Categories
সময়ের ডায়েরি: ইফতারি জার্নাল । মুম রহমান
আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
আপনি যে ঘরে বাস করেন সেখানেই কি থুতু ফেলেন, মল-মূত্র সেখানেই ত্যাগ করেন? যে আপনাকে আহার দেয়, বাসস্থান দেয় তাকেই কি আপনি যেমন তেমন অবহেলায় ব্যবহার করেন? তাই যদি না-করেন তবে এই পৃথিবীটার কথা একটু ভাবুন। এই যে মা পৃথিবী সে ছাড়া কি আর এই বিশ^জগতে আপনার থাকার উপযুক্ত আর কোন জায়গা আছে? না, তন্ন তন্ন খুঁজে লক্ষকোটি মাইলের মধ্যেও আর একটি গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি যেখানে মানুষের উপযুক্ত আবাস আছে। অথচ এই মানুষই কি পৃথিবীকে নোংরা করে, পরিবেশ দূষণ করে।
বাঘ, সিংহ, কুকুর, বিড়াল, গন্ডর, পিঁপড়া, শকুন, তিমি, অক্টোপাস জগতের আর কোন প্রাণীকূল মানুষের মতো আত্মঘাতী নয়। সুন্দর সবুজ, ফুলে-ফলে ভরা, নির্মল জলধারা, পাহাড়-পর্বত পেয়েছিলো মানুষ। এগুলো কাউকে উপার্জন করতে হয়নি, বানাতে হয়নি। পৃথিবী ভালোবেসেই মানুষের উপযুক্ত করে নিজেকে সাজিয়েছে। সৃষ্টিকর্তার সব প্রাণীর জন্যই আবাসস্থল এই পৃথিবী নামের ছোট্ট গ্রহটি। আর এই ছোট্ট গ্রহের মানুষের নামের দুপেয়ে প্রাণী সব দখল করতে চায়। গাছের ফল, ফুল, নদীর পানি, ঝর্ণার পানি, গরু, ভেঁড়া, পাখি, কচ্ছপ, কাঁকড়া, মাছ– সবই খেয়ে ফেলতে চায় মানুষ। আর সব কিছু দখল করতে চায়। বন উজার করে ফেলেছি আমরা, পাহাড় ধ্বসিয়ে দিচ্ছি, নদী দখল করে ফেলছি, সমুদ্রে ময়লা ফেলছি, এমনকি হিমালয়ের চূড়া থেকে মহাশূন্য সবখানেই নিজেদের উচ্ছিষ্ট ফেলে আসছি আমরা। কিন্তু এই পৃথিবীতে আমার-আপনার ব্যক্তিগত ময়লার ভাগার নয়, এমনকি আমাদের একক সম্পত্তিও নয়। একটা মহিষ, তেলাপোকা, গুবড়েপোকা, ভাল্লুক, জোনাকি সবারই বাসস্থান এই পৃথিবী। সবার এই বাড়িটাকে আমরা কি নিজেদের লোভেই ধ্বংস করবো?
এখন তো বোধহয় বোঝার সময় হয়েছে, আমাদের বিকল্প বাসস্থান নেই। আপনার টাকা থাকলে বাংলাদেশ ছেড়ে আপনি আমেরিকা, ইউরোপ গিয়ে বসবাস করবেন? কিন্তু সেখানেও যদি বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ না পান, তবে কোথাও যাবেন? মেরু বরফ গলতে শুরু করেছে, পাহাড়ে বরফ গলতে শুরু করেছে, অরণ্য ক্রমাগত মরুভূমি হয়ে উঠছে। পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে। মারণঘাতি রোগব্যাধি বাড়ছে। আমাদের মা পৃথিবী অসুস্থ। তাকে এখনি লাইফ সাপোর্ট দিতে না-পারলে সে বাঁচবে না। আর মা-পৃথিবী মরে গেলে আমরাও বাঁচবো না।
আজকের গুগুল ডুডল থেকে যখন মনে পড়লো, আরে তাই তো আজ পৃথিবী দিবস (আর্থ ডে) তখন এইসব কথা আবার মগজে চাড়া দিয়ে উঠলো। যারা নিয়মিত পড়ছেন ইফতারি জার্নাল তাদের জন্য আজ এই পৃথিবী দিবস নিয়ে কয়েক লাইন লিখতে চাই। এই লেখাটুকু হয়তো আমার উপকার দেবে। যতোবার নিউজফিডে (মেমোরিতে) ফিরে আসবে ততোবার মা পৃথিবীর কথা আরো গভীর করে ভাবতে পারবো আশা করি।
প্রথম পৃথিবী দিবস পালিত হয়েছিলো আজ থেকে ৫১ বছর আগে ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল। মার্কিন সেনেটর গাইলর্ড নেলসন এই দিবসের ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৬৯-এর সান্তা বারবারায় যে ভয়াবহ তেল দূষণ হয়েছিলো তা দেখেই নেলসন মহাশয় পৃথিবীর আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরেছিলেন। এরমধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের অনেক ইঙ্গিতই তিনি পান। আশার কথা যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাকে এ দিবস পালনে সহায়তা দিয়েছিলেন। ২২ এপ্রিল দিবসটি নেলসন বেছে নিয়েছিলেন নানা হিসাব নিকাশ করেই। তারমধ্যে অন্যতম বিষয় ছিলো এই সময়টায় স্কুল-কলেজ খোলা থাকে, আবহাওয়াও থাকে অনুকুল। নেলসনের মূল ইচ্ছা ছিলো নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা যেন এই দিবসটিতে সচেতন হয়। তার যেন পৃথিবী নামক এই গ্রহটির যত্ন নেয়। সুখের কথা যে প্রথম বছরেই নেলসনের ডাকে লক্ষ লক্ষ তরুণেরা পৃথিবী দিবস পালনে এগিয়ে এসেছিলো। শুরুটা আমেরিকাতে হলেও ক্রমে পৃথিবী দিবসের ধারণাটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে ডেনিস হায়াস পৃথিবী দিবস সমন্বয়ে দায়িত্ব পেলেন। আর তার চেষ্টাতেই একসাথে ১৪১টি দেশে পালিত হলো পৃথিবী দিবস আর সারা পৃথিবীর ২০ কোটি মানুষ এই আয়োজন উদযাপনের সঙ্গী হয়। তারপর থেকে পৃথিবী দিবসে হাজার হাজার পরিবেশবাদী সংগঠন, পৃথিবীপ্রেমী তরুণ প্রজন্ম স্বতস্ফুর্তভাবে এ দিবস পালন করে আসছে।
আরো পড়ুন: ইফতারি জার্নাল (পর্ব-৪)
২০১১ সালে পৃথিবী দিবস উপলক্ষে আফগানিস্তানে প্রায় তিন কোটি বৃক্ষ রোপণ করা হয়। ‘গাছ লাগাও, বোমা নয়’ (Plant Trees Not Bombs) নামের এই প্রকল্প পৃথিবী দিবসের অন্যতম একটি সাফল্য। ২০১২ সালে চীনে লক্ষাধিক মানুষ সাইকেলকে তাদের বাহন করে নেয়। গাড়ির বদলে সাইকেল চালানোর কারণে সেখানে বাতাসে ক্ষতিকর কার্বন ডাই অক্সাইডের মিশ্রণ কমে যায় রাতারাতি। ২০১৬ সালে এসে আমরা দেখি ২০০টি দেশের শত কোটি লোক পৃথিবী দিবস পালনে অংশগ্রহণ করছে। নতুন করে বনায়ান, কার্বন দূষণ কমানো, গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমানোর মতো কাজের মাধ্যমে পৃথিবী দিবস পালন হয়ে আসছে। ২০২০ সালে বিশে^র নানা প্রান্তে ৭৮০কোটি বৃক্ষ রোপণ করার বিশাল প্রকল্প নেয়া হয়।
প্রতি বছরই পৃথিবী দিবস পালনের ক্ষেত্রে একটা মূলভাব বা বিষয় নির্ধারণ করা হয়। এ বছরের পৃথিবী দিবসের মূলভাব হলো ‘আমাদের পৃথিবী পুনরুদ্ধার’ (Restore Our Earth)। পৃথিবীর পরিবেশ দূষণ কমিয়ে একে সকল প্রাণীকূলের উপযুক্ত করা এবং সমগ্র প্রকৃতির উন্নয়নের মাধ্যমে পৃথিবীকে সুস্থ-সবল করে তোলাই এবারের মূল মন্ত্র।
এখন এই সোস্যাল মিডিয়ার যুগে এসে আমরা তো কতো রকম চ্যালেঞ্জই গ্রহণ করে থাকি। ছয় শব্দে গল্প লেখা থেকে একেকদিন একেক রঙের শাড়ি পরার মতো বহু চ্যালেঞ্জেই আমরা সাড়া দিয়েছি। আজ এই পৃথিবী দিবসে আমি আপনাদের একটা চ্যালেঞ্জ দেই, আপনার জীবন থেকে মাত্র একটা ঘণ্টা সময় ব্যয় করুন এই পৃথিবীর জন্য, এমন কিছু একটা করুন, যাতে পৃথিবীর উপকার হয়। পৃথিবীর সুন্দর হলে, সুস্থ হলে আমরাও টিকে থাকবো আরো আরো আনন্দ নিয়ে। আমি এখানে ১০টি ভাবনা আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিচ্ছি, এর যে কোন একটি করলেই আপনি পৃথিবীর উপকার করতে পারবেন। আপনার নিজের সামর্থমতোই এর যে কোন একটি দিক পালন করুন, অন্ততে একবার হলেও করুন।
১. ইংরেজিতে বলা হয় তিনটা আর (R)-এর কথা। এগুলো হলো : Reduce, reuse, and recycle। বাংলায় বলতে পারি, হ্রাস, পুনব্যাবহার এবং নবায়ন। উদাহরণ দেই, ধরুণ আপনি পানির ব্যবহার কমিয়ে আনলেন, হয়তো জিনিসপত্র ধোঁয়ার সময় কলটা টানা ছেড়ে রাখলেন না এটাই হলো হ্রাস বা রিডিউস। এবার যে পানিটা দিয়ে থালা-বাসন ধুলেন সেটা দিয়েই বাগানের গাছে পানি দিলেন বা গাড়ি মুছলেন, এটা হলো পুনব্যবহার বা রিইউজ। আর যদি এই পানিটা বিশুদ্ধ করে আবার ট্যাঙ্কিতে ফিরিয়ে আনা যায় আবার ব্যবহার করা যায় সেটাই নবায়ন বা রিসাইকেল।
২. স্বেচ্ছাশ্রম দেয়া। সাধারণ সচেতনতার মাধ্যমে খুব সামান্য শ্রম দিয়েই হয়তো আমরা পৃথিবীর উপকার করতে পারি। হয়তো নিজের এলাকার ময়লা পরিস্কারে সাহায্য করতে পারি স্বেচ্ছায়। সেটুকু না-পারলে ময়লা পরিস্কারে নিয়োজিত মানুষটিকে উৎসাহ দিতে পারি।
৩. শিক্ষা নেয়া এবং দেয়া। শিক্ষা সব সময়ই সচেতনতা বাড়ায়। আমরা হয়তো একটা ঘণ্টা পরিবেশ দূষণ নিয়ে পড়তে পারি। নিজের পড়া বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারি শিশুদের সঙ্গে। যে পড়ালেখা জানে না তাকে বুঝিয়ে বলতে পারি, এই পৃথিবী সুস্থ থাকার গুরুত্ব কতোটুকু।
৪. পানি সংরক্ষণ। এই পৃথিবীতে এক সময় সবচেয়ে বেশি দামী হবে পানি। পানির অপর নাম জীবন কথাটা মুখস্থ করলেও আমরা এখনও পানির গুরুত্ব বুঝি না। অথচ এই মুহূর্তে পৃথিবীর এমন অনেক স্থান আছে যেখানে বিশুদ্ধ খাবার পানিও দূর্লভ। আমরা পানির অপচয় রোধ করতে পারি, সংরক্ষণ করতে পারি আমাদের নদী, খাল, জলাধারকে।
৫. এই করোণাকালে আমরা নিয়মিত হাত ধুচ্ছি। অনেক সময়ই এমন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করছি যা পানিতে মিশে পানি দূষণ করছে। কোন রকম রাসায়নিক দ্রব্য পানিতে না ফেলার চেষ্টার করতে পারি আমরা।
৬. অবশ্যই প্লাস্টিক এই পৃথিবীর মাটি, হাওয়া, জলের জন্য একটা হুমকি। হিমালয়ের চূড়া থেকে সমুদ্রের গভীরেও আমরা প্লাস্টিক ব্যাগ ফেলে আসছি। এগুলো মাটির সঙ্গে মিশতে শত শত বছর লেগে যাবে। অন্যান্য প্রাণীকূলের জন্যও এই প্লাস্টিক ব্যাগ বিপদজনক। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারি আমরা। একশটা পলিথিনের বদলে একটা পাটের থলে ব্যবহার করলেও পৃথিবী মাতা উপকৃত হবেন।
৭. আলোর ব্যবহারেও আমাদের সাবধান হতে হবে। অধিক উত্তাপ এবং অধিক বিদ্যুবাহী বাল্ব গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃস্বরণ বাড়ায়। বিদ্যুৎ শক্তির অপচয় কমানো জরুরি। অন্তত যখন ঘরে থাকছেন না তখন লাইট আর ফ্যান নিভিয়ে রাখুন। এসি কম ব্যবহার করুন।
৮. একই কথা জ্বালানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। খনিজ গ্যাস, খনিজ তেল আমাদের অফুরান নেই। এক সময় ভাণ্ডর ফুরিয়ে আসবে। তার আগেই বুঝে-শুনে হিসাব করে তেল-গ্যাস খরচ করতে হবে। থাকলে আমরাই পাবো, না-থাকলে হাহাকার করবো কেবল।
৯. এটাও জ্বালানি বাঁচানোর সাথে সংযুক্ত। চীনের উদাহরণ মেনে গাড়ির ব্যবহার কমান। পেট্রোল, ডিজেল যমন অফুরান নেই, তেমনি এরা পরিবেশ দূষণকারীও। চাইলে দুচার কদম বেশি হাঁটুন। এতে আপনার শরীরও ভালো থাকবে। সাইকেল চালান।
১০. স্রেফ একটা গাছ লাগান। গাছ লাগানোর জন্য আপনাকে বিরাট জমিদার হতে হবে না, জায়গা জমি লাগবে না। প্রয়োজনে পথের ধারে, যে কোন প্রতিষ্ঠানে কিংবা অনাবাদি কোন জায়গায় কিংবা জঙ্গলে-পাহাড়ে গিয়ে হলেও একটা গাছ লাগান। ভেবে দেখুন প্রায় আটশত কোটি মানুষ আছে এই পৃথিবীতে। সবাই যদি একটি করে গাছও লাগায় আটশত কোটি গাছ দিয়েই বদলে যাবে পৃথিবী।
অনেক কথা হলো। হয়তো এতোদূর পড়ে কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আপনাদের জন্য শেষে এসে আমার অন্যতম প্রিয় কবি চেশ্লভ মিলজের একটা কবিতা উপহার দিলাম নিজে অনুবাদ করে–
‘‘এমন নয় যে আমি দেবতা কিংবা নায়ক হতে চেয়েছি।
স্রেফ রূপান্তরিত হতে চেয়েছি একটা গাছ হিসাবে,
যুগ যুগ ধরে বড় হবো,
কাউকে আঘাত না-করেই।’’
জন্ম ২৭ মার্চ, ময়মনসিংহ। এমফিল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা লেখালেখি।