Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya separation-last-part

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১৬)

Reading Time: 5 minutes

সুরমাকে কথা দিয়েছিলাম সুমনের সাথে আলাপ করিয়ে দিব।

কথা রাখবার সময় এসে গেছে বুঝতে পারছি। সেকেণ্ড ইয়ারে ওঠার পর থেকেই চারদিক থেকে নানারকম চাপ শুরু হয়ে গেছে। এইচ এস সি সামনের বছর। এই বছরেই টেস্টের ধাক্কা। আবার নানারকম এক্টিভিটিজেও কমবেশি জড়িয়ে পড়ছি সবাই। তাই দম ফেলারও আর ফুরসত নেই কারো। তবু এর মধ্যেও সুরমাকে দেওয়া সেই কথাটা মনের মধ্যে খচ খচ করে সবসময়।

কলেজে এখন আমরা সবাই বেশ বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছি। একসাথে ক্লাস করা, প্রাক্টিকাল করা, নানারকম গ্রুপ বেঁধে একসাথে কাজ করা…এসবের মাধ্যমে সকলেই পরস্পরের অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়েছি।

কো এডুকেশনে পড়তে হবে শুনে শুরুতে একটা বেশ চাপ বোধ করেছিলাম। বরাবরই আমি মুখচোরা মানুষ। খুব বেশি হইহুল্লোড় করতে ভালো লাগে না। গল্পগুজব করতে পারি না তেমন একটা। আর এসব কো এডুকেশন কলেজে শুনেছি নানারকম ইভ টিজিং এর শিকার হতে হয়। ছেলেরা নানাভাবে মেয়েদের উত্যক্ত করে। ঢাকার বাইরে এখনো ছেলেমেয়ের মধ্যে ফ্রি মিক্সিং এর বিষয়টা কম। কাজেই চেপে রাখা আগ্রহের বহিঃপ্রকাশেই নানারকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।

তবে সেই ধারণাগুলো আস্তে আস্তে ভুল প্রমাণিত হতে শুরু করেছে। মেয়েদের পাশাপাশি কিছু ছেলের সাথেও ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আমার। নিছকই নির্দোষ বন্ধুত্ব। দেখা হলে হাই হ্যালো করা…লেখাপড়া নিয়ে এটা সেটা জিজ্ঞেস করা কিংবা মাঝে মাঝে নোটপত্র আদানপ্রদান এসবেই সীমাবদ্ধ রেখেছি এই বন্ধুত্বকে। প্রেম ভালোবাসা অথবা ছেলেদের প্রতি অতি আগ্রহ আমার মধ্যে কেন যেন কাজ করে না। মা-বাবার ভাঙনের সংসারে অল্প বয়সেই আমার ভাবগুলো কেমন যেন পরিপক্ক হয়ে গেছে।

একটু আধটু হাসি বিনিময় কিংবা চোখাচোখি যে কারো সাথেই হয়নি কখনো, তা নয়। সেই হাসির আড়ালে অন্য কোনো ভাবেরও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছি আমি। কিন্তু অতি পাষন্ডের মতো সেই ভাবাবেগকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় না দিয়ে সরে গিয়েছি। হাবভাবে বুঝিয়ে দিয়েছি, পথিক…হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা…অন্য কোনোখানে।

তবে এদের মধ্যে বিপ্লব নামের একজন ছেলের ভাবভঙ্গি একটু যেন বেশিমাত্রায় মরিয়া। সে অন্যদের মতো ইঙ্গিত দিয়েই সটকে পড়েনি, দু’একখানা চিঠিও কোনো এক ফাঁকে আমার পড়ার বইয়ের ভাঁজে গুঁজে দিয়েছে। আমি দেখেও না দেখার ভান করেছি। চিঠিটা ফেলে দিয়ে পরে এমন ভাব করেছি যে, কিছুই জানি না এই সম্পর্কে। বিপ্লব তবুও হাল ছেড়ে দেয়নি। আমার সাথে যে মেয়েদেরকে বেশি ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে, তাদের দু একজনকে উকিল হিসেবেও নিয়োগ করেছে।

প্রথম প্রথম একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ঘটনা কোথা থেকে কোথায় যায় কে বলতে পারে! এমনিতেই মামাবাড়িতে আমরা একরকম আশ্রিত। যদিও তাদের স্নেহমমতা আমাদের আগলে রেখেছে। কিন্তু বাবার বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও থাকা মানেই একরকম আশ্রিতের মতই থাকা। তাই শুধু শুধু তাদেরকে আমার অন্য কোনো সমস্যা দিয়ে আর বিব্রত করতে চাইনি। ঘরভাঙ্গা পরিবারের সন্তান বলেই বোধকরি, অল্প একটুখানি ঘন মেঘ দেখলেই তুফানের আশঙ্কা জাগে মনে।

বিপ্লবের এই মরিয়াপনা দেখেও তাই ভয় করছিল ভেতর ভেতর। এই আশিকের কবল থেকে কীভাবে নিস্তার পাবো বুঝতে পারছিলাম না। তবে এখন মনে হচ্ছে সামলাতে পারবো। এসব ছ্যাঁচড়া টাইপের ছেলেরা আদতে ভিতু গোছের হয়। এদেরকে শক্তমতো ধরতে পারলে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ করে পালিয়ে বাঁচে। আমিও তাই একদিন সাহসে ভর করে সবার সামনেই বিপ্লবকে ধরলাম। সে যা ভাবছে সেটা যে কিছুতেই হওয়ার নয়, এই কথাও সাফ সাফ জানিয়ে দিলাম। বিপ্লব আমার বিনয়ী ভাবসাবে ধরেই নিয়েছিল খুব অল্প ফাঁদেই আমাকে আটকাতে পারবে। তাই আমার তরফ থেকে এতটা স্পষ্টকথন সে যেন ঠিক আশা করেনি। হাবেভাব দেখে মনে হলো, ঔষধে কাজ হয়েছে। আমিও সেই আশায় আছি। পানি বেশিদূর না গড়ালেই হয়!

সুমনের সাথেও হাই হ্যালো…কী, কেমন চলছে পড়াশুনা, এই পর্যন্তই আমার সম্পর্ক। ছেলেটা ছাত্র হিসেবে তুখোড়। এই শহরের এক বিখ্যাত স্কুলের প্রথম সারিতে থাকা ছাত্র। কলেজেও খুব ভালো করছে। ভবিষ্যৎ জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল সেটা বলেই দেওয়া যায়।

তবে ছাত্র হিসেবে সে কেমন, এটা দেখে তো আর সুরমা আকৃষ্ট হয়নি।

সে সুমনের চেহারা সুরতেই আটকে গেছে। ছেলেটা সত্যিই আমাদের কলেজের হিরো। শুনলাম এ্যানুয়াল প্রোগ্রামে নাকি দুজন ছাত্র ছাত্রীকে রাজা রাণী বানানো হবে।কী একটা নাটকও করার নাকি প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। আর্টসের একজন সুন্দরী মেয়ের নাম রাণী হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। আর রাজা হিসেবে চিন্তা করা হচ্ছে আমাদের ক্লাসের সুমনকে। আমরা এই নাটক নিয়ে সবাই বেশ উত্তেজিত। অডিটেরিয়ামে নাটকের কলাকুশলী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে। মাঝে মধ্যেই ক্লাসে অটো নিয়ে আমরা সবাই হৈ হৈ করতে করতে সেখানে হাজির হয়ে যাই। যারা অভিনয় করতে আগ্রহী তাদেরকে মঞ্চে ডাকা হয়। ছোটখাট অডিশন চলে। দর্শক সারিতে থাকা আমরানিজেদের মতামত দিই। কার অভিনয় ভালো লাগছে বেশি এসব নিয়ে মাঝে মাঝে ভোটাভুটি চলে। সব মিলিয়ে জমজমাট পরিবেশ।

রাজা রাণী হিসেবে প্রস্তাবিত সুজন আর আর্টসের কুমু দর্শকের ভোটেও নির্বাচিত হয়ে গেল। আমরা সবাই হাত খুলে ভোট দিলাম দুজনের জন্য।


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১৫)

আচমকা মাইকে আমার নিজের নামের ঘোষণা শুনে হকচকিয়ে গেলাম। উপস্থাপক পলাশ হাসিহাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘মঞ্চে নীরাকে উঠে আসার জন্য অনুরোধ জানাই। নীরা উঠে এসো প্লিজ। একটা বড় সংখ্যক দর্শক তোমাকে রাজার মা হিসেবে সিলেক্ট করেছে।’

একটা হাসির হল্লা উঠলো ছেলেদের সারির একটা পাশ থেকে। আমার মাথা কেমন যেন ঝিমঝিমিয়ে উঠলো। হাসির উৎস লক্ষ করে সেই সারিতে তাকিয়ে দেখলাম, বিপ্লব আর তার কিছু লাফাঙ্গা বন্ধু দাঁত কেলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের উসকানিতে আরো কয়েকজন ছেলে এসে জুটে গেছে। আমার বুঝতে বাকি রইলো না, এই নাম প্রস্তাবের পেছনে কার হাত আর কী জন্যই বা আমাকে রাজার মায়ের ভূমিকায় দেখতে চাইছে সে।

নিজের অজান্তেই আমার চোখদুটো জ্বালা করতে লাগলো। কার কী এমন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি? নিজের দুনিয়া নিয়ে মেতে থাকি। তবুও কেউ কেউ কেন পায়ে পাড়া লাগিয়ে ঝগড়া বাঁধাতে আসে?

মনকে তিরস্কার করলাম। কিছুতেই কান্না করা যাবে না! দুদিন আগেই নিজের ভাইটাকে বুঝিয়ে এসেছি। এখন আমিই যদি এই সামান্য পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়ি, তাহলে নিজের কাছে কী জবাব দিব?

আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, বিপ্লব আর তার সঙ্গী সাথীদের এই অনাহুত নাম সুপারিশে কেউওই খুশি হতে পারিনি। প্রত্যেকেই যার যার মতো করে ক্ষেদ ঝাড়ছে। বেশি রেগে গেছে আমার বান্ধবীরা। তারা তখন বিপ্লবের মুণ্ডুপাত করছে বসে বসে। একজন বললো, ‘নিজের রাণী বানাতে পারেনি তো, তাই রাজার মা বানিয়ে গায়ের জ্বালা মেটাতে এসেছে। লুজাররা এমনই হয়, তুই মন খারাপ করিস না নীরা!’

আমি স্পোর্টিং মনোভাব নিয়ে বললাম, ‘আরে! এখানে মন খারাপের কী আছে? আর তাছাড়া কাউকে না কাউকে তো রাজার মায়ের চরিত্রটা করতেই হবে তাই না? আমি করলে দোষ কী? ওদের যখন এত ইচ্ছা, তাহলে রাজার মা হতে আমার আপত্তি নেই!’

আমার বান্ধবীরা হতভম্ব। কেউ কেউ জোর প্রতিবাদ জানালো। ‘তোর কি মাথা খারাপ হইছে? তাই বলে তুই করবি রাজার মায়ের চরিত্র? রাণীর চেয়ে তোর চেহারা কতটুকু কম ভালো শুনি?’

আমি ওদের কথায় খুব হাসতে লাগলাম। মন খারাপ ভাবটা এক ফুঁয়ে উড়ে গেল।

শেষমেষ অবশ্য রাজার মায়ের চরিত্রটা করা হলো না আমার। সেই চরিত্রটা করেছিল আমাদের ক্লাসেরই আরেকজন মেয়ে। তার খুব অভিনয় করার শখ। কোন চরিত্র করছে সেটা নিয়ে  মাথাব্যথা নেই। শুধু একটা চরিত্র পেলেই হলো। রাজার মায়ের চরিত্র জুটে যাওয়াতেও তাই সে অখুশী হলো না। বরং চমৎকার অভিনয় করে চরিত্রটাকে একেবারে জমিয়ে তুললো।

এই চরিত্র নির্বাচনে একটা কাজের কাজ হয়ে গেল। সুমনের সাথে একদিন এটা নিয়ে বেশ গল্প হলো আমার। এতদিন অতিরিক্ত পড়ুয়া ভাবুক গোছের বলে ছেলেটাকে খুব অবজ্ঞা করেছিলাম মনে মনে। আলাপ হওয়ার পরে বুঝলাম, সুমন বেশ মিশুক গোছের। বিপ্লবরা যে মজা করে আমাকে ফাঁসাতে চাইছিল এটাতে সে আমার কাছে দুঃখপ্রকাশ করে বললো, ‘বিপ্লব বরাবরই ওমন। আমাদের স্কুলেই পড়তো। আমরা বন্ধুরা কেউ ওর সঙ্গে মিশতাম না। কিন্তু ওর কেন যেন বন্ধু বান্ধবেরও কোনো অভাব হতো না। তোমার পেছনে লেগে আছে তাই না? চিন্তা করো না। বেশিকিছু করতে পারবে না!’

আমি কথার ফাঁক ফোকরে সুরমার কথাটা বলে দিলাম। ‘ইয়ে…সুমন…আমার এক কাজিন আছে। এই কলেজেই কমার্সে পড়ে। সে কিন্তু তোমার সাঙ্ঘাতিক ফ্যান। পরিচিত হতে চায় তোমার সাথে!’

সুমন অবাক। হাসিমুখে সপ্রতিভ গলায় বললো, ‘ওরে বাবা! আমি কি কোনো সেলিব্রিটি নাকি যে আমার আবার ফ্যান থাকবে?’

‘বাহ্‌! এত ভালো নাটক করলে! রাজার প্রশংসায় তো সবাই পঞ্চমুখ! তার ওপরে ভালো ছাত্র। ফ্যান ফলোয়ার তো জুটেই যেতে পারে। যাহোক আমার কাছে এত ভাব নিতে এসো না। বিনা পয়সায় ফ্যানের সন্ধান পেয়ে গেছো। সেখানে ভাব নিতে চাইলে নিও।’

সুমন আমার কথায় খুব হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতেই বললো, ‘আচ্ছা বেশ,… পরিচয় করিয়ে দিও আমার ফ্যানের সাথে! দেখি কী করতে পারি তার জন্য!’

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>