Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya separation-last-part

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২৭)

Reading Time: 5 minutes

‘ওহ নীরা…কিছু করতে পারবি মা? তোর মামা তো পুলিশের কাছে যাবে না বলছে! আমার মেয়েটা একা একা পুলিশ কাস্টডিতে থাকবে?’ বড়মামীর আহাজারিটা ভেসে এলো যেন অনেক দূর থেকে।

‘আহ্‌! তোমার মেয়ে কুকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে! বুঝুক এখন কেমন মজা! এতদিন তো খুব হাতিঘোড়া মেরে বেড়াত! ধরাকে সরা জ্ঞান করতো উঠতে বসতে! এখন একটু দুনিয়ার আসল দর বুঝতে দাও! এর মধ্যে কেন শুধু শুধু নীরাকে টানছো? নীরা কী করবে এখানে?’

আমি বড়মামার দিকে তাকালাম। কী কঠিন দৃষ্টি বড়মামার চোখে! ছোটমামাকেও কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। নরমশরম ছোটমামা নিজের দায়িত্ব বুঝে উঠতে পারছে না। একবার ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার ভাবীর দিকে। আমাকে দেখতে পেয়ে যেন হালে পানি পেলো। ধড়ফড় করে বললো, ‘নীরা…তোর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কারো বাবা কি পুলিশে আছে?

আমি একটু একটু করে সম্বিত ফিরে পাচ্ছি এখন।

ঘটনা পরবর্তী ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াতেই কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম! তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘হ্যাঁ মামা, আমার বান্ধবী সুক্তির বাবা পুলিশ। কোন পোস্টে যেন আছে…দাঁড়াও আমি ফোন করে জিজ্ঞেস করছি!’

বড়মামার হুঙ্কার শুনতে পেলাম সঙ্গে সঙ্গেই। ‘কাউকে ফোন করার দরকার নাই! মান-ইজ্জত ধুলাবালিতে লুটালুটি খাচ্ছে আর উনি যাচ্ছেন সেটাকে জনে জনে বিলি করতে! ফোন করে কী বলবি? আমার মামাতো বোনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে…আংকেল কিছু করুন… লজ্জা লাগে না…’

বড়মামার মুখ থেকে দুনিয়ার হাবিজাবি অকথা কুকথা বেরিয়ে আসতে লাগলো স্রোতধারার মতো। নানী নামাজ পরছিল। চিল্লাচিল্লি শুনে ধড়মড় করতে করতে উঠে এসেছে। এসেই ‘কী হইছে…তোরা এত চেঁচামেচি করিস ক্যান…’ বলে দাঁড়িয়ে গেল সবার মধ্যে। দুই মামাই একেবারে পাংশুটে হয়ে গেল সাথে সাথে। ছোটমামা নানীকে ধরে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘আরে! তুমি উঠে এসেছো কেন? তেমন কিছু না!’

নানী এক ঝটকায় ছোটমামার হাত সরাতে সরাতে বললো, ’তেমন কিছু না, তাইলে তোরা এমন চিল্লাপাল্লা করিস ক্যান? কী হইছে আমারে বল? কী আবার হবে! এই বাসায় এখন সুরমা ছাড়া আর কার সুকীর্তি নিয়ে আলাপ আলোচনা হবে? তোরা কী মনে করিস আমি আন্ধারে থাকি? কিছুই বুঝি না? কী হইছে খুলে বল! সুরমা কী করছে এইবার?’

দুই মামাই কাঁচুমাচু মুখে এদিক ওদিকে চাইতে লাগলো। জীবনে এতটা অসহায় তাদের কখনো দেখছি বলে মনে পড়ে না।

তাদেরকে অবশ্য কিছু বলার দায় থেকে বড়মামীই রেহাই দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘মা…সুরমাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে! ওর কাছে নাকি ইয়াবা পাওয়া গেছে! কী বলছে এসব মা? আমার মেয়ে এমন কাজ কীভাবে করবে? করলে আমরা কিছু বুঝবো না? আপনেই বলেন মা!’

সবাই নানীকে নিয়ে চিন্তায় ছিল। হয়ত এই কথা শুনে নানী অসুস্থ হয়ে পড়বে। কিন্তু আমার নানী অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি সবকিছু খুব ঠান্ডা মাথায় শুনলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, ‘বউমা, কান্নাকাটি বন্ধ করো। এইটা কান্নাকাটি করার সময় না। যখন সময় ছিল, তখন চুপ করে বসে ছিলা। আর এখন লাফালাফি করে কী হবে? আমরা একটা কথা বলি না? সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। সময় থাকতে মেয়েরে শাসন করোনি। গালে থাপ্পড় দিয়া দাঁত ফালাইয়া দাওনি। আমি বুড়া মানুষ। চুপ করে এইসব নকশা খালি দেখে গেছি। আমার কথা যদি তোমাদের পছন্দ না হয়! তখন তো বলবা যে, মা আমাদের সুখের সংসারে আগুন জ্বালাইয়া দিলো! তবু নিজের নাতিন… চোখের সামনে দিনকে দিন মেয়েটারে শেষ হইতে দেখলাম! কিন্তু কিছু করতে পারলাম না!’

রাগারাগি তর্জন গর্জন শেষে হুট করেই পরিবেশটা কেমন যেন ভারি হয়ে গেল। বড়মামী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদেই চলেছে তখন থেকে। দুই মামা আমসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। একমাত্র ছোটমামীকেই একটু নিস্পৃহ মনে হচ্ছে। যেন এসবের খুব বেশি গভীরে তার না ঢুকলেও চলবে।

বিপদ কার কখন কোন দিক দিয়ে আসে কে বলতে পারে! আজ ছোটমামী উদাসীনতা দেখাচ্ছে। তার নিজের ছেলে ওদিকে কী করছে সেই খবর কী না রাখতে হচ্ছে আমাকে!

আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। বকা খেলে খাবো, তবু কিছু একটা করতে হবে! এভাবে হাত-পা গুটিয়ে কি বসে থাকা যাবে? ছোটমামার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ছোটমামা, আমি পুলিশ স্টেশনে যাবো। তুমি কি যাবা আমার সাথে?’

ছোটমামা কিছু বলার আগেই বড়মামা আবার খেঁকিয়ে উঠলো, ‘এ্যাই নীরা, খুব বাড় হয়েছে তাই না? তুই কোত্থাও যাবি না। আমি আর বাবু যাচ্ছি। তোরা বাসায় থাক।’

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। জানতাম বড়মামা বেশিক্ষণ রাগ করে থাকবে না। একেই বলে নিজের সন্তান। সন্তান হাজার ভুলত্রুটি করুক, তাকে শেষপর্যন্ত ক্ষমা করে দেওয়াই মা-বাবার নিয়তি।

দুই মামা পুলিশস্টেশনে চলে গেল। আমরা সারা বিকেল আর সন্ধ্যা মুখ চুন করে ড্রইংরুমে বসে থাকলাম।

বড়মামী ফোন করার জন্য বার বার মোবাইলটাকে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। আমি এটা সেটা বলে মামীকে থামালাম। এখন কিছুতেই মামাদেরকে ফোন করে বিরক্ত করা যাবে না। আর বড়মামার মেজাজ যেরকম হয়ে আছে! এখন বিরক্ত হলে সবার কপালে দুর্ভোগ আছে!

সন্ধ্যার পরে মামারা বাসায় ফিরে এলো।

দুজনের মুখই গম্ভীর। বড়মামী ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হলো তোমরা একা এসেছ কেন? আমার সুরমা কই? ওকে নিয়ে আসোনি?’

বড়মামা চুপ করে থাকলো। ছোটমামা অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর মুখে বললো, ‘সুরমাকে হাজতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওর কাছ থেকে দশটা ইয়াবা পাওয়া গেছে। বলেছে উকিল ঠিক করে কথা বলতে। জামিন হবে কী না সেটা পরের ব্যাপার!’

‘ওহ আল্লাহগো! এসব কী বলছো তোমরা? আমার মেয়েটাকে হাজতে রেখে চলে আসলা? ওখানে থাকতে পারলা না তোমরা? আমার মেয়েটা সেখানে একা একা কীভাবে থাকবে? এ কী খবর দিলা! এই খবর নিয়ে আসলা! একটা সামান্য কাজও করতে পারলা না?’

আমি ভয়ে ভয়ে বড়মামার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। বড়মামীর আহাজারি বাড়তেই বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা ঝড় উঠতে যাচ্ছে। সেই ঝড় ঠেকানোর আর বুঝি কোনো উপায়ই নেই!

হলোও তাই! বড়মামা একেবারে বাঘের মতো গর্জে উঠলো, ‘এ্যাহ! হাজতে কীভাবে থাকবে! তোমার মেয়ে হাজতে থাকার জন্যই জন্মেছে! সেটাই ওর উপযুক্ত জায়গা! ন্যাকামি করতে আসবা না বলে দিলাম!’

বড়মামী চুপ। তবু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নাটা কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। বড়মামা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললো, ‘দিনের পর দিন মেয়েটা কী করতো একবার খোঁজ করেছো? আজ এসেছো মাছের মায়ের পুত্রশোক দেখাতে! …’


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২৬)


বড়মামার কথা শেষ হওয়ার আগেই এবারে বড়মামী ফুঁসে উঠলো।

‘একবার চুলার পাড়টা সামলে দেখেছো কেমন লাগে? দিন নাই রাত নাই শীত নাই গ্রীষ্ম নাই… বাসার প্রতিটা মানুষের উদরপূর্তি করতে করতেই দিন যায়। একেকজনের আবার একেকরকমের ফরমায়েশ! আজ মাছের কোপ্তা খাবো…বিরিয়ানি খাবো… এসব সামলাবো নাকি তোমার সোমত্ত মেয়ে দিনরাত কী করছে কোথায় যাচ্ছে সেসব দেখবো? কেন তুমিও তো ওর বাবা! তুমি দেখতে পারোনি? তোমার দায়িত্ব ছিল না? খালি তর্জন গর্জন করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? নাকি তাতে নিজের দায়দায়িত্ব আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায়?…’

বড়মামীও তুমুল বেগে গজরাতে লাগলো। আজ দু’পক্ষই কেউ কাউকে ছাড়বে না মনে হচ্ছে! আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। নয়ন আর সুনেত্রা দেখি এক ফাঁকে পড়া থেকে উঠে এসেছে। এই প্রচণ্ড ঝড় ঝাপ্টাতে কী আর পড়াশুনা করবে? আমি আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম, সুজন এখনো ফেরেনি। ছোটমামা আর ছোটমামীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নেই! আজ এই ঝগড়া ঝাঁটিতে নিজেদের দর্শক ভাবতে হয়ত খুব নিরাপদ বোধ হচ্ছে। কাল যখন নিজেদেরকেই এতে অংশ নিতে হবে, তখন নিশ্চয়ই এত নিরাপদ লাগবে না!

নয়নের মুখচোখে ভীতির ছাপ স্পষ্ট। বহুদিন পরে আমার বাবার বাসার সেই দুর্বিষহ দিনগুলো মনে পড়ে গেল। সুখের স্বর্গ এক নিমেষেই কেমন ভয়ানক নরকে পালটে যায়! শুধু কিছু মানুষের দায়িত্ব আর বিবেকবোধের অভাবে সকলকেই কেমন চড়ামূল্য চুকাতে হয়!

নানী এই পর্যায়ে হস্তক্ষেপ করলো। বড়মামীকে ‘বউমা একটু শান্ত হও মা…’ এসব বলে থামিয়ে বড়মামাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ক্যান পুলিশ কী কইছে…ক্যান ওরে হাজতে থাকতে হবে…খুলে বলিস না ক্যান?’

‘কী শুনবা মা? বলার মতো কী আছে যে আমি বলবো! পুলিশ বলছেসুরমা নাকি ড্রাগ সাপ্লায়িং এর কাজ করতো। নানারকম জায়গায় ড্রাগ পৌঁছে দিত তোমার গুণধর নাতিন। পুলিশ ইনফর্মারের সাহায্য নিয়ে সুরমার গতিবিধির দিকে লক্ষ রাখছিল। আজকে সে একবারে নাকি দশকেজি ইয়াবা নিয়ে আমাদের এই শহরেরই এক নামী হোটেলে গিয়েছিল। সেখানে কার নাকি আসার কথা ছিল। সুরমা অপেক্ষা করছিল। পরে সেই লোক আর আসেনি। পুলিশ হাতেনাতে ধরেছে সুরমাকে। কিন্তু অন্যদেরকে এখনো ধরতে পারেনি। কার কথামত সে এসব কাজ করতো এখন তাদেরকে ধরার জন্য সুরমাকে তারা কিছুতেই ছাড়বে না!

বুঝতে পারছো? দেখো কত গর্বিত বাবা আমি! আজ মেয়ের গর্বে আমার বুক দশহাত ফুলে উঠেছে! আমার চেয়ে গর্বিত পিতা আজ আর কে? হা হা…’

মানসিক বিপর্যস্ত মানুষের মতো হা হা করে হাসতে লাগলো বড়মামা। আমরা সবাই শঙ্কিত চোখে মামাকে দেখতে লাগলাম। নানী এসে বড়মামার হাত ধরে বললো, ‘ও পল্টু…একটু শান্ত হ বাবা! বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। মেয়েটা বিপদে পড়েছে। কুকর্ম করেই বিপদে পড়েছে। কিন্তু আমরা ওর পরিবারের লোকজন যদি ওকে দোষ দিয়েই সরে পড়ি, তাহলে এই বিপদে ও কী করবে? কার কাছে যাবে?’

বড়মামা চুপ করে বসে থাকলো। অন্যরাও এখন চুপচাপ। কারো মুখেই কথা সরছে না। এই পরিস্থিতিতে কী বলা দরকার… কারো মাথাতেই আসছে না!

আমি চিন্তা করে চলেছি। কিছু একটা করা প্রয়োজন। সুমন বেশ কিছুদিন আগেই আমাকে এই ব্যাপারে একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, সুরমা যার সাথে ঘুরছে সেই বিপ্লব ড্রাগ ব্যবসার সাথে জড়িত। তাহলে বিপ্লবকে যদি পুলিশ ধরতে পারে, তাহলেই অন্য পালের গোদাদেরও ধরে ফেলা সম্ভব!

আমি কি তাহলে বিপ্লবের নামটা পুলিশের কাছে বলে দিব? তাতে হয়ত সুরমাকে ছাড়িয়ে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু তার আগে একবার সুমনের সাথে কথা বলে নেওয়া দরকার। মামাদের আগেই কিছু বলা উচিত হবে না। মাথা গরম হয়ে আছে সবার। এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, কী বলা উচিত…কোথায় থামা উচিত কিছুই তারা বুঝতে পারবে না।

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>