Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya separation-last-part

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১০)

Reading Time: 4 minutes

সুবর্ণা আপা শশুরবাড়িতে চলে যাওয়ার পরে সুরমা আর সুনেত্রা দুই বোন এক ঘরে ঘুমায়। পাশাপাশি দুটো খাট। একটা ডাবল, আরেকটা সিঙ্গেল খাট। এখন থেকে আমারও জায়গা হলো সেই ঘরে। ডাবল খাটে… সুরমার পাশে। সুরমা প্রায় মাঝরাত অব্দি বকবক করে আমার মাথা ধরিয়ে দেওয়ার গুরুভার নিলো। এত যে কথা বলে আনন্দ পায় মেয়েটা! পাশের খাটে সুনেত্রা অঘোরে ঘুমায়। সুরমার বকবকানিতে আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বসে থাকলেও সুনেত্রার ঘুমের কিছুমাত্র ক্ষতি হয় না। সুরমার এই অতি বাচালতার সাথে তার ভালোরকম অভ্যস্ততা আছে বুঝতে পারি।

সুরমার গল্পের ভাণ্ডার অফুরন্ত। সদ্য স্কুল ছেড়ে আসা তারুণ্যের জোয়ারে ভেসে যাওয়ার বয়স তখন আমাদের। গল্পের কি আর শেষ আছে? এতদিন আমাদের পরিবারের ঝুট ঝামেলায় নিজের মনের ক্যানভাসে শুধু কালো রঙের পরত চড়িয়েছি। আড়ালে আবডালে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকা রঙিন বসন্ত নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। কিংবা ঘামানোর সুযোগ পাইনি। সুরমা এক লহমায় আমার মনের সাগরে ঢেউ তুলে দিলো। প্রথম প্রথম কথার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে একসময় আমিও যোগ দিলাম এই শব্দকুঞ্জনে। ভালোই লাগতো এই অকারণ উচ্ছাস, বাঁধভাঙা তারুণ্যের ছটফটানি।

 

নয়নের শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে সুজনের ঘরে। আমি মনে মনে একটু চিন্তায় পড়েছিলাম। নয়ন কখনো আমাকে ছাড়া ঘুমায়নি। আল্লাহই জানে, কোনো ঝামেলা না করে বসে!

সেই চিন্তা অবশ্য দুইদিন পরেই কেটে গেছে। সুজনের সাথে নয়ন এর মধ্যেই বেশ জমিয়ে নিয়েছে। সেদিন দুজনকে দেখলাম… মন দিয়ে ঘুড়িতে মাঞ্জা মারা দেখছে। ছোটমামা কোথা থেকে যেন মাঞ্জা মারার সরঞ্জামাদি কিনে এনেছে। কাঁচের গুঁড়া, আঠা, রঙ আর কী কী সব হাবিজাবি জিনিসপাতি। নয়ন চোখ গোল গোল করে দেখছে। ওর দশ বছরের জীবনে এ এক ভারী নতুন অভিজ্ঞতা। খুব যে উপভোগ করছে সেটা চোখমুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি।

 

আমার খুব ভালো লাগলো দেখে। আহারে! শৈশবের এসব মিঠেকড়া সৌরভগুলো কোথায় লুকিয়ে ছিল এতদিন? আমাদের জীবনে তো এসবের কোনো অস্তিত্বই ছিল না! দুজন মানুষের দিনরাতের অবিরত ঝিকঝিকানি দেখেই দিন কাটতো আমাদের। জীবন এত আনন্দময় রূপে তো কখনো ধরা দেয়নি আমাদের কাছে!

নয়নকে প্রাণভরে এসব আনন্দ শুষে নিতে দেখে আমার মনটা ফুরফুরে হাল্কা হয়ে যেতে লাগলো। মনে হচ্ছে, এবার হয়ত বেঁচে যাবো আমরা। একটা ঘর হারিয়েছি, কিন্তু ভালোবাসায় টইটুম্বুর আরেকটা ঘরের সন্ধান পেয়েছি। এটাকেই আঁকড়ে ধরে মাথা তুলে দাঁড়াবো আবার।

 


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৯)

ছোটমামাটা সেই আগের মতোই আছে। হুল্লোড়বাজ আর আমুদে। জীবন সম্পর্কে এতটুকুও সিরিয়াস না। সম্ভবত এই কারণেই চাকরিবাকরি বা ভবিষ্যত নিয়ে মামার তেমন একটা মাথাব্যথা নেই। তার এখনো সেই আগের মতো করেই সময় কাটাতে ভালো লাগে।

মায়ের সাথে হাতেগোনা যে কয়েকবার নানাবাড়িতে এসেছি, দেখেছি ছোটমামার তুমুল হুল্লোড়। এই কখনো বন্ধুদের সাথে সাইকেলে চড়ে আরেকগ্রামে চলে যাচ্ছে, কখনো আবার কোথা থেকে যেন দোনলা বন্দুক জোগাড় করে নিয়ে এসে পাখি শিকারে মেতে উঠেছে। কিছু না কিছু করছেই সবসময়। শুধু পড়ার কথা শুনলেই তার মুড অফ হয়ে যেত। পড়াশুনায় মনোযোগ ছিল না দেখে বড়মামা একসময় প্রচুর বকাঝকা করেছে ছোটমামাকে। নানাকে তো বেশিদিন পায়নি ছোটমামা, তাই অভিভাবকত্বের ভারটা বড়মামার কাঁধেই চেপে গেছে। কিন্তু ছোটমামার সেসবদিকে কোনো পরোয়াই ছিল না! পড়াশুনা করতে তার নাকি কখনোই ভালো লাগতো না। ছোটমামার মতে, সবাই চশমাআঁটা পণ্ডিত হয়ে গেলে ব্যাকবেঞ্চার কারা হবে?

 

ছোটমামা এবার পড়েছে আমাকে আর নয়নকে নিয়ে। আমাদের দুজনকে চাঙ্গা করার জন্য ছোটমামা টাইট শিডিউল হাতে নিয়েছে। অফিস থেকে কীভাবে যেন এক সপ্তাহের ছুটি ম্যানেজ করে নিয়েছে। ছুটির প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাচ্ছে বলা চলে। প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু করছে।

গতকাল সবাইকে সাথে করে পুকুরে মাছ ধরা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে আমার নানা কিছু জমি কিনে রেখেছিল। ইচ্ছে ছিল ভবিষ্যতে ছেলেদের জন্য বাড়ি বানানোর চেষ্টা করবেন। সেই ইচ্ছে পূরণ না হলেও দুই মামা জমিটাকে বেশ কাজে লাগিয়ে ছেড়েছে। সেখানে একটা খামারবাড়ি মতোন তৈরি করেছে দুইজন মিলে। নানারকম শাকসব্জির গাছ লাগিয়েছে। বেশকিছু গরু ছাগল কিনে দিয়েছে। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্যদুজন লোককেও নিয়োগ করা হয়েছে। তারা সেখানে একটা টিনের চালা দেওয়া ঘর বানিয়ে থাকে। গরু ছাগল চরায়। শাকসব্জির গাছের যত্ন নেয়। শুধু তাই না, একটা বড়সড় পুকুরও কাটা হয়েছে। তাতে নাকি গতবছরনানারকম মাছের পোনা ফেলা হয়েছিল। তাই গতকাল আমাদেরকে সাথে নিয়ে সেই পুকুরে জাল ফেলা হলো।

 

নয়ন আর সুজনের আনন্দ দেখে এত মজা লাগছিল! জাল গুটানোর তর সইছিল না তাদের। পুকুরে নেমে পড়ে এমন অবস্থা! আর ছোটমামা তো ভালোই একটা ভেল্কি দেখালো। পুকুরে জাল ফেলার সাথে সাথে ছোটমামা সুড়ুত করে সেই কেয়ারটেকারদের ঘরে চলে গেল। একটু কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলো লুঙ্গি পরে, কাছা বেঁধে। ঘটনা জানতে পারা গেল সাথে সাথেই। ছোটমামা নাকি একটা কাপড়ের ব্যাগে করে লুঙ্গি নিয়ে এসেছিল। মাছ ধরা হবে আর তিনি পানিতে নামবেন না, এটা কীভাবে হয়?

 

হৈ হৈ করে ভালোই কাটতে লাগলো আমাদের সময়। নানীকে নিয়ে অবশ্য একটু ঝামেলায় পড়েছি। নানী এমনিতে মা-বাবাকে নিয়ে বেশিকিছু জিজ্ঞেস না করলেও কান্নাকাটি চালু রেখেছে। সময় সুযোগ পেলেই কথা বলতে বলতে কাঁদছে। একদিন না পেরে বললাম, ‘নানু, কাঁদছো কেন? আমরা তো চলেই এসেছি! তুমি খুশি হওনি?’

নানী সাথে সাথে চোখ মুছে নিয়ে চোখে মিথ্যে হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলার আপ্রাণ করতে করতে বলেছে, ‘এইটা কী কও গো বুবু! তোমাদের এতদিন পরে কাছে পাইলাম…আমার বুকটা জুড়াইয়া গেলো গো সোনা!…খালি একটা দুঃখ মন থেইকা সরাইতে পারিনা গো বুবু! আমার নিজের পেট আমার সাথে এত বড় শত্রুতা করলো ক্যামনে? এমন মেয়ে আমি ক্যামনে জন্মাইলাম! লাজ লজ্জা হায়া কোনো কিছুরই ধার ধারলো না? এই বয়সে আইসা ছেলেমেয়ে দুইটারে এমন বিপদে ফ্যাললো!’

 

আমার ভেতরে নিজের অজান্তেই জ্বালাপোড়া হতে থাকে। বুঝতে পারি, নানীকে না থামালে এই দুঃখের পাঁচালী নিয়মিতই শুনে যেতে হবে। তাই কপট রাগ দেখিয়ে বলি, ‘নানী, তুমি থামবা কী না বলো! নইলে আবার কিন্তু ঐ বাসাতেই রওয়ানা দিব!

নানী সাথে সাথে আমাকে জাপ্টে ধরে বলে, ‘এমন কথা জীবনেও বলবা না বুবু। আমি বাঁইচা থাকতে কেউ তোমারে এই বাড়িছাড়া করতে পারবো না…এইটা আমার জবান। আল্লাহ্‌ এই জবান রক্ষা করবো!’

 

তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। শীতের আগমনী সুর বাজছে বাতাসে। দেওয়ালের ওপাশের বাঁশঝাড় থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে শিরশিরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে শরীর আর মনে।

নানীবাড়ির সুপ্রশস্ত দাওয়ায় বসে আমি পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে রইলাম বয়সের ভারে জরাজীর্ণ একটি শতচিহ্নবাহী ঋজু হাত। সেই হাত আমাকে নিজের ভাষায় জানিয়ে গেল, হাতের মালকিন যা বলছে ভেবেচিন্তেই বলছে। সময়ের চিহ্ন তাকে জীর্ণ বানিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এতটুকুও নতজানু করতে পারেনি অন্যায়ের কাছে।

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>