| 28 মার্চ 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২৮)

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

অন্যরকম একটা রাত শেষে দিন হলো আবার।

সারারাত কেউ এক ফোঁটা ঘুমাতে পারলো কী না সন্দেহ। নানারকম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর আলাপ পরামর্শের ভেতর দিয়েই বিভীষিকাময় রাতের যবনিকাপাত ঘটলো।

পরদিন সকালে উঠেই আমি কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। সুনেত্রা দেখি তখনও বিছানা ছাড়েনি। ঘুমাচ্ছে না। এক মনে তাকিয়ে আছে সিলিঙয়ের ফ্যানটার দিকে। আমার হঠাৎ কেমন একটু ভয় ভয় করলো। কম কথা বলা মানুষগুলো অন্যরকম হয়। অনেক অভিমান আর অব্যক্ত কথা জমিয়ে রাখে মনের ভেতরে। সেই সব অভিমানের বিস্ফোরণে কখন কী অগ্নুৎপাত ঘটে কে জানে!

আমি হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুনেত্রা, আজ কলেজে যাবি না? এখনো শুয়ে আছিস যে!’

সুনেত্রা ওপরের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো, ‘ইচ্ছে করছে না নীরাপা। আমাদের আর পড়াশুনা করে কী হবে? এখন থেকে তো সবাই ইয়াবা সাপ্লায়ারের বোন বলে আমাকে ডাকবে… তাই না?’

আমি চমকে উঠলাম। চমকে ওঠার কারণ কয়েকটা। প্রথম কারণ হলো, সুনেত্রা একসাথে অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছে যা সে সচরাচর করে না। অর্থাৎ ওর মনের গতিপ্রকৃতি আজ স্বাভাবিক নেই। অবশ্য স্বাভাবিক থাকবে এটা আশাও করা যায় না। বোনকে পুলিশ ধরে হাজতে রেখেছে। বাসায় অস্থির আবহাওয়া। এমন অবস্থায় কে বা স্বাভাবিক থাকতে পারে!

এছাড়াও যে কারণে চমকে উঠলাম তা হলো, সুনেত্রা সিলিঙয়ের দিক থেকে চোখ সরাচ্ছে না। নিবিষ্টমনে কী যেন দেখছে সেখানে। ওর মনে আজেবাজে কিছু ঘুরছে না তো? আমার ভেতরটা কেমন শিরশির করে উঠলো! একজনের পাপের দায় কতজন মানুষকেই না বহন করতে হয়! অধ্যবসায়ী পরিশ্রমী মেয়েটা আজ কেমন হতাশার কথা বলছে! যেন জগত সংসারের ওপর থেকে এখনই সব আশাভরসা হারিয়ে ফেলেছে। আমি কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলালাম। কপালে হাত দিয়েই চমকে উঠলাম। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।

তাড়াতাড়ি বললাম, ‘ওমা এ কীরে সুনেত্রা! তোর তো গায়ে ভীষণ জ্বর! এত জ্বর নিয়ে তুই চুপ করে আছিস? শিগগির নাস্তা খেয়ে একটা প্যারাসিটামল খা!’

সুনেত্রা গা করলো না। যেন আমার কথা ওর কানেই ঢোকেনি! পরিস্থিতি ভালো ঠেকলো না। আমি বড়মামীকে ওর জ্বরের কথাটা বলতে গেলাম। তাছাড়া সুনেত্রার পাশে এখন কারো থাকা দরকার। এই মানসিক অবস্থায় ওকে একা রাখা কিছুতেই উচিত হবে না।

বড়মামী রান্নাঘরে মোড়া পেতে বসে আছে। এক হাতে আটার ময়ান। সেটাকে আনমনে টিপতে টিপতে আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে চলেছে। ছোটমামী চুলাতে কী একটা নাড়াচাড়া করছে। চোখমুখ গম্ভীর। অন্যদিন নানী তেমন একটা রান্নাঘরে আসে না। আজ দেখি নানীও তরকারি কুটছে।

বড়মামীকে উদ্দেশ্য করে এটা সেটা বলে চলেছে নানী, ‘বিপদে ধৈর্য ধরতে হয় মা। আমরা যে একটা জীবন পার করে দিছিরে মা…আমাদের কি কোনো ঝামেলা ছিল না? তোমাদের তো এখন কতদিক দিয়ে কত রকম সুযোগ সুবিধা আছে! আমাদের যুগে তো এতসব কিছু ছিল না। হাতে টাকা পয়সাও ছিল না। তবু মাথা ঠান্ডা করে যদি না চলতাম, ছেলেদুটাকে কি মানুষ করতে পারতাম? আমার কপালেও তো একটা কুলক্ষী জুটেছিল! তার জ্বালায় এখনো ভেতরে ভেতরে জ্বলছি…’


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২৭)


হঠাৎ আমার দিকে চোখ পড়তেই নানী নিজের কথা থামিয়ে দিলো। আমি কিছু বললাম না। আমার মায়ের জীবনের সেই পুরনো কাসুন্দির ঝাঁঝালো গন্ধ আর কতদিন শুঁকে যেতে হবে কে জানে! এখন আর গায়ে মাখি না ওসব। তবু বাতাসে নাক খুলে রাখলে এখনো সেই গন্ধের রেশ কাটাতে পারি না।

বড়মামী আমাকে দেখেই আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওহ মা নীরা, তুই একবার যাবি মা? তোর মামারা হয়ত কিছু বুঝতে পারছে না। ছাত্র চড়ে বেড়াইছে সারাজীবন। কার কাছে বলতে হয়…কী করতে হয় কিছু জানে না। তুই তোর বান্ধবীর বাবাকে একবার বলে যদি জামিনের ব্যবস্থাটা করাতে পারতি…’

আমি করুণ চোখে বড়মামীর দিকে তাকালাম। একেবারেই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে বড়মামীকে। দেখাবেই না বা কেন? এই বয়সের একটা মেয়ে গতকাল সারারাত হাজতে থাকলো। জেলখানাকে নিয়ে কতরকম কথা শোনা যায়! মেয়েরা এখন কোথায় নিরাপদ? চিন্তা করলে আমি নিজেই অস্থির হয়ে যাচ্ছি মাঝে মাঝে! সুরমা এ কোন বিপদে পড়লো আল্লাহ মালুম! কতদিনে উদ্ধার পাবে কে বলতে পারে!

ছোটমামী আমাকে আপদমস্তক দেখে নিয়ে বললো, ‘তুমি কি আজকেও কলেজে যাচ্ছো? বাসায় এত বড় একটা বিপদ! আজকেও তোমাকে কলেজে যেতে হবে?’

কথাগুলো খচ করে বিঁধলো যেন। ছোটমামীর ভেতরে দশহাজার টাকার শোক তুষের আগুনের মতো জ্বলছে এখনো, বেশ বুঝতে পারছি। ভেতরে ভেতরে আমাদের দুই ভাইবোনকে উনি সহ্য করতে পারছেন না। একেকসময় ইচ্ছে করছে সুজনের কথাটা বলে দিই। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হয়, এখনো সময় আসেনি।

আমি নিরাসক্ত কঠিন মুখেই জবাব দিলাম, ‘ক্লাস বাদ দিব কেন ছোটমামী? আর তাছাড়া সুরমার ব্যাপারে কিছু করতে হবে তো! বাসায় বসে থাকলে কী করতে পারবো?’

অনেকগুলো বাক্যই একসাথে বলে ফেললাম আজকে। আমি কখনোই এই বাসার কারো মুখের ওপরে এত কথা বলিনি। তিনজনই আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকালো।

বড়মামীর চোখে একটু যেন আশার ঝিলিক দেখতে পেলাম। মুখে খুশির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো, ‘তুই কিছু করতে পারবি নীরা? দ্যাখ না মা! তোর মামাদের ওপরে আমি ভরসা করতে পারছি না!’

আমি বললাম, ‘দেখছি মামী। তুমি প্লিজ একটু সুনেত্রাকে দেখো। ওর গায়ে বেশ জ্বর। দুশ্চিন্তা রাতজাগা…সবমিলিয়ে জ্বর এসে পড়েছে। আর মামী…সুনেত্রাকে একা রেখো না।’

বড়মামী জিজ্ঞাসু মুখে তাকাতেই আমি বললাম, ‘সুনেত্রার ভাবভঙ্গি ভালো ঠেকছে না আমার। যারা নিজেদেরকে প্রকাশ করতে পারে না, তাদের আবেগ অনেকসময় ভুল পথে নিয়ে যায় তাদেরকে। এর বেশি কিছু খোলাশা করে বলতে পারব আমি! যা মনে হলো বললাম। এখন বাদবাকী তোমরা বোঝো!’

বড়মামী উদ্রান্তের মতো চেয়ে থাকলো। নানী হাত ধুয়ে নিয়ে বললো, ‘তুমি বসো বউমা। আমি দেখতেছি সুনেত্রারে।’

বাসা থেকে বের হওয়ার সময় একবার বড়মামার সাথে দেখা করে আসতে চাইলাম। পরে বাদ দিলাম চিন্তাটা। মানুষের অসহায়ত্ব দেখতে ভালো লাগে না। বড়মামা ওপরে ওপরে যতোই শক্ত থাকার ভান করুক, আমি জানি ভেতরে ভেতরে কতটা ক্ষয়ে গেছে! সন্তানকে সুপথে না আনতে পারার অসহায়ত্বের সাথে যোগ হয়েছে নিজের চোখে সন্তানের শাস্তি দেখার যন্ত্রণা!

বাসা থেকে বের হয়ে আচমকা দুম করে নিজের সবটুকু জোর কোথায় যেন হারিয়ে ফেললাম।

খুব তো বড়গলায় বলে এলাম, সুরমার জন্য কিছু করবো! কিন্তু কী করবো? কিছু করার কি আদৌ কোনো ক্ষমতা আছে আমার? সুরমা যে অপরাধের জন্য এখন হাজতে বসে আছে, যতদূর জানি তা খুব শক্তপোক্ত অপরাধ। এই অপরাধে দোষী ব্যক্তিরা খুব সহজে জামিন পায় না। দশটা ইয়াবা খুব অল্পস্বল্প নয়। আমি সামান্য মানুষ। কার সাথে পরামর্শ করবো?

সুমনের কথাই সবার আগে মনে হলো। ফোন দিয়ে আমাদের ক্যান্টিনে আসতে বললাম। সুমন ক্লাসে ছিল। বুঝতে পারলাম ফোনটা কেটে দেওয়াতে। অসময়ে আমার ফোন পেয়ে তাজ্জব হয়ে গেছে হয়ত। আমি মেসেজ দিলাম, ‘ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে এসো। খুব জরুরি প্রয়োজন!’

আমি ক্লাসে গেলাম না। আজ কিছুতেই ক্লাসে মন দিতে পারবো না। বার বার বড়মামা মামী আর সুনেত্রার চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। যার কথা মনে করতে চাইছিলাম না, সেই সুরমাও উঁকিঝুঁকি মারছিল মনের কোণে। কী করছে এখন সুরমা? একবারের জন্যও কি এখন অনুতপ্ত হবে না ফেলে আসা দিনগুলোর অবাধ্যতার কথা মনে করে?

সুমন প্রথম ক্লাস শেষ করেই চলে এসেছে। আমার মেসেজ পড়ে আর দেরি করতে পারেনি বেচারা। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো, ‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে?’

আমি ভনিতা না করে ঘটনা খুলে বললাম। সুমন একেবারেই গম্ভীর হয়ে গেল। ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারছিলাম না, ভেতরে কী চলছে। আশেপাশে কোনোদিকে তাকাচ্ছে না, যেন ধ্যানে বসেছে। প্রায় দুই মিনিট পরে নীরবতা ভেঙ্গে বললো, ‘জানতাম এমন কিছুই হবে। নিশ্চয়ই বিপ্লব পলাতক! সুরমাকে ফাঁদে পেতে রাখা ছাগল বানিয়ে এতদিন বাঘ শিকার করেছে বিপ্লব। সুরমার মতো চালাকচতুর মেয়ে এই সত্যিটা কেন বুঝতে পারেনি আমি জানি না। তা…এখন কী করবে? জামিনের আবেদন কি করা হয়েছে?’

‘নাহ! সবে তো গতকাল ঘটনা ঘটলো! আজকে বড়মামা উকিলের কাছে যাবে। কার কাছে যেতে হবে…কে ভালো এই লাইনে…বড়মামা কিছুই জানে না! আমার মুখের দিকে বড়মামী চেয়ে আছে! আমি কী করবো?’

সুমন মাথা নিচু করে বসে রইলো। আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলো না। পরবর্তি যে প্রশ্নটা করলো তাতে বুঝতে পারলাম, আমার শেষের কথাগুলো ওর মাথাতেই ঢোকেনি!

‘আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়? দলের হোতাদের বের করতে পুলিশের ইনফর্মার হলে কেমন হয়? বিপ্লবও টের পাক কত ধানে কত চাল!’

এই অসময়েও আমার মাথায় কেমন একটা দুষ্ট চিন্তা চাপলো। সুমনকে বললাম, ‘তাতে কি তোমার জ্বালা কিছুটা জুড়ায়? আমি এলাম পরামর্শ করতে আর তুমি ব্যক্তিগত হিসাবনিকাশ রফা করছ!

‘এ্যাই…আরে না না! একদম না! আমি চিন্তা করছি, সুরমা তো ভালোমতোই ফেঁশে গেছে! নিজের ভাগের শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে! কিন্তু ভাবছি…পালের গোদাদেরও যদি এক এক করে ধরে আনা যায়, তাহলে হয়ত সুরমার অপরাধটা তুলনামূলকভাবে কমে আসবে। বোঝাতে পারলাম?’

আমি মাথা নাড়লাম। এটা যে আমার মাথাতে আসেনি তা নয়। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। পুলিশের কাছে বিপ্লবের নাম বলে দিব? তাতে কি কাজ হবে?

এর পরের কিছুদিন বাসার পরিবেশ খুব উত্তপ্ত হয়ে রইলো। কেউ যেন বিন্দুমাত্র মানসিক স্থিরতাতে নেই। বড়মামা আর ছোটমামা অনেক দৌঁড়াদৌঁড়ি করলো কয়েকটা দিন। উকিলের কাছে দিনরাত ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকলো।

কিন্তু সুরমার জামিন কোর্ট না মঞ্জুর করে দিলো। দশকেজি ইয়াবা রাখার অপরাধে সুরমাকে জেলে পাঠানোর হুকুম হলো।

বড়মামার সাথে একদিন দেখতে গেলাম সুরমাকে। যে দশায় দেখলাম, সেই বর্ণনা দিতে ইচ্ছে করছে না। সুরমা করুণ গলায় আমাকে বললো, ‘নীরা…বিপ্লব এসব করিয়েছে আমাকে দিয়ে! আমি কিছুই বুঝতে পারিনি! বিশ্বাস কর!’

আমি নরম হতে চেয়েও হতে পারলাম না। অনাহুত কঠিন গলায় বললাম, ‘আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কিছু আসে যায় না সুরমা!’

আমাদের সকলের দুর্বিষহ দিনরাত শুরু হলো। শান্ত বাসাটাতে চিল্লাচিল্লি কান্নাকাটি প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনাতে পরিণত হলো। 

পুলিশের কাছে বিপ্লবের নাম বলে দিয়েছি। পুলিশ ধারণা করছে, শুধু বিপ্লব নয়। এই কাজে আরো একাধিক কেউকেটা জড়িত আছে। বিরাট একটা চক্র। এই চক্রের লেজ ধরে টান দেওয়া হলেই একে একে সব কটা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও সেই লেজ অর্থাৎ বিপ্লবকে এখনো ধরতে পারা সম্ভব হয়নি। সে যে কোথায় লাপাত্তা হয়ে গেছে তা কেউ জানে না!

এরই মধ্যে আমি একদিন প্রায় মাঝরাতে একটা ফোন পেলাম। অপরিচিত নাম্বারটা রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

‘বোনরে বাঁচাইতে চাও? তাইলে তো আমার কাছে একবার তোমাকে আসতে হবে সুন্দরী! এত দেমাগ কিন্তু ভালো না! ভাইবা দ্যাখো ঠিকমত। তোমার সুমন হইল গুল্লুবাবু। সে কিছুই করতে পারব না! এই বিপদে আমিই হইলাম তোমার ভরসা…বুঝতে পারছ?’

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত