| 28 মার্চ 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২২)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

পরের কিছুদিন আমি আর সুরমার ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারলাম না।

নয়নকে নিয়ে আমার কিছুটা ব্যস্ততা দেখা দিলো। আমি মনে করেছিলাম নয়নের সমস্যাটা বুঝি একেবারে মিটে গেছে। কিন্তু সমস্যার মূল যে আরো গভীরে সেটা জানা ছিল না আমার। একদিন ছাদে একটু অসময়ে গিয়েই বিষয়টা প্রথম আবিষ্কার করলাম।

দিনটা ছিল শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বড়মামা আর ছোটমামা জুমার নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদে রওয়ানা হয়েছে। যাওয়ার আগে বড়মামা বেশ কিছুক্ষণ গজগজ করলো, ‘এই বাড়ি থেকে তো ধর্মকর্ম সব উঠেই গেল দেখছি! এত বড় বড় দুটা ছেলে আছে…কেউ নামাজ কালামের নাম পর্যন্ত নেয় না! কোন ওয়াক্তের নামাজ কত রাকয়াত সেটাও বলতে পারবে কী না সন্দেহ! কেয়ামতের দিন তো আমাদেরকেই জিজ্ঞেস করা হবে! সেদিন কী জবাব দিব আল্লাহ্‌র কাছে?’

আপনমনে কথাগুলো বলেই ছোটমামার দিকে ফিরে বললো, ‘এ্যাই বাবু, একদিনও তো দেখলাম না ছেলেটাকে নিয়ে নামাজে যাচ্ছিস! কীরে…বাপ হিসেবে তোর দায়িত্ব নাই? অবশ্য মানুষকে দায়িত্ব চিনায়ে কী হবে? আমার নিজের মেয়েটাই বেহায়ার মতো এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে! তার কি কিছু করতে পেরেছি? আমি আল্লাহ্‌র কাছে কী জবাব দিব কে জানে! বিয়েশাদী দিয়ে দিতে চাইলাম…সেখানেও বাগড়া দিয়ে বসে আছে…!’

কথাবার্তা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে দেখে আমি তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিতে চাইলাম। সুরমার প্রসঙ্গ ওঠা মানেই বাসায় নতুন করে অশান্তির হাওয়া বয়ে যাওয়া। আজ ছুটির দিনটাতে অন্তত এই ঝামেলা হোক সেটা চাচ্ছি না। ঝগড়াঝাঁটি আর অশান্তির রেশ কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে সেটা আমার চেয়ে বেশি ভালো আর কে জানে!

চটপট করে বললাম, ‘বড়মামা আমি দেখে আসছি ওরা দুজন কোথায়। আচ্ছামত বকবো আমি দাঁড়াও। এর পরের বার থেকে ঠিক তোমাদের সাথে নামাজে যাবে দেখো!’

বড়মামা টুপি মাথায় দিতে দিতে নিরাসক্ত মুখে বললো, ‘ঠিক আছে দ্যাখ, তুই যদি পারিস! আমরা তো এখন ব্যাকডেটেড! আমাদের কথা শুনতে আর ভালো লাগবে কেন?’

আমি সারা বাসা ঘুরেও নয়ন আর সুজনের দেখা পেলাম না। ভাবলাম হয়ত খেলতে গিয়েছে। মামারাও নামাজে চলে গিয়েছে। কাজেই আপাতত বিষয়টা ঢাকা পরে যাওয়াতে আমি আর তেমন একটা মাথা ঘামালাম না। যুগ যুগ ধরে বড়রা এভাবেই ছোটদের শাসন করে যাবে আর ছোটরাও ফাঁকতাল দেখে পল্টি মারবে। বড়রা বকাঝকা করার সময় ভুলে যায় যে তারাও একসময় এসবই করতো আর ছোটরাও বড় হয়ে হুবহু নিজেদের পূর্বপুরুষদের বেশ ধারণ করে ফেলে।

ছুটির দিনের আমেজটাকে নষ্ট হতে দিতে মন চাইলো না। সুরমা সুমন আর বিপ্লবের ত্রিভুজ প্রেমের জটিলতাকে মন থেকে সরিয়ে রেখেছি। অনেক দুঃখ করলাম, হা পিত্যেশ করলাম…কিছু কি হলো তাতে? যাদের জীবন তারাই সামলাক। আমি হয়ত দুজনের আগ্রহের মাঝে মধ্যস্থতা করেছি মাত্র। সুমনের ভাগ্যেও ভোগান্তি ছিল। সেজন্যই সেও এত মেয়ে থাকতে সুরমাতেই মজেছে। আর সুরমা যা করছে তার প্রতিদানও সে নিজেই ভোগ করবে। আমি দোষের ভাগিদার হতে যাব কোন দুঃখে?

এমন কিছু ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে মনকে আপাতত শান্ত রেখেছি। যা ঘটছে ঘটুক। আমি কেন শুধু শুধু মনকে ভারাক্রান্ত করে রাখবো সারাক্ষণ। ক্লাসের দিন এগিয়ে আসছে হাঁটি হাঁটি পায়ে। আমার মনোযোগ এখন সেখানেই থাকা উচিত।


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২১)


একটু নিজের মতো থাকতে মন চাইছে। একবার ছাদে উঠলাম। বেলা বাজে প্রায় একটা। বাইরে কটমটে রোদ দাঁত কামড়াচ্ছে। বৃষ্টি হওয়ার আগে কিছুদিন এমন উগ্র গরম যায়। মনে হচ্ছে দুই একদিনেই বৃষ্টি নামবে। ছাদে আমি শখ করে কিছু গাছ লাগিয়েছি। সেগুলো মানুষের মতোই এই প্রচণ্ড গরমে ত্যক্ত হয়ে থাকে। সকাল বিকাল পানি দিতেও ছাদে উঠতে হয়। আজ একটু দেরিই হয়ে গেল।

ছাদের চিলাকোঠায় পা দিয়েই মনে হলো, ভেতরে কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। একজন কিছু বলছে, আরেকজন জোরের সঙ্গে বলছে, না না। একটু কান পাততেই মনে হলো, সুজন আর নয়ন আছে ছাদে। কিন্তু ওরা এই ভরদুপুরে ছাদে উঠে কী করছে? আমি আর আড়ালে দাঁড়িয়ে গোয়েন্দাগিরি চালাতে চাইলাম না। ছাদে উঠে দেখি, সুজন আর ওর এক বন্ধু দুজনে মিলে কিছু একটা গুঁজে দিচ্ছে নয়নের হাতে। নয়ন একটু জড়সড় হয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। জিনিসটা নিতে চাইছে না। অবাক হয়ে গেলাম এসব কাণ্ডকারখানা দেখে।

নয়ন শুক্রবার দিন পড়া থেকে বিরতি নেয়। সুজনের এসএসসি আর দু’মাস পরেই। শুক্রবারে সেও একটু ছুটির আমেজেই থাকে।

এখানে কী হচ্ছে জানার জন্য একটু বেশ জোরের সাথেই হাঁক দিলাম, ‘এই তোরা এখানে কী করছিস সবাই মিলে? সুজন কী দিচ্ছিস নয়নের হাতে? এ্যাই…কী হয়েছে কথা বলছিস না কেন?’

সুজন আর তার বন্ধুর মুখ সাথে সাথেই কেমন একটু চুপসে গেল যেন। নয়ন মুখটাকে কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়েছে। আমার প্রশ্নটা মনে হলো যেন ওদের কানেই ঢোকেনি। তিনজনই উত্তর না দিয়ে এদিক সেদিকে চাইতে লাগলো। একটু পরে সুজন আর তার বন্ধু ‘আচ্ছা আমরা একটু মাঠে যাই…নয়ন তুই কি যাবি?’ বলে ধুপধাপ করে নীচে চলে গেল। আমি বুঝতে পারলাম নয়নকে ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নটা তেমন গুরুত্ব রাখে না। ওরা দুজন এখন এই জায়গা থেকে পালাতে চাইছে।

আমি নয়নের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীরে ওরা কী দিচ্ছিলো তোর হাতে?’

নয়ন মুখচোখ শক্ত করে বললো, ‘আপা…তুই ডাক্তার হলে একটা বাসা নিবি? আমরা অন্য কোথাও গিয়ে থাকবো। এখানে থাকলে সবসময় এই সুজন ভাইয়ের ব্লাকমেইলিং সহ্য করে যেতে হবে!’

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। ব্ল্যাকমেইলিং মানে? অবাক হয়ে বললাম, ‘সুজন কেন তোকে ব্ল্যাকমেইলিং করবে! কী বলছিস এসব?’

নয়ন অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ আপা…সুজন ভাই না কেমন জানি! আজকে থেকে না। প্রথম থেকেই! সুজন ভাই আমাকে অনেক কিছু করতে বলে। তুই জানিস… আমি এখানে আসার পরে সুজন ভাই প্রথম আমাকে সিগারেট খেতে বলেছিল। আমি খেতে চাইনি দেখে বলেছে, আমার মা-বাবার কথা স্কুলের সবার কাছে বলে দিবে।

আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। তাই ওর কথামতো সিগারেট খাইছিলাম। কিন্তু তারপরও সুজন ভাইয়ের ক্লাসের সেই ছেলেটা কীভাবে ওসব কথা জেনে গেছিলো আমি বুঝতে পারিনি।’

আমি হতবাক হয়ে শুনছিলাম। নয়ন থামতেই ওকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর? আজকে কী দিতে চাইছিল তোকে?’

নয়ন মাথা নীচু করে ফেললো। নিমেষেই কেমন লাল হয়ে উঠলো ওর চোখদুটো। থমথমে মুখে বললো, ‘আপা সুজন ভাই ভালো না। ও অনেক আজেবাজে ছেলেদের সাথে মিশে। ওরা সব কী কী জানি নেশার জিনিস খায়। আমাকেও খাইতে বলে। আমি নিতে চাই না দেখে আমার সাথে জোর করে। আর বলে, না নিলে স্কুলের সবার কাছে আমাদের মা-বাবা কী কী করে বেড়াইছে সেসব কথা বলে দিবে!…আর খালি তাই না…. ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। বলে আমি এখনো দুধের বাচ্চা। কিছুই শিখিনি। আমি নাকি এখনো নাবালক। ওরা অনেক কিছু জানে…আমি গণ্ডমূর্খ।’

বিস্মিত হতেও এক পর্যায়ে ভুলে গেলাম আমি। এসব কী শুনছি!

