Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla-sahitya-logical-framework-part-18

যুক্তিচিন্তা-১৮ : অভিনেতা ফেরদৌসের জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল কী?

Reading Time: 2 minutes
অ.
পাবলিক বাসে অফিস থেকে ফিরছি। জ্যামে আটকে থাকা বাসে উঠল এক তরুণ। দেখে মনে হয় কলেজ পড়ুয়া। উঠেই কাঁদতে শুরু করল। কোনমতে কান্না আটকে ভেজা গলায় হেঁচকি সামলাতে সামলাতে বলল, কিডনি রোগে আক্রান্ত মায়ের জরুরি অপারেশন লাগবে। পৌনে দুই লাখ টাকা আছে। দুইদিনের মধ্যে আরও সোয়া লাখ টাকা লাগবে। নিজে কলেজে পড়ে। বাবা জীবিত নেই। বিপদে পড়ে অন্যের সহায়তা চাইছে। তাদের মতো পরিবারের কেউ মানুষের কাছে হাত পাতার কথা চিন্তাও করেনি কখনও। সব আল্লাহর ইচ্ছা। কথা বলছে আর চোখের জল ঝরছে। কথা শেষে মুখ নিচু করে আবার কান্না।
আমি ছেলেটিকে দেখি। দেখি, একের পর এক যাত্রীরা টাকা দিয়ে যাচ্ছে, এবং অধিকাংশই দিচ্ছে পঞ্চাশ অথবা একশ টাকার নোট। ছেলেটি আমার সিটের কাছাকাছি আসতে থাকে। আমি মেন্থলের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ পাই। আরও কাছে আসলে খেয়াল করি ঘ্রাণের উৎস সেই ক্রন্দনরত ছেলেটিই। আমার আর বুঝতে বাকী থাকে না, অনবরত চোখের জল ফেলার জন্য সে চোখে টাইগার বাম লাগিয়েছে। আমি অনুমান করি, এই গাড়ি থেকে নেমে সে চোখের জল আর টাইগার বাম মুছে টাকা গুণতে গুণতে হাসবে এবং আবার চোখে টাইগার বাম লাগিয়ে অন্য গাড়িতে উঠে কাঁদবে। গণপিটুনির ভয়ে আমি ওর চোখে টাইগার বাম লাগিয়ে কান্নার বিষয়ে চুপ থাকি।
আ.
অভিনেতা ফেরদৌস বঙ্গবন্ধু বায়োপিকে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু ভিসা না পাওয়ার কারণে মুম্বাই যেতে পারেননি। তার বদলে সেই চরিত্রে অভিনয় করবেন অভিনেতা রিয়াজ। দুঃখ করে ফেরদৌস বলছিলেন, ভুল করেছি, তার খেসারত দিচ্ছি। দৈনিক প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি এই ঘটনাকে জীবনের সেরা ভুল হিসেবে মেনে নেন।
কী ভুল করেছিলেন ফেরদৌস? পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে এক‌টি দলের প্রচার মিছিলে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। বিদেশী নাগরিক হিসেবে এটা তার ভিসার শর্তের লংঘন। তাই তার ভিসা বাতিল হয় এবং পরবর্তীতে ভিসা পেতেও সমস্যা হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন। কাজটি যে বেআইনি, সে বিষয়ে তার ধারণা ছিল না বলে তিনি উল্লেখ করেন। নইলে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ার বিষয়টি তিনি ভুল মনে করেন না। পরবর্তীতে নিজ দেশের নির্বাচনী প্রচারে তাকে অংশ নিতে দেখা গেছে।
শুধু ফেরদৌস কেন, বা নির্বাচনী প্রচারে কেন, খোদ নির্বাচনেই অংশ নিচ্ছেন অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী তথা সেলিব্রিটি ব্যক্তিরা। যে কারণেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন না কেন, জনপ্রিয় হলেই ভোটের বাজারে তার বাড়তি দাম আছে। কেউ হয়তো কায়দা করে অনেক জোরে ব্যাট দিয়ে বলে বারি মারতে পারেন এবং তার তুমুল বারির চোটে বল বহুবার বহুদূরে চলে গেছে, বিপুল মানুষ একারণে হাততালি দিয়েছে এবং একারণেই তিনি ভোটে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় আইনপ্রণেতা হয়ে গেছেন।
ই.
বাড়তি কাটতির আশায় সবুজ রং গোলানো পানিতে চুবিয়ে শশা বিক্রির কথা মাঝেমধ্যে শোনা যায়। কচি শশা খাওয়ার আশায় মানুষ এভাবে না জেনে ভয়ঙ্কর কেমিক্যাল মেশানো রং খাচ্ছে।
ঈ.
শশায় মেশানো সবুজ রংয়ের সাথে শশা কাঁচা বা পাকা হওয়ার কোনও যৌক্তিক সম্পর্ক নেই। তেমনি টাইগার বাম লাগানো চোখের জলের সাথে ওই ব্যক্তির মায়ের অসুস্থতা বা আবেগের সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নের যোগ্যতার সাথে ন্যূনতম যৌক্তিক সম্পর্ক নেই ভাল অভিনয় বা ক্রিকেট খেলার। অথচ ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে।
এই যে বিভ্রান্ত হওয়ার প্রক্রিয়া, এটাকে বলে ‘বিষয়গত ছদ্মযুক্তি’ বা Informal Fallacy। যুক্তি নয়, আবেগ, বিভ্রান্তি, ব্যক্তিগত পরিচিতি, অস্পষ্টতা, প্রসঙ্গ থেকে সরিয়ে দেওয়া, ব্যক্তিগত আক্রমণ করা, হেয় করা–এ ধরনের বিভিন্নরকম যৌক্তিকভাবে সংযুক্ত নয় এমন বিষয় ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বা করানোর মাধ্যমে এ ধরনের ছদ্মযুক্তির চর্চা হয়।
আমরা প্রতিনিয়তই বিষয়গত ছদ্মযুক্তির চর্চা করছি, নিজেরাও শিকার হচ্ছি। আমরা টাইগার বামের কান্নায় আকুল হচ্ছি, রং মেশানো শশা খাচ্ছি, সেলিব্রেটিদের ভোট দিচ্ছি, মানে যদি দেওয়ার সুযোগ পাই আরকি। কোথাও কৃত্রিম রং, কোথাও মিথ্যা আবেগ অথবা কোথাও ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা আমাদের বিভ্রান্ত করছে। আমরা যুক্তির প্রশ্ন ভুলে আকুল হচ্ছি, ব্যাকুল হচ্ছি, বেভুল হচ্ছি, ফতুর হচ্ছি, হয়েই যাচ্ছি!

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>