Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla-sahitya-iftar-journal-part-8

সময়ের ডায়েরি: ইফতারি জার্নাল । মুম রহমান

Reading Time: 5 minutes
 
বই দিবসের আখ্যান
 
‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’– এই প্রবাদ বাক্যের প্যারোডি করেছিলেন সত্যজিৎ রায় তার হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রে। সেখানে একটা সংলাপ ছিলো, ‘লেখাপড়া করে যে অনাহারে মরে সে’। আজকের দিনে এসে এই সংলাপ অনেকটাই সত্য হয়ে গেছে। অন্তত আমার আজকের এই সোনার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ টাকাঅলা লোকদের কিংবা প্রচুর গাড়ি-বাড়িঅলা লোকদের তালিকার দিকে যদি তাকাই তবে দেখবো যে তারা আর যাই করুক, প্রচুর লেখা-পড়া করেনি। আমি অবশ্য লেখাপড়া বলতে কেবল বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বলছি না। আমি বলছি সৃজনশীল পড়ার কথা, পাঠ্য বইয়ের বাইরে যে বিশাল জ্ঞানভা-ার আছে সেটি চর্চার কথা বলছি। সেই সুপ্রাচীন লাউৎ সে থেকে আজকের মিশেল ফুকো তক জ্ঞানের বিপুল ভাণ্ডার পাঠ করার সঙ্গে অবশ্য গাড়ি-ঘোড়ার কোন সম্পর্কই নেই। থাকলে ভালো হতো, না-মন্দ হতো তা জানি না– তবে বই পড়ার আনন্দ থেকে, জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব থেকে তথাকথিত যান্ত্রিক এই যুগ ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।
এ কথাও অবশ্য বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেই বলছি। কারণ বিশ্ব বাণিজ্য বাজারে এখনও কিন্ডল বুক, কোবো কিংবা ই-বুক রিডার বিক্রির হার কম নয়। এখনও জালাউদ্দিন রুমি থেকে হারুকি মুরাকামি পর্যন্ত লেখকদের বই বিশ্ব বাজারে লাখ কপি বিক্রি হয়। আর আমরা তিনশত কপি বই বিক্রি করতে এর জামা ধরে টানি, ওর শার্ট ধরে টানি, একে ইনবক্সে মিনতি করি, তাকে ঘি-মাখন লাগাই। চিত্রটার ভিন্ন দিক আছে। যদি নির্দিষ্ট ধর্মের বই, কথিত মটিভেশনাল বইয়ের কথা ধরি কিংবা ইংরেজি ভাষা শিক্ষা বা ইউটিউব চালানোর শিক্ষাকে সাহিত্য বা সৃজনশীল পাঠের তালিকায় ধরি তাহলে এ দেশেও ভালো সংখ্যক বই বিক্রি হয়। ফেসবুক কেন্দ্রিক কোন কোন জনপ্রিয় লেখকের বইও বিক্রি হয় হাজারে হাজারে। কিন্তু ফ্যান-ফলোয়ার-বুস্টিংয়ের কথা বলছি না, যদি সাহিত্য বা সৃজনশীলতার কথা বলি, তবে সত্যিকারের ভালো বইয়ে আমাদের সামগ্রিক অবহেলা অবশ্যই আছে।
আমার নিজের লেখা দিয়েই উদাহরণ দেই। এ বছরই আমি একটা বই করেছিলাম, শামস আল তাবরীজের ‘ভালোবাসার ৪০ সূত্র’ বইটার অনুবাদ। এই বইটা দ্বিভাষিক। মানে ইংরেজি ও বাংলা পাশাপাশি আছে, সেই সঙ্গে আমার নিজের তোলা ৪০টা আলোকচিত্রও আছে। পেপারব্যাক হলেও জলধি থেকে প্রকাশিত এই বইটি খুব নিটোল আর নিঁখুত একটি প্রকাশনা। শামস আল তাবরীজকে যারা চেনেন না তাদের সুবিধার্থে বলি তিনি ছিলেন মওলানা জালাউদ্দিন রুমি’র গুরু, পথ প্রদর্শক। বলা হয়ে থাকে, যখন রুমি আর তাবরিজের সাক্ষাত হয় তারা একটা কক্ষের মধ্যে ৪০ দিন অবস্থান করেছিলেন। সেখানে তারা ধ্যান করেছেন এবং ক্রমশ তাবরিজের এই ৪০টি সূত্র রুমির কাছে উন্মোচিত করা হয়েছে। অত্যন্ত সরল, সহজ আর আকর্ষণীয় ভাষায় বয়ান করা এই সূত্রগুলো উৎকৃষ্ট কবিতার মতোই আকর্ষনীয়, সরস এবং গভীর অর্থবাহী। শামস আল তাবরিজ তার এই ৪০ সূত্র দিয়ে শিষ্য জালাউদ্দিন রুমিকে তথা তাবত বিশ্বকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। সরল ভাষায় গভীর কথা প্রকাশের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে শামস আল তাবরিজের ‘ভালোবাসার ৪০ সূত্র’। আমরা তো এটা জানিই যে ৪০ সংখ্যাটি সূফিবাদে নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
এই বইটি যখন আমি অনুবাদ করেছিলাম আমার ধারণা হয়েছিলো যে এই বইয়ের হাজার কপি অন্তত বিক্রি হবে। আমার অনুবাদের গুণে নয়, তাবরিজের বিস্ময়কর জ্ঞান ভাণ্ডারের গুণে মনে করেছিলাম এই বই এ দেশের মানুষ লুফে নেবে। আমি অন্তত নিজে আমার দুঃখ-বেদনায়-শোকে-রাগে-ক্ষোভে এই বইকে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের মতো ব্যবহার করেছি। ধারণা করেছিলাম, বহু লোক এই বই থেকে উপকৃত হবে। কিন্তু বইটি তেমন করে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছায়নি। আমি লজ্জ্বায় প্রকাশককে জিজ্ঞাসাও করতে পারিনি এই বই কতো কপি বিক্রি হয়েছে। এই উদাহরণটা দিলাম এই কারণে যে, আমি অন্তত রকমারি ডটকমের বেস্টসেলার থেকে বাছাই করে, ধরে ধরে বলতে পারবো যে তাদের তালিকার অনেক অনেক বইয়ের চেয়ে আমার এই বইটি বিষয়, উপস্থাপন এবং মূদ্রণ গুণে অনেক এগিয়ে। তাহলে কি ধরে নেয়া যাবে যে, ভালো বই থেকে আমাদের মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি আমরা? ভালো বইয়ের প্রতি অবহেলা কেন তৈরি হলো?
 

