| 20 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৩৫-৩৯)

আনুমানিক পঠনকাল: 30 মিনিট

(৩৫)

সুজনকে দিয়ে সত্যিটা উগরিয়ে নিতে অনেক বেগ পেতে হলো।

সে কি সহজে কিছু স্বীকার করে? প্রথমে তো সোজাসুজি অস্বীকার করে বসলো। এসব নাকি ডাঁহা মিথ্যা কথা। কেউ হিংসা করে ওর নামে এসব বলছে। পুলিশের কথা বলাতে জোঁকের মুখে নুন পড়েছে। যত বড় সেয়ানাই হয়ে উঠুক, এখনো তো বাচ্চা একটা ছেলে! পুলিশকে ভয় করবে না তো কী! সত্যিটা বের করতে তাই আর দেরি করেনি।

ছেলেটা সত্যিই অনেকদূর এগিয়ে গেছে। হাড়বজ্জাত কিছু ইঁচড়েপাকা বন্ধুবান্ধবের সাথে মিশে জীবনটাকে নিয়ে একেবারে গোল্লাছুট খেলা শুরু করে দিয়েছে। সুজনের কীর্তিকলাপের কথা শুনে আমারই হাত নিশপিশ করছিল। নানী দেখলাম কটমট করে ওর দিকে তাকাচ্ছে। তবু নিজের কথার সত্যতা প্রমাণ করে ছোটমামা সত্যিই অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিলো। বাসার কাউকে এর মধ্যে ঢুকতে না দিয়ে নিজেই পুরো ব্যাপারটা সামলালো। তবে ভাগ্য ভালো, সুজন এখনও পুরোপুরি আসক্তিতে জড়িয়ে যায়নি। সবে একটু আধটু নিতে শুরু করেছে মাত্র। আরেকটু কিছুদূর এগুলেই ওকে সরিয়ে আনা আর সম্ভব নাও হতে পারতো।

আসক্তিতে কীভাবে জড়িয়ে পড়েছে, সেই গল্পটা আমার ইতিপূর্বেই জেনে ফেলা হয়েছে। এদিক সেদিক থেকে খবর সংগ্রহ করে আমি মোটামুটি ইতিহাসটা জেনে গেছি।

খাতির জমাতে আসা কিছু ‘বহিরাগত’ অনেকটা অযাচিতের মতোই বন্ধুত্ব পাকিয়ে ফেলে ওদের অনেকের সাথে। স্কুলের গ্যাপে, গলিতে, রকের আড্ডায়…কোত্থেকে যেন কিছু ‘বন্ধু’ এসে হাত মেলায়। ‘টেনশনফ্রি’ থাকার নানারকম উত্তেজক ফ্রি দাওয়াইয়ের সন্ধান দেয় ওরা। মূল্য দিতে হবে না। শুধু খাও আর সব দুশ্চিন্তাকে টাটা বাই বাই করে দাও!

বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে কেউ কেউ এই দারুণ অফার ফেরাতে পারে না। ফ্রিতে দিচ্ছে যখন, নিলে ক্ষতি কী! কৌতুহল থেকেই দু’একবার সেবন করে ওরা। কিন্তু সেই সামান্য কৌতুহল অনেক ভারি বোঝা হয়ে কাঁধে চেপে বসে। কিছুতেই আর বেরুতে পারে না সেই মায়াজাল কেটে। দু’একবারের নিছক শখ ভয়ানক নেশার থাবা বাড়িয়ে দেয়।

তখনই ওদের মাথাতে আসল বাজটা এসে পড়ে। ফ্রি দাওয়াই হঠাৎ করেই কেমন যেন চড়াদামের ধরাছোঁয়ার বাইরের বস্তুতে পরিণত হয়। স্কুলের ছাত্র একেকজন। দু’দিন পরেই একেকজনের পকেটে টান পড়ে। তখন দোসর জোটাতে অন্য বন্ধুদের ফুসলাতে থাকে আসক্তরা। এভাবেই সার্কেল বড় হয়। যে যেভাবে পারে, টাকার জোগানে লেগে যায়। মা-বাবার ব্যাগ থেকে টাকা সরানো তো তখন অতি মামুলি কাজ ওদের জন্য! আর কিছুদিন গেলেই ছুরি নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। ছিনতাই রাহাজানি করে নেশার টাকা জোগাড় করতে হবে।

শুনতে শুনতে কেমন যেন শিরশিরানি বয়ে যায় শরীর দিয়ে। এই ছুরি একসময় মা-বাবার গলায় বসাতে হলেও নেশাসক্তরা পিছপা হয় না!

অস্বীকার করার আর উপায় নেই বুঝতে পেরে সুজন স্বীকার করেছে, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে কৌতুহলবশতই দু’একবার সুখটান দিয়েছে সে। পরে এমনই সুখের দেখা পেয়ে গিয়েছে যে, আর ফিরে আসতে পারেনি।

তবে যেকোনো অসচেতনতাই কিছু না কিছু ছাপ তো রেখেই যায়! এই নেশার পেছনে ছুটতে গিয়ে পড়াশুনার পেছনে আর সময় দেওয়া হয়নি। এই বছর পরীক্ষা দিতে বসতে হলে নির্ঘাত ফেল করতে হবে।

সুজন আরেকটা কথাও স্বীকার করেছে। নয়নের পেছনে সন্দেহের বীজটা সে নিজেই তার মায়ের মনে বুনে দিয়েছিল। নয়ন মন দিয়ে পড়ছে, সবার চোখে ভালো হচ্ছে, কিছুতেই তাকে আজেবাজে কিছু চাখানো যাচ্ছে না…এসব সুজন সহ্য করতে পারেনি। তাই মায়ের ব্যাগ থেকে টাকা সরিয়ে সুযোগমত দোষের ভাগটা নয়নের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। এটা সেটা বলে মায়ের মনে সন্দেহ আর অবিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছে নয়নের প্রতি।

ছোটমামা খুব ধৈর্যের সাথে ব্যাপারটা সামলালো। আমি এতটা আশাই করিনি। সবসময় গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ালেও ছোটমামা যে নিজের কাজটা ভালোই বোঝে, সেটা সবাই বুঝতে পারলো।

সুজনের বন্ধু বান্ধবদের মা-বাবার সাথেও যোগাযোগ করা হলো। যথাসম্ভব সতর্ক করে দেওয়া হলো সবাইকে। সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়া অব্দি এই বন্ধুবান্ধবদের সাথে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হলো। পরীক্ষা দিতে পারবে না শুনেও ছোটমামা শান্তভাবে বললো, ‘আচ্ছা এই বছর না হয় রেস্টই নে! আরাম করে বইগুলো শেষ কর। পরেরবার একেবারে ধুন্দুমার একটা ভালো রেজাল্ট করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিস! ঠিক আছে?’

বড়মামা আর এর ভেতরে ঢুকলো না। তবে আমাকে কাছে ডেকে বলেছে, ‘ভাগ্যিস তুই ছিলিরে নীরা! নইলে আমার অভাগী মেয়েটার মতো সুজনের খারাপ পরিণতিটাও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হতো।

ছোটমামা নানী সকলেই কাজে আর কথায় আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললো না। সত্যটাকে লুকিয়ে না রেখে আমি যে এভাবে সামনে আনতে পেরেছি, এজন্য অনেক সাধুবাদ সেলামী পেলাম। কিন্তু একজন মানুষ কোনোরকম উচ্চবাচ্যই করলো না। তিনি হচ্ছেন ছোটোমামী। এতকিছু জানার পরেও ছোটমামী একবারের জন্যও আমার কিংবা নয়নের কাছে দুঃখপ্রকাশ করলো না। বরং তার ছেলেকে সবার চোখে ছোট করার দায়ে আমাকে আর নয়নকে তার মনের অন্দরমহল থেকে একরকম যাবজ্জীবন কারাদণ্ডেই দন্ডিত করে দেওয়া হলো!

আমি অবাক হলেও মেনে নিলাম। মাঝে মাঝে কিছু জিনিস মেনে নেওয়া ছাড়া আর অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না।


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৩২-৩৪)


বাসার পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসার পর আমি আবার নিয়মিত কলেজে যাওয়া আসা শুরু করলাম। কয়েকদিন ধরে বয়ে চলা অশান্তিতে কলেজে যাওয়ার কথা মাথাতেই আসেনি। আবার শুরু করার পর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যত ঝড়ঝাপ্টাই আসুক, আর কিছুতেই ক্লাস মিস দিব না। নিজের জীবনকে অগোছালো ফেলে রেখে আশপাশটাকে গোছাতে চাওয়া বোকামি।

সুমন এরমধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। সত্যিকারের উদ্বেগের সুরেই বলেছে, ‘কী ব্যাপার নীরা? তুমি ক্লাস করছো না কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?’

সুমনের ফোন এলেই আমার ভেতরের যত কথা সব একেবারে পাহাড়ি ঝর্ণার মতো আগল খুলে বেরিয়ে আসতে চাইতো। ইচ্ছে করতো গল গল করে সব উগরে দিই। এতদিনের জমিয়ে রাখা যত মান অভিমান উদ্বেগ ভয়ভীতি সবকিছুকে মুক্ত করে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত নির্ভার হয়ে বসে থাকি। এতদিন ক্লাস করছি না দেখে আর কেউ তো কোনো খোঁজ নিচ্ছে না আমার! অথচ অন্য কলেজের হয়েও সুমন প্রায়ই ফোন করে কুশল জানতে চাইছে! কিন্তু কেন? কেন এত উদ্বেগ ওর? নাকি নিছক কৌতুহল?

এই কেন’র উত্তর পেতেও খুব আনচান করতো ভেতরটা। সুমনের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা খুব কাছেই চলে এসেছে…তবু কোন এক দুর্বোধ্য বাধা আমাকে সেই হাত ধরতে দিচ্ছে না! আমি বুঝতে পারছি না কী সেই বাধা! অনেকদিন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছি, কীসের বাধা আমাকে আটকে দিচ্ছে সুমনের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরা থেকে?

উত্তরটা পেয়েছি অবশেষে একদিন…আচমকাই।

বাধাটা আর অন্যকিছু নয়। সুরমার অদৃশ্য উপস্থিতিই আমাকে ধরতে দিচ্ছে না সুমনের হাত। সুরমা যেন দূর থেকে আমাদের দুজনের দিকে দৃষ্টি লাগিয়ে রেখে বলছে, ‘কীরে নীরা…এই তোর ভালোবাসা বোনের প্রতি? তুই না আমাকে ভালো একটা ছেলের সন্ধান দিয়েছিলি! আমি একটু দূরে সরে এসেছি, তাই এই ফাঁকে তুই ধরে ফেললি ওর হাত?’

আমার ভেতরটা কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে। একসময় সুমনের মনটাকে বুঝতে অসুবিধা হতো আমার। আমি হাতড়ে হাতড়ে সুমনের মনের ভেতরের নরম কাদামাটির স্পর্শ পেতে চাইতাম। কখনো একটুখানি নরম ছোঁয়াতে চমকে উঠে ভাবতাম, এই তো এখানেই! কিন্তু পরমুহূর্তেই বুঝতে পারতাম ওটা মরীচিকা।

অথচ সুমন যখন একটু একটু করে নিজের মনটাকে আমার দিকে ঝুঁকিয়ে আনছে, উন্মুক্ত করছে মনের সবটুকু দুর্বোধ্যতা… ঠিক তখনই আমি নিজেই নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছি। এখন আমি নিজেই নিজের কাছে কেমন যেন অস্পষ্ট আর অচেনা হয়ে পড়ছি। ঠিক যেন চিনতে পারছি না নিজেকে।

অবশ্য কলেজে যাওয়ার পরে আর ঘাপ্টি মেরে থাকা সম্ভব হলো না। ব্রেকের আগেই ফোন দিয়ে জানালাম, ফ্রি হলে দেখা করতে।

বলাইবাহুল্য, সুমন তৎক্ষনাৎ এসে হাজির। আমার ক্লাস শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বসে বসে অপেক্ষা করলো ক্যান্টিনে। আমি ক্লাস শেষ করে সেখানে গেলাম। সুমনের ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ মনে মনে খুব মিস করছিলাম। আজ অনেকদিন পরে ওকে দেখে খুব ভালো লাগলো। সেই সাথে ওর চোখমুখের ব্যাকুল জিজ্ঞাসাটা পড়তে পেরে খুব মজাও পেলাম। আমাকে দেখেই সুমন একেবারে ঝর ঝর করে দুনিয়ার প্রশ্ন একসাথে করে ফেললো।

‘কী ব্যাপার, কী হইছে তোমার? এতদিন ক্লাসে আসছিলে না কেন? আজব তো! ফোন করলেও কিছুই বলতে না! আমি তো ভাবলাম যে…’

আমি উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। সুমনের কথা শেষ হলো না দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ভাবছিলে তুমি?’

‘আমি ভাবলাম যে, তোমার বুঝি…ইয়ে মানে তোমার হয়ত বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! এইজন্যই ক্লাস করছ না। ফোনেও কথা বলতে চাইছো না! তারমানে মামলা ক্লিয়ার। মেয়েরা যখন বিয়ের প্রস্তুতি নেয়, তখন অন্য সবকিছু বন্ধ করে বসে থাকে।’

আমি দুই তিন সেকেণ্ড হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর অনেকদিন পরে হা হা করে প্রাণখুলে হাসলাম। আশেপাশের দু’একটা কৌতুহলী মুখ অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকালো। দেখেও পাত্তা দিলাম না। হাসতে হাসতেই বললাম, ‘তুমি মনে করেছিলে যে, যেহেতু বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে কাজেই আমার আর ডাক্তার হওয়ার দরকার নাই! তাই না? বিয়েশাদী হয়ে গেলে আর পড়াশুনা করে কী হবে? ডাক্তার হয়ে রোগী দেখার চেয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়তে পারাটা অনেক বেশি আরামদায়ক। আর ঐটাই আমার প্রায়োরিটি তাই না?’

সুমন একটু হকচকিয়ে গেল আমার মুখ থেকে এতকিছু শুনে। একটু লজ্জিত হয়ে বললো, ‘আরে! আমি এতকিছু ভেবে কিছু বলিনি! যা মনে হইছে সেটাই বললাম। বিয়ের পরে মেয়েরা কি পড়ে না নাকি? কত মেয়ে বিয়ের পরে ক্যারিয়ার মেইনটেইন করছে। কিন্তু অনেক সময় মাঝপথে বিয়ে হয়ে গেলে একটু গ্যাপ পড়ে যায়। এটাই বলতে চাইছি আর কী!’

আমি হাসতে হাসতেই বললাম, ‘আরে বাবা, বুঝেছি বুঝেছি! একটু মজাও করতে পারা যায় না তোমার সাথে! সবকিছুতেই এত ভয় পেয়ে যাও কেন?’

‘বাহ! ভয় পাবো না? এক সুরমাকে সামলাতে গিয়ে মজা বুঝেছি! তুমিও তো ওরই বোন! আচ্ছা সে যাক…তুমি এতদিন আসোনি কেন সেটা আগে বলো! এতদিন ক্লাস মিস হয়ে গেল! কাভার করতে পারবা? প্রফের ডেট পড়ে গেলে কী করবা?’

কী যে করবো সেই দুরুহ চিন্তাটা নিজেই এখনো শুরু করিনি। সুমনের কথা শুনে চিন্তাটা মাথায় একবার চিলিক দিয়ে উঠলো। বললাম, ‘প্রফের চিন্তা করবো এখন থেকে। বাসায় খুব ঝামেলা গেল। বিভিন্ন ঝড়ঝাপ্টা সামলে অবশেষে ফিরতে পারলাম।’

‘আবার কীসের ঝড়ঝাপ্টা? সুরমার কেস কি কোর্টে উঠেছে? পুলিশ চার্জশীট দিয়েছে?’

‘নাহ…সেই ব্যাপার না। গেল নানারকম ঝামেলা। একটা একান্নবর্তী পরিবারে কি কম ঝামেলা থাকে? আমি নিজেও তো এখন এই পরিবারেরই একজন সদস্য!’ আমি একটু চেপেই গেলাম। আবেগের বশবর্তী হয়ে সব কথা না বলে ফেলাই ভালো। পুলিশের সাথে মিলে যে বিপ্লব সার্চিং অপারশনে গিয়েছিলাম, সেটা তো এখন একেবারে ভুলে যেতে হবে!’

‘কী নানারকম ঝামেলা? বলা যাবে না আমাকে?’ সুমন কেন যেন পিছনেই লেগে গেল!

‘বাসার সপ্তঝামেলা সামলে সবে একটু মুক্তি মিললো! এখন আবার সেই ঝামেলার মধ্যেই টেনে নামাচ্ছো আমাকে? জানাবো না কেন? তবে সেসব ঝামেলার গল্প শুনতে কি তোমারই ভালো লাগবে? যৌথ পরিবারের নানারকম ঝড়ঝাপ্টা!’

আমি একটু হেঁয়ালি করে উত্তরটা দিলাম যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। অন্যের পারিবারিক সমস্যা শুনতে নিশ্চয়ই আগ বাড়িয়ে আগ্রহটা ভালো দেখায় না!

সুমন আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। একটু চুপ করে গেল। কিছুটা সময় পরে নীরবতার ভাঙার জন্য আমি কিছু একটা বলতে গেলাম। কিন্তু তার আগে সুমন নিজেই আবার বলল, ‘বিপ্লব ধরা পড়েছে জানো?’

‘সত্যি? তুমি কীভাবে জানলে? এ তো খুব ভালো খবর! কীভাবে ধরা পড়লো? কবে ঘটলো এই ঐতিহাসিক ঘটনা?’ নিজের অভিনয় দক্ষতায় আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

সুমন বললো, ‘তেমন বিস্তারিত কিছু জানি না। পুলিশ নাকি ড্রাগের ব্যবসা এবং স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের কাছে ড্রাগ সরবরাহের অভিযোগে অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করেছে ওকে। সুরমার কেসটা এবারে হয়ত একটু ভিন্ন মাত্রা পাবে…কী বলো? তোমার মামারা জানেন?’

প্রসঙ্গটা থেকে অব্যহতি পেতে মন চাইছিল। তবু স্বচ্ছতা ধরে রাখতেই কিছুক্ষণ আলাপ চালিয়ে গেলাম। মন পড়ে রইলো অন্যখানে। আজ সুমনের সাথে একটু অন্যরকম দুষ্টুমি করতে মন চাইছে।

আমি আচমকা কিছু না ভেবেই বললাম, ‘আচ্ছা…অনেক তো স্টাডি করেছো দেখলাম মেয়েদের নিয়ে! মেয়েরা বিয়ের পরে কী করে না করে, দুনিয়ার সবকিছু জেনে বসে আছো! আচ্ছা, একটা কথা বলো দেখি! তুমি কি বিয়ের পরে তোমার বউকে পড়তে দিবে? মানে ধরো… সে পড়তে চাচ্ছে, কেরিয়ার বিল্ডআপ করতে চাচ্ছে। তুমি সেসব করতে দেবে কি? নাকি এভারেজ হাজবেন্ডদের মতো নীতিবাক্য আওড়াবা… বিয়ের পরে সংসারই মেয়েদের আসল কর্মক্ষেত্র! মা-বাপ যা পড়াইছে বহুত পড়াইছে…এখন বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করা আর রান্নাবান্না করাই তোমার আসল কাজ…’

সুমন গাঢ়স্বরে বললো, ‘আলবত পড়াবো! কেন তোমার কি সন্দেহ আছে এই ব্যাপারে? ডাক্তার হওয়ার পরেও আরো কী কী যেন পড়তে হয় না? সব পড়াবো! ভরসা রাখতে পারো!’

আমি এতটা খোলামেলা উত্তরের জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না।

আচমকাই সকালের তপ্ত রোদের আঁচটা কেমন জানি মিঠেকড়া হয়ে গেল। চারপাশে বইতে লাগলো অসময়ের ফাগুনের হাওয়া! মনের ভেতরটা বলে উঠলো…বসন্ত বুঝি এসেই গেল!

(৩৬)

প্রায় সাত মাস পরে জামিন পেলো সুরমা।

এই সাতটা মাস বাসার প্রতিটা মানুষের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেল সেই গল্প করতে বসলে আমার গল্পটা হয়ত আর শেষই করা হবে না! সুরমার উকিল বার বার আশ্বাস দেয় নিশ্চয়তা দেয়, আর প্রতিবারেই জামিনের আবেদন কোর্ট নামঞ্জুর করে দেয়। এক পর্যায়ে বড়মামা আর মামী সবরকম আশাই ছেড়ে দিলো! ভাগ্যের ওপরে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকলো না।

অবসন্ন দেহে স্কুল থেকে ফিরে ড্রইংরুমের বারান্দার ইজি চেয়ারে মুখ গোমড়া করে বসে থাকে বড়মামা। আগের মতো ডেকে ডেকে বাসার অন্যদের হাল হকিকত জিজ্ঞেস করে না। তার চোখমুখের সেই থমথমে ভাব দেখে প্রকৃতিও বুঝি বিষণ্ন হয়ে যায়।

বড়মামী রান্নাঘরে বসে খুনখুন করে কাঁদে। আপনমনে আহাজারি করে। সেইসব আহাজারির কোনো সান্ত্বনা হয় না। অথচ সহ্যও করা যায় না। কিন্তু দিনকে দিন একই দৃশ্য দেখতে দেখতে তা যত অসহনীয়ই হোক না কেন, সহ্য করার ক্ষমতাটা কীভাবে যেন এসেই যায়। বড়মামীর কান্নাকাটি আহাজারি এসবও একসময় খুব স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়ে গেল। আমরা বিষয়টার সাথে মানিয়ে নিতে শুরু করলাম।

সবাই মিলে হয়ত কিছু একটা করছে। মটরশুঁটির খোসা ছাড়িয়ে বীচি বের করছে কিংবা একসাথে পিঠা বানাচ্ছে। হঠাৎ মাঝখানে শুরু হয়ে গেল বড়মামীর খুনখুন সুরে কান্না… ‘হু হু হু…আমার মেয়েটা না জানি এখন কী করছে! কী খাচ্ছে কোথায় ঘুমাচ্ছে…আর আমি বসে এসব বানাচ্ছি! হু হু হু…আমি কেমন মা! আমার বুকে কোনো মায়াদয়া নাই! এসব আমি কোন বুকে সহ্য করি! আমি তো পাষাণ মা… হু হু হু…’

নানী একদিন একটু শক্তভাবেই বলে ফেলেছিল, ‘এসব চিন্তা তো আগেই করা লাগতো গো মা! মেয়ে হাত ফসকে ফুড়ুৎ করে উড়ে যাওয়ার পরে তো আর এসব কথা ভাবলে চলে না!’

এই কথা শুনে বড়মামী সেদিন খুব কান্নাকাটি করেছিল। আমি না থাকতে পেরে নানীকে বলেই ফেলেছিলাম, ‘সবসময় এভাবে কেন বলছো নানী? কেউ কি শখ করে নিজের মেয়েকে খারাপ বানায়? নাকি কেউ চায় যে তার মেয়ে খারাপ হোক? ভাগ্যের ফেরে এমনটা হয়ে গেছে। এখন তাই বলে কি সবসময় এভাবে একই কথা বললে চলবে?’

নানী আমার দিকে কড়া দৃষ্টিপাত দিতে গিয়েও ফিক করে হেসে ফেলে। বলে, ‘বুবুরে! আমি তো আর এমনি এমনি মাথার চুল পাকাইনি রে বুবু! তোরা এই যুগের পোলাপাইন…ম্যালা বুদ্ধি তোদের মাথায়। তবে খানিকটা বুদ্ধিশুদ্ধি আমার মাথাতেও আছে বুবু! সুরমার আজ এতখানি অধঃপতনের জন্য তোর মামা-মামীর দোষও কিছু কম না! যেইদিন থেকে সুরমার রঙ ঢঙ শুরু হইছিল, সেইদিনই আমি তোর বড়মামীরে সাবধান করছিলাম। আমার কথারে পাত্তা দেয়নি তোর বড়মামী। এই মাইয়া আজ এক ছেমড়া কাল আরেক ছেমড়ারে নাচায়…এইসব তোর মামা-মামী দেখে নাই?’

আমি অবাক হয়ে গেলাম এই কথা শুনে। সুরমা যে ছেলে নাচাতো এই কথা নানী কীভাবে জানলো? এসব তো কলেজের ঘটনা! নানীর জানার কথা না। প্রশ্নটা চেপে রাখতে পারলাম না.। জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘এসব কথা তুমি কীভাবে জানলা? এই যে…সুরমার এইসব ছেলে নাচানোর খবর?’

‘ওমা! তুই কি ভাবছিস এই মাইয়া আজকে থেকে এইরকম? সে স্কুলে যাওয়ার সময় থেকেই এই আকাম করে! ছেলেপুলে তার হাতে চিঠি ধরায়ে দেয়। রাস্তাঘাটে তার হাত ধরে টান দেয়। সেইসব চিঠি সে আবার ফেলেও আসতো না। বাসায় আনা চাই। আজেবাজে কেচ্ছাকাহিনি আর বর্ণনা সেইসব চিঠি জুড়ে। বাসায় আসার পরে বাপ মায়েরে যা বোঝায় তারা তাই বোঝে। বাপের কাছে তো আর সব বলতো না। মায়ের কাছেই বলতো। আর তার মায়ের কাছ থেকেই আমরা জানছি। আমি তখনই তোর বড়মামীরে সাবধান করে দিছিলাম, এই মেয়ের দিকে নজর রাখতে। সুন্দরী মেয়ে অন্য বাসাতেও আছে। শুধু এই বাসাতেই সুন্দরী পয়দা হয়নি। কিন্তু এই মেয়ের পিছে যেন মৌমাছির ঝাঁক লেগে থাকতো সবসময়! আরে! মধু চুইয়ে চুইয়ে পড়লে মৌমাছির ঝাঁক তো ভনভন করবেই নাকি?’

আমি আর কিছু বলতে গেলাম না। বুঝতে পারলাম, নানীর চুল সত্যিই এমনি এমনি পাকেনি!

সুরমার জামিন কয়েকদফা নামঞ্জুর হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত কোর্টের দয়া হলো।

আপাতত কারামুক্তি ঘটলো সুরমার। এর মধ্যে সুরমার উকিলসাহেব প্রায় প্রতিমাসেই একবার করে জামিনের আবেদন করেছেন। আলামত আসামীর দখলে থাকায় এবং তার কাছ থেকেই সেই আলামত উদ্ধার হওয়ায় পূর্বের সব আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। শেষ পর্যন্ত চার্জশীট গৃহীত হয়ে মামলা বিচারিক আদালতে বদলি হওয়ার পর সুরমার উকিলসাহেব এবং আরেকজন স্থানীয় ব্যক্তির জিম্মায় সুরমাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হলো।

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। বড়মামা ফোনে জানালো, জামিনের আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। আজ সুরমাকে বাসায় আনতে পারবে। বড়মামা আর ছোটমামা গিয়েছিল সুরমাকে আনতে।আমরা সবাই ধুকপুকে বুকে অপেক্ষা করে বসে আছি। বড়মামী এক মনে দোয়া ইউনুস পড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শিশুর মতো গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘আচ্ছা, জামিনের আবেদন মঞ্জুর করার পরেও আবার না মঞ্জুর হয়ে যায় না তো? জানিস কিছু নীরা?’

আমি এটা সেটা বলে বড়মামীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে চলেছি। মায়ের মন… মেয়ে না ফেরা অব্দি আশ্বস্ত হয় কীভাবে?

নয়ন আর সুজনও আজ সকাল থেকেই বাসাতে বসে আছে। এতদিন পরে ওদের সুরমা আপা বাসায় ফিরছে! দুজনেই একটু উত্তেজিত। সুজন এখন অনেকটা স্বাভাবিক। নিয়মিত পড়ার টেবিলে বসতে দেখা যায়। অনাহুত বন্ধু বান্ধবদের উপস্থিতিও তেমন একটা চোখে পড়ে না আর। ছোটমামা আর মামী এতদিনে এসে ছেলের দিকে ঠিকঠাক মনোযোগ দিতে শুরু করেছেন।

শুধু সুনেত্রা একটু যেন ম্রিয়মান হয়ে বসে আছে। কেমন একটা ঝিম মারা ভাব। আমি হালকা গলায় বার কয়েক জিজ্ঞেস করেছি, ‘কীরে সুনেত্রা! এতদিন পরে তোর সুরমা আপু বাসায় আসছে! আর তুই এমন মনমরা হয়ে আছিস? কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?’

সুরমা নিরাসক্তের গলায় বললো, ‘নাহ শরীর ঠিকই আছে। আর আপা বাসায় আসছে…এটাতে কি আমাদের গায়ে লেগে যাওয়া দাগটা মুছে যাবে নীরাপা? যে কালি গায়ে লেগেছে তা আর হাজার চেষ্টাতেও মুছবে না!’

আমি মন খারাপ করে সুনেত্রার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই মনোভাবটা কেমন যেন গেঁড়ে বসে গেছে ওর মধ্যে। ইদানিং সুনেত্রা খুব কথা শিখেছে। এমনিতে কথা এখনো কমই বলে, কিন্তু যখন বলে একেবারে ছেড়ে বলে না!

সুনেত্রা এই সাতটা মাসে অনেকটাই পালটে গেল! সেই আগের সুনেত্রাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পড়াশুনা করে ঠিকই, কিন্তু আগে যেমন মন লাগিয়ে পড়তো সেই মনোযোগটা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। যেন করতে হয় তাই করে। এর বেশিকিছু না! আগের সেই সম্ভাবনাময়ী সুনেত্রাকে এখন একজন গড়পড়তা ছাত্রী বলেই চালিয়ে দেওয়া যায়।

আমি প্রথম দিকে ওর এইমনোভাব পাল্টানোর অনেক চেষ্টা করেছি। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছু বুঝিয়েছি। একজনের পাপের বোঝা আরেকজন কেন বইবে? সুরমার ভুলের খেসারত সুরমাকেই দিতে হবে। সুনেত্রা কেন শুধু শুধু নিজের জীবনটাকে এভাবে নষ্ট করছে?

কিন্তু আমার বোঝানোতে তেমন একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয়নি। চুপচাপ শান্ত স্বভাবের মেয়েটা ভেতরে ভেতরে অসম্ভব গোঁয়ার। আমার কথা শেষ হতে শুধু ছোট্ট করে বলেছে, ‘তাহলে তুমি আর নয়ন কেন তোমাদের মা-বাবার ভুলের মাশুল দিচ্ছো নীরাপা? তোমরা তো কোনো পাপ করোনি!’

এই কথার পরে আর কী বলবো মাথায় আসেনি।

আজকের দিনটাতেও সুনেত্রাকে নিরাসক্ত মুখে বসে থাকতে দেখে মনটা খারাপই হয়ে গেল। কিছু কিছু দাগ হয়ত সত্যিই আর মুছবে না কখনো!

হঠাৎ নয়ন এসে খবর দিলো, ‘সুরমা আপা এসেছে। রিক্সা থেকে নামছে ঐ যে!’

আমরা সবাই মিলে হুড়মুড় করে ড্রইংরুমের বারান্দায় গেলাম। এখান থেকে বাইরের গেটটা পরিষ্কার দেখা যায়। সুরমা রিক্সা থেকে নামছে। বড়মামাও বসে আছে ঐ রিক্সায়। ছোটমামা আরেকটা রিক্সা থেকে নামছে। রিক্সা থেকে নামতে গিয়ে সুরমা বুঝি একটু টলে গেল। ছোটমামা চট করে এসে সুরমার হাতটা ধরলো। দৃশ্যটার মধ্যে কেমন যে একটা অসহায়ত্ব মিশে ছিল, ঠিক বোঝাতে পারবো না। সাত মাস আগের সেই সুরমাকে চট করে একবার কল্পনা করে নিলাম। উদ্ধত তেজোদীপ্ত দাম্ভিক সেই সুরমার সাথে এই নুয়ে পড়া অঋজু শারীরিক অবয়বের সুরমার কোনোই মিল নেই! এ যেন রূপকথার বইয়ে পড়া সেই সুয়োরাণী আর দুয়োরাণীর বাস্তব উদাহরণ। সুয়োরাণী হারিয়ে গেছে। তার জায়গায় ফিরে এসেছে দুয়োরাণী।

দৃশ্যটা দেখে জানি না কেন, বুকের ভেতরটা একটু মোচড় দিয়ে উঠলো। যদিও আমি ঋষি মুনি টাইপের কেউ নই। মনে মনে এখনো সুরমার সেই ঔদ্ধত্য মনে করে গা গরম হয়ে ওঠে আমার। তবু এটাও না ভেবে পারি না, সুরমার শাস্তিটা হয়ত বড্ড তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। আরেকটু সুযোগ বুঝি দেওয়া যেত সুরমাকে।

বড়মামী আবার সেই খুনখুনে কান্নাটা শুরু করে দিলো। আজকে আর একেবারেই এই কান্না শুনতে মন চাইছে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, আজকে সারাদিন ধরেই এই কান্নাকাটি চলবে!

ঘরে ঢুকে সুরমা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। অনেক শুকিয়ে গেছে সুরমা। গায়ের রঙটাও কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেছে! মাথার চুলগুলো পাট করে পেছনে একটা ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে রাখা। চুলের ঘনত্বও অনেক কমে গেছে। সিঁথিটা অনেক বেশি চওড়া আর সাদামাটা। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে প্রাণহীন। ঝলমলে উজ্জ্বল যে চোখের তারা দেখে এসেছি এতদিন, তার সাথে এ যেন একেবারেই বেমানান! সুরমা ঘরে এসে ঢুকতেই আমরা প্রত্যেকেই কিছুক্ষণের জন্য কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেলাম।স্তব্ধতা কাটতেই বড়মামী জড়িয়ে ধরতে গেল সুরমাকে।

সুরমা ঝ্যাত করে হাতটা সরাতে সরাতে বললো, ‘ধুর সরো তো! এই গরমে এভাবে জড়ায়ে ধরতে আসবা না!’

বড়মামী কাচুমাচু হয়ে হাত সরায়ে নিলো। আমরা কেউই আর আবেগ দেখানোর কোনোরকম সুযোগ নিতে গেলাম না। সুরমা আমাদের পাশ কাটিয়ে গট গট করে ঘরে ঢুকে গেল।

কিছুক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম সবাই। ভেবেছিলাম, সুরমা হয়ত ফিরে এসে খুব কান্নাকাটি করবে। নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবে। কিন্তু সেসব কিছুই না হতে দেখে আমরা সবাই বিশেষ করে আমি একটু চুপসে গেলাম।

ছোটমামা সবাইকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে ফিসফিস করে বললেন, ‘একটু সময় দাও ওকে। এখনই টানাটানি করো না। এতদিন পরে সবে বাসায় এলো…মনের অবস্থা কেমন বুঝতেই তো পারছো সবাই। ওকে ওর মতো থাকতে দাও। এ্যাই… নয়ন সুজন তোরা যেন সুরমা আপুকে জ্বালাবি না একদম, বুঝতে পেরেছিস?

ছোটমামা সুনেত্রার দিকে চাইতেই সুনেত্রা বলে উঠলো, ‘আমি কাউকে জ্বালাবো না। তোমরা এখন বসে বসে উনার যত্ন আত্তি করো। মা…আমি একটু বের হবো। কলেজে দরকার আছে!’

বড়মামী ধরাগলায় বললো, ‘এখন কেন কলেজে যাবি? এতদিন পর বড়বোনটা এলো! আজকেও তোর কলেজে যেতে হবে?’

‘হ্যাঁ যেতে হবে। বড়বোন কোনো যুদ্ধজয় করে ফেরেনি যে তার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে হবে! তোমরা আছো, সেবা শুশ্রুষা করার। আমি না থাকলেও চলবে!’

সুনেত্রা আর একটাও কথা না বলে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

আমি দিকভ্রান্তের মতো একবার এর মুখে আরেকবার ওর মুখের পানে চাইছি। বড়মামী কেমন যেন বোকার মতো মিইয়ে গেছে। নানীর মুখভাব ঠিক বুঝতে পারছি না। সুজন আর নয়ন অবস্থা বেগতিক দেখে নিজেদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। ছোটমামী সবকিছু দেখছে কিন্তু কোথাও যেন তার মন নেই। তিনি যেন অন্য ভুবনে নিজের খেয়ালে বসে আছেন।

আমি আমার মনের অবস্থা যাচাই করে নিতে চাইলাম। সুরমা ঘরে ঢুকেছে। তবু আমার এখন ওঘরে ঢুকতে মন চাইছে না। কী জানি, পুরনো সেই সুরমাকেই দেখতে পাবো কী না কে জানে!

মনের মধ্যে এতদিন একটা আশার আলো জ্বালাতে চেয়েছিলাম সুরমাকে নিয়ে। একটা জীবনে নিজের দোষে অনেকখানি পথ ভুল পথে ঘুরপাক খাওয়া হলো। হয়ত পথের শেষে এজন্য মাশুলও গুনতে হবে কড়ায়গণ্ডায়। কিন্তু তবুও যাতে গন্তব্যটাতে ফেরা হয়। হোক কিছুটা দেরি, না হয় পথের সাথীরা ইতিউতি সরেই যাক…তবুও যাতে গন্তব্যটা একই থাকে।

আমার সেই আশাটা কি পূরণ হবে না?

(৩৭)

সুরমা বাসায় ফেরার পর একমাস পার হয়ে গেছে।

প্রতিমাসে একবার করে হাজিরা দিতে হচ্ছে ওকে। আগের চেয়ে অনেক বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে সুরমা। ডাকাডাকি করলে সহজে সাড়া দিতে চায় না। অনেকগুলো কথা বললে হঠাৎ কখনো দু’চারটার উত্তর দেয়। প্রথমদিন ওর সেই উদ্ধত ভাবটা দেখে যে ভয় পেয়েছিলাম, তা একটু একটু করে কাটতে শুরু করেছে। সুরমা সত্যিই আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। ওর চোখেমুখে এখন কেমন যেন একটা ত্রস্ততা, ভীতু হরিণশাবকের মতো আহত করুণ চাহনি। কেউ জোরে একটা শব্দ করলেও চমকে তাকায়।

প্রায় প্রতি রাতেই ঘুমের মধ্যে এটা সেটা বলে চিৎকার করে ওঠে। পাশে শুয়ে থাকা আমি ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে জেগে উঠি। নাম ধরে অনেকবার করে ডাকি। বিছানার পাশে একটা সাইডটেবিলে পানির গ্লাস আর জগ রেখেছি। কয়েক ঢোঁক পানি খাইয়ে দিই। সুরমা ফ্যাল ফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো কখনো চোখের কোলে অশ্রুকণা চিকচিক করে ওঠে। আমার বুকের ভেতরে কীসের একটা মায়া জন্মায়। আহা! বোনটা আমার! কত সুন্দর নিটোল একটা জীবন হতে পারতো! অথচ কী হলো! কার দোষে? নিজেরই দোষে তো! জীবনের ছক কষতে কেন যে মানুষের এত ভুল হয়!

সুনেত্রা কিছু দেখেও দেখে না। আসার পর থেকে দুইবোনের মধ্যে দুএকটা কথাও বলতে শুনিনি।

এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা ঘটেছে। সুমনবাসায় এসেছিল একদিন।

সুরমার বাসায় ফেরার খবর ওকে বলতেই কাঁচুমাচু মুখে বললো, ‘ইয়ে নীরা, আমি যদি একদিন তোমাদের বাসায় যাই, সবাই কি এতে মাইণ্ড করবে?’

আমি অবাক। একটু অদ্ভুত চোখে তাকালাম সুমনের দিকে। এমন প্রস্তাব ওর কাছ থেকে আসবে, এটা সত্যিই আশা করিনি। একটু যেন দুঃখও বোধ হলো। সুরমা আসার খবর শুনেই কি সুমনের মনে পুরনো সুখের দিনগুলো রিনরিনিয়ে উঠলো? সুরমা ওর প্রথম প্রেম। লোকে বলে, প্রথম প্রেম নাকি কিছুতেই ভুলতে পারা যায় না। অভিমানের বাষ্প জমে তাতে শক্ত পরত পড়ে গেলেও সেই প্রেম লুকিয়ে থাকে অনেক গভীরে। কখনো কখনো সাদাচোখে সেটাকে দেখাও যায় না।

বুকের মধ্যে একটু যেন জ্বলতে লাগলো আমার। বুঝতে পারলাম, দুঃখবোধ নয়, যাতে আক্রান্ত হয়েছি তার নাম ঈর্ষা। ভালোবাসার মানুষ এখনো পুরনো ভালোবাসার কথা ভেবে মনঃকষ্টে ভোগে… এটা নিশ্চয়ই আমার মনঃকষ্ট বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট!

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমন ফিক করে হেসে দিলো। সেই হাসি দেখে আমার বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটা আরো বেড়ে গেল।সুদর্শন প্রিয় মানুষের সুন্দর হাসি দেখলেই ভুলে যাবো, এই সত্যিটা তো সে জেনেই বসে আছে এতদিনে!

সুমন হাসতে হাসতেই বললো, ‘ওহ! আচ্ছা তুমি কি ভাবছো, আমার পুরনো প্রেম আবার জেগে উঠলো কী না? হা হা হা… না না সেই সুযোগ আর নেই। একবারেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে। ভয় নেই গো! আমি শুধুমাত্র তোমারই এখন! মানবিকতার খাতিরেই একবার দেখা করতে আসতে চাইছিলাম। মানুষে মানুষে সবকিছুর ওপরেও তো আরেকটা সম্পর্ক থাকে। সেই সম্পর্কের নামই তো মানবতা। তাছাড়া ভবিষ্যতে তো তোমাদের বাসার সাথে আত্মীয়তা জুড়তেই চাচ্ছি! এই সুযোগে রথদেখা আর কলাবেচা দুটো কাজই করে আসা যাবে! কী বলো ভুল কিছু বললাম?’

আমি লাজুক মুখে মাথা নামালাম। নিজের মনটাকে এমন উদগ্রভাবে প্রকাশিত হতে দেখে নিজের কাছেই সহজ হতে পারছিলাম না। ছিঃ ছিঃ! কী ভাবলো সুমন? ও কীভাবে আমাকে এমন পরিষ্কারভাবে পড়ে ফেলতে পারছে? ভালোবাসার গাঢ়ত্ব বাড়লে নাকি এমনটা হয়। এরমধ্যেই কি ও আমাকে এতটা ভালোবাসতে পেরেছে?

আমার বাবা-মায়ের সেপারেশনের বিষয়টা সুমনের কাছে আদ্যোপান্ত গল্প করেছি। ও শুনতে চায়নি আগ বাড়িয়ে। হয়ত সুরমার কাছ থেকেই কিছুটা ধারণা পেয়েছিল। আমি সেই ধারণাকে ওর নিজের মতো করে ডালপালা গজাতে দিইনি। যা সত্যি তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছি। বলতে যে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, সেটাও বুঝতে পারছিল সুমন। বেশ কয়েকবার থামিয়েও দিতে চেয়েছে মাঝপথে। কিন্তু আমি থামতে দিইনি নিজেকে। পুরোটা বলার পরে শেষ করেছি এই বলে, ‘আজ পুরোটা শুনে নাও। যেন ভবিষ্যতে তোমাকে এই বিষয়ে আর কিছু বলার না থাকে আমার!’

আমাদের মেডিক্যাল কলেজের অনেকেই এখন সুমন আর আমার সম্পর্কের ব্যাপারটা জানে। আড়াল থেকে সুমনকে দেখে বান্ধবীদের মুখে গল্পের তুবড়ি ফুটেছে। ‘আরেব্বাস! এই আমিরখানকে কই থেকে পেলিরে নীরা? আমাদের জন্য আমির খান না হোক, একটা আরবাজ খানটান পারলে জুটিয়ে দে না!’

সুমন আমার কলেজের বন্ধু শুনে একেকজনের চক্ষু চড়কগাছ। দুনিয়ার টিপ্পনি কাটতে কাটতে বলেছে, ‘আরেব্বাবা! তলে তলে এত! তোকে দেখে তো মনে হয় এক্কেবারে ধোয়া তুলসিপাতা। ভাজা মাছটিও উলটে খেতে পারিস না! এদিকে কাঁটাশুদ্ধু পুরো মাছ খেয়ে বসে আছিস! সেই কলেজ লাইফ থেকেই এসব চলছে? আমরা ভেবেছিলাম বইয়ের পাতা থেকে চোখ ওঠানোরই সময় পাসনি বুঝি!’

আমি ওদের টিকা টিপ্পনিতে হাসি। কিছু বলতে গিয়েও বলি না। থাক, সব কথা সবাইকে বলে বেড়ানোর কী দরকার? ওরা যা ভাবছে ভাবুক না!

সুমনকে নিয়ে একদিন বাসায় এলাম।

ক্লাস শেষ করেই এসেছিলাম দুজন। বিকেল হয়ে গেছে। বাসায় এসে দেখলাম, বড়মামা ছোটোমামা দুজনেই বাসায় চলে এসেছে। বাইরের ঘরে বসে কী যেন আলাপ করছে দুই মামা। আমাকে একটা ছেলের সাথে বাসায় ঢুকতে দেখে মামাদের চোখে আপনাআপনি একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন এসে জুড়ে গেল। আমার কেমন জানি লজ্জা লজ্জা করছিল। সুমন যদিও আজ সুরমার সাথে দেখা করার অযুহাতেই বাসায় এসেছে, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি বুঝি নিজের পাত্র দেখাতে নিয়ে এসেছি। রিক্সায় করে আসার সময় পইপই করে এটা সেটা শেখাতে শেখাতে এনেছি।

‘শোনো অযথা সবার সামনে বেশি কথা বলবে না, বুঝলা? আর একেবারেই ক্যাল ক্যাল করে হাসবা না! এই যে…এভাবে তো একদমই তাকাবা না কারো দিকে! মুখে একটা গাম্ভীর্য ধরে রাখার চেষ্টা করবা। দেখে যাতে মনে হয়, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছেলে। ওহ ভালো কথা, সবাইকে কিন্তু সালাম দিবা বুঝেছো? নানীকে তো দিবাই, দুইমামীকেও সালাম দিবা।’

সুমন গম্ভীরমুখে বললো, ‘ইয়ে…পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবো নাকি শুধু আসসালামু আলাইকুম বললেই হবে?’

আমি উত্তর দিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, মজা করছে। বাকি পথ গাল ফুলিয়ে এলাম। সুমন মান ভাঙ্গানোর নানারকম চেষ্টা তদবির চালিয়ে গেল। কিন্তু আমি পুরো পথে নিজের ‘ব্যক্তিত্ব’ সটান বজায় রাখলাম। সুমন নিজের কানে হাত দিয়ে বলতে বলতে এলো, ‘এই যে এই দেখো আর মজা করবো না। কানে ধরেছি দেখো দেখো! আরে বাবা, আমি তো একটু কনফিউজডও হয়ে আছি। প্রথমবার যাচ্ছি তোমাদের বাসাতে। কী না কী করে বসি! শেষে ইমেজ খারাপ হয়ে গেলে তো আমারই বিপদ!’

আমি দুইমামার দিকে তাকিয়ে যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভাব বজায় রেখে বললাম, ‘ইয়ে…মামা ও হচ্ছে আমাদের কলেজফ্রেণ্ড সুমন। ডেন্টালকলেজে পড়ে। সুরমাকেও চিনতো। সুরমা বাসায় এসেছে শুনে দেখা করতে এসেছে।’

এটুকু বলতেই আমার কানমাথা একেবারে গরম হয়ে গেল। মনে হচ্ছে দুই কান দিয়ে ভোঁস ভোঁস করে বাষ্প বেরুচ্ছে। না জানি, মামারা কী মনে করলো! এত তাড়াতাড়ি তো মামারা কেউওই বাসায় ফেরে না! আজকেই তাদের বাসায় এসে বসে থাকতে হবে?

বড়মামী ডাইনিং টেবিলে বসে আপেল কাটছিল। আমাদের দুজনকে দেখেই জিজ্ঞাসু মুখে আমার দিকে তাকালো। আমি একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। সুমনের ব্যাপারে বড়মামীকে বেশ অনেকদিন আগে একবার বলেছিলাম। বলেছিলাম সুরমার পাত্র হিসেবে উল্লেখ করে। আজ তো ভিন্ন পরিস্থিতি। কাজেই আজ ওকে কীভাবে পরিচয় করিয়ে দিব সেটাই ভাবতে লাগলাম।

বড়মামী কিন্তু নিজে থেকেই সুমনকে চিনতে পারলো। কীভাবে চিনলো আমি জানি না। আমার দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল মুখে বললো, ‘নীরা… ও সুমন তাই না? ঐ যে তুই একবার বলেছিলি ওর কথা! তা বাবা তুমি এসেছো আমি তো ভাবতেই পারছি না! সুরমার সাথে দেখা করতে এসেছো?’

আমার সর্বাংগ বেয়ে কেমন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। বড়মামী কি অন্যকিছু ভেবে বসলো? সুমন আর সুরমার ব্রেকয়াপের বিষয়টা কি বড়মামী জানতো না? বিপ্লবের সাথে দিনেদুপুরে ঘুরে বেড়িয়েছে সুরমা। এই বাসার সামনে থেকেই বিপ্লব ওর হোণ্ডার পেছনে উঠিয়ে নিয়ে গেছে সুরমাকে। একদিনও কি এসব বড়মামীর চোখে পড়েনি? আজ সুমনকে দেখেই বড়মামী কীসের আশায় এমন খুশি হয়ে উঠলো?

নিজের মনকে তিরস্কার করলাম। খুব বেশি চিন্তা করে বসে আছি। বড়মামী হয়ত কিছু না ভেবেই কথাগুলো বলে ফেলেছে। এতদিনে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি, আমার এই বড়মামী মানুষটা একেবারে বোকাসোকা। খুব বেশি কুটিল বা জটিল স্বভাবের মানুষ নয়। অতকিছু ভেবেচিন্তে কথা বলতে পারে না। সেজন্য অবশ্য প্রায়ই তাকে ধরা খেতে হয়। নানীর অল্পবিস্তর বকাঝকা মাঝে মধ্যে বড়মামীকেই খেতে দেখেছি। ছোটমামীকে নানীও একটু এড়িয়ে চলে।

আমি সুমনের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, সে একটু বিব্রত মুখে অপেক্ষা করছে। অতএব ত্রাণকত্রী হিসেবে আমাকেই মাঠে নামতে হলো। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললাম, ‘হ্যাঁ মামী, সুমন আমাদের সাথে কলেজে পড়তো। এখন ডেন্টালে পড়ছে। আমাদের মেডিক্যাল ক্যাম্পাসের সাথেই লাগোয়া ওদের ডেন্টাল ইউনিট। আমার সাথে দেখা হয় তো…সুরমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। তাই আমিই সুমনকে বাসায় বেড়াতে নিয়ে এলাম।’

আমার এত লম্বা চওড়া ফিরিস্তি শুনে বড়মামী কী বুঝলো জানি না। তবে বেশিকিছু আর বলতে গেল না। হাসিমুখেই বললো, ‘ভালো করেছিস নীরা। যাও বাবা…ঐ ঘরে সুরমা আছে। ও তো এখন বের টের হতে চায় না। ঘরের মধ্যেও হাঁটাচলা করে না একদম। সারাটা সময় নিজের ঘরেই বসে থাকে। কী সব চিন্তা করে…’

বড়মামীর গলাটা ধরে এলো। সুরমা সত্যিই এখন নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও যায় না। এমনকি খাওয়ার সময়টাতেও ওকে বলেকয়ে ডাইনিং রুমে নিয়ে আসা যায় না। প্রথমদিকে আমি বড়মামী নানী আমরা অনেক সাধ্যসাধনা করেছি। এখন আর কেউ চাপাচাপি করি না। হয়ত ও সবাইকে এড়িয়ে চলতে চায়। অযথা সবার মুখোমুখি হতে ওর ভালো লাগে না। তাছাড়া জেলখানার পরিবেশে হয়ত একটা অন্যরকম অভ্যস্ততা চলে এসেছে। সেটাকে ভাঙতে সময় লাগছে এখন।

সুমনকে নিয়ে আমাদের ঘরটাতেই ঢুকলাম। ঘরটা অগোছালো হয়ে ছিল। সুনেত্রা আগে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল। নিজের জায়গাটা ঝকঝকে তকতকে করে রাখতো। এখন সবকিছুতেই কেমন একটা গা ছাড়া ভাব। পরিষ্কার থাকলে থাকলো না থাকলে নাই, এমন একটা অবস্থা। আর আমি তো সকালে ঝড়ের বেগে ক্লাসে আসি। ছেড়ে আসা জামাটা পর্যন্ত চেয়ারের গায়ে ঝুলে থাকে। বিকেলে বাসায় ফিরে সবকিছু গোছগাছ করি। আর সুরমা তো এখন নিজের জগতেই নেই। ওকে আর কী বলার আছে?

সুমনকে এই অগোছালো ঘরে নিয়ে এসে লজ্জা পেলাম। প্রথমবার আমার থাকার জায়গাটা দেখলো। অথচ এইভাবে!

সুরমা বিছানাতেই বসে ছিল। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দুর্বোধ্য দৃষ্টি। আমি ভয়ে ভয়ে কাছে গেলাম। সুমনের দিকে তাকিয়ে দেখি, ওর দৃষ্টিতে বিস্ময় সমবেদনা দুঃখ সব মিলেমিশে একাকার। প্রথমবার এই বেশে সুরমাকে দেখে আমাদের সবার যেমনটা লেগেছিল আর কী!

সুরমাকে ধীরে ধীরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, ‘সুরমা দ্যাখ কে এসেছে। সুমন এসেছে তোকে দেখতে। তাকা সুরমা!’

সুরমা তাকালো। সুমনকে দেখে অল্প একটু হাসলোও বুঝি। বেশ অনেকটা স্বাভাবিক ভাবেই বললো, ‘ভালো আছো সুমন?’

আমি ওদেরকে একা রেখে বাইরে যাচ্ছিলাম। সুমন সিনেমাটিক ভঙ্গিতে পেছন ফিরে আমার হাত ধরে থামালো। ইশারায় বসতে বললো। কিছু কথাবার্তা হলো ওদের মধ্যে। আমি চুপচাপ নীরব শ্রোতার ভূমিকায় থাকলাম। কিছুটা স্পেস সব সম্পর্কের মধ্যেই থাকতে পারে। দিলাম না হয় আমিও কিছুটা স্পেস। এটুকু দেওয়াতে সুমন নিশ্চয়ই আমার পর হয়ে যাবে না!

বড়মামী ভালোই আপ্যায়ন করলো সুমনকে। অল্পসময়ের মধ্যেই তেলের পিঠা বানিয়ে আনলো। নানীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম সুমনকে। নানীও দেখলাম টুক টুক করে এটা সেটা গল্প করলো সুমনের সাথে। দুইমামা এসেও কিছুটা সামাজিকতা দেখালো। মোটকথা, আমাদের বাসাতে সুমনের প্রথমবারের আগমনটা ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো।

মামাদেরকে একটু যেন গম্ভীর মনে হলো আজকে। বুঝতে পারলাম না কী হয়েছে। কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেন যেন ভালো ঠেকলো না!

সুমন বিদায় নেওয়ার পর ঘরে ঢুকে দেখি সুরমা আবার নিজের জগতে ডুব মেরেছে। আমি আমার জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে যাব এমন সময় সুরমা বললো,

‘নীরা তোরা বিয়ে করছিস কবে?’

আমি চমকে সুরমার দিকে তাকালাম। তারপর খুব স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘এই তো…পাশটা করলেই আর দেরি করবো না সুরমা।’ 

তারপর কিছুক্ষণ থেমে থেকে আবার বললাম, ‘একটা ঘর বাঁধার যে বড্ড শখ আমার!’

(৩৮)

সেদিন রাতে খেতে বসেও দুইমামাকে অসম্ভব গম্ভীর মনে হলো।

অন্য দিন খাওয়ার টেবিলে এটা সেটা নিয়ে বেশ গল্পগুজব হয়। বিশেষ করে ছোটমামা তো চুপ করে খেতেই পারে না! হই হুল্লোড় করে খাওয়ার টেবিলে ঝড় তুলে ফেলে। এটা নিয়ে নানীর হাল্কা বকাঝকাও তাকে হজম করতে হয়। ‘চুপ করে বসে খা! মুখের মেশিন সারাক্ষণ চলতেই থাকে!’

আজ সেই ছোটমামাও কেমন চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়লো। ব্যাপারটা কমবেশি প্রত্যেকেরই নজরে পড়লো। কিন্তু কেউ কিছু বললো না। এত ঘটনার জন্ম হচ্ছে এই বাসায়! একজনের সামান্য মুড অফ নিয়ে কে মাথা ঘামায়?

খেয়ে উঠে যাওয়ার পরে সুজন এসে খবর দিলো, বড়মামা আমাকে ড্রইংরুমে ডাকছে। সাথে সাথে উঠে গেলাম। ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি, বিকেলের মতো গম্ভীরমুখে দুইমামা বসে কী নিয়ে জানি আলাপ করছে। আমাকে ঢুকতে দেখেই বড়মামা বলে উঠলো, ‘এই যে নীরা…আয় আয় মা এদিকে আয়। বস এখানে!’

আমার বিস্ময় বাড়ছে। বড়মামা আমাকে কেন এত আদর করে পাশে বসতে বলছে? কী হয়েছে? খারাপ কিছু? আমার মস্তিষ্ক থেমে নেই। মনে মনে ভেবে চলেছি কী হতে পারে!

বড়মামা আমাকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘নীরা, মনটাকে একটু শক্ত কর মা। তোকে একটা খারাপ সংবাদ দিব।’

আমার ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো। খারাপ সংবাদ! কীসের খারাপ সংবাদ? কার কী হয়েছে? মা-বাবার কিছু? কিন্তু তারা তো থেকেও নেই আমাদের জীবনে! কখনোই তাদের কোনো খবরই আমার কাছে পৌঁছায় না। অথবা আমি নিজেই সেই খবর পাওয়ার চেষ্টা করি না। জানি না, আমার কোনো খবর তাদের কাছে পৌঁছায় কী না! আজ হঠাৎ এতদিন পরে কী খবর শোনাতে যাচ্ছে বড়মামা?

আমি বললাম, ‘আমি শক্তই আছি মামা। বলো কী হয়েছে?’

‘তোর বাবা দুইদিন আগে ঢাকার একটা ক্লিনিকে মারা গেছে।’

আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কিছুটা সময় আমার আশেপাশে সবকিছু কেমন যেন নিঝুম হয়ে গেল। এমনকি আমি বাতাসের অস্তিত্বও টের পাচ্ছিলাম না। বুকের ভেতরে অক্সিজেনের জন্য এখনই বুঝি আকুতি শুরু হবে!

আমার বাবা মারা গেছে! আমার বাবা মারা গেছে…মারা গেছে…

মনে মনে অনেকক্ষণ ধরে বলে গেলাম বাক্যটা। এমন নয় যে, এই এতগুলো দিন মা-বাবাকে আমার খুব মনে পড়েছে। বরং দুজন মানুষ কেমন অদ্ভুতভাবে আমার জীবন থেকে নাই হয়ে গেল, এটা ভেবে নিজের কাছেই অজানা এক বিস্ময় জন্মাতো। নয়নও কখনো কিছু জিজ্ঞেস করতো না। অথচ এই বয়সের একটা ছেলে মায়ের কেমন ন্যাওটা হয়! তারা যেন বেঁচে থেকেও মরেই গিয়েছিল একরকম। বড়মামার কাছেই শুনেছিলাম বাবা নাকি আমার আর নয়নের খরচ দিতে চেয়েছিল। ব্যস ঐ পর্যন্তই! এর বেশিকিছু আমরা আর কখনো শুনিওনি…শুনতেও চাইনি!

আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে ছোটমামাও আমার আরেকপাশে বসে আমার হাতদুটো ধরলো।

আমার হাঁসফাঁস লাগছিল। শান্তগলায় বললাম, ‘আমি ঠিক আছি। তোমরা শুধু শুধু আমাকে নিয়ে ভাবছো!’

বড়মামা বললো, ‘আমাদের কাছে খবর এসেছে আজ দুপুরের পর। মারা গেছে দুইদিন আগে। আগে জানলে জানাজাটাতে অন্তত অংশ নিতে যেতাম! যেমনই হোক…যেভাবেই হোক, একটা আত্মীয়তা তো ছিল! অথচ সেই আত্মীয়তার কিছুই রক্ষা করতে পারলাম না!’

কিছুক্ষণ সকলেই চুপ। আমিই নীরবতা ভাঙলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে দিলো খবরটা? বাবার নতুন স্ত্রী?’

বড়মামা ঝট করে আমার দিকে তাকালো। কেমন অন্যরকম হয়ে আছে বড়মামার চোখমুখ। বললো, ‘তোর বাবা বিয়ে করেনি নীরা। তোর মা ই তোর বাবার একমাত্র স্ত্রী ছিল। তবে ছন্দা নামের একজন তোর বাবার একজন ভালো বন্ধু ছিলেন। হ্যাঁ উনিই আমাকে ফোন করেছিলেন আজকে। আর আজকে সকালেই উনার একটা চিঠি এসে পৌঁছেছে, তোর নামে। চিঠিটা তুই পেয়েছিস কী না সেটা জানতেই আমাকে ফোন করেছিল। তখনই খবরটা দিলো।’

আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। বিয়ে করেনি, কিন্তু ভালো বন্ধু ছিল! কেমন বন্ধু? জানি না সেই বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা আসলে কী! বাবা দুইদিন আগে মারা গেল, অথচ তার ছেলেমেয়েকে আজকে খবরটা দেওয়া হলো!

আমি বললাম, ‘এত দেরি করে খবরটা দেওয়ার কারণ কী? দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না নাকি?’ আমার গলার রুক্ষতায় নিজেই চমকে উঠলাম। আমার বাবা…আমার জন্মদাতা, যেমনই হোক আমার সেই জন্মদাতা…তার জন্যই আজ আমি সগর্বে পৃথিবীতে চরে বেড়াচ্ছি। সেই বাবা মারা গেছে… অথচ আমি দেরি করে খবর দেওয়া নিয়ে এত কর্কশ ভাষায় কথা বলছি!

বড়মামা ক্ষীণ দুর্বল গলায় বললো, ‘নীরা, তুই চিঠিটা পড়। ওতে সবকিছু লেখা আছে। আর…মা নীরা…বাবার ওপরে রাগ পুষে রাখিস না মা। পারলে ক্ষমা করে দিস মানুষটাকে। সেও তো শান্তিতে ছিল না। সবকিছুই হারিয়েছে। সোনার টুকরা দুটো ছেলেমেয়ে থাকতে পারতো তার, সুন্দর একটা সংসার থাকতে পারতো…অথচ মানুষটা সবকিছু থেকেও কাঙালের মতো জীবনটাকে পার করে দিলো!

বড়মামা আমার হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ আদর করলো। তারপরে দুই মামাই ড্রইংরুম থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় ড্রইংরুমের দরজা ভেজিয়ে দিতে ভুললো না। আমি ঘরে বসেও শুনতে পেলাম, বড়মামা ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে বলছে… ‘এখন ও ঘরে কেউ যেও না!’

আমি হাতে ধরা খামটার দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। সাদা আড়ম্বরহীন একটি খামের ভেতরে লেখা চিঠিটা আমারএতদিনের জ্বালা যন্ত্রণাকে নতুন করে আর কতটুকু বাড়াবে? বাবা তো কবেই আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে! আজ আবার নতুন করে কী হারাবো তাকে?

আমি মনে করেছিলাম, চিঠিটা হয়ত বাবার লেখা। নাটক সিনেমায় এমন কত দেখেছি! একজনের মৃত্যুর পরে তার নিজের হাতে লেখা কোনো চিঠি আমানত হিসেবে আরেকজনের কাছে থেকে যায়। সেই চিঠি অর্থাৎ আমানত মৃত ব্যক্তির প্রিয়জনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থাকে। এই দুঃসময়েও হাসি পেল! আমি আমরা কি সত্যিই আমাদের মা-বাবার প্রিয় কেউ ছিলাম? যদি তাই হতো, তারা যেকোন মূল্যেই আমাদের পাশে রাখতে চাইতো। এভাবে আমাদের দূরে সরে যেতে দিতো না। নিজেরাও আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যেত না।

চিঠিটা খুললাম। প্রথমেই চোখ চলে গেল শেষের অংশে। ছন্দাআন্টির লেখা চিঠি। সেই ছন্দা আন্টি! যার বাসায় আসার খবর জানিয়ে বাবা আমাকে বিকেলের নাস্তা বানাতে বলেছিল।

‘নীরা,

এই চিঠিটা আমি লিখলেও তোমার বাবার অনুমতি নিয়েই লিখছি। তার অনুমতি না পেলে এই খবরটা হয়ত তোমাকে আমার কোনোদিনই জানানো হতো না। শুধু একটা প্রতিজ্ঞা তিনি আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন। তার জীবদ্দশায় যেন কোনোভাবেই এই চিঠি তোমার কাছে না পৌঁছায়। কারণ তোমার বাবা কিছুতেই তোমার মুখোমুখি হতে চাননি। সেই সাহস তার ছিল না।

আজ সকাল দশটার সময় তোমার বাবা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। ষাট বছরের একটা জীবন একেবারে সাদামাটা করুণভাবে শেষ হয়ে গেল। দুই সন্তানকে দেখার প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ একা বেওয়ারিশের মতো দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হলো। হ্যাঁ… আমি পাশে ছিলাম অবশ্য। আমি আর আমার স্বামী শেষ সময় পর্যন্ত তার পাশে ছিলাম। কিন্তু আমরা আর কে ই বা ছিলাম তার? রক্তের বন্ধনে জুড়ে রাখা মানুষগুলো থেকেও থাকলো না তার পাশে!

আমি বুঝতে পারছি নীরা, আমার স্বামীর কথা শুনে তুমি খুব অবাক হয়েছো। কারণ তুমি এতদিন জানতে, তোমার বাবার সাথে আমার একটা সম্পর্ক ছিল। এটাও জানতে তিনি আমাকে বিয়ে করতে চলেছেন। তুমি এটা জানতে, কারণ তোমার বাবা এটা তোমাকে জানিয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন তুমি এমনটাই জেনে তোমার বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যাও। তোমাকে আর নয়নকে তিনি নিজে ইচ্ছে করে তোমার মামার বাসায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। সবকিছু খুলে বললে হয়ত তুমি কিংবা নয়ন তোমরা কেউই তোমার বাবাকে ছেড়ে যেতে চাইতে না। তাই জেনেবুঝেই এই মিথ্যাটুকুর আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল।

একদিন হুট করেই তোমার বাবা অফিসে আমাকে এমন একটা সাজানো নাটকে অংশ নিতে বলেছিলেন। আমি কিছুতেই তোমার বাবার এমন অদ্ভুত প্রস্তাবে রাজি হতে চাইছিলাম না। তিনি আমার বাসায় এসে আমার স্বামীকে পর্যন্ত রাজি করিয়েছিলেন যাতে আমি এই সাজানো খেলায় অংশ নিই। এটা নাকি তার জন্য নয়, তার ছেলেমেয়ের জন্য খুব প্রয়োজন। কারণ তোমার বাবা জানতেন, তোমার মা তাকে পছন্দ করেন না। তিনি একদিন না একদিন নিজের জীবনের কথা ভেবে তোমাদের কাছ থেকে দূরে চলে যেতেন। সেই দিনটা যখন সত্যি সত্যি চলে এলো, তখন তোমার বাবা তার কর্তব্য স্থির করে নিয়েছিলেন।

বুঝতে পারছি অনেক প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে তোমার মনে। একে একে উত্তর দিই। এসব বলতে খুব খারাপ লাগবে আমার। তোমার শুনতে কতটা খারাপ লাগবে কল্পনা করতে পারছি। তবুও বলতে তো হবেই। কারণ সবকিছু জেনে হয়ত তোমার মনে তোমার বাবার প্রতি একটুখানি হলেও ক্ষমা জন্ম নিতে পারে। সেটুকুর আশাতেই এই কলম তুলে নেওয়া।

তোমার বাবা তার জীবনে একবার একটা মস্ত বড় ভুল করেছিল। ঐ একটিমাত্র ভুলই গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তোমার বাবার জীবনটাকে।

তুমি তখন অনেকটা বড় হয়ে গেছো। কিন্তু নয়ন তখন একেবারেই ছোট। তোমার বাবা একবার একটা খারাপ জায়গায় গিয়েছিল। সম্ভবত বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে অথবা শয়তানের প্ররোচণায়। হবে কিছু একটা। সেই একবারের গমনই তোমার বাবার শরীরে দাগ ফেলে গিয়েছিল। খারাপ একটা অসুখ ধরা পড়েছিল তোমার বাবার। ফলে বিষয়টা তোমার মায়ের কাছে গোপন থাকে না। তিনি এটা জেনে ফেলেন। তোমার বাবাই তার কাছে সব কথা অকপটে স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিল।

কিন্তু এই কথা জানতে পেরে তোমার মা মন থেকে তাকে আর ক্ষমা করতে পারেনি। হয়ত ক্ষমা করা এত সহজও নয়। এমন ভুল একটা মেয়ে যদি করে তাহলে কি তার স্বামী তাকে ক্ষমা করে? কখনোই না! তাহলে তোমার মাকে কীভাবে দোষ দেওয়া যায় বলো?

যাই হোক, এই ভুলের কারণেই তোমার বাবার জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। সিফিলিস ধরা পড়েছিল তার। চিকিৎসাও চলছিল। তোমার মা জানতে পেরে তোমার বাবার সংসর্গ পুরোপুরি ভাবে এড়িয়ে চলে। বুঝতেই পারছো কোন সংসর্গের কথা বলতে চাইছি।

চিকিৎসাতে অনেকেটা সুস্থ হয়ে এলেও পুরোপুরি সুস্থ তোমার বাবা কখনোই হয়নি। গত বছর মারাত্মক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন আমি আর আমার স্বামী অনেকটা জোর করেই তাকে একটা ক্লিনিকে ভর্তি করাই। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তোমার বাবা মারা গেলেন।

তোমার বাবার অসুখটা ধরা পড়ার পর থেকেই তোমার মা তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করতে শুরু করে। তোমার মায়ের ধারণা জন্মেছিল যে, তোমার বাবা হয়ত প্রায়ই খারাপ পাড়ায় যাতায়াত করে। সেজন্য তাকে সবসময় কটু কথা বলত তোমার মা।

এসব গল্প তোমার বাবাই আমার আর আমার স্বামীর কাছে করেছিল। আমাদের সাথে পারিবারিকভাবে উনার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নির্বান্ধব একজন মানুষের আমরাই ছিলাম একমাত্র বন্ধু। আমাদের বাসায় উনার আসা যাওয়া ছিল।

তোমার মা তোমার বাবাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল যে, নিজে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে তোমার বাবার ওপরে প্রতিশোধ নিবে। তোমার বাবা বুঝতে পেরেছিল যে, তোমার মা তার এই কথা সত্যি করেই ছাড়বে!

যেদিন তোমাদের বাসায় তোমার বাবার বন্ধু বেড়াতে এলেন, সেদিন তোমার বাবার আর বুঝতে বাকি রইল না যে সবকিছু সেই পথেই এগুচ্ছে। আর তখনই তোমার বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, তোমাকে আর নয়নকে তোমাদের মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিবে।

তারপর আশাকরি পরের অংশটুকু তুমি নিজেই বুঝতে পারছো।

তোমার বাবার মিথ্যা অভিনয়, আমার নাম উল্লেখ করে তোমার কাছে গল্প করা… সব কিছুই ছিল তোমার বাবার সাজানো পরিকল্পনার অংশ মাত্র।

গত একটা বছরে আমি তোমার বাবাকে অনেক অনুরোধ করেছিলাম যাতে তোমাদের কাছে সত্যিটা খুলে বলে। কিন্তু উনাকে রাজি করাতে পারিনি। তোমার বাবা কিছুতেই এসব কথা তোমার কাছে বলতে রাজি হয়নি।

হয়ত তোমার মনের অনেক প্রশ্নের উত্তরই তুমি এবারে পেয়ে গেছ নীরা। তোমার বাবা আজীবন তোমাদের পাশে চেয়েছেন। তোমাদের দুই ভাই বোনকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছেন। কখনোই তোমাদেরকে নিজের থেকে আলাদা করতে চায়নি। কিন্তু তোমার মায়ের সাথে অসুখী দাম্পত্যের রেশে তোমার আর নয়নের জীবনটা ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছিল দেখে তোমার বাবা এমন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল।

তুমি পড়ালেখায় ভালো করছো, মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছো এইসব খবরই তোমার বাবা পেয়েছে। তোমার বড়মামার সাথে মাঝে মাঝে কথা হতো তোমার বাবার। তিনিই এসব খবর তোমার বাবাকে দিয়েছেন। তোমার মামাবাড়ির প্রতিও তোমার বাবা অনেক কৃতজ্ঞ ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

এই তো…আমার চিঠি প্রায় শেষের পথে। আর কিছু বলার নেই। যা বলতে পারলাম না, তুমি বুঝে নিও নীরা। আমি জানি তুমি খুব মেধাবী একজন মেয়ে। আর খুব ভালো একজন মানুষ। তোমার মনের বিশুদ্ধতা নিয়ে তুমি সব পঙ্কিলতাকে জয় করতে পারবে…এমনটাই স্বপ্ন দেখেছিল তোমার বাবা।

যদি পারো, তোমার অপরাধী বাবাকে ক্ষমা করে দিও। সুখি হও জীবনে।

পুনশ্চঃ তোমার বাবার চিকিৎসা বাবদ অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। তবু যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তোমার বাবার ইচ্ছা মোতাবেক তোমার মামার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। টাকাটা তোমাদের প্রয়োজনে খরচ করলে হয়ত তোমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে।

ইতি

তোমার ছন্দা আন্টি

চিঠিটা ভাঁজ করে বিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। মাথার মধ্যে সব কেমন জট পাকিয়ে গেছে। যা পড়লাম, তাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আবার না বিশ্বাস করেও উপায় নেই। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একবার মায়ের কথা মনে হলো। ইচ্ছে করছে, মায়ের কাছে এর কৈফিয়ত দাবী করি। কিন্তু চুপসে গেলাম পরমুহূর্তেই। মাকেও বা দোষারোপ করি কোন মুখে? আমি নিজে যদি মায়ের জায়গায় থাকতাম, তাহলে কি পারতাম বাবাকে ক্ষমা করতে?

খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে বাবার খুব সুন্দর কিছু স্মৃতি মনে করে বুকটা উজাড় করে কাঁদি। কান্না দিয়ে ধুয়ে ফেলি জমে থাকা সবটুকু গ্লানি!

(৩৯)

ছন্দা আন্টির সাথে ফোনে কথা বলেছি।

আন্তরিক গলায় অনেকক্ষণ ধরে কথা বললেন ভদ্রমহিলা। বাবার অনেক অজানা কথা জানতে পারলাম তার কাছ থেকে। বার বার ক্ষমা চাইলেন, আরো আগে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি দেখে।

‘বিশ্বাস করো, আমার কিছু করার ছিল না। অনেক বুঝিয়েছিলাম তোমার বাবাকে। বলেছিলাম একটিবার সুযোগ নিতে। ভুল তো মানুষেরই হয়! ফেরেশতারা তো ভুল করে না। যে ভুল তোমার বাবা করেছিলেন, তার জন্য একটিবার তো ক্ষমার আবেদন করা যেত। আমি বুঝিয়েছি, আমার স্বামী বুঝিয়েছে…তোমার বাবা তার অবস্থান থেকে সরেননি। উনার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, এসব শুনলে তোমাদের মনে বাবার প্রতি যেটুকু মমতা আছে সেটুকুও হারিয়ে যাবে।’

নয়নকে বাবার মৃত্যুর খবরটা দিয়েছি। ও শুনে চুপ করে থেকেছে। নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না জানতাম, তাই আমিই রেখেঢেকে অনেক কথা বললাম। চেষ্টা করলাম বাবার একটা সুন্দর ছবি ওর মনে গেঁথে দেওয়ার। সেটাতে কতটুকু সফল হলাম, বলতে পারবো না। কিন্তু বুঝতে পারলাম, নয়ন আগ্রহ নিয়ে শুনছে।

মা-বাবার স্নেহবঞ্চিত দুজন মানুষ আমরা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা যেন জীবন নামের মহাসমুদ্রে স্রোতের টানে ভেসে চলেছি। কোথাও থেকে একটুখানি স্নেহ ভালোবাসা পেলেই সেটাকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরে তীরে ওঠার প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছি।

মা-বাবার স্নেহ ভালোবাসা কী জিনিস, সেটা অনুভব করার আগেই ভাগ্য নামের কোনো এক নির্দয় লুটেরার কাছে সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছি আমরা। তাই সেই লুটেরা যখন করুণাবশত কিছুমিছু ফেরত দিয়ে যায়, তখন নির্বাক তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না!

সুমনকে বলেছি সবকিছু। কিছুই চেপে রাখিনি। সব কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল সুমন। তারপর সান্তনা দেওয়ার ছলেই বলেছে, ‘তোমার বাবা কিন্তু ভুল সিদ্ধান্ত নেননি নীরা। আজ মামার বাসায় ছিলে বলেই হয়ত তোমার আর নয়নের জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায়নি। উনি যে দূরদর্শিতা নিয়ে কাজটা করেছিলেন সেটাকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই! হ্যাঁ…তার নিজের জীবনটা একেবারে এলোমেলো হয়ে গেছে। সেটাকে হয়ত ঠিক করার উপায়ও ছিল না!’

‘ছন্দা আন্টিকে মনে মনে কত খারাপ মানুষ বলে ভেবেছি। অথচ দেখো উনিই শেষ পর্যন্ত বাবার পাশে থাকলেন। আমরা… তার পরিবারের মানুষগুলোই তার খবরটুকুও রাখলাম না!’

আমার কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো। সুমন আলগোছে আমার হাতটা ধরলো। ভালোবাসার উত্তাপ গলায় মেখে বললো, ‘এখানে তো তোমারও কিছু করার ছিল না নী! নিজেকে শুধু শুধু অপরাধী মনে করার তো কিছু নেই!’

সুমন মাঝে মাঝে আমাকে ছোট করে নী বলে ডাকে। এত মিষ্টি লাগে ডাকটা!

আমার মনটাকে একটু অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যই আচমকা এক প্রস্তাব দিয়ে বসলো সুমন।

‘নী চলো, তোমাকে আমার মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই!’

আমি চমকে উঠলাম ওর কথায়। কী ভয়ানক কথা! আমি যাবো ওর মায়ের সাথে দেখা করতে? সর্বনাশ! কী জিজ্ঞেস করবে, না করবে কে জানে!

সুমনের বাবা নেই। ওর ছোটবেলাতেই সুমনের বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল। মা ই ওদের পরিবারের সর্বময় কর্ত্রী। সুমনের ছোটো একটা বোন আছে, কলেজে পড়ছে। ছিমছাম পরিবার। সুমনের কাছে গল্প শুনেছি, ওর মা খুব নিয়ম মেনে চলা মানুষ। কোনো জিনিসের অপচয় একদম সহ্য করতে পারেন না।যেখানে যতটুকু কথা বলা প্রয়োজন, তার বেশি একটা শব্দও খরচ করেন না।

বয়ষ্ক মহিলাদের টিভি সিরিয়াল দেখার ঝোঁক থাকে। বিশেষ করে আমাদের বাসার দুই মামী তো ইণ্ডিয়ান বাংলা সিরিয়ালের এক নাম্বার ভক্ত। সন্ধাবেলায় তারা কোনো কাজ হাতে রাখেন না। সব কাজ সন্ধার আগে আগেই শেষ করে দুই মামী ড্রইংরুম, টিভি ও টিভির রিমোট দখল করে বসে যায়। বড়মামা খবর দেখার জন্য ঘুরঘুর করতে থাকে। মুখে কিছু বলতে পারে না। আর ছোটমামা প্রতিদিন এসে কিছু সময় চেঁচামেচি করে যায়।

‘তোমাদের যন্ত্রণাতে দেখছি আরেকটা টিভি কিনতে হবে! খেলাধুলা, খবর কিছুই দেখতে পারি না!’

সেখানে সুমনের মা নাকি মোটেও সিরিয়াল দেখেন না! সারাক্ষণই বাসার এটা সেটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। যেটুকু সময় হাতে পান, সেই অবসর সময়ে বই পড়েন। সুমনের দুই ভাইবোনের বই পড়ার অভ্যাসটাও নাকি ওর মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া।

সুমনের প্রস্তাব শুনে আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাদের বাসাতে এখনো সুমন আর আমার সম্পর্কের বিষয়টা জানাইনি। সুরমার এমন একটা খারাপ সময় যাচ্ছে। মামলার শুনানির ডেট পড়ছে মাঝে মাঝে। মামারা উকিলের সাথে কথা বলে মুখ গোমড়া করে বসে থাকে বাসায়। আলামত সহ ধরা পড়া আসামী। ক্ষমা পাওয়ার কোনোই সুযোগ নেই। প্রতারণার শিকার হয়েছে, এমনটা প্রমাণ করারও ফাঁকফোকড় নেই। আসামী নাবালিকা নয় যে, এইরকম প্রতারণার ফাঁদে তাকে ফেলা যাবে।

কাজেই বাসার এইরকম পরিস্থিতিতে আমি একজনকে পছন্দ করে বসে আছি, এ’কথা বলা যায় না। কোথায় জানি বাঁধো বাঁধো ঠেকে।

সুমন আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললো, ‘তুমি কি আম্মার সাথে দেখা করার ব্যাপারে চিন্তা করছো? আম্মা এমনিতে কথা কম বলে তা ঠিক, কিন্তু ছেলের পছন্দের ব্যাপারে তার সায় আছে। চিন্তা করো না!’সুমন হাসিমুখে বললো। আমি বললাম, ‘তার মানে? তুমি কি বাসাতে জানিয়ে দিয়েছো নাকি?’

‘না, তা জানাইনি। তবে তোমাকে সাথে করে নিয়ে গেলে অন্যকিছু ভাবনার কি আর সুযোগ থাকবে? আমি নিশ্চয়ই প্রায়ই বান্ধবী নিয়ে বাসায় যাই না!’

‘কেন? সুরমাকে নিয়ে যাওনি?’ আমার হঠাৎ একটু খোঁচা মারতে ইচ্ছে হলো।

আমি আর সুমন মাঠে বসে আছি। সুমন আমার পাশে বসে বাদাম খাচ্ছিলো। এই কথা শুনে ধীরস্থিরভাবে আমার দিকে ঘুরে বললো, ‘শোনো আজ একটা কথা তোমাকে বলি। আমি আসলে যেকোনো সম্পর্কের ব্যাপারেই খুব সৎ। যখন সুরমার সাথে সম্পর্কে ছিলাম, তখনও ওর প্রতি সৎ ছিলাম। এখন তোমার প্রতি সৎ আছি। সুরমার সাথে সম্পর্কটা টেকেনি। কিন্তু সেজন্য যে এখনো ওর প্রতি সৎ আছি, বসে বসে ওর কথা ভাবি…এমন ভাবনা কিন্তু তোমার কিংবা আমার কারো জন্যই স্বাস্থ্যকর নয়!’

আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। সুমন মনে হলো আচমকা একটু সিরিয়াস হয়ে গেছে। মনে মনে কিছু একটা বলার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করছি এমন সময় সুমনই আবার বললো, ‘তুমি কি এটা ভেবে কষ্ট পাও যে, সুরমা আমাকে গলাধাক্কা না দিলে আমি কখনোই তোমার হতাম না?’

আমি অবাক। এতটা কঠিনভাবে কখনো ভাবিনি ঠিকই। কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও না কোথাও হয়ত ভাবনাটা লুকিয়ে আছে আমার। সেজন্যই মাঝে মাঝে ওকে এভাবে খোঁচা মারতে ইচ্ছে করে অথবা সুরমার ব্যাপারে ঈর্ষার জন্ম নেয়।

আবারও সুমনই বললো, ‘যদি এই ভাবনা তোমার মনে থেকে থাকে তাহলে আমি কিছু করতে পারবো না নীরা। কারণ আমি তো আর তোমার মনের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না! কিন্তু এই অসুস্থ ভাবনা তোমাকে কিংবা আমাকে কাউকেই ভালো থাকতে দিবে না!

আমরা হিন্দি মুভি দেখে শাহরুখ খানের ডায়লগ মুখস্থ করে বসে আছি— আমরা একবার জন্মাই, একবার মরি একবারই ভালোবাসি। এইসব ডায়লগ নাটক সিনেমার জন্য একেবারে পারফেক্ট, জীবনের জন্য নয়। মানুষের জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে। না চাইতেও অনেক দুর্ঘটনাও ঘটে যায়। সাজানো সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। এখন যার জীবনটা তছনছ হয়ে যায়, সে কি তার বাকি জীবনটা হাতপা গুটিয়ে বসে থাকবে? স্বপ্ন দেখার আর কোনোই অধিকার তার থাকবে না? বলো? তোমার কাছে কী মনে হয়?’

সুমনের এই লম্বা চওড়া ভাষণে আমি একেবারে নির্বাক হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম আজ একেবারে ভালোরকম জোরে আঘাতটা গিয়ে লেগেছে। সুমনকে এই পর্যন্ত কখনো রাগ করতে অথবা এত কথা বলতে শুনিনি। আজ আমার একটা কথাতে আঘাত পেয়ে অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছে সুমন।

আমি খুব অনুতপ্ত হলাম মনে মনে। বুঝতে পারলাম, অভিমানির মান ভাঙাতে হবে এবং সেটা এক্ষুণিই! বেশিকিছু আর না ভেবেই বলে ফেললাম, ‘চলো মার্কেটে যাই!’

সুমন হঠাৎ এই অদ্ভুত প্রস্তাবে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি চটপট বললাম, ‘বাহ, তোমার মায়ের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাবে বললে না? সালোয়ার কামিজ পরে গেলে কেমন দেখাবে? একটা শাড়িটাড়ি পরে গেলে ভালো হতো না? আমার তো নিজের কোনো শাড়িই নেই! মামীদের কাছে চাইতে গেলে অনেক কিছু ভেঙ্গেচুরে বলতে হবে! তার চেয়ে নিজে একটা শাড়ি কিনে ফেলি। বাসায় ফাংশন টাংশন কিছু একটার কথা বলে দিলেই হবে!’

নিজেই বুঝতে পারলাম, অত্যন্ত খোঁড়া যুক্তি। মামীদের কাছে চাইতে গেলে যা বলতে হতো এখনও তাই বলতে হবে। তবু আমি চাইছিলাম সুমনকে নিয়ে শপিং এ বেরুতে। খুঁজে খুঁজে ওর পছন্দের শাড়ি কিনতে। তাতে হয়ত কিছুটা হলেও ওর মনের এই গুমোট ভাবটা কাটতো!

আমার প্রস্তাবে সুমন কিন্তু সত্যি সত্যিই চাঙ্গা হয়ে উঠলো। যতটা না একসাথে শপিং করার কথা শুনে খুশি হলো, তার চেয়ে অনেক বেশি একসাথে খোলা রিক্সায় ঘুরে বেড়ানোর চিন্তায়। কলেজের বাইরে আমরা কোথাও তেমন একটা যাইনি বলতে গেলে। সেদিন আমাদের বাসায় যাওয়ার পথে দুজনে একসাথে রিক্সায় উঠেছিলাম। হুড তোলা রিক্সায় যেতে যেতে সুমন অকারণেই প্রচণ্ড প্রগলভ হয়ে উঠেছিল। জড়াজড়ি করে বসে থেকেও মন ভরছিল না। আমার হাতদুটোকেও যখন নিজের মুঠোয় নেওয়ার আবদার জানাচ্ছিল, তখন মেকি গাম্ভীর্য দেখিয়েছিলাম।

‘উহুঁ হাত ধরতে হবে না। আমার হাত সস্থানেই ভালো আছে!’

সুমন কপট কষ্টের ছাপ মুখে তুলে বলেছিল, ‘তুমি খুব বেশি নির্দয়া। মায়া দয়া একেবারেই নেই!’

‘উহুঁ যথেষ্ট আছে। আর বেশি মায়াদয়া দেখালে বিপদ হতে পারে!’

সেদিন রিক্সা আমাদের বাসার কাছে গিয়ে থামতেই সুমন বলেছিল, ‘যাহ! চলে এলাম! এত তাড়াতাড়ি!’

আজ আবার সেই রিক্সায় ঘোরাঘুরির প্রস্তাবে সুমনের খুশি না হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই। একটু আগের মন খারাপ ভাবটা নিমেষেই গায়েব হয়ে গেল। খুশি খুশি গলায় বললো, ‘চলো কোন মার্কেটে যাওয়া যায় বলো দেখি? ভালো কথা, শাড়ি যে কিনবা টাকা পয়সা কিছু আছে?’

আমার ব্যাগে গতমাসের টিউশনীর প্রায় পুরো টাকাটাই ছিল। ভাবলাম সস্তা দেখে একটা কিছু কিনে নিব। তাহলে বেশি খরচ হবে না। বললাম, ‘আছে, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না!’

শহরের প্রাণকেন্দ্রের একটা মার্কেটেই গেলাম। ঘুরে ঘুরে অনেকগুলো দোকানের শাড়ি দেখলাম। যে শাড়িই একটু পছন্দ হয়, সুমন সেটারই কিছু না কিছু খুঁত বের করে। ‘এটা কিনবা? একটু বেশি ম্যাড়ম্যাড়ে দেখাচ্ছে না?’ ‘উহুঁ! এটার রঙ তো একটু বেশিই ডার্ক!’ ‘এটা বেশি চকরাবকরা! পড়লে মনে হবে জঙ্গলে বসে আছো!’ এরকম নানাবিধ মন্তব্যে অতিষ্ঠ হয়ে বললাম,

‘আচ্ছা বেশ, কী শাড়ি কিনবো তুমিই পছন্দ করে দাও! এই আমি হাত গুটিয়ে বসলাম!’

সুমন মনে মনে সেটাই চাইছিল। অনেক পরে একদিন এই কথা আমাকে বলেছিলও সুমন। আমার প্রথম কেনা শাড়িতে সুমনের পছন্দের ছাপ থাকবে না, সেটা কিছুতেই হতে পারে না।

শেষমেষ কমলার ওপরে বেগুনি রঙের হাতের কাজ করা একটা জামদানি শাড়ি পছন্দ করলো সুমন। দামের ট্যাগটা দেখে গলা শুকিয়ে গেল। কী করবো মনে মনে ভাবছি। এত টাকা দিয়ে শাড়ি কিনে ফেললে মাসের শেষে হাতে আর কিছুই থাকবে না আমার। অবশ্য বাবার দেওয়া টাকাটাতে এখনো হাত দিইনি। কিন্তু ওটাতে শিগগিরই হাত দেওয়ার ইচ্ছেও নেই আমার। বিপদাপদের জন্য কিছু সঞ্চয় রাখাটা জরুরি।

বহুত দরদাম করে কিছুটা দাম কমানো গেল। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে পার্স খুলতে যাবো এমন সময় দেখি সুমনের টাকা দেওয়া সারা। আমি হৈ হৈ করে উঠলাম, ‘আরে এ কী! না না এমনটা তো কথা ছিল না!’

সুমন দোকানে একটা কথাও না বলে গম্ভীর মুখে শাড়ির প্যাকেট হাতে বের হয়ে এলো। তারপর একগাল হেসে আমার বেনি ধরে একটা টান মেরে বললো, ‘আমি এতক্ষণ দেখছিলাম, তুমি শাড়ি কিনে দেওয়ার বায়না করো কী না। সেজন্যই কিছু বলছিলাম না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যখন বায়না করোনি তখন বুঝতে পারলাম যে, আমার বউটা বেশি একটা বায়নাক্কা করবে না। যাক বাবা, বড় একটা ফাঁড়া কেটে গেছে!’

সুমনের কথা শুনে হাসলাম। বায়নাক্কা বুঝি তারাই করে, যারা আশেপাশে প্রচুর বায়না মেটানোর মানুষ পায়। আমার আর নয়নের জীবনে তেমন মানুষ ছিলই বা কোথায় যে যখন তখন বায়না করবো?

শাড়ি কিনেই বাসায় ফেরার তোড়জোড় করছি দেখে সুমনের মুখ ভার হলো।

‘বা রে! ক্লাস মিস করে এই এতদিনে একটু ঘুরে বেড়ানোর সময় পেলাম! আর তুমি কাজ হয়ে যেতেই চলে যাওয়ার ছুতো খুঁজছো!’

আমি ভয়ে ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম সুমনের সাথে। ছোট শহরে কার সাথে কখন যে দেখা হয়ে যায় কে জানে! ছোটমামা নাকি এখনো সুযোগ পেলেই অফিসের ফাঁকে বন্ধুদের সাথে ইতিউতি আড্ডা মারতে চলে আসে। যদি ছোটমামার সাথেই দেখা হয়ে যায়! কী একটা কেলেঙ্কারি হবে ভাবা যায়!

তবু সুমনের আবদার অনুযায়ী আজকে আরো কিছুক্ষণ ঘুরতেই হবে! এমনিতেই মনে আজ বড় দাগা দিয়েছি!

দুজনে একটা ছোটখাট রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। পেটের মধ্যে ছুঁচো নাচছিল। ভাতের রেস্তোরাঁগুলো নাকে কেমন একটা সুবাস ছড়িয়ে দিচ্ছিলো! সুমন ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকতে যাচ্ছিলো। আমিই ভাত খাবো বলে জোর করেছি।

মেন্যু দেখে মন ভরে গেল। নানারকমের ভর্তা, ভাজি, ছোটমাছ… যাকে বলে একেবারে বেহেশতী খাবারদাবার! আমি তো রীতিমত কবজি ডুবিয়ে খেলাম। সুমনও ভালোই খেলো তবে আমার চেয়ে কম। আমার খাওয়া দেখে মিটিমিটি হাসছিল সুমন। খাওয়া শেষে বললো, ‘এহ হে, তুমি তো দেখছি একেবারে ভেতো বাঙালী! মেয়েরা বিয়ের পরে মুটিয়ে যায় কেন জানো? এই অতিরিক্ত ভাত খাওয়ার অভ্যাসের কারণে!’

আমি বললাম, ‘আমার তো এখনো বিয়ে হয়নি। এখনো তো খুব ভাত খাচ্ছি। তাহলে এখন মুটাচ্ছি না কেন?’

‘মুটাচ্ছো না কারণ কিছু হরমোনজনিত ব্যাপার আছে এখানে। মেয়েদের শরীর থেকে বিভিন্ন বয়সে যে হরমোনগুলো নিঃসৃত হয়…’

আমি হাত দেখায়ে বললাম, ‘ব্যস ব্যস! দিনরাত শরীরতত্ত পড়ে পড়ে মাথা ব্যথা! এখন তো একটু নিষ্কৃতি দাও!’

সুমন ফিক করে হেসে বললো, ‘এই রে! মায়ের কাছে নানীবাড়ির গল্প শোনাতে এসেছি!’

দুজনেই হাসলাম। হঠাৎ দুম করে একটা কথা মনে হতেই বললাম, ‘আচ্ছা সুমন, তুমি কি তোমার মায়ের কাছে আমার বাবা-মায়ের গল্প করেছো?’

‘নাহ। আমি তো তোমার গল্পই এখনো করিনি!’

আমার কেমন যেন ভয় হলো। শিরশিরে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল বুঝি শরীর বেয়ে। আমার মা-বাবার এত সব কিচ্ছা কাহিনি শুনেও কি সুমনের মা আমাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারবেন?

আমরা মুখে যতই আধুনিকতার বাণী কপচাই না কেন, মনের দিক দিয়ে আধুনিক হওয়া এত সহজ নয়। আর কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করে না…এই কথাটাও যে সত্যি নয় সেটাকেও এতদিনে দিব্যি বুঝতে শিখে গিয়েছি আমি!

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত