Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya separation-last-part

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৩১)

Reading Time: 5 minutes

বিপ্লব আগামীকালের ডেট দিয়েছে। যে জায়গার নাম বলেছে সেটা ভালোমত চিনি না। আচ্ছা সে না হয় চিনে নেওয়া যাবে! কিন্তু তার আগে পুলিশ অফিসারকে একবার ফোন দেওয়া দরকার।

আমি কল করার আগেই আমার ফোনটা বেজে উঠলো। পুলিশ অফিসারের ফোন। ওপাশ থেকে শুধু, ‘লোকেশন ট্রেস করা হয়েছে। এখনই ফোর্স পাঠাবো।’ এটুকু বলেই লাইনটা কেটে দিলো। আমি হতভম্বের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। এখন আমার কী করা উচিত কিছুতেই বুঝতে পারছি না। খানিকটা সময় যাওয়ার পরে বুঝতে পারলাম, ঠিক এই মুহূর্তে আমার কিছুই করণীয় নাই। আপাতত যা করার পুলিশ করবে। ধরতে পারলে আম ছালা দুটোই উদ্ধার করা সম্ভব। আর না হলে আমাকে আগামীকাল বলির পাঁঠা হয়ে যেতে হবে। সেই কথা চিন্তা করেই গায়ে কেমন জ্বর এসে যাচ্ছে!

বাসায় গিয়ে পুরো সময়টা টেনশনে কাটলো। একবার ঘর আরেকবার ছাদ এই করে করে সময় পার হলো। ছোটমামা বাসায় ফিরে আমার এই অবস্থা দেখেই জিজ্ঞেস করলো, ‘এ্যাই নীরা, কী হয়েছে রে তোর? এমন ঘর বাহির করছিস কেন?’

আমি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলাম। নিজের মনোভাব কিছুতেই কাউকে বোঝানো যাবে না। কেউ কিছু টের পেলেই বিপদ! আমাকে এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে আমার দুই মামা অন্তত কিছুতেই ঢুকতে দিতে চাইবে না! কিন্তু একবার সিদ্ধান্তে এসেছি যখন, ঢুকতে আমাকে হবেই।

সুরমার শাস্তি লাঘব করার আর কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুরমার উকিলও এমন কথা বলেছেন। দলের মূল হোতারা ধরা পড়ে দোষ কবুল করলে হয়ত নিছক সাপ্লায়ারের শাস্তি কিছুটা লঘু হতে পারে। আর যদি কোনোভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয় যে, সুরমা না জেনে এই কাজটি করেছে তাহলে হয়ত বেকসুর খালাসও জুটে যেতে পারে। যদিও এতটা আশা এই মুহূর্তে কেউওই করছে না, কিন্তু উপায় থাকলে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী?

সন্ধ্যার পরে পুলিশ অফিসারের ফোন পেলাম। বিপ্লব পালিয়েছে। ওর ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার পরে সবকিছুই জায়গামত পাওয়া গিয়েছে। শুধু পাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গিয়েছে। পরে বিপ্লবের নাম্বারে ফোন দিয়ে নাম্বারটা আবার যথারীতি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

শুনেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো। এত তাড়াতাড়ি কীভাবে টের পেয়ে গেল সবকিছু? সাবধানতাতে তো নিশ্চয়ই কমতি ছিল না। অফিসার যেভাবে আমাকে সবকিছু গোপন রাখতে বলছেন, সহজেই অনুমান করা যায় যে উনি নিজেও কম গোপনীয়তা বজায় রাখেননি। তাহলে বিপ্লব কীভাবে পালিয়ে গেল?

সেইসঙ্গে আরেকটা চিন্তা ঢুকে পড়েছে মাথায়। আমাকে তো তাহলে বিপ্লবের সাথে দেখা করতে যেতে হবে! শেষরক্ষা হলো না শেষমেষ! আর আজকের এই ঘটনার রেশ যে আগামীকাল থাকবে না এটা কে বলতে পারে! বিপ্লব কি প্রতিশ্রুতিমতো খবর দিবে নাকি এই পুলিশী অভিযানের বদলা আমার ওপর দিয়ে নিয়ে ছাড়বে?

এটা জানার জন্য অবশ্য আগামিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো না। পুলিশ অফিসারের ফোন পাওয়ার দুই ঘণ্টা পরেই আরেকটা নাম্বার থেকে বিপ্লবের ফোন পেলাম। কয়টা সিম সে ব্যবহার করছে কে জানে! প্রচণ্ড রাগে একেবারে ফুঁসছে বিপ্লব।

‘ওহ আচ্ছা এই তাহলে তোমার ফন্দিফিকির! আমার সাথে কথা বলার নাটক করে পুলিশের সাথে জোট পাকাইয়া নাটক করতাছো? তুমি কী মনে করছো? বিপ্লব দুধের শিশু? ফিডারে করে দুদু খায়? আরে বিপ্লব তোমাগো সক্কলের বাপ…এইটা মনে রাখবা! শুনো এইসব ছলচাতুরি করতে গেলে সবকূল হারাইবা বইলা দিলাম! যদি সত্যি সত্যিই আমার কাছ থেইকা খবর আদায় করতে চাও, তাইলে এইসব চোর পুলিশ খেলা বন্ধ করো বুঝলা?’

আমি এবারে সত্যি সত্যিই একটু নাটক করার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘তুমি কী বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি পুলিশের সাথে কীসের জোট পাকাইছি?’

বিপ্লব হিস হিস করে বললো, ‘আজ যাও নাই তুমি পুলিশের কাছে? সব কথা বলো নাই? পুলিশ আমার আস্তানার খবর পাইলো ক্যামনে? পুলিশ আজ আমারে ধরতে আসছিল। আর একটু হইলেই একটা পেচকীতে পড়ছিলাম আর কী! ইনোসেন্ট চেহারা বানাইয়া ঘুইরা বেড়াও, এইদিকে দ্যাখা তো যাইতাছে পুলিশের কলকাঠিতে উঠো বসো! বহুত সেয়ানা মাইয়া তুমি!’

আমি একদম নাবালিকার গলায় উত্তর দিলাম, ‘তুমি কোথায় থাকো আমি কীভাবে জানবো? এইসব কী বলতাছো যা তা? আমি পুলিশের কলকাঠিতে উঠি বসি? দেখো বিপ্লব মুখ সামলাইবা বুঝলা? সবাইরে নিজের লেভেলে চিন্তা করবা না!’

আমার এই আত্মবিশ্বাসী উত্তরে বিপ্লব একটু হকচকিয়ে গেল। এতটা আত্মবিশ্বাস সম্ভবত সে আশা করেনি। তালগোল হারিয়ে একটু যেন বিভ্রান্ত মনে হলো বিপ্লবের গলা। বললো, ‘তুমি যাও নাই পুলিশের কাছে? ওহ আচ্ছা! পুলিশের কাছে গেলেই বা পুলিশ আমার আস্তানার খবর ক্যামনে জানবে? তোমারেও তো বলি নাই আমি কই থাকি! আচ্ছা…তাইলে চালাকি করতাছো না আমার লগে?’

‘কীসের চালাকি করবো? দেখো বিপ্লব তুমি আমারে হেল্প করতে চাইলে করবা নইলে না! খামাখা এইসব এদিক ওদিকের কথা বলে আমার মাথাটা নষ্ট করবা না বলে দিলাম!’

‘হুম! আচ্ছা শুনো। দেখা করার সময় দুইদিন পিছাইয়া দিলাম। আমারে নতুন আস্তানার খোঁজ লাগাইতে হইবো আগে। আমি দুইদিন পরে আবার ফোন দিমু। খবরদার কোনোরকম ঝামেলা যাতে না হয় এইবার!’

আমি ফোন রেখে দিয়ে ঘামতে লাগলাম। এ কী মহাবিপদে পড়েছি রে বাবা! এখন আমি কী করি? পুলিশ অফিসারকেই বা কী বলি? বেশি চালাকি করতে গিয়ে এখন তো সত্যিকারের বিপদে পড়তে যাচ্ছি মনে হচ্ছে!

দুটো দিন পার হলো। এই দুইদিনে আমি পুলিশস্টেশনে ফোন দিইনি। আমাকেও পুলিশ অফিসার ফোন দিয়ে কিছু বলেনি। আর এর মধ্যে বিপ্লবের কাছ থেকেও কোনো খবর আসেনি। সব মিলিয়ে বেশ একটা রুদ্ধশ্বাস অবস্থা।

কোনো কাজে মন বসাতে পারছি না। পড়ালেখা তো মোটামুটি শিকেয় চড়ে বসেছে। এমন চলতে থাকলে আমার স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা সবকিছুকেই জলাঞ্জলি দিতে হবে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছি, সেটা থেকে তো বের হওয়ার উপায়ও আমার জানা নেই।


আরো পড়ুন:  খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৩০)


সকালে মুখ গোমড়া করে ক্লাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই অনিশ্চয়তা আর থমথমে অবস্থা একেবারেই ভালো লাগছে না। এমন সময় নয়ন ওর ফোন হাতে দৌঁড়ে এসে বললো, ‘আপা কে যেন ফোন করেছে। তোমাকে চাইছে!’

গতমাসে নয়নকে সস্তা দেখে একটা মোবাইল সেট কিনে দিয়েছি। বাসার কাউকে না জানিয়ে আমি একটা টিউশনি নিয়েছি। কত টুকিটাকি প্রয়োজন থাকে নিজের! সবসময় মামাদেরকে বলতে ইচ্ছে করে না। একটা দুটো টিউশনী তো আমি করতেই পারি এখন!

গতমাসেই প্রথম বেতনের টাকা হাতে পেয়ে এই সেটটা নয়নকে কিনে দিলাম। ইদানিং ওকে নিয়ে আমার আগের চেয়েও অনেক বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কখন কোন ফাঁদে পা দিয়ে বসে কে জানে! যতই নিজেকে সংযত রাখছে মনে করুক, পচা শামুকে পা কাটতে সময় লাগে না। বয়সটাই তো ঝামেলার!

সুরমার ধরা পড়ার পর থেকে সুজনের কেসটা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারছি না। সুজনের গতিবিধির দিকেও লক্ষ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু টুকটাক নয়নের কাছ থেকে যেটুকু শুনি, তাতে বেশ বুঝতে পারি সুজনও সর্বনাশের পথে পা বাড়িয়েছে। আগে বড়মামা ওর পড়ালেখার খোঁজখবর নিত। এখন বড়মামা নিজের জ্বালা নিয়েই অস্থির। সুজন তাই দেদার স্বাধীনতা পেয়ে গেছে।

ছোটমামা কিংবা মামী পড়ালেখা নিয়ে তত বেশি চিন্তিত না। সবাইকে একেবারে টপক্লাস ছাত্র হতে হবে এমনটা তারা মনে করে না। মোটামুটি খেয়ে পরে বাঁচার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু হলেই নাকি চলে যাবে। কাজেই এতরকম অনুকূল পরিবেশ পেয়ে সুজনকে আজকাল পড়াশুনা করতে দেখাই যায় না! অথচ সামনের মাসেই ওর এসএসসি! ভাবছি এই বিপ্লবের কেসটা একটু দফারফা হলেই ছোটমামাকে কিছু একটা বলবো। লেখাপড়া কম করলে তো জীবন বাঁচে, কিন্তু বিপথে চলে গেলে জীবনে কী হয় সেটা তো এই বাসার সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে!

নয়নকে পইপই করে বুঝিয়েছি যদিও, তবু উঠতি বয়সের ছেলে। বিগড়াতে ক’দিন লাগে? ফোনটা থাকাতে যখন তখন খোঁজ খবর রাখতে পারি। আর নেহায়েত কেজো ফোন। একেবারেই আনস্মার্ট! কোনো রকম এপ্লিকেশন ফেশন নেই। শুধু ফোন দেওয়া আর রিসিভ করা যায়।

অল্প কিছুদিন হলো ফোনটা কেনা হয়েছে। এর মধ্যে নয়নের ফোনে কে আমাকে ফোন দিলো? আমার নাম্বারটা যেখানে চালু আছে! অবাক হয়েই ওর হাত থেকে ফোনটা নিলাম। হ্যালো বলতেই বিপ্লবের গা জ্বালা করা কণ্ঠস্বরটা ভেসে এলো,

‘কীগো সুন্দরী! খুব অবাক হইয়া গ্যালা তাই না? হিহ হি! তোমার ভাইয়ের নাম্বার জোগাড় করা কি কোনো ব্যাপার? তোমার আরেক গুণধর মামাতো ভাই আছে না? সুজন? ওর কাছ থিইকা নিছি! আকাশ থেইকা পইড়ো না আবার! কী দারুণ মামাবাড়ি তোমার! সব কয়জন একেবারে গুণের ডিব্বা! তা…তোমার ছোটভাইটারে বাঁচাইবার ইচ্ছা আছে কি?’

আমার সারা শরীর শিউরে উঠলো। বিপ্লব এসব কী বলছে? সে কি এখন নয়নের কথা বলে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চায় নাকি? এত সাহস হয়েছে বিপ্লবের? একবার ধরতে পারলে পুলিশ ওর গায়ের ছালছিলকা সব উঠায়ে ফেলবে! আর সে ফোন করে আমাকে পরোক্ষ হুমকি শোনায়?

দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, ‘তুমি নয়নের নাম্বারে ফোন দিছ কেন? আমার ফোনে কী অসুবিধা হইছে? নয়নের কাছ থেকে দূরে থাকবা বুঝলা?’

‘আরে আরে! তোমার ভাইয়ের কাছাকাছি কবে গেলাম? শুধু বললাম যে, ওরেও তো চাইলে কেউ বিপদে ফেলতে পারে তাই না?…আর নয়নের নাম্বারে ক্যান ফোন দিছি সেইটা বুঝো না তুমি? তোমার ফোন যে পুলিশ ট্রেস করতাছে সেইটা বুঝতে কি আমারে আরেকবার জন্মাইতে হইবো?  বিপ্লবরে দুদু খাওয়া বাচ্চা ভাবছো?’

আমি বুঝতে পারলাম, পুলিশের প্ল্যান চোপাট হয়ে গেছে। বিপ্লব সব ধরে ফেলেছে! কেমন একটা ভয় হলো আমার। ঢোঁক গিলে কোনমতে বললাম, ‘কী চাও তুমি?’

‘ঐ যে আগেই কইছি! একবার তোমার চাঁদমুখটা দ্যাখতে চাই। আহা! কতদিন দেখি না! কাল একবার আসো, ঠিকানা দিতাছি। খবরদার এইবার পুলিশের ধারেকাছে ভিড়বা না কইলাম! যদি ভিড়ো তাইলে তোমার ছোটভাইরে কেউ আমার কাছ থেইকা বাঁচাইবার পারবো না বইলা দিলাম!’

এতদিন পালের গোদাদের খবরাখবর দিবে এই আশার বাণী শুনিয়ে বিপ্লব দেখা করার কথা বলছিল, এখন কী না নয়নকে নিয়ে ভয় দেখায়!

প্রায় ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা আমি কাউকে বলবো না… হ্যাঁ হ্যাঁ পুলিশকেও বলবো না। বলো কোথায় যেতে হবে?’

বিপ্লব এবারে আমাদের কলেজের এড্রেস দিলো। আর বার বার সাবধানবাণী উচ্চারণ করে আমার অন্তরাত্মা একদম কাঁপিয়ে দিয়ে গেল।

নয়নকে ফোনটা ফেরত দেওয়ার সময় বুঝতে পারলাম আমার হাত দুটো অল্প অল্প কাঁপছে। নয়ন আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললো, ‘কে ফোন করেছেরে আপা? আর তুই এত ভয় পাইছিস কেন?’

আমি অনেকদিন পরে নয়নকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, ‘তুই খুব সাবধানে থাকিস ভাই আমার। খুব সাবধানে। কোনো ঝামেলা টের পেলেই আমাকে বলবি। বলবি তো?’

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>