| 10 নভেম্বর 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

তিনটি দীর্ঘ গদ্য কবিতা । হাবীব ইমন

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

অসম্পর্কিত সময়চেতনা ‘আপন-পর’

জীবনটা কেমন যেনো ফানসে ফানসে লাগছে। অথচ কতো না ইচ্ছে ছিলো একদিন ফানুস হবো। ইথারে ইথারে উড়ে বেড়াবো। যতোদিন যায়, দুয়ারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন আর খোলা আকাশ দেখতে পারি না। নয়ন জুড়ে কেবল অস্থিরতা আর ভয়। যে দুর্বৃত্তের সাথে আমরা লড়াই করছি, তাকে দেখা যায় না, অস্পষ্ট আন্দামান একটা। দিন যায়, মাস যায় আমাদের লড়াই শেষ হয় না। বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর। মেঘ জমে ক্ষণে ক্ষণে। কিন্তু আমাকে তারা ছুঁতে পারে না। অথচ একদিন এরা কতো আনন্দে আমাকে ঘিরে রাখতো। এখন আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে অচেনা-অজানা-অদেখা একটা দুর্বৃত্ত। কোভিড-১৯। আমার ভিত্ কাঁপিয়ে তোলছে। মাঝে মাঝে মনে হয়. আমি কী বেঁচে আছি, এইভাবে কী বেঁচে থাকা যায়! জরাজীর্ণ বেঁচে থাকা!

লকডাউন চলছে। ছুটি চলছে। অনেকদিন অপেক্ষায় ছিলাম এমন একটা ছুটির। লম্বা একটা অবসর মিলবে। অফুরন্ত সময় কাঁটবে। কিন্তু অবসর তো মিলছে না। মাথার ভেতর কতো চিন্তা-দুশ্চিন্তা উঁকি-ঝুঁকি মারছে। কতো বই এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছি, কিন্তু ওগুলো নাড়তে ইচ্ছে করে না। পড়তে ইচ্ছে করে না। আমার মন এখন তৃষ্ণার্ত নয় বই পড়ার জন্য, আমার মন কেবলই শঙ্কিত। ওই যে বললাম, অদেখা একটা দানব, যে আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এ দানবীয় শক্তি গোটা পৃথিবীকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করছে।

ক’ দিন আগের কথা। ফেরা যাক তবে। এই যে ছোট্ট রেস্তোরাঁতে কাঁটালাম, মুখোমুখি দু’পেয়ালা চা আর গরম গরম পুড়ি খাবারদাবারে চটা ওঠা কাপডিশ, লবণদানি, পানির গেলাস। পর্দা ঝুলছে তবু কেবিনের আব্রæ বাঁচিয়ে নিয়নবাতির আলো ঢেলে দেয় ঘরে। জানালার পাল্লাটা খুলে দিয়ে দেখে নিতাম শহরের ঘোলাটে দু’চোখ। কমরেড রিয়াদ, কমরেড কবীর আপনাদের কি মনে পড়ে সেদিনগুলোর কথা?

ব্যাপারটা যদি নিছকই ভিন্ন ভিন্ন সময়বোধে ভিন্ন-ভিন্ন ব্যক্তির বাস করার প্রশ্ন হতো, তাহলে কিছু অসুবিধা হতো না। একটু রিলেটিভিস্ট কায়দায় বলতে পারতাম. ‘বেশ তো, আপনি থাকুন আপনার সময়ে. আমি থাকি আমার নিজস্ব যুগে।’ এইরকমই হয়ে থাকে মৃত ও জীবিত মানুষের সম্পর্কে।

এখন সুবহে সাদিক হলে আমি জানালা দিকে তাকিয়ে থাকি, কতো মানুষ হাত উঁচু করে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের কাছে খাওয়া নেই। খাওয়ার পয়সা নেই। দুইদিন আগেও এই মানুষগুলোকে দেখিনি। শোনেছি, বাহাদুরেরা খাওয়া দিচ্ছে। কোথায় সে খাবার? কেনো মানুষ খাওয়ার জন্যে ছুটছে। মরিয়া হয়ে উঠছে।

আমি দুর্ভিক্ষ দেখিনি। বইতে পড়িছি, মায়ের কাছে গল্প শুনেছি। জয়নুলের খাদ্যের অভাবে কঙ্কালের ছবি দেখেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে বাংলার জনপদ ও জনজীবনে স্বাভাবিক বিন্যাস ভেঙে পড়েছিল। দেশের মানুষ ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ এবং তৎসহ বস্ত্রসংকটের শিকার হয়েছিল। কিন্তু আমাকে আজ সেই অদেখা দানবটা দুর্ভিক্ষ দেখাচ্ছে। দানবটা পুঁজিবাদী বিশ্বে সিংহভাগ মানুষের শ্রম, উৎপাদন, সম্পদ, সুখ কেড়ে নিয়েছে। মুষ্টিমেয় মানুষ এখনও এদের শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে শোষণ করছে। শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিশোষণ যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে শ্রেণিবিরোধ। এ যেন বিশ্বায়নের ভেঁপু-বাদকদের সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের রূপকথার গল্প।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমশক্তিও পণ্য। শ্রমশক্তি যে শ্রমিকের মধ্যে রয়েছে, তার চেতনাও বিদ্যমান। শ্রমিক ছাড়া পুঁজি বাড়তে পারে না, উৎপাদন করতে পারে না। তাই পুঁজির শ্রমশক্তিকে চাই। কিন্তু শ্রমশক্তিকে দিয়ে যা খুশি করানো যায় না, শ্রমিকরা প্রতিরোধ করতে জানে। কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, এই ক্ষেত্রে পুঁজিপতি ও শ্রমিক, দুইয়েরই দাবি ‘ন্যায্য’। আর দুই ন্যায্য দাবির মধ্যে ফয়সালা করে শক্তি।

বড় ভয় হয় রাষ্ট্রের রাজনীতির ম্যারপ্যাঁচ ফাঁদে বিবিধ পরস্পর-অসম্পর্কিত সময়চেতনা ‘আপন-পর’। আমার উচ্চারণ অব্যর্থ নয়।

 

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya kobita habib emonn

রাঙা শাঁখা ভেঙেছে

সময়গুলো পাল্টে গ্যাছে। একটা মন্থর লেগেছে। কেটে উঠতে হয়তো সময় লাগবে অথবা কাটবে না আর। জং সারানো অনেক কঠিন। আমার-তোর জীবন লাভার মতোই। সহজে নেভে না।

একটি ক্ষীণ স্রোত নেমেছে দেয়াল বেয়ে বেয়ে।

রাতে জ্বর আসে, এটা এখন আর খবর নেয় না। অথচ এক-সময় এটাও খবর ছিলো।

শুকনো পাতার মতো আমরা নুয়েও পড়ছি। কখন যে এতো ছিন্ন হয়ে উঠেছি বুঝতে পারি নি। প্রজাপতির মতোন রঙিন সেই আমাদের জীবন। একটা সাদাকালোর ফ্রেমের ভেতর ঢুকে গেছি। যেখানে স্মৃতিগুলোর প্রলাপ করতে পারি কিংবা অ্যাক্রোলিকে বিমূর্ত চিত্র এঁকে নিতে পারি। একদিন আমরা আমাদের শহরে এখানে-সেখানে জ্যোৎস্না ফুটিয়েছি। জোনাক বাতির মতো এখন ওই শহরে নিভু নিভু হয়ে গেছি। একদা ওই শহরে কবি হয়ে ওঠার প্রসববেদনায় ককিয়ে উঠেছি। যে কিশোর সন্ন্যাসে গিয়েছে তার মতো।

মাঝে মাঝে শহরটা আমাদের মনে করে। আমরাও মনে করি আমাদের প্রিয় শহরটাকে। কিন্তু বাস্তুহারা জীবন অতোটুকুই। যখন মাঝে মাঝে শহরে যাই, তখন কিছুই মিইয়ে যাই, তাকে আর আপন মনে হয় না। কোনো পাল্টে যাওয়া পম্পেই মনে হয়। বড়ো মলিন মনে হয়। মনে হয় কোনো মৃত শহরে পরিণতি দ্যাখছি।

রাঙা শাঁখা ভেঙেছে।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya kobita habib emonn

লেনিনের জন্মদিনে

দেয়ালে আটকে আছো তুমি, ম্যালাদিন; সমাজ বদলের বিপ্লবের প্রতীক তুমি। তোমার এ পোর্টেটখানা দিয়েছিলো আমার মেজ মামা মনজুর হাছান লিটন। একদিন সেও তোমার মতো ভেবেছিলো, আজ সেও নেই এ পৃথিবীতে। পোর্টেটখানা আমাকে দিয়ে বলেছিলো-যত্ন করে রাখিস। পোর্টেটটা কার আঁকা জানি না। আমি আগলে রেখেছি আজো। ওই সময়ে লেনিনের ছবি, আমার কাঁচা মনকে পাল্টে দিয়েছিলো, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর নামিয়ে দিয়েছিলো।

নাগরিক জীবন আমাদের। নিজের ঘোর-দোর নেই। দুইদিন পর এ ঘর যাও, ও ঘর যাও। এ জীবন বদলানোর। একেকবার ঘর পাল্টানোর কী যে ঝামেলা! ব্যাপারটা মন্দ নয় তবে। নতুন টাইলস। ঝকঝকে ঘর। চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

বড় ঘর থেকে থেকে ছোট ঘর। একটু স্পেস পাওয়াও মুশকিল। অনেক কিছু ফেলে দিতে হয়। কিন্তু তোমাকে কখনো ফেলতে পারি নি। ফেলা দেওয়ার কথা ভাবিও নি। রেখেছি যতন করে দেয়ালে। আস্তর খসে হয়েছে জীর্ণ, তৈলচিত্রের কোণায় কোণায় তুমি ছি’ড়ে পড়েছো।

দৃষ্টিজুড়ে যার বিপ্লবের ছাপ―সূর্যোদয় হবে, পথ নির্ধারণ নয়, শরীরজুড়ে একটা ভোর দেখেছিলাম―পুলিশ-থানা-রাষ্ট্রু সব বাজি রেখে কারখানা থেকে রাস্তায় নামো, ছন্দের গভীরে জমিদার ও পুঁজিবাদ খতম করো। কখনো গুলিয়ে ফেলা যায় না। ওটা একটি সকাল কিংবা স্বপ্ন।

তুমি আর আমি একই পথে চলি। একই সঙ্গে হাঁটি।

হতাশাগ্রস্ত আমরা। শতাব্দী পেরিয়েও তুমি জাগিয়ে তোলো-সমাজ রূপান্তরে, তুমি আমার প্রগতি। আর সাম্যের প্রেরণা। শোষণভিত্তিক সমাজের অবসান তুমি।

তুমি আমার ঈশ্বর। তোমার ঋষিবচন নিয়ে আমার কী যে সমস্যা হচ্ছিল, ঘুমাতে পারি নি অনেকদিন! কথাটা সত্য কী! জানি না, কিন্তু সত্যের মতো তুমি আমাদের সামনে সপ্রতিভ। এই সপ্রতিভতা থেকে জীবনে আর পিছুপা আসেনি কখনো। মুদ্রাহীন-পুঁজিহীন এই বেঁচে থাকা সর্বজয়ী প্রত্যয়ে আমি তো ভালো করে জানি একজন সর্বহারার মৃত্যু ছাড়া আর হারানোর কিছু নেই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত