| 20 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২৪)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

টক ঝাল মিষ্টিতে মিলিয়ে আমার দিনগুলো ফুরফুরিয়েই কেটে চলেছে।

সাতসকালে নাকে মুখে কিছু একটু গুঁজে নিয়েই ক্লাসে চলে আসি। বেশিরভাগ দিন একটানা দুপুর পর্যন্ত ক্লাস চলে। টিচারদের লেকচার শুনতে শুনতে হাই তুলি আর বার বার ঘড়ির দিকে তাকাই…কখন দু’দণ্ড বিশ্রাম মিলবে! তবে এ্যানাটমির ক্লাসটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি।

স্যার ক্লাসে একটা কঙ্কাল নিয়ে আসেন। সেটা দেখামাত্রই চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে যায়। মানুষের শরীরে যে নানারকম হাড়গোড়ের অস্তিত্ব আছে, সেটা নিয়ে এতকাল অন্তত সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এত এত হাড় এতরকম নার্ভ দিয়ে এমনভাবে জুড়ে দেওয়া থাকে…যত দেখি ততই বিস্মিত হই। কী অপূর্ব এক কারিগর কী সুনিপুণ দক্ষতায় এই দেহকাঠামো তৈরি করেছেন! বাসায় একটা কঙ্কাল রাখতে পারলে খুব ভালো হতো। খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে মানুষের কঙ্কাল দরকার হয়। হলে কয়েকজন একটা কঙ্কাল নিয়ে স্টাডি করে। বিপদ হয় যারা বাসায় থাকি, তাদের জন্য।

ছোটমামা মাঝে মাঝে এসে আমার পড়ালেখা নিয়ে গল্পগুজব করে। ভাগ্নীর ডাক্তারী পড়ার বিষয়টাতে ছোটমামা ভেতরে ভেতরে থ্রিলড, যদিও মুখে তার প্রকাশ করে না কখনো। বরং যখন তখন একটাই কথা বলছে, ‘কেন যে সুন্দর চেহারাটা ডাক্তারী পড়ে কয়লা বানায়ে ফেলবি কে জানে! ডাক্তার হয়ে গেলে মেয়েরা তো খুব কাঠখোট্টাও হয়ে যায়। কেমন কট কট করে কথা বলে! … যান এই টেস্টগুলো করিয়ে আনুন। যেখান থেকে বললাম সেখান থেকেই করাবেন। ঔষধগুলো ঠিকমত খাবেন। এবার আসুন…নেক্সট!’ মামার কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাই। হাসতে হাসতে বলি, ‘আর পুরুষ ডাক্তাররা বুঝি খালি মধু ছড়ায় মুখে? সব তিতা শুধু মেয়েদের মুখেই!’

ছোটমামাও হাসতে হাসতে বলে, ‘সেটা তো জানি নারে! আমি আবার দেখেশুনে লেডি ডাক্তারদের কাছেই যাই, বুঝলি? তোর ছোটমামী বিষয়টা জানে না অবশ্য!’

কঙ্কালের বিষয়টা ছোটমামাকে বলতেই আঁতকে উঠেছে, ‘সর্বনাশ! বলিস কী! ঘরের মধ্যে মানুষের রিয়েল কংকাল নিয়ে বসে থাকবি? তোর ভয় ডর নাই? রাতে ঘুমাতে পারবি? না না…আসল মানুষের কঙ্কাল দিয়ে কাজ নেই। খোঁজ নে, আর্টিফিশিয়াল কিছু দিয়ে কাজ চলবে কী না!’

এটা কিন্তু খারাপ বলেনি ছোটমামা। মানুষের সত্যিকারের কঙ্কাল জোগাড় করাটা খালি ঝামেলার কাজই না, খরচসাধ্যও বটে! আর্টিফিশিয়াল কঙ্কাল নাকি বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের টিচাররা সেগুলো নিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে না। এসব কঙ্কালে নাকি অনেক সময় বেশ ভুল থাকে। রিয়েল কঙ্কালে হয়ত একটা গর্ত আছে, একটা নার্ভ চলে গেছে অথবা কোনো একটা গ্রুপ আছে। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল কঙ্কালে হয়ত ওইটা আসেই নাই!

তবে শেষমেষ ভেবেচিন্তে কঙ্কাল কেনার প্ল্যান মাথা থেকে বাদ দিয়েছি। ঠিক করেছি কয়েকজন বন্ধু মিলে লাইব্রেরিতে পড়বো। তখন একটা ব্যবস্থা করা যাবে!

সেদিনের পর থেকে সুমনের সাথে মাঝে মাঝেই দেখা হয়। দেখা হয় না বলে, দেখা করি বললেও হয়ত ভুল হয় না। সুমন খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাকে ফোন করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে, আজকে তোমার ক্লাসের ব্রেক কখন? তোমাদের ক্যান্টিনে এক কাপ চা খেতে আসতাম! অবশ্য যদি অনুমতি পাওয়া যায় তবেই!’

প্রথম প্রথম মনে করেছিলাম, কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে না পারার দুঃখবোধটা হয়ত সুমনের মধ্যে অনেকদিন ভূত হয়ে চেপে বসে থাকবে। জীবনের অনেকগুলো হিসাবনিকাশ উল্টেপাল্টে যাওয়া ভুলতে পারাটা স্বাভাবিকভাবেই কঠিন। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্নটা ও কতদিন ধরে লালন করে আসছে কে জানে! স্বাভাবিক আর দশটা পরিবারের সন্তানেরা স্বপ্ন দেখতে শেখে অনেক আগে থেকে থেকেই। আমার না হয় ভিন্ন পরিস্থিতি! যে পরিবারে বড় হয়েছি, সেখানে পরেরদিনটা কীভাবে কাটবে সেই নিশ্চয়তাটাই ছিল না কারো কাছে। এর মধ্যে আবার স্বপ্ন দেখতে চাওয়ার দূরাশা!


আরো পড়ুন:  খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২৩)


সুমনের প্রতিনিয়ত স্বাভাবিক হয়ে ওঠাটা দেখতে ভালো লাগছে। আমাদের ক্যান্টিনটার দখলদারিত্ব শুধু মেডিক্যাল কলেজেরই না, এটা ডেন্টাল ইউনিটেরও দখলে। তবু সুমনের একটু হাল্কা পিন খাওয়াটা এখন দিব্যি হজম করে ফেলি। সে সবকিছুতে বোঝাতে চায়, আমি এখন ওর বেশ অনেকটা ওপরে অবস্থান করছি।

আমি হাসতে হাসতেই বলি, ‘বেশ তো। চা খাওয়া যাবে আমাদের ক্যান্টিনে। আজকে ব্রেক হবে…’

সুমন সেদিন কথাচ্ছলে মজা করেই সুরমার প্রসংগটা তুললো। আমি খুব অপ্রস্তুত। মনে করেছিলাম ও সুরমাকে ভুলতে চাইছে। তাই ভুলেও কখনো সেই প্রসঙ্গ তুলি না। কিন্তু সুমন নিজে থেকেই বললো, ‘তোমার কাজিন তো চুটিয়ে প্রেম করছে বিপ্লবের সাথে। বিপ্লবের সাথে এখানে সেখানে যেতেও দেখেছি। না না…আবার তাই বলে মনে করো না যে, পিছু নিয়েছি। হঠাৎ চোখে পড়ে যায়…একই শহরেই থাকি কী না!

সুরমা বিপ্লবের ব্যাপারটা জানে তো? বিপ্লব কিন্তু এখন আরো অনেকদূর এগিয়েছে। শুনতে পাই, মাদক ব্যবসাও নাকি শুরু করেছে আজকাল। বাতাসে কান পাতলেও অনেক কিছু শোনা যায়। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও নাকি নানারকম আজেবাজে জিনিস সাপ্লাই দেয়। ওদের একটা চক্র আছে। এরা খুব কৌশলে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে এ্যাক্সেস তৈরি করে। নানারকম ভাবে পটিয়ে পাটিয়ে বন্ধুত্ব তৈরি করে ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন রকম মাদকে আসক্ত করে তোলে। আর একবার ভালোমত আসক্তিতে জড়াতে পারলেই কিস্তিমাত। ছেলেমেয়েরা তখন তাদের হাতের পুতুল!’

আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। বিপ্লব এখন এই কাজ করছে! আর সুরমা কী না এমন একটা ছেলের সাথেই দিনে দুপুরে ঘোরাঘুরি করে? সুরমা কি কিছুই বুঝতে পারছে না?

আমি বললাম, ‘তুমি এতকিছু জানো কীভাবে? তোমার সাথে তো বিপ্লবের কোনো বন্ধুত্ব নেই! নিশ্চয়ই বিপ্লবের সার্কেলের কাউকে তুমি সেভাবে চেনোও না!’

‘ঐ যে বললাম, বাতাসে কান পাতলেও অনেক কিছু শোনা যায়! আমি শুনেছি একভাবে। তুমি খবর নাও সুরমা কিছু জানে কী না! জেনেও যদি ঘোরাঘুরি করে কিছু বলার নাই। কিন্তু না জেনে থাকলে তো বিপদে পড়তে সময় লাগবে না!’

আমি হতাশা ফুটিয়ে বললাম, ‘সুরমাকে আমি বিপ্লবের কথা কী জিজ্ঞেস করবো? একবার জিজ্ঞেস করেই অনেক কিছু শুনেছি। একমাত্র উপায় হচ্ছে, মামাদের যদি জানিয়ে দিই। কিন্তু তার পরিণতিও কি ভালো হবে মনে করছো?’

সুমন আর কিছু বললো না। আমিও চুপ হয়ে গেলাম। এই প্রসঙ্গটাই সেদিনের মতো আমাদের সব আলাপচারিতাকে বন্ধ করে দিলো।

সেদিন বাড়িতে ফিরে মনে মনে খুব প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আজ সুরমাকে কিছু বলবোই বলবো, যা হয় হোক! শেষে যদি বড় কোনো বিপদে পড়ে যায় সুরমা! তখন কি আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো? কেন জেনেশুনে বোনটাকে একটুও সাবধান করলাম না? যদিও বোন আমার কচি খুকি নয় মোটেও। কিন্তু তবুও আরেকবার সাবধান করাটা আমার দায়িত্ব।

আমি কলেজ থেকে বাসায় ফিরতেই বড়মামা আমাকে তার ঘরে তলব করলো। গিয়ে দেখি মামীও বসে আছে। আমি একটু অবাক হলাম। কী এমন জরুরি প্রয়োজন দেখা দিলো আবার?

বড়মামাই শুরু করলো। ‘ইয়ে…নীরা… আমরা সুরমার জন্য একটা প্রস্তাব পেয়েছি। ছেলে দেশের বাইরে থাকে। বড়মেয়ের পর আমাদের ইচ্ছা ছিল না সুরমাকে দেশের বাইরে পাঠানোর। কিন্তু ওর যে হালচাল দেখছি তাতে ওকেও দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো হবে। দেশে থাকলে আমাদের নাকের ডগার সামনে দিয়ে বখে যাবে আর আমাদের সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে!’

আমি চুপ করে আছি। কী বলবো বুঝতে পারছি না। সুরমাকে এখন বিয়ের কথা বললে কী বলে কে জানে! আর মামা-মামী আমাকেই বা এসব কথা বলছে কেন?

বেশিক্ষণ অবশ্য ভাবতে হলো না আমাকে। বড়মামাই আমার প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে দিলো।

‘আমি কিংবা তোর মামী…আমরা কেউই ওকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে চাচ্ছি না। তুই ওকে বিয়ের ব্যাপারে রাজি করা। মানে তুই শুরু কর। ছেলের ছবিও আছে। ছেলে দেখতে শুনতে খারাপ না। বিয়ের এক মাসের মধ্যেই মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে তাদের। আমাদেরও আপত্তি নেই। এখন সুরমাকে রাজি করানোর দায়িত্বটা তোর!’

আমি চোখে সর্ষেফুল দেখলাম। এই গুরুদায়িত্ব আমি কীভাবে পালন করবো? মিনমিন করে বললাম, ‘বড়মামা…আমি সুরমাকে কীভাবে রাজি করাবো? ও কি আমার কথা শুনবে?’

বড়মামা গম্ভীর গলায় বললো, ‘শুনবে না তো ও কী করবে? এই বয়সী একটা মেয়ে পড়াশুনা না করে বাসায় বসে আছে। মাঝে মাঝে এদিক সেদিকে ঘুরতে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কী করছে কিছুই বুঝতে পারছি না! সেদিন আমার অফিসের এক কলিগ নাকি ওকে এক ছেলের সাথে ঘুরতে দেখেছে। অথচ বাসাতে এই ব্যাপারে কিছুই বলে না। বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছে বলে বের হয়ে যায়। আমার তো ইচ্ছে করছিল বাসায় ফিরে এই বুড়ো মেয়েকে ধরে মারধোর করি! তোর মামী না আটকালে কিছু একটা হয়েই যেত সেদিন।

এরপরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আর এই আপদ আমরা নিজের ঘাড়ে রাখবো না। বিয়েশাদী দিয়ে পার করে দিই। ওর নসিবে সুখ থাকলে হবে…নইলে না!’

আমি চুপ করে থাকলাম। এবারে মামী মুখ খুললো, ‘তুই একটা ডেন্টালে চান্স পাওয়া ছেলের কথা বলছিলি না? খুব নাকি ভালো ছেলে। সুরমা কি এই ছেলের সাথেই ঘুরছে? তুই কিছু জানিস নীরা?’

আমি আমতা আমতা করছি। বড়মামা খ্যাক করে গর্জে উঠলো মামীর ওপরে।

‘সেই খবরে কী কাজ তোমার? যে ছেলে কেবল ভর্তি হয়েছে তার সাথে কি বিয়ে দেওয়া যাবে? ভালো একটা প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এটা নিয়ে কথা বলো। তা না…কার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই খোঁজ নিতে বসলে!’

আমি আর বেশি কথা বাড়ালাম না। যদিও জানি কাজটা অসম্ভব, তবু বড়মামার কাছ থেকে ছেলেটার ছবি নিলাম। সুরমা এই প্রস্তাবের কথা শুনে কী বলবে আমি জানি না। তবু যারা আমাদের জন্য এত করলো, তাদের মুখ চেয়ে একটা কাজ কি করতে পারবো না?

সেদিন রাতের বেলায় বাসায় আরও একটা কাহিনি হলো।

আমরা বাসার ছোটরা খেতে বসেছি। হঠাৎ ছোটমামী তার ঘর থেকে চেঁচামেচি জুড়ে দিলো। ‘হায় হায়! এই ব্যাগেই তো রেখেছিলাম টাকাটা! কই গেল? এতগুলো টাকা? কী সর্বনাশ! কী হবে এখন?’

আওয়াজ শুনে ছোটমামা তাদের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো, ‘কী হয়েছে? এত চেঁচাচ্ছো কেন? টাকা হারাবে কেন? ভালোমত খুঁজে দেখো। হয়ত রাখছো কোথাও, এখন মনে করতে পারছো না!’

‘আমি একশো ভাগ গ্যারান্টি দিচ্ছি টাকাটা এখানেই রেখেছিলাম! হায় হায়! তুমি যে দশহাজার টাকাটা আলাদা করে রেখে দিতে বললে সেটাই গো! কী সর্বনাশ! এই বাসা থেকে টাকাও চুরি হওয়া শুরু হলো!’

‘আহ্‌ চুপ করো! চুরি হবে কেন? আজগুবি না দেখেই যা তা কথা শুরু হয়ে গেল! আস্তেধীরে দেখো!’

আমাদের খাওয়া একরকম মাথায় উঠে গেল। আমার কেমন একটু ভয় ভয়ও করতে লাগলো।

বাসার কিছু খোয়া গেলে বাসার লোক কাজের লোকজনকে সন্দেহ করে। আমরা এই বাসায় উড়ে এসে জুড়ে বসা বাসিন্দা। যদিও নানাবাড়িতে আমাদেরও হক আছে…কিন্তু মূল বাসিন্দা তো এখন মামা-মামীরাই!

আমার মনের মধ্যে কীসের একটা কুডাক যেন ডাকতে লাগলো। বুঝতে পারছি না…তবু কেন যেন কিছুই ভালো লাগছে না!

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত