Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya separation-last-part

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৮)

Reading Time: 5 minutes

এরপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুতই ঘটে গেল।

কিংবা হয়ত ধীরলয়েই ঘটেছিল! জীবন নামক আশ্চর্য মেশিনে চড়ে আমার কাছে মনে হচ্ছিলো… হয়ত খুব দ্রুতগতিতে বয়ে চলেছে সময়। বড়মামা আমাকে ধরাধরি করে রিক্সায় চড়িয়ে বাসায় নিয়ে আসার পরে কী কী ঘটেছিল, তার সবকিছু আমার এখন আর স্পষ্ট মনেও নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, মা-বাবা দুজনের সাথেই বড়মামা বেশ উচ্চস্বরে কথা বলছিল।

 

মা-বাবার গলার স্বর খুব বেশি শোনা না গেলেও বড়মামাকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছিলো। আমি আধো চেতন আধো অবচেতনে আচ্ছন্ন হয়ে নিজের ঘরে শুয়েছিলাম। কেন যেন মাথার মধ্যে সবকিছু জট পাকিয়ে বসেছিল। কেন যেন মনে হচ্ছিলো,হয়ত আমরা সবকিছু সামলে উঠবো। আবার সেই আগের মতো একটা জীবন হলেও হতে পারে আমাদের। মা-বাবা দুজনেরই দোষে দোষে দোষমুক্তি ঘটে যাবে। ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে মুক্তি পাবে একটি সংসার।

কিন্তু তা তো হলো না! মা-বাবা শেষপর্যন্ত সেপারেশনের মতো কঠোর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো? আমাদের কথা একটুও চিন্তা করলো না? যদি তারা দুজনই নিজের নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে আমরা কার কাছে যাবো? বাকি জীবনটা মা-বাবার সংস্পর্শ ছাড়াই বড় হয়ে উঠতে হবে আমাদের!

 

বড়মামার উত্তেজিত গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। বাবা মাঝে মধ্যে দু’একটা কথা বলছিল, তাও কেমন যেন ক্ষীণসুরে। আসলে বলার মতো মুখ তো ছিল না দুজনের কারোরই! বলবেই বা কী! বড়মামা জোরে জোরে বলছিল, ‘এটা কোনো মগের মুল্লুক না। আমি জানি তোমরা ওদের মা-বাবা। তাই তোমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমরা কখনোই নাক গলাতে আসিনি। কিন্তু তোমাদের জীবনের সাথে দুজন বাচ্চা ছেলেমেয়ের জীবন জড়িয়ে আছে। আর দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের সাথেও ওদের রক্তের সম্পর্ক আছে। ওদের কথা চিন্তা করলে আমাদেরও রাতে ঘুম আসে না।

আজ প্রায় দশ-পনেরোদিন ধরে মা চোখের পাতা এক করে না। খালি বলে যাচ্ছে, বাচ্চাদুটোকে আমার কাছে এনে দাও।… না না আমি জানি তোমাদের ছেলেমেয়ে। এক কথা এত বার বার বলার প্রয়োজন নেই।কিন্তু নিজের ছেলেমেয়ে বলেই তো তোমরা তাদের জীবন নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারো না!

…ঠিক আছে, নীরা আর নয়ন যা চাইবে তাই হবে। আমরা জোর খাটাতে যাবো কেন? ডাকো ওদেরকে। ওরা কী বলে শুনে দেখি।’

 

আমি বুঝতে পারছিলাম, বড়মামা আমাকে আর নয়নকে নিয়ে যেতে এসেছেন। এই বাসায় আমাদের দুই ভাইবোনের যে দুর্বিষহ দিন কাটছে, তাতে বড়মামার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার মতো মনের জোর আমার নেই। আর নয়ন নিজেই আমাকে অনেকদিন বলেছে, এখান থেকে চলে যাবে সে। তাছাড়া আমার ওপরে নয়ন যেরকম নির্ভর করে থাকে, আমাকে ছাড়া ও একদিনও থাকতে পারবে না। নিজেদের জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাবনিকাশ নিয়ে মা-বাবা এত বেশি চিন্তিত যে, তারা আমাদের অস্তিত্বটাকেই যেন আর স্বীকৃতি দিতে পারছিল না। জন্ম দিলেই যে বাবা- মা হয়ে ওঠা যায় না, তারা যেন এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

 

নয়ন স্কুলে গিয়েছিল। সামনে ওর পিএসসি পরীক্ষা। তাই এই বছরের শুরু থেকেই পড়ালেখার খুব চাপ।

আমাকে বড়মামার সামনে ডেকে আনা হলো। মা-বাবা দুজনের মুখই থমথমে। তবু বাবাকে কেন যেন একটু বিষণ্ন মনে হচ্ছিলো। মায়ের চেহারার মধ্যে একটা বিব্রত সঙ্কোচ। ঠিকমত যেন তাকাতে পারছিল না আমার দিকে। আমি মনে মনে হাসলাম। আজ এতদিন বাদে এই সঙ্কোচের দেখা মা কোথা থেকে পেল?

 

কেউ কিছু বলার আগে বড়মামা নিজেই জিজ্ঞেস করলো, ‘নীরা, আমি তোকে আর নয়নকে আমার সাথে নিয়ে যেতে এসেছি। তুই মানে তোরা কি আমার সাথে যেতে চাস? সেখানে তোর নানী আছে। আমরাও আছি। আমাদের বাসা ছোট। তেমন টাকা পয়সাও নেই আমাদের। হয়ত অনেক বেশি ভালোমন্দ খাওয়াতে পারবো না। তবু ভালোবাসার অভাব হবে না আমাদের কাছে। ভালোভাবে ভেবেচিন্তে বল। মা-বাবার কাছে যদি থাকতে চাস, তাহলে আমরা জোর খাটানোর কেউ নই। এখন তোরা কী চাস আমাকে জানা!’

জীবনে এমন একটা পরিস্থিতিতেও যে কখনো পড়তে হবে, ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি। আমি হতবিহবল চোখে মা-বাবার দিকে তাকালাম। এতদিন ধরে অনেক সময় মনে মনে চিন্তা করেছি, অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সুযোগ পেলেই আর পেছন ফিরে তাকাবো না। এই অসুস্থ দুর্বিষহ পরিবেশে শান্তিমত শ্বাসটুকুও নিতে পারি না আমি। এতদিনে সেই সুযোগ সত্যি সত্যিই এসেছে। অথচ এখন যেন পায়ে পায়ে বাধা এসে পথ আটকাতে চাইছে।

 

আমার মা-বাবার ক্ষয়িষ্ণু আত্মবিশ্বাসহীন মুখদুটোর দিকে চাইলাম। আমার শৈশব কৈশোর… আমার ফেলে আসা জীবন…একটু একটু করে অঙ্কুরিত না হতে পারা আমার যতসব স্বপ্নের অপমৃত্যু…সবকিছুর সূচনাই তো এদের হাত ধরেই হয়েছে। একটা একটা করে ঝড় উঠতো, একটু একটু করে মাটির দিকে ঝুঁকে আসতাম। তারপর আবার যখন একটুখানি স্নিগ্ধ বাতাসের ছোঁয়া লাগতো, প্রাণপনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইতাম। মনে মনে শপথ নিতাম, এখন থেকে শুধুই ওপরে উঠবো। কোনো ঝড় ঝাপ্টাকেই আর সুযোগ দিব না আমাকে পরাস্ত করার। সেই শপথকে বাস্তবে পরিণত করতে পারতাম না কক্ষনো। তবু বারে বারে শপথবাণী উচ্চারণ করতে ভুলতাম না।

হয়ত সেই শপথবাণীটুকুই আমাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি যোগাতো।

 

মা অসম্ভব রকম গম্ভীর হয়ে আছে। বড়মামাকে মা আগে থেকেই ভয় পেত, এটা আমি লক্ষ করেছি। আর এবারে তাকে যে অপরাধের জন্য ভাইয়ের সামনে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়াতে হচ্ছে, তাতে অন্তত কথা বলার মুখ থাকে না। কিন্তু বাবাকে দেখে আমি সত্যিই খুব অবাক হলাম। আজ এই কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন কয়েক বছর বয়স বেড়ে গেছে বাবার।

মামাবাড়ি থেকে আগে কেউ আমাদের বাসায় এলেবাবাকে কখনো তাদের পাত্তাই দিতে দেখতাম না।সেই দাপুটে বাবাও যেন কেমন একটু মিইয়ে গেছে। চোখের দৃষ্টিতে কেমন একটু আকুলতা। আমার দিকে তাকিয়ে বুঝি ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠলো বাবার। মামাকে বললো, ‘আমি একটু নীরার সাথে কথা বলতে চাই। আলাদাভাবে।’

 

মা এবং বড়মামা দুজনেই একবার মাথা উঁচিয়ে বাবাকে দেখলো। তারপর বড়মামা বললো, ‘মাহফুজ, তোমার মেয়ে নীরা। তুমি কথা বলবা এটা আমাকে বলার কি কিছু আছে? শুধু একটাই অনুরোধ, ওদের অমতে কিছু করো না। ওরা যা চায়…আজ সেই চাওয়াটাকে অন্তত সম্মান করো। তোমরা ওদের জন্ম দিলেও জীবনটা কিন্তু ওদেরই!