বিস্ময় ছাপিয়ে একসময় রাগ উঠে এলো মাথার ওপরে। এত বড় সাহস সুজনের! আর নয়ন এসব চুপচাপ হজম করে গেল কেন? সব রাগ এসে পড়লো নয়নের ওপরে। বললাম, ‘তুই এসব কথা এতদিন বলিসনি কেন আমাকে? সুজন এমন কথা বলার…এসব কাজ করার সাহস কীভাবে পায়? বেশিকিছু করতে হতো না, বড়মামাকে বললেই সব ঠিক হয়ে যেত। আর ছোটমামাও কি চুপ করে বসে থাকতো? ওরা তোকে যেভাবে খুশি নাচালো আর তুই নাচলি? আর এখন মিন মিন করে এসব কথা আমাকে বলছিস? লজ্জা করছে না তোর?’

নয়ন সত্যি সত্যিই মিন মিন করে বললো, ‘আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম আপা। সুজন ভাই কিছু হলেই বলে… তোরা তো আমাদের বাসায় থাকিস। আমার কথা না শুনলে তুই কি এই বাসায় থাকতে পারবি ভেবেছিস?

আর বলে… তুই কিছু বললেও মা-বাবা কেউ তোর কথা বিশ্বাস করবে না। মা তো বলেই সবসময়, তুই ঢাকা শহরের ছেলে। আগে থেকেই নটঘট জানিস। তোর মা-বাবাও কত কী নটঘট করেছে! আমার নামে কিছু বলতে গেলে তুই উলটা ফেঁসে যাবি!’

আমি স্তম্ভিত। কাঁপতে কাঁপতে বললাম, ‘ও বললো…আর তুই সেটাই বিশ্বাস করলি?’

নয়ন কেমন যেন কাঁচুমাচু ক্লান্ত একটা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।

হতাশ গলায় বললো, ‘আপা…তুই আর বড়মামাকে কিছু বলিস না প্লিজ! আমার আর এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তুই চিন্তা করিস না। আমি ওদের কথামতো কিছু উলটাপালটা কাজ করিনি। ওরা যত আমার পিছে লাগতে এসেছে আমি দূরে দূরে থেকেছি। শুধু কাউকে কিছু বুঝতে দেইনি। কিছু হলেই সবাই শুধু মা-বাবার কথা বলে। আপা…সবাই শুধু তাদের দোষগুলো আমাদের গায়ে লাগায়ে দেয় কেন?

আপা, আমার কাউকে বিচার দেওয়ার ইচ্ছা নাই। তুই বলতি না, আমরা মানুষ হলেই সবার জবাব দেওয়া হয়ে যাবে। এখন আমিও তাই মনে করি। তুই মেডিক্যালে চান্স পেয়ে গেছিস। কিছুদিন পরে ডাক্তার হয়ে যাবি। আমি মন দিয়ে পড়ছি যাতে আমিও ভালো কিছু করতে পারি। আমাদের তখন কাউকে লাগবে না…শুধু তুই থাকিস আপা!’

নয়নের গলার স্বর ভারী হয়ে এলো। আমিও আদ্র চোখে ওর দিকে তাকালাম।

আমি যেন আজকেই এই প্রথমবারের মতো নয়নকে দেখলাম। চিনতে পারলাম ওর ভেতরটাকে। মনে মনে বললাম, তুই এত বড় কবে হয়ে গেলিরে নয়ন?

মুখে বললাম, ‘আচ্ছা…কাউকে কিছু বলবো না। কিন্তু তুই এখন থেকে সব কথা আমাকে বলবি। সুজন কী কী করছে, কোথায় যাচ্ছে কাদের সাথে মিশছে সব বলবি। আর…কাউকে ভয় পাওয়ার দরকার নাই…বুঝলি?’

তারপর কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললাম, ‘কাউকে দরকার নাই…এটা ভুল বললি নয়ন। যারা আমাদের ঝড়ের মুখ থেকে তুলে নিয়ে এসে আশ্রয় দিলো…তাদের ঋণ কিন্তু কোনোদিন ভোলা যাবে নারে! সুজন একদিন তার খারাপ কাজটা ঠিকই বুঝতে পারবে। হয়ত সেদিন শুধরে যাবে আর না হলে ওকে নিজের ভুলের খেসারত দিতে হবে। কিন্তু তাই বলে আমরা এই বাড়ির এতদিনের সব দায় ভুলে গিয়ে নিজেরা মাথা তুলে বেঁচে থাকবো…এটা যেন কোনদিন ভাবিস না তুই। বুঝতে পেরেছিস?’

নয়ন অশ্রুসজল চোখে আমার দিকে তাকালো। নিঃশব্দে মাথাটাকে ঝাঁকিয়ে চুপ করে রইলো।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত