Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla-sahitya-iftar-journal-part-8

সময়ের ডায়েরি: ইফতারি জার্নাল । মুম রহমান

Reading Time: 5 minutes
চুরি যাওয়া দিনগুলি
 
আমরা হয়তো লক্ষ্যই করি না, আমাদের অমূল্য সব সম্পদ কেমন করে চুরি হয়ে যায়। উন্নয়ন, প্রযুক্তি ইত্যকার নানা অজুহাতে আমাদের আবেগ, প্রেম, ভালোবাসা চুরি হয়ে যায়, ছিনতাই হয়ে যায়। এই যে ইনবক্সে আর স্ক্রিণশটের এই যুগে কি চোখের সঙ্গে চোখের মিল হয়? সানি লিওন কিংবা কিম কার্দাশিয়ার এই যুগে এসে কি হাতে হাত রাখার শিহরণ হয়? যখন কিবোর্ড টিপলেই, মেগাবাইট, গিগাবাইট কিনলেই হাতের কাছে নগ্নতা এসে পড়ে তখন কি আর প্রেমপত্র লেখার আনন্দ থাকে? আম-জাম কুড়ানির দিন শেষ। এখন অনলাইনে অর্ডার দিলে বৈশাখের আম ঘরে এসে পৌঁছে যাবে। বিভূতিভূষণের উপন্যাস পথের পাঁচালীতে অপু-দূর্গার আম কুড়ানোর কি বিস্ময়কর বর্ণনাই না আছে। কতো রকম আম গাছের নাম? আমাদের ছেলেমেয়েরা কি জানবে পাকা আমের পেছন দিকে দাঁত দিয়ে একটু ফুটো করে তারপর টিপে টিপে, চুষে চুষে সেটাকে খাওয়া যায়? ছোট ছোট আবেগ আর আনন্দগুলো আমরা হারিয়ে ফেললাম।
আমি একসময় খুব বড়লোক একটা স্কুলে মাস্টারি করতাম। সেও প্রায় এক যুগ আগের কথা। তখন আমি একটা নোকিয়া ফোন চালাই। স্কুলে ছেলেমেয়েদের ফোন আসা নিষেধ। তো এক ছাত্রী আইফোন নিয়ে এলো। নিয়ম অনুযায়ী ফোনটা নিয়ে আমি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিলাম। এইবার আমিই বিপদে পড়লাম। কারণ ওই ছাত্রীর বাবা-মা-অভিভাবক কেউই আসে না ফোন নিতে। আমি ছাত্রীকে বললাম, তোমার ফোন নাও না কেন! সে বললো, নেভার মাইন্ড, আই ডোন্ট নিড ইট! আমার চোয়াল ঝুলে গেলো। ক্লাস সেভেনের মেয়ের হাতে আইফোন। তখনও আমি স্বপ্ন দেখতে পারি না যে আমি একটা আইফোন কিনবো। সেই আইফোন তার লাগবে না! প্রতি বছর সামার আর উইন্টার ভ্যাকেশন হতো আমাদের স্কুলে। এই ছুটিতে বিদেশের (মূলত ইউরোপ বা আমেরিকার) সামার-উইন্টার মাথায় রেখেই হতো। কারণ ছুটিতে অধিকাংশ ছেলেমেয়েই বিদেশে ঘুরতে যেতো। ছুটি শেষ হলে ওরা যখন প্রথম ক্লাসে আসতো আমি জানতে চাইতাম, হাউ ওয়াজ দ্য ভ্যাকেশন। অধিকাংশই এক শব্দে জবাব দিতো, বোরিং। আমার চোয়াল ঝুলে পড়তো! আমার সারা জীবনের স্বপ্ন (এখনও পূরণ হয়নি) একটু ইউরোপ, আমেরিকা যাবো, দেশ-বিদেশ ঘুরবো, অথচ ওদের কাছে এগুলো বোরিং। একটা আইফোনের গুরুত্ব ওদের কাছে নেই, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, কানাডা ট্যুরও ওদের কাছে বোরিং লাগে। অথচ আমি স্কুলের ছুটিতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যেতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। পুরো ময়মনসিংহ শহর আমি টইটই করে ঘুরতাম। আর পকেটে যদি দুটাকা থাকতো নিজেকে বিরাট বড়লোকের সন্তান ভাবতাম!
অর্থনীতির উন্নতি, প্রযুক্তির উন্নতি, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হলো–কিন্তু মানুষের ছোট ছোট জিনিসে আনন্দ পাওয়ার অভ্যাসটা আর থাকলো না!
 

আরো পড়ুন: ইফতারি জার্নাল (পর্ব-৩)

 
আর বড় বড় জিনিসগুলো যে চুরি হয়ে গেলো, ছিনতাই হয়ে গেলো তাও কেউ খেয়াল করলো না। আমাদের দৃষ্টিশক্তি থেকে আকাশ সরিয়ে নেয়া হয়েছে খুব সুকৌশলে। আমরা কজন সৌভাগ্যবান আছি এই ঢাকা শহরে যারা বিছানায় শুয়ে আকাশ দেখতে পাই। চারিদিকে অট্টালিকা। একেকটা দালান যেন কনুই দিয়ে আরেকটা দালানের সঙ্গে ঘেষে আছে। দেখে দমবন্ধ লাগে। আকাশ দেখা, ফুল পাখি দেখা তো দূরের কথা, পাশের বাড়ির ভাইয়ের কাশির শব্দেও অনেক সময় জানালা খোলা যায় না। এতো ঘেষাঘেষি করে আমরা থাকি, অথচ কেউ কাউকে চিনি না। চেনা মানুষকেও বলি, আপনার ফেসবুক আইডি দেন তো? হোয়াটস্্যাপ আছে আপনার? ইন্সটায় কী নামে থাকেন? ঘরের বউ এই ঘর থেকে ও ঘরে এসে কথা বলে না, ফেসবুকে কমেন্ট করে যায়! তো একান্ত আকাশের মতো, মেঘের মতো, আমরা আমাদের ছোট ছোট স্পর্শ, দীর্ঘশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি।
নগর গড়ার জন্য আমরা গাছ কেটেছি। নিরাপত্তার জন্য মজবুত দেয়াল দিয়েছি। উঁচু উঁচু দালান করেছি। তারপর দেখি, একি, সবুজ নেই, আলো নেই, হাওয়া নেই। কী করি উপায়? ছুটে চলো, নার্সারিতে। থাই পেঁপে আছে? থাই পেয়ারা? বিদেশি ফলের গুতোয় আতা ফল আর পাওয়া যায় না। পেলেও দাম অকল্পনীয়। আমলকি যে পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হয় সেটাই তো জানতাম না আমরা। শাপলা ফুলও যে শ’হিসাবে বিক্রি হয় তাই বা ভাবতে পেরেছিলাম কখনো? এখনও তো মনে পড়ে, স্কুল কলেজের বয়সটায় আমরা প্রত্যেক একুশে ফেব্রুয়ারিতে নিজেরা শহীদ মিনার বানিয়েছি। রাস্তা থেকে, পাশের বাড়ি থেকে, ইট কুড়িয়ে এনে, মাটি দিয়ে শহীদ মিনারের আদল তৈরি করেছি। তারপর এর গাছ ওর গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে এনে (কখনো চুরি করে এনে) প্রভাত ফেরি করেছি। বুড়োকালে একবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গেলাম। ফুলের স্তবক আর তোড়ার আকার, সেই সঙ্গে নানা প্রতিষ্ঠানের নাম-ধাম দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো, এ কি শ্রদ্ধাঞ্জলি নাকি কর্পোরেট প্যাকেজ? আমাদের চোখের সামনে একুশে ফেব্রুয়ারি একটা উৎসব হয়ে গেলো! ঈদে কাপড় কিনতে হয়, সে কাপড় লুকিয়ে রাখতে হয়, সে কাপড় কেউ দেখে ফেললে ঈদ নষ্ট হয়ে যায়, তখন কেঁদে অস্থির হতে হয়। দরজি কাকার দোকানে গিয়ে বারবার খোঁজ নিতে হয় চাঁদ রাতে আমার শার্টটা পাওয়া যাবে কি না! সে কি উৎকণ্ঠা! আর এখন ঈদ বানান ‘হ্রস্ব ই-কার’ হয়ে গেলো। আর আমরা দেখলাম, বিজয় দিবস, ভ্যালেন্টাইন দিবস, পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, নারী দিবস, পুরুষ দিবস– নানা দিবসের পোশাক আছে! পোশাকি হয়ে গেলাম আমরা। পোশাক সর্ব স্ব হয়ে গেলাম আমরা। আমরা মানুষের মুখ দেখতে ভুলে গেলাম। চোখে চোখে কথা বলা চুরি হয়ে গেলো। এখন পোশাক দিয়ে, লেবাস দিয়ে যাচাই করি একে অপরকে!
নিজের ঘরে শুয়ে কিংবা বারান্দায় বা উঠানে গিয়ে আমরা পূর্ণিমা দেখেছি, বৃষ্টি দেখেছি। বাড়ির পেছনের পুকুরে চাঁদের ছায়া দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এখন চাঁদ দেখতে গেলে ফেসবুকে ইভেন্ট খুলতে হয়। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, পূর্ণিমা, নক্ষত্রের রাত দেখতে হলে রীতিমতো আয়োজন করে জায়গা খুঁজে নিতে হয়। আমাদের চাঁদ, তারা, ফুল, পাখি চুরি হয়ে গেছে, ছিনতাই হয়ে গেছে। আমরা কি আমাদের সন্তানকে চিনিয়েছে কোনটা ধান শালিক আর কোনটা গাঙ শালিক? বোরো আর আমন ধান তো দূরের কথা, আইড় আর বোয়াল মাছ চেনে তো আমাদের ছেলেমেয়েরা? পিৎজা-পাস্তার ভিড়ে হারিয়ে গেলে পুলি পিঠা, পাক্কন পিঠা, নকশি পিঠা। ভাপা আর চিতই এখনও ফুটপাথে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে তবুও।
চিপস মানে আমরা বুঝতাম গোল গোল আর পাতলা করে কাটা আলু, একটু নুন হলুদ মাখানো। তা বানাতেন আম্মা নিজে। প্রতিদিন বিকালের নাস্তায় আলুর চপ, ছোলা, চটপটি, হালুয়া, মুড়ি মাখানো– যা কিছু খেয়েছি তা ঘরে বানানো, মায়ের হাতের রান্না। মা-খালার রান্নার খাওয়ার যে স্মৃতি আমাদের জিভে আর পরাণে লেগে আছে তার সঙ্গে কি সুপারশপ থেকে কেনা চিপস-চকলেটের তুলনা চলে? এই রান্না, এই খাওয়া তো একটা বন্ধনও ছিলো। জগতের সেরা রাঁধুনি বলতে এখনও তো আমাদের কাছে মা। কিন্তু পরের প্রজন্ম কিংবা তার পরের প্রজন্ম? মায়ের হাতের আচার, চচ্চড়ি, ঝোলের আদর কি হারিয়ে যাবে একদিন? সকালগুলোতে দেখি মহল্লার হোটেলে ভিড় করে পরোটা কেনা হচ্ছে, ভাজি, সবজি, ডিম কিনে নিয়ে যাচ্ছে অনেকেই। আমাদের সময় হোটেলে খাওয়া, বাড়ির বাইরে খাওয়াকে ভালো চোখে দেখা হতো না। বড় হয়েও হোটেলে চা-সিঙ্গারা খাওয়ার একটা নিষিদ্ধ আনন্দ ছিলো। ভাবটা এমন, এবার আমি সত্যিই বড় হয়ে গেছি।
আর বড় হয়ে কী দেখলাম, মুড়ি ভাজতেন যে কাকিমা তাকে কেউ চেনে না। এখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলেও অমুক কোম্পানির মুড়ি, তমুক কোম্পানির চানাচুরের প্যাকেট খোলা হয়। আমাদের খই মুড়ি চুরি করে নিয়ে গেছে কর্পোরেট কোম্পানিরা। মনে পড়ে, বছর পনের আগে শিবচরে ছবি তুলতে গিয়ে এক বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারা গরম মুড়ি ভাজা দিয়েছিলো, সাথে মরিচ-পেয়াজ মাখানো মূলা। এ সবই কৃষকের নিজের উৎপাদন। সেই মূলা-মুড়ির স্বাদের কাছে বিশ্বের সেরা চিপস, বিস্কুটও তুচ্ছ মনে হয় আজও। এই ঢাকা শহরে প্রায় চার দশক কাটিয়েও আমি বোধহয় শৈশবের গ্রামের স্মৃতি থেকে বের হতে পারিনি।
আমরা কখনো বলিনি, কুমাররা মাটির হাড়ি-কলসি বানায়, আমরা বলতাম, রমেন কাকা কলসি বানায়, থালা বানায়। পূর্বা মাসি, চৈতালি দিদি, রাবেয়া ফুপু একসাথে সারা রাত ঢেকিতে চাল বানতেন। আমাদের চারপাশে ছিলেন মাসি-পিসি, ফুপা-কাকা, নানী-বড় মা আরো কতো সম্পর্ক। কোনদিন হিসাব করিনি, বুঝতেও পারিনি, ও হিন্দু, আমি মুসলমান। আমার কোরবানিতে ওরা এসেছে, ওদের পূজাতে আমি গেছি। এ তো বেশিদিন আগের কথা নয়। তখন অতো মাইক মেরে, চিৎকার করে ওয়াজ হতো না। হেলিকপ্টারে করে কোন হুজুর আসতো না, লাখ টাকার বিনিময়ে অসহিষ্ণু কথাবার্তা বলতো না। পুরুত কাকা আর বড় হুজুর দুজনকেই তো সালাম দিয়েছি। আহা, আমাদের সম্প্রীতি, আমাদের যৌথ উৎসব, পারস্পরিক শ্রদ্ধাগুলো চুরি হয়ে গেছে, ছিনতাই হয়ে গেছে।
 
 
 
 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>