এরপরে কেটে গেছে মাস ছয়েক।
এই ছয়মাসে অনেক পরিবর্তন আর অনেক ঘটনা ঘটে গেছে আমাদের সবার জীবনেই। মহাকালের হিসেবে হয়ত অতি ক্ষুদ্র এই সময়, কিন্তু আমাদের অতি ছোট মানবজীবনে ছয়মাস মোটেও কোনো সামান্য সময় নয়। কত কিছু ঘটে যায় এইটুকু সময়ে!
সুরমার এই বছরেই আরেকবার পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষার দিনক্ষণ এসে আবার ঘুরেও গেল। সুরমা এবারেও পরীক্ষা দিলো না। সে নিজের মতো থাকে, খায় দায় ঘুমায়। মাঝে মাঝে পড়ার টেবিলে বসে পড়াশুনা করার নাটক করে। বড়মামা ওর বইপুস্তক পুড়িয়ে দিয়েছিল। সুরমাকে কোথা থেকে যেন কিছু বইখাতা নোটপত্র নিয়ে এসে কিছুদিন নাকের কাছে ঝুলিয়েও রাখতে দেখলাম। ওর কাজকর্ম নিয়ে মাথা ঘামানো সবাই একরকম ছেড়ে দিয়েছে।
বাসার সবাই চুপচাপ ওর কাণ্ডকীর্তি দেখে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না। কেউ জানতেও চায় না, সুরমা কী চিন্তাভাবনা করছে! ওর প্রতি সকলের এই নিস্পৃহতা সুমনার জেদ দিনকে দিন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে…সেটা ভালোই বুঝতে পারি আমি। কিন্তু আগ্রহ দেখিয়েও বা কে কী করবে! শেষমেষ সুরমা সেটাই করবে, যেটাতে ওর মন সায় দিবে।
আমিও সেদিনের পর থেকে তেমন একটা কথা বলি না সুরমার সাথে। হয়ত আমার অতিরিক্ত খবরদারি ও এখন সহ্য করতে পারছে না। কিংবা কে জানে…আমাকেই হয়ত এখন আর সহ্য করতে পারছে না! আমি কোথা থেকে উড়ে এসে ওর মা-বাবার মন জুড়ে বসে গেছি। তারা এখন নিজের সন্তানের চেয়ে আমাকেই বেশি মাথায় তুলে রাখে…এমনটাই হয়ত মনে মনে ভাবছে সুরমা।
যতদিন সুমন ছিল ওর জীবনে, ততদিন আমার একটা মূল্য ছিল। এখন বিপ্লব ভর করেছে। এখন তো আমাকে অসহ্যই মনে হবে! যা ইচ্ছে করুক…আমার কী!
এই বাড়িতে আমার দিনরাত্রিগুলো এখন অনেকটাই ক্লিশে। বাড়ির বড়রা ব্যস্ত থাকে নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে। আমার ভাইও এখন ভিন্ন এক জগতের বাসিন্দা। আগে সুরমা ছিল সবসময়ের বন্ধু। সেও অজানা আক্রোশে দূরে চলে গেল!
আমার ভাই নয়নও পড়ালেখায় খুব ভালো করছে। সেদিন বড়মামাও কথাপ্রসঙ্গে কথাটা বললো, ‘বুঝলিরে নীরা…তোরা দুটি ভাইবোন তো একেবারে খাঁটি হিরা! এমন হিরার টুকরো ছেলেমেয়ের কপালেই কেন মা-বাবার স্নেহ লেখা থাকবে না কে জানে! গতকাল নয়নের স্কুলের হেডমাস্টার ওর ভূয়ষী প্রশংসা করে বলছিল, নয়ন নাকি খুব ভালো করছে স্কুলে। অংকের মাথা নাকি সাংঘাতিক ভালো! আমার শুনে বুকটা ভরে গেলো রে মা! দোয়া করি, তোরা অনেক বড় হ!
পাশাপাশি আমার মেয়েটাকে দ্যাখ…ঠিক যেন একটা মাকাল ফল! ওপরটা দেখে সবাই ধোকা খাবে। চকমকে রঙিন। আর ভেতরটা? একদম পচা!’
আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২২)
সুরমার কথা উঠে আসাতে আমি বলবো না বলবো না করতে করতেও প্রসঙ্গটা তুলেই ফেললাম।
‘ইয়ে মামা…সুরমা তো এবারও পরীক্ষা দিলো না। তুমি…মানে তোমরা যদি একটু বুঝিয়ে বলতে, তাহলে হয়ত…’
‘তাহলে হয়ত কী? পড়ালেখা করে ভাসিয়ে ফেলতো?’ মামা একেবারে খ্যাক করে উঠলো আমার কথা শুনে। আমি ভয়ে একদম চুপসে গেলাম। না জানি কী একটা অকাজ করে ফেললাম ভালো কাজ করতে গিয়ে!
আমার চুপসানো মুখ দেখে বড়মামার বুঝি একটু মায়া হলো। শান্ত হয়ে বললো, ‘যে মেয়ে পরীক্ষাতে ফেল করেও অনুতপ্ত হয় না, তুই কি মনে করেছিস সে নিজেকে শোধরাতে চায়? ওর দ্বারা আর যাই হোক…পড়াশুনা হবে না! সে আমি বেশ বুঝে নিয়েছি।’
তারপর কী একটু চিন্তা করে বড়মামা বললো, ‘আচ্ছা তোর মামী সেদিন কী একটা যেন বলার চেষ্টা করছিল। আমার ধমক খেয়ে আর বলতে পারেনি। তুই নাকি কোন একটা ছেলের কথা বলছিলি তোর মামীকে। কী নাকি বলছিলি যে…পছন্দ ফছন্দ করে! এই মেয়েকে দিয়ে তো আর পড়ালেখা হবে না…শুধু শুধু বাসায় বসিয়ে না রেখে একে পরের বাড়ি বিদায় করে দিই। কী করে সেই ছেলে?’
আমি অকূল সাগরে ঝুপ করে পড়ে গেলাম। একেই বুঝি বলে খাল কেটে কুমির আনা! এখন বড়মামাকে আমি কী বোঝাই?
কোনোমতে ইনিয়ে বিনিয়ে জোড়াতালি মেরে বললাম, ‘ইয়ে…মামা…হ্যাঁ একটা ছেলে ছিল আমাদের কলেজের। ও এবার ডেন্টাল কলেজে চান্স পেয়েছে। আমাদের সাথেই পড়তো। পছন্দ করতো মানে…ঐ একটু আধটু। তবে সুরমা কী চিন্তা করছে…এখন বিয়েশাদী করতে রাজি হবে কী না…এসবও ভেবে দেখার বিষয় আছে। আর ছেলেটা তো সবে এবারে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলো। এখনো টেনেটুনে পাঁচ বছর। এস্টাবলিশড হতে হতে ধরো আরো দুই বছর। এতদিন কি তোমরা অপেক্ষা করতে চাও? না…মানে করতে চাইলে করতে পারো! তবে আমি বলছিলাম কী…যাই করো সুরমার মতটা নিও একবার!’
পুরোটা বলতে পেরে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভেতরে ভেতরে ঘেমে নেয়ে উঠেছি একদম। বড়মামা যদি কিছু বুঝতে পারে! কেন সেদিন এই ছেলের হয়ে ঘটকালি করে আজ আবার উলটা কথা বলছি…এমন কিছু যদি ভেবে বসে!
তবে বড়মামা সেদিকে গেল না। বিরসমুখে সেই একই কাসুন্দি ঘেঁটে চললো। ‘আরে দূর দূর! ওর মতামত নেওয়ার কী আছে! একটা কাউকে পেলেই গলায় ঝুলিয়ে দিব। তারপর ঝুলে থাক সারাজীবন বান্দরনির মতো…’
বড়মামার ভাষাজ্ঞানে আমি অক্কা পেতে পেতে বেঁচে গেলাম। কোনোমতে সেখান থেকে পালাতে পালাতে ভাবলাম, আর কখনোই এভাবে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবো না। সুরমার বিয়ে নিয়ে আমার মতামত দেওয়ার কিছু নাই। ওর আজ রামকে ভালো লাগবে…কালকে লাগবে শ্যামকে। মাঝখান থেকে আমরা কদু মধু যদুরা বিপদে পড়ে যাবো।
পরীক্ষা না দিলেও সুরমার রোজকার রুটিনে তেমন কোনো হেরফের হলো না।
দু’একদিন পর পরই সে সেজেগুজে ‘নোট’ আনতে যায়। ও নিচে নামলেই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে জানালার কাছে গিয়ে সন্তর্পণে উঁকি মারি। এখনো বিপ্লবেই আটকে আছে সুরমা। এটাও অত্যশ্চর্য ব্যাপার। ফটকবাজ ছেলেরা বোধকরি বিশেষ কায়দাকানুন জানে উড়ু উড়ু মেয়েদের বশে রাখার!
বিপ্লব অসভ্যের মতো ওপরের দিকে তাকালেই আমি সুড়ুত করে সেখান থেকে সরে আসি।
বিপ্লবের নাম্বারটা ব্লক করে দিয়েছিলাম। অপরিচিত কোনো নাম্বার থেকে ফোন এলেও কেটে দিই। বিপ্লবের ফোনকল রেকর্ড করে রেখে সুরমাকে শোনানোর ইচ্ছেটাও সেই কবেই অক্কা পেয়েছে। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে পারবো না আমি। থাকুক ওরা ওদের মতো।
আমার মেডিক্যালের ক্লাস শুরু হয়ে যেতেই তুমুল ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সুরমা বিপ্লব…এসব জ্বালা যন্ত্রণা আমার জীবন থেকে ধুয়ে মুছে গেল। ক্লাস আর ক্লাস! পড়ার ভেতরে ডুবে যেতে যেতে জীবনের নতুন অর্থ প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরতে লাগলাম। জীবনের কাছে কী চাই আমি…সেই উপলব্ধিটাকে প্রতিদিন একটু একটু করে জানতে পারলাম।
কিন্তু এই নিজেকে খুঁজে ফেরার মাঝেও একদিন অতীতের চেনামুখ এসে সামনে দাড়িয়ে গেল। ক্লাস থেকে বের হতে গিয়ে দেখলাম, অডিটেরিয়ামের সামনের বকুল গাছের নিচে সুমন দাঁড়িয়ে আছে। সেই পরিচিত ফিটফাট বেশ… চশমা চোখের আলুথালু কেশের পড়ুয়া সুমন। ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম কলেজের শুরুর দিকের দিনগুলোতে।
সুমন আমাকে দেখতে পেয়েই হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানালো। বুঝতে পারলাম, আমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, ওদের ডেন্টাল ইউনিটটা আমাদের মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্নই। কাজেই আমার দেখা পেতে খুব বেশি কাঠখড় পোড়ানোর কিছু নেই।
সুমনকে বেশ অনেকদিন পরে দেখে খুশি হলাম। বিশেষ করে চেহারার সেই অতীত ঐতিহ্য ফিরে আসাতে বেশি ভালো লাগলো। হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আরে এ কাকে দেখছি! একেবারে যে সেই সুমন!’
সুমনও হাসতে হাসতে বললো, ‘সেই সুমনের পরিবর্তে কি অন্য কোনো সুমনকে দেখবে বলে আশা করেছিলে নাকি?’
‘না তা না নিশ্চয়ই! তবে সেই সুমনকে যে আবার দেখতে পাবো, এই আশা প্রায় জলাঞ্জলিই দিতে বসেছিলাম!’
হাঁটতে হাঁটতে সবুজ মাঠটা পার হচ্ছিলাম আমরা। একটানা ক্লাশ করতে করতে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আছি। গায়ে জড়ানো এপ্রোনটাকে খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছি।
সকালে বাসা থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরুনোর সময় মাথার চুলগুলোকে একটা লম্বা বিনুনীতে সেঁটে নিয়েছিলাম। সেটাকে নিজের অজান্তেই সামনে টেনে এনে আনমনে আঙুলে জড়াচ্ছিলাম। সুমন ওর হঠাৎ শুরু হওয়া ব্যস্ততার গল্প করছিল। সেই ব্যস্ততা ওকে কীভাবে আবার নতুন জীবনে টেনে এনেছে, সেই গল্প শুনতে শুনতে পথ চলতি দু’চার জোড়া উৎসুক চোখকে পাশ কাটিয়ে চলছিলাম।
কেন যেন খুব ভালো লাগছিল আমার। সুমনের আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠটা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিলো, ছেলেটা যেন নিজেকে আবার ফিরে পেয়েছে।
হঠাৎ মনের মাঝে অনেকদিন আগের একটা দৃশ্য সপাট ভেসে উঠলো।
একটা আলগোছে এলানো নকশাদার শাড়ির আঁচল…হাত নেড়ে নেড়ে গল্পরত কোনো এক স্বতঃস্ফূর্ত তরুণ…ঘাসের গালিচা বিছানো সবুজ মাঠ…
মন জুড়ে কী একটা অতৃপ্ত ছবি যেন টেনে নিয়ে চলছিলাম এতদিন। সে কথা আমার মন জানতো…মননে তা ধরা দেয়নি কোনোদিন!
চুপিসারে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ভাবলাম… হায়রে বিচিত্র মানবমন! ক্যামনে চিনতে পারি তার সুচতুর ধরণ!
গল্পকার,
রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পুরকৌশল নিয়ে পড়ে এখন নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরে।