| 26 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

প্রবন্ধ: সৈকত রক্ষিতের গল্প : ভিন্ন ভুবনের আখ্যান । পুরুষোত্তম সিংহ

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

           

 

 লেখা তার কাছে এক অপ্রত্যক্ষ সংগ্রাম, গল্প উপন্যাসে তিনি কাহিনির বন্যা ঘটাতে চান না, জীবন যেন তাঁর কাছে খালি পায়ে হেঁটে ভূমিহীন মানুষগুলির কাছে পৌঁছানো – হ্যাঁ আমরা সৈকত রক্ষিতের কথাই বলতে চাইছি। তিনি মূলত ‘সাবঅলটার্ন’ জীবনের কথাকার। আটের দশকে আমরা পেয়েছিলাম তাঁর দুটি গল্প সংকলন ‘আরাম চেয়ার’ ও ‘জন্মভূমি বধ্যভূমি’। এই দুটি গল্প সংকলন পড়লেই বোঝা যাবে তিনি গল্প উপন্যাসে কী বলতে চান বা সৈকত রক্ষিতের কথাভুবনের অভিমুখ কোনদিকে। তাঁর লেখার প্রেরণামূলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরুও তো জীবনের শেষের দিকে সেই ‘ব্রাত্য মন্ত্রহীন’দের কথাই লিখতে চেয়েছিলেন। জন্মসূত্রে পুরুলিয়ার সন্তান। বাংলা সাহিত্য পড়তে এসে দেখলেন কথাসাহিত্য নিজের জেলার সাহিত্য কই ? মনে মনে পীড়া বোধ করলেন, প্রচণ্ড জেদ চেপে গেল লিখতে হলে পুরুলিয়া নিয়েই লিখতে হবে, নিজের জেলার ইতিহাস, সংস্কৃতি তুলে ধরতে হবে। কিন্তু ‘ আমার লেখা শুধু লেখার জন্যই লেখা না হয়ে দাঁড়ায়’ সেদিকে নজর দিলেন। ফলে সমাজ, ইতিহাস, সংস্কৃতি সহ লোকজ উপদান ও ভাষাকে তিনি কমপেক্ট করে সাহিত্যে নিয়ে এলেন। শুধুমাত্র গল্পের জন্য যে গল্প তা তিনি কখনোই লেখেন নি, সামাজিক ইতিহাসের দিক থেকে তাঁর গল্প বিশেষ মূল্য দাবি করে। আর সে দাবি আরও জোড়ালো হয়ে ওঠে লেখক যখন নিজেই জানান-

“আমি লিখি মূলত ‘সাবঅলটার্ন’দের নিয়ে। মফস্বল শহর, গ্রাম এবং গ্রামজীবন আমার লেখার উপজীব্য। এবং সেটা পুরুলিয়ার। আদিবাসী অধ্যুষিত পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমার জন্ম। আমার পূর্বপুরুষদেরও আদিভূমি এই পুরুলিয়া। গত কুড়িবছর ধরে জেলার সাঁওতাল- আদিবাসী ছাড়াও বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখেছি। আমার পেশাহীন ভ্রাম্যমাণ দিনযাপনের সূত্রে গ্রামের এইসব মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে মনে হয়েছে, আমাদের মতো দেশে একজন দরিদ্র মানুষই বোধ হয় জীবনের ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যকে অনেকবেশি উপলব্ধি করতে পারে। দারিদ্র্যই জীবনের সঙ্গে যোগ করে জীবনের বহুমাত্রিকতা। আমার লেখায় এই বহুমাত্রিকতার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। ( কেন লিখি, সম্পাদনা-সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ, পৃ. ২৭৮ )

ভূমিহীন, বস্তুচ্যূত মানুষের আর্তনাদ তাঁকে পীড়া দেয়। পুরুলিয়া দর্শনই যেন তাঁর ভারতদর্শন। ফলে ছোট ভূগোলে বসেই তিনি বৃহত্তর ক্যানভাসের চালচিত্র আঁকতে চান ও তা সফল ভাবেই পারেন। সমাজে যারা বঞ্চিত, তাচ্ছিল্য সেই সব বর্জিত মানুষদেরই প্রতি লেখকের দায়বদ্ধতা, সেই সব মানুষদের কাছে পৌঁছানোই লেখকের কাছে এক সংগ্রাম। ফলে তাঁর কথাভুবন পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন প্রান্তের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে আবর্তিত হয়। তিনি নিজের সৃষ্টিভুবনের চালচিত্রের গঠন প্রণালী ঠিক করেই সাহিত্যে এসেছিলেন- “আমার লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য হবে কথাসাহিত্যের মাধ্যমে এই পুরুলিয়াকেই প্রতিবিম্বিত করা। পুরুলিয়ার ডকুমেনটেশন করা।“ ( তদবে, পৃ. ২৭৯ )

              আমাদের আলোচনার বিষয় সৈকত রক্ষিতের দশটি গল্প। যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৪১৬ বঙ্গাব্দে ‘পরশপাথর’ প্রকাশন থেকে। বেশিরভাগ গল্পই লিটল ম্যাগাজিনের ফসল। প্রত্যক্ষ বাস্তব অভিজ্ঞতাই এই গল্পগুলির ভিত্তিভূমি। কেননা এত নিবিড় ডিটেলিং বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্ভব নয়। তিনি শবর, সাঁওতাল, লোধা পল্লিতে চলে যান সাইকেল নিয়ে মনের আনন্দ খুঁজতে। এ যেন লেখকের এক আনন্দ ভুবন, সে ভুবনের অংশীদার করতে চান পাঠককে। এ বিষয় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে লেখকের বক্তব্যে-“আমি সারা বছরই পাহাড়ে-জঙ্গলে, নদীর চরে চরে, শবর-সাঁওতাল-বাউরি-কুর্মীদের গ্রামে, আদিবাসী মেলায়, বাউল-ঝুমুর-খেমটি নাচের আসরে ঘুরে বেড়াই। আসলে ভ্রমণের ভেতর দিয়ে যে বিচিত্র ভূখণ্ড ও মানবসমাজের সন্ধান আমি পাচ্ছি আমার লেখার মধ্যে সেটাই- সেই জীবনের আনন্দ-উল্লাস-দুঃখ-বিষাদ- উজ্জীবনের প্রতিরূপ পাঠকের কাছে উপস্থাপিত করতে চেষ্টা করি অখণ্ড প্রেক্ষাপটসহ। আমার কাছে তাই একটা গল্প মানে জার্নিও। আমি যা বলতে চাইছি তা এই সংকলনের দশটি গল্পে হয়তো আরও স্পষ্ট করে বোঝা যাবে।“( ভূমিকা )

‘আঁকশি’ এক জীবন সংগ্রামের গল্প, এক যাত্রাপথের গল্প। এখানে সংগ্রাম আছে, বাঁচার আর্তি আছে তবে শ্রমের আনন্দ ও শ্রেণিসংগ্রামে জিতিয়ে দেবার মনোভাবও আছে। আসলে ভারতবর্ষ নামক দেশের নানা প্রান্তে আজও দারিদ্র বর্তমান। লেখক নিজের ভূগোল থেকেই যেন বৃহত্তম ভারতবর্ষকে দেখতে চেয়েছেন। গণেশ যেমন মাতাকে পূজা করেই সমস্ত জগতের পূজা করেছিল তেমনি সৈকত রক্ষিত আগে জন্মভূমির পূজা করতে চেয়েছেন। সমগ্র ভারতদর্শন যেন তাঁর কাছে পুরুলিয়া দর্শন। সময়ের আরশিতে তিনি জীবনকে দেখতে চেয়েছেন, জীবনের পরিবর্তনকে লক্ষ্য করেছেন। ভারতবর্ষ স্বাধীন হলেও ঔপনিবেশিকতা আজও দূর হয় নি। আজ যে কোন শাসক দলের কাছেই নিজের অঞ্চল যেন নিজের উপনিবেশ। সেই উপনিবেশের শোষণের কথাই লেখক লিখতে চেয়েছেন। তবে তিনি কিন্তু আঞ্চলিক কথাকার নন। আসলে একজন লেখককে একটি বা একাধিক অঞ্চল নিয়েই মঞ্চে নামতে হয়, তবে তা বলার গুণেই বা পরিবেশনের ঢঙেই হয়ে ওঠে সর্বজনীন- সে গুণ সৈকত রক্ষিতের সর্বদা বর্তমান।

       দরিদ্র মাগারাম ও তাঁর পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘আঁকশি’ গল্প। জীবনে দরিদ্রতার জন্য তাদের কোন ক্ষোভ নেই, তারা জানে এটাই নিয়তি। আর সেই নিয়তিকে সামনে রেখেই তারা জীব সংগ্রাম করে চলে। আর তাদের কথক সৈকত রক্ষিত। তিনি তাদের দেখেন নির্ভেজাল দৃষ্টি দিয়ে। ফলে তাঁর গল্পে আপাত রোমান্টিকতা আমরা পাই না। জুয়ালকাঠির অদূরে সাঁওতাল পল্লির বাস। ফাল্গুন চৈত্র মাসে মাগারাম তুলা সংগ্রহ করে সামান্য রোজগার করে। বনে বনে গিয়ে প্রথমে তুলা সংগ্রহ করলেও মাঝে মাঝে মালিককে টাকা দিয়ে গাছের তুলা কিনতেও হয়। সেই তুলা শুকিয়ে বাজারে বিক্রি করে। এমন একদিন মাগারাম স্ত্রী, পুত্র নিয়ে ভিন্ন গ্রামে গেছে তুলা সংগ্রহে। দিনের শেষে তুলা সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছে, গোটা গল্পটি এই একদিনের প্রেক্ষাপটেই লেখা। তবে দিনের শেষে মাগারাম ব্যর্থ হয় নি, তুলা নিয়েই বাড়ি ফিরছে। এই আনন্দে সে সমস্ত শ্রম ভুলে গেছে, মনে ভেসে আসে লৌকিক গান, এই গানই যেন তাঁকে তুলার বস্তা নিয়ে হাঁটতে সাহায্য করে, মনে আনন্দের বারি বর্ষণ করে। লেখক যেমন গল্পের ডিটেলিং এ যান তেমনি জীবনের অসহয়তা দেখিয়ে দেন, এ যেন পরিবেশে ও ভূগোলের অসহয়তা। যেন নিয়তি। এই নিয়তিকে মনে মনে মেনে নিয়েছে মাগারামরা। তবে তাঁর কোন হতাশা ছিল না, তাই সে নিজেকে ‘রাঢ়ের বাজিকর’ ভাবতেও পিছপা হন নি। তাই সে ভকু গরাইকে নিজের দারিদ্রতার কথা বলে হয়ত বিনে পয়সায় তুলা নিতে পারত, তবে সে কথা মুখ দিয়ে প্রকাশ পায় নি। তাঁর দৃঢ় ও আত্মপ্রত্যয়শীল চরিত্রকে লেখক নিখুঁত ভাবে দেখিয়েছেন। এ যেন লেখক সৈকত রক্ষিতের নিজের ই আত্মপ্রত্যয়। তেমনি রয়েছে প্রতিবাদ-

       “মাগারামকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোর নামটা ত বলছিস নাই বাবু ?’

       ‘হামার ? নাম ? মাগারাম।‘

       ‘মাগারাম ?’

       ‘হঁ। মাগারাম মুচি।‘

       ‘তার মানে তুঁই মাইগে মাইগে বুলিস?’

       গরাইয়ের এই খোলামেলা রসিকতায় মাগারাম নিজেও হাসে। কী জবাব দেবে বুঝতে না পেরে, সে       বলে, ‘আহা, গরিবের একটা সাপ-ব্যাঙ নাম ধরে লেন ক্যানে।‘ ( উত্তরকথা,পারুল, প্রথম সংস্করণ ২০১৫,

                                                       পৃ. ১৯ )

               সৈকত রক্ষিত নিজেই আখ্যান কথক, আখ্যান বিশ্লেষক ও বেবচ্ছেদক। জীবনের ওপরের রঙ নয় তিনি জীবনের গভীরে প্রবেশ করেন। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাই তাঁর কথাভুবনের মূল বিষয়। গুহিরামের জীবন সংগ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘পট’ গল্পটি। তাঁরা ঘরে ঘরে পট বানাত, ছবি আঁকত, কিন্তু সে দিন অস্তমিত হয়েছে। তবে এখনও তাঁরা পটকার নামেই পরিচিত। আসলে নিজেদের ঐতিহ্যকে তারা হারাতে চায় না। এখন সে দিন নেই তবুও ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চায়। গুহিরামের এখন কাজ মৃত্যু বাড়িতে গিয়ে পরলৌকিক ক্রিয়া সম্পর্কে নানা বিশ্বাসের কথা শোনানো, ফলে কিছু চাল সহ অর্থ জোটে। তবে শিক্ষিত পরিবারে সে প্রবেশ করে না, কেননা সেখানে কেউ এসব বিশ্বাস করে না। এজন্য গুহিরামকে খবর রাখতে হয় কোন বাড়িতে মৃত্যু ঘটেছে।  এ কাজের জন্য তাঁকে ছুটতে হয় এই গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। গ্রীষ্মের ভরা দুপুরে খালি পায়ে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সৈকতের বেশিরভাগ নায়কই  ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে না, তাদের অভিযোগ প্রকৃতির বিরুদ্ধে। আসলে পুরুলিয়ার রুক্ষ প্রকৃতিতে তারা বিদ্ধস্ত। তেমনি জীবনের প্রতি কোন আসক্তি নেই গুহিরামের, তাঁর সুসংবাদ আসে মৃত্যুতে –“ ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদ শুনতেও সে আগ্রহী নয়। তার যত আগ্রহ মরা মানুষের খবর জানার “ ( তদবে, পৃ. ৮৬ )। আসলে সৈকত রক্ষিত একটি সময়-সমাজের কথা বলতে চান। সেই সমাজের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তিনি সভ্যতার বিবর্তন দেখিয়ে দেন। আর সে বিবর্তন চিহ্নিত হয় পুরুলিয়ার ভূগোলকে কেন্দ্র করেই।

মুসলিম বাদ দিয়ে ছত্রিশ ঘর জাতির ঘরে মৃত্যুর পর উপস্থিত হয় সে, সামান্য রোজগারের আশায়। তাঁর স্ত্রী চেপি সহ দুই সন্তান নিয়ে অভাবের সংসার। তবে এঁরা কেউ নিয়তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেনি। তেমনি গুহিরাম উদাসীন সন্তানদের প্রতি। সে জানে এই রুক্ষ মাটিতে বাঁচতে হলে প্রথম থেকেই সংগ্রাম করতে হবে। লেখকের দৃষ্টি গুহিরাম সহ এই পটকর সমাজের প্রতি। সেই বৃত্তি কীভাবে হারিয়ে আজ অন্য বৃত্তিতে প্রবেশ করেছে পটকর সমাজ এবং সেখানে জীবনের যে বিবর্তন তাই তিনি দেখতে চান ও পাঠককে দেখাতে চান। এই পটকরদের স্ত্রী বছরের বিভিন্ন সময় জমিতে কাজ করে, মৃত্যুর খবর তারাই বহন করে আনে। গুহিরাম মৃত্যুর দ্রুত, মৃত্যুতেই তাঁর আনন্দ, তবে বাড়িতে ফিরে সে সন্তানের পিতা। লেখক সে জটিলতা অদ্ভুত সুন্দর ভাবে দেখান –“এখন গুহিরাম আর পাইট্‌কর নয়। সে অন্য মানুষ। সে সন্তানের পিতা। তার ভেতরেও সন্তানদের প্রতি মমতা আছে। পিতৃত্ব আছে। শত কষ্ট ও দারিদ্র্যের মধ্যেও সে চায় তার সন্তাদের দীর্ঘায়ু আর সতত হাসিমুখ।“ ( তদেব, পৃ. ৯৩ ) সমাজের পরিবর্তন গুহিরামের চোখে পড়ে, আসলে লেখকই তা পাঠককে দেখিয়ে দিতে চান।  সমাজে শিক্ষার প্রসার ঘটলেই তাদের এই কর্মের অবসান ঘটবে তা সে জানে, ফলে গোষ্ঠীবদ্ধতাকে টিকিয়ে রাখতে চায়। আজ গুহিরাম এক মৃত বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে, নানা ছল ছুতোয় নানা জিনিস নিয়েছে, যাবার সময় অন্য এক বাড়িতে প্রবেশ করে। কিন্তু সে বাড়িতে তখনও মানুষ মৃত হয় নি। কিন্তু পাইট্‌কার আসা মানেই অশুভের ইঙ্গিত, ফলে সবাই প্রহার শুরু করে গুহিরামকে। প্রথমে সে বাঁচার চেষ্টা করে, নিজের অর্জিত চাল রক্ষার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই রক্ষা করতে পারে না , শুধু ভেসে ওঠে অভুক্ত সন্তানের মুখ –

“প্রহৃত হতে হতেও চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে তার অভুক্ত সন্তানদের মুখগুলি। সে দেখতে পায়, তালগুড়গুড়ি কোলে নিয়ে উঠোনে পড়ে রয়েছে তার ছোট ছেলে। আধখানা পাঁউরুটি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে দু-ভাই।… ভাবতেই ভিড় ঠেলে নিজেকে বের করে আনে গুহিরাম। কিন্তু ছুটে পালিয়ে যেতে পারে না। পাথরে হোঁচট খেয়ে দণ্ডী দেওয়ার ভঙ্গিতে পড়ে যায়! চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে গাঁটা-বাঁধা চাল। গড়িয়ে যায় থালাটিও। তার কোমর থেকে খসে পড়া কাগজগুলো বাতাসে উড়ে যায়।“ ( তদেব, পৃ. ১০০ )

                           ‘উৎখাতের পটভূমি’ এক জীবন সংগ্রামের গল্প। ভারতবর্ষ নামক দেশের চলমান ইতিহাসের গল্প। যে ভারতবর্ষ আবহমান কাল ধরে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে, সেখানেও যে নানা উদ্বাস্তু আছে তাদের গল্প। আদিবাসী সমাজের যে বিশেষ পরিবর্তন ঘটে নি তা লেখক চোখে আঙ্গুল দিয়ে দিখিয়ে দেন। সৈকত রক্ষিত গল্পে জনজীবনের চালচিত্রের আভাস দিতে চান। তাঁর কাছে গল্পে আখ্যানের চেয়ে পরিবেশ বেশি গুরুত্ব পায়। পুরুলিয়া জেলার যে রুক্ষ প্রকৃতি তাই তিনি অঙ্কন করতে চান। সেই রুক্ষ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে রুক্ষতা, জীবনে বেঁচে থাকার যে অসহায়তা তা তিনি অঙ্কন করেন চিত্রকরের তুলিতে। ‘উৎখাতের পটভূমি’ এক আদিবাসী পুরুষ ও রমণীর ভূমিচ্যুত হওয়ার গল্প। চাকা নদীর তীরে কুটনি গ্রামে বসবাস সেমতি বেসরার। সে সন্তানহীন, স্বামীও কিছুদিন আগে মারা গেছে। আদিবাসী সমাজে সে চিহ্নিত হয়েছে ডাইনি হিসেবে। সমাজের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে সে বনে আশ্রয় নিয়েছিল। তাঁকে ভালোবাসে মড়েয়া নামে এক যুবক। প্রথমে সেমতির সন্দেহ হলেও পরে মড়েয়ার ভালোবার প্রতি বিশ্বাস জন্মে। তারা পালিয়ে গিয়ে নতুন করে ঘর বাধতে চেয়েছিল কিন্তু আবার ধরা পড়ে যায়। বিচারে অর্থ জরিমানা হয়, সিমতির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মড়েয়ারও অর্থ জরিমানা হয়। তবে শুধু অর্থই জরিমানা নয়, মড়েয়া সিমতিকে বিবাহ করে এই গ্রামে থাকতে পারবে না তাও জানিয়ে দেয় গ্রাম প্রধানরা। জরিমানায় প্রাপ্ত অর্থ দেবার জন্য কিছুদিন সময় দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই জমি বাড়ি সমস্ত ফেলে সেমতি ও মড়েয়া অন্য ভূখণ্ডে চলে যায়। লেখক ঘোষণা করেন –“এক আদিম ভূখণ্ড ছেড়ে আরও এক ভূখণ্ডের সন্ধানে।“ (তদেব, পৃ. ২৬৯ )। গল্পের কাহিনি এটুকুই। কিন্তু সৈকত রক্ষিত তো আর কাহিনি লিখতে চান না, তিনি গল্পে একটি সমাজ বিপ্লবের ইতিহাস ধরে দিতে চান। সেই সমাজের পরিবর্তনকে দেখিয়ে দিতে চান। একবিংশ শতাবন্দীর ভাচ্যুয়াল ওয়ার্ল্ডে  এসেও আদিবাসী সমাজ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে ? পরিবর্তনের ছোয়ায় তাদের জীবনে কি আদৌও কোন পরিবর্তন এসেছে ? লেখক সেই সব বিষয়ে বিশেষভাবে জোড় দেন। সহজ গদ্যে জীবনের বৃস্তৃতি দেখিয়ে দেন। সেই সঙ্গে তিনি চিত্রকরও। সে গদ্য পড়তে পড়তে যেন আমরা নিজেরাই সেই পরিবেশে উপস্থিত হয়ে যাই-

“সেদিনও নদীর নির্জন ঘাটে জল আনতে গিয়েছিল সিমতি। অন্ধকার গাঢ় হয় নি। আকাশে টুপটাপ তারাফুল ফুটছে। জেগে উঠছে জ্যোৎস্না। চাকা নদীর তরঙ্গহীন স্থির জলে চাঁদ হাসছে। কুমারী মেয়ের লাজুক নাকছবির মতো ফিনফিন করছে উজ্জ্বল চাঁদ। সিমতি তার কানভাঙা মাটির হাঁড়ি দিয়ে সেই চাঁদ ঠেলে ঠেলে জলে হেলিক দেয়। জল ভরে। মাথার পাতার বিঁড়া রেখে হাঁড়িটি বসিয়ে দেয়। মশ মশ শব্দে ভিজে বালি মাড়িয়ে সে যখন ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়, তখন আচমকা তার কানে আসে একটি ডাক।“ ( তদেব, পৃ. ২৫৮ )

‘উচ্ছেদ’ গল্প গড়ে উঠেছে কেষ্টের উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে। আসলে দরিদ্র মানুষকে নানা ভাবে নিপীড়িত হতে হয়। আর সে পীড়নের জন্য অপেক্ষাকৃত সামান্য ধনি মধ্যবিত্ত একজোট হয়। সেই শ্রেণিচেতনার কাছে পরাজিত হতে হয় দরিদ্র মানুষকে। দরিদ্র মানুষের কোন সঙ্গী নেই, আছে শুধু কৌশলে তৈরি করা ফাঁদে পা দেওয়ার পথ। কেষ্ট ছিল বাজারে সবজি বিক্রেতা, কিন্ত তাঁর পুজি সামান্য বলে দোকানের জৌলুসও কম। ফলে ক্রেতা তেমন আসে না। কাঁচামালের দোকানে দৈনিক বিক্রি না হলে লোকসান হতে বাধ্য। ফলে কেষ্টর দিনে দিনে লোকসানে হতে থাকে। কোনসময় সে কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম নিলে পাশের দোকানের নিরঞ্জন সে জায়গা দখল করে নেয়। পরে কেষ্ট বসতে পারে কিন্তু পরিসর কমে আসে। সাংসারে দারিদ্রের জন্য সে সন্তান অপরের দোকানে কাজে দিতে বাধ্য হয়। পরে আবারও সে সবজি নিয়ে বাজারে বসেছিল কিন্তু পাশের দোকানের অত্যাচারে স্থান পরিবর্তন এবং সেখানেও বিক্রির সুরহা করতে না পেরে সে ফেরিয়ালা হতে বাধ্য হয়। যে ছিল বাজারে প্রতিষ্ঠিত সবজি বিক্রেতা , সমাজের চাপে, পরিস্তিতির চাপে তাঁকে হতে হয়েছে আজ ভ্রাম্যমান সবজি বিক্রতা। লেখক বারবারই পরিবেশের ওপর জোড় দেন। তাঁর গল্প শুধু ব্যক্তিমানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না। ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে যে সমাজ সেই সমাজই যেন তাঁর গল্পের নায়ক। এ গল্পে কেষ্টের এই যে পরাজয় তার জন্য যেমন দায়ী বাজারের সমস্ত দোকানদাররা তেমনি ক্রেতারাও। আসলে টাকা দিয়ে কেই বা একটু খারাপ জিনিস কিনতে চায়। লেখক এই গোটা পরিমণ্ডলটিকেই ধরতে চান।

                     সৈকত রক্ষিতের দ্বিতীয় গল্প সংকলনের নাম ছিল ‘জন্মভূমি বধ্যভূমি’। এখানে ‘জন্মভূমি’ বলতে লেখক সেই পুরুলিয়ার পরিবেশের সঙ্গে গল্পের চরিত্রগুলির যে নাড়ির যোগ, ভৌগোলিক অবস্থানের যোগ, শিকড়ের যে যোগ তা বুঝিয়েছেন। আর ‘বধ্যভূমি’ হল কীভাবে এইসব মানুষগুলি স্বভূমি থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, শিকড় থেকে কীভাবে উদ্বাস্তু হচ্ছে সেই ইতিবৃত্ত লক্ষ্য করা। ‘উৎখাতের পটভূমি’ ও ‘উচ্ছেদ’ গল্পে সেই নিজভূমে পরবাসী হওয়া চরিত্রদের আমরা দেখতে পাই। লেখক হিসেবে তিনি জানিয়েছেন –“খালি পায়ে যাব / সহস্র খালি পায়ের কাছে।“ ফলে তাঁর গল্পের চরিত্ররা এক প্রত্যক্ষ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসে। সেখানে নান্দনিক কলাকৌশলের কোন ভিন্ন প্রয়োগ নেই। রুক্ষ মাটির মতোই তাঁর চরিত্ররা রুক্ষ ও বাস্তব। তবে বাস্তবতার বিবরণই সাহিত্য নয়। লেখকের মোটিপ হল ‘অ্যামবিয়েন্স বা এনভাইরনমেন্টকে’ ফুটিয়ে তোলা। আর সে কাজটি তিনি করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।

              সৈকত রক্ষিতের ‘মুখোশ’ গল্পটি বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সমাজিক ভারসাম্য, সংস্কৃতির বিবর্তন, ঐতিহ্যেকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা, শিল্পীসত্তার দ্বন্দ্ব, পিতৃসত্তার কাছে শিল্পীসত্তার পরাজয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পরিবর্তনশীল সময় সমস্ত মিলে মিশে লুকিয়ে আছে। একজন কথক কত শক্তিশালী হলে ও সমাজতান্ত্রিক ভাবনা কত প্রগাঢ় হলে এমন গল্প লেখা যায় তা গল্পপাঠেই সচেতন পাঠক লক্ষ্য করতে পারবেন। গল্পের নাম ‘মুখোশ’, শিল্পী ভীমা যেমন ছৌ নাচের মুখোশ তৈরি করে তেমনি মানুষের মুখের আড়ালে, ভালোবাসার আড়ালে যে  মুখোশ বর্তমান তা লেখক দেখিয়েছেন। ভীমা আজ কন্যা ছুটমণিকে হত্যা করতে উদ্যোত হয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত হত্যা করেনি। অমর মিত্রের ‘মেলার দিকে ঘর’ গল্পে আমরা দেখেছিলাম প্রবল অনাহারের দিনে পিতা কন্যাকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ গল্পে ভীমা কন্যাকে হত্যা করতে উদ্যোত হলেও, পাঠক যখন ভেবে নিতে চলেছে এ লেখক কী করছেন , তখন লেখক পাঠকের সমস্ত ধারনা ভেঙে দেন, জয়ী হয়ে যায় মানবিকসত্তা। কিন্তু প্রশ্ন হল ভীমা কন্যাকে হত্যা করতে কেন উদ্যোত হলেন ? আসলে যেখানে অভাব সেখানে নিত্য কুসংস্কার বাসা বাঁধে। লোকসংস্কৃতির যে মোটিপ বা চিহ্নতত্ত্বের ওপর লেখক জোড় দিবেছেন। কন্যা জন্মের দিন ভীমা দেখেছিল মনসার স্বপ্ন। তখন থেকেই মুখোশের কাজে অবনতি হতে শুরু করেছে। তেমনি দীর্ঘদিন পর ভীমা ও সন্তান শিল্পের জন্য মাটি আনতে গিয়ে পলাশ বনে মাটির ভিতরে দেখেছিল সাপ, যা ভীমাকে দংশন করতে এসেছিল। ভীমার মনে হয়েছে সেই কালনাগিনীই হয়ত সংসারে প্রবেশ করেছে।

       এ গল্পের প্রেক্ষাপটে রয়েছে ছৌ নাচের জন্য তৈরি করা মুখোশ শিল্পীদের জীবন বৃত্তান্তের কথা । আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘শিল্পী’ গল্পে দেখেছিলাম প্রবল অভাবেও মদন তাঁতি গামছা বোনে নি, লেখক মদনের শিল্পীসত্তাকে জয়ী করেছিলেন। তেমনি আনসারউদ্দিনের ‘শিল্পী’ গল্প ছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পটভূমিকায় লেখা, সে শিলপাটায় রাম মসজিদ ও বাবরি মসজিদের ছবি আঁকে, শিল্পীর যে কোন জাত নেই, ধর্ম নেই তা অদ্ভুতভাবে দেখিয়েছিলেন আনসারউদ্দিন। তবে জাতির ক্ষেত্রে গোত্রান্তর যে ভয়ঙ্কর ভাবে সত্য তা ঘোষণা করেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য তাঁর ‘গোত্রান্তর’ নাটকে। তাই সুনীল চন্দের ‘চক্ষুদান’ গল্পে দেখি মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য হারিয়ে, বাজার ধরতে এবং সময়ের চাহিদার কাছে কীভাবে শিল্পসত্তার পরাজয় ঘটেছিল। এ গল্পেও ভীমার নির্দেশ এসেছিল মুখোশের রীতি পাল্টানোর, কিন্তু সে লক্ষ্যে অবিচল-

“দু-একলোক আমাকে এমনও বলেছে যে তুমারই করিগর ? দুর্গা-ফুর্গার মুখের কাটিনগুলাকে ইবার পালটাও। সিনিমার হিরোইনদের পারা করে দাও। দেখবে কেমন জমবেক !

তখনকে ? কী জবাব দিলে তুমি ?

কী আর জবাব দিব ? বললি, না বাবা, শিল্পী হয়ে ওমন পাপ কাজ করতে লারব !” (তদেব, পৃ. ১৩০)

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের ধারা পাল্টে যায়, নতুন যুগ তার দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়। সেদিনের ঐতিহ্যবাহী ছৌ নাচ আর নেই। ছৌ নাচেও নানা পরিবর্তন এসেছে, প্রবেশ করেছে যুগের প্রভাব। আধুনিক সভ্যতার পণ্যবাহী সংস্কৃতি আজ সমস্তই গ্রাস করতে উদ্যোত, ফলে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যধারা। অর্থের অভাবে এই নাচে যেমন নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসছে না তেমনি আধুনিকতার নামে যা ইচ্ছা তাই সংস্কৃতির প্রভাবও লেখক লক্ষ্য করেছেন-“লাল ঝান্ডাধারী রামের’ মুখ দিয়ে সরাসরি দলীয় রাজনীতির ভাষণও দেওয়ানো হয়। এসব মুখোশশিল্পী হিসেবে রাখালেরও অজানা নয়, তবুও সে না হেসে পারে না।“(তদেব, পৃ. ১৩০ ) এই শিল্পের চর্চা আছে গবেষক মহলে, তবে চর্চা হলেই তো আর শিল্পীর পেট ভরে না, লেখক এই কঠিন বাস্তব সত্যের ওপর জোড় দেন-

“যদিও পুরুলিয়া জেলার বাইরে দেশে-বিদেশে ছৌ নাচ নিয়ে চর্চা তথা গবেষণা আরও বেড়েছে। কিন্তু তারা তো এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখবে না –তারা দশেমাসে শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানাবে মাত্র। গ্রামীণ এই শিল্পকে সত্যিকারের বাঁচিয়ে রাখবে তো গ্রামবাসীরাই।“ (তদেব, পৃ. ১৩১ )

লেখক ভীমার জীবনকে বহুকৌনিক দৃষ্টিকোন থেকে আলো ফেলে বিশ্লেষণ করেছেন। গল্প লেখা তাঁর কাছে শুধুমাত্র ঘটনা পরম্পরার বিবরণ দেওয়া নয়। তিনি নিজেই আখ্যান কথক ও বিশ্লেষক। সে বিশ্লেষণ সমাজতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষকের চোখে। যে ভীমা প্রথমে শিল্পীর সত্তায় অবিচল থাকতে চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর যাতাকলে পিষ্ঠ হতে হতে মনে হয়েছে এ পথ ভুল। ভীমা প্রথমে নিজের সন্তানকে মুকোশ শিল্পীর ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার সূত্রে গড়ে তুলতে চাইলেও পরে মনে হয়েছে এ পথ ভুল। আর সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে ভালোবাসার মুখোশের প্রতি পদাঘাত করে। তবে সে পরাজিত হয় নি। শিল্পীজীবন ভুল হলেও, ব্যর্থ হলেও সে শিল্পসত্তার ভুল পথে যায় নি। লেখক চমৎকার ভাবে ভীমাকে বিশ্লেষণ করেন-

“আর সর্বোপরি ভুল তার এই শিল্পীর জীবন। বারে বারে তার মনে হতে লাগল, এই জীবন প্রকৃত ব্যর্থতা ও বঞ্চনার জীবন। তার ধিক্কার জন্মাল নিজের ওপর। অনুশোচনাও হতে লাগল। এই কাজে তার নিপীড়িত জীবনের চল্লিশটি বছর দেখতে দেখতে খরচ হয়ে গেল। কে তাকে ফিরিয়ে দেবে এই আয়ু ? কার কাছেই বা সে এই কাতরতা জানাবে ? তার চারপাশে কোনো মুখ নেই – শুধু মুখোশ । কোনো একটি মুখোশের মধ্যেও সে তার মতো একটি বঞ্চিত মুখের অব্যক্ত ভাষাকে প্রকাশ করতে পারেনি। একজন শিল্পীর কাছে এর চেয়ে মর্মিক ব্যর্থতা আর কী হতে পারে ?” (তদেব, পৃ. ১৩৫ )

‘ছল’ গল্পটিও গড়েছে আদিবাসী জীবনের বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে।  আদিবাসী সমাজে লোকাচার বিশ্বাসের এখনও তেমন কোন পরিবর্তন ঘটে নি, ডাইনি প্রথা আজও সেখানে বর্তমান। ডাইনি প্রথাকে সামনে রেখে ‘উৎখাতের পটভূমি’র মত এ গল্পও গড়ে উঠেছে। ‘উৎখাতের পটভূমি’ গল্পে মড়েয়া ভালোবেসেছিল সিমতিকে, ভালোবাসাকে জয়ী করতেই তাঁরা পালিয়ে বেঁচে ছিল। এ গল্পেও সমাজের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে কালিন্দী ও রামলাল পালিয়েছিল তবে তাঁদের মধ্যে কোন ভালোবাসা ছিল না। ভালোবাসা অপেক্ষা জীবনে বেঁচে থাকাই যে শেষ কথা তা লেখক দেখিয়েছেন। আমরা তারাশঙ্করের ‘তারিণী মাঝি’ গল্পে দেখেছিলাম ময়ূরাক্ষীর হড়কা বান থেকে বাঁচতে তারিণী স্ত্রী সুখীর হাত ছেড়ে দিয়েছিল। জৈবধর্ম অপেক্ষা জীবনে জীবধর্মেরই জয় দেখিয়েছিলেন তারাশঙ্কর। সৈকত রক্ষিতও সেই জীবনধর্মেরই জয় দেখাতে চেয়েছেন, তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ও ভিন্ন পরিসরে।

                           কালিন্দীর স্বামী কালসুলি হাঁসদা, তাঁদের নিবাস জারাটাঁড় গ্রামে। এই সাঁওতাল গ্রামে তিন বছর ভালো ফসল হয় নি। ফলে গ্রামবাসী সখাবাবার কাছে এর কারণ নির্ধারণ করতে গিয়েছিল। সখাবাবা জানায় গ্রামে ডাইনির বাস তাই এই অবনতি, আর এই ডাইনি এসেছে ধলডাঙি গ্রাম থেকে। এই ধলডাঙি গ্রামেই বিবাহ করেছিল কালসুলি। ফলে গ্রামবাসী ধরে নেয় কালসুলির স্ত্রী কালিন্দীই ডাইনি। তবে কালসুলি ও তাঁর পিতা ভক্তিপদ প্রতিবাদ করছিল কিন্তু গ্রামবাসীর যৌথ দাবির কাছে তা টেকে নি। এমনকি কালসুলিকে এর জন্য প্রহারও করা হয়। গ্রাম্য রীতি অনুসারে সমাজ নেতারা জরিমানাও করে, তবে সে টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না কালসুলির পক্ষে। শেষে স্থির হয় কালিন্দীর সঙ্গে একরাতে একঘরে থাকবে গ্রাম্য নেতা রামদুলাল। তবেই প্রমাণ হবে কালিন্দী প্রকৃত ডাইনি কি না । রামদুলালের দৃষ্টি ছিল কালিন্দীর প্রতি। তবে সৈকত রক্ষিত যৌনতার শিল্পী নন। যৌনতার দৃষ্টিনন্দন তাঁর গল্পে লক্ষিত নয়। যখন পাঠক ভেবে নিয়েছে এই বুঝি ধর্ষিত হতে চলেছে কালিন্দী, তখনই তিনি বাজিমাত করেন, এখানেই তাঁর মুন্সিয়ানা। একদিকে রামদুলালও পেতে চায় কালিন্দীকে, অন্যদিকে ডাইনি অপবাদ থেকে নিজেকে রক্ষা করার প্রবণতা। শুধুমাত্র জীবনে বেঁচে থাকতে স্বামীকে ভুলে রামদুলালের সঙ্গে পালিয়ে যায় কালিন্দী-

“ভোরের অন্ধকার থাকতেই গ্রামবাসীরা এসে ভিড় করে সেই মাটির ঘরের কাছে। গ্রামের মালিকরাও আসে। তারা দেখে ঘরে কেউ নেই। মাটির মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে আছে ডিবা। চুঁইয়ে পড়া কেরোসিন গোল হয়ে ছড়িয়ে গেছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। কপাট হাট করে খোলা। বোঝা যায়, টাঙি দিয়েই কেটে ফেলা হয়েছে কড়ায় পাকানো পাড়টি। তবু তারা রটিয়ে দেয়, রামলাল আর বেঁচে নেই। ডাইনে তাকে খেয়ে ফেলেছে।

‘কিন্তুক ডাইন ? কুথায় গেল ডাইন্‌টা ?’ কৌতুহলী গ্রামবাসীদের এই প্রশ্নের জবাবে তারা বলে, ‘ডাইন্‌ কি আর থাকে ? রামলালকে খাঁইয়ে উ কুথায় ছন্ন হয়ে গেছে !” ( তদেব, পৃ. ৩৩৯ )

 এও এই ভূমিচ্যুত উচ্ছেদের গল্প। লেখকের লক্ষ্য থাকে সামাজিক পরিবর্তনকে ফুটিয়ে তোলা। আদিবাসী সমাজেও যে বিবর্তন ঘটে চলেছে এই পরিবর্তনের স্রোতকে ফুটিয়ে তোলা। ডাইনি অপবাদ দিতেই গর্জে উঠেছিল  কালসুলি –“মানি নাই তদের বিচার-ফিচার ! কুছু মানি নাই !” ( তদেব, পৃ. ৩৩৬ ) তেমনি ডাইনি অপবাদ যে শুধু সমাজের গোষ্ঠীপতিদের স্বার্থ সিদ্ধির কৌশল তা জানতো রামদুলাল। আসলে সেই রীতিপদ্ধতিই গোষ্ঠীপতিদের মূলধন। তবে লেখক সামাজিক বার্তাও দিতে চান, ফলে কালিন্দী ও সিমতিরা যে ডাইনি নয় গল্পের শেষে তাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।

                           মধ্যবিত্তের গোত্রান্তর নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘নিউ রক্ষিত ভাণ্ডার’ গল্পটি। এই মধ্যবিত্তের গোত্রান্তর খুব সহজ নয়, অহংকার, ব্যক্তিত্ববোধ সহ অর্থনৈতিক কাঠামো যখন তলানিতে ঠেঁকে তখনই সম্ভব হয় এই গোত্রান্তর। পতন যখন স্থরে স্থরে নিম্নজ্জিত হতে হতে শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছায় তখনই মধ্যবিত্ত নিজের শ্রেণিচ্যুত হয়। আনন্দের প্রথমে বাজারে দোকান ছিল, কিন্তু বড় সংসার চালাতে গিয়ে সে দোকানের সমস্ত পুঁজি শেষ হয়ে গেছে। আনন্দরা তিন ভাই। বর্তমানে আনন্দের রোজগার শূন্য। ফলে ছোটভাই বাচ্চুর রোজগারে তেমন ভালোভাবে সংসার চলে না। অনেকেই আনন্দের দোকান ভাড়া চেয়েছিল কিন্তু সে দেয় নি। অভাবের সংসারে নিত্যদিন তাঁকে ভাই ও পিতার কাছে নানা বিদ্রুপ শুনতে হয়। একদিন বিদ্রুপের মাত্রা চরমে উঠলে সে দুপুরের খাবার পরিত্যাগ করে। পরের দিনই নতুন কাজের সন্ধানে চলে যায়। দোকানের মালিক আনন্দ প্রথমে অন্য কাজে ইচ্ছা না হলেও, লজ্জাবোধ করলেও পারিবারিক লাঞ্ছনা আজ তাঁকে এই পথে নিয়ে এসেছে। সে মানিকের দোকানে কাজ করতে চাইলেও মানিক তাঁকে ঠেলাগাড়ি ভাড়ার উপায় করে দেয়। দোকানের মালিক আনন্দ আজ থেকে হয়ে যায় ঠেলাগাড়ির ভাড়াওয়ালা রক্ষক। সৈকত রক্ষিতের গল্পে নৈতিকতা বর্জিত মানুষ দেখা যায় না। মানুষের বিবেক বোধের বলি দেখালেও তিনি শেষ পর্যন্ত মানুষের মানবতাকেই জয়ী করেন। তাই আনন্দের অসহায়তার দিনে এগিয়ে এসেছিল মানিক। আজ আনন্দের হাসি আর ধরে না, এ হাসি নতুন জীবনচেতনার হাসি, মধ্যবিত্তের শ্রেণি রূপান্তরের হাসি। সৈকত রক্ষিত গল্পের ডিটেলিং এ ভারি সিদ্ধহস্ত। অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্রের বিবৃতি দিয়েই তিনি বিদায় নেন না, ঘটনার রন্ধে রন্ধে প্রবেশ করেন। প্রতি গল্প থেকেই দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়, তবে আমরা শুধু একটি দিয়েই ক্ষান্ত হব-

“ এই পুরুলিয়ার সমস্ত ঠেলাই তো আসে রাঁচি থেকে। আনন্দর ঠেলা দুটোও আসবে সেখান থেকে। আসার মধ্যে আসে লোহার দুটো চাকা, যাদের গায়ে বসানো থাকে টায়ারের মোটা ও গোল একটা চাদর, আর থাকে দুটো চাকার মধ্যবর্তী এক্সেল বা লিঘা এবং হ্যান্ডেল দুটো। এরই দাম পড়ে যায় বারোশো টাকার মতো। এগুলো আসে কোলা অবস্থায়। কাঠের মিস্ত্রি লাগিয়ে ফের সেগুলো জুড়তে হয়। তারপর এই চেসিসের ওপরে ফিট করতে হয় বডি। বডির জন্য কাঠ এবং মিস্ত্রির মজুরি নিয়ে আরও ছ-শ।“ ( নিউ রক্ষিত ভাণ্ডার )

 একজন পাঠক যদি গল্পের মধ্যপথে গিয়ে উপলব্ধি করতে পারেন গল্প এই পথে যাচ্ছে, অথচ শেষে গিয়ে যদি সেই ভ্রান্তি ঘুঁচে যায় তখনই একজন গল্পকারের প্রকৃত জয়। আর এ বিষয়ে সৈকত রক্ষিত যে সিদ্ধহস্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘বয়ার কাড়া’ গল্পটি গড়ে উঠেছে এক মোষের লড়াইকে কেন্দ্র করে। তবে সৈকতের লক্ষ্য থাকে একটি জনজীবন, একটি সমাজকে তুলে ধরা। তিনি একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গল্প সাজালেও ঘটনাকেই একমুখী রাখেন না, বৃত্তের চারিদিকে যে বিসর্গ তারও আভাস দেন। শবর লোধা আর সর্দারদের বাস এই পিয়ালশোলে। এখানকার অধিবাসীদের বছরের বেশির ভাগ সময়ই কোন কাজ থাকে না, খাদ্যের তাগিদায় বহু মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়। সাগারাম সর্দার খুব নিরুপায় না হলে গ্রাম ছাড়ে না। আগের বছর গ্রামে আসার সময় সে একটি মোষ কিনে এনেছে, এই মোষকেই সে করে তুলেছে স্বাস্থ্যবান লড়াকু ‘বয়রা কাড়া’। সাগারামের ঘরে আছে দুই বাই। ঝুমুর ও খেমটা নাচ করেই সাগারামের দিন চলে। সংসারে প্রবল অভাব তবে সে সর্বদা উল্লাস প্রিয়। ঘরে থাকা দুই বাইয়ের মধ্যে সুখীরানী বেশি সুন্দর বলে সাগারামের পক্ষপাতিত্ব থাকলেও আসরে সে দুই বাইকেই সমান ভাবেই সাজায়। নাচের আসরে আর পক্ষপাতিত্ব নেই। আগে অন্য গ্রামে বয়রা কড়া হত। এবার পিয়ালশোলেই সে খেলার আয়জন করেছে সাগারাম। সে খেলায় জয়ী হয়েছে সাগারামের মহিষ। এই ঘটনাকে সামনে রেখে লেখক সেই সমাজের লোকাচার, জীবিকা, আনন্দে মেতে ওঠার বর্ণনা এনেছেন। সাগারম সহ এ গ্রামের সেই হত দরিদ্র মানুষগুলি যেন আজ সাগারামের পক্ষ নিয়েছে। দরিদ্রকে ভুলে আজ যেন পিয়ালশোলের জয় হয়েছে-

“আসলে এ শুধু লড়াই নয়। কাড়াকে মাধ্যম করে মানুষের সঙ্গে মানুষেরই লড়াই। অথবা তাদের অবচেতনে, তাদের বঞ্চনা আর অদৃষ্টের বিরুদ্ধে লড়াই। তাই গ্রামের মধ্যে যারা সত্যিকারের হা-ভাতের দল, যাদের কাড়া নেই, তারাও এ লড়াইয়ে শামিল। সমর্থকের ভূমিকায় নেচে-কুঁদে-কুলকুলি দিয়ে আত্মপক্ষের বিজয় তারা ছিনিয়ে নিতে চায়।“ (তদেব, পৃ. ৩৬০ )

 আসলে এ জয় মহিষ বা সাগারামের নয়, পিয়ালশোল সহ সমস্ত দরিদ্র মানুষের। আর এই জয়কে কেন্দ্র করে পিয়ালশোলের সমস্ত গ্রামবাসী দরিদ্র ভুলে আনন্দে মিলিত হয়েছে, হাড়িয়া সহ ঝুমুর নাচে মেতে উঠেছে। এই দরিদ্রের জয়, পরাজিত মানুষের মিলনই এ গল্পের মূল বিষয়।

                           সৈকত রক্ষিত সমাজের পরিবর্তনের স্রোতকেই গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় করতে চেয়েছেন। কেন্দ্র থেকে, ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে মানুষ কোন পথে চলেছে সেই পথের বিবর্তিত রেখাই তাঁর গল্পের লক্ষিতব্য বিষয়। তাই ‘আঁকশি’ ‘পট’ গল্প যেমন যাত্রাপথই গল্পের বিষয় তেমনি ‘মুখোশ’ ‘উৎখাতের পটভূমি’ ‘উচ্ছেদ’ ও ‘নিউ রক্ষিত ভাণ্ডার’ গল্পে ভূমিচ্যুত সহ স্থানচ্যুত হওয়ার প্রসঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে এসেছে। তেমনি গল্পে তিনি লোকাল কালারকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর লক্ষ্যই থাকে পুরুলিয়ার হারিয়ে যাওয়া ভাষা, লোকসংস্কৃতির পরিচয় লিপিবদ্ধ করা। তিনি জানেই এই সাংস্কৃতিক সম্পদ একদিন হারিয়ে যাবেই। ফলে গল্প উপন্যাসে তা তিনি জীবিত রেখে যেতে চান পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের জন্য। তাঁর আলোচ্য প্রতিটি গল্পেই পরিবেশ, প্রকৃতিসহ এসেছে লোকজ জীবন। আমরা শুধু বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করব –

প্রকৃতি

ক. “তখন ঢের রাত।আষঢ়ের বর্ষণস্নাত নীল আকাশে ছোট্ট শিশুর মতো টলটল করছে পূর্ণিমার চাঁদ। যেন   যে কোনো সময় কদম ফুলের মতো খসে পড়বে উঠোনে। ভাঙা চালের ফাঁকে ফিনকি দিয়ে ঢুকছে চাঁদের আলো। আর সেই আলোয় ঝলমল করছে ঘুমন্ত ছুটুমণির নিষ্পাপ মুখখানি।“ ( মুখোশ, পৃ. ১৩৬ )

খ.”সেদিনও নদীর নির্জন ঘাটে জল আনতে গিয়েছিল সিমতি। অন্ধকার গাঢ় হয়নি। আকাশে টুপটাপ তারাফুল ফুটছে। জেগে উঠেছে জ্যোৎস্না। চাকা নদীর তরঙ্গহীন স্থির জলে চাঁদ হাসছে। কুমারী মেয়ের লাজুক নাকছবির মতো ফিনফিন করছে উজ্জ্বল চাঁদ। সিমতি তার কানাভাঙা মাটির হাঁড়ি দিয়ে চাঁদ। সিমতি তার কানাভাঙা মাটির হাঁড়ি দিয়ে সেই চাঁদ ঠেলে ঠেলে জলে হেলিক দেয়। জল ভরে। মাথায় পাতার বিঁড়া রেখে হাঁড়িটি বসিয়ে নেয়। মশ মশ ভিজে বালি মাড়িয়ে সে যখন ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়, তখন আচমকা তার কানে আসে একটি ডাক।“ (উৎখাতের পটভূমি, পৃ. ২৫৮ )

                                  শুধু প্রকৃতি নয় তিনি সমগ্র জীবনের শিল্পী। সে জীবন সাঁওতাল, শবর, লোধাদের দৈন্দনিন চালচিত্রের জীবন। বাংলা আখ্যান ভুবনে যা নতুন। সে পথের যাত্রী হিসেবে আমরা পেয়েছি নলিনী বেরাকে। এই সমস্ত কথাকার এক নতুন জীবনবোধ নিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যের ভুবনকে যেমন বিস্তৃত পরিসরে নিয়ে গেছেন তেমনি এনেছেন আখ্যানের নতুনত্ব। এখানেই এঁদের অভিনবত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত