| 20 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১৭)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

নয়ন আর সুজন দুজনেরই হাবভাব সন্দেহজনক লাগে ইদানিং।

নয়ন সবে ক্লাস সিক্সে উঠেছে। তবু এরই মধ্যে কেমন একটা পাকা পাকা ভাব। মাথার চুলগুলোতে হাত দিয়ে যেভাবে একটা ঝাঁকুনি দেয় আজকাল! আমি গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। মনে মনে ভাবি, এই কি আমার সেই ছোট্ট ভাইটি… যাকে এই সেদিনও গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে ঘুমাতে পারতো না?

খুব অস্থির লাগে। কিন্তু কী করবো বুঝতে পারি না। আমার নিজের জগতই এখনো টালমাটাল। এই টালমাটাল চারপাশটাকে একটু সমতায় আনতে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছি।

নিজের পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কলেজের টিচারদের কাছে আশাব্যঞ্জক নামে পরিণত হয়েছি। আমি নিজেও এই ধারাবাহিকতাকে নষ্ট হতে দিতে চাই না। জীবনে তো অনেক কিছুই হারালাম! নিজের মা-বাবার কাছ থেকে একটা নাম পেয়েছি শুধু। সেই নামের আড়ালে যে একজন যোগ্য মানুষ লুকিয়ে আছে, এটা এবারে সবাইকে জানানোর সময় এসেছে। আর…বাবার বাসায় থাকার সময়কার সেই স্বপ্নটার কথা এখনো ভুলে যাইনি আমি। একটা ঘর…আমার নিজের ঘর। সেই ঘরে একজন ভালোবাসার মানুষ…তার সাথে কাটানো সুখের ফুলঝুরি ওড়ানো দিনলিপি…

তবু যতবারই সেই স্বপ্নটা নিয়ে বিভোর হয়ে উঠি, কই থেকে যেন নয়ন এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয়ে ভাবতে বসি, আমার জীবনের সাথে অতপ্রোতভাবে আমার ভাইটা জড়িয়ে আছে। মা-বাবাকে ফেলে আমার হাত ধরে সে চলে এসেছে কেবলমাত্র আমার ভরসাতে। সেই ভাইকে ছাড়া কেন আমি আমার ব্যক্তিগত সুখ নিয়ে বিভোর হবো?

নয়নের পাশাপাশি সুজনকেও ভালোভাবে লক্ষ করি। তবে চালচলন, হাবভাবে নয়নের যেরকম প্রকাশ্য পরিবর্তন চোখে পড়ে, সুজনের ততটা পড়ে না। ওকে দেখতে এমনিতে আমার কাছে সাদামাটাই মনে হয়। নয়নের সাথে মিলে দুজনে খুব দৌঁড়ঝাঁপ করে। নয়নের পরিবর্তনটা যেমন হঠাৎ করে চোখে লাগছে, সুজনেরটা সেভাবে লাগছে না।

বড়মামাকে একদিন একা পেয়ে সব কথা খুলে বললাম। এই কথাগুলো বলার জন্য বড়মামা ছাড়া আর কাউকেই আমার উপযুক্ত মনে হলো না। কথাগুলো খুবই বিব্রতকর। পুরোটা বলতে গা হাত-পা ঘেমে উঠছিল আমার। তবু দাঁতে দাঁত চেপে বলেই ফেললাম। বড়মামা খুব মন দিয়ে পুরোটা শুনলো। মাঝখানে একটাও প্রশ্ন করতে আমাকে থামিয়ে দিলো না। তারপর কিছুক্ষণ ধম মেরে থেকে বললো, ‘এসব কথা আমাকে আগে বলিসনি কেন? এত কিছু হয়ে গেছে আর আমি বসে বসে আরামে ঘুমাচ্ছি?’

আমি একটু ভয় পেলাম। কে জানে, বড়মামা এখন গিয়ে আবার নয়নকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবে না তো? সেইটা ঠেকাতে তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘ইয়ে মামা…তুমি প্লিজ নয়নকে কিছু জিজ্ঞেস করো না! ও খুব সেন্টিমেন্টাল ছেলে। আমি তোমাকে বলে দিয়েছি শুনলে আর হয়ত কোনো কথাই আমাকে বলবে না। স্কুলেও যেতে চাইবে না আর। কী বলবো তোমাকে…এখনই যেতে চাইছে না!’


আরো পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১৬)


বড়মামা খুবই দুঃখিত হয়ে গেল শুনে। তবে আমার কথা বুঝতেও পারলো। বললো, ‘এই বয়সের ছেলেপেলেরা একটু এমনই হয়। ঠিক আছে, আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবো না। তবে বসেও তো থাকতে পারি না। ওদের স্কুলের হেডমাস্টারের সাথে আমার ভালো পরিচয় আছে। উনার সাথেই কথা বলবো আমি। তবে এসব কথা তো ফোনে বলা যায় না! একদিন ওদের স্কুলে যাবো।’

আমি ইতঃস্তত করে বললাম, ‘মামা…আমিও তোমার সঙ্গে গেলে কি তুমি রাগ করবে?’

বড়মামা অবাক হয়ে বললো, ‘তুই যাবি মানে? এসব কথা আমি তোর সামনে উনাকে কীভাবে বলবো? আর তাছাড়া…উনি আমার পরিচিত। তোর এত ভাবতে হবে না। বাকিটা আমি দেখছি। আর কেউ কিছু বলবে না নয়নকে। তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস।’

তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দুঃখিত গলায় বললো, ‘আজব ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিস! সবসময় পিতামাতাকে সন্তানের ভুলের জন্য খেসারত দিতে হয়। আর তোরা কী না সন্তান হয়ে পিতামাতার ভুলের খেসারত দিয়ে চলেছিস!’

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বড়মামা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু একটা ভরসা জাগাতে চাইলো। একটু যেন আশ্বস্তও হলাম তাতে। বড়মামা যখন কথা দিয়েছে, আপাতত নয়নকে নিয়ে না ভাবলেও চলবে। ওর স্কুলের ব্যাপারটা বড়মামা ঠিকই সামলে নিবে। তারপরেও যদি কোনো ঝামেলা হয়, সেটা পরে দেখা যাবে। আর বিষয়টা একবার যখন বড়মামার কানে দিয়েছি, তখন উনি নিজে থেকেই নয়নের হাবভাব চালচলন দেখাশুনা করবেন। এতদিনে এটুকু ভরসা তো করতেই পারি!

আমি আবার নিজের পড়াশুনা, ক্লাস, পরীক্ষা, কোচিং…এসব নিয়ে মেতে উঠলাম।

ওহ আচ্ছা…বলা হয়নি, সুমনের সাথে সুরমার আলাপটা করিয়ে দিয়েছি। সুমন বেচারাকে দেখতে যা লাগছিল! লজ্জায় একেবারে টমেটো। আর সুরমা যথারীতি প্রাণবন্ত, উচ্ছলা হরিণী। দেখে মনে হচ্ছিলো, আমি বুঝি কনেরূপী সুমনকে আলাপ করিয়ে দিলাম বররূপী সুরমার সঙ্গে।

তবে যাই হোক, সুরমা তার কথা আর রঙরূপের মাধুর্য দেখিয়ে সুমনকে ভালোই বশ করে ফেললো। এমন আঁতেলমার্কা ভালোছাত্রটিও দিব্যি পটে গেল সুরমার মায়াজালে। পড়ালেখার এই তীব্র সিরিয়াস সময়েও সে সুরমার জন্য যথেষ্ট সময় বরাদ্দ রাখে। দুটিকে প্রায়ই ক্লাসের ফাঁকে এখানে সেখানে আড্ডা মারতে দেখা যায়।

একদিন দেখি বায়োলজি বিল্ডিং এর সামনের বিশাল সবুজ মাঠে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে দুজন। পেছন ফিরে হাঁটছিল। সেজন্যই দেখতে পায়নি আমাকে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ওদের দেখলাম। সুরমা শাড়ি পরেছে। ইদানিং দেখছি প্রায়ই শাড়ি পরছে সুরমা। খুব সুন্দর করে খোঁপা করেছে। খোঁপার একপাশে একটা রক্তজবা। হেলেদুলে চলছে ওর দীঘল তনু। সুন্দর নকশাদার আঁচল অবহেলে এলিয়ে আছে মাটিতে। সুমনের এক হাতে একটা ফাইলমতো কিছু। আরেক হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন বলছে সুরমাকে। 

আমি মুগ্ধ হয়ে দৃশ্যটা দেখছি। একটু চিনচিনে উপদ্রব কি ভর করছে বুকের বাঁ পাশে? নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম। হাসলাম মনে মনে। প্রেমভরা এই সুন্দর দৃশ্যগুলো দেখতে ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু কীসের যেন একটা ভয় দানা বেঁধে ওঠে অজান্তেই। হাসির আড়ালে যেমন কান্না লুকিয়ে থাকে…এই সব ভালোবাসায় মাখামাখি দৃশ্যগুলোর পেছনের গল্পটাও সবসময় মিলনাত্মক হয় না!

তবে একটা কথা না মেনে উপায় নেই। সুরমা এই সম্পর্কটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে। ওর আগের বন্ধুত্ব কিংবা  ভালোবাসা যা কিছুই হোক, সেই সম্পর্কগুলোর মতো এটাকে হাসিঠাট্টাচ্ছলে নেয়নি। যদিও ওর মনের কৌমার্য নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি কখনো। এক মেয়ে যখন একাধিক ছেলের সাথে অন্যরকম সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, তখন তার মনের কৌমার্য ফুরুত করে পালিয়ে যায়। সুরমাকে নিয়ে যা যা শুনেছি এতদিন, তাতে সেটা এখনো টিকে আছে… সেই আশা গুড়েবালি!

শুধু সুমন ছেলেটার জন্য মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। ছেলেটার খুব বড় কোনো ক্ষতি হয়ে গেল না তো? এত পড়ুয়া ছেলে, যার সামনে মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং…কত কিছুর হাতছানি! সেই ছেলে এইচএসসির এই গুরুতর সংকটপূর্ণ সময়ে এভাবে প্রেম করে বেড়াচ্ছে! পড়ালেখার যথেষ্ট ক্ষতি যে হচ্ছে, সেটা বলাইবাহুল্য। কারণ যতটুকু সময় দুজন কলেজে কাটায়, এর বাইরেও লম্বা একটা সময় ফোনালাপে কেটে যায়। কলেজের সময়টা বাদে সুরমা তো আমার চোখের সামনেই ঘুর ঘুর করে সারাদিন। কাজেই ওর গতিবিধি বোঝা আর কী এমন শক্ত কাজ!

বড়মামাকে দেখলেই একেবারে সুবোধ বালিকা। অন্য সময় হয় ফেসবুক নয়তো মোবাইল কানে ধরা…কিছু একটা চলছেই সবসময়।

ওকে দেখলে মনে হয়, জীবনটাকে নিয়ে এত ভাবনাচিন্তা করার কিছু নেই। এটা স্রেফ কাটিয়ে দেওয়ার জন্যই বুঝি আমাদের উপহার দেওয়া হয়েছে। আমরা জীবনকে উপহার পেয়ে ধন্য হইনি, বরং জীবনই বুঝি আমাদের ঘাড়ে চাপতে পেরে একেবারে বর্তে গেছে!

সুরমা কার সাথে কথাবার্তা বলছে, সেটাও বুঝতে পারা আমার জন্য কঠিন ব্যাপার নয়। ভাগ্যবানটি যে সুমনই, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবু ছেলেটার মূল্যবান সময়গুলো এভাবে জলে ভেসে যাচ্ছে…দেখে কেন যেন স্বস্তি পাই না। ফার্স্ট ইয়ারে সুমনের ধারেকাছে আমরা কেউ ছিলাম না। অথচ সেকেণ্ড ইয়ার ফাইনালে আমি সুমনকে হারিয়ে দিয়েছি। শুধু আমিই না, সুমনের ওপরে আরো জনা পাঁচেক ছেলেমেয়ে অনায়াসেই জায়গা পেয়ে গেছে। তাই নিজেই মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করছি…সুমনের এই অধঃপতনের মূল কারিগর আমিই নয় তো?

আমার ঠোঁটকাটা দু’একজন বান্ধবীর চোখেও বিষয়টা এড়িয়ে যায়নি। একজন তো সেদিন মুখ ফস্কে বলেই ফেললো, ‘সুমনের সাথে ঐটা তোর কাজিন না? একে ভিড়িয়ে দিলি সুমনের পেছনে? এটা একটা কাজ করলি তুই? ওই মেয়ে তো স্রেফ বেচারা ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খাবে। নাকি ইচ্ছা করেই কাজটা করলি নীরা…যাতে তোর পথটা পরিষ্কার হয়ে যায়!’

কথাগুলো মজা করে বলা হলেও আমার ভেতরে গিয়ে লাগে একদম।

আমি কেন ইচ্ছা করে সুমনের ক্ষতি করতে যাবো? আমি ঘুণাক্ষরেও ওমন কথা ভাবিনি। সুরমারও যাতে ভালো হয়, মনে মনে সেটাই চেয়েছি। সুরমাকে কথা দিয়েছিলাম। তাছাড়া মনে হয়েছিল, আজেবাজে ছেলেদের সাথে ঘুরে সুরমার ভবিষ্যতটা ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে। এরা কেউই হয়তো সুরমার উপযুক্ত নয়। এমন কোনো একজনকে সুরমা বেছে নিক, যার সাথে নির্বিঘ্নে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে। কাজেই সেই ছেলেটা সুমনের চেয়ে উপযুক্ত আর কে হতে পারে?

আমি তো দুটো মনকে বাঁধতে চেয়েছি…ভাঙ্গনের সুর তো আমার মনের কোত্থাও নেই!

আশায় বুক বাঁধি মনে মনে। সব ফিসফাস থেমে যাবে একদিন। দুটোতে সুখী হলে সবাই উল্টো আমাকে এসে অভিনন্দন জানিয়ে যাবে।

সেই দিনটার প্রতীক্ষাতেই আমার মনটা খুশি হয়ে ওঠে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত