈনুদ্দিন খালেদের কথার জবাবে মরমীবাদ নিয়ে আমার বক্তব্য পরিস্কার করেছি, তাই এ বিষয়ে পুনরাবৃত্তি অবান্তর। শুধু বলব যে আমি মরমীবাদের বিরুদ্ধে নই, কিন্তু মরমীবাদের ছদ্মবেশে যেকোনো মৌলবাদী চিন্তা ও তৎপরতার বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে এটাও তো বলতে হয় যে পশ্চিমে পোস্টমর্ডানিজম নিয়ে যা কিছুর চর্চা চলছে তার সবকিছুই কী নেতিবাচক, সেই চিন্তাদর্শনের সাথে এজাজ কথিত দেশজ ‘উত্তর আধুনিক’ তত্ত্বের সবকিছুই কী বিরোধাত্মক, নাকি এমন কিছু আছে যা আমাদের চিন্তাপদ্ধতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করার দাবি রাখে? এজাজ যদি পশ্চিমের দার্শনিক চিন্তাভাবনায় একেবারেই মাথা ঢুকাতে না চান, তাহলে ‘লিরিক’-এর উত্তর আধুনিক সংখ্যাগুলোতে তিনি পশ্চিমী পোস্টমডার্ন তাত্ত্বিকদের লেখার অনুবাদ ছাপেন কেন? কেনইবা বাঙালি উত্তর আধুনিক তাত্ত্বিকরা গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমী পোস্টমডার্ন তাত্ত্বিকদের চিন্তাদর্শন নিয়ে গুরু-গম্ভীর আলোচনা করেন? ‘লিরিক উত্তর আধুনিক কবিতা সংখ্যা ২’-এ, নব্বই পৃষ্ঠার একটি ক্রোড়পত্রে ৬ টি প্রবন্ধ সঙ্কলিত হয়েছে যথাক্রমে : আধুনিকোত্তর নন্দন – তত্ত্ব ও প্রয়োগ/ তপোধীর ভট্টাচার্য, আধুনিকোত্তরবাদ ও স্কিজোফ্রেনিক ভাষা/ অনুপম ত্রিবেদী, অধুনান্তিক এলাকা/ প্রবাল দাশগুপ্ত, আধুনিকতা- একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প/ ইয়েরগেন হ্যাবারমাস (বাংলা অনুবাদ: জিললুর রহমান), আধুনিকোত্তর ও বিলম্বিত আধুনিক : প্রয়োজনীয় সংজ্ঞাসমূহ/ চার্লস যেঙ্কস (অনুবাদ: টিটু কাজল), জাক দেরিদা বা দর্শনের আত্মহত্যা/ অমল বন্দ্যোপাধ্যায়। এ সম্পর্কে এজাজ কী বলবেন? 

এ পর্যায়ে এজাজ ইউসুফী বইয়ের মলাট উল্টে বলেন: “আমার বন্ধু অনুজ তুষার গায়েন খুব ক্রনোলজিক্যালি, অনেকগুলো নাম বাদ পড়েছে, কিন্তু ক্রনোলোজিক্যালি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন বাংলা কবিতা, কিন্তু বিশ্লেষণটি তার প্রাসঙ্গিক হয়নি। এরপর তিনি আমার প্রবন্ধের একদম শুরু থেকে দু’লাইন পড়লেন, “বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে, একালে বহু-উচ্চারিত শব্দবন্ধ পোস্টমডার্ন। যুগপৎ সমীহ ও সন্দেহ আদায়কারী এবং তরুণ কবিদের মনোজগতে দারুণ প্রভাব সঞ্চারকারী এই নব্য শব্দবন্ধ (পরিভাষা) নিয়তই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে চলেছে যে, এ কি নিতান্তই হাল ফ্যাশনের প্রভাবে ভেসে আসা কোনো ব্যাপার নাকি এর বাস্তব প্রেক্ষাপট বলে কিছু রয়েছে?” লাইনগুলো পড়ার পর (বইয়ের পাতা উল্টে প্রবন্ধের শেষ অধ্যায়ে এসে) নাটকীয় ভঙ্গিতে এজাজ আমার উদ্দেশে বলেন, “তিনিই প্রশ্ন করছেন, আবার তিনিই … যে কবিতা পর্বটি এখানে ছাপা হয়েছে তার শিরোনাম দিয়েছেন পোস্টমডার্ন কবিতা। এই যে স্ববিরোধীতা, এই কথাগুলো তাকে মনে রাখতে হবে এবং আমি যে কথাগুলো বললাম, এই যে তার একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ, অনেকগুলো কবিতাই আছে যে এটি কি পোস্টমডার্ন কবিতা? পোস্টমডার্ন কি এইকথা বলে, ”বাবা তো কৃষক ছিলেন,/ জমির আলে তার পায়ের দাগগুলো সভ্যতার চিহ্ন হয়ে আছে/চন্দ্রবাড়ির ঢাল ঘেঁষা আয়তক্ষেত্রগুলো/ এত দিনে রেখার খসড়া ছেড়ে/ মালিকানা পাল্টে নিয়েছে অবলীলায়/” … এটা কোন  পোস্টমডার্ন ভাষাতাত্ত্বিক কিম্বা কবি এই কথাগুলো লিখবেন? … “কৃষক স্বামী খুব ভোরে উঠে, মাঠে যাবে/ ধান বোনা হবে/ বউ ও বউ, বীজ ধান দে, প্রাণের সোয়ামী গো মোর” …. কোন মর্ডানিজম এটি? এটি আমাদের মাটিজ, ভূমিজ, আমাদের প্রাণের কথা, এটা পোস্টমডার্নিজমের কথা নয়। অধুনান্তিক তো নয়ই, অধুনান্তিক একটি শব্দবন্ধ, বাক্যবন্ধ যেটিকে আমি একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেই। পোস্টমডার্নিজম যেটা বাংলায় আছে, আমরা আধুনিকোত্তরবাদ বলি … পোস্টমডার্নিজমের যদি বাংলা করি সেটি আসে।”

[ভিডিও # ৪, সময়কাল ৫৭:৩৫ – ৫৯:৫৪ ]

মারহাবা ! আপনার অমৃতভাষণ শুনে সুকান্তের ‘অবাক পৃথিবী’ কবিতার দু’টো লাইন একটু ভিন্নভাবে বাগযন্ত্রে উচ্চারিত হ’ল : “অবাক ইউসুফী, অবাক যে বারবার/ দেখি এই আলোচনায় মিথ্যারই কারবার।” মঈনুদ্দিন খালেদের মতো আপনিও আমার লেখার খণ্ডিত পাঠ করে বিকৃত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করলেন। আপনি যে দু’লাইন পড়ে আমাকে স্ববিরোধী বললেন, পরের লাইনগুলোতে আমি কী লিখেছি তা কি পড়েছেন, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেলেন? পাঠকের জন্য পরবর্তী কিছু লাইন উল্লেখ করছি : “বাংলাদেশে কি এখন সত্যি পোস্টমর্ডান কবিতা রচিত হচ্ছে? বাংলাদেশ কি মডার্নযুগ অতিক্রম করে এতটাই পোস্টমর্ডান যুগে প্রবেশ করেছে যে, কবিরা প্রাকৃতিক নিয়মেই এই যুগপ্রভাবকে প্রকাশ করছেন কবিতায়? নাকি কালবোধ এমনই এক প্রপঞ্চ যা অঞ্চলভেদে পৃথিবীর বিভিন্ন মানবসম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর ভেতরকার জাগতিক ও বৌদ্ধিক অর্জনের পার্থক্য সত্ত্বেও এক অখণ্ডবোধে নিয়ে আসতে সক্ষম? অথবা পোস্টমডার্ন বিষয়টি নিতান্তই কাল-নিরপেক্ষ কিছু বৈশিষ্ট্য ও জীবনবোধকে প্রকাশ করে ও প্রশ্রয় দেয়? সোজা কথায়, পোস্টমর্ডান বলতে আমরা কী বুঝব এবং এর সাথে বাংলাদেশের কবিতার কী সম্পর্ক, তা স্পষ্ট করে পাঠকের বোঝার দাবি কোনোমতেই উপেক্ষা করা চলে না। উপরন্তু, বাংলাভাষায় পোস্টমর্ডান শব্দটির পারিভাষিক প্রকাশ কী এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই প্রকাশের অভিব্যক্তি কেমন, তা বোঝাও জরুরি।” এই লাইনগুলোতে স্পষ্ট যে আমি পোস্টমর্ডানকে উড়িয়ে দিইনি, বরং এর চর্চা বাংলায় কীভাবে হচ্ছে সেটা অনুসন্ধান করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি। সেই অনুসন্ধানের ফলাফল এই প্রবন্ধে স্পষ্ট করে বলেছি যে বাংলায় পশ্চিমী ‘পোস্টমডার্ন’ ধারার সরাসরি অনুসারী যেমন রয়েছেন, পাশাপাশি দেশজ ও ঐতিহ্যলগ্ন ‘উত্তর আধুনিক’ ধারা রয়েছে। এই ‘উত্তর আধুনিক’ শব্দবন্ধের দুটো উৎস: একটি এসেছে ‘পোস্টমডার্ন’ শব্দের বাংলা অনুবাদ হিসেবে, আরেকটি এসেছে ভারতীয় দর্শন থেকে যেখানে ‘উত্তর’ শব্দটি ‘উত্তরণ ঊর্ধ্বে’ প্রযুক্ত (অঞ্জন সেন কৃত ব্যাখ্যা) যা আগেই উল্লেখ করেছি। এর বাইরেও আরো দু’টো নাম আমরা পেয়েছি: একটি হচ্ছে তপোধীর ভট্টাচার্য প্রস্তাবিত ‘আধুনিকোত্তর’, অপরটি প্রবাল দাশগুপ্ত প্রণীত ‘অধুনান্তিক’; উভয় তাত্ত্বিক নামকরণের পক্ষে নিজেদের যুক্তি পেশ করেছেন। আমি লক্ষ করে দেখেছি, পারিভাষিক পরিচয় নিয়ে যে বিতর্ক আছে তার কোনো শক্ত ভিত্তি নেই, বরং কে কোন চিন্তাধারায় অবস্থান করেন (পশ্চিমী ধারা নাকি দেশজ ধারা) তার উপর নির্ভর করছে সব। সার্বিক বিবেচনায় আমার কাছে ‘অধুনান্তিক’ নামটি বেশি গভীর ও ব্যঞ্জনাধর্মী মনে হয়েছে বলে আমি এটি গ্রহণ করেছি যার সাথে চিন্তাধারায় দেশজ ‘উত্তর আধুনিক’-এর মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। এজাজ আমার প্রবন্ধ ভালো করে না পড়েই আলোচনা করতে এসেছেন, তার প্রমান তিনি যে-দু’টো কবিতা (ফারহান ইশরাকের ‘কৃষি সভ্যতার গল্প’ ও শাহনাজ মুন্নীর ‘চাষী বউয়ের সাথে যখন বদলায় কবির জীবন’) থেকে লাইন আউড়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে আমাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন ‘এটি কি পোস্টমডার্ন কবিতা?’ এটা কোন পোস্টমডার্ন ভাষাতাত্ত্বিক কিম্বা কবি এই কথাগুলো লিখবেন?’ আমার অট্টহাস্য করতে ইচ্ছা হয়, জিজ্ঞাসা করি, এজাজ কী দেখেন নাই যেসব কবিতার উদ্ধৃতি আমি দিয়েছি তাদের দু’ভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে : ভাষা ও আঙ্গিকবাদী পোস্টমডার্ন ধারা এবং জীবনবাদী অধুনান্তিক ধারা? ফারহান ইশরাক ও শাহনাজ মুন্নীর কবিতা অন্তৰ্ভূক্ত হয়েছে দ্বিতীয় ধারায় যা এজাজের পরিভাষায় দেশজ ও ঐতিহ্যলগ্ন ‘উত্তর আধুনিক’ ধারার সমার্থক। ‘লিরিক’-এর উত্তর আধুনিক সংখ্যায় যেসব কবিতা অন্তৰ্ভূক্ত হয়, তার সাথে আমার প্রবন্ধের জীবনবাদী অধুনান্তিক ধারায় উদ্ধৃত কবিতাগুলো আপনি নিজেই একবার মিলিয়ে দেখুন। এবং এটাও দেখুন ভাষা ও আঙ্গিকবাদী পোস্টমডার্ন ধারায় আমি কী ধরণের কবিতা নিয়েছি, তাহলেই আপনার কাছে পানির মতো সব কিছু পরিস্কার হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি তো গোঁ ছাড়বেন না ! আপনি ‘অধুনান্তিক’ ছুঁড়ে ফেলে দেবেন ! যা আপনি ছুঁড়ে ফেলে দেন, তার মাহাত্ম্য বর্ণনা করে লেখা প্রবাল দাশগুপ্তের প্রবন্ধ ‘অধুনান্তিক এলাকা’ এত যত্ন করে নিজের সাধের পত্রিকা ‘লিরিক’-এ ছাপেন কেন? আপনি ‘উত্তর আধুনিক’ নামাবলীর বাইরে আর কিছু গায়ে দেবেন না। ভালো কথা, কিন্তু ‘উত্তর আধুনিক’ নাম এবং চিন্তাদর্শনের উদ্ভাবক তো আপনি নন, আপনি এটা পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের তাত্ত্বিকদের কাছ থেকে। কবি অমিতাভ গুপ্ত যিনি ‘উত্তর আধুনিক’ নামের উদ্ভাবক, তিনি নিজেই তো এই নাম ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। গত বছর পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাটে তিনদিন ব্যাপী ‘উত্তর আধুনিক চেতনা’ শিরোনামে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হল (যেখানে জিললুর রহমান, আপনি ও আমি ছিলাম) সেখানে তো অমিতাভ গুপ্ত গত ৩০-৩৫ বছর আগে নেয়া ‘উত্তর আধুনিক’ নাম ফেলে দিয়ে ‘উত্তর চেতনা’ নাম ধারণ করেছেন। সেই অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক, কবি জিললুর রহমান ‘উত্তর চেতনা’কে সমর্থন করে ঢাকায় সেমিনার করেছেন এবং ‘দৈনিক সংবাদ’-এর সাহিত্যপাতায় প্রবন্ধও লিখেছেন। তাহলে তো দেখাই যাচ্ছে যে নাম অনিত্য, বরং নামের আড়ালে যে ভাবনা রয়েছে সেটাই নিত্য ও গুরুত্বপূর্ণ। আপনি হয়ত বলতে পারেন যে কে কী করল, তাতে আপনার কিছু যায় আসে না, আপনি ‘উত্তর আধুনিক’ নামাবলীই গায়ে দিয়ে থাকবেন। থাকুন, সেটা নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু আপনি কী জানেন ‘পোস্টমডার্ন’ শব্দটির ব্যাপারে আপনার এত যে আপত্তি, সেটার উদ্ভাবক কে? কে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন? আপনার জ্ঞাতার্থে বলি, এই শব্দটি প্রথম পশ্চিমে উদ্ভাবিত হয়নি, এর আদি উদ্ভাবক লাতিন আমেরিকার কবি ফেদেরিকো দ্য ওনিস। [সূত্র: পোস্টমডার্ন কবিতা কাকে বলে/ মলয় রায়চৌধুরী/ সুনৃত ৩য় সংখ্যা, বৈশাখ ১৪১০, সিলেট] এই তথ্য কী আপনাকে নতুন করে ভাবতে প্রণোদনা দিতে পারে? 

আমি শুরুতেই বলেছি, “বাংলা অঞ্চলে বিতর্ক হচ্ছে দু’টো ব্যাপার নিয়ে: একটা হচ্ছে পারিভাষিক ও অন্যটি ভাবগত। আমি লক্ষ করে দেখেছি যে পারিভাষিক বিতর্কের কোনো সত্যিকার ভিত্তি নেই,” … এবার এ প্রসঙ্গে কিছু বলব। এটা প্রতিষ্ঠা করা আমার উদ্দেশ্য নয় যে বাঙালি তাত্ত্বিক যারা দাবি করেছেন পশ্চিমের পোস্টমডার্ন সম্পর্কে কিছু না জেনেই স্বাধীনভাবে ‘উত্তর আধুনিক’ নাম ও চিন্তাদর্শনের উদ্ভাবন করেছেন, তাঁদের দাবি মিথ্যা বা তাঁরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আমার দেখার বিষয় যে আধুনিকতার সংকট থেকে উত্তরণের ভাবনায় একই সময়ে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন এলাকার তাত্ত্বিকরা যেসব চিন্তাদর্শনের কথা বলছেন তাদের ভিতর ঐক্য ও বিরোধের জায়গা কোথায়? আমরা এই চিন্তাদর্শন থেকে কী এবং কতটুকু নেব যা আমাদের অঞ্চলগত প্রেক্ষাপটে সদর্থক ও মানানসই। এই বিষয়ে সবচেয়ে পরিস্কার ধারণা যার কাছ থেকে পেয়েছি তিনি ভাষাতাত্ত্বিক ও দার্শনিক কলিম খান। তিনি তাঁর ‘দিশা থেকে বিদিশায়’ গ্রন্থের ‘প্রাগাধুনিকতা আধুনিকতা ও অধুনান্তিকতা’ প্রবন্ধে লেখেন, প্রাগাধুনিক কালে যেভাবে প্রতিটি ধর্ম শুরুতে প্রগতিশীল চিন্তাধারা রূপে উদ্ভূত হয়ে একদিন তা মৌলবাদী হয়ে পড়ে (যার বিস্তৃত ব্যাখ্যা তিনি তাঁর ‘মৌলবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে’ গ্রন্থে দিয়েছেন) তেমনি আলোকপ্রাপ্তিতন্ত্র (Enlightenment) আলোকপ্রাপ্তিকেই গ্রাস করে নেয় অর্থাৎ একদিন আধুনিকতাও মৌলবাদীর খপ্পরে পড়ে যায়।” এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার ডাক দিল পোস্টমডার্নিজম বা অধুনান্তিকতা। মৌলবাদী হয়ে পড়া আধুনিকতার সীমানা ভেঙে ফেলা দরকার, তা সে যেদিক থেকেই হোক। এই কাজে হাত লাগানোর জন্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী আধুনিকগণই নবরূপে দেখা দিলেন — দুই দলে বিভক্ত হয়ে তাঁরাই অবতীর্ণ হলেন ‘মৌলবাদী-আধুনিকতা’র সীমা লঙ্ঘন করতে। একদল ভাঙলেন নিম্নসীমা, অপরদল লঙ্ঘন করলেন ঊর্ধ্বসীমা। একরকমভাবে বিকশিত হবার বাধ্যবাধকতা কিছুতেই মান্য করা যাবে না, তাঁরা বললেন, কেননা তা অবাস্তব অস্বাভাবিক অসম্ভব। তাঁদের সাফ কথা, যার যেমন খুশি তেমনভাবে বিকশিত হবার অধিকার আছে। … ‘এতই যখন ঝামেলা, বিকশিত হতেই হবে এমন কি কথা আছে, ধুত্তোর বিকশিত হবই না।’ …বললেন নিম্নসীমা লঙ্ঘনকারীগণ। ‘এসো প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’ ধ্বংস হয়ে যাই। সংস্কৃতিতে উদোম হওয়ার, পচে যাওয়ার, ঝরে যাওয়ার, আত্মবিনাশের চল হল সর্বক্ষেত্রে। এই হচ্ছে নেগেটিভ পোস্টমডার্নিজমের রূপ। […] 

প্রায় একইসঙ্গে আবির্ভুত হলেন আধুনিকতার ঊর্ধ্বসীমা লঙ্ঘনকারীগণ। তাঁরা বললেন — ছকে রাখা ভুল জীবন ঠিকভাবে বাঁচার জন্য যে গুনাহ্গারি দিতে হয়, তার থেকে ব্যক্তিকে নিষ্কৃতি দিতে হবে। ব্যক্তির আত্মবিকাশের পদ্ধতি ও ইচ্ছা তারই এখতিয়ারভুক্ত ব্যাপার, সব রকম খবরদারি থেকে তাকে মুক্ত রাখা চাই। তাঁরা বললেন — শৃঙ্খলিতের উপর বর্ষিত ‘প্রীতিহীন-হিতাকাঙ্ক্ষা’ আশীর্বাদের পুষ্পবৃষ্টি নয়, অভিশাপের শিলাবৃষ্টি। মানুষকে গোষ্ঠীকে জাতিকে দেশকে সংস্কৃতিবিশেষকে, তাঁরা বললেন, পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দিতে হবে। Bio-diversity, Bio-regionalism, Bio-centrism, Species-ism, Bio-ethics ইত্যাদি নানান পোস্টমডার্ন প্রস্তাব তুলে তাঁরা আধুনিকতাকে ছাপিয়ে ছাড়িয়ে তার ঊর্ধ্বসীমাকে বাড়িয়ে নিতে চাইলেন। […] দাম্পত্য সম্পর্কে নরনারীর সমমর্যাদার দাবি উঠছে। সমাজ সম্পর্কে কেন্দ্র প্রান্তের সমমর্যাদার দাবি উঠছে। জীবজগতের সঙ্গে সম্পর্কে জীবের সুরক্ষার প্রশ্ন উঠছে। প্রকৃতির সঙ্গে প্রকৃতির মর্যাদার কথা উঠছে। বলা হচ্ছে বায়ুদূষণ চলবে না, সমুদ্রকে ডাস্টবিন বানানো যাবে না, বনকে ধ্বংস করা চলবে না।” এই হ’ল পোস্টমডার্নিজমের পজিটিভ দিক। আমি প্রবন্ধের ১ম পর্বের দ্বিতীয় অধ্যায়ে, পোস্টমডার্ন/ অধুনান্তিকতার ইতিবাচক ধারাটিকে নিয়ে আলোচনা করেছি যা সাধারণভাবে পৃথিবীর সব অঞ্চল ও জাতিসমূহের জন্য প্রযোজ্য। এর সাথে দেশজ উত্তর আধুনিক ধারার কোনো বিরোধ নেই। কলিম খান বিষয়টিকে স্বচ্ছভাবে দেখতে পান বলে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে পোস্টমডার্ন, অধুনান্তিক, উত্তর আধুনিক নামগুলো সমার্থবোধক হিসেবে ব্যবহার করেছেন, কারণ কোনো নির্দিষ্ট নামাবলী গায়ে তাঁকে ক্ষুদ্র ভক্তকূল পরিবেষ্টিত ছোট মাজারের খাদেম হয়ে টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় নামতে হয়নি। আমিও সেই পথের অনুসারী!  এমনকি পূর্ববর্তী আলোচক মঈনুদ্দিন খালেদ যার সাথে চিন্তার দিক থেকে এজাজ ইউসুফীর কোনো পার্থক্য নেই, তিনিও তাঁর আলোচনায় পুরোটা সময় ‘পোস্টমডার্ন’ শব্দটিকেই ব্যবহার করেছেন। 

না পড়ে মন্তব্য করা ও স্ববিরোধিতাই শুধু নয়, বক্তব্য প্রদানে অসংলগ্নতাও এজাজ ইউসুফীর ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যা তার উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এজাজ বলছেন, “এক হাজার বছরের ইতিহাস উনি (তুষার) দেখাবার চেষ্টা করেছেন খণ্ডিতভাবে … যে আমাদের সুদীর্ঘকালের এক হাজার বছরের যে কাব্যিক ইতিহাস, সংস্কৃতির ইতিহাস সেটিকে তিনি (আমি যে আধুনিকতার কথা বললাম উচ্চশিখর নিয়েছে) সেখান থেকে এখন আমাদের নতুন অবস্থান হবে অধুনান্তিকতা। এটি তো সত্য নয় ! কারণ, আমি বলেছি যে, আমরা এখন জ্ঞানের জগতে পাশ্চাত্যকে ইন্টারভেইন করছি। শুধু ইন্টারভেইন নয়, আমাদের সন্তানরা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে, আমাদের সন্তানরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের সন্তানেরা নাসায় যে কাজ করছে এবং আমাদের সন্তানেরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে,সমাজতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষীয় মানুষ আজকে পুরো পৃথিবীকে লিড করছে জ্ঞানের রাজ্যে। চীনের কথা ধরুন, প্রযুক্তি সে আমেরিকান প্রযুক্তিকে কনভার্ট করে নিজস্বীকরণ করেছে। এই যে জ্ঞানের শিপমেন্ট হচ্ছে, ডিসপ্লেসমেন্ট হচ্ছে, ওরা ঝিমিয়ে পড়ছে আর আমরা জ্ঞানকে চর্চা করে আরেকটি স্তরে উন্নীত করার চেষ্টা করছি। এই বিষয়গুলো পরিস্কারভাবে না বুঝলে আপনি বিভ্রান্তিতে ভুগবেন। এখানে দুটো সারণী দেয়া হয়েছে। একটি ইহাব হাসানের সম্ভবত আরেকটি অঞ্জন সেনের … কিন্তু আমাদের একটি জায়গা ছিল, দাঁড়াবার জায়গা, সেটি হচ্ছে পৃথিবীতে চারটি স্বীকৃত মহাকাব্য আছে, আপনি বলতে পারেন ইলিয়ড, ওডিসি, রামায়ণ, মহাভারত … এই চারটি মহাকাব্যের দু’টো হলো এই ভারতবর্ষের। তাহলে জ্ঞানের রাজ্যে আমি পিছিয়ে থাকবো কেন?”

[ভিডিও # ৪, সময়কাল ১:০০:০২ – ১:০২:১৩ ] 

আমি বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাস সংক্ষেপে চর্যাপদ থেকে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছি, কীভাবে তা খণ্ডিত, এজাজ ইউসুফী কী তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন? অধুনান্তিকতার প্রশ্নে আমার বক্তব্য ইতোমধ্যে পরিস্কার করেছি। তিনি এর আগে বলেছেন পশ্চিমের দার্শনিক চিন্তাভাবনায় মাথা ঢুকাবেন না, কিন্তু আমি প্রমান দিয়েছি যে তিনি মাথা ঢুকিয়েছেন। এখন তিনি বলছেন জ্ঞানের জগতে পাশ্চাত্যকে ইন্টারভেইন করার কথা; বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা নেতৃত্ব দিচ্ছি, জ্ঞানের চর্চাকে নতুন স্তরে উন্নীত করছি আর পশ্চিম ঝিমিয়ে পড়ছে। তার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক ! আমাদের সন্তানেরা পশ্চিমে ভালো করছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ভারতবর্ষীয় মানুষ জ্ঞানের রাজ্যে পুরো পৃথিবীকে লিড করছে, এটা কী অতিশয়োক্তি নয়? অতিশয়োক্তি না হয় তিনি করলেন, কিন্তু জ্ঞানচর্চার জন্য পশ্চিমে মাথা না ঢুকিয়ে আমরা কী পারছি? পশ্চিম বলে কথা নয়, জ্ঞান পৃথিবীর যে-প্রান্তেই ফলুক না কেন, মানুষ হিসেবে সেখানেই আমাদের অধিকার। তিনি নিজেও তো বলেছেন যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জ্ঞানের জগতে প্রবেশাধিকারের কথা। কথা তো সেই দাঁড়াল যে উন্নত দেশের জ্ঞানভাণ্ডের কাছে না গিয়ে আমরা কী পারছি? না পড়ে মন্তব্য করার কারণে তিনি বলছেন, ইহাব হাসান এবং অঞ্জন সেন কৃত সারণী তিনি পেয়েছেন আমার প্রবন্ধে, কিন্তু আমি যে এর সাথে প্রভাত চৌধুরীর ইশতেহার দিয়েছি সেটা তার নজরেই আসেনি। কেন আমি ইহাব হাসানের সারণী, প্রভাত চৌধুরীর ইশতেহার ও অঞ্জন সেনের সারণী (রূপরেখা) দিয়েছি তা তিনি বোঝার চেষ্টা করেন নি। প্রথম দু’টি দেয়া হয়েছে পশ্চিমা পোস্টমডার্ন এবং পশ্চিমানুসারী বাংলার পোস্টমডার্ন চিন্তার মুখপত্র হিসাবে যার প্রয়োগ ‘ভাষা ও আঙ্গিকবাদী পোস্টমডার্ন কবিতা’য় লক্ষণীয় এবং অঞ্জন সেনের রূপরেখা দেয়া হয়েছে ভূমিজ ‘উত্তর আধুনিক’ চিন্তার মুখপত্র হিসেবে যেটা জীবনবাদী অধুনান্তিক ধারার কবিতায় অনুসৃত। এই বিষয়টার আলোচনায় না গিয়ে প্রসঙ্গ বহিৰ্ভূতভাবে এজাজ মহাকাব্যের মহিমা গাইতে শুরু করলেন। রামায়ন, মহাভারতের কথা তো আমি প্রবন্ধের ১ম পর্বেই উল্লেখ করেছি, সেইসাথে মনীষী কলিম খানের যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথাও বলেছি যিনি তাঁর ‘ক্রিয়াভিত্তিক-ভাষাতাত্ত্বিক শব্দার্থবিধি’র প্রয়োগে এই মহাকাব্য দু’টি নতুন পাঠোদ্ধার করে দেখিয়েছেন যে এগুলো নিতান্তই ধর্মকাব্য, রূপকথা বা মিথোলজি নয়, বরং প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস যা আত্মবিচ্ছেদের ফলে আমরা বিস্মৃত হয়েছিলাম। ফলে তার আলোচনা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরোধিতা করার জন্য বিরোধিতা ! আলোচনার একদম শেষে তিনি বইয়ের কিছু মুদ্রণ প্রমাদ নিয়ে অত্যন্ত কড়া ভাষায় সমালোচনা করলেন: “এই গ্রন্থটির সবচেয়ে দৃষ্টিকটু যে প্রচুর ভুল, প্রচুর বানান ভুল, যেটি এই সময়ে এসে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া সত্যি আমি বলবো যে এটি অন্যায়।” আমি জানি বইটিতে প্রচুর নয়, কিছু বানান ভুল আছে, সেটা থাকা নিশ্চয়ই সঙ্গত নয়। তাই বলে নতুন প্রজন্মের হাতে এই বই তুলে দেয়া অন্যায় হবে বলে তিনি যে ভঙ্গিতে বললেন তা ছিল অনভিপ্রেত ! প্রজন্ম কী বানান শিক্ষার জন্য বইটা কিনবে? আমি পাণ্ডুলিপির প্রুফ যথাসম্ভব দেখেই প্রকাশককে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু দেশে কম্পোজ করার পর অনেক শব্দ ভেঙে যায়। এটা প্রকাশকের দায়িত্ব ছিল প্রফেশনাল প্রুফ রিডারকে দিয়ে বানানগুলো সংশোধন করা। বই প্রকাশের কিছুদিন আগে আমি দেশে গিয়ে দেখি প্রুফ দেখার কাজ তেমন কিছুই এগোয়নি, নিজের ব্যস্ত সময়ের ভিতরেও ৩/৪ টি প্রুফ দেখে ফাইনাল করেছি। কিন্তু বই প্রকাশের পর দেখি কিছু বানান অসংশোধিতভাবেই ছাপা হয়েছে। এর দায় কী আমার উপর বর্তায়?  

বইয়ে আরো দু’টো ভুলের কথা উল্লেখ করেছেন আলোচকরা। শোয়েব শাহরিয়ার দেখিয়েছেন যে ‘বাংলা কবিতা: অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ প্রবন্ধের ৪৮ পৃষ্ঠায়, প্রভাত চৌধুরী কর্তৃক প্রকাশিত ‘পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা’-র যে ইশতেহার আমি উল্লেখ করেছি, সেখানে একটা ভুল রয়ে গেছে। ইশতেহারের ২য় পয়েন্ট আমার প্রবন্ধে ছাপা হয়েছে, “কবিতাটি Close Ended হবে।” মূল ইশতেহারে এই লাইনটিতে আছে “কবিতাটি Close Ended হয় না বরং Open Ended হয়।” আমার হাতে মূল লেখকের বইটি ছিল না, অন্য একজন লেখকের প্রবন্ধের বই থেকে ইশতেহারটি সংগ্রহ করি, ভুলটা সেখানেই ছিল। দ্বিতীয় ভুলটি ধরিয়ে দিয়েছেন মঈনুদ্দিন খালেদ। একই প্রবন্ধের ৪৫ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে, “১৯৭০ দশকে পৃথিবী ব্যাপী অনেকগুলো ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিক্রিয়া বিশেষত ছাত্রদের সাথে শাসকগোষ্ঠীর সংঘর্ষ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী বিক্ষোভ ইত্যাদি …” পূর্বোক্ত থেকে আমি এই তথ্য পেয়েছি, সেখানে সালটা ঠিকই লেখা ছিল, ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু কীভাবে আমার প্রবন্ধে সেটা ‘১৯৭০ দশকে’ হয়ে গেল, সে এক বিস্ময় ! ধারণা করি কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন দশকের প্রসঙ্গ এসেছে, সেখান থেকেই লেখা কম্পোজ করার সময় ভুলবশত ওটি অস্থানে এসে বসে গেছে। ভুল যেভাবে হোক সেটা ভুলই, বইটির পরবর্তী সংস্করণে উপরোক্ত সব ভুলগুলো সংশোধন করা হবে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
‘লেখক আড্ডা’য় বই নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখছেন ফরিদুল আলম

এজাজ ইউসুফীর বক্তব্যের পর ফরিদুল আলমকে মাইক দেয়া হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে সঞ্চালক শওকত হোসেন তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন একজন অভিজ্ঞ বানান সমন্বয়ক (প্রুফ রিডার) হিসেবে যিনি প্রুফ দেখার পাশাপাশি অলিখিত দায়িত্ব হিসেবে স্বেচ্ছায় সম্পাদনার কাজটিও করে দেন। খুব ভালো কথা, আমি অবশ্য তার নাম আগে কখনো শুনিনি বা কোনো লেখাও পড়িনি। এদিকে অনুষ্ঠান দ্রুত শেষ করবার একটা তাড়া আমি সঞ্চালকের ভিতর লক্ষ করি। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ফরিদুল আলম যা বললেন তাতে মনে পড়ে গেল কবিগুরুর বিখ্যাত লাইন, “বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ”। তিনি ‘বাংলা কবিতা: অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ প্রবন্ধ নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বললেন যে আমি প্রবন্ধটির ১ম পর্ব লেখার অনেক বছর পর ২য় পর্ব লিখেছি, তাই গভীর মনোযোগ দিতে পারিনি বলে লেখাটি বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। তিনি মঈনুদ্দিন খালেদের বক্তব্য সমর্থন করে বললেন যে পোস্টমডার্ন বা উত্তর আধুনিক নিয়ে আমি যা লিখেছি সেটা তাকে ‘রিলেট’ করতে পারেনি, কারণ আমার চিন্তা স্পষ্ট ও সহজভাবে তার কাছে বোধগম্য হয়নি। তিনি এটাও বললেন যে উত্তর আধুনিকতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত অনেক লেখা তিনি পড়েছেন, সেগুলো পড়েও তিনি কোনো স্পষ্ট ধারণা পাননি। তাই তিনি আমাকে উপদেশ দিলেন আমি যেন মার্জিত ভাষায় সহজ করে আবারও প্রবন্ধটি লিখি।

[ভিডিও # ৪, সময়কাল ১:০৭:৩০- ১:১০:৪৩ ]  

আমার লেখা না হয় তিনি বুঝতে পারেননি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত এত লেখা পড়েও যদি কিছু বুঝতে না পারেন, তাহলে এই বিষয়ে তার আসলেই কতটুকু জ্ঞান বা বোঝাপড়া আছে, তা নিয়েও তো আমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। মঈনুদ্দিন খালেদের মতো পণ্ডিত লেখক এবং উত্তর আধুনিকতা নিয়ে পত্রিকা করা ঝানু সম্পাদক, কবি এজাজ ইউসুফীই যদি ভালোভাবে বইটি না পড়ে তার সমালোচনা করতে পারেন, তাহলে অজ্ঞাতনামা ফরিদুল আলমের কাছ থেকে আমি কী প্রত্যাশা করতে পারি? কোনো লেখকের লেখা না বুঝলে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু লেখককে পুনর্লিখনের পরামর্শ দেয়া কী শোভন?


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
‘লেখক আড্ডা’য় বই নিয়ে আলোচনা করছেন লেখক আলমগীর খান

এরপর আলোচনা করলেন আলমগীর খান। মনে হ’ল তিনি কিছুটা হেঁয়ালির ভঙ্গিতে বললেন যে পোস্টমডার্নিজম নিয়ে তার ধারণা নাই বললেই চলে, আমার বইট পড়ে তিনি তেমন কোনো ধারণা পান নি, বরং সমস্যা হয়েছে এবং আলোচকদের আলোচনা শুনে সমস্যা আরো বেড়েছে; কিন্তু বইটি তার ভালো লেগেছে। তিনি বললেন ‘পোস্টমডার্ন’ শব্দটিই বেশি ব্যবহার হচ্ছে, এটি ব্যবহার করতেই সবাই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন অর্থাৎ আমরা এখনও ইংরেজি থেকে বের হতে পারিনি এবং বাংলায় এর যেসব শব্দ (পরিভাষা) রয়েছে উত্তর আধুনিক ও আধুনিকোত্তর, তাদের তুলনায় ‘অধুনান্তিক’ আরো কম ব্যবহৃত হয়। তাই তিনি রেফারেন্স টানলেন পূর্ববর্তী বক্তা মঈনুদ্দিন খালেদের যার প্রশ্ন ছিল পোস্টমডার্নিজম বুঝতে কী আমাদের সেই পশ্চিমের দিকেই তাকাতে হবে, কারণ মঈনুদ্দিন আমাকে সমালোচনা করেছিলেন এই বলে যে পশ্চিমের সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এর ব্যাখ্যা করেছি। আলমগীর খানের বক্তব্য নিয়ে আমার নতুন করে বলার কিছু নেই, পূর্ববর্তী আলোচকদের যে জবাব আমি দিয়েছি সেখানেই এসব কিছুর ফয়সালা করা হয়েছে। তিনি আরো একটি বিষয় উত্থাপন করেন, পোস্টমডার্ন/ উত্তর আধুনিককে আমি যদি আধুনিকতা থেকে একটা ভিন্ন জীবনদর্শন বলেই মনে করি, তাহলে প্রাগাধুনিক, আধুনিক ও অধুনান্তিক ব’লে কালের প্রেক্ষিতে কেন তা ব্যাখ্যা করলাম? কেনই বা আমি সোভিয়েতের ভাঙনকে আধুনিক কালের শেষ এবং অধুনান্তিক কালের শুরু বলে চিহ্নিত করছি। তবে আলমগীর খান নিজেই এর জবাব দিয়েছেন আমার ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করে অর্থাৎ পোস্টমডার্ন চিন্তাদর্শনের উদ্ভব আগে হলেও, সোভিয়েত ভাঙনের পরেই এর প্রকৃত চর্চা শুরু হয়, কারণ আধুনিকতাবাদী চিন্তাদর্শনের আওতায় পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সংকট থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটবে সেই চিন্তা থেকেই তরুণদের মধ্যে এর সম্পর্কে আগ্রহ ও চর্চার প্রসার ঘটেছে। আমার প্রবন্ধে এর অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা রয়েছে যা এজাজ ইউসুফীর বক্তব্যের জবাবে আমি পুনরুল্লেখ করেছি এবং এর স্বপক্ষে মনীষী কলিম খানের প্রবন্ধ ও বইপত্রের রেফারেন্স দিয়েছি। তিনি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে উচ্চকিত কিছু মন্তব্য করলেন যার সাথে আমার লেখার বিষয় সম্পর্কিত নয়। তবে ‘কে এই শক্তি প্রোষিতভর্তৃকা : জীবনানন্দের মানবসমাজ ও বিশ্বপ্ৰকৃতি পরিক্রমা’ প্রবন্ধে পুঁজিবাদী সভ্যতার ব্যাখ্যায় বস্তুবাদী, মাকর্সীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে বলে তার যে পর্যবেক্ষণ সে ব্যাপারে আমার দ্বিমত নেই। মানব সমাজ ও ধনতন্ত্রের বিকাশ, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ের ব্যাখ্যায় মাকর্স আজও প্রকৃত উত্তর আধুনিক/ অধুনান্তিক চিন্তকদের কাছে গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। এজাজ ইউসুফী যেভাবে শুরুতেই উত্তর আধুনিক তত্ত্ব বোঝাতে শ্রোতাদের জন্য তাঁর কবিতা ‘বিনির্মাণ’ থেকে পড়লেন, ” আমি তো কলোনিয়াল ছেলে / নানাভাবে ফেঁসে গেছি মার্কসবাদের মৃত্তিকায়” — এসব অগভীর চিন্তা-চেতনার ফল ! আলমগীর খান প্রবন্ধটির উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন, সেজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই !
[ভিডিও #৪, সময়কাল ১:১০:৫৮ – ১:১৮:১০ ]


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
‘লেখক আড্ডা’র সর্বশেষ বক্তা লেখক ও কবি আফরোজা সোমা

অনুষ্ঠানের সর্বশেষ বক্তা ছিলেন আফরোজ সোমা। সোমা তার বক্তব্য শুরু করেন এই বলে যে আলোচকরা সেই বিখ্যাত চিন্তার সাথে নিশ্চয়ই পরিচিত আছেন যে লিখিত হয়ে যাবার পর লেখকের মৃত্যু ঘটে (স্মর্তব্য রোঁলা বার্থ) এবং রচিত সাহিত্যকর্ম হয়ে যায় পাঠকের বস্তু, তাই একজন কবি বা লেখক তার বক্তব্যে কী অর্থ পুরে দিয়েছেন তার থেকে অধিক অর্থপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় পাঠক তা কীভাবে গ্রহণ করছে। তার মতে কথাটি প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে অনুষ্ঠানে আসতে দেরি হওয়ায় তিনি এজাজ ইউসুফীর বক্তব্য থেকে শুনতে পেয়েছেন এবং দেখেছেন যে আলোচনাটি গিয়ে ঠেকেছে পোস্টমডার্নিজম নিয়ে, কিন্তু আলোচ্য বিষয়ের ফোকাস ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে সমস্ত গ্রন্থটি নিয়ে হতে পারত যেখানে ঐ বিষয় ছাড়াও আরো ৫ টি প্রবন্ধ রয়েছে। সোমা মন্তব্য করেন যে ঐ প্রবন্ধে আরো কী যোগ হলে তা সর্বাঙ্গীন হতে পারত ব’লে পূর্ববর্তী আলোচকরা যেসব আলোচনা করেছেন, তার বাইরে গিয়ে তিনি প্ৰবন্ধটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন যার গুরুত্ব সময়ের সাথে সাথে আরো বাড়বে, কারণ শুরু (চর্যাপদ) থেকে গত শতাব্দীর নব্বই দশক পর্যন্ত বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপট, ধাঁচ এবং স্বর কেমন ছিল সেটা বুঝতে চাইলে পাঠক নিশ্চয় এর খোঁজ করবে। এটাতো ঠিক যে অধিকাংশ আলোচক একটি প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই হিমশিম খেয়ে গেছেন, বাকি প্রবন্ধগুলো নিয়ে তো কোনো আলোচনা হয়নি। সোমার বক্তব্য ছিল অত্যন্ত গোছানো, নির্মেদ ও চিন্তার দিক থেকে স্বচ্ছ, কিন্তু তাকে দ্রুত বক্তব্য শেষ করতে তাগাদা দিচ্ছিলেন সঞ্চালক। ঢাকার বাইরে থেকে আসা শোয়েব শাহরিয়ার ও এজাজ ইউসুফী ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং মঈনুদ্দীন খালেদও যোগ দেন তাদের সাথে। ফলে পূর্ববর্তী অধিকাংশ আলোচকদের বক্তব্যে যে নেতিবাচক ডিসকোর্সের সৃষ্টি হয়, তার কাউন্টার হিসেবে সোমার বুদ্ধিদীপ্ত শানিত কণ্ঠস্বর জ্বলে উঠলেও তাকে থামিয়ে দেয়া হয় কয়েক মিনিটের মধ্যে। কিন্তু এর ভেতরেই তিনি এজাজ ইউসুফীর উদ্দেশে তির্যক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন: “এজাজ ইউসুফী ভাই বাংলা সাহিত্যের কথা বলছিলেন, সংস্কৃত এসে কী কী করল না করল, আমার মনে হ’ল এখানে একটু জায়গায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে যে এই ভারতবর্ষের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে এক হাজার বছর আগের ইতিহাস এটি নয়। আপনাকে ইন্ডাস ভ্যালি থেকে শুরু করতে হবে এবং সেটি শুরু হবে আজ থেকে ৭০০০ বছর আগে থেকে হয়ত এবং তারও আগে আপনি যদি মেহেরগড় সভ্যতার দিকে দেখেন তাহলে আপনি নয় হাজার বছর আগে ফিরে যাবেন। আর্যরা এসছে, তারপর দেখলাম এখানে আপনি অনেকক্ষণ মুসলিম … সেই বিষয়-আশয় নিয়ে অনেক কথাবার্তা হ’ল, মুসলমানদের আগমন এই ভারতবর্ষে খুব বেশি বছর হয়েছে তা নয় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা আলাপ হ’ল, পশ্চিমের মুখাপেক্ষী হয়ে গেছি সেই কথা হ’ল। রাবন প্রসঙ্গ নিয়ে একটা বিরাট আলাপ হ’ল এবং এই কথাটা এখানে বারবার বলার চেষ্টা হয়েছে রাবনকে যেই দৃষ্টিকোণ থেকে নায়ক হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে, এটা পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ। এই ব্যাপারে আমার শতভাগ একটি আপত্তির জায়গা রয়েছে। কারণ রাবনকে যে এতকাল রাক্ষস হিসেবে দেখানো হয়েছে, এই দেখানোটাই ছিল ভূমিপুত্রের জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনি ভূমিপুত্রকে নাকচ করে দিচ্ছেন। আপনি যার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা বলছেন, সেটা হচ্ছে সেই হিন্দুকুশ পাড়ি দিয়ে আসা আর্য বলে আমরা যাদেরকে বলছি তাদেরই দৃষ্টিকোন থেকে ভূমিপুত্রদের আপনি রাক্ষস বলে চিহ্নিত করছেন। ফলে এই জায়গাটা নিয়ে আরো কথা বলবার সুযোগ রয়েছে।”
[ভিডিও # ৪, সময়কাল ১:২০:৪৬ – ১:২৮:৫৮ ]  

ব্রাভো, এই আড্ডার সর্বকনিষ্ঠ আলোচক কবি আফরোজা সোমা পূর্ববর্তী বক্তার চিন্তার গলদ নির্ভুলভাবে সনাক্ত করেছেন। নব্বইয়ের দশক থেকে আমি লক্ষ করে দেখেছি যে আত্মপরিচয় সন্ধান করতে গিয়ে তরুণদের একটা বড় অংশ ধর্মীয় পরিচয়কে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন যা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমি অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি। রাবনকে নিয়ে এজাজ ইউসুফী আমার দৃষ্টিভঙ্গির যে সমালোচনা করেছেন, আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে তার জবাব আগেই দিয়েছি। সোমা আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়ে কথা বলে আরো শক্ত ভিত্তি দিলেন। সোমা যখন কথা বলছিলেন, তখন সভায় ভাঙা হাটের শব্দ ; তিনি যত সংহত হয়ে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন, সভার পরিবেশ ততটাই অসংলগ্ন হয়ে তার কথায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। সভার কয়েকজন বক্তা চলে গেলেও, যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের নিয়ে আলোচনাটি আরো কিছুক্ষণ চালিয়ে যেতে কী সমস্যা ছিল, আমার কাছে স্পষ্ট নয়। সোমার কথা শেষ হতে না হতেই অনলাইনে আমার বক্তব্য গ্রহণ শুরু হয় এবং আমিও সেই একই হট্টগোলের মধ্যে পড়ি। সেই অকথিত জবাবকে সম্পূর্ণ করতেই কলম ধরা যা আমার ধারণাতীত অনেক শ্রম ও সময় ছিনিয়ে নিয়েছে। পরিশেষে আমি সব আলোচকদের ধন্যবাদ জানাই, বিশেষ করে এজাজ ইউসুফী এবং শোয়েব শাহরিয়ারকে যারা শুধুমাত্র একটা বই নিয়ে আলোচনা করার জন্য দূর চট্টগ্রাম এবং বগুড়া থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। এই আলোচনায় যারা অংশ নিয়েছেন এবং আগামীতে নিতে চান, তারা আমার শ্রমঘন লিপ্ততার প্রতি সুবিবেচনা করে, আমার জবাব পড়ে যেন তাদের মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেন এই বিনীত অনুরোধ করে যবনিকা টানছি। 

সবাই ভালো থাকুন, নিরাপদ থাকুন ! 

[সমাপ্ত ]

 

 

লেখক আড্ডার ভিডিও #২ দেখতে ক্লিক করুন

 

লেখক আড্ডার ভিডিও #৩ দেখতে ক্লিক করুন

 

লেখক আড্ডার ভিডিও #৪  দেখতে ক্লিক করুন

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত