| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২৬)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেল।

জীবনযাত্রাতে খুব বড় কোনো পরিবর্তন এলো না। প্রতিদিন সকালে উঠে মনমরা হয়ে ক্লাসে যাচ্ছি। ক্লাস থেকে ফিরে পড়তে বসছি কিংবা নিজের কোনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকছি। বাসার অন্যরাও যে যার মতো চলছে।

সুরমা আর আমার মুখ দেখাদেখি বলতে গেলে বন্ধ একরকম। সীমা ছাড়িয়ে গেছে সুরমার ঔদ্ধত্য। আর যত দিন যাচ্ছে ওর ব্যস্ততা দৌঁড়াদৌঁড়ি কেমন যেন বেড়েই চলেছে। বড়মামা আর মামী সারাদিন মুখ চুন করে রাখে। বেচারাদের দিকে তাকালে আমারই খারাপ লাগে। সুরমার সাথে আমার কী কী কথা হয়েছে সবকিছুই আমি মামীকে জানিয়ে দিয়েছি। সুরমার ব্যাপারটা হয়ত এখন ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। আর মামা মামী যদি কঠোর অবস্থানে যেতে পারে তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু এত বড় মেয়েকে হাতপা বেঁধে বিয়ে দেওয়াটা কি খুব সহজ কাজ হবে?

আমার ছোটভাই নয়ন ভালো নেই। ওর মুখের দিকে তাকালে আমার বুক ভেঙে যায়। ছোটমামীর নৈবৃত্তিক আচরণ দেখে আরো খারাপ লাগে। কেমন অদ্ভুত চোখে আমাদের দিকে তাকায়, যেন আমরা কত বড় অপরাধী! মাঝে মাঝে আমারও ইচ্ছে করে এই বাড়ি থেকে চলে যাই।

এই এতগুলো বছরে একবারের জন্যও এই ইচ্ছেটা হয়নি। কিন্তু সেদিন ছোটমামীর টাকা হারানো আর তারপরের ঘটনাপ্রবাহের পর থেকেই ইচ্ছে করছে, অন্য কোথাও চলে যেতে। এতদিনের ভালোবাসা আর স্নেহমমতা মাখানো সম্পর্কগুলোর কাছ থেকে যা পাওয়ার ছিল, তার সবই বুঝি পাওয়া হয়ে গেছে আমাদের। এখন ছুটতে হবে ভিন্ন কোনো ভালোবাসার উৎসের সন্ধানে।

তবে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছি, টাকা হারানোর রহস্য আমি উদ্ধার করেই ছাড়বো! এই কাজে আমাকে যতদিন অপেক্ষা করতে হয় করবো।

একদিন একটা ভিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে আমি সেই রহস্যের গিঁট খোলার অনেকটা কাছাকাছি চলে এলাম।

খুলেই বলি ঘটনাটা। সেদিন আমার কলেজের এক বান্ধবীর বাসাতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মেডিক্যালে ভর্তির পরও কলেজের কয়েকজন বান্ধবীর সাথে আমার মেলামেশা ছিল। তাদেরই একজন মিথিলার জন্মদিন উপলক্ষে আমরা আরো কয়েকজন বান্ধবী একত্র হয়েছিলাম। খাওয়াদাওয়া শেষে আমরা আড্ডা বসিয়েছিলাম মিথিলাদের বাসার ছাদে।

বান্ধবীদের মধ্যে অবন্তি ভালো গান জানে। সবাই মিলে অনুরোধ করলাম গান শোনাতে। অবন্তিও ভাব না দেখিয়ে শুরু করে দিলো। কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারলো না। আচমকা পাশের ছাদ থেকে একটা হৈ চৈ শোনা গেল। কয়েকজন ছেলেছোকরার আজেবাজে খিস্তি ভেসে এলো। আমরা বিরক্ত মুখে সেদিকে তাকিয়ে মিথিলাকে বললাম, ‘এই কীরে! এরা কারা? এভাবে চেঁচাচ্ছে কেন?’

মিথিলা সেদিকে তাকিয়ে ততোধিক বিরক্ত মুখে বললো, ‘উফ! আবার শুরু করেছে! সরে আয় তো ওদিক থেকে। এই শুরু হয়েছে নতুন জ্বালা! প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি পিচ্চি পিচ্চি কয়েকটা ছেলে ঐ বাড়ির ছাদে বসে কীসব যেন খায় আর নানারকম খিস্তিবাজি করে।’

আমি বললাম, ‘কী সব খায় মানে? কী খায়? দেখে তো স্কুলের পোলাপান মনে হচ্ছে!’

‘স্কুলেরই তো! নাইন কী টেনে পড়ে একেকজন। বাপ-মা খোঁজখবর নেয় না। পড়াশুনার নাম করে এখানে বসে এসব খাচ্ছে! আর বুঝিসনা? কী আবার খাবে? ড্রাগ নেয় সম্ভবত। একসাথে গোল হয়ে বসে মাটিতে ঝুঁকে কিছু একটা টানে তারপরে সিগারেটের মতো করে ফুকতে থাকে।’

‘ওহ বাবা! তুই এতকিছু খেয়াল করেছিস?’

‘করবো না? নাকের ডগাতেই তো ঘটে চলেছে! আর নিত্যদিনের কেচ্ছা হয়ে দাড়িয়েছে এখন! ভাবছি বিষয়টা কাউকে জানাবো। মুরুব্বিগোছের কাউকে। পাড়ার একটা মান সম্মান আছে। তাছাড়া এইসব ছেলেগুলোর ভবিষ্যতও তো একেবারে ঝুরঝুরে হয়ে যাচ্ছে!’

বিষয়টা চিন্তা করার মতোই। আর সচেতন নাগরিক হিসেবে সবকিছু দেখেশুনে এভাবে চুপ করে বসে থাকাটাও উচিত না!

অবন্তি গান থামিয়ে আমাদের আলোচনা শুনছিল। আমরা থামতেই বললো, ‘আমার ছোটভাই জেলাস্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। ও সেদিন একটা কথা বললো শুনে তো মা-বাবা খুব চিন্তা করছিল! ওদের ক্লাসের টিফিন পিরিয়ডে নাকি কয়েকজন বড়ভাই গোছের ছেলে স্কুলের ভেতরে ঢোকে। একটু উঁচু ক্লাসের ছেলেদের সাথে ভাব জমায়ে গল্পগুজব করে। ওরা নাকি কারো কারো কাছে কী সব জিনিস বিক্রি করে!’

‘বিক্রি করে মানে?’ আমরা সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম। আমাদের মধ্যেও অদ্ভুত উত্তেজনা ঢুকে পড়েছে। কেস তো ভালো ঠেকছে না!


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২৫)


অবন্তি বললো, ‘আরে হ্যাঁ…আমার ভাইটা তো এখনো ছোটমানুষ! সেভাবে বলতে পারছিল না। যেটুকু বললো তাতে বুঝতে পারলাম, এই ছেলেগুলো বড় ক্লাসের ছেলেদেরকে কিছু একটা ফ্রিতে টেস্ট করতে দেয়। তারপর বলে ভালো লাগলে আরো আছে। কিছু টাকা দিলেই ওদেরকে সাপ্লাই দিতে পারবে!’

‘কী সর্বনাশ!’ আমার মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল, নয়নের সেদিনের কথাগুলো। ছাদে সুজন আর তার বন্ধু নয়নকে কিছু একটা নিতে জোর করছিল। কিন্তু জিনিসটা যদি ফ্রি না হবে তাহলে ওরা নয়নকে জোর করবে কেন? মাথার মধ্যে কেমন যেন গুলিয়ে গেল সবকিছু। বিপদের গন্ধ টের পেলাম। পার্ট ফার্টি সব মাথায় উঠলো।

মাথা ধরার অযুহাতে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এলাম।

বাসায় ফিরেই নয়নের খোঁজ করলাম। নয়ন বাসাতেই ছিল। নিজের ঘরে বসে মন দিয়ে অংক করছিল। আমিও আজকে খুব মন দিয়ে নয়নের প্রতিটা হাবভাব ভালোমত বোঝার চেষ্টা করছিলাম। নয়ন আমাকে যা বোঝাচ্ছে, তা শতভাগ ঠিক তো? নাকি ছোটমামীই ঠিক প্রমাণিত হয়ে মনে মনে হাসবে। আর আমি হেরে যাবো নয়নের মিথ্যার কাছে!

আমার চোখের তীক্ষ্ণভাব নয়নের নজর এড়ালো না। অবাক মুখে বললো, ‘কী হয়েছেরে আপা? তুই এভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিস কেন?’

আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। তবু সাবধানের মার নেই। নয়নকে ডেকে ছাদে নিয়ে গেলাম। এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে গেলাম, কেউ আমাদের লক্ষ করছে কী না। আমার ব্যাপারস্যাপার নয়নের কাছে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিলো। আসতে আসতেই আরো দুইবার জিজ্ঞেস করেছে, ‘কী হয়েছে বল না! এমন করছিস কেন?’

আমি ছাদে গিয়ে একেবারে মুখ খুললাম। নয়নকে আগে শপথবাক্য পড়িয়ে নিলাম যাতে একটাও মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা না করে। যদি আজকে মিথ্যা বলে তাহলে চিরদিনের জন্য আমাকে হারাবে, এই ভয়টাও ভালোমত ঢুকিয়ে দিলাম ওর মাথায়। নয়ন এবারে কাঁদো কাঁদো মুখে বললো, ‘তুই আগে আমাকে বল কে কী বলেছে তোর কাছে? কেউ আমার নামে নালিশ করেছে আবার… তাই না?’

আমি বুঝতে পারলাম সাসপেন্সের মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গেছে। তাই এবারে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘নাহ! কেউ নালিশ করেনি। তবে তোর সত্যি কথাটা বলা খুব জরুরি। যা কিছুই হোক, কিছুতেই আমার কাছে মিথ্যা বলতে পারবি না। তুই যদি আজ একটা অন্যায় কাজও করিস, তবুও সত্যিটা বললে আমি হয়ত তোকে বাঁচাতে পারবো। আর মিথ্যা বললে শুধু আমি কেন…কেউই তোকে বাঁচাতে পারবে না!’

নয়ন অস্বাভাবিক জোরের সাথে বললো, ‘আমি কখনোই তোর কাছে মিথ্যা কথা বলিনি। এবারে বল কী হয়েছে!’

‘তোদের স্কুলে কি বাইরের ছেলেপেলে এসে কিছু দিয়ে যায়? মানে তোদেরকে কিছু খেতেটেতে দেয়? অথবা টাকা দিয়ে কিনতে বলে…এমন কিছু?’

নয়ন খুব বেশিক্ষণ চিন্তা করলো না। প্রায় সাথে সাথেই বললো, ‘হ্যাঁ আপা। প্রায়ই কেউ না কেউ আসে এরকম। আমি ওদের সাথে কথা বলিনি কখনো। দূর থেকে দেখেছি। কথাটথা বলে চলে যায়। একবার আমাদের ক্লাসের রনি নামে একটা ছেলে বলছিল, ওকে নাকি গোলাপী রঙের একটা ট্যাবলেট দিয়ে বলেছে ওটা খেলে পড়ালেখায় মনোযোগ বাড়ে। পড়া মনে থাকে। পরীক্ষায় ভালো করা যায়। ওরা নাকি এসব ট্যাবলেট বিক্রি করে। খাওয়ার পরে ভালো লাগলে আরো দিবে। কিন্তু তখন দাম দিতে হবে।’

নয়ন একটানা কথাগুলো বলে গেল। আমি হতবাক হয়ে শুনছিলাম। ও থামতেই বললাম, ‘আর রনি কী করেছিল? খেয়েছিল সেই গোলাপী ট্যাবলেট?’

‘তা তো জানি না আপা! গত পরশুদিনেরই ঘটনা। আজকে জিজ্ঞেস করিনি। ও আচ্ছা, আজকে তো রনি স্কুলেই আসেনি! কাল এলে জিজ্ঞেস করবো।’

মনে মনে বললাম, ‘আর এসেছে কাল!’ মুখে বললাম, ‘সুজন আর ওর এক বন্ধু তোকে কী নাকি দিচ্ছিলো খেতে। কী সেটা?’

নয়ন মাথা নিচু করে বললো, ‘সিগারেটের ভেতরের তামাক বের করে ওরা কী যেন ঢুকায়ে নেয়। সেটা খায়। ঐদিন আমাকে জোর করে খেতে বলছিল।’

আমি গা ঝাড়া দিয়ে বললাম, ‘সুজন বাসায় ফেরেনি এখনো? ওর না দুইমাস পরেই পরীক্ষা!’

নয়ন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, ‘এখন মাঝে মাঝেই অনেক দেরি করে বাসায় আসে। কী জানি কোথায় যায়! আগে সামনের মাঠে ফুটবল খেলতো। এখন আর খেলে না। জিজ্ঞেস করলে বলে, পরীক্ষা তো তাই বন্ধুরা মিলে একসাথে পড়াশুনা প্রিপারেশন এসব নিয়ে কথা বলে। তাই বাসায় ফিরতে দেরি হয়।’

‘ছোটমামা আর মামী এসব জানে?’

‘কী জানি…আমি বলতে পারবো না। তবে সেদিন বড়মামা সুজনের কথা জিজ্ঞেস করছিল। বলছিল এত দেরি করে পড়তে বসে কেন? কোথায় গিয়েছে এখনো ফিরছে না কেন…কিছু বলে গিয়েছে নাকি, এই তো এইসব।’

‘হুম! আচ্ছা ঠিক আছে। তুই কাউকে কিছু বলতে যাস না। যা বলার কিংবা যা করার আমিই করবো। তুই শুধু মন দিয়ে একটা কথা শুনে রাখ। কেউ কিছু খেতে বললে ভুলেও খাবি না। পড়াশুনায় মনোযোগ বাড়বে…হেনতেন যা বলে বলুক কিচ্ছু শুনবি না। সব ফালতু কথা! ঔষধ খেয়ে পড়াশুনায় মনোযোগ বাড়লে সবাই শুধু ঔষধই খেতো বুঝলি?’

নয়ন শক্তভাবে বললো, ‘আমাকে কি বোকা মনে করেছো? আমি ওসব কথা জীবনেও শুনবো না!’

‘হুম…যা নিচে যা। ঘরে গিয়ে পড়তে বস। আমি একটু পরে আসছি।’

নয়ন ধুপধাপ পা ফেলে নিচে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে দুটো সিদ্ধান্ত নিলাম। এক, নয়নদের স্কুলের হেডমাস্টারের সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু সেটা করতে হবে বড়মামার মাধ্যমে। আর দুই, সুজনের ব্যাপারে কড়া নজরদারি করতে হবে। সুজন কোথায় যায়, কাদের সাথে মিশে…এইসব। আমার মোটামুটি বোঝা হয়ে গেছে, সুজন বন্ধুদের সাথে মিলে ড্রাগ নিচ্ছে।

আর এই ড্রাগের খরচ ওঠাতে গিয়ে কোথায় হাত দিচ্ছে কিছুই হুঁশ পাচ্ছে না। ছোটমামীর টাকা কোথায় হাপিস হয়ে গেছে এটা জানা যাবে, সুজনের ব্যাপারটা ভালোভাবে নিশ্চিত হওয়ার পর। হাওয়ায় ছড়ি ঘুড়ায়ে তো লাভ নেই! যা করার হাতেনাতেই করতে হবে!

নিচে নেমেই একটা শোরগোল শুনতে পেলাম। দেখলাম, বড়মামা ছোটমামা আর আমার দুই মামী জোরে জোরে কী যেন বলছে। কে বলছে কে শুনছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে ভয়ানক কিছু একটা হয়েছে এটা বেশ বুঝতে পারছি। বড়মামীকে এক পর্যায়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে দেখলাম। বড়মামার বকাবকি কানে ভেসে আসছে।

আমি দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই বড়মামী বললো, ‘নীরা…শুনেছিস? আমাদের কী সর্বনাশ হয়ে গেল রে মা! সুরমাকে নাকি কোন এক হোটেল থেকে পুলিশ ধরেছে। ওর ব্যাগে নাকি কী বলছে শোন…ওর ব্যাগে নাকি ইয়াবা ট্যাবলেট ছিল। এসব কী বলছেরে মা…’

আমার পা দুটো মেঝেতে কে যেন পেরেক দিয়ে গেঁথে দিলো। কিছুতেই আর এক ধাপও এগুতে পারলাম না!

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত