| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক রাজনীতি সময়ের ডায়েরি

যুক্তিচিন্তা-১৭: এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৭০ টাকা হলে আড়াই কেজি আলুর দাম কত?

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
অ.
ছোটবেলায় একটা ছড়া শুনেছিলাম বা পড়েছিলাম, স্পষ্ট মনে নেই। ছড়াটা আশাকরি মনে আছে-
“এখান থেকে মারলাম থালা
লাগল গিয়ে কলাগাছে
হাঁটু ভেঙ্গে রক্ত পড়ে
চোখ গেল রে বাবা!”
আ.
কাকে যেন একবার প্রশ্ন করতে শুনেছিলাম, বাজারে এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৭০ টাকা হলে, বল দেখি, আড়াই কেজি আলুর দাম কত?
ই.
তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি, দিদি ফোরে। একদিন বাড়িতে দিদিকে কী একটা গান যেন গাইতে শুনে বাবা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, এইসব বাজে গান কোথা থেকে শিখলে? গানের কথাগুলো আমি কিছুই খেয়াল করিনি বা বুঝতে পারিনি। শুধু এক‌টি শব্দ, ‘হিয়া’, কানে লেগে ছিল। ‘হিয়া’ শব্দটি সেদিনই প্রথম শুনি। অর্থ না জানলেও বুঝতে পারি ‘হিয়া’ কথাটি খারাপ।
কিছুদিন পরে স্কুলে স্যার এক‌টি কবিতা পড়ে শোনালেন, কাজী নজরুলের লেখা। দুষ্টু ছেলেরা পাখির বাসা থেকে বাচ্চা চুরি করেছে, মা পাখিটা বাচ্চা না পেয়ে অস্থির হয়ে চেঁচামেচি করছে। দুষ্টু শিশুরা এটা দেখে খুব মজা পাচ্ছে, মা হারানো এক‌টি শিশুর চোখ ভিজে যাচ্ছে মা পাখির কষ্ট দেখে। কবিতাটিতে এক‌টি লাইনে ছিল “বুঝিবে সে কি হিয়ার বেদন”। আমি কবিতায় ‘হিয়া’ শব্দটি দেখেই বুঝে যাই এটি এক‌টি ‘বাজে’ কবিতা, কারণ ‘হিয়া’ শব্দওয়ালা একটি গানকে বাবা ‘বাজে’ বলেছেন। সেদিন বাড়িতে এসে দিদিকে সেই ‘বাজে’ কবিতার কথা বললে দিদি ‘হিয়া’ শব্দের অর্থ বুঝিয়ে বলেন।
ঈ.
বহুদিন পরে গ্রামে গিয়েছি। গ্রামের মাটিতে শিকড় পোঁতা থাকলেও সে শিকড় ছিঁড়ে গেছে। ফলে দু-চার বছরে একবার একবেলার জন্য যাওয়া হয়। সেবার রাস্তায় পরিচিত একজন অনেকদিন দেখা না হওয়া, জন্মস্থান গ্রামকে ভুলে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে অনুযোগ করলেন। কথার এক পর্যায়ে তিনি জানতে চাইলেন, দেশেই থাক, নাকি ইন্ডিয়া চলে গেছ? মুহূর্তের মধ্যে কান গিয়ে গরম বাস্প বের হওয়া শুরু হল। কোনোমতে সামলে জানালাম, ঢাকায় থাকি। তার উদ্দেশ্য এবং আন্তরিকতা আমি ঠিকই টের পেয়েছি, তবুও প্রশ্নটা একটা ধাক্কা দিয়েছিল সেদিন।
 
 
 
 
উ.
ছুড়ে দেওয়া থালা যদিওবা কলাগাছে লাগতে পারে, তাতে হাঁটু ভাঙ্গার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর হাঁটু ভেঙ্গে রক্ত পড়লে “চোখ গেল” বলে কাৎড়ানোর তো প্রশ্নই আসে না। অন্যদিকে পেঁয়াজের দাম থেকে আলুর দাম জানতে চাওয়াও একটা উদ্ভট প্রশ্ন বলেই ধরে নেবেন সবাই। এ ধরনের ছড়া শোনালে বা প্রশ্ন করলে বরং লোকজন পেগ বা পোঁটলার সংখ্যা জানতে চাইতে পারে!
তারমানে উপরের দুইটি জায়গায় কোনওরকম সম্পর্ক নেই এমন একাধিক বিষয়কে অযৌক্তিকভাবে যুক্ত করা হয়েছে, শুধু যুক্ত করাই না, এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু গানটি যেহেতু ‘বাজে’, ফলে গানে ব্যবহৃত ‘হিয়া’ শব্দটিও ‘বাজে’। তারমানে ‘হিয়া’ শব্দ আছে এমন কবিতাও ‘বাজে’–এই ধাচের চিন্তা কিন্তু আমরা অহরহই করে থাকি, যা যৌক্তিক বলেই মনে হয়। আবার পাশের গ্রামের কিছু হিন্দু পরিবারকে যেহেতু ইন্ডিয়া যেতে দেখেছেন বা শুনেছেন, ফলে আমার গ্রামের সেই মানুষটি ধরেই নিয়েছেন, যে কোনও হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের ইন্ডিয়া চলে যাওয়া স্বাভাবিক। ফলে আমিও ইন্ডিয়া চলে যেতে পারি। যুক্তির এই কাঠামোটি তার কাছে ঠিক মনে হয়েছে বলেই তিনি সরল মনে আমাকে সেদিন প্রশ্নটি করেছেন।
যুক্তির এই ধরনের কাঠামো কি অনেকেই অহরহ ব্যবহার করছি না? পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সাপোর্টার সব জামাত-বিএনপি, হিন্দুরা সব ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের সাপোর্টার, দাড়ি-টুপিওয়ালা লোকজন জঙ্গি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা ব্যভিচারী, কওমী মাদ্রাসার হুজুররা পায়ুকামী–এ ধরনের অজস্র ভুল ধারণা লালন করা এবং ধারণাগুলোকে যৌক্তির কাঠামোতে ফেলে তার ভিত্তিতে বিশেষ ব্যক্তিকে বিচার বা চিহ্নিত করতে দেখছি। আমি যদি ইন্ডিয়া গিয়েও থাকি বা আপনার চিহ্নিত একজন পাকিস্তান ক্রিকেটে সাপোর্টার যদি বিএনপি সমর্থকও হন, অর্থাৎ উল্লেখিত কাঠামোর মাধ্যমে নেওয়া সিদ্ধান্ত যদি সত্য হিসেবে প্রমাণিতও হয়, তবুও যুক্তির কাঠামোটি যে ভুল, সেটি ভুলে গেলে চলবে না।
কোন এক‌টি ঘটনার সাথে যৌক্তিক সম্পর্ক নেই এমন এক‌টি বিষয়কে জুড়ে দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে কাঠামো সেটাকে ‘কাঠামোগত ছদ্মযুক্তি’ বা Formal Fallacy বলা হয়। এখানে যুক্তির সিদ্ধান্ত ভুল নাকি ঠিক তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যুক্তির কাঠামোগত ভ্রান্তি।
পেঁয়াজের দাম জেনে যেমন আলুর দামের হিসাব করা যায় না, তেমনি কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের ইন্ডিয়া যাওয়া থেকে সকল হিন্দুই ইন্ডিয়া যেতে পারে বা কওমী মাদ্রাসায় কয়েকটি পায়ুকামের ঘটনার সংবাদ জানা গেছে বলেই মাদ্রাসার সবাই পায়ুকামী এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এরকম সিদ্ধান্ত যৌক্তিকভাবে ভ্রান্ত, কারণ কয়েকজন সম্পর্কে জানা থেকে সবার সম্পর্কে নেওয়া সিদ্ধান্ত যৌক্তিকভাবে বেরিয়ে আসে না, যেমন পেঁয়াজের দাম থেকে বেরিয়ে আসে না আলুর দাম। তারপরও আপনি যদি আড়াই কেজি আলুর দাম ঘোষণা করতে চান বা চোখ গেল রে বাবা বলে চিৎকার করতে চান, সেটা আপনার ব্যাপার!
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত