| 24 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২৫)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

ছোটমামী টাকা হারানোর ব্যাপারটা নিয়ে বহুত ঝামেলা করলো।

একবার হৈ চৈ শুরু করলো যে, পুলিশের কাছে যাবে। এতগুলো টাকা খোয়া যাওয়াটা কিছুতেই মানতে পারছে না ছোটমামী। ছোটমামা তাকে বহুত কষ্টে শান্ত করেছে। কিন্তু মামীর এক কথা, ‘এই বাসা থেকে চুরি হয়ে গেল…আর তুমি বলছো চুপ করে থাকবো? কেন? এর আগে কখনো কি এইরকম হইছে?’

নয়নকে একদিন মনমরা দেখে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে। উত্তরে যা বললো তা শুনে আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল। সুজন নাকি ওকে বলেছে যে, ছোটমামীর ধারণা টাকাটা নয়ন নিয়েছে। আমি শুনে বললাম, ‘তুই জিজ্ঞেস করলি না, তোকে কেন সন্দেহ করছে? আর এই কথা কি মামী নিজের মুখেই বলেছে নাকি সবই সুজনের বানানো কথা?’

নয়ন বললো, ‘ছোটমামী আমাকে মুখে কিছু বলেনি ঠিকই, কিন্তু আমার দিকে কেমন করে যেন তাকায়। মনে হয় কেমন যেন সন্দেহের চোখে!’

আমি বুঝতে পারলাম, সুজনের কথাতে নয়ন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েছে হয়ত। ছোটমামী কেন শুধু শুধু এমন বাজে ধারণা করবেন? নয়ন কেন তার টাকা নিতে যাবে? আমাদের পরিবারে অশান্তি ছিল ঠিকই, কিন্তু তাই বলে চুরি করার প্রয়োজন তো পড়েনি কখনো!

কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো একটা ঘটনাতে। সেদিন ক্লাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। একটু তাড়াহুড়া করছিলাম। চুলে বেনি করার পরে ব্যান্ড খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এদিক সেদিকে চাইছি, এমন সময় দেখি ঘরে ছোটমামী ঢুকছে। সেইদিন সুরমা সকাল সকালই তার জরুরি কাজ করতে বেরিয়েছে। সুনেত্রা গেছে কলেজে। ঘরে তখন আমি ছাড়া আর কেউওই নেই। ছোটমামীকে অসময়ে ঘরে আসতে দেখে খুব অবাক হয়ে গেলাম। মামী অবশ্য কোনোরকম ভনিতা করলো না। সোজাসুজি কাজের কথাতে চলে এলো,

‘এ্যাই যে নীরা…তুমি তো সারাদিন ব্যস্ত থাকো নিজের পড়াশোনা নিয়া। কলেজে চলে যাও। ফিরে আসার পরে তোমাকে একাই পাই না যে, দুই দণ্ড কথা বললো। আজ একটা জরুরি কথা বলতে এলাম। কথাটাকে খারাপ ভাবে নিও না। তুমি যতই ব্যস্ত হও, তোমার কিন্তু একটু নয়নের দিকে লক্ষ রাখা উচিত।’

আমি অবাক চোখে তাকালাম মামীর দিকে। নির্জলা কৌতুহলেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই কথা কেন বলছো ছোটমামী?’

‘বলছি কারণ, তোমার অনুপস্থিতির সুযোগে নয়ন কিছু করে কী না…এসব খবর কি ঠিকঠাকমতো পাও?’

মামীর গলার স্বর খুবই চাঁচাছোলা মনে হলো আমার কাছে। অনেকদিন কেউ আমার সাথে এই ভাষায় কথা বলে না, শুধু সুরমার উলটাপালটা কথাবার্তাটা বাদ দিলে। আমার ভ্রু জোড়া নিজের অজান্তেই কুঁচকে গেল। আমি এতক্ষণে ছোটমামীর কথার সূত্র ধরতে পেরেছি। বললাম, ‘মামী, নয়নের ওপরে আমার এখন পর্যন্ত আস্থা আছে। ও এমন কিছু করছে না, যাতে কারো মাথা নিচু হয়। তুমি কি বলতে চাইছো আরেকটু খোলাখুলি বললে ভালো হয়।’


আরো পড়ুন:  খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২৪)


ছোটমামীর চোখের দৃষ্টি আমার মুখে স্থির এখন। সেই দৃষ্টি একটুও এদিকে ওদিকে না সরিয়ে ছোটমামী বললো, ‘তাহলে তো কোনো কথাই নাই! তুমি যখন নিজের ভাইকে এত বিশ্বাস করো! খোলাখুলি আর কত বলা যায় বলো? আজকে আরেকজনের টাকাতে হাত দিচ্ছে…কাল আরো কী করবে কে জানে! যাই হোক…তোমার সাথে যা কথা হওয়ার হলো। এসব যেন আবার তোমার মামাদেরকে বলতে যেও না!’

আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ঘরে।

ছোটমামী সেই কথাগুলো বলেই আর দেরি করেনি। কখন যেন বেরিয়ে গেছে। আমার অজান্তেই চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগলো। সাড়ে ন’টায় ক্লাস, আমি একসময় ভুলেই গেলাম। মেডিক্যালে ভর্তির পর সেদিনই প্রথম আমি ক্লাস মিস করলাম।

নয়ন বাসায় ছিল না। স্কুলে গিয়েছে। বাসায় থাকলেও আমি ওকে কিছুই জিজ্ঞেস করতাম না। ঠিক করলাম, এই রহস্যের কিনারা আমি নিজেই করবো। এই টাকা কে নিয়েছে কেন নিয়েছে আমাকে সেটা বের করতেই হবে। আমার ছোট ভাইটাকে এভাবে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার উচিত উত্তর আমাকে দিতেই হবে! বাজে ভাবে নয়, কিন্তু মাথা উঁচু করে জানাতে হবে, মামী যা মনে করছে তা ঠিক নয়।

সেদিন আর কলেজেই গেলাম না। বেশকিছু ইম্পোর্টান্ট ক্লাস ছিল। আমি আমলেই আনলাম না। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকলাম। বড়মামী একবার ঘরে এসে আমাকে দেখে অবাক।

‘কীরে নীরা, আজ ক্লাসে যাসনি? শুয়ে আছিস কেন?’

আমি চোখ দুটো খটখটে শুকনো করে মুছে নিলাম খুব সাবধানে, অতি সন্তর্পণে। তারপর হাসিমুখে বললাম, ‘শরীরটা বেশি ভালো লাগছে না মামী। আজ বাসাতেই থাকবো ঠিক করেছি।’

‘ওহ মা! তাহলে কাউকে কিছু বলবি না? দেখি দেখি জ্বর এসেছে নাকি?’

আমি তাড়াতাড়ি নিজেকে আড়াল করে নিয়ে বললাম, ‘না না জ্বর আসেনি মামী। এমনি গা টা একটু ম্যাজ ম্যাজ করছে। কিছু হয়নি আমার। আজকে একটু ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে!’

বড়মামী কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বললো, ‘তুই কি সুরমাকে ছবিটা দেখিয়েছিলি নীরা? ছেলেপক্ষ অলরেডি একবার খোঁজ নিয়ে ফেলেছে! আজ যদি বাসায় থাকিস…তাহলে একবার সুরমার সাথে কথা বলিস!’

সুরমার ব্যাপারটা একেবারেই মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। যেদিন বলবো বলে ঠিক করেছিলাম সেদিনই তো ছোটমামীর টাকা হারালো। এই টাকা নিয়েই হুলুস্থূল শুরু হলো। যাহোক টাকা হারানোর রহস্য আমি পরে উদ্ধার করবো। ছোটমামীর এই অভিযোগ আমার ভেতরে কাঁটার মতো বিঁধে রইলো। কিন্তু সুরমার কাজটা করা দরকার। বড়মামী কেমন অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!

সেদিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। নরম গলায় বললাম, ‘মামী, সুরমা তো তোমাদের মেয়ে! এই সামান্য কথাটা বলতে এত কেন সঙ্কোচ বোধ করছো বল তো আমাকে?’

বড়মামীর মুখটা বিষণ্ন হয়ে এলো। বললো, ‘ওমন মেয়েকে কি কোনো কথা বলা যায়? এই সেদিনও মেয়েটা এইরকম ছিল নারে! কেন যে এমন হয়ে গেল! এখন তো ওর সঙ্গে দুটো ভালো কথাও বলা যায় না। সব কথাতেই কেমন ঝ্যাংটা মেরে ওঠে। তোর বড়মামাকে যে কত কষ্টে সামলে রেখেছি! পারলে মেয়েকে এদ্দিনে ঝাঁটাপেটা করে ভূত ছাড়াতো। কিন্তু এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলে কেলেঙ্কারি করাটা কি ঠিক হবে? তুই একবার বুঝিয়ে বল। বন্ধুর মতো সম্পর্ক তোর সাথে। হয়ত ফিরিয়ে দেবে না তোর কথা!’

বড়মামীকে কীভাবে বোঝাই, সেই বন্ধুর মতো সম্পর্কটা আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে! আর এর পেছনের কারণটাও ভেঙ্গেচুরে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার চেয়ে এই ভালো, পুরনো সবকিছু ভুলে একবার নতুন করে চেষ্টা করে দেখা। কাজ হলে ভালো, না হলে কী আর করা!

সুরমা ফিরলো দুপুরের আগ দিয়ে। পিঠে মোটা একটা ব্যাকপ্যাক ঝোলানো । আজকাল দেখছি মাঝে মাঝেই এরকম মোটা ব্যাগ নিয়ে আসে সুরমা। আবার যখন বের হয় সেটাকে সাথে করে নিয়ে যায়। আমি জানতে চাইনি ভেতরে কী আছে। হয়ত উত্তর পাবো, নোটপত্র আছে। কীসের নোট সেটা একমাত্র আল্লাহই জানে!

সুরমা আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ। ইদানিং সুরমার দৃষ্টিতে কেমন একটা স্পর্ধামাখানো ভাব লক্ষ করি। চলাফেরায় ঔদ্ধত্য। চারপাশের কোনোকিছুকেই যেন পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। সবকিছুই তার সেবা করার জন্যই উন্মুখ থাকবে। সে কাউকে পাত্তা দিবে কী না সেটা তার ব্যাপার।

আমি নিজের গরজেই আগ বাড়িয়ে কথা বললাম। হাসিমুখে বললাম, ‘আজ শরীরটা ভালো লাগছে না। তাই কলেজে গেলাম না!’

সুরমা ভ্রুজোড়াকে নাচিয়ে ‘ওহ আচ্ছা’ ভাব করলো। আমি আবার বললাম, ‘কোথাও গিয়েছিলি?’

‘হুম তাই তো মনে হয়! বাইরে থেকেই তো এলাম! এখন তুইও বাবার মতো জেরা শুরু করে দে, কই গিয়েছিলাম কেন গিয়েছিলাম!’

আমি তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ইয়ে সুরমা…তোকে একটা ছবি দেখাবো। দেখবি?’

সুরমা আচমকা এই প্রস্তাবে অবাক। বললো, ‘কীসের ছবি?’

‘একটা ছেলের ছবি। খুব সুন্দর দেখতে। দেশের বাইরে থাকে। ইঞ্জিনিয়ার, মোটা স্যালারির জব করে!’

‘ওহ আচ্ছা এবারে ঘটকালির ভারটা তাহলে তোকে দেওয়া হয়েছে। মা-বাবাকে বলে দিস, আমি এখন বিয়ে করার মুডে নেই!’

হঠাৎ আগুন উঠে গেল আমার মাথায়। নিজের অজান্তেই গলায় ঝাঁঝ চলে এলো। বললাম, ‘তাহলে কীসের মুডে আছিস এখন? ঘোরাঘুরি আর নষ্টামির মুডে?’

সুরমা স্থির চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।

তারপর আমার গা মাথা বুক সবকিছু জ্বালিয়ে দিয়ে বললো, ‘আমি নষ্টামির মুডেই থাকি আর যেই মুডেই থাকি, তোর পায়ে পাড়া দিয়ে তোর খবরাখবর নিতে যাচ্ছি না। সুমনের জন্য কেন আমার কাছে ওকালতি করতে এসেছিলি, সেই গুপ্ত রহস্যও তো জেনে বসে আছি। দুজনে তো ভালোই ‘মধুর সময়’ কাটাচ্ছিস খবর পেলাম। তোরা ঘোরাঘুরি করলে মধুর সময় কাটানো হয়, আর আমরা ঘুরলে হয় নষ্টামি। তুই একটা ছেলের সাথে ইটিসপিটিস করলে কেউ দেখতেও আসবে না। কারণ তুই হলি ভালো ছাত্রী। দেশের ভবিষ্যত। তোদের নষ্টামিও সোনার অক্ষরে লেখা হয়।

ভালোভাবে বলছি কান খুলে শুনে রাখ। আমার কোনো কাজে খবরদারি করতে আসবি না। ফল ভালো হবে না বলে দিলাম!’

কথাগুলো বলেই সুরমা বাথরুমে ঢুকলো। হাতে নিলো আরেক সেট সালোয়ার কামিজ। সম্ভবত আবার বের হবে। আমার ধারণাই ঠিক হলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ড্রেস পালটে বের হয়ে এলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দশ মিনিট ধরে মুখে ঘষাঘষি চালালো। আজকাল কত রকম মেকআপ সরঞ্জামাদি যে ব্যবহার করছে, আর কত রকম নিত্যনতুন জামাকাপড় পরছে…সেই হিসাব রাখতে যাওয়াও বাতুলতা।

আমার স্বল্প সীমিত আয়ের স্কুলশিক্ষক বড়মামার পক্ষে এই বিলাসিতার খরচ সামলে ওঠা অসম্ভব। তাহলে এই খরচ কে সামলাচ্ছে কে বলতে পারে!

কুড়ি মিনিটের মধ্যে ভোলভাল বদলে ফেলে বাসা থেকে বের হয়ে গেল সুরমা। যাওয়ার আগে মোটা ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিতে ভুললো না। আর ভুললো না আমার দিকে ক্রুর একটা দৃষ্টি হানতে।

আমি নতুন আরেক যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সারাদিন বিছানায় গড়াগড়ি খেলাম।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত