Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya separation-last-part

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১৩)

Reading Time: 4 minutes

‘মাথা খারাপ হইছে তোর? একটা ছেলের দেখা পেতে তুই সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে এসে ঘুরঘুর করছিস! এত বেহায়া হইছিস!’ হিসহিস করে বললাম আমি।

সুরমা আমার হিসহিসানিকে আমলেও আনলো না। সে শান্তভাবে আমার পাশে এসে বসলো। চোখেমুখে অদ্ভুত স্থৈর্য। কিছুক্ষণ এটা সেটা বলে আমার মনোযোগটাকে তিনশো ষাট ডিগ্রীতে ঘুরিয়ে আনলো।

‘আহা! তুই সবসময় আমার ওপরে চটে থাকিস। এটা কিন্তু ঠিক না! আমি কি বলেছি যে, তোর এই সুমনের দেখা পেতে এখানে এসেছি আমি? এখানে এসেই তো এই চিজ দেখতে পেলাম। আমি এসেছি তোর সাথে গল্পগুজব করতে। এত কাছাকাছি থাকি দুই বোন…দেখা সাক্ষাতই হয় না!’

‘আচ্ছা তুই এসেছিস আমার দেখা পেতে…আমার সাথে গল্পগুজব করতে? এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?’

‘বিশ্বাস করা না করা তোর ব্যাপার! আমি যা সত্যি সেটাই বললাম! এ্যাই…মা তোকে চারটা পাটিসাপ্টা দিয়েছে? আর আমাকে দিয়েছে তিনটা। মা কি আমার চেয়ে তোকে বেশি কেয়ার করছে নাকি ইদানিং?’

সুরমা আমার বক্স থেকে পাটিসাপটা তুলে নিয়ে আমার সাথে গল্প চালিয়ে গেল। আমি বেশ বুঝতে পারলাম, সুমনকে ঠিকই ঠারে ঠারে লক্ষ করছে সুমনা। কিন্তু সেই ব্যাপারে সে আর কিছু বললো না। আমার ক্লাসের সময় হতেই ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। সুমনা বিরসমুখে বললো, ‘কীরে…আমিও এলাম আর তুইও উঠে পড়ছিস? ভদ্রতা করেও তো আরো কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারতি আমার সাথে!’

আমি সামনে তাকিয়ে দেখি সুমন তখনো নিবিষ্টমনে খাতায় কী যেন আঁকিবুকি করছে। সেদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘যার জন্য এসেছিস, তিনি বসে আছেন এখনো। তুই যদি তাকে কোম্পানি দিতে চাস আমার তাতে কোনো আপত্তি থাকবে না!’

বলতে বলতেই দেখি, সুমনও এক নজর হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েই ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। আমি সুরমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বললাম, ‘যাহ্‌! আর তো বসে থাকার কারণ রইলো না! কী আর করবি? যাহ্‌ গিয়ে আবার আবেদা জোবেদার সূত্র মুখস্থ কর!’

সুরমা মুখ ভেংচি কেটে উঠে দাঁড়ালো। যেতে যেতে বললো, ‘তোদের ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের ভাব খুব বেশি। এত ভাব দিয়ে কী করবি?’

আমি হাসি চাপতে চাপতে পরের ক্লাসে গেলাম। বেশ বুঝতে পারলাম, সুরমা মনে মনে কিছু একটা ফন্দি আঁটছে। আমিও মনে মনে কিছু একটা চিন্তায় জড়িয়ে গেলাম। ক্লাসে এই এতদিনে আমারও বেশ কিছু বান্ধবী জুটে গেছে। এদেরই একজন একদিন বলছিল সুমনার কথা। আমার মামাতো বোন শুনে সেদিন অনেক কথা বললো।

‘ও কিন্তু খুব ছেলেবাজ, এটা জানো কি? সরি…আমার কথায় আবার কিছু মনে করো না। ওকে প্রায়ই নানারকম ছেলের সাথে আড্ডা মারতে দেখা যায়। কেউ কেউ এটা সেটা আজেবাজে মন্তব্য করে। বোঝোই তো…আমাদের ছোট শহর। নামেই জেলা শহর। কিন্তু এখনো তো আর মন মানসিকতায় তেমন আধুনিক হয়ে ওঠেনি। সুরমাকে একটু বুঝিয়ে বোলো। মেয়েদের একবার দুর্ণাম রটে গেলে আর কিন্তু ফিরে আসা মুশকিল হয়ে যায়। ছেলেরা যতকিছুই করুক, কেউ মনেও রাখে না। কিন্তু মেয়েদের অল ক্লিয়ার থাকা চাই! প্লিজ কিছু মনে করো না। আমি তোমাকে বন্ধুর মতো মনে করে অনেক কিছু বলে ফেললাম।’


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১২)


 

সত্যিই চিন্তার বিষয়। সুরমা এমনিতে হাসিঠাট্টা ইয়ার্কি দিয়ে মাতিয়ে রাখতে পারে চারপাশ। ওর বন্ধুবান্ধবের অভাব হবে না, সেটা বলেই দেওয়া যায়। কিন্তু তাই বলে ছেলেদের সাথে এত বেশি মাখামাখিটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। আর তাছাড়া ছেলেরা মিশবে বন্ধুর মতো, কিন্তু বন্ধু কি আর হয়ে উঠবে? মনে মনে একজন ছেলে কখনো একটা মেয়েকে নিজের সমকক্ষ বলে মনে করে না। ওপরে যে হৃদ্যতা দেখায়, সেটা হতে পারে ভদ্রতার খাতিরে অথবা আরো কোনো গুরুতর সার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে।

মনে মনে ঠিক করলাম, সুরমাকে একটু ভালোভাবে বোঝাবো। এই যে কলেজে ইতিমধ্যেই ওকে নিয়ে একটা ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেছে, এর ফল তো ভালো নাও হতে পারে!

বিকেলবেলা বেশ অনেকক্ষণ লেডিজ কমনরুমে দাঁড়িয়ে থাকার পরে সুরমার দেখা মেলে। আজ দেখলাম আমার আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই কাঁচুমাচু মুখে বললো, ‘সরি!’

বললাম, ‘সরি কেন? কী হইছে?’

‘না…তখন ওমন করে তোর ক্লাসে গিয়ে হাজির হইলাম…তুই কিছু মনে করিসনি তো? আসলে সত্যি বলছি তোর সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছিল…তাই…’

আমি চুপ করে থাকলাম। সুরমা কিছু একটা বলতে চাইছে আমাকে। এটা তার সূচনা সঙ্গীত মাত্র। এই ক’দিনে আমি আমার কাজিনকে ভালোমতই বুঝে গেছি।

আমার ধারণাই সত্যি হলো। একটু উসখুস করে সুরমা বলেই ফেললো, ‘ইয়ে…নীরা…আসলে সবাই তো তোদের মতো ভালো স্টুডেন্ট হয় না। আমার এত পড়ালেখা করতে ভালো লাগে না। ভাবছি…’

‘কী ভাবছিস? বিয়ে করে ফেলবি? ভালো তো…করে ফেল! কিন্তু তাই বলে…’

‘না না, বিয়ে করার কথা কে বললো? বিয়েশাদীর চক্করে এখনই কেন পড়তে যাবো? আমার ভালো লাগে আড্ডা মারতে…গল্পগুজব করতে…ভালো ভালো মুভি দেখতে…আর সুন্দর কোনো একটা ছেলের সাথে প্রেম করতে! ইয়ে…কিছু মনে করিস না। সবার চিন্তাধারা তো আর একরকম হয় না। তুই না হয় ভালো ছাত্রী। দিনরাত পড়াশুনা করিস। সামনে একটা ফিউচার আছে। হয়ত ‘বিগবস’ টাইপের কিছু একটা হয়ে যাবি। আমার তো এত পড়াশুনার ঘিলু নাই!…’

ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা বলতে লাগলো সুরমা। এবার আমার রাগ হলো। একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, ‘আহা যা বলবি বলে ফ্যাল। এত ত্যানা প্যাচাচ্ছিস ক্যান?’

সুরমা এবারে টানটান হয়ে গেল। ধুম করে কাজের কথাটা শেষমেষ বলেই ফেললো।

‘তোদের ক্লাসের সুমনের সাথে একদিন কথা বলায়ে দিবি? না না…শুধু কথা বলতে চাইছি। বেশিকিছু না। তুই এমন করে তাকাচ্ছিস কেন আমার দিকে?’

আমি এবারে হেডমিস্ট্রেসের মতো গলার স্বরে বললাম, ‘সুমনা তুই যে ভয়াবহ বাড়াবাড়ি করছিস এটা কি তুই বুঝতে পারছিস? এভাবে একটার পর একটা ছেলের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছিস! এর ফল ভালো হবে বলে মনে করেছিস?’

সুরমা অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো, যেন পৃথিবীর আশ্চর্যতম কথাটা আমি এইমাত্র বললাম। ‘আমি ছেলেদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছি! বাহ্‌! বাহ্‌! খুব ভালোই বললি! কোথায় দেখেছিস আমাকে ছেলেদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে? আর যদি ঘুরাই তো ঘুরাইছি! তোর অসুবিধা আছে? আমার ভেতরের কলকব্জা সব ঠিক আছে বুঝলি? তোর মতো পোতায়ে যাইনি। আর হ্যাঁরে তুই কী? এমন রোমান্টিক বাপ-মায়ের মেয়ে হয়ে তুই এমনধারা হইলি ক্যান? মা-বাপ তো প্রেমের সমাধি রচনা করে ফেলছে! তাও একবার না! দুই দুইবার! তাদের মেয়ে হয়ে কী না তুই…’

আমি বিস্ফোরিত চোখে সুমনার দিকে তাকালাম।কী বললো সুরমা? আমার মা-বাবা প্রেমের সমাধি রচনা করেছে তাও দুই দুইবার! ভেতরটা তীব্রভাবে নাড়া দিয়ে উঠলো। একটা ভয়ানক ইচ্ছে হলো একেবারে আচমকা। আমার ইচ্ছে করতে লাগলো, এক ধাক্কায় সুমনাকে রিক্সা থেকে নিচে ফেলে দিই। তারপর যা হয় হোক!

পরমুহূর্তেই সম্বিত ফিরে এলো আমার। কী এমন বেশি কথা বলেছে সুরমা? যা সত্যি তাই তো বলেছে! সুরমা হয়ত ঠোঁটকাটা বাচাল বলেই সত্যি কথাটা বলে ফেলেছে। কিন্তু কত মানুষ আছে যারা মনে মনে এমন ধারণা পোষণ করে, অথচ মুখে কিছু বলে না। আজ হয়ত তারা ভদ্রতাবশত চুপ করে আছে। কিন্তু কতদিন আর চুপ করে থাকবে? সত্যিটা এভাবেই আচমকা একদিন হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসবে।

আমি উদাসচোখে অন্যপাশে তাকিয়ে রইলাম। গোধূলির অস্তমিতপ্রায় সূর্য সবেমাত্র লাল আভা ছড়াতে শুরু করেছে চারপাশে। সেই রক্তিমাভা নিজের অজান্তেই আমার চোখের ভেতরেও বাসা বাঁধতে শুরু করেছে…টের পাইনি আমি।

সুরমাও সম্ভবত বুঝতে পেরেছে, জোশের বশে কিছু একটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। আমাকে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলে উঠলো, ‘এ্যাই এ্যাই…নীরা…আমি সরি রে! কী বলতে কী বলে ফেলছি! প্লিজ কিছু মনে করিস না! এ্যাই শুনছিস…’

আমি উত্তর দিলাম না। ছোট করে শুধু বললাম, ‘আমি কালকে তোকে সুমনের সাথে আলাপ করিয়ে দিব। চিন্তা করিস না! তোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে! সুমন ভালো ছেলে।’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>