বাবা কিছু না বলে আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে এলো। তারপর খুব আস্তে আস্তে বললো, ‘তোরা যা চাস তাই হবে নীরা। আমি না করবো না। কখনো যদি মনে হয়…মানে যদি এই খারাপ বাবার কথা মনে হয়…’

বাবা আর কিছু বলতে পারলো না। অবাক হয়ে দেখলাম, বাবা অনেক কষ্টে কান্না চাপতে চাপতে অন্যঘরে চলে গেল।

 

নয়নকে কিছুক্ষণ পরে স্কুল থেকে নিয়ে এলাম। সবকিছু দেখেশুনে ও কেমন একটু যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। আমাকে আসতে আসতে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, ‘কী হয়েছে আপা? বড়মামা কেন এসেছে? আমাদের নিয়ে যেতে এসেছে? সত্যিই আমরা বড়মামা নানু ছোটোমামা এদের বাসায় গিয়ে থাকবো? মা- বাবা আমাদের যেতে দিবে?’

ওর প্রশ্নের ঝাঁক আমাকে সবেগে আক্রমণ করতে করতে ধেয়ে এলো। আমি শুধু বললাম, ‘বাসায় গিয়ে কথা বলি। এখন একটু চুপ করে বসে থাক!’


আরো পড়ুন: তোমারে বধিবে যে

নয়নকে নিয়ে আসার পর খুব বেশি আর টানাটানি চললো না কোনো পক্ষের মধ্যে। নয়ন বড়মামাকে দেখে কেমন যেন আড়ষ্ঠ হয়ে পড়লো। সেই কোন ছোট্টবেলায় মামারা আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে বেড়াতে আসতো! মাঝখানে দীর্ঘসময়ের বিরতিতে কেউই তেমন একটা আসেনি আমাদের বাসায়। তাই চোখের আড়ালে সরে গিয়ে মনের আড়ালে চলে গেছে সবাই। বড়মামা কয়েকবার ওকে কাছে টানতে চাইলো। কিন্তু নয়ন ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আর  মা-বাবার সাথে একটা অদেখা দূরত্ব তো আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল। ওর একমাত্র ভরসাস্থল আমাকেই তাই ছায়ার মতো অনুসরণ করতে লাগলো।

আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্যই নয়নকেও একবার জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘তুমি কার সাথে থাকতে চাও?’

নয়ন সর্বহারার চোখে আমার দিকে চাইলো। আমি তাকালাম মা-বাবার মুখের দিকে। মনের মধ্যে তখনো দ্বিধা আর দোদুল্যমানতা সমানে বাগড়া দিয়ে চলেছে। নয়ন কিছু বলার আগেই আমি মুখ খুললাম, ‘আমরা নানাবাড়িতে যাবো।’ সাথে সাথে নয়ন উত্তর দিলো, ‘আমি নীরাপুর সাথে যাবো!’

 

সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই আমরা বড়মামার সাথে নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। মা-বাবার বাকরুদ্ধ মুখটাকে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, বাবা কী যেন একটা বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। আর মাকে যতই দেখছিলাম, ততই অবাক হয়ে ভাবছিলাম… এই মানুষটাই কি আমাকে আর নয়নকে পেটে ধরেছিল?

মায়ের সাথে এর পরেও দেখা হয়েছিল আমার। কিন্তু বাবার সাথে সেই আমার শেষ দেখা। বাবা কেমন যেন এক রহস্যময় কারণে আমাদের সবার জীবন থেকেই হারিয়ে গিয়েছিল।

এই ঘটনার প্রায় বছর দশেক পরে বাবার পরিচিতা সেই ‘ছন্দা আন্টি’র কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলাম আমি। বাবার জীবনের অজানা রহস্যকে সেদিনই প্রথম জানতে পেরেছিলাম। এই রহস্যের সবটুকু আমার মা জানতো কী না, সেটা অবশ্য আমার শোনা হয়নি। তবে খুব অভিমান হয়েছিল বাবার ওপরে।এই চিঠির প্রসঙ্গে পরে একসময় আসবো।

সোহানুর আংকেলের সাথে মায়ের গাঁটছড়া বাঁধার খবরটা জেনেছিলাম নানাবাড়িতে বসেই।


আরো পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৭)

মা-বাবাকে ঘৃণা করি কী না, এই প্রশ্ন নিজের কাছে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। কখনো সাদামাটা কোনো উত্তর পাইনি। আমার মনও ভারী ছলচাতুরি মিশিয়ে খেয়ালখুশিমত কিছু একটা বলে দিয়েছে।

একটা ঘর ভাঙার আদ্যোপান্ত গল্পটা চোখের সামনে রচিত হতে দেখে মনে মনে অনেকবার শপথ করেছি… জীবনে একটা কাঁচকেও ভেঙে দু’টুকরো করবো না আমি।

সেই শপথকে সত্যি করতে পেরেছি কী না সে’কথাই তো জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছেন? সেই গল্পটাই এবারে বলতে যাচ্ছি আমি।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>