আরো পড়ুন: একখন্ড শৈশব (পর্ব-১)

 
কারণটার গভীরে লুকিয়ে আছে ওই ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’ আপ্ত বাক্যের মধ্যে। আমাদের শৈশবে যতো কিছু শেখানো হয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে জঘন্য শিক্ষাটা এটাই যে বই পড়লে গাড়ি-ঘোড়া চড়ার সামর্থ হয়। মানে পাঠের মতো নির্মল, বিশুদ্ধ আনন্দ, পাঠের মতো সাধনাকেও আমরা চাকরি-বাকরির সাথে জুড়ে দিয়েছি। বিসিএস-এর পড়া তৈরি করা দোষের নয়। কিন্তু চাকরীর জন্য পড়া আর জগতের জ্ঞাণ ভাণ্ডারের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার পড়া অন্য জিনিস।
আমার প্রায়শই এমন মনে হয় যে, জ্ঞানের জগতে আমরা একটা ধারাবাহিকতা রক্ষা করি। আমার পিতামহ যে বৃক্ষটি লাগিয়ে গেছেন তার ফল তিনি ভোগ না-করলেও আমরা ভোগ করছি, আমার পিতার জমি আর বাড়ি আমি ভোগ করছি। তেমনি সক্রেটিসের জ্ঞান, লালনের জ্ঞান আমরা পেয়েছি ধারাবাহিকতার মাধ্যমে। মানুষের প্রতি মানুষের এই ধারাবাহিক উপহারকে তুচ্ছ গাড়ি আর ঘোড়া দিয়ে মাপতে শেখানো হয়েছে আমাদের।
বই যে বৌদ্ধিক আর মানসিক বিকাশের অনুসঙ্গ, বই যে বিশুদ্ধ বিনোদন সেটা আমরা ভুলে গেছি। অথবা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। হীরক রাজার দেশেইরই আরেক সংলাপ ছিলো, ‘জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।’ শাসনতন্ত্র আমাদের কম জানাতে পারলে খুশি। কারণ ‘এরা যতো বেশি জানে ততো কম মানে।’ বাইবেলের কথা মনে আছে তো। ইভ যখন জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করলো তখনই তার সদাসদ জ্ঞান হলো, মানে ভালো-মন্দ ভেদাভেদ তৈরি হলো। আর সেই অপরাধে তাকে বিতাড়িত করা হলো স্বর্গ থেকে। অর্থাৎ স্বয়ং ঈশ্বরও চাননি আমাদের বোধদয় হোক। আমি নিজে ছোটবেলা, মা’র হাতে অনেক মার খেয়েছি ফালতু বই পড়ার জন্যে। ফালতু বই মানে, স্কুলের পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই।
আমি এখনও দেখি আমাদের দেশে বহু পাঠক আছেন, ‌এই বই পড়িয়া কী শিক্ষা পাইলাম সে প্রশ্ন প্রায়শই করেন।’ অথচ তাহারা এতো শিক্ষামূলক বই পড়িয়াও কোথায় কফ-থুতু ফেলতে হবে আর কোথায় মূত্র বিসর্জন করতে হবে সেই সাধারণ শিক্ষাটাও অর্জন করে নাই। কোট-টাই পড়া, ভালো জিপিএ পাওয়া আর পাঠের আনন্দ পাওয়া এক নয়। আমি নিজে দেখিছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ফার্স্টক্লাস পাওয়া ছাত্ররা পাঠ্যবই, এসাইমেন্ট আর টিউটোরিয়াল সমৃক্ত জ্ঞানই নিয়েছে। মানে, তারা কেবল ভিটামিনই খেয়েছে। তাদের অনেকেই পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, সরকারী কর্মকর্তা ইত্যাদি হয়েছে। সেটা হওয়া দোষের নয়, কিন্তু তারচেয়েও ভালো হতো তারা যদি খানিক সংবেদনশীল, রুচিশীল কিংবা রসিক মানুষ হতেন। রসবোধ আর রুচির আকাল কিন্তু আপনার প্রতি মুহূর্তে দেখছি। একটা মানুষের রুচি, সংবেদন আর রসবোধ না-থাকলে জ্বালানি কাঠের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে ভাববো কেন তাকে? আপনি জীবন ভর গাড়ি-ঘোড়া চড়ার আশায়, মানে ক্যারিয়ার আর টাকা-পয়সার চিন্তায় বই পড়েছেন এবং সফল হয়েছেন। কিন্তু এই সাফল্য আপনাকে একটি উন্নত কলুর বলদ ছাড়া আর কী করেছে? বাড়ি-গাড়ি-শাড়ি-নারী, ক্ষমতা-বিত্ত হয়তো আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ করেছে কিন্তু আপনি কি জীবনের আনন্দ পেয়েছেন। আপনি কি যে ধারাবাহিক প্রবাহমান জ্ঞানভাণ্ডারে অবগাহন করেছেন?
আমি মনে করি, জ্ঞান-প্রজ্ঞার বহমান ধারাটি অটুট রাখতে বই সবচেয়ে একটা বিশাল অদৃশ্য সেতু। সেই সেতু আপনাকে নিয়ে যাবে পুলক আর বিস্ময়ের জগতে। সে জগত এলিসের ওয়াণ্ডারল্যান্ড কিংবা ওজের যাদুকরের দেশের চেয়েও মনোরম। এই মনোরম যাত্রায় গাড়ি-বাড়ির চেয়ে অনেক অমূল্য রতন আপনার জন্যে অপেক্ষা করে। গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, বাড়ি ধ্বসে পড়ে– কিন্তু জ্ঞান, প্রজ্ঞা ফুরায় না, হারায় না, নষ্ট হয় না। এমনকি তাকে সংরক্ষণও করতে হয় না, বিলিয়ে দিলে বাড়ে।
সভ্য, সুরুচিশীল যথার্থ মানুষ হওয়ার জন্য বই পড়ার কোন বিকল্প আদতেই নেই। সাম্প্রতিককালে অধ্যাপক এনি ই. কানিংহাম তার এক গবেষণায় প্রমাণ করেছেন, যারা নিয়মিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়ে তারা অনেক বেশি চৌকস (স্মার্ট) হয়। টাকাঅলা লোকের চেয়ে স্মার্ট লোক আকর্ষণীয়। খেয়াল করুন আমি পয়সাঅলা, টাকাঅলা লোক বলি, কিন্তু তাদেরকে ধনীলোক বা বড়লোক বলি না। সত্যিকারের ধনীলোক, বড়লোক হলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, জগদীশচন্দ্র বসু, আইনস্টাইন, ডারউইন- প্রমুখ। আসুন না, আমরা পয়সাঅলা লোকের চেয়ে ধনীলোক, বড়লোকদের ভালোবাসি, তাদেরকে বেশি সম্মান দেই। জানেন তো, সম্মান দিলে সম্মান ফেরত পাওয়া যায়।
লেখাটা শেষ করি আরো দুটো গবেষণার কথা দিয়ে। মনস্তাত্ত্বিক আচরণ বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টেল রাসেল প্রমাণ করেছেন যে, বই পাঠ আপনার অস্থিরতা, মানসিক চাপ কমিয়ে দেয়। এই করোনাকালে আমরা অনেকেই মানসিক চাপে ভূগছি, বিশেষ করে লেখক-কবি-পাঠকরা অস্থিরতায় ভূগছেন। তাদের জন্য বই পাঠ চিকিৎসা পদ্ধতির অংশ হতে পারে। মার্কিন নিউরো বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, বই পড়া স্মৃতিকে উজ্জীবিত করে। যাদের স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে বা হচ্ছে তাদের স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলতে বই পড়া কার্যকর ভূমিকা রাথে। এমনকি এলঝাইমার, ডিমনেশিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রেও বই পাঠ উপকারী হতে পারে। এই মুহূর্তেই মনে পড়ছে নিকোলাস স্পার্কের বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য নোটবুক’-এর কথা। এখানে দেখি এলঝাইমার আক্রান্ত এলি ভুলে গেছে তার প্রেমিক-স্বামী নোয়াকে, ছেলেমেয়েদেরকে। আর নোয়া হাসপাতালে প্রতিদিন এলিকে তার নোটবুক থেকে গল্প পড়ে শোনায় স্মৃতিকে জাগ্রত করতে। একই নামে এই বই অবলম্বনে হলিউডে চলচ্চিত্রও হয়েছে। বই পড়ায় এলার্জি থাকলে চলচ্চিত্রটি দেখতে পারেন, প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে। নিশ্চয়তা দিচ্ছি, ভালো লাগবে।
তবে আবার বলে নিচ্ছি, বই পড়ার কোন বিকল্প নেই। বই আপনাকে আরো চৌকস, বুদ্ধি, আবেদনময় (সেক্সি) করে তুলবে। বই আপনার ভাষাভঙ্গি, চিন্তার ধরণ এবং বিবিধ দক্ষতা বাড়িয়ে দেবে। মোদ্দা কথায় আপনি হয়ে উঠবেন আকর্ষণীয়।
 
 
 
 